বুড়ো চুপ করে গেল।
ঢাকায় পৌঁছে বকুল পুরোপুরি সুস্থ। যেন তার কিছুই হয়নি। মুনার ক্ষীণ সন্দেহ হল অসুখের ব্যাপারটা পুরোপুরি বানানো–বকুলের একটা চমৎকার অজুহাত।
বাকেরের অবশ্যি খুব সুবিধা হয়েছে। দিনের মধ্যে তিনবার চারবার আসছে রুগীর খোঁজ নিতে এলাম মুনা। অবস্থা কেমন?
মুনা বিরক্ত হয়ে একবার ঝাঝিয়ে ওঠে… আপনি বড় ঝামেলা করেন বাকের ভাই। সকালবেলা তো একবার দেখে গেলেন বকুল সুস্থ। এই তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার কী হবে?
তবু একটু খোঁজ নেয়া–মনের মধ্যে টেনশন থাকে।
টেনশনের কিছু নেই বাকের ভাই, যদি কিছু হয় আপনাকে খবর দেব। দয়া করে বিরক্ত করে মারবেন না।
আমি বিরক্ত করি?
কেন–আপনি নিজে বোঝেন না?
আচ্ছা আর করব না।
মুখ কালো করে বাকের চলে যায়। মনটা অসম্ভব খারাপ হয়। জলিল মিয়ার স্টলে তিনি কাপ চা খেয়ে ফেলে। মনস্থির করে ফেলে আর না। কী দরকার? যাদের ব্যাপার তারা বুঝবে। তবু সন্ধ্যার পর মনে হয়–খোজ নেয়া বিশেষ প্রয়োজন। দু’টা মেয়ে মানুষ একা একা থাকে। কত রকম সমস্যা হতে পারে। সন্ধ্যার পর দরজায় টোকা দেয়। মুনা গম্ভীর মুখে দরজা খোলে। বাকেরকে দেখেও কিছু বলে না।
দরজা-টরিজা ভাল করে বন্ধ করে ঘুমুবে। চুরি হচ্ছে। দেশে বাস করা মুশকিল।
রাগ করতে গিয়েও মুনা রাগ করতে পারে না। হেসে ফেলে। বাকের বিস্মিত হয়ে বলেহাস কেন?
কেন হাসি তা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই বাকের ভাই। বসুন। চা খাবেন?
খাব।
মুনা চা বানাতে যায়। বাকের বসে থাকে। তার বড় ভাল লাগে।
সিদ্দিক সাহেবকে আজ একটু বিমর্ষ দেখাচ্ছে
সিদ্দিক সাহেবকে আজ একটু বিমর্ষ দেখাচ্ছে।
কোন কারণে তিনি চিন্তিত এবং বিরক্ত। বিরক্ত হলে তার মুখে ঘন ঘন থুথু ওঠে। এখন তাই উঠছে। তিনি চারদিকে থুথু ছিটাচ্ছেন। সরকারি দলের নমিনেশন তিনি পাবেন, এই নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। এক লাখ টাকার চাঁদা দেয়া ছাড়াও অন্য এক কায়দায় বিশেষ একজনকে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা নগদ দেয়া হয়েছে। তিনি হিসেবি লোক পুরোপুরি নিশ্চিত না হলে এতগুলি টাকা বের করতেন না। সমস্যা এখানে নয় সমস্যা ভিন্ন জায়গায়। সরকারি দল মানেই বেশির ভাগ লোকের অপছন্দের দল। এই দেশের মানুষদের সাইকোলজি হচ্ছে ক্ষমতায় যে আছে তার বিপক্ষে কথা বলা। যতদিন পর্যন্ত তুমি ক্ষমতায় নেই। ততদিন পর্যন্ত তুমি ভাল। যে মুহূর্ত ক্ষমতায় চলে গেলে সেই মুহূর্তে থেকে তুমি খারাপ। তোমার বিরুদ্ধে জ্বলাও-পোড়াও আন্দোলন। বড় বড় বক্তৃতা।
সরকারি দলে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা এটাই সিদ্দিক সাহেব বুঝতে পারছেন না। চালে ভুল হলে মুশকিল। রাজনীতিতে প্রতিটি চাল ভেবেচিন্তে নিতে হয় এবং ভবিষ্যতের কথা মনে রাখতে হয়। আওয়ামী লীগের এক সময় রমরমা ছিল. কোথায় গেল সেই রমরমা? তবে কিছুই বলা যায় না। রমরমা ফিরেও আসতে পারে।
কোন রকম দলে না গিয়ে স্বতন্ত্র থেকে ইলেকশন করাই ভাল। তাহলে সব দলকেই বলা যায় আছি তোমাদের সাথে। তবে স্বতন্ত্র থেকে দাঁড়ালে ইলেকশনে জেতা কষ্টকর। প্রশাসনের সাহায্য দরকার। প্রশাসন শুধু শুধু সাহায্য করবে কেন? তাদের কী ঠেকা?
এই ইলেকশন সিদ্দিক সাহেবের কাছে খুবই সামান্য ব্যাপার। কিন্তু বড় কিছুতে যাওয়ার এটা হচ্ছে প্রথম সিঁড়ি। নামটা প্রথম ভাসতে হবে। মুখে মুখে ফিরতে হবে। খুনখারাবি হবে। হাঙ্গামা হবে। খবরের কাগজে লেখালেখি হবে–তখন সবাই বুঝবে এই কনসটিটিয়েনসি একটা জটিল জায়গা। সিদ্দিক সাহেব সেই জটিল জায়গা পানি করে দিয়েছেন। তার চেহারা এবং কার্যকলাপে। বোঝা যাওয়া চাই যে তিনি মহা ধুরন্ধব এবং মহা কঠিন ব্যক্তি।
আগেকার অবস্থা এখন নেই হেঁ হেঁ করে ভোটারের সামনে হোত কচলালে হবে না। হাত কচলান ক্যান্ডিডেটের দিন ফুরিয়েছে। এখনকার ভোটাররা শক্তের ভক্ত।
শুধু ভোটাররা না–সবাই এখন শক্তের ভক্ত।
সিদ্দিক সাহেব বসে আছেন তার বসার ঘরে। তার সামনে একগাদা পোস্টার। ছাপানো নয় আর্টিস্ট এনে লেখান হয়েছে। নগর কমিটির পোস্টার। নগর কমিটি তিনি কিছুদিন হল করেছেন। সরাসরি এই কমিটিতে তিনি নেই। কাজ করছেন উপদেষ্টা হিসেবে। যদিও সমস্ত কিছুই তাঁর করা। পোস্টারগুলিতে নানান ধরনের বক্তব্য–
“এই নগর আপনার
একে সুন্দর রাখুন।
যেখানে সেখানে মযলা ফেলবেন না।
নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলুন।”
–নগর কমিটি
“আপনার আশপাশে কী অসামাজিক
কার্যকলাপ হয়? অসামাজিক কার্য
কলাপ প্রতিরোধ করা আপনার
সামাজিক দায়িত্ব।”
–নগর কমিটি
“আপনার আশপাশে কী বখাটে
ছেলেপুলের আড্ডা দেয়? নেশা করে?
নগর কমিটিতে খবর দিন।
–নগর কমিটি
“হিরোয়িন, মদ, গাঁজা আপনার
শত্ৰু। যারা এসবের ব্যবসা করছে
তারাও আপনার শত্রু। শত্রু নিৰ্মল করুন।”
–নগর কমিটি
“ধূমপান মনে বিষপান। পয়সা খরচ করে
কেন বিষপান করছেন? ধূম্রমুক্ত নগর
সৃষ্টি করুন।”
–নগর কমিটি
প্রায় একশর মত পোস্টার। লাল কাগজে ঘন কালো রঙে লেখা। আর্টিস্ট ছোকরা লিখেছে। ভাল। জায়গায় জায়গায় পোস্টার পড়লে দেখতে ভালই লাগেব।
সামনের সপ্তাহে তিনি শিশু নিকেতনের উদ্বোধন করতে মন ঠিক করেছিলেন সেখানে একটা ঝামেলা বেধেছে।
শিশু নিকেতনের চেংড়াহেগুলি উদ্বোধনের দিন কোন কবিকে নাকি আনতে চায়। প্রস্তাবটা তার মন্দ লাগেনি। তিনি সভাপতি কবি প্রধান অতিথি। এখন আবার বাতাসে অন্য রকম কথা ভাসছে। শিশু নিকেতনের সেক্রেটারি নাকি সভাপতি, কবি শামসুর রাহমান প্রধান অতিথি, সওগাত পত্রিকার নাসিরুদিন সাহেব বিশেষ অতিথি।