বকুল মাথা কাত করল। লজ্জায় তার মুখে কথা ফুটছে না। ডাক্তার সাহেব বললেন, এক মাস পর যখন আসবে তখন বাচার হাট বিট তোমাকে শুনিয়ে দেব। আর এক মাস পর থেকেই হার্টবিট করতে শুরু করবে। নিজের বাচার হার্টবিটি শোনা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা।
বকুল ফিসফিস করে বলল, কিভাবে শুনব?
খুব সোজা। ঐদিন টের পাবে।
মুনা ডাক্তার সাহেবের কথাবার্তায় বেশ অবাক হচ্ছে। কোন ডাক্তার রুগীর সঙ্গে এত আগ্রহ নিয়ে কথা বলেন না। ইনি বলছেন। এমন না যে এর কাছে রুগী আসে না। অনেক’দিন পর একজন রুগী পাওয়া গেছে। ডাক্তার সাহেবের চেম্বার রুগীতে ভর্তি। নম্বর লেখার স্লিপ হাতে নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে।
বকুলের জন্যে এই ডাক্তার এতটা আগ্রহ কেন দেখালেন?
চলে আসবার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে মৃদু গলায় বললেন, রিকশায় চলাফেরা করলে সাবধানে করবে যেন ঝাকুনি না লাগে। কেমন?
পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে! সেই সব রহস্যের একটা হচ্ছে মানবিক সম্পর্ক। এর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। হঠাৎ যে কোনো একজন মানুষের জন্যে হৃদয় মমতায় উদ্বেলিত হতে পারে।
মুনা, ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, চল বকুল তোর বাচ্চার জন্যে কিছু একটা কেনা যাক।
বকুল লজ্জিত গলায় বলল, কি কিনবে?
চল নিউ মার্কেটে গিয়ে দেখি কি পাওয়া যায়। আমি তো ছাই জানিও না।
লজা লাগে যে আপা।
লজ্জার কী আছে? তাছাড়া তোরই যে বাচ্চা তাও তো কেউ বুঝবে না।
নিউ মার্কেট থেকে কিনবে না। কিনবে না করেও অনেক কিছু কেনা হয়ে গেল। যাই দেখে তাই বকুলের পছন্দ হয়ে যায়। নিচু গলায় বলল, এটা কিমব আপা, বেবি সোপ। এত দাম গাচ্ছে। থাক লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করলেই হবে। এত বাবুয়ানির দরকার নেই। বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুনাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কিনে নে।
এই টাওয়াল কিনব। আপা? হাত দিয়ে দেখি কত নরম।
পছন্দ হলে নে।
পরে কিনলেও তো হবে। এত আগেভাগে কিনে লাভ কী আপা?
তাহলে পরে কিনব।
কিন্তু পরে যদি না পাওয়া যায়। ভাল জিনিস কিছুই থাকে না।
তাহলে কিনে ফেলাই ভাল।
গভীর সুখ ও গভীর আনন্দে বকুলের চোখ ঝলমল করে। তার দিকে তাকিয়ে মুনার বড় মায়া লাগে। পুঁটলা পুটলি সব বকুলের নিজের হাতে। মুনার কাছে দিতে রাজি না। মুনা বলল, তোর কষ্ট হচ্ছে কিছু আমার কাছে দে।
বকুল হাসিমুখে বলল, কষ্ট হচ্ছে না আপা। তাছাড়া পরিশ্রম করার দরকার। ডাক্তার সাহেব তো। তাই বললেন।
কিছু খাবি ক্ষিধে পেয়েছে?
হুঁ পেয়েছে? ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছ করছে।
চল কিছু খাই।
ঝাল খেলে বাচার আবার ক্ষতি হবে না তো আপা? ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল। বাসায় ফেরার পথে একবার থেমে জিজ্ঞেস করে যাব আপা?
তা করা যেতে পারে।
কাঠের একটা দোলনা বানাতে দিতে হবে। তুমি এ রকম করে হাসছ কেন আপা?
যা আর হাসব না।
তোমার অনেক টাকা খরচ করিয়ে দিলাম।
তা দিলি। কি আর করা।
তুমি আবার মনে মনে আমার ওপর রাগ করছ না তো?
করছি।
বকুল হাসল। চমৎকার হাসি। মুনার মনে হল এত সুন্দর করে বুকল এর আগে কখনো হাসেনি। সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে তার মুখে। গায়ে হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি। সেই নীল রঙের আভা পড়েছে তার মুখে-চমৎকার ছবি।
জহির বৃহস্পতিবার ভোরে এসে উপস্থিত। তার দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠতে হয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনেক দিন চুল কাটা হয়নি বলেই মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। এই গরমে গায়ে হলুদ রঙের ময়লা একটা কোট। বাসায় পা দিয়েই প্রথম যে কথাটি বলল তা হচ্ছে–বিরাট ভুল হয়ে গেল। নিতান্ত বেকুবের মতো কাজ করেছি। ছিঃ ছিঃ!
বেকুবের মতো কাজ আর কিছুই না। সঙ্গে সে একটা মাছ নিয়ে এসেছিল। রুই মাছ। ট্রেনে সিটের নিচে রাখা ছিল। নামার সময় মাছ না নিয়েই নেমে এসেছে।
মুনা বলল, এখন আর আফসোস করে কি হবে? মাছ গেছে গেছে। রুই মাছ ঢাকাতেও পাওয়া যায়। তোমার এই অবস্থা কেন? দেবদাসের মতো লাগছে।
গালে অ্যালার্জির মত হয়েছে। আপা–ব্লেড ছুলেই ফুলে ওঠে। এই জন্যে দাড়ি কাটা বন্ধ। মন মেজাজও খারাপ।
কেন?
পর পর দুটো মামলায় হেরেছি। তৃতীয় একটা শুরু হয়েছে। এটাতেও মনে হচ্ছে হারব। ঢাকা আসার মূল কারণ হচ্ছে বড় বড় উকিল ধরব।
টেলিগ্রাম পাওনি?
না তো। কিসের টেলিগ্রাম?
ঠিক আছে, পরে শুনবে। যাও মুখ ধোও। দয়া করে কাপড়গুলিও বদলাও। এত ময়লা কাপড় তোমার আছে জানতাম না।
জহির টেলিগ্রামের বিষয়ে কোন রকম আগ্রহ প্রকাশ করল না। গোসল করে পর পর দুকাপ চা খেয়ে চাদর গায়ে ঘুমিয়ে পড়ল। টানা ঘুম। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন সে আরাম করে ঘুমুতে পারছে না।
মুনা অফিসে যাবার আগে বকুলকে বলে গেল ঘুম ভাঙলেই সব গুছিয়ে বলবি। জহিরের মনটন খুব খারাপ। খরবদার ঝগড়া-টগরা করবি না।
বকুল অবাক হয়ে বলল, শুধু শুধু ঝগড়া করব কেন?
জহির রেগে কিছু বললে ও চুপ করে থাকবি।
ওইবা রেগে রেগে কথা বলবে কেন? রাগ করবার মত আমি কী করলাম?
তুই বড়ই বোকা বকুল। এই রকম বোকা হলে তো মুশকিল।
তোমার মতো চালাক হলে আপা মুশকিল। চালাক মেয়েরা বিয়ে-টিয়ে কিছুই করতে পারে না। একা একা থাকে এবং মনে করে বিরাট একটা কাজ করা হল।
মুনা, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কি অদ্ভুত কথা বকুলের। চোখ-মুখ শক্ত করে কথা বলছে। আগের বকুলকে এখন আর চেনা যাচ্ছে না। মুনা কিছু বলল না। বাবুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। বাজার করে বাবুকে পাঠাবে। ঘরে প্রায় কিছুই নেই। আজও নিশ্চয়ই অফিসে যেতে দেরি হবে।