কী করলাম?
এই যে দুপুরে খেতে বসে চেঁচামেচিটা করলে। বেচারী বকুল কেঁদে কেটে অস্থির। ভাত খায়নি দুপুরে।
ননীর পুতুল একেকজন। ধমক দিলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে হয় এদের।
তুমি যাও তো মামা, ওকে দু’একটা মিষ্টি কথা বল। আমার কানের কাছে বসে ঘ্যান ঘ্যান করবে না;
শওকত সাহেব উঠে পড়লেন। বারান্দায় গিয়ে প্রচণ্ড একটা ধমক দিলেন বাবুকে বই নিয়ে বসার কথাটা বলে দিতে হবে?
বাবু শুকনো মুখে বই আনতে গেল।
অংক বই খাতা নিয়ে আয়। গায়ে তো কারো বাতাস লাগে না? শক্ত মার দিলে হুঁশি হবে। তার আগে হুঁশি হবে না। শয়তানের ঝাড়। দুপুরবেলা হুঁট করে কোথায় গিয়েছিলি?
বাবু কোনো জবাব দিল না। অংক খাতা ও বই নিয়ে বসল। তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। বাবাকে সে খুব ভয় পায়। শওকত সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। বকুল বাবাকে দেখে জড়সড় হয়ে গেল।
রান্নাঘরটাকে একেবারে দেখি পায়খানা বানিয়ে রেখেছিস; গুছিয়ে-টুছিয়ে নিতে পারিস না। কোনোটাই তো দেখি হয় না। পড়াশুনা না কাজকর্মও না। কারবিটা কি? কারো বাড়িতে ঝিগিরিও তো পাবি না। এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যা।
বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, দুধ চা?
একটা হলেই হল। তোর মা কিছু খেয়েছিল দুপুরে?
রুটি খেয়েছিল।
মুনার জন্যে হালকা করে বার্লি বানা। লেবুর রস দিয়ে লবণ দিয়ে ভাল করে বানা। বার্লি আছে না ঘরে?
আছে।
শওকত সাহেব চলে গেলেন। তখন বকুলের মনে পড়ল ঘরে বার্লি নেই। এই কথাটা এখন বাবাকে বলবে কে? রাগে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে। সে বাবার জন্যে চায়ের পানি চড়াল। ঘরটা একটু গোছাতে চেষ্টা করল। তার আবারও কেন জানি ভয় ভয় করছে। রান্নাঘরে একা থাকলেই একটা ভয়ের গল্প মনে হয়। ঐ যে রান্নাঘরে একটি বউ একা একা মাছ ভাজছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা রোগাকালো হাত বেরিয়ে এল। নাকি সুরে একজন কে বলল, মাছ ভাজা দে। তাছাড়া আজ দুপুরেও ভাবী পাঁচ-ছটা ভূতের গল্প বলেছে। তার কোন খালার নাকি জ্বীনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেই জ্বীন সুন্দর সুন্দর সব জিনিসপত্র এনে দিত। একবার নাকি একটা ফুলের মালা এনে দিয়েছিল যার সবগুলি ফুল কুচকুচে কালো রঙের। দিনের বেলা গল্পগুলি শুনে হাসি এসেছে কিন্তু এখন আবার কেমন ভয় ভয় লাগছে। সবগুলি গল্পই মনে হচ্ছে সত্যি। ভাবী বলছিল–তুমি যা সুন্দর, সাবধানে থাকবে ভাই। ভর দুপুরে আর সন্ধ্যায় এলোচুলে থাকবে না। বকুল অবাক হয়ে বলেছিল, এলোচুলে থাকলে কি হয়?
খারাপ বাতাস লাগে।
খারাপ বাতাস লাগে মানে?
জীন-ভূতের আছর হয়। সুন্দরী মেয়েদের ওপর জ্বীনের আছর হওয়া খুব খারাপ। সারা রাত এরা ঘুমুতে দেয় না। বিরক্ত করে।
কিভাবে বিরক্ত করে?
এখন বুঝবে না। বিয়ে হওয়ার পর বুঝবে।
এই বলে ভাবী মুখ টিপে টিপে হাসল। রহস্যময় হাসি।
কি বকুল শুনতে চাও কিভাবে বিরক্ত করে?
না শুনতে চাই না।
অবশ্যি অনেকে সেটা পছন্দও করে। আমার ঐ খালার কথা বলছিলাম না সেই খালা জ্বীন না এলে কেমন অস্থির হয়ে যেত কাপড়-টাপড় খুলে ফেলে বিশ্ৰী কাণ্ড করত।
এখন তিনি কোথায় থাকেন?
চাঁদপুরে। এখন আর এইসব নেই। খুব ভাল মানুষ। এক ওভারশিয়ারের সাথে বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলেমেয়ে। জ্বীন-ভূতের কথা আর কিছুই মনে নেই।
ডাক্তার এল সাড়ে নটার সময়। তার সঙ্গে এল বাকের। বাকেরের গায়ে চকচকে লাল রঙের একটা শার্ট। শার্টের পকেটে ফাইভ ফাইভের প্যাকেট উঁচু হয়ে আছে। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। যেন অসুখের ব্যাপারে দারুণ চিন্তিত। বাকেরকে দেখে মুনার বিরক্তির সীমা রইল না। তাকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে–এ বাড়িতে যেন কোনোদিন না আসে। তবু কেমন নির্লিজের মত এসেছে। আর বাবুর কাণ্ড, একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে আসতে হবে। সে তো অব ডাক্তার না। মুনা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের বলল, খুব ফুঁ হচ্ছে চারদিকে। কাহিল অবস্থা। জ্বর বেশি। নাকি তোমার?
মুনা জবাব দিল না। তাকাল ডাক্তারের দিকে। এই ডাক্তার এ পাড়ায় নতুন এসেছে। দেখে মনে হয় নাইন-টেনে পড়ে। স্টেথিসকোপ হাতে নিয়ে এমন ভাবে চারদিক দেখেছে যেন যন্ত্রটি নিয়ে সে কি করবে। মনস্থির করতে পারছে না। কিংবা হয়ত স্টেথিসকোপ বুকে বসাতে সাহস করছে না। মুনা বলল, আমার গলাটা দেখুন। ঢোঁক গিলতে পারি না।
ডাক্তার সাহেব গলায় ছোট্ট একটা টর্চের আলো ফেললেন। বাকের বলল, দেখি আমি টর্চ ধরছি, আপনি দেখুন ভাল করে। ডাক্তারের কিছু বলার আগেই সে টর্চ নিয়ে নিল। মুনা বলল, আপনি বসার ঘর গিয়ে বসুন না। ওঁকে দেখতে দিন।
উনিই তো দেখছেন। আমি দেখছি নাকি? আমি কি ডাক্তার? হা হা হা।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কানে ব্যথা আছে?
জি না।
আপনার কি আগেও টনসিালের প্রবলেম ছিল?
জি।
বাকের একগাল হেসে বলল, একেবারে ছেলেবেলা থেকে মুনার এই প্রবলেম। বৃষ্টির একটা ফোঁটা পড়ল, ওমনি তার গলা ফুলে গেল। পিকিউলিয়ার।
ডাক্তার সাহেব নিচু স্বরে বললেন, একটা থ্রোট কালচার করা দরকার।
বাকের বলল, দরকার হলে করবেন। একবার কেন দশবার করবেন। হা হা হা।
মুনা, বলল, আপনারা বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি চা দিতে বলি।
বাকের বলল, চা-টা কিছু লাগবে না। রোগীর বাসায় কোনো খাওয়া-দাওয়া করা ঠিক না। কি বলেন ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার কিছু বললেন না। বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে একটু পানি দেবেন? হাত ধোব।