কুয়াশা-আচ্ছন্ন প্রভাত।
তীব্র কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল কয়েকটা কাকাতুয়া!
নোভাক উঠে বসল, দেখল সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ কুইচারা!
সকলের মুখপাত্র হয়ে মালো বললে, মালিক, আমরা ফিরে যাচ্ছি।
নোভাক বললে, কালও তুমি ওই কথাই বলেছিলে।
নোভাক উঠে দাঁড়াল। তারপর শুরু হল লড়াই।
কিন্তু এবার আর দ্বন্দ্বযুদ্ধ হল না, অন্যান্য কুইচারা একসঙ্গে নোভাককে আক্রমণ করলে। তারপর কেমন করে আহত নোভাককে ফেলে রেখে কুইচারা সরে পড়ল, কেমন করে হল জিভারোদের আক্রমণ এবং কেমন করে জিভারোদের হাতে বন্দি হয়ে নোভাক এল জিভাবোদের গ্রামে সেই কথা কাহিনির পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা আছে, আবার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।
৩. কুঁড়েঘরের ভিতর নিদ্রিত
আচ্ছা, এবার জিভারোদের গ্রামে একটা কুঁড়েঘরের ভিতর নিদ্রিত ফ্রাঙ্ক নোভাককে নিয়ে আবার কাহিনি শুরু করছি।
নোভাকের ঘুম ভাঙল অত্যন্ত রূঢ়ভাবে।
অচম্বিতে তার পাঁজরের উপর এসে পড়ল একটা লাথি আর শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করলে অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর। এমন সাংঘাতিক অভ্যর্থনা পেয়ে নোভাকের ঘুম ভেঙে গেল। সে ভাবল, এবার নিশ্চয়ই তার মুণ্ডুটাকে ঘচাং করে কেটে জিভারোদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ত-সানটা করা হবে।
নোভাক ভালো করে চারদিকে তাকাল।
কুঁড়েঘরের ভিতর এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি লোক।
যে সর্দার আগের রাতে নোভাকের বন্দুকটা অধিকার করেছিল সেই লোকটিও ভিড়ের মধ্যে আছে, তবে আজ তার হাতে বন্দুকের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে একটা মস্ত ধনুক।
নোভাকের ঘুম ভেঙে যেতেই ধনুকধারী সর্দার কুটিরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চিৎকার করে বললে, চিচা ম্যনিয়ক!
নোভাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
চিচা হচ্ছে এক ধরনের উত্তেজক পানীয় আর ম্যনিয়ক একজাতীয় গাছের মূল, রেড-ইন্ডিয়ানদের প্রিয় খাদ্য।
নোভাক বুঝলে জিভারোরা এখনো তাকে হত্যা করার সঙ্কল্প করেনি। সেই ধরনের ইচ্ছা থাকলে অন্তত তাকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে তারা আপ্যায়ন জানাবে না।
আহার্য এবং পানীয় নিয়ে এল একটি অর্ধবয়স্ক জিভারো রমণী। ক্ষুধার জ্বালায় বাঘ ঘাস খায় কিনা জানি না কিন্তু যে অপরূপ খাদ্য ও পানীয় কোনো শ্বেতাঙ্গ মানুষের গলা দিয়েই নামত না, সুসভ্য আমেরিকার অধিবাসী হয়েও ফ্রাঙ্ক নোভাক সেই বস্তু অম্লানবদনে গিলে ফেলল।
তবে স্বাদ যতই খারাপ তোক, শরীরের পক্ষে ওই খাদ্য ও পানীয় নিশ্চয়ই খারাপ নয়। কারণ, পানাহারের পরেই নোভাকের অবসাদ কেটে গেল, সে দস্তুরমতো সুস্থবোধ করলে।
এবার তাকে নিয়ে যাওয়া হল আর একটা কুটিরের দরজায়। গ্রামের মধ্যে যে কটা কুঁড়েঘর নোভাকের চোখে পড়েছিল এটা তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো।
যে সর্দার নোভাকের সঙ্গে এসেছিল সে নোভাককে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলে। কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করতেই নোভাকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল একটি বলিষ্ঠ দেহ মানুষের উপর।
লোকটির মুখ দেখে তার বয়স অনুমান করা যায় না, তবে সে যে একেবারে তরুণ নয়, এ কথাটা নোভাক সহজেই বুঝতে পারলে। লোকটির মুখের রেখায় রেখায় বহু অভিজ্ঞতার ছাপ, কিন্তু তার পেশীবহুল দেহের উপর বয়স স্বাক্ষর এঁকে দিতে পারেনি।
ঘরের ভিতর একটা কাঠের আসনের উপর বসে আছে সেই অপরূপ মনুষ্য-মূর্তি এবং তার পাশেই একটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ঝুলছে তিনটি শুষ্ক নরমুণ্ড ও নোভাকের বন্দুক। নোভাক সবিস্ময়ে দেখলে মুণ্ড তিনটির গঠন স্বাভাবিক নরমুণ্ডের মতো হলেও একটি সাধারণ মানুষের মাথার তুলনায় মুণ্ডগুলি প্রায় চারগুণ ছোটো।
একেই বলে ত-সানটা, সঙ্কুচিত নরমুণ্ড!
উপবিষ্ট মানুষটির দিকে একনজর তাকিয়ে নোভাক বুঝল পূর্ববর্তী সর্দার একটি ছোটোখাটো দলের নায়ক মাত্র- এই হচ্ছে জিভারোদের প্রধান দলপতি!
দলপতি একা নয়, তার সঙ্গে রয়েছে দুজন স্ত্রীলোক।
একজন প্রৌঢ়া, অপরজন তরুণী।
প্রৌঢ়াকে দেখে নোভাক অনুমান করলে দলপতির স্ত্রী।
তরুণীর দিকে একবার তাকিয়ে সে চমকে উঠল।
জিভারো মেয়েদের সৌন্দর্য ইতিপূর্বেই নোভাকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু এই মেয়েটির সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের তুলনাই হয় না। দুর্ভেদ্য অরণ্যের অন্তরালে হিংস্র নৃমুণ্ড শিকারির অন্তঃপুরে এমন রূপসীর অস্তিত্ব কল্পনার অতীত- এক মুহূর্ত নোভাকের দৃষ্টি নিশ্চল হয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে, পরক্ষণেই সে চোখ ফিরিয়ে নিলে।
মেয়ে দুটি ছাড়া তাঁবুর মধ্যে অন্য মানুষও ছিল।
দলপতির পিছনে মাটিতে বিছানা পাতা রয়েছে এবং সেই শয্যা আশ্রয় করে শুয়ে আছে একটি কিশোর। অনেকগুলি চাদর ও কম্বল দিয়ে টাকা দেওয়া হয়েছে সেই ছেলেটিকে। কুটিরের মধ্যে খুব গরম— এই দারুণ গরমে ছেলেটিকে এতগুলো কাপড় কম্বল দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে দেখে নোভাক আশ্চর্য হল। সে লক্ষ করলে ছেলেটি টেনে টেনে অতিকষ্টে শ্বাসগ্রহণ করছে এবং তার উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের আশেপাশে জমে উঠেছে নীলাভ ফেনা ও লালা নোভাক অনুমান করলে ছেলেটি অসুস্থ।
একটু পরেই ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় দলপতি কথা কইতে শুরু করলে। স্প্যানিশ ভাষা নোভাকের ভালোভাবেই জানা ছিল, দলপতির কথা বুঝতে তার অসুবিধা হল না।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চার্লিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে নোভাক জানতে পারলে দলপতির নাম হচ্ছে পনি। রোগশয্যায় শায়িত কিশোরটি পনির পুত্র তার নাম পটো। জিভারোদের ওঝা বলেছে বনের মধ্যে কোনো শয়তানের কু-নজর লেগেই পনির ছেলে পটো হয়েছে অসুস্থ। সেই শয়তানের মুণ্ড কেটে আনতে পারলেই নাকি পটো আরোগ্যলাভ করবে। সেই জন্যই জিভারো যোদ্ধারা চতুর্দিকে নরমুণ্ড শিকার করতে শুরু করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আসল শয়তানের মুণ্ডটা কেউ আনতে পারেনি।