ঘুমুচ্ছিস নাকি বকুল?
বকুল বিছানায় উঠে বসল। মুনা আপা গম্ভীর মুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে।
কিছু বলবে আপা?
তোর কি হয়েছে বল তো?
কী আর হবে কিছু হয়নি।
জহির কী রাগ করে চিঠিতে কিছু লিখেছে?
না তো। বিশ্বাস না হলে তুমি চিঠি পড়ে দেখ আপা। এনে দেই? ড্রয়ারে আছে।
না। এনে দিতে হবে না। তোর কি বাচ্চ-কাঁচা হবে? বল তো ঠিক করে।
বকুল অবাক হয়ে বলল, বাচ্চ-কাচ্চা হবে কী জন্যে?
মুনা বিরক্ত গলায় বলল, যা জিজ্ঞেস করেছি। তার জবাব দে। হ্যাঁ বা না বল।
না।
নেত্রকোনা যেতে ইচ্ছে করছে? জহিরের কাছে?
না।
ইচ্ছা না করলেও যেতে তো হবে। সারা জীবন এখানে পড়ে থাকবে? তোর নিজের ঘর-সংসার আছে না?
কী করে যাই আপা। আমার তো শরীর খারাপ। মাথার ঠিক নেই।
মাথা খুব ঠিক আছে।
আজেবাজে। জিনিস যে দেখি।
এখন তো আর দেখছিস না।
ঐখানে গেলেই দেখব।
তাহলে আবার চলে আসবি।
আচ্ছা। তুমি যা বল তাই
বকুল একটু আগে বন্ধ করা বই আবার মেলে ধরল। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। আপা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
মুনা বলল, একটা দিন ঠিক করে বাবুকে নিয়ে চলে যা। বাকের ভাইও সঙ্গে যাবে। নয়ত জহির রাগ করবে। কে জানে হয়ত করেও বসেছে। রাগ না করলে এর মধ্যে এখানে একবার আসত।
রাগ করেনি।
রাগ না করলেই তো ভালই।
মামলায় হার হয়েছে এই জন্যে মনটন খারাপ। আরেকটা কী মামলা দিয়েছে। ঐটাতোও হারবে।
কে বলল হারবে?
আমার মনে হচ্ছে। একবার হারাতে শুরু করলে হারিতেই হয়।
তোকে বলল কে?
কেউ বলেনি। আমি জানি আপা। পান খেতে ইছে হচ্ছে। বাবুকে পাঠিয়ে একটা পান আনাও তো। ঐ বাড়িতে থেকে থেকে আমার পান খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমিও একটা খাও আপা। ঠোট লাল হবে। দেখতে সুন্দর লাগবে।
মুনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরুল। যতই দিন যাচ্ছে বকুলের ছেলেমানুষি ততই বাড়ছে। মানুষের বয়স বাড়ে বকুলের বয়স কমছে। শরীরও খারাপ হচ্ছে। এই বয়েসী মেয়েদের চোখে-মুখে যে উজ্জ্বল আভা থাকে বকুলের তা নেই।
রাতে খেতে বসেও খানিকক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে বকুল উঠে পড়ল। মুনা বলল, কী হয়েছে রে?
পেট ব্যথা করছে আপা?
পেট ব্যথা করছে?
হুঁ।
বেশি?
না বেশি না।
দুপুরেও তো খাসনি।
শোবার আগে এক গ্লাস দুধ খাব। আপা ওতেই হবে।
মুনা দুধ নিয়ে নিজেই গেল। বকুল বিনা বাক্যে ব্যয়ে দুধ শেষ করে হঠাৎ নিচু গলায় বলল, তুমি যা বলছিলে তাই সত্যি আপা।
আমি কি বলছিলাম।
ঐ যে দুপুরে বললে। বাচ্চা হবার কথা।
সে কি?
এখন কি করব। আপা?
কি করাবি মানে? করাকরির কি আছে?
বাবুকে মিষ্টি দিয়ে একটা পান আনতে বল তো আপা। খেতে ইচ্ছে করছে। আলাদা করে যেন জর্দা আনে। আমি নিজেই বাবুকে বলতাম। কিন্তু এখন ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে হয়েছে সমস্যা।
বকুল হাসছে। কেমন অদ্ভুত ভয় এবং সংকোচ মেশানো হাসি। মুনা এসে বলল বকুলের পাশে। বকুল প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, রাগ করনি তো আপা?
রাগ করব কেন?
বাচা হচ্ছে যে এই জন্যে।
পাগলের মতো কথা বলছিস কেন রে বকুল? তুই কী পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি?
হ্যাঁ আপা পাগল হয়ে যাচ্ছি। পুরোপুরি যেদিন হব সেদিন বুঝবে। আমাকে একটা পাগলাগারদে রেখে আসতে হবে।
বকুল এবার কাঁদতে শুরু করল। শিশুদের কান্না। সবাইকে জানাতে হবে যে কান্না শুরু হয়েছে। চোখে পানি তেমন থাকবে না। ফুপানোর শব্দ থাকবে, না ফুপানোর শব্দ থাকবে, শরীর বারবার দুলে উঠবে। আশপাশের সবাই বুঝবে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে।
কাঁদছিস কেন রে বকুল?
মনের দুঃখে কাঁদছি।
এত কি তোর মনে দুঃখ যে কাঁদতে হবে?
তাহলে যাও মনের আনন্দে কাঁদছি।
মুনা হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে বকুলেরও হাসি পেলে গেল। অনেক কষ্টে সে হাসি৷ থামিয়ে রাখল। মুনা বলল, কাল ভোরে তোকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তারপর জহিরুকে টেলিগ্ৰাম করব চলে আসতে। বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তুই থাকবি আমার কাছে।
আমার বুঝি ঘর-সংসার নেই আপা?
একটু আগেই না থাকতে চাচ্ছিলি।
একন চাচিছে না।
বেশ তো জহির এসে নিয়ে যাবে। য
মুনা, বকুলের হাত ধরে খানিকক্ষণ বসে রইল। মুনার মুখ এখানো হাসি হাসি। বকুল খাকিনকটা গম্ভীর হয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না।
কিছু বলবি বকুল।
হুঁ।
কী বলবি বলে ফেল।
বাবু যেন কিছু জানতে না পরে আপা।
বাবু জানলে কী?
লজ্জা লাগে আপা।
বকুল, মুনাকে জড়িয়ে ধরল। তার গা কাঁপছে। হয়ত আবার কাঁদবে। কিংবা কে জানে হয়ত আনন্দে হাসছে। বকুলের হাসি কান্নার কোন ঠিকঠিকানা নেই।
বুড়ো ডাক্তার সাহেব খুব আগ্রহ করে বকুলকে অনেক কিছু বললেন, সকাল-বিকাল হাঁটতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম খুব প্রয়োজন এতে রক্তের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা বাড়ে। শরীর সুস্থ থাকে। সুষম খাদ্যও খুব ইম্পর্টেন্ট। সেই সঙ্গে দরকার মানসিক প্রশান্তি।
তিনি বকুলকে একটা চটি বই দিলেন মা ও শিশু। বইটির মলাটে একটি শিশুর ছবি যে মার দুধ খাচ্ছে। লজ্জায় লাল হয়ে বকুল বই হাতে নিল। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বয়স কত?
ষোল।
এত অল্প! আজিকাল তো এ বয়সে মেয়েরা মা হচ্ছে না। তবে মা হবার জন্যে বয়সটা খারাপ ও না। তুমি কিন্তু খুকি প্রথম বাচ্চার পর খুব সাবধান হবে। শিশু দিয়ে দেশ ভর্তি করে ফেলার কোন মানে হয় না। এক মাস পরে আবার আসবে।