জিভারোরা নোভাককে খুব আদর-যত্ন করলে একথা বললে ভুল হবে, তবে পনি তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিলে। নোভাকের বন্দুক তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল এবং গ্রামের ভিতর যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও তাকে কেউ বাধা দিত না, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে যাওয়ার স্বাধীনতা তার ছিল না। অর্থাৎ জিভাবোরা তার সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করলেও তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে তারা রাজি হয়নি।
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন পনির কুটিরে নোভাকের তলব পড়ল।
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই নোভাককে ডেকে পনি বললে, তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিলুম! তুমি ম্যাকানিকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও- আজ থেকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী।
কথাটা বলেই পনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
নোভাক দেখলে ঘরের ভিতর সে আর পনির মেয়ে ম্যাকানি ছাড়া আর কেউ নেই। খানিকক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে সে মেয়েটির হাত ধরে পনির ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলে।
পনির ঘরে প্রথম যে সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে নোভাক মুগ্ধ হয়েছিল এই হচ্ছে সেই মেয়ে ম্যাকানি! নোভাকের জিভারো বউ।
ব্যস, শুরু হল তাদের বিবাহিত জীবন।
জিভারোদের জীবনযাত্রায় কোনো জটিলতা নেই। পিতার সম্মতি পেলেই যে কোনো লোক কন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারে। এজন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের দরকার হয় না।
নতুন বউ পেয়ে নোভাক খুবই খুশি হল। মেয়েটি দেখতেও যেমন সুন্দর, তার স্বভাব-চরিত্র তেমনই নম্ব। একটা বিষয়ে নোভাক বড়ো অসুবিধা বোধ করতে লাগল- ম্যাকানি স্প্যানিশ কিংবা ইংরাজি জানে না, শুধুমাত্র আকার ইঙ্গিতেই পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করতে হত-~ কথা বলার কোনো উপায় ছিল না।
কিছুদিন পরে এই অসুবিধাও নোভাক আর অনুভব করলে না। ম্যাকানি বড়ো মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে এবং বুদ্ধিমতীও বটে। নোভাকের ইশারা সে সহজেই বুঝতে পারত আর খুব বেশি কথা কইবার জন্যেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না, নোভাকের সঙ্গে থাকতে পারলেই সে খুশি থাকত। ম্যাকানিকে নোভাকের খুবই পছন্দ হল- এমন অনুগত স্ত্রী সুসভ্য ইউরোপীয় বা মার্কিনদের মধ্যেও বড়ো একটা দেখা যায় না।
একঘেয়ে ভাবে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। নোভাকের মনে আর বিপদের আশঙ্কা ছিল না, তবে সে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল- বুনো মানুষদের মধ্যে সংসার করে দিন কাটাতে সে আসেনি, সে এখানে এসেছে অন্য উদ্দেশ্যে। নোভাক বুঝল তেলের সন্ধান এখন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে গেলে জিভারোদের মনে নানা রকম সন্দেহ দেখা দিতে পারে, এমনকী হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতাটুকুও হয়তো আবার কেড়ে নেওয়া হবে। মনে মনে অস্থির হয়ে পড়লেও সে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল সুযোগের প্রতীক্ষায়…
জিভারোদের শান্ত জীবনযাত্রায় একদিন ঝড় উঠল।
যে লোকটিকে নিয়ে গোলমালের সুত্রপাত তার নাম নানিও।
এই নানিও একদিন ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হল পনির কাছে তার মুখ ও শরীর ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত!
নানিও যা বললে তার মর্ম হচ্ছে এই–
নদীর ধারে সে মাছ রান্না করছিল। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হল একদল রেড-ইন্ডিয়ান। এই মানুষগুলিকে নানিও জানে তারা জিভারোদের গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে বাস করে। নদীর স্রোত যেদিকে চলে গেছে, এই নবাগত মানুষগুলোর গ্রামও সেইদিকে।
লোকগুলো এসেই হাতের লাঠি দিয়ে নানিওকে দারুণ প্রহার করলে! আহত নানিও যখন মাটিতে পড়ে ছটফট করছে, তখন লোকগুলি আবার অরণ্যের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। নানিরও ধারণা আক্রমণকারীরা দূরে কোথাও ক্যানো লুকিয়ে রেখেছিল, কার্য শেষ করে তারা আবার ক্যানো চার্লিয়ে জলপথে অদৃশ্য হয়েছে। খুব সম্ভব তারা এদিকে এসেছিল শিকার করতে, হঠাৎ নানিওকে একা পেয়ে তার উপর খানিকটা অত্যাচার করে গেল- জিভারোদের সঙ্গে এই উপজাতির মোটেই সদ্ভাব ছিল না, তাই বেচারা নানিওর কপালে এই লাঞ্ছনা।
নানিও আরও বললে যে লোকগুলির সঙ্গে বর্শা, ব্লো-গান প্রভৃতি অস্ত্র তো ছিলই, তার উপর তাদের মধ্যে একজন বন্দুকধারী। নানিওর সৌভাগ্যবশত তাকে কেউ অস্ত্রাঘাত করেনি, যদিও বন্দুকধারী লোকটি মাঝে মাঝে তাকে বন্দুক তুলে ভয় দেখিয়েছে।
নানিওর কাহানি শুনে জিভারোরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল- তারা এখনই যুদ্ধযাত্রা করতে চায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক সশস্ত্র জিভারো জনতা ক্যানো ভাসাবার জন্য প্রস্তুত হল। পুরুষ-যোদ্ধাদের সঙ্গে সেজেগুজে তৈরি হল জিভারো-মেয়েরা।
পনির বক্তব্য হচ্ছে মেয়েদের দেখলে শত্রুপক্ষ হয়ত অসাবধান হতে পারে। তাদের অসাবধানতার সুযোগে যদি আক্রমণ চালানো যায়, তাহলে নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়ি জয়লাভ করা যাবে।
সাধারণত মারাত্মক যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে মেয়েরা অংশগ্রহণ করে না কিন্তু দলপতির ইচ্ছাতেই মেয়েরা এই অভিযানে যোগ দিলে।
সশস্ত্র যোদ্ধারা এবং মেয়েরা যখন নৌকার দিকে ছুটে চলল তখন পনি নোভাকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ক্রুদ্ধ উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, দাও! তোমার বন্দুকটা আমায় দাও! ওদের সঙ্গে একটা বন্দুক আছে, আমাদেরও একটা থাকা দরকার। তাড়াতাড়ি।
নোভাক বললে, না, আমি বন্দুক দেব না। তবে আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে রাজি আছি! আমার বন্দুক আমার সঙ্গেই থাকবে, যদি দরকার হয় আমি নিজেই গুলি ছুড়ব- অন্য লোকের হাতে আমি বন্দুক দেব না।