এই বালিপাথরের নীচেই থাকে তেলের ভাণ্ডার!
নোভাক নাসারন্ধ্র সঙ্কুচিত করলে; তার নাকে এসে ধাক্কা মেরেছে একটা পরিচিত তীব্র গন্ধ আর সেই গন্ধ আসছে অকা-যোদ্ধার মৃতদেহ থেকে–
নোভাক মৃতদেহের উপর ঝুঁকে পড়ল।
তেল! তেল! তেল! অকা-যোদ্ধার দেহ থেকে ভেসে আসছে তেলের গন্ধ!
খনিজ তৈলের মূল্যবান খনি আবিষ্কার করেছে এই বর্বর অকা, যুদ্ধে যাত্রা করার আগে সেই তেলে রং মিশিয়ে নকশা এঁকেছে নিজের সর্বাঙ্গে!
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল নোভাক।
অকারা যে অঞ্চলে বাস করে সেদিকে অনুসন্ধান চালালে হয়তো তেলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। একমাত্র পনি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলে লাভ নেই। কিন্তু জিভাবো দলপতি এখন আহতদের শুশ্রূষা এবং মৃতদেহগুলি সকার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত নোভাক বুঝল এই মুহূর্তে তাকে কৌতূহল সংবরণ করতেই হবে।
সে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তবু সকাল পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করলে। পরের দিন সকালে সে পনিকে সেই পাথরটা দেখিয়ে অকাদের আস্তানা কোথায় জানতে চাইল।
পনি বললে আক্রমণকারী অকা-যোদ্ধাদের গলায় এই ধরনের বালিপাথর ইতিপূর্বে সে বহুবার দেখছে কিন্তু ওই পাথর বা তেল তারা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে তা সে বলতে পারে না।
পনির ধারণা অকাদের বাসস্থানের কাছেই আছে সেই তৈলভাণ্ডার। নোভাক ঠিক করলে এবার সে একাই তেলের সন্ধানে যাত্রা করবে।
পনিকে তার উদ্দেশ্য জানাতেই সে নোভাককে বারণ করলে। তার বক্তব্য হচ্ছে অকারা এমনই হিংস্র, আর এখন তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। অতএব এখন অকাদের আস্তানায় গেলে বিদেশির মৃত্যু অবধারিত।
নোভাক স্থির হয়ে জিভারো দলপতির বক্তব্য শুনল কিন্তু নিজের সঙ্কল্প ত্যাগ করলে না। একদিন সকালে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে তৈল অভিযানে যাত্রা করলে। যাওয়ার আগে সে জিভারোদের কাছ থেকে আর একটা ধাক্কা খেল। গ্রাম ছেড়ে সে যখন চলে গেল কোনো জিভারো-যাদ্ধাই তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে এল না, এমনকী তার বউ ম্যাকানি পর্যন্ত একবার তার সামনে এসে দাঁড়াল না।
আগের দিন নোভাক ম্যাকানিকে বুঝিয়ে বলেছিল যে সে চলে যাচ্ছে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
ম্যাকানি নোভাকের ভাষা বুঝতে না পারলেও স্বামীর বক্তব্য ভালো ভাবেই বুঝেছিল।
এতদিনের মধ্যে নোভাক কখনও ম্যাকানির মুখে ইংরেজি ভাষা শোনেনি, যাওয়ার আগের দিন সে স্ত্রীর মুখে ইংরেজি শুনল- সেই প্রথম সেই শেষ!
শুধু দুটি কথা, নোভাক গোয়িং! (নোভাক যাচ্ছে)।
নোভাক আশা করেছিল যাওয়ার সময়ে নিশ্চয়ই ম্যাকানি তার সামনে এসে দাঁড়াবে কিন্তু তার আশা পূর্ণ হল না। সে গ্রাম ছেড়ে অরণ্যে প্রবেশ করলে,
ম্যাকানি একবারও তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে না!…
৪. নোভাকের অরণ্যযাত্রা
আবার শুরু হল নোভাকের অরণ্যযাত্রা।
অন্যান্য বারের মতো এবারও তার খুব কষ্ট হতে লাগল।
আসন্ন বর্ষার ইঙ্গিত বহন করে ছুটে আসে কালো মেঘে, যখন তখন প্রবল বর্ষণে নোভাকের সর্বাঙ্গ হয়ে যায় জলসিক্ত।
জুতোর চামড়ায় জল শুষে শুষে চামড়া হয়ে উঠল শক্ত, তার পায়ে পড়ল বড়ো বড়ো ফোঁসকা। ফোঁসকাগুলোতে ধুলো লেগে নোভাকের অবস্থা হয়ে উঠল অতিশয় শোচনীয়।
একদিন জলে ভিজে অসুস্থ নোভাক বিশ্রাম নিতে বাধ্য হল। নদীর জলে ভালো করে পা ধুয়ে তাতে ওষুধ লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। পা দুটোকে উঁচু করে সে পায়ের উপর গ্রহণ করলে সুর্যরশ্মির উত্তাপ এবং পর পর দুদিন একটুও হাঁটাহাঁটি করলে না। দুদিন বিশ্রাম নেবার পর তার পা ভালো হয়ে গেল। নতুন উদ্যমে শুরু হল তার অভিযান…
২৩ জানুয়ারি।
যাত্রা আরম্ভ করার এক সপ্তাহ পরে সে এসে দাঁড়াল একটা মস্ত নদীর ধারে- ম্যাপ দেখে সে বুঝল এটা কুরারে নদী।
কুরারে নদী চলে গেছে অকাদের আস্তানার ভিতর দিয়ে নোভাক মনে মনে খুব খুশি হয়ে উঠল, তার চেষ্টা অন্তত আংশিক ভাবে সফল হয়েছে।
সে এবার নতুন কায়দায় অনুসন্ধান-পর্ব শুরু করলে।
নদীর ধার দিয়ে বনের ভিতর পর্যন্ত আঁকাবাঁকা ভাবে সে প্রার্থিত বস্তুর সন্ধান করতে লাগল। তার সঙ্গে কম্পাস ছিল, কাজেই দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
দিন দুই পরে হঠাৎ সে ইন্ডিয়ানদের দেখতে পেল।
তেলের সন্ধানে টহল দিতে সে যখন অরণ্যের ভিতর দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে আসছে তখনই তার দৃষ্টি পথে ধরা দিলে একটি ক্যানো এবং দুজন আরোহী। দুটি লোকই বর্গার সাহায্যে নদী থেকে মাছ ধরছিল। নোভাক ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে পড়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলে, ক্ষিপ্রহস্তে বন্দুকে টোটা ভরে সে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য।
নৌকাটা নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল– সম্ভবত আরোহীদের দৃষ্টি ঘাস জঙ্গলের মধ্যে ভূমি শয্যায় লম্বমান নোভাককে আবিষ্কার করতে পারেনি।
ক্যানোর আরোহীদের দেহের গঠন ও চুল কাটার ধরন দেখে তাদের অকা বলেই মনে হল তবু অতদূর থেকে নোভাক খুব নিশ্চিত ভাবে রেড-ইন্ডিয়ান দুটির জাতি নির্ণয় করতে পারলে না।
সাবধানের মার নেই- অতএব নোভাক হাতের বন্দুক বাগিয়ে মাটির উপরে শুয়ে রইল। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করার পরেও যখন নদীর জলে কোনো ক্যানো দেখা গেল না তখন সে আবার তেলের সন্ধানে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলে।