এই অফিসে কাজকর্ম একটু বেশি হয় নাকি? সবাই ব্যস্ত। কোণার দিকে একটি মেয়ে একবারও মাথা না তুলে ক্রমাগত টাইপ করে যাচ্ছে। মুনা বলছিল এই অফিসের বিশ্বাস সাহেবের সঙ্গে মেয়েটির কী নাকি একটা বাজে ঝামেলা হয়েছে। বাজে ঝামেলাটা কী সেটা পরিষ্কার করে বলেনি। আগে মেয়েটি বিশ্বাস সাহেবের সঙ্গে বসন্ত, এখন অফিসের সবার সঙ্গে বসে। মামুন আড়াচোখে মেয়েটিকে কয়েকবার দেখল। বাজে ঝামেলাটা কোন পর্যায়ের হতে পারে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল। তেমন কোনো আকর্ষণীয় চেহারা নয়। মোটা ঠোঁট, চাপা নাক।
মামুন সাহেব!
মামুন তাকিয়ে দেখল পাল বাবু এক কপি দৈনিক বাংলা নিয়ে ঢুকেছেন।
বড় সাহেবের ঘর থেকে নিয়ে এলাম। বসে বসে পড়ুন। চা খাবেন নাকি আর এক কাপ?
জি না। ও বোধ হয় আজ আর আসবে না।
আসবে। আসবে। মেয়েরা ইন জেনারেল অফিস কামাই করে না। দেরি করে আসে। সাজতেগুজতে দেরি হয়।
পাল বাবু মামুনের পাশের চেয়ারটায় বসলেন। পানের কৌটা বের করলেন। হাসিমুখে বললেন পান খাবেন?
জি না।
খান একটা, ভাল জর্দা আছে।
মামুন পান নিল। বসে থাকার চেয়ে পান চিবানো ভাল। জর্দাটা কড়া। চট করে মাথায় ধরেছে। মুখ ভর্তি হয়ে গেছে পানের পিকে। ফেলার জায়গা নেই, গিলে ফেলতেও সাহস হচ্ছে না। পাল বাবু। তরল গলায় বললেন বাড়ি না, অফিসই মেয়েরা বেশি পছন্দ করে। বাড়িতে শতেক রকমের কাজ। ওই রান্না করবে, এই এক গ্লাস পানি দাওরে, এই চা বানাওরে। অফিসে এসব ঝামেলা নেই। মামুন কিছু বলল না, জর্দার রস ভর্তি পিক গিলে ফেলায় তার সত্যি সত্যি বমি বমি লাগছে। সে বলল, এগারটা বিশ বাজে। আজ আর বোধ হয় আসবে না।
যদি আসে কিছু বলতে হবে?
বলবেন ছুটির পর আমার মেসে যেতে। খুব দরকার।
বলব।
পাল বাবু তাকে অফিসের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই লোকটি সম্ভবত ফাঁকিবাজ, শুধু সময় নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এখন আবার এক আমসত্তওয়ালার সঙ্গে দীরদাম করা শুরু করেছে। দর দামের নমুনা দেখেই মনে হচ্ছে কিনবে না। সময় কাটানোর একটা ব্যাপার।
মামুন হাঁটছে ধীরপায়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে। তার মনে ক্ষীণ আশা, হঠাৎ দেখবে মুনা নামছে রিকশা থেকে। কিংবা মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে আসছে অফিসের দিকে। সে সিগারেট কেনার অজুহাতে পান বিড়ির দোকানটির সামনে মিনিট দশেক দাঁড়াল। মুনার দেখা পাওয়া গেল না।
আজকের দিনটাই মাটি হয়েছে। তিনদিনের ক্যাজুয়েল লিভের আজ হচ্ছে প্রথম দিন। কথা ছিল মুনা অফিসে এসে কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে সাড়ে এগারটার দিকে বেরুবে। তারপর দুজনে মিলে বাড়ি দেখতে যাবে কল্যাণপুরে। সেখানে নাকি নশ টাকায় চমৎকার একটা দুরুমের ফ্ল্যাট আছে। কথা দেয়া আছে একটার সময় বাড়িওয়ালা চাবি নিয়ে থাকবেন। হাতে এখনো সময় আছে। নিউ পল্টন থেকে মুনাকে উঠিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু মুনার কঠিন নিষেধ যেন কোনোদিন তার মামার বাড়িতে মামুন না যায়। নিষেধ সব সময় মানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু সে রেগে যাবে। একবার রেগে গেলে তার রাগ ভাঙান মুশকিল। দিনের পর দিন কথা না বলে থাকবে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা কথার জবাব দেবে। তাও এক অক্ষরের জবাব। হ্যাঁ কিংবা না।
মামুন গুলিস্তান থেকে মীরপুরের বাসে উঠল। জর্দা দিয়ে পান খাবার জন্যেই তার মাথাটা হালকা লাগছে। বমি বমি ভােব কাটেনি। কিন্তু সেই সঙ্গে বেশ ক্ষিধেও লেগেছে। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ব্যাপার এক সঙ্গে কিভাবে ঘটছে কে জানে। মামুন একটা সিনেমার কাগজ কিনে ফেলল। প্রথম পাতা জুড়ে তিন রঙা বিশালবীক্ষা মেয়ের ছবি। ভালই লাগে দেখতে।
বলা হয়েছিল মেইন রোডের পাশেই দোতলা বাড়ি। আসলে তা নয়, বেশ খানিকটা ভেতরে যেতে হল। বাড়ি দেখে যে কোনো আশাবাদী মানুষেরই আশাভঙ্গ হবে, মামুনেরও হল। অর্ধসমাপ্ত একটি বাড়ি। সামনে চুনসুড়কির পাহাড়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি এমন যে দু’জন মানুষও পাশাপাশি উঠতে পারে না। বাড়িওয়ালা হাজী সাহেবকেও খুব সুবিধার লোক মনে হল না। যেন বাড়ি দেখানোর তার কোনো গরজ নেই। দুপুর একটায় আসতে হওয়ায় তার যে কত বড় ক্ষতি হল সেই কথা তিনি চার-পাঁচ বার বললেন। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন। বলেছিলেন, আনলেন না কেন?
একটা কাজে আটকা পড়ে গেছে। পরে আসবে।
বাববার তো বাড়ি দেখানো যাবে না। নিতে যদি চান আজই বলবেন। নিতে না চাইলেও আজ বলবেন।
দোতলার বারান্দায় উঠেই মামুন বলল, বাড়ি পছন্দ হয়েছে, আমি নেব।
না দেখেই পছন্দ, ভাল করে দেখেন।
মামুন হৃষ্টচিত্তে ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখল। চমৎকার বাড়ি। দু’টি বিশাল ঘর। দু’টি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচিড বাথরুম। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা স্টোর রুম। চমৎকার একটা বারান্দা। উথালিপাথাল হাওযা খেলছে। হাজী সাহেব বললেন, আপনি আসবেন কবে?
সামনের মাসেব দশ-পনের তারিখেই আসব। কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে যাই আপনাকে?
অ্যাডভান্স দেয়ার দরকার নেই। আর আপনি যদি সামনের মাসের আগেই উঠতে চান বা জিনিসপত্র ব্যাখতে চান রাখবেন। তার জন্যে কোনো বাড়তি ভাড়া দিতে হবে না।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের দরকার নেই। বাড়িটার যত্ন করবেন, সাত তারিখের মধ্যে ভাড়া দিবেন ব্যস। দেশ কোথায় আপনার?
ময়মনসিংহ।
ময়মনসিংহের লোক খুব পাজি হয়। আমার বাড়িও ময়মনসিংহ। তবে আপনি প্রফেসর মানুষ। এটাই ভরসার কথা।