শোধন প্রক্রিয়ার সমস্ত কার্যকলাপ নোভাককে দেখতে দেওয়া হল না, কারণ জিভারোদের কাছে এখনও সে বিজাতীয় মানুষ তাকে কখনই সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করা চলে না। প্রক্রিয়ার কিছু কিছু অংশ নোভাককে দেখতে দেওয়া হল বটে কিন্তু ওই বীভৎস কার্যকলাপের বর্ণনা দেবার ইচ্ছা আমার নেই আমার ধারণা ওই সব বর্ণনা পাঠক-পাঠিকাদের বিশেষ ভালো। লাগবে না।
যাইহোক, কাজ শেষ হয়ে গেলে পনি নোভাককে ডেকে পাঠাল। বিস্মিত নোভাক দেখলে সেই মুণ্ডগুলির মুখের আকৃতি একটুও পরিবর্তিত হয়নি বটে কিন্তু দৈর্ঘ্য প্রস্থে তাদের আকার হয়ে গেছে অতিশয় ক্ষুদ্র- সেই সঙ্কুচিত মুণ্ডগুলি এখন স্বাভাবিক নরমুণ্ডের তুলনায় অন্তত চারগুণ ছোটো! ত-সানটা!
সেই শুষ্ক সঙ্কুচিত নরমুণ্ডগুলিকে বর্শাফলকে বিদ্ধ করে জিভারোরা উৎসব শুরু করলে নৃত্য, গীত, পান ও আহার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলল সেই উন্মত্ত উৎসব…
আর এই উন্মত্ত উৎসবের ফাঁকে এতদিন পরে নোভাক যা চাইছিল তাই হল। পনি তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে। এখন থেকে সে গ্রামের ভিতর অথবা গ্রামের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে যেখানে-সেখানে বিনা-অনুমতিতে ঘুরে বেড়াতে পারবে-যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করার জন্যই এই পুরস্কার।
নোভাক ঠিক করলে এইবার চারপাশের জঙ্গলে সে তেলের খোঁজ করবে। যে-সব জায়গায় তেলের অস্তিত্ব আছে বলে সন্ধানকারীর সন্দেহ হয় সেই সব জায়গায় সে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অনুসন্ধান করে। বিস্ফোরণের ফলে ভূমির কম্পন এবং প্রতিধ্বনির শব্দ থেকেই অভিজ্ঞ তৈল-বিশারদরা তেলের সন্ধান বুঝতে পারে!
নোভাকের সঙ্গে যে সাজ-সরঞ্জাম ছিল তার মধ্যে কয়েকটা ডিনামাইটের স্টিক সে নিয়ে আসতে ভোলেনি। এইবার সব কিছু গুছিয়ে তার অভিযান শুরু করার আগে সে পনিকে বললে, ম্যাকানিকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। সে আমায় সাহায্য করবে।
পনি একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে নোভাকের দিকে, তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ঘৎকার জাতীয় অসন্তোষের ধ্বনি- কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বাধা দিলে না।
ম্যাকানি প্রথমে নোভাকের প্রস্তুতি দেখে ভয় পেয়েছিল, তার ধারণা ছিল তার স্বামী বুঝি তাকে ফেলে প্রস্থান করতে চায়। অবশেষে যখন সে বুঝল যে নোভাক তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তখন তার মুখের ভাব হয়ে উঠল অতিশয় হাসি-খুশি!
মালপত্র নিয়ে ম্যাকানির কাঁধে একটা প্যাকেট ঝুলিয়ে নোভাক যাত্রার উদ্যোগ করছে এমন সময়ে বিপত্তি- রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ ভুতুড়ে ওঝা ফ্যাচুয়ের আবির্ভাব।
ফ্যাচুয়ে পনিকে উদ্দেশ করে কি বললে নোভাক তা বুঝল না কিন্তু আচম্বিতে একদল অস্ত্রধারী যোদ্ধা পনির আদেশে নোভাকের পথরোধ করে দাঁড়াল।
নোভাক রুষ্টকণ্ঠে পনিকে প্রশ্ন করলে, এর মানে কী?
পনি বললে, যাওয়া হবে না!
–যাওয়া হবে না! যাওয়া হবে না মানে? তুমি কথা দিয়েছিলে যে আমাকে কোথাও যেতে বাধা দেওয়া হবে না, এখন তুমি কথার খেলাপ করতে চাও? তোমার কথার কোনো দাম নেই? বাঁদরের কিচির-মিচির শব্দের মতো তোমার কথাও দেখছি নিতান্ত মূল্যহীন!
পনির মুখ লাল হয়ে উঠল, সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওঝা ফ্যাচুয়ের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
ফ্যাচুয়ে দন্তবিকাশ করে হাসল, তারপর তার গলায় ঝোলানো চামড়ার থলি থেকে একটা কোনো বস্তু বার করলে ইনজেকশন সিরিঞ্জ।
নোভাকের মনে পড়ল প্রথম যেদিন সে পটোকে ইনজেকশন দেয় তখন খালি সিরিঞ্জিটাকে সে ওঝার হাতেই গুঁজে দিয়েছিল– এটা সেই সিরিঞ্জ!
ফ্যাচুয়ে সিরিঞ্জটাকে মট করে ভেঙে ফেলল তারপর পনির দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে হাসতে লাগল যেন সে একটা মস্ত কাজ করে ফেলেছে।
রাগে নোভাকের সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল কিন্তু সে তার মনোভাব প্রকাশ করলে না, শান্তভাবে পনিকে প্রশ্ন করলে, এর অর্থ কি?
পনি বললে, ওঝা বলছে তুমি আমার মেয়েকে জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যাবে কিন্তু আর ফিরবে না। তুমি ওর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো খেয়ে ফেলবে আর এমন সব গুণ-তুক করবে যে গ্রামের লোকের ভীষণ অকল্যাণ হবে।
কী! নেভাক চিৎকার করে উঠল, আমি আমার বউকে হত্যা করে তার মাংস খাব? শয়তান! বর!… পনি, তোমার ছেলেকে আমি বাঁচিয়েছি সেকথা কী এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
ফ্যাচুয়ে বলছে আমার ছেলেকে সে বাঁচিয়েছে, তুমি নও। এইমাত্র তোমার ওষুধটা সে ভেঙে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ফ্যাচুয়ে ঠিকই বলছে। তোমার ওষুধের মোটেই জোর নেই তাই সে তোমার ওষুধে ভালো হয়নি, তাকে বাঁচিয়েছে ফ্যাচুয়ে।
–হুঁ। ফ্যাচুয়ে আর কি বলছে?
-সে বলছে তুমি অত্যন্ত খারাপ লোক। তোমার মাথা দিয়ে ত-সানটা করতে পারলে গ্রামের লোকের কল্যাণ হবে।
নোভাক বন্দুকটাকে আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাইল। ম্যাকানি তার পাশ থেকে তখন সরে গেছে- স্বামী তোক আর যাইহোক নোভাক হচ্ছে বিদেশি, কলহের সময় জিভারো রমণীর স্থান স্বজাতির পাশে, বিধর্মীর পাশে নয়!
হু নোভাক মনে মনে বললে, আমার মাথা ত-সানটা করার আগে অন্তত কয়েকটা মাথা আমি ফুটো করে দেব। মরবার আগে কয়েকজনকে আমি মেরে মরব…।
হঠাৎ নোভাকের রাগ ঠান্ডা হয়ে এল। সে বুঝল জিভারোদের সঙ্গে তার ঝগড়ার কোনো কারণ নেই, ওই শয়তান ফ্যাচুয়েটাকে জব্দ করতে পারলেই তার পথ হবে নিষ্কণ্টক।