সাহস না মামা, লজ্জা।
লজ্জা? লজ্জার কী আছে। এর মধ্যে?
তুমি বুঝবে না মামা।
বুঝবে না কেন?
মুনা চেয়ার টেনে মামার মুখোমুখি বসল। শওকত সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। মুনাকে কেন জানি তিনি একটু ভয় করেন। মুনা শান্ত স্বরে বলল, এতবড় মেয়ের গাযে হাত তোলা ঠিক না। মামা।
এত বড় মেয়ে কোথায় দেখলি তুই?
মেট্রিক দিচ্ছে তিন মাস পর। সে ছোট মেয়ে নাকি?
নিজের মেয়েকে শাসনও করতে পারব না?
না।
না মানে?
না মানে না। আর কিছু বলবে?
তুই এ বাড়ি থেকে যাবি কবে?
বিয়ে হোক তারপর তো যাব। বিয়ের আগে যাই কী করে? নাকি তুমি চাও এখনই চলে যাই?
শওকত সাহেব সিগারেট ধরালেন। মুনা সহজ স্বরে বলল মামা, তুমি আমার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করছ কেন?
কী রকম ব্যবহার করছি?
কথাটথা বল না। যেন আমাকে চিনতেই পার না।
রোজ রাতদুপুরে বাসায় ফিরবি আর আমি তোকে কোলে নিয়ে নাচব? এটা ভদ্রলোকের বাসা না? পাড়ার লোকের কাছে আমার ইজ্জত নেই?
কয়েকটা দিন মামা। তারপর তুমি তোমার ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারবে।
মুনা উঠে দাঁড়াল।
শওকত সাহেব চুপ করে গেলেন। মুনা বলল, তুমি আর কিছু বলবে? তিনি জবাব দিলেন না। মুনা চলে এল রান্নাঘরে। বাথরুমের দরজা খুলে বকুল বের হয়েছে। তার চোখ-মুখ ভেজা। আচার-আচরণ বেশ স্বাভাবিক। সে আবার তার বাবার কাছে পড়তে গেল। যেন কিছুই হয়নি। শওকত সাহেব শুকনো মুখে মেয়েকে ইংরেজি গ্রামার পড়াতে লাগলেন। বকুল এবার ইংরেজিতে তেইশ পেয়েছে। হেড মিসট্রেস প্রগ্রেস রিপোটো লিখে দিয়েছেন ইংরেজের একজন টিচার রাখার জন্যে।
ভাত চড়াবার আগে মুনা দুকাপ চা বানোল। বাবুকে দিয়ে এক কাপ পাঠাল মামার কাছে। অন্য কাপটি রাখল নিজের জন্যে। বড় ক্লান্ত লাগছে। রান্নার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
খাওয়া-দাওয়া সারিতে রাত হল। ভাদ্র মাস। বিশ্ৰী গরম। গা ঘামে চটচট করছে। মুনা বকুলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের বারান্দায় মোড়া পেতে বসেছে। কিছু বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শোবার ঘর নরক হয়ে আছে। আজ রাতে ঘুমানো যাবে বলে মনে হয় না। বকুল বলল, আপা তোমরা বাসা পেয়েছে?
না। মালিবাগে একটা ফ্ল্যাট দেখলাম। বেশ ভাল, চার তলায়।. খুব হাওয়া, পনেরশ টাকা চায়।
নিয়ে নাও।
নিয়ে নিলে খাব কী? ও বেতনই পায় পনেরশ।
তুমিও তো পাও।
আমি পাই নয়শ পঁচাত্তর। নয়শ পঁচাত্তরে দুজনের চলবে?
বকুল কিছু বলল না। মুনা হালকা স্বরে বলল, মনে হয় বৃষ্টি হবে। বিজলি চমকাচ্ছে। বৃষ্টি নামলে আজ ভিজব।
তোমার টনসিালের দোষ। টনসিল ফুলে যাবে।
যা ইচ্ছা হোক, আজ ভিজব। সারা রাত যদি বৃষ্টি হয়। সারা রােতই ভিজব। দেখিস তুই।
বকুল অস্পষ্ট স্বরে হাসল। মুনা আপার অনেক পাগলামি আছে। রাতের বেলা বৃষ্টি হলেই সে ভিজে অসুখ বাধায়। যেন অসুখ বাধাবার জন্যেই ভিজে। বকুল নিচু গলায় বলল, বাকের ভাই তোমার ব্যাপারে খোজখবর করছিল জানো?
জানি।
খুব নাকি হাম্বিতম্বি করছিল?
মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, হাম্বিতম্বি মানে? সে হস্তিম্বি করার কে? তার অনুমতি নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে?
বাবুকে নাকি কী সব আজেবাজে কথা বলেছে।
কই বাবু তো আমাকে কিছুই বলেনি। আয় তো যাই জিজ্ঞেস করি।
বকুল উঠল না। তার বসে থাকতে ভালই লাগছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হয়ত সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামবে। এই বাড়ির ছাদে টিনের হওয়ায় বৃষ্টির শব্দ চমৎকার পাওয়া যায়। মুনা বিরক্ত স্বরে ডাকল এই চল, জিজ্ঞেস করে আসি বাবুকে।
বাবু তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আরেকটু বাস। তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলব।
বকুল মজার ঘটনা বলতে শুরু করার আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ভদ্র মাসের বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। মুনা বকুলকে নিয়ে ভেতরের উঠোনে ভিজতে নামল। বকুল খানিকটা সংকোচ বোধ করছিল কারণ শওকত সাহেব ভেতরের বারান্দায় চশমা পরে বসে আছেন। বকুলের ধারণা তিনি বাজে ধরনের একটা ধমক দেবেন। কিন্তু শওকত সাহেব তেমন কিছুই করলেন না। তার নিজেরও কেন জানি পানিতে নেমে যেতে ইচ্ছা করছিল। এবং এর রকম একটা ইচ্ছার জন্যে লজ্জিত বোধ করছিলেন। মুনা উঁচু গলায় বাবুকে ডাকল, এই বাবু নেমে আয়। বাবু নামল না। ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল এত ঢং করছিস কেন? আয়।
শওকত সাহেব বাবুকে সুযোগ দেবার জন্যেই হয়ত শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। বাবু বসেছে উঠোনে। বকুল একবার বলল আপা, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। মুনা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল লাগুক।
তোমার টনসিল।
আমার টনসিালের ভাবনা আমি ভাবব। তোর ভিজতে ইচ্ছা না করলে উঠে যা।
তুমি যতক্ষণ থাকবে আমিও ততক্ষণ থাকব।
আমি থাকব। সারারাত।
আমিও।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। বুপকূপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এক সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। বাবু শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল আমি উঠলাম। আপা! উঠতে গিয়ে সে আবার পিছলে পড়ল। খিলখিল করে হেসে উঠল মুনা। অন্ধকার বৃষ্টির রাতে সেই হাসি এমন চমৎকার শোনাল।
মুনার দেখা নেই
দশটা থেকে এগারটা এই এক ঘণ্টা মামুন মুনার অফিসে বসে রইল। মুনার দেখা নেই। অপরিচিত লোকজনদের মাঝে বসে থাকা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। সবাই যে অপরিচিত তা নয়, পাল বাবু তাকে চিনতে পেরেছেন এবং বাকি সবার সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন এই যে ইনি মামুন সাহেব। আমাদের মুনা ম্যাডামের সঙ্গে এনার সামনের মাসে বিয়ে হচ্ছে। কেউ কোনো উৎসাহ দেখায়নি। সম্ভবত মুনার সঙ্গে এদের সম্পর্ক ভাল নয়। পাল বাবু চা এনে দিয়েছেন এক কাপ। চায়ে ঘন সর। তার মধ্যে একটা বেশ তাজা কালো রঙের পিঁপড়া ভাসছে। মামুন আঙুল ডুবিয়ে পিঁপড়া সরাল। চায়ে চুমুক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু সময় কাটানোর জন্যে একটা কিছু করা দরকার। মামুন পিঁপড়াটার দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিল। চায়ে অন্য কোনো পোকা-মাকড় ডুবে থাকলে কেউ সে চা খায় না। কিন্তু পিঁপড়া ডুবে থাকলে কেউ আপত্তি করে না। এর কারণ কী? মামুন সিগারেট ধরাল। এক ঘণ্টার মধ্যে এটা হচ্ছে চতুর্থ সিগারেট। বা পাশের ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে তাকাচ্ছে। তিনি হয়ত সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারেন না। মামুন লক্ষ্য করেছে যে কবারই সে সিগারেট ধরিয়েছে এই লোকটি ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। একে নিৰ্ভয়ে সিগারেট অফার করে ভদ্রতা দেখানো যায়। সিগাটে নেবে না, ভদ্রতাও বজায় থাকবে। মামুন হাসিমুখে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়াল। মামুনকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক সিগারেট নিলেন এবং আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।