অকাদের পুরুষ বাহিনীর পিছন পিছন ছুটে এল মেয়েরা!
নোভাক সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে অকা-নারী পুরুষদের চাইতে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও হিংস্র!
চারদিক তখন ধুলায় ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, এখানে সেখানে জিভারো কুটিরে অগ্নিসংযোগ করছে অকা-সৈন্য… জ্বলন্ত গৃহত্যাগ করে বাইরে এসে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে জিভারো মেয়েরা আর তাদের উপর হিংস্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শত্রুপক্ষের নারী বাহিনী… নোভাকের চোখের সামনেই তিন চারটি অকা রমণী একটি জিভারো মেয়েকে জ্বলন্ত কাষ্ঠের সাহায্যে প্রহার করতে লাগল…
হঠাৎ চারজন অকা-যোদ্ধার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল নোভাকের কুটিরের দিকে। তারা একসঙ্গে এগিয়ে এল ঘরটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণের জন্য নোভাক বুঝল জিভারোদের লড়াই তার লড়াই, যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার উপায় নেই!
উন্মুক্ত দ্বারপথে একজন বন্দুকধারীর আকস্মিক আবির্ভাবে অকারা চমকে গেল, চারজন যোদ্ধাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
নোভাক তাদের দিকে এগিয়ে এল, কাছে, কাছে আরও কাছে…
হঠাৎ মুখ বাড়িয়ে সে চিৎকার করে উঠল, চুলোয় যাও তোমরা! চারজন যোদ্ধা একসঙ্গে লক্ষত্যাগ করলে সচমকে!
অকারা দেখেছে তাদের সামনে দাঁড়ালেই যে কোনো শত্রু ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় এমন অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনা তারা কোনো আশা করেনি!
অকা চারজন কি করত বুলা যায় না, হয়তো তারা ধীরে ধীরে সরে পড়ত– কিন্তু অকস্মাৎ রঙ্গস্থলে আত্মপ্রকাশ করলে নোভাকের বউ ম্যাকানি।
নোভাকের পিছন থেকে হঠাৎ ভেসে এল অস্পষ্ট ক্রন্দন ধ্বনি। সচমকে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করতেই নোভাক দেখতে পেল ম্যাকানিকে। সে বুঝল শূন্যঘরে একা থাকার সাহস তার হয়নি, তাই সে স্বামীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্ত্রীর উপরে নোভাকের দারুণ রাগ হল! এতক্ষণ শুধু তাকে আত্মরক্ষার কথাই ভাবতে হচ্ছিল কিন্তু এখন ম্যাকানির ভারও তার উপরেই এসে পড়ল। যতই রাগ হোক, এই সঙ্গীন মুহূর্তে স্ত্রীর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা সম্ভব নয়! ম্যাকানিকে আড়াল করে সে ধীরে ধীরে কুটিরের দিকে পিছিয়ে চলল। তাদের দুজনকে ঘিরে এগিয়ে আসতে লাগল চারজন অকা-যোদ্ধা।
ম্যাচেট হাতে একজন বলিষ্ঠ অকা সামনে এগিয়ে এল।
তার ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর হাসির রেখা।
নোভাক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার একটু পিছনেই কুটিরের দেয়াল আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
ম্যাচেটধারীর মুখের হাসি মুছে গেল, বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে সে নোভাকের দিকে এগিয়ে এল আক্রমণের পূর্বাভাস..
গর্জে উঠল নোভাকের বন্দুক, লোকটি ছিটকে পড়ল মাটির উপর তার মস্তক ভেদ করে ছুটে গেছে বুলেট!
বাকি তিনজন শত্রুর চোখে চোখ রেখে পিছিয়ে গেল। একজন হাতের বর্শা তুলে নোভাকের দিকে ছুড়বার উপক্রম করলে। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে বন্দুক- লোকটি দুপাক ঘুরে সশব্দে মাটিতে বসে পড়ল, তার কাঁধে গুলি বিঁধেছে…
বন্দুকের গর্জনধ্বনিতেই শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ।
উভয় পক্ষই মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল- অকাদের মধ্যে অনেকেই বন্দুকের শব্দ কখনো শোনেনি।
পাখির কণ্ঠ অনুকরণ করে চেঁচিয়ে উঠল অকা-যোদ্ধার দল। দুএকজন অকা বন্দুকধারী নোভাক এবং গুলিবিদ্ধ আহত সঙ্গীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে, স্পষ্টই বোঝা গেল আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা তাদের নেই। আবার জাগল নকল পক্ষীকণ্ঠের কলধ্বনি– অকাদের পলায়ন সঙ্কেত!
অতিদ্রুত অথচ সুশৃঙ্খল ভাবে অকা যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল প্রধান দরজার দিকে। নোভাক তাদের অনুসরণ করলে…
হঠাৎ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তীব্র উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায় সে নিজেকে হারিয়ে ফেললে চিৎকার করে উঠল নোভাক, উচ্চৈঃস্বরে অভিশাপ বর্ষণ করতে লাগল অকাদের উদ্দেশে।
নিজের উপর আর নোভাকের কর্তৃত্ব রইল না, বিকল স্নায়ু এবার বিদ্রোহ ঘোষণা করলে অজ্ঞাতসারে তার ডান হাতের অবাধ্য আঙুল বারংবার বন্দুকের ঘোড়া টিপে ধরলে, যান্ত্রিক কণ্ঠের হুঙ্কারে অরণ্যের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে লক্ষ্যহীন অনির্দিষ্ট পথে ছুটল গুলির পর গুলি…
অকাদের মধ্যেও এবার ভীতির সঞ্চার হল। এতক্ষণ তারা সুশৃঙ্খল সৈনিকের মতো পিছিয়ে অসছিল, এবার সব নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে তারা ছড়িয়ে পড়ল- এলোমেলো ভাবে যে যেদিকে পারে ঊর্বশ্বাসে ছুটল।
পলায়নের সময়েও অকারা ক্ষতি করতে ছাড়ল না।
জিভারোদের যে কখানা ক্যানো নদীর ধারে ছিল সেগুলোকে অকা-যোদ্ধার দল লুঠ করে জলপথে পলায়ন করলে…
নোভাক ভেবেছিল এবার নিশ্চয়ই জিভাবোরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কিন্তু কোথায় কি? তারা সমস্ত ব্যাপারটাকে খুব সহজ ভাবেই গ্রহণ করলে। যোদ্ধারা দুএকবার নোভাকের দিকে দৃষ্টিপাত করে অন্য কাজকর্মে ব্যস্ত হয় পড়ল। মেয়েরা কোনো দিকে চাইল না, হতাহত পুরুষদের জন্যে করুণ কণ্ঠে তারা শোকপ্রকাশ করতে লাগল।
যে অকা-যোদ্ধাটি প্রথমেই বন্দুকের গুলি খেয়ে মারা পড়েছিল নোভাক তার মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ তার চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল অত্যন্ত প্রখর-মৃতের গলায় চামড়ার ফাঁসের সঙ্গে ওটা কি ঝুলছে? সে নীচু হয়ে নিহত অকার গলা থেকে সেই বস্তুটি খুলে নিয়ে দেখল জিনিসটা আর কিছু নয়– একটা পাথর।
পাথরটার উপর ভালো করে নজর বুলিয়ে সে চমকে উঠল– এটা সাধারণ পাথর নয়, বালিপাথর!