১৫ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সাল।
পনি সদলবলে বেরিয়ে গেছে মাছ ধরতে ও শিকার করতে। প্রায় ফাঁকা, অধিকাংশ লোক আছে পনির সঙ্গে। মাত্র দুজন জিভারো বসে বসে তিরের মুখে শান দিচ্ছে আর ব্লো-গান তৈরি করছে। নোভাক প্রস্তুত হচ্ছে তার দৈনন্দিন অভিযানের জন্য, অ্যানি নামে যে রেড-ইন্ডিয়ানটিকে নোভাক ডিনামাইট ফাটাতে শিক্ষা দিয়েছিল সেও তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে নোভাকের হুকুম পেলেই সে বেরিয়ে পড়বে।
নোভাক বললে, অ্যানি, এবার চলো, বেরিয়ে পড়ি!
অ্যানি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল তারপর হঠাৎ দরজার দুদিকে হাত দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অসহিষ্ণু কণ্ঠে নোভাক বললে, কী হল? থামলে কেন? চলো, চলো।
নোভাক এগিয়ে এসে অ্যানির পিঠে হাত দিয়ে আস্তে ধাক্কা দিলে, সঙ্গেসঙ্গে অ্যানির দেহ গড়িয়ে পড়ল মাটির উপর!
নোভাক এবং অপর দুজন জিভারো দেখলে অ্যানির বুকে বিঁধে আছে একটা তির!
জিভারো দুজন ঊধ্বশ্বাসে ছুটল পনির উদ্দেশে।
নোভাক চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি সঞ্চালন করলে কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কোনো মনুষ্য-মূর্তি তার নজরে পড়ল না।
একটু পরেই ছুটতে ছুটতে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলে পনি এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা। পনি চিৎকার করে বলছে, অকা! অকা!
কিন্তু তার গলার স্বর অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল। স্পষ্ট বোঝা গেল অনেকটা পথ দ্রুত ছুটে এসে সে হাঁপিয়ে পড়েছে।
গ্রামের ভিতরে ঢুকেই জিভারোরা বেড়ার গাত্ৰ-সংলগ্ন প্রধান ফটকটা বন্ধ করে দিলে। কাঠের গুঁড়ির তৈরি বেড়ার ফাঁক দিয়ে তারা চারদিক লক্ষ্য করতে লাগল- হাতে তাদের ব্লো-গান, বর্শা, ম্যাচেট প্রভৃতি অস্ত্র।
জিভারোদের ভাবভঙ্গি দেখে নোভাক বুঝতে পারল তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এই ভীত সঙ্কুচিত মানুষগুলিকে দেখলে মনেই হয় না যে মাত্র কয়েকদিন আগেও তারা গর্বিত পদক্ষেপে যুদ্ধ যাত্রা করেছিল।
নোভাক পনিকে ডেকে প্রশ্ন করলে, ব্যাপারটা কি?
পনি বললে, অকা! অকারা আমাদের আক্রমণ করেছে।
তা এত ভয় পাচ্ছ কেন? অকারা তো তোমাদের মতোই মানুষ।
–অকাদের সবাই ভয় করে।
জিভারোদের মতো ভীষণ যোদ্ধারা যাদের ভয়ে এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে তাদের স্বভাব-চরিত্র অনুমান করতে নোভাকের একটুও অসুবিধা হল না। তবে সে ঠিক করলে এবারের লড়াইতে সে নিরপেক্ষ থাকবে। সবসময় রেড-ইন্ডিয়ানদের ঘরোয়া ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা তার ছিল না।
অবশ্য আক্রান্ত হলে তাকে বাধ্য হয়ে বন্দুক ধরতে হবে- নোভাক তার কুটিরে প্রবেশ করলে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই সে দেখলে একটা কাঠের আসনের উপর বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তার বউ ম্যাকানি!…
ঠিক দুপুরবেলায় অকা-যোদ্ধারা জিভারোদের পল্লী আক্রমণ করলে। জঙ্গলের মধ্যে টুইটি টিট শব্দে পাখির শিস শোনা গেল হঠাৎ শুনলে মনে হবে সত্যিকার পাখির ডাক– কিন্তু আসলে সেটা আক্রমণোদ্যত অকাদের সঙ্কেত ধ্বনি।
কাঠের বেড়ার চারদিকে জঙ্গলের ভিতর থেকে ঘন ঘন ভেসে এল সেই নকল পক্ষী কণ্ঠের কলরব জিভারো-যোদ্ধারা ব্লো-গানে তির লাগিয়ে প্রস্তুত হল। একটু পরেই ছুটে এল একঝাক তির জঙ্গলের ভিতর থেকে। জিভায়রারা চুপ করে থাকল না, তাদের স্লোগান থেকে ঝাঁকে ঝকে তির নিক্ষিপ্ত হল জঙ্গলের দিকে শন শন শব্দে বাতাসে আলোড়ন তুলে উড়ে গেল এক ঝাঁক মৃত্যুদূত শত্রুর উদ্দেশে। অকাদের মধ্যে কেউ হতাহত হল কিনা বোঝা গেল না কারণ ঘন পত্র-পল্লবের আড়ালে কোথায় তারা গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছে তা অনুমান করা অসম্ভব। কিন্তু দুজন জিভারো যোদ্ধা শত্রুর তিরে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে লাগল। নোভাক আশ্চর্য হয়ে দেখলে যে তির যদিও সাংঘাতিক ভাবে তাদের দেহ ভেদ করেছে তবুও দুটি যোদ্ধার মধ্যে একজনও চিৎকার করছে না!
একজন যোদ্ধা শরীরের ভিতর থেকে তিরটা নিজের হাতেই টেনে বার করে ফেললে তিরের পশ্চাৎভাগে কাঁটা তার জড়ানো থাকায় লোকটির পাকস্থলী ক্ষতপথে বাইরে বেরিয়ে এল! তবুও আহত যোদ্ধা একটুও আর্তনাদ করলে না– আশ্চর্য সহ্য শক্তি!…
মেয়েরা তখন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। ঝাঁকে ঝাকে ছুটে আসছে তির– সেই অসংখ্য মৃত্যুদূতের উড়ন্ত দংশন উপেক্ষা করে জিভায়রা-যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না– কাঠের গুঁড়ির পিছন থেকে সরে এসে তারা যে যার ঘরের মধ্যে গা-ঢাকা দিলে।
অকারা এবার বনের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করলে। কাঠের গুঁড়ির বেড়া ডিঙিয়ে তারা ভিতরে ঢুকলে এবং বেড়ার বড়ো দরজাটা খুলে ফেললে; জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও অনেক অকা-যোদ্ধা ছুটে এসে খোলা দরজা দিয়ে জিভারো পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করলে।
ঘরের মধ্যে যেসব জিভারো যোদ্ধা লুকিয়েছিল এবার তারা বাইরে এসে শত্রুকে আক্রমণ করলে। শুরু হল হাতাহাতি লড়াই।
নোভাক তার কুটিরের ভিতরে সরে এল। তার পিছনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল তার জিভায়রা-বউ ম্যাকানি।
দরজার কাছে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে যথাসম্ভব আত্মগোপন করে নোভাক যোদ্ধাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে
জিভারো পল্লীর মাঝখানে তখন ভীষণ লড়াই শুরু হয়েছে।
নোভাকের চোখের সামনেই একটা বর্শা একজন জিভারো-যোদ্ধার মস্তক ভেদ করলে… একটি জিভারো হাতের ধারাল ম্যাচেট চার্লিয়ে একজন অকা-যোদ্ধাকে মাটির উপর পড়ে ফেললে আর সঙ্গেসঙ্গে বিজয়ীর পৃষ্ঠদেশে বিদ্ধ হল তিন-তিনটে শাণিত তির…