গোসতের লবণ একটু দেখবে আপা।
আমি দেখতে পারব না, তুই দেখ! চুলা খালি থাকলে আমাকে একটু চা করে দে। মাথা ধরেছে। আমি শুয়ে থাকব।
মামুন ভাই এত দেরি করছে কেন আপা? তুমি কখন আসতে বলেছ?
মুনা তার কথার জবাব না দিয়েই চলে গেল। বকুল ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। গত কয়েক দিন থেকেই মুনা আপা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। কেন করছে কে জানে। রেহানা আপা ছবি চাইলে সে কী করতে পারে? সে তো বলতে পারে না না। আপনি ছবি চাইতে পারবেন না। কেন ছবি চাইবেন?
বকুল চায়ের কাঁপে চা ঢালল। আর তখনই বাবু এসে গম্ভীর স্বরে বলল–ডাক্তার সাহেব এসেছে। বকুলের হাত কেঁপে গেল। বাবুর মুখ রাগী রাগী। যেন ডাক্তারের আসা একটা অপরাধ। এবং এর জন্যে বকুল দায়ী। বকুল বলল, ডাক্তার এসেছে তো আমি কি করব? বাবু বলল, কথা বলছে বাবার সঙ্গে।
বলছে বলুক, যা তুই মুনা। আপাকে চা দিয়ে আয়।
বাবু আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে কেন?
বকুল চমকে উঠল। ক্ষীণ স্বরে বলল, কে বলল?
আমি দেখলাম।
ডেকেছিল তাই গিয়েছিলাম।–কী হয়েছে তাতে?
আমি মুনা। আপাকে বলে দেব।
দিস। যা এখন চা নিয়ে যা।
বাবু চা নিয়ে চলে গেল। সে অবশ্যি মুনা আপাকে কিছুই বলবে না। তার স্বভাবের মধ্যে এটা নেই। একজনের কথা অন্যজনকে কখনো বলবে না। তবু বকুলের হাত-পা কাঁপতে লাগল।
ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা এমন কিছু নয়। সে স্কুল থেকে ফিরছিল চিশতি মেডিকেল কর্নারের কাছে আসতেই দেখে ডাক্তার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখেই ডাকলেন, এই যে বকুল, এই! এস দেখি। বকুল নিশ্চয়ই না-শোনার ভান করে চলে যেতে পারে না। সে গিয়েছে। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, ইস ঘেমে-টেমে কি অবস্থা। ভেতরে এসে ফ্যানটার নিচে দাঁড়াও তো। ঠাণ্ডা কিছু খাবে? বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, জি না। তিনি শুনলেন না। একটা ছেলেকে পাঠালেন খুব ঠাণ্ডা দেখে এক বোতল পেপসি কিংবা কোক নিয়ে আসতে। বকুল বলতে গেলে কোনো কথাই বলেনি। পেপসি অর্ধেক শেষ করে চলে এসেছে। ভয়ে তার সমস্ত শরীর কঁপিছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। তার ধারণা ছিল কেউ দেখেনি। কিন্তু ধারণা সত্যি নয়। বাবু দেখেছে। বকুলের কান্না পেতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল এক্ষুণি কেউ এসে বলবে, ডাক্তার সাহেব তোমাকে ডাকে। কিন্তু কেউ সে রকম কিছু বলল না। বকুল নিজের মনে রান্না সারতে লাগল। সে ভেবে পেল না। তাকে নিয়ে কেন এত ঝামেলা হচ্ছে।
বাবু এসে বলল, ডাক্তার সাহেবকে এক কাপ চা দাও। বকুল নিঃশব্দে চা বানাতে লাগল। বাবু বলল, ডাক্তার সাহেব মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। তার এক বোনের মেয়ে হয়েছে এই জন্যে। বকুল কিছুই বলল না।
কড়া নাড়ার শব্দে মামুনের ঘুম ভাঙল। সে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়েছিল। চারদিক অন্ধকার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে নাকি? মামুন ক্লান্ত স্বরে বলল, কে?
আমি। আমি মুনা।
মামুন তেমন কোনো আবেগ অনুভব করল না। আজ দুপুরে ওদের ওখানে খেতে যাবার কথা। যাওয়া হয়নি। তার জন্যে তেমন অনুশোচনাও হল না।
মুনা বলল, কি হয়েছে তোমার?
কিছু হয়নি।
যাওনি কেন?
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীরটা ভাল না;
মামুন হাই তুলল। টেনে টেনে বলল, এস ভেতরে এসে বস।
মুনা একবার ভাবল বলবে না বসব না। এবং গভীর মুখ করে চলে যাবে। কিন্তু যেতে পারল না। মুখ ভর্তি দাড়িতে এমন অদ্ভুত লাগছে মামুনকে। মুখের ভাব ধরা যাচ্ছে না। মুখ কেমন রোগা রোগা। সারাদিন ঘুমানোর জন্যে চোখ লাল। মুনা ভেতরে ঢুকাল।
বস, চেয়ারটায় বস। চা খাবে?
হুঁ।
কাউকে পেলে হয়। ছুটির দিন তো। লোকজন থাকে না। এই বলেই মামুন বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল, যেন খুব-একটা হাসির কথা। মুনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল।
তুমি বসে থাক। আমি হাত-মুখটা ধুয়ে আসি। একা একা বসে থাকতে ভয় লাগবে না তো?
ভয় লাগবে কেন?
মামুন আবার হেসে উঠল। সুস্থ মানুষের হাসি না। ছাড়া ছাড়া হাসি; হাসার সময় কেমন অদ্ভুত ভাবে গা দোলাচ্ছে। r
হাত-মুখ ধুতে মামুনের অনেক সময় লাগল। তার মনেই রইল না ঘরে একজন অপেক্ষা করছে। কাজের ছেলেটি দুকাপ চা দিয়ে গেছে। সেই চা পিরিচ ঢেকে রাখা সত্ত্বেও জুড়িয়ে জল হয়েছে।
মামুন বিস্বাদ ঠাণ্ডা চাতেও চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুনা বলল, চা ভাল লাগছে?
হ্যাঁ ভালই তো।
ঠাণ্ডা না?
একটু অবশ্যি ঠাণ্ডা।
আগে তো ঠাণ্ডা চা মুখেই দিতে পারতে না।
মামুন চুপ করে রইল। মুনা বলল, দুপুরে কিছু খেয়েছে?
না!
কেন, খাওনি কেন?
ঘুমিয়ে পড়লাম। দশটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্ষিধেও হয়নি।
এখন হয়েছে?
হুঁ।
চল আমার সঙ্গে।
কোথায়?
আমাদের বাসায়। রাতে খাবে।
ঠিক আছে চল।
কাপড় বদলাতে বদলাতে মামুন বলল, তোমার শরীর ভাল মুনা?
হ্যাঁ ভাল।
টনসিালের ঐটা কমেছে, তাই না?
হ্যাঁ। তুমি দাড়ি রেখেছ কেন?
দাড়ি রাখব কেন? কয়েক’দিন কাটা হয়নি সেই জন্যে।
তোমাদের বাড়ির খবর কি বল।
বাড়ির কোনো খবর নেই। ছোট বোনটা মারা গেছে।
ওর কথা তো তুমি আমাকে কখনো কিছু বলনি।
মামুন চুপ করে রইল।
মুনা বলল, তুমি নিজের কথা কখনো কাউকে কিছু বল না। এটা ঠিক না। এতে মনের ওপর চাপ পড়ে।
হুঁ।
তোমার ভাই-বোনদের কথা আমি কিছুই জানি না।
মামুন চাপা স্বরে বলল, ঐ একটি বোন আমার। মরবার সময় খুব কষ্ট পেয়েছে। খুব কষ্টের মৃত্যু।