না। বিরক্ত হব কেন? ঢাকা শহরে কি এই ছেলের কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে?
কেন বল তো?
না। এমনি। একটু খোঁজখবর করতাম।
কিসের খোজখবর?
হাসিনা জবাব দিলেন না। জাহানারা সহজ গলায় বলল, তুমি যা ভাবিছ সে সব কিছু না মা।
সে সব কিছু হলেই বা ক্ষতি কী?
হাসিনা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে রাগ ছিল, অভিমান ছিল, বিষাদ ছিল এবং কিছু পরিমাণে মিনতিও ছিল। জাহানারা একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
হাসিনা নরম স্বরে বললেন–ছেলেটা ভাল। আমার পছন্দ হয়েছে।
জাহানারা বলল, পছন্দ হলে কী করতে হবে? জাহানারা গলার স্বরে রাজ্যের বিরক্তি। হাসিনা অবাক হলেন। এর রকম তো হবার কথা না। তার ধারণা জাহানারাও ছেলেটিকে পছন্দ করে। এই পছন্দ সাধারণ পছন্দেরও বেশি। তাহলে কি তার ধারণা ভুল। ভুল তো হবার কথা না। এই সব ব্যাপারে মারা সচরাচর ভুল করেন না। তিনিও করেননি। ছেলেটি যে কবার এসেছে জাহানারার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে কথা বলেছে কিশোরীদের তরল গলায়। শব্দ করে হোসেছে। এসব কিসের লক্ষণ তা তিনি জানেন। তাহলে জাহানারা এমন করছে কেন? অন্য কোনো গোপন রহস্য আছে কি? তার জানতে ইচ্ছে করে। তবে জানতে ইচ্ছা করলেও লাভ নেই। জাহানারা মুখ খুলবে না। মুখ তালাবন্ধ করে রাখবে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা জবাব দেবে। সেই জবাব থেকে কিছু বোঝা যাবে না।
হাসিনা ক্ষীণ স্বরে বললেন, জাহানারা তুই আমার পাশে বস তো। জাহানারা সহজ গলায় বলল, পাশেই তো বসে আছি মা।
হাসিনা পাশ ফিরে মেয়ের কোলে একটা হাত রাখলেন। কোমল স্বরে বললেন, ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ। ঠাণ্ডা ছেলে। আজকাল এ রকম দেখা যায় না।
আজকাল বুঝি ছেলেরা সব গরম হয়ে গেছে?
তুই এমন রেগে যাচ্ছিস কেন রে মা? রেগে যাবার মতো কিছু বলেছি? ছেলেটাকে ভাল লেগেছে এইটা শুধু বললাম। এতে দোষের কী হল?
না দোষের কিছুই হয়নি। আমি রাগ করিনি। একজনকে ভাল বলবে তাতে আমি রাগ করব। কেন?
আমরা আগের কালের মানুষ। এ কালের কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝি নারে মা।
জাহানারা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। মার রোগশীর্ণ হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। তারপর খুবই নিচু গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বর বলল, ছেলেটাকে নিয়ে তুমি যা ভাবতে শুরু করেছ তা না ভাবলেই ভাল হয় মা। মামুন সাহেবের বিয়ে ঠিক হয়েছে আছে। কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হবে।
হাসিনা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হবে তাহলে এখানে এসে বসে থাকে কেন? এটা কি ধরনের ভদ্রতা?
বিয়ে হচ্ছে বলে সে এ বাড়িতে আসবে না। এমন তো কোন কথা নেই মা।
হাসিনার চোখে পানি এসে গেল। তিনি সেই লুকুবার কোনো চেষ্টা করলেন না। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন জাহানারার সঙ্গে এই ছেলেটির বিয়ে হবে। সংসারের ভিত পাকা হবে।
জাহানারা বলল, চা খাবে নাকি মা?
না।
শরীর খারাপ লাগছে?
উঁহু।
তুমি এমন ভেঙে পড়ছি কেন? এই ছেলে ছাড়া কি ছেলে নেই? মেয়ের বিয়ে দিতে চাও দেবে। আমি তো কখনো না বলিনি। এক’দিন শাড়ি গয়না পরে বরের বাড়িতেই চলে যাব। তখন হায় হায় করবে।
হাসিনা জবাব দিলেন না। মেয়ের কোল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পাশ ফিরলেন। জাহানারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে এখন আর ইচ্ছা করছে না।
জাহানারা রান্নাঘরে চলে গেল। রান্না করতে ইচ্ছা করছে না। শুরু করতে হবে। এর থেকে উক্ত নেই।
মার জন্যে তার বেশ খারাপ লাগছে। এই মহিলার ভাগ্যটাই এ রকম। দু’দিন পর পর শুধু আশাভঙ্গ হয়। বছর দুই আগে একবার হল। চমৎকার ছেলে। ফর্সা লম্বা, হাসি-খুশি। এমন একটা ছেলে যে, দেখলেই পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। বিয়ের সব ঠিক ঠাক। ছেলের এক মামা পাথর বসানো একটা আংটি দিয়ে জাহানারার মুখ দেখে গেলেন।
বিয়ের দিন-তারিখ হল, ১৭ কার্তিক। বিয়েটা হল না। কেন হল না সে এক রহস্য। তারা হঠাৎ জানাল একটু সমস্যা হয়েছে। কী সমস্যা কিছুই বলল না। কি লজ্জা কি অপমান লাল পাথর বসান আংটি জাহানারা খুলে ট্রাংকের নিচে লুকিয়ে রাখল। একবার ভেবেছিল নর্দমায় ফেলে দেবে। ফেলতে পারেনি। আংটিটাি হাতে নিলেই ফর্সা, লম্বা, কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটির ছবি মনে আছে। শত অপমানের মধ্যে কেন জানি ভাল লাগে।
কত দিন কত জনের সঙ্গে দেখা হয় এই ছেলেটির সঙ্গে কখনো দেখা হয় না। জাহানারা ঠিক করে রেখেছে। যদি কখনো দেখা হয় তাহলে সে হাসিমুখে এগিয়ে যাবে। খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে কী কেমন আছেন? চিনতে পারছেন আমাকে?
জাহানারা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। আর ঠিক তখন ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনা ঘটল। বা পায়ের ওপর কেতলি উল্টে পড়ল। কেতলি ভর্তি ফুটন্ত পানি। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝলসে গেল। জাহানারা কোন শব্দ করল না। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করল।
রাতে প্রচণ্ড জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে মনে হল যেন লম্বা, ফর্সা, কোকড়ানো চুলের ছেলেটি তার পায়ের কাছে বসে আছে। বিরক্ত গলায় বলছে, তুমি এত অসাবধান কেন? পা সম্পূর্ণ ঝলসে গেছে আর তুমি একজন ডাক্তার পর্যন্ত দেখালে না? এ রকম ছেলেমানুষী করার কোন অর্থ হয়? ইস কী অবস্থা হয়েছে পায়ের।
জাহানারা বলল, ছিঃ, তুমি পায়ে হাত দিচ্ছ কেন?
পায়ে হাত দিলে কী হয়?
লজ্জা লাগে।
এত লজ্জা লাগার দরকার নেই।
জ্বরের ঘোরে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ফর্সা, লম্বা, কোকড়ান চুলের ছেলেটিকে এক সময় মামুন বলে মনে হতে থাকে।