পনি অসন্তুষ্ট হল, কিন্তু নোভাককে যেতে বারণ করলে না।
যোদ্ধাদের সঙ্গে নৌকায় চড়ে নোভাক যুদ্ধ যাত্রা করলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিভারোদের ক্যানো নৌকাগুলি শত্রুপক্ষের গ্রামের কাছে নদীর তীরে ভিড়ল। শক্ত কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে গ্রামের কুটিরগুলিকে। সেই বেড়ার আড়ালে আত্মগোপন করে শত্রুরা ওত পেতে আছে জিভারোদের অপেক্ষায়। কাঠের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শত্রুর অস্ত্র সজ্জা ব্লো-গান, তীরধনুক, বর্শা, ম্যাচেট, মুগুর প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রগুলি নোভাকের চোখে পড়ল। নানিও যে বন্দুকধারীর উল্লেখ করেছিল তাকেও নোভাক দেখতে পেল। সেটা বন্দুক নয় রাইফেল- কিন্তু তেলের অভাবে অস্ত্রটার অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। নোভাক বুঝল রাইফেলের অধিকারী অস্ত্রটাতে কখনো তেল দেয় না, খুব সম্ভব তেল দেওয়ার পদ্ধিত সম্বন্ধে তার কোনো জ্ঞান নেই– ফলে বহুদিন ধরে মরচে পড়ে রাইফেলটার অবস্থা এমন হয়েছে যে গুলি চালালে অস্ত্রটা হয়তো অস্ত্রধারীর হাতেই ফেটে যেতে পারে।
নৌকাগুলি নদীতীরে থেমে যেতেই পনি ডাঙায় নামল। তার সঙ্গে নামল মেয়েরা আর কয়েকটি পুরুষ যোদ্ধা।
শত্রুরা বেড়ার গাত্র-সংলগ্ন দরজাটা খুলে দিলে। মেয়েদের দেখে তাদের ধারণা হয়েছিল যে পনি এসেছে বন্ধুভাবে মিটমাট করতে, খারাপ উদ্দেশ্য তার নেই। ঠিক এই ব্যবহারই পনি আশা করেছিল, ভিতরে ঢুকেই সে চেঁচিয়ে উঠল, নান কি সুশায়ে! (এই নাও আমার বর্শা!)
পরক্ষণেই তার হাতের তীক্ষ্ণ বল্লম একজন শত্রুর কণ্ঠভেদ করলে।
ব্যস বারুদের গাদায় কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিলে।
অরণ্যের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল বহু কণ্ঠের হিংস্র গর্জন, শনশন শব্দে ছুটে এল অসংখ্য তির জিভারোদের দিকে!
নোভাক তাড়াতাড়ি ম্যাকানিকে টেনে নিয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ল- তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাক উড়ন্ত মৃত্যুদূত। পনির তিরন্দাজরা এবার তির ছুঁড়ল।
উভয় পক্ষেই কয়েকজন হতাহত হয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হয়ে পড়ল।
নোভাক দেখলে একজন জিভারো-যোদ্ধার গলার মধ্য দিয়ে ঢুকে একটা তির পিছনের কাঠের গুঁড়িতে বিধে গেল। লোকটি যথাসাধ্য টানাটানি করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারলে না– সেই অবস্থায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুখৃস্টের মতো প্রাণ বিসর্জন দিলে।
এবার শুরু হল হাতাহাতি লড়াই। দুজন শত্রু পানিকে ঘিরে ফেলল। নোভাক এবার স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করলে জিভারো দলপতির বীরত্ব পনি একাই বর্শা চার্লিয়ে দুজন শত্রুকে হত্যা করলে।
নোভাকের সামনে, পিছনে, এপাশে, ওপাশে চলছে হাতাহাতি লড়াই। ঝকঝক করে উঠছে শাণিত ম্যাচেট, ধারাল বর্শার আঘাতে ফুটো হয়ে যাচ্ছে যোদ্ধাদের দেহ, মুগুরের আঘাতে চুরমার হয়ে যাচ্ছে মানুষের মাথা এক বীভৎস রক্তাক্ত কাণ্ড!
হঠাৎ একটা লোক মুগুর হাতে এগিয়ে এসে ম্যাকানির হাত ধরে টানলে।
এক ঝটকায় নোভাক ম্যাকানিকে ছাড়িয়ে নিলে। শত্রু এবার মুগুর তুলল নোভাকের মঞ্চ লক্ষ্য করে–
নোভাক গুলি ছুড়ল না, বন্দুকের নল দিয়ে সজোরে গুঁতো মারল তার মুখে! দাঁত ভেঙে বন্দুকের নলটা প্রায় তিন ইঞ্চি ভিতরে ঢুকে গেল– লোকটা মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল, তার মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্তের ধারা এবং অনেকগুলো ভাঙা দাঁতের টুকরো।
ইতিমধ্যে যে লোকটার হাতে রাইফেল ছিল সে নোভাককে লক্ষ্য করে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে।
নোভাক তার বন্দুকের ট্রিগার টিপল।
একই সঙ্গে গর্জে উঠল দুটি আগ্নেয়াস্ত্র।
নোভাকের গুলি ফসকে গেল, কিন্তু রাইফেলধারীর নিজের অস্ত্রই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে। মরচে পড়া রাইফেল সশব্দে ফেটে পড়ল- হ্যাঁমার, স্প্রিং প্রভৃতি যান্ত্রিক অংশগুলি রাইফেলধারীর মুখে চোখে যেখানে-সেখানে বিঁধে গেল। লোকটি আর্তনাদ করে রাইফেল ফেলে দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। খুব সম্ভব সে একেবারেই অন্ধ হয়ে গেছে!
অল্প সময়ের মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে গেল। বিজয়ী জিভারোরা ধরাশায়ী শত্রু যোদ্ধাদের দেহ থেকে মাথাগুলোকে কচাকচ কেটে ফেললে; তারপর সেই রক্তাক্ত নরমুণ্ড গুলিকে হাতে নিয়ে বিজয়গর্বে ক্যানোতে উঠে বসল। পনি চিৎকার করে হুকুম দিলে, নৌকা চালাও।
জিভারো যোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ হুকুম তামিল করলে। কারণ, যে কোনো সময়ে বিজেতারা আবার দল বল নিয়ে বিজয়ীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে- অতএব চটপট সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
ছিন্ন নরমুণ্ডগুলি দেখে প্রথমে নোভাকের মনে জিভারোদের সম্বন্ধে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিল কিন্তু একটু পরেই তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল বিগত মহাযুদ্ধের ছবি।
সেই যুদ্ধে নোভাকও সৈন্য হয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছিল। সভ্য মানুষ যে কত অসভ্য হতে পারে সে কথা নোভাক জানে- মহাযুদ্ধের সে একজন ভুক্তভোগী সৈনিক।
যুদ্ধের সময়ে সুসভ্য ইউরোপের মানুষ যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই, নরমুণ্ড শিকারি জিভারো-যোদ্ধা মানুষের ইতিহাসকে এতখানি কলঙ্কিত করতে পারেনি।
নোভাক বুঝল জিভারোদের ঘৃণা করা তার উচিত নয়…।
শুধু জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে জিভাষোরা শত্রুর মুণ্ডচ্ছেদ করেনি। একটু পরেই নোভাকের বোধগম্য হল যে ছিন্ন মুণ্ডগুলো সঙ্গে আনার বিশেষ কারণ আছে। গ্রামে এসেই একটা গাছের বড়ো বড়ো পাতা দিয়ে মুণ্ডগুলোকে ঢেকে দেওয়া হল। পনি নোভাককে বুঝিয়ে দিলে মুগুগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়া দ্বারা শোধন করে নেওয়া হবে। ওই ভাবে শোধন করে নিলে মুণ্ডগুলো আকারে ছোটো হয়ে ত-সানটায় পরিণত হবে এবং যে সব মানুষ মস্তক বিহীন অবস্থায় প্রেতদেহ ধারণ করে প্রতিহিংসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের প্রেতাত্মাগুলিও প্রক্রিয়ার ফলে শুন্যে লীন হয়ে যাবে। যতক্ষণ ওই প্রেতাত্মা বেঁচে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত জিভাবোরা নিরাপদ নয়। একমাত্র সানটা হলে অর্থাৎ মুণ্ডগুলোকে প্রক্রিয়া অনুযায়ী সঙ্কুচিত করতে পারলেই হত্যাকারীরা প্রেতের আক্রোশ থেকে মুক্তিলাভ করবে অদ্ভুত কুসংস্কার!