সেদিন বিকাল বেলা নোভাক যখন আবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আর একটা নতুন পথ ধরে নদীর দিকে এগিয়ে আসছে তখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটা ভাঙা এরোপ্লেন বা বিমান-পোত!
বিমানটি নদীর অপর তীরে অকেজো অবস্থায় পড়ে ছিল।
নদী পার হয়ে নোভাক বিমানপোতের পাশে এসে দেখলে যন্ত্রটির অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দারুণ আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে অর্থাৎ এককথায় সেটি হচ্ছে একটি বিমানপোতের ভগ্নাবশেষ।
ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নোভাক বুঝলে যে ভারি অস্ত্র দিয়ে বারংবার আঘাত করে যন্ত্রটিকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
নোভাক হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল– ব্যাপারটা কি?
বিমানটি কি হঠাৎ অচল হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছে?
বিমান চালকেরই বা পাত্তা নেই কেন?
বিমানের যান্ত্রিক-দেহটাকে কারা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে? জড় পদার্থের উপর আক্রমণকারীদের এমন আক্রোশের কারণই বা কি হতে পারে?….
বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা অশুভ চিন্তা তার মাথায় পাক দিয়ে উঠল, মনে মনে নিজেকেই বার বার অভিশাপ দিতে লাগল নোভাক নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ানো তার উচিত হয়নি। অকাদের আক্রমণের কথা তার হঠাৎ মনে পড়ল- জিভারো যোদ্ধাদের উপর ছুটে এসেছিল অকাদের তিরগুলি অরণ্যের আড়াল থেকে, আর সেই অকা-যোদ্ধাদের ডেরার মধ্যেই সে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়!
নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই সে মনে মনে গালাগালি দিলে।
কাঁধের বন্দুকটা হাতে নামিয়ে নোভাক ভাঙা বিমানের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলে এবং সেইখানে গুঁড়ি মেরে বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল চারদিকের ঝোঁপ-জঙ্গল।
একটা গাছের উপর ধাতু নির্মিত একটা ছোটো ঘর তার চোখে পড়ল। আর এক জায়গায় সে দেখলে অগ্নিকুণ্ডের ভস্মাবশেষ এছাড়া মানুষের বসবাসের কোনো চিহ্ন তার নজরে ধরা দিলে না।
কিন্তু…হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেই গাছটির নীচে যার উপর ধাতু নির্মিত ঘরটি অবস্থান করছে–
একটা ঢিপি!
হ্যাঁ, একটা টিপি– কিন্তু ঢিপিটাকে দেখলে একটা কবর বলেই সন্দেহ হয়।
নোভাক এগিয়ে এসে টিপিটাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে। তার সন্দেহ সত্য ঢিপিটা আর কিছু নয়, একটা খুব সাধারণ কবর। নোভাকের মনে নানারকম প্রশ্ন জমা হল– কবরটা কাদের? কয়জন মানুষের প্রাণহীন দেহ শুয়ে আছে এই কবরের মৃত্তিকা-শয্যায়? লোকগুলির সঙ্গে এই বিধ্বস্ত বিমানপোতটির কি কোনো সম্পর্ক আছে?
কবরের আশেপাশে মানুষের পায়ের চিহ্ন দেখা গেল না। ঝড়বৃষ্টি ও সূর্যরশ্মি সব চিহ্নকে করে দিয়েছে লুপ্ত। তবু বারবার নোভাকের মনে হল অকাদের কথা কিছুতেই সে অশুভ চিন্তাটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে না!
বিমানটির দুখানা ডানার মধ্যে মাত্র একখানা বর্তমান, সেই একটি মাত্র ডানার ছায়ায় বসে নোভাক চিন্তা করতে লাগল। তার ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, কিন্তু হাতের বন্দুক রইল তৈরি আর চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল প্রখর ও তীব্র…।
নোভাক ভাবছে, ভাবছে আর ভাবছে। সে যেন ছুটে চলেছে এক মরীচিৎকার পিছনে এই তৃষ্ণার্ত যাত্রার বুঝি আর শেষ নেই।
অরণ্যের এই অঞ্চলে হানা দিয়ে ফিরছে হিংস্র শ্বাপদ এবং হিংস্রতর মানুষ আর সেই মৃত্যুপুরীর মাঝখানে পদে পদে প্রাণ বিপন্ন করে ঘুরছে নোভাক– কিন্তু কেন?
একটা বন্য মানুষের তৈল-লিপ্ত দেহ এবং গলায় ঝোলানো একখানা বালিপাথরকে নিশানা করে সে এতদূর ছুটে এসেছে আশায় আশায়। আজ দুমাস হল সে তৈলখনির কোনো সন্ধানই পায়নি। ভবিষ্যতে যে পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কী?
আর সে তেলের সন্ধান পাওয়ার আগেই যদি রক্ত-পিপাসু অকা-যোদ্ধারা তার সন্ধান পায় তাহলে ঘাড়ের উপর মাথাটাকে সে কি বজায় রাখতে পারবে?
নোভাক ঠিক করলে আর নয় যথেষ্ট হয়েছে, এবার সে সভ্য জগতে ফিরে যাবে মরীচিকা-লুব্ধ পথিকের মতো সে আত্মহত্যা করতে রাজি নয়।
গুঁড়ি মেরে নীচু হয়ে সে বিমানপোতের তলা থেকে বেরিয়ে এল, তার পর সেই অবস্থায় নদীর ধারে ধারে ঘন অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় যথাসম্ভব আত্মগোপন করে সে ছুটে চলল। দারুণ গরমে তার দেহ অবশ হয়ে এল, চোখে নামল ঘুমের আবেশ- কিন্তু নোভাক বিশ্রাম নিতে একটুও থামল না।
এখানে ঘুমিয়ে পড়লে যে কোনো মুহূর্তে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলল নোভাক…
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!
নদীটা হঠাৎ যেখানে পাক খেয়ে ঘুরে গেছে ঠিক সেই জায়গায় নোভাক এসে পড়ল তাদেরই কাছে যাদের কবল থেকে পালাবার জন্যে সে এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে!
চারজন অকা নদীর ধারে তির-ধনুক দিয়ে মাছ শিকার করছিল। (রেড-ইন্ডিয়ানরা ধনুর্বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত- জলের মাছকে তারা অনায়াসেই তির দিয়ে বিঁধে ফেলতে পারে) অকাদের ক্যানোটা নদীর ধারে বাঁক ঘুরে ছুটে আসতেই নোভাকের সঙ্গে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। একজন অকা ধনুকের ছিলা টেনে নদীর জলে শর সন্ধান করছিল– মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্বিকার ভাবে সে মাছের উপর থেকে নোভাকের উপর নিশানা সরিয়ে নিলে পরক্ষণে শন শন শব্দে ছুটে এসে তিরটা নোভাকের মাথার কাছে একটা গাছের গুঁড়িতে বিধে গেল।
নোভাক পরবর্তী তিরের জন্য অপেক্ষা করলে না, সে চটপট জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দুটো তির তৎক্ষণাৎ তাকে অনুসরণ করলে কিন্তু পলায়মান শিকারের দেহস্পর্শ করতে পারলে না। একটা গাছের আড়াল থেকে নোভাক দেখলে চারজনের মধ্যে তিনজন অকা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে মেরে অরণ্যে প্রবেশ করলে আর একজন রইল ক্যানোর কাছে।