সিদ্দিক সাহেবের মেজাজ খারাপ হওয়ার মূল কারণ এটা। ওরা করতে চাইলে করুক তাঁর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছেন। তার ধারণা এর পেছনে নুরুদিনের হাত আছে। নুরুদ্দিন তার সঙ্গে কনটেস্ট করছে। তার পেছনে আছে আওয়ামী লীগ। নরুদ্দিন খুবই ঘুঘু লোক। পুরনো আওয়ামী লীগার। শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর পর অবশ্য সে আওয়ামী লীগের সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলতে থাকে যার একটা হচ্ছে দেশটা লিজ দেয়া হয়ে গিয়েছিল ইন্ডিয়ার কাছে। আল্লাহ পাকের দয়ায় রক্ষা পেয়েছে।
জিয়াউর রহমান সাহেবের সময় নুরুদিন কঠিন বিএনপি হয়ে যায়। তাতে তার আওয়ামী লীগে আবার ফিরে যাওয়াতে কোন অসুবিধা হয়নি। ঘুঘু লোক বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কে সাবধান থাকা ভাল। সিদ্দিক সাহেব যথেষ্ট সাবধান। তবুও অস্বস্তি লেগেই থাকে। সিদ্দিক সাহেব শিশু নিকেতনের সেক্রেটারিকে আসতে বলেছেন ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার করে নিতে চান। ব্যাটাকে আসতে বলা হয়েছে চারটার সময় এখন বাজে পাঁচটা। এখনো আসছে না। সিদ্দিক সাহেবেবী মেজাজ ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।
সেক্রেটারি ঢুকাল পাঁচটা পচিশে। মুখে তেলতোলে ধরনের হাসি। পরনে নকশাদার পাঞ্জাবি। পাতলা গোঁফের জন্যে চেহারাটাই কেমন ধূর্ত ধূর্ত হয়ে গেছে। লোকটির নাম মনোয়ার হোসেন তবে সবাই ডাকে মনু ভাই।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম। কী ব্যাপার?
মনোয়ার হোসেন অবাক হয়ে বলল, আপনি তো ডেকে পাঠালেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা, মনেই ছিল না। আরেকটু হলে চলে যেতাম! ভাগ্যিস এসেছে। হাজার ঝামেলা নিয়ে থাকি কিছু মনে থাকে না। বস বস।
মনোয়ার হোসেন বসল। তার মুখের হাসি আরো বিস্তুত হল।
তোমাদের শিশু নিকেতন সম্পর্কে জানার জন্যে ডাকলাম। কত দূর কি করলে?
হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা স্যার। তবে একটা ঘর পাওয়া গেছে এটা একটা বড় উপকার হয়েছে।
ঘর কোথায় পেলে?
নুরুদিন সাহেব দিয়েছেন। কিছু ফার্নিচার ও পাওয়া গেছে। আপনাদের দশজনের সাহায্য ছাড়া তো স্যার হবে না। দশের লাঠি একের বোঝা।
সিদ্দিক সাহেব শুকনো গলায় বললেন, তা তো বটেই।
আপাতত ছবি আঁকা, নাচ আর গান শিখানো হবে। একটা শিশু লাইব্রেরি থাকবে। শিশুদের জন্যে হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের হবে। পত্রিকার নাম স্যার অনির্বাণ।
ভাল খুবই ভাল।
অনিৰ্বাণ প্রথম সংখ্যায় স্যার আপনাকে একটা বাণী দিতে হবে। না বললে হবে না স্যার।
উদ্বোধনের কী ব্যবস্থা করলে?
এখনো ফাইন্যাল কিছু হয়নি। শামসুর রাহমান সাহেব প্রধান অতিথি। এটা শুধু ফাইন্যাল হয়েছে।
ভাল ভাল খুবই ভাল।
আপনাকে স্যার উদ্বোধনীর দিন থাকতে হবে।
থাকব। নিশ্চয়ই থাকব। কেন থাকব না?
মনোয়ার হোসেন চা-বিসকিট খেয়ে বিদায় হল। সিদ্দিক সাহেব দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন। ঝামেলা বাড়ছে–এত সব ঝামেলা সহ্য করা কঠিন। ব্যবসার ঝামেলা, জমিজমার ঝামেলা; প্রতিষ্ঠার ঝামেলা। একটা পরিত্যক্ত সম্পত্তি তিনি কিনেছেন। কিন্তু দখল পাচ্ছেন না। চারতলা বিল্ডিং ভাল জায়গায় গ্রিন রোড়ে। দখল না পেলে লাভ কি? সম্পত্তি, আসল মালিকের কাছ থেকেই কেনা। বলাই বাহুল্য। জলের দামে কেনা। কত দামে কেনা সেটা বড় কথা নয়। কাগজপত্র ঠিক আছে এটাই বড় কথা। কাগজপত্র থেকেও লাভ হচ্ছে না।
বাড়িতেও ছোটখাটো অশান্তি লেগে আছে। মন টেকে না। তার স্ত্রী দশ বছর আগে হঠাৎ করে মোটা হতে শুরু করেছিলেন–এখন মৈনাক পর্বত। দুই হাত দিয়ে বেড় পাওয়া যায় না। গাড়িতে উঠলে গাড়ি খানিকটা ডেবে যায়। এক মেয়েও মায়ের পথ ধরেছে। বয়স তেইশ। এর মধ্যেই হুঁলস্থূল কারবার। ছোট মেয়েটা এখনো ঠিক আছে। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে?
সিদ্দিক সাহেব রাত আটটার দিকে বেরুলেন। তার মন-মেজাজ খুব যখন খারাপ থাকে তখন এগার নম্বর বাড়িতে কিছু সময় কাটান। মেয়ে তিনটার সঙ্গে হালকা গল্পগুজব করেন। এর বেশি। কিছু না। সেই সাহস তার নেই। মেয়ে তিনটার বয়স তার বড় মেয়ের বয়সের চেয়েও কম। এদের নিয়ে অন্য কোন চিন্তা কেমন যেন দানা বঁধতে পারে না। তাছাড়া ভয়ও আছে। জানাজানি হয়ে যেতে পারে। কে জানে কিছুটা জানাজানি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে কি না। বাকের বড় যন্ত্রণা করছিল। হাজতে যতদিন ছিল ভাল ছিল এখন আবার ছাড়া পেয়েছে। এগার নম্বর বাড়ি প্রসঙ্গ তুলে তাকে বেইজিত করবে। কী না কে জানে? সম্ভাবনা আছে। নুরুদিন এই সুযোগ ছাড়বে না। তার আগেই একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
জোবেদ আলি তাকে দেখে ছুটে এসে তালা দেয়া গেট খুলল। এই ব্যবস্থাটা সিদ্দিক সাহেবের খুব পছন্দ। গেট সব সময় তালাবন্ধ থাকে। লোকজন আসছে যাচ্ছে। এ রকম কোনো ব্যাপার নেই। বাড়ির চেহারাও এরা পাল্টে ফেলেছে। চারদিকে ফুলের টব। রঙ-বেরঙের পাতা বাহার, অৰ্কিড মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। পাড়ার মধ্যে এমন একটা সুন্দর বাড়ি দেখতে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে যখন মনে হয়। এই বাড়িটা তার। বেনামীতে কেনা।
জোবেদ আলি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, বাড়িতে তো কেউ নাই।
তাই নাকি?
জি কক্সবাজার গেছে।
বৈশাখ মাসে কক্সবাজার?
ভিড় কম থাকে। নিরিবিলি। আসেন বসেন চা খান।
না চা খাব না। আসবে কবে?
তা তো জানি না। ইতালির দুই সাহেব আছে সাথে বাংলাদেশ ঘুরতে আসছে।