মেসে ফিরতে ফিরতে চারটা বেজে গেল। ঘরে ঢুকে দেখে মুনা তার চৌকির ওপর একা একা বসে আছে। তার গলায় নীল রঙের একটা মাফলার। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি করেছে। দেখেই বোঝা যায় গায়ে জুব। মুনা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, সেই কখন থেকে বসে আছি, কোথায় ছিলে? মামুন আজ সারাদিন ভেবেছে মুনার সঙ্গে দেখা হলেই খুব কথা শোনাবে। খুব রাগ করবে। কিন্তু রাগ করা গেল না। মুনার ওপর রাগ করা মুশকিল। মামুন গম্ভীর গলায় বলল, একটার সময় আমাদের এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল না?
যাব কিভাবে? অফিসেই গিয়েছি। দেড়টার সময। আমার জ্বর, গলা ব্যথা। টনসিল!
আবার টনসিল, বল কী?
বৃষ্টিতে ভিজালাম। আমি ভিজালাম, বকুল ভিজল, বাবু ভিজল। ওদের কারো কিছু হয়নি। আমার অবস্থাই কাহিল।
মুনা অসহায়ের মত মুখ করল। মামুন এগিয়ে এসে হাত রাখল। তার গলায়। মতলব ভাল নয়। মুনা বলল, কী অসভ্যতা করছ, হাত সরাও।
না সরাব না।
মামুনের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। কখন কে এসে পড়বে। বারান্দায় লোকজন চলাচল করছে। মামুন তার হাত সরিয়ে নিল না। তার হাসি হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রকম কোনো ইচ্ছাও তার নেই। মামুন নরম স্বরে বলল, কাল তোমার কী প্ল্যান?
কোনো প্ল্যান নেই, কেন?
চল কাল তোমাকে কল্যাণপুরের বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।
মুনা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মামুন বলল–দু’একটা ফার্নিচারও কিনব। তুমি সঙ্গে থাকলে ভাল হয়।
কী ফার্নিচার?
বড় দেখে একটা খাট!
এমন অসভ্যের মত কথা বলা কেন?
মামুন শব্দ করে হাসল। চোখ ছোট করে বলল, খাট কেনার মধ্যে অসভ্যতার কী দেখলে তুমি?
ভদ্র হয়ে বাস।
ঠিক আছে বসছি। ভদ্র হয়ে। কাল কখন আসবে বল।
কাল আসতে পারব না, অনেক কাজ আছে। ঘরে কাজের লোক নেই। মামির অসুখ।
কোনো কথা শুনব না। কাল আসতেই হবে। প্লিজ। মুনা। দুপুরে কোনো রেস্টটুরেন্টে বসে খাব। ফাইন হবে।
রেস্টুরেন্টে বসে খাবার মধ্যে ফাইন কী আছে?
আছে, তুমি বুঝবে না। মুনা, আসবে তো?
দেখি।
দেখাদেখি না। আসতেই হবে। সকাল নটার মধ্যে চলে আসবে, পজিটিভলি।
মুনা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। এখান থেকে সে যাবে মামির ভাইয়ের বাড়ি। আংটি দিয়ে আসবে। মামুন বলল … কী আশ্চর্য, এখনি উঠছ কেন?
কাজ আছে আমার।
এত কাজের মেয়ে হয়ে উঠলে কবে থেকে?
মুনা কিছু বলবার আগেই মামুন চট করে তার ঠোঁটে চুমু খেল। মুনা সরে গেল মুহূর্তেই। বিরক্ত স্বরে বলল, কেন সব সময় বিরক্ত কর? দরজা খোলা। লোকজন যাওয়া-আসা করছে।
মামুন হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি।
থাক। দরজা বন্ধ করতে হবে না।
তুমি আসছ তো?
দেখি।
কাল নটায়। পজিটিভলি।
মামির ভাই বাসায় ছিলেন না। তার স্ত্রী ছিলেন। ভদ্রমহিলা মুনাকে দেখেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন কাল তোমরা কেউ আসলে না যে, ব্যাপারটা কী?
মামির শরীরটা ভাল না।
তোমাদের শরীর তো ঠিক ছিল, না তোমাদের সবার একসঙ্গে শরীর খারাপ হল?
মুনা কিছু বলল না।
শদেড়েক লোক খেয়েছে। অথচ নিজের আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। বাস তুমি। চা-টা কিছু খাবে?
জি না।
এক বাটি গোসাত তুলে রেখেছিলাম তোমাদের জন্যে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেয়ো।
মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, গোসতের বাটি নিয়ে যাব কিভাবে?
বাটি নিয়ে যাবে কেন? টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দেব।
মুনাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হল। এ বাড়িতে অনেক লোকজন থাকে। এদের কাউকেই সে ভাল করে চেনে না। সে যে অনেকক্ষণ ধরে একা একা বাস আছে। এটা কেউ তেমন লক্ষ্যই করছে। না। পাশের কামরায় বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ভি সি আর দেখছে। একটি মেয়ে এসে এক ফাঁকে বলে গেল–অমিতাভের ছবি হচ্ছে, দেখবেন? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ছুটে চলে গেছে।
মুনা টিফিন বক্সের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কাজের ছেলেটি তার সামনে একটা পেপসির বোতল রেখে গেছে। বাড়ির কত্রী টেলিফোন ধরতে গিয়ে আর ফিরছেন না। মুনা ঘড়ি দেখল, সাড়ে ছটা বাজে। আজও বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
মুনার মনে হল তার জ্বর আসছে
মুনার মনে হল তার জ্বর আসছে।
মুখ তেতো, মাথায় ভোঁতা। একটা যন্ত্রণা। সকালে নাশতা খেতে গিয়ে টের পেল গলাব্যথা আরো বেড়েছে। গলা দিয়ে কিছুই নামছে না। মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল–বকুল, একটু গরম পানি করে দে, গোসল করব। বকুল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
নাশতা শেষ করে যা। বলা মাত্রই দৌড়াতে হবে নাকি?
আমার নাশতা খাওয়া হয়ে গেছে।
বকুল রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মুনা বলল, মামা কোথায় রে বাবু?
সকালবেলা কোথায় যেন গেছেন।
নাস্তা খেয়ে গেছেন?
না। বকুল বলেছিল চা খেয়ে যেতে।
মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, বকুল বকুল করছিস কেন? কতবার বলেছি আপা বলতে।
আপাই তো বলি।
আবার মিথ্যা কথা? চড় খাবি।
গার্গল করেও লাভ হল না। পানি বেশি গরম ছিল, মাঝখান থেকে জিব পুড়ে গেল; বকুল বলল, তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। শুয়ে থাক গিয়ে। মুনা কিছু বলল না। বকুল ইতস্তত করে বলল, ফজলু ভাইদের বাসায় একটু যার আপা? মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কেন?
যেতে বলেছিল আমাকে। খুব নাকি দরকার।
কী দরকার?
জানি নাকি, শুধু বলেছেন খুব জরুরি। বোধ হয় ভাবীর সঙ্গে আবার ঝগড়া-টগড়া হয়েছে।
সেটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, তুই কেন যাবি?
বকুল আর কিছু বলল না। ফজলুর রহমান সাহেব গলির ওপাশেই থাকেন। মাস ছয়েক হল এসেছেন। খুব সামাজিক ধরনের মানুষ। এসেই আশপাশের সব বাড়িতে গেছেন। বিয়ের সময় নিজে এসে দাওয়াত করে গেছেন। মুনার নিজের ধারণা লোকটি গায়ে-পড়া ধরনের। প্রথম আলাপেই খালা, খালু, আপামণি ডাকাডাকি তার ভাল লাগেনি। বকুলের সঙ্গে ভদ্রলোকের স্ত্রীর খুব খাতির। এটাও মুনার ভাল লাগেনি। অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে একজন বিবাহিত মহিলার এত ভাব থাকা ঠিক না। বকুল আবার বলল, আপা যাব?