নোভাক পনির মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললে, আমি একবার প্রমাণ করেছি যে ফ্যাচুয়ের যাদুবিদ্যার চাইতে আমার ওষুধের শক্তি বেশি। এবার আমি প্রমাণ করে দেব যে মানুষ হিসাবে আমি তার চেয়ে অনেক বড়ো, পুরুষ হিসাবেও তার চেয়ে আমি অনেক শক্তিশালী পুরুষ। পনি, আমাকে চারখানা মাদুর আর একটা চাকভর্তি ভীমরুল আনিয়ে দাও।
পনির আদেশে কয়েকজন জিভারো মিনিট কুড়ি বাদে একটা ভীমরুলের চাক এবং চারখানা মাদুর হাতে নিয়ে ফিরে এল। চাকের প্রবেশ পথ কাঠের ছিপি দিয়ে বন্ধ করা আছে।
সমস্ত ব্যাপারটা ফ্যাচুয়ের পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই— পরীক্ষার সম্মুখীন না হলে জিভায়রারা তাদের ওঝাকে আর সম্মান করতে রাজি হবে না। ফ্যাচুয়ে অস্বস্তির সঙ্গে নোভাকের কার্যকলাপ লক্ষ করতে লাগল।
নোভাক কাঠের ছিপি খুলে ভীমরুলের চাকটাকে আগুনের উপর ধরলে। অগ্নিকুণ্ড থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুমরাশি প্রবেশ করলে চাকের মধ্যে, ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল ভীমরুলের গুঞ্জনধ্বনি– অবশেষে যখন নোভাক বুঝল ভীমরুগুলি চাকের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছে তখন সে দুখানা মাদুর বিছিয়ে চাকটাকে ওই মাদুর দুটির উপর ঝাঁকাতে লাগল। প্রায় অচেতন অবস্থায় ভীমরুলগুলি এসে পড়ল মাদুরের উপর। কয়েকটা তখনও খুব দুর্বল ভাবে নড়াচড়া করছিল বটে কিন্তু তাদের অবস্থা খুব ভালো নয়। নোভাক গুনে দেখল এক একটা মাদুরে রয়েছে প্রায় চব্বিশটা ভীমরুল। সে এবার অন্য দুটো মাদুর দিয়ে আগের মাদুর দুটিকে চাপা দিলে।
ভীমরুলগুলিকে দুজোড়া মাদুরের মাঝখানে বন্দি করে চাকটাকে নোভাক ছুঁড়ে ফেললে অগ্নিকুণ্ডর মধ্যে…।
কিছুক্ষণ পরেই ধোঁয়ার প্রভাব কেটে গেল। মুক্ত বায়ুর সংস্পর্শে চঞ্চল হয়ে উঠল মাদুরের বন্ধনে বন্দি ভীমরুলগুলি- ক্রুদ্ধ গুঞ্জনধ্বনি তুলে তারা জানিয়ে দিলে বর্তমান অবস্থাটা তারা মোটেই পছন্দ করছে না।
নোভাক তার গায়ের শার্ট খুলে ফেললে, তারপর পনির দিকে ফিরে বললে, আমরা দুজন এবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ব, তোমরা ভীমরুল সুদ্ধ এক-একখানা মাদুর আমার আর ফ্যাচুয়ের বুকের উপর চাপিয়ে দাও। আমি শক্তিশালী পুরুষ, ভীমরুলের কামড় সহ্য করতে পারব কিন্তু তোমাদের ওঝা ওই বুজরুক ফ্যাচুয়েটা হচ্ছে মেয়েমানুষের অধম ও এখনই উঠে দৌড় মারবে।
নোভাক এবং ফ্যাচুয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। জিভাবোরা খুব সাবধানে দুপাশ থেকে ধরাধরি করে মাদুর দুটাকে দুজনের বুকের উপর চাপিয়ে দিলে। মাদুরের বুনোটের ফাঁক দিয়ে ক্রুদ্ধ ভীমরুলগুলি তাদের ভীষণভাবে দংশন করতে শুরু করলে…
অসহ্য যাতনায় নোভাকের কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছিল একটা আর্তচিৎকার- দাঁতে দাঁত দিয়ে সে আর্তনাদ রোধ করলে। আর কতক্ষণ? তার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সমস্ত পৃথিবী তার চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসছে- দুহাতের আঙুল দিয়ে নোভাক প্রাণপণে মাটি আঁকড়ে ধরলে…
ফ্যাচুয়ে আর সহ্য করতে পারলে না। মাদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে উঠে পড়ল এবং দুহাতে বুকের মাংস চেপে ধরে আর্তনাদ করতে লাগল।
নোভাক এবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। অস্থির পদক্ষেপে সে প্রবেশ করলে নিজের কুটিরে, তারপর কীট-পতঙ্গের দংশনের প্রতিবোধ যে ওষুধ ছিল তার সঙ্গে ডিসটিলড ওয়াটার (পরিশ্রুত জল) মিশিয়ে স্বহস্তে বাহুতে ইনজেকশন করলে। এতক্ষণ পরে নোভাক তার রুদ্ধ আবেগকে মুক্ত করে দিলে বাঁশের খাঁটিয়ার উপর শুয়ে সে ফোঁপাতে লাগল…।
কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে সে উঠে পড়ল এবং সোজা প্রবেশ করলে ফ্যাচুয়ের কুটিরের মধ্যে। যাতনাকাতর ফ্যাচুয়েকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সে আবার বাইরে বেরিয়ে এল।
…এর পর আর কোনো দিন ফ্যাচুয়ে তার পিছনে লাগতে চেষ্টা করেনি..
নোভাক এবার নতুন উদ্যমে তৈলখনির সন্ধানে অভিযান শুরু করলে। জঙ্গলের মশা, জোঁক প্রভৃতির অত্যাচারে সে অস্থির হয়ে উঠল, বু ভাগ্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না।
একজন রেড ইন্ডিয়ানকে সে ডিনামাইটের ব্যবহার শিখিয়ে দিয়েছিল। ডিনামাইটের সাহায্যে অরণ্যের বুকে ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টি করে সেই লোকটি অবশ্য খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল কিন্তু নোভাকের মনে এতটুকুও আনন্দ ছিল না কোথাও সে তেলের সন্ধান পায়নি।
এত পরিশ্রম আর আশাভঙ্গের দুঃখে নোভাক হয়তো ভেঙে পড়ত, তবে অনেক কষ্টের মধ্যেও তার একটি আনন্দের কারণ ছিল- সে হচ্ছে ম্যাকানি, তার জিভাবেউ!
মেয়েটি স্প্যানিশ কিংবা ইংরেজি ভাষা বলতে পারে না। তাই ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্যে সে কোনোমতে নোভাককে তার মনের ভাব বোঝাবার চেষ্টা করত।
স্বামীর সঙ্গে বাক্যালাপ করার উপায় তার ছিল না। কিন্তু কথা বলতে না পারলেও নোভাকের সুখ-সুবিধার জন্য তার দৃষ্টি থাকত সর্বদাই জাগ্রত। ছায়ার মতো সে অনুসরণ করত স্বামীকে সারাদিনের ক্লান্তি ও পথশ্রমে আচ্ছন্ন হয়ে যখন নোভাক বিছানায় লুটিয়ে পড়ত তখন ম্যাকানি নিঃশব্দে এসে দাঁড়াত তার পাশে, নিপুণ হাতের সযত্ন সেবায় নোভাকের চোখে নেমে আসত সর্বসস্তাপহারিণী নিদ্রার আবেশ….
নোভাক কখনো ভাবতে পারেনি যে ম্যাকানির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হতে পারে…
বিচ্ছেদ এল। নোভাক আর ম্যাকানির মধ্যে হঠাৎ নেমে এল দুস্তর ব্যবধানের যবনিকা। আচম্বিতে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো হিংসা আর আক্রোশের বন্যা আঘাত হানলে জিভায়রা-পল্লীর বুকে…