বাবু ইতস্তত করতে লাগল। মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, বল কী বলল?
বলল, কী রে তোর আপামণি নাকি বিয়ে করছে?
তুই কী বললি?
আমি কিছু বলিনি।
কিছুই বলিসনি?
বাবু ইতস্তত করে বলল, বলেছি, আমি কিছুই জানি না। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, মিথ্যা বললি কেন? সত্যি কথাটা বলতে অসুবিধা কী? সত্যি কথা বললে সে কী তোকে মারত? আবার যদি কোনোদিন জিজ্ঞেস করে, তুই বলবি, হ্যাঁ বিয়ে করবে। বাবু মুখ ফিরিয়ে নিল, যেন সত্যি কথাটা সে স্বীকার করতে চায় না। এই ব্যাপারটার জন্যে সে যেন লজিত। মুনা কড়া গলায় বলল, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছিস কেন? তাক আমার দিকে। বাবু তাকাল। মুনা হালকা স্বরে বলল, তোরা সবাই এ রকম ভাব করিাস যেন আমি মস্ত একটা অন্যায় করে ফেলেছি। একটা মেয়ে যদি একটা ছেলেকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করে তাহলে তার মধ্যে লজ্জার কিছুই নেই; তুই যখন বড় হবি তখন তুইও এ রকম পছন্দ করে একটা মেয়েকে বিয়ে করবি।
যাও।
তুই দেখি লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছিস।
মুনা। আপা ভাল হবে না কিন্তু।
তুই মুনা আপা মুনা আপা করিস কেন? শুধু আপা ডাকবি। কিংবা বড় আপা। সঙ্গে আবার মুনা কী জন্যে?
আচ্ছা। আপা, তোমাদের বিয়ে কবে?
সামনের মাসে।
বাবু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে মনে হল বেশ লজ্জা পাচ্ছে। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোরা কেউ আমাকে সহ্য করতে পারিস না। বাবু লজ্জিত স্বরে বলল, কী যে তুমি বল।
ঠিকই বলি। ইট বিছিয়ে রাখতে বলেছিলাম, বিছিয়েছিস? সন্ধ্যার পর বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে বলেছিলাম তাও তো রাখিসনি।
বাবু কী যেন বলতে চাইল, মুনা তা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না। মামা-মামির শোবার ঘরে ঢুকল। এই ঘরটিতে কিছু জায়গা আছে। একটা আলমারি, ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল; তার পাশে বিয়েতে পাওয়া পুরনো আমলের ভারী খাট, একটা কালো রঙের আলনা। তবুও কিছু ফাঁকা জায়গা আছে।
মুনা ঘরে ঢুকতেই তার মামি লতিফা হাত ইশারা করে তাকে কাছে ডাকলেন। তার হাত ইশারা করে ডাকার ভঙ্গি ও তাকানোর ধরন-ধারণ দেখেই টের পাওয়া যায় কিছু একটা ঘটেছে। মুনা বিছানার পাশেই বসল।
মামি শরীর কেমন?
ভালোই।
জ্বর আসেনি তো?
উঁহু।
মুখে উঁহু বললেও বোঝা যাচ্ছে গায়ে জ্বর আছে। চোখ লালচে। কপালের চামড়া শুকিয়ে খড়খড় করছে। চারদিকে অসুস্থ অসুস্থ গন্ধ। লতিফা তার রোগা হাতে মুনার হাত চেপে ধরলেন। গলার স্বর অনেক খানি নিচে নামিয়ে বললেন, তোর মামা যায় নাই।
কেন, যায়নি কেন?
আমি কী করে বলব?
আংটি দেখিয়েছিলো?
হুঁ! আংটি দেখে আরো রাগ করেছে। বাবু সামনে পড়ে গেল তখন। রাগের চোটে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলেছে খাটে। জিব কেটে গেছে বোধ হয়। রক্ত পড়ছিল।
বল কী?
হুঁ।
লতিফা কান্নার মত শব্দ করতে লাগলেন। মুনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করল। আজ দুপুরে লতিফার বড় ভাই মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের ছোট মেয়ের আকিকা। সেই উপলক্ষে এ বাড়ির সবার দাওয়াত ছিল। শওকত সাহেব যেতে রাজি হলেন না। দাওয়াত প্রসঙ্গে অত্যন্ত তেতো ধরনের কিছু কথা বললেন, ফকির খাওয়ানোর বদলে আমাদের খাইয়ে দিচ্ছে। তু বলে ডাকলেই যাব নাকি? পেয়েছি কী আমাকে? আমি ভিখিৱি নাকি? আমি তো যাই না। এ বাড়ির কেউ যদি যায় ঠ্যাং ভেঙে দেব।
লতিফা এই জাতীয় কথায় বিশেষ কান দেননি। তাঁর বড় ভাই তাকে করুণার চোখে দেখে বলেই হয়ত গোপন সঞ্চয় ভেঙে মুনাকে দিয়ে একটা আংটি কিনিয়ে এনেছিলেন। তার আশা ছিল রাগটোগ ভাঙিয়ে দুপুরের দিকে পাঠাতে পারবেন। কিন্তু পারেননি।
মুনা উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, তুমি খাওয়া-দাওয়া কিছু করেছ? লতিফা জবাব দিলেন না। মুনা বলল, কাল অফিসে যাবার সময় আংটি দিয়ে আসব আর বলব তোমার অসুখের জন্যে কেউ আসতে পারেনি। কথাটা তো মিথ্যাও না। লতিফা কী যেন বললেন। মুনা শোনার অপেক্ষা না করে রান্নাঘরে চলে গেল। ভাত চড়াতে হবে। কাজের ছেলেটি চলে যাওয়ায় খুব ঝামেলা হচ্ছে। সারাদিন অফিস করে চুলার পাশে এসে বসতে ইচ্ছা করে না। বড় খারাপ লাগে।
মুনা আপা, বাবা ডাকে।
মুনা দেখল বাবুর মুখ রক্তশূন্য। যেন বড় রকমের কোনো বিপদ আশংকা করছে সে। মুনা স্বাভাবিক ভাবেই বলল, এখন যেতে পারব না। ভাত চড়াচিছে, দেরি হবে।
না, তুমি এখন চল।
কী ব্যাপার?
বাবু কিছু বলল না। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য চেহারা। সে বেশ ভয় পেয়েছে।
শওকত সাহেব চেয়ারে পা তুলে শক্ত হয়ে বসে আছেন। ছোটখাটো মানুষ। মাস তিনেক আগেও স্বাস্থ্য ভাল ছিল। এখন অসম্ভব রোগা হয়ে গেছেন। গালটাল ভেঙে একাকার। চুল উঠতে শুরু করেছে। মাথা ভর্তি চকচকে টাকের আভাস। মেজাজও হয়েছে খারাপ। কথায় কথায় রেগে ওঠেন। গতকাল প্ৰায় বিনা কারণে কাজের ছেলেটিকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
শওকত সাহেবের চোখে চশমা। এটি একটি বিশেষ ঘটনা। কারণ চশমা তিনি পরেন না। তাঁর ধারণা চশমা পরলেই চোখ খারাপ হতে থাকবে এবং বুড়ো বয়সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যেতে হবে। আজ হঠাৎ চশমা চোখে দেয়ার কারণ স্পষ্ট নয়। খুব সম্ভব পরিবেশ বদলাতে চাচ্ছেন।
মুনা ঢোকা মাত্র তিনি ইশারায় তাকে বসতে বললেন। মুনা বসল না। শওকত সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, তুই আমার ছেলেমেয়েগুলিকে নষ্ট করছিস।
কীভাবে?
তোর কাছ থেকে সাহস পেয়ে এরা এ রকম করে। সামান্য একটা চড় দিয়েছি, এতেই মেয়ে উঠে গিয়ে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এত বড় সাহস।