কি যে কাণ্ড তোমার। একটা খবর দিলে চলে আসতাম না? রাত দিন থাকতাম। খবর দিবে না। কিছু না।
জ্বরের সময় আমি আরেকটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে আপনাকে আমি খুব পছন্দ করি। আপনার মত বাজে ধরনের একজন মানুষকে এতটা পছন্দ করি ভেবে নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল।
রাগ হওয়ার কথা।
তারপর মনে হল আপনার মত ভাল মানুষই বা কজন আছে। আপনি যে একজন ভালমানুষ সেটা কী আপনি জানেন?
কি সব কথাবার্তা তুমি বলছ?
সবদিন কি এইসব কথা বলা যায়? হঠাৎ এক আধাদিন বলতে ইচ্ছা করে। বাকের ভাই আমি খুব একলা হয়ে পড়েছি। আর পারছি না।
মুনার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বাকের কি বলবে কিছু বুঝতে পারল না। কী বললে মুনা খুশি হবে? সে যা করতে বলবে তাই করবে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে বললে লাফিয়ে পড়বে।
ঝড়বৃষ্টি আসবে বাসায় চলে যান। আপনার বাসা তো আবার নেই। কোন একটা দোকানেটোকানে গিয়ে উঠে পড়ুন। ঐ কাঠের দোকানেই তো এখন থাকেন?
হ্যাঁ।
আপনাকে এই রকম আর আমি থাকতে দেব না। সুন্দর একটা একতলা বাড়ি ভাড়া করব। সারাদিন যত ইচ্ছা গুণ্ডামি করবেন। সন্ধ্যার পর ফিরে আসবেন। রাতে দু’জন মুখোমুখি বসে ভাত খাব।
মুনার গলা ধরে এল। কথা শেষ করতে পারল না। বাকের একটা ঘোরের মধ্যে তার ঘরে ফিরে এল। বৃষ্টি হচ্ছিল সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। কাদায় পানিতে মাখামাখি। অথচ কিছুই বুঝতে পারছে না। ভেজা কাপড়েই সে তার বিছানায় বসে আছে। ঘোর কাটল রাত তিনটার দিকে।
পুলিশের বাঁশি বাজছে। ওসি সাহেব দরজায় লাথি দিচ্ছেন। পুলিশ কর্কশ গলায় ডাকছেন–বাকের, এই বাকের।
বাকের দরজা খুলতেই তাকে অ্যারেস্ট করা হল। অভিযোগ গুরুতর। জোবেদ আলি খুন হয়েছে। খুন করার দৃশ্য এবং খুনির পালিয়ে যাবার দৃশ্য তিনজন দেখে ফেলেছে। তিনজনই বলছে– খুন করছে বাকের।
বাকেরের এই মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলল। ডেটের পর ডেট পড়ে। মামলা পরিচালনা করলেন মুনার সেই পরিচিত উকিল। কখনো তিনি মুনাকে বললেন না যে মামলা টিকবে না। উল্টোটাই বললেন। একবার না। অনেকবার বললেন। বলার সময় প্রতিবারই কিছুটা বিষন্ন হলেন।
ব্যাপারটা কি জানেন, ওরা মামলাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। আমি কোন ফাক ধরতে পারিনি। মোটিভ আছে প্রত্যক্ষদশীর সাক্ষী আছে। মিথ্যা মামলার সাজানোটাই হয় অসাধারণ। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি আপনাকে মিথ্যা কোন আশ্বাস দিতে যাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কনভিকশন হয়ে যাবে।
উকিলের মুখ বিষন্ন দেখা যায়।
বিষন্ন দেখায় না। শুধু বাকেরকে। মুনার সঙ্গে তার যতবারই দেখা হয় সে ততবারই বলে, কোনমতে যদি বের হতে পারি তাহলে সিদ্দিক শালাকে পুতে ফেলবে। তবে আমাকে আগেই যদি ঝুলিয়ে দেয় তাহলে তো কিছু করার নেই।
ভয় লাগে না বাকের ভাই। যদি সত্যি সত্যি…
আরে না। ভয় লাগে না।
সত্যি ভয় লাগে না।
রাতের বেলা একটু গা ছমছম করে। রাতের বেলা ফাঁসি দিলে একটা ভয়ের ব্যাপার হত। ফাসিটা তো দিনে দেয়। তাই ভয়টা থাকে না।
পাগলের মত কথাবার্তা বলছেন বাকের ভাই।
পাগলের মতো বলব কেন এটা হচ্ছে ট্রথা। রাতের বেলা মরা খুবই ভয়ংকর। দিনের মৃত্যু কিছু না। সিদ্দিক শালাকে আমি রাতের বেলা মারব। ওয়ার্ড অব অনার।
মামলা চলতে থাকে।
মুনা অপেক্ষা করে।
ক্লান্তির অপেক্ষা। দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রজনী কিছুতেই যেন মার কাটে না।
আশা ও আনন্দের কথায় ভর্তি করে সুন্দর সুন্দর চিঠি লেখে বকুল। তার ছেলের কথা লেখে, ছেলের দুষ্টামির কথা লেখে, জহির যে ক্রমে ক্রমেই সেরে উঠছে সে কথাও লেখে। সে নিজেও সেরে উঠেছে। সেই কথাও থাকে।
এখন সে আর পুরনো দুঃস্বপ্ন দেখে না। স্বামীর গায়ে হাত রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তাকে সাবধান করে দিতে অশরীরী কেউ আর আসে না। কত সুন্দর সুন্দর চিঠি কিন্তু মুনার পড়তে ভাল লাগে না।
চিঠি লিখে জাহানার নামের অপরিচিত একটি মেয়ে। অচেনা একজন কিন্তু বড় চেনা একজন। বড় সুন্দর করে সে লেখে–আপা, আমরা দু’জন কিছু কী করতে পারি আপনার জন্যে? আপনার জন্যে ও বড় কষ্ট পচ্ছে। একটা কিছু করার সুযোগ আপনি ওকে দিন। বাকের সাহেবের মামলা যেদিন কোর্টে উঠে ও সেই সব দিনগুলিতে মামুন কোর্টে উপস্থিত থাকে। লজ্জায় আপনার সামনে যেতে পারে না। এক’দিন সে বলল, আপনি নাকি খুব কাঁদছিলেন বলতে বলতে সেও খুব কাদল। আপা, আপনি ওকে কিছু করার সুযোগ দিন।
এই মেয়েটির চিঠি পড়তে তার ভাল লাগে। কিন্তু জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বড় আলস্য লাগে। মাঝে মাঝে এমন ক্লান্তি লাগে যে কোর্টে যেতে পর্যন্ত ইচ্ছা করে না। তবু তাকে যেতে হয়। এক কোণে বসে থেকে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে হাই গোপন করতে। কোর্ট থেকে বেরুতে বেরুতে কোন কোন দিন তিনটা সাড়ে তিনটা বেজে যায়। ক্ষিধেয় শরীর কেমন করতে থাকে। কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। ঝিম ধরা দুপুরে সে রাস্তায় একা একা হাঁটে।
হাঁটতে হাঁটতেই কোনো কোনো দিন হঠাৎ সুখের কোনো কল্পনা মাথায় চলে আসে যেন সে রিকশা করে যাচ্ছে হঠাৎ পথে বাকেরের সঙ্গে দেখা। বাকের তাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে। উৎসাহ নিয়ে বাকের বলল–যাচ্ছ কোথায়?
মুনা বলল, তা দিয়ে আপনার দরকার কি?
না কোনো দরকার নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
বলতে বলতে বাকেরের মুখ একটু যেন বিষন্ন হয়ে গেল। মুনা বলল, আপনার কোনো কাজ না থাকলে আসুন তো আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাব।