জাহানারার বড় ভাল লাগে। তার বলতে ইচ্ছে করে, তুমি এত দূরে বসে আছে কেন? ব্যথায় মরে যাচ্ছি। আর তোমার একটু মায়া লাগছে না? আরো কাছে আসা। দেখ তো জ্বর আর বাড়ল কিনা। কপালে হাত দিলে কোন পাপ হবে না।
দুর্ঘটনা শুরুতে যত সামান্য মনে হয়েছিল দেখা গেল তা মোটেই সামান্য নয়। পা ফুলে উঠল। দুদিনের মাথায় ঘা বিষিয়ে গেল। তৃতীয় দিনের দিন ভর্তি করতে হল হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তাররা ঘা দেখে চমকে উঠলেন।
এক রাতে আধো ঘুম আধা জাগরণের মধ্যে জাহানারা শুনল বুড়ো মতো একজন ডাক্তার বলছেন–আর একটা দিন দেখব তারপর এম্পুট করে ফেলব। গ্যাংগ্রিনের সূচনা।
জাহানারা চেঁচিয়ে বলতে চাইল–দয়া করুন, আমার পা কাটবেন না। বলতে পারল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। সমস্ত শরীরে ভয়াবহ ক্লান্তি পায়ে কোন ব্যথা নেই। মাথায় ভোতা যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার ধরনটাও অদ্ভুত। তেমন যে নেশা লেগে যায়।
মনে হয় থাকুক না। আর শুধু ঘুমুতে ইচ্ছা করে। শরীরের প্রতিটি কোষ আলাদা আলাদা ভাবে ঘুমুতে চায়।
এগার দিনের দিন জাহানারা পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পেল। তার বিছানার পাশে মামুন বস আছে। ঘরে অনেক লোক। মা আছেন, মীরপুরের বড়খালা আছেন। বড়খালার ছেলে যে আর্মির অফিসার সেও আছে। জাহানারা বলল, আমার পা কেটে বাদ দিয়েছে তাই না?
মামুন বলল, না।
জাহানারার বিশ্বাস হল না। অথচ বিশ্বাস না হবার কানো নেই ঐ তো রোগা রোগা পায়ের পাতা দু’টি দেখা যাচ্ছে। মামুন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এত সুন্দর লাগছে কেন মামুনকে? কি সুন্দর তাকে লাগছে। সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে এত সুন্দর লাগে। জাহানারা চোখ বন্ধ করল। আবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে তলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে শুনল, মামুন বলছে খালা আর ভয় নেই। আপনারা বাসায় যান। বিশ্রাম করুন। আমি আছি।
আহ কী চমৎকার শব্দ–আমি আছি। আমি আছির মত সুন্দর আর কোন শব্দ কী বাংলা ভাষায় আছে? না নেই।
জাহানারা সুস্থ হবার পনের দিনের মাথায় মামুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। হাসিনা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ করে যতটা হৈচৈ করবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন তার কিছুই করতে পারলেন না। একটা কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত ভাড়া করা গেল না। আলো দিয়ে বাড়ি সাজানো হল না। মেয়েকে নতুন একসেট গয়নাও দিতে পারলেন না। তবু তার মনে কোন অপূর্ণতা রইল না। দীর্ঘদিন পর গভীর আনন্দ বোধ করলেন। তাঁর ভাড়া বাড়ির প্যালাস্তারা ওঠা কুদর্শন একটা কোঠায় বাসর হবে। মেয়েরা ছোটাছুটি করে গর সাজাচ্ছে। এক ফাঁকে সেই ঘরও তিনি দেখে এলেন। অপূর্ব লাগল। চোখ ভিজে উঠল।
কি সুন্দর লাগছে জাহানারাকে। তাঁর এই কালো মেয়ের মধ্যে এত রূপ কোথায় লুকিয়ে ছিল? নাকি তার এই মেয়ে রূপবতীই ছিল শুধু তার চোখে পড়েনি? হাসিনার চোখ বারবার ভিজে উঠতে লাগল। তার বড় বোন তার হাত ধরে মেয়ের সামনে থেকে তাকে সরিয়ে নিলেন। রাগী গলায় বললেন, আনন্দের দিনে এ রকম কাঁদে কেউ। কাঁদতে কাঁদতে তুই দেখি চোখে ঘা করে ফেলবি।
বাসর রাতে ঘোর বর্ষণ। পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মত বৃষ্টি। খুব আনন্দ করছে সবাই। পাড়ার মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজে হৈচৈ করছে। এ ওকে ধরে কাদা পানিতে মাখামাখি করছে। অকারণে হাসছে। হাসিনা ঘর অঙ্গদকার করে একা একা তার ঘরে শুয়ে আছেন। সমস্ত দিনের উত্তেজনায় তার হাঁপানীর টান প্রবল হয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। হোক কষ্ট আরো কষ্ট হোক। শুধু মেয়েটা সুখী হোক। আজ রাত হোক তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাত।
হাসিনার কেন জানি গা ছমছম করতে লাগল। মনে হচ্ছে অন্ধকার ঘরে কে যেন এসে ঢুকেছে। নিঃশব্দে হাঁটছে। উৎসবের দিনে মৃত আত্মীয়-স্বজনরা এসে উপস্থিত হন। তাই নিয়ম। তাঁরাই কি এসেছেন? জাহানারার বাবা তো আসবেই। কে বলবে এই মুহূর্তে এই ঘরেই হয়ত সে আছে। মেয়েকে দেখে ফিরে যাবার মুহুর্তে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে এসেছে। হাসিনা কাতর গলায় বললেন, কে? কে ওখানে?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। কিন্তু হাসিনার মনে হল কেউ-একজন এসে যেন তার পাশে বসল। শব্দহীন স্বরে বলল, আমি। চিনতে পারছি না হাসু?
পারছি। পারব না কেন?
অনেক দিন তো হয়ে গেল, ভয় হচ্ছিল হয়ত চিনতে পারবে না।
হাসিনা ধরা গলায় বললেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।
খুব ভাল করছে। একা একা অনেক কষ্ট করলে হাসু।
হাসিনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি পাশে ছিলে না। এইটাই একমাত্র কষ্ট। এছাড়া অন্য কোন কষ্ট-কষ্টই না। তুমি কেমন আছ?
রাত বাড়ছে। ঝড়বৃষ্টির চমৎকার একটি রাত।
সোনালি ডানার চিল চক্রাকারে ওড়ে
মুনা লক্ষ্য করল আজ সারাদিন বকুল মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুপুরে ভালমত খেল না। খানিকটা মুখে দিয়েই উঠে পড়ল। মুনা বলল, কি হয়েছে রে?
বকুল হাসিমুখে বলল, ক্ষিধে নেই। ক্ষিধে হলেই আবার খাব। তুমি আজ অফিসে গেলে না। কেন আপা?
আজ শুক্রবার। অফিস বন্ধ।
ও আচ্ছা। আমার কিছু মনে থাকে না।
বকুল উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাতে গল্পে বই। পাড়ায় পারলিক লাইব্রেরি হয়েছে। বাবু তার মেম্বার। রোজ বই নিয়ে আসছে। সাত আট পাতা পড়ে বকুল সে সব বই ফেরত পাঠাচ্ছে। পড়তে ভাল লাগে না। অথচ আগে কোনো একটা বই হাতে পেলে শেষ না কর উঠতে পারত না।
আজও পড়তে ভাল লাগছে না। হাই উঠছে। বকুল বই নামিয়ে রাখল। ঘুম ঘুম আসছে। অথচ ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। কারো সঙ্গে গল্প করতে পারলে ভাল লাগতে গল্প করার মানুষ নেই।