হায় হায়, নোভাক ভাবলে, এই তুচ্ছ কারণে এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হল!
কিন্তু জিভাবোদের নিবৃত্ত করবে কে? এই ওঝারা হচ্ছে রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সর্বশক্তিমান তাদের কথা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে একেবারে অকাট্য, অভ্রান্ত।
তারপর পনি যা বললে তা শুনে নোভাকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। পনি বললে তাদের ওঝা বলেছে নোভাকই হচ্ছে সেই শয়তান। অতএব তার মুণ্ডটাকে স্কন্ধচ্যুত করতে পারলেই পটো করবে আরোগ্যলাভ।
নোভাকের মাথা গরম হয়ে উঠল। নির্বোধ, মুখ, বলে সে সবাইকে গালাগালি দিতে লাগল।
হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকল একজন জিভারো, তার কাঁধে ও হাতে রয়েছে নোভাকের চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং আরও দুটো মস্ত মস্ত বাক্স।
পনি বললে, এই হচ্ছে তোমার ওষুধপত্র। আমি দেখেছি এইসব ওষুধ দিয়ে খ্রিস্টান পাদরিরা অসুস্থ লোকদের সারিয়ে দেয়। তুমি যদি খারাপ লোক না হও, তাহলে এক্ষুনি আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও।
একটু থেমে সে আবার বললে, তুমি বলছো তুমি খারাপ লোক নও। বেশ, তাহলে আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না, আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়ে বেঁচে ওঠে তুমিও বাঁচবে! সে যদি মরে, তুমিও মরবে।
কি মুশকিল! নোভাক প্রতিবাদ করলে, ওর অসুখটা কি তাই তো আমি জানি না!
ওকে বাঁচাও!
ওষুধ হয়তো কাজ না করতে পারে।
পনি তার পাশে যে ব্লো-গানটা ছিল সেটাকে তুলে নিলে, তারপর অঙ্গুলি নির্দেশ করলে খুঁটিতে দোদুল্যমান নরমুণ্ডগুলির দিকে ইঙ্গিত অতি স্পষ্ট।
নিরুপায় নোভাক শেষ পর্যন্ত বাক্স থেকে পেনিসিলিন ও ইনজেকশনের সরঞ্জাম বার করলে। যা থাকে বরাতে, একবার পেনিসিলিন দিয়ে দেখা যাক–কাপড় সরিয়ে নোভাক ছেলেটির নিতম্বে অ্যালকোহল লাগিয়ে দিলে। ঘরের মধ্যে সমবেত জিভারো পুরুষ ও নারী সকলেই খুব আগ্রহের সঙ্গে নোভাকের কার্যকলাপ দেখতে লাগল।
হঠাৎ ঘটনাস্থলে প্রবেশ করলে একটি জিভারো।
লোকটি নেহাৎ সাধারণ মানুষ নয়– কুটিরের দরজায় দণ্ডায়মান দুই প্রহরীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সে এসে দাঁড়াল দলপতি পনির সম্মুখে!
কয়েকজন ফিসফিস করে বলে উঠল, উইশিন! উইশিন!
নোভাক বুঝল এই হচ্ছে জিভারোদের ওঝা!
লোকটার সর্বাঙ্গে ও মুখে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা আঁকা হয়েছে, কালো চুলে বাহার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি লাল আর কালো রঙের পাখির পালক, হাতে রয়েছে একটা কাষ্ঠদণ্ড এবং সেই দণ্ডের অঙ্গসজ্জা করা হয়েছে শুষ্ক অস্থিচূর্ণ, পাখির পালক ও লাল-নীল কাপড়ের সাহায্যে।
এই অপরূপ দণ্ডটি হচ্ছে তার যাদুদণ্ড।
লোকটির নাম ফ্যাচুয়ে।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। হঠাৎ লোকটি উগ্রকণ্ঠে চিৎকার করে পনির উদ্দেশ্যে কিছু বললে। প্রত্যুত্তরে পনিও চিৎকার করে উঠল। তারপর উভয়পক্ষে উচ্চৈঃস্বরে কথা কাটাকাটি চলল। নোভাক তাদের কথা খুব ভালো বুঝতে পারলে না, তবে এইটুকু সে বুঝল যে পটোকে ইনজেকশন দেওয়াতে ফ্যাচুরের আপত্তি আছে।
পনি অবশ্য সাদা চামড়ার মানুষের ওষুধে খুব বিশ্বাস করে, কিন্তু ফ্যাচুয়ের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ উপেক্ষা করতে সে ভরসা পাচ্ছে না।
ওঝাদের ক্ষমতা রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে অতিশয় প্রবল। রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে পরাক্রান্ত দলপতিও ওঝাদের কথার উপর কথা বলতে সাহস পায় না, আর এটা তোত একেবারেই চিকিৎসার ব্যাপার।
চিৎকার-চেঁচামেচি চলল, উভয়পক্ষই উচ্চৈঃস্বরে নিজের নিজের মত প্রকাশ করতে ব্যস্ত।
নোভাক কিন্তু এই চেঁচামেচিতে কান দিলে না, সে ছেলেটির দেহে ইনজেকশন করে দিলে!
ছুঁচ ফুটতেই ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠল।
ফ্যাচুয়ে ও পনি দুজনেই চমকে উঠে তর্ক বন্ধ করে ফেললে।
নোভাক তখন তার কাজ শেষ করে ছুঁচটাকে বার করে আনছে। তর্কের অবকাশে কারও কোনো মতামতের অপেক্ষা না করে নোভাক যে ঔষুধ প্রয়োগ করতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা দুজনের কারও মাথাতেই আসেনি।
ওঝা রাগে জ্বলে উঠল।
পনি কিন্তু তখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, সমস্ত ঘটনার দায়িত্ব যে এখন তার কাঁধ থেকে নোভাকের কাঁধে চেপেছে তাতেই সে খুশি।
ওঝা ফ্যাচুয়ে তখনও ক্রোধ প্রকাশ করছে উগ্রকণ্ঠে।
নোভাক হঠাৎ এগিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, এই! শোনো!
ফ্যাচুয়ে চমকে উঠল। নোভাক ক্ষিপ্রহস্তে ফ্যাচুয়ের একটা হাত ধরে ফেললে তারপর ইনজেকশনের যন্ত্রপাতি জোর করে তার হাতে গুঁজে দিলে। হতভম্ব ফ্যাচুয়ে কিছু বলার আগেই নোভাক চিৎকার করে বললে, ঠিক আছে পটো সেরে যাবে।
তারপরই ধীর পদক্ষেপে সে কুটিরের বাইরে বেরিয়ে গেল। সশস্ত্র রক্ষীরা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তাকে বাধা দিলে না।
কিছুক্ষণ পরে নোভাক ফিরে এল, আরও দুটো পেনিসিলিন ইনজেকশন দিলে রোগীর দেহে। তার বরাত ভালো ওষুধটা কাজে লেগে গেল। দুদিন পরেই অসুস্থ ছেলেটি ম্যনিয়ক সিদ্ধ আর কাকাতুয়ার মাংসের গ্রিল গোগ্রাসে খেতে শুরু করলে! আরও দিন সাতেক বাদে দেখা গেল রোগী অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে মিলে নদী থেকে মাছ ধরছে এবং গ্রামের পথে পথে ছুটোছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে।
নোভাক বুঝল ফ্যাচুয়ে যতই রাগ করুক, এ যাত্রা তার মুণ্ড যথাস্থানেই বজায় থাকবে। পনি তাকে কথা দিয়েছিল তার ছেলে যদি বাঁচে তাহলে নোভাককে হত্যা করা হবে না। নোভাক জানত রেড-ইন্ডিয়ানরা কখনো কথার খেলাপ করে না, অতএব বর্তমানে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ।