কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না।
মালো সাঁৎ করে একপাশে সরে গেল আর সঙ্গেসঙ্গে একটা কঠিন বস্তু সবেগে আঘাত করলে নোভাকের ঘাড়ে।
নোভাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না, হাঁটু পেতে বসে পড়ল হুমড়ি খেয়ে—
একজন কুইচা ম্যাচেটের উলটো দিক দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে।
ম্যাচেট এক ধরনের বড়ো ছোরা।
ছোরা না বলে এই অস্ত্রকে তরবারি বললেই ভালো হয়।
লোকটা ইচ্ছে করলে ম্যাচেটের এককোপে নোভাকের মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে পারত, কিন্তু খুন করার উদ্দেশ্য তার ছিল না– মালিককে সে বাধা দিতে চেয়েছিল।
দারুণ ক্রোধে নোভাকের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল।
সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল মালোর উপর।
আবার দুলে উঠল একটা ম্যাচেট, অস্ত্রের ভোতা দিকটা ঠকাস করে এসে লাগল নোভাকের মাথায়।
আঘাতের বেগ সামলাতে না পেরে সে একটা গাছের শিকড়ের উপর পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে হোঁচট খেয়ে তার দীর্ঘদেহ লম্বমান হল ভূমিশয্যায়। দারুণ যাতনায় তার সর্বাঙ্গ হয়ে এল অবশ, কেবল তীব্র ইচ্ছাশক্তির জোরে নোভাক তার চৈতন্যকে জাগ্রত করে রাখল।
নোভাকের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে মালো বললে, মালিক, আমরা দুঃখিত। তোমার উপর আমাদের একটুও রাগ নেই, তোমাকে আমরা মারতেও চাইনি। কিন্তু কি করব? তুমি আমাদের সবাইকে মৃত্যুর মুখে টেনে নিতে চাও তাই তোমাকে বাধা দিলুম। সামান্য কিছু খাদ্য আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আর সব খাবার, মালপত্র, সাজসরঞ্জাম সবই তোমার জন্য রেখে দিচ্ছি। মনে রেখো মালিক- কুইচারা চোর নয়।
নোভাক বললে, চুলোয় যাও।
মালিক! এখনো বলছি তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। জিভারোরা নরমুণ্ড-শিকারে বেরিয়েছে, এখানে থাকলে তুমি মারা পড়বে।
নোভাক বললে, চুলোয় যাও।
বেশ। যে লোক মরতে চায় তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। আমরা তোমার কাছে টাকা পয়সা কিছু চাই না কারণ তোমার সঙ্গে যে চুক্তি ছিল তা আমরা রাখতে পারিনি, কাজেই তোমার কাছে আমরা কোনো পারিশ্রমিক দাবি করতে পারি না। তোমার জন্য একটা ক্যানো আমরা রেখে যাচ্ছি।
নোভাক আবার বললে, চুলোয় যাও।
কুইচারা চলে গেল।
একটা ক্যানো নৌকো এবং প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ-বিষুধের বাক্স পড়ে রইল সেখানে। যেটুকু–নিলে নয় শুধু সেই টুকু খাবার দাবার নিয়ে কুইচারা জলপথে অন্তর্ধান করলে।
নোভাক মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে কুইচারা সত্যিই ভালো লোক। মার খেয়ে নোভাক একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি, ওদের চলে যাওয়াটাই তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। জিভারো সম্বন্ধে মালোর উক্তি সে আদৌ বিশ্বাস করেনি।
নোভাক চিন্তা করে দেখল যে এবার তাকে একাই এগিয়ে যেতে হবে। সেটা একেবারে অসম্ভব না হলেও সে বুঝল ব্যাপারটা অতিশয় কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। এক ঘণ্টার পথ চলতে এখন তার সময় লাগবে তিন ঘণ্টা। যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি- সে ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হোঁচট খেয়ে পড়ে নোভাকের পা মচকে গিয়েছিল কিন্তু পায়ের আঘাত যে কতখানি গুরুতর সেটা সে আগে বুঝতে পারেনি। উঠে দাঁড়াতেই পায়ের গোড়ালি থেকে উরু অবধি অসহ্য যন্ত্রণায় টনটন করে উঠল–
অগত্যা নোভাক আবার মাটির উপর বসে পড়ল ধপাস করে। বুট জুতো খুলে সে দেখল। পায়ের গোড়ালিটা খুব ফুলে উঠেছে আর চামড়ার তলা থেক ঠেলে উঠেছে অনেকগুলি নীল শিরা– পায়ের অবস্থা শোচনীয়!
কুয়াশা সরে যাচ্ছে। ঘন সন্নিবিষ্ট লতাগুল্ম ও সারিবদ্ধ গাছের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসছে প্রভাত-সূর্যের আলোকধারা।
নোভাক দেখল উঁচু জমিটা মোটেই সঁতসেঁতে নয়, বেশ শুকনো। একটু দূরেই কলকল শব্দে গান গাইতে গাইতে ছুটে চলেছে নদীর জলধারা। কুইচারা রেখে গেছে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, একটু দূরে বাক্সবন্দি অবস্থায় সেগুলো ছড়িয়ে আছে।
নোভাক নিশ্চিন্ত হল- তাবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম নেবার পক্ষে এটি হচ্ছে আদর্শ স্থান…
নোভাকের বঁড়শিতে ধরা পড়ল কয়েকটা নদীর মাছ।
ঘাসপাতা, শুকনো গাছের ডাল প্রভৃতির সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে নোভাক মাছ রান্না করলে। আহার-পর্ব শেষ করে নোভাক বসে রইল নদীর জলে গা ডুবিয়ে কারণ জঙ্গলের মধ্যে পোকার বড়ো উপদ্রব।
ঠান্ডা জলের স্পর্শে ঘাড় এবং পায়ের ব্যথা অনেক কমে গেল। রাত্রিবেলা নৈশভোজন শেষ করে সে তার বাঁশীটাকে বার করে ফুঁ দিলে। যাত্রাপথে নোভাক একটা গান শিখেছিল আর এই গানটাকেই নানারকম করে সে বাজাতে লাগল।
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডর পাশে বসে ভরা পেটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে এক সময় তার চোখ ঘুমে ভারি হয়ে উঠল। বাঁশি রেখে সে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার একবার মনে হল হতভাগা মালো যদি এখানে থাকত তাহলে বুঝতে পারত তার আশঙ্কা কতখানি অমূলক..
.
পরের দিন সকালে নোভাক বুঝল মালো মোটেই ভুল করেনি।
সকালবেলা। একটা গাছের গুঁড়িতে, ঠেস দিয়ে ঢুলছে নোভাক। পায়ের ব্যথা কমে গেলেই সে যাত্রা শুরু করবে এই হচ্ছে তার মনের ইচ্ছা।
হঠাৎ তার তন্দ্রাচ্ছন্ন শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল এক অদ্ভুত শব্দ-তরঙ্গ- ঠিক তার মাথার উপরে গাছের গুঁড়িতে আওয়াজ উঠল ফট। ফট ফট!
নোভাক সচমকে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করলে
পরক্ষণেই পায়ের যন্ত্রণা ভুলে সে মাটির উপর ঝাঁপ খেল এবং কখনো গড়িয়ে কখনো ছুটে উধ্বশ্বাসে এগিয়ে চলল তাঁবুর দিকে বন্দুকের উদ্দেশ্যে।