মুনার সঙ্গে এরকম কিছু এখন পর্যন্ত ঘটেনি। তবু যতবারই সে বড় সাহেবের ঘরে ঢোকে ততবারই দারুণ অস্বস্তি ভোগ করে। আজও সে ঢুকাল ভয়ে ভয়ে। ইসরাইল সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, খুব কাহিল হয়েছে তো?
জি স্যার। টনসিল ফুলে গিয়েছিল।
ভালমত চিকিৎসা করান। কেটে ফেলে দিন। নয়ত রেগুলার অফিস কামাই হবে। গত তিন মাসে আপনি নয় দিন ছিলেন সিক লিভে। ফাইলটা সেদিন দেখলাম।
মুনা কিছু বলল না। ইসরাইল সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বসুন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মুনা আড়ষ্ট হয়ে সামনের একটি চেয়ারে বসল। ইসরাইল সাহেব থেমে থেমে বললেন, না দেখে চিঠিতে সই করেন কেন? টাইপিস্টরা ভুল করেই। কাজেই এদের টাইপ করা প্রতিটি শব্দ চেক করতে হয়। বিশেষ করে ফিগারগুলো
মুনা ঠিক বুঝতে পারল না ঝামেলাটা কি। বড় রকমের কিছু হওয়ার কথা না। সে চিঠিপত্র দেখেই সই করে।
এনকো কর্পোরেশনের কাছে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে এগার হাজার নয়শ ছত্ৰিশ। একচুয়েল ফিগার হবে এগার হাজার ছয়শ ছত্রিশ। কমন মিসটেক, ছয় হয়েছে নয়। আমি জাস্ট আউট অব কিউরিওসিটি ফাইলটা আনিয়ে দেখি এই ব্যাপার।
মুনা সাবধানে একটি নিঃশ্বাস ফেলল। ইসরাইল সাহেব বললেন, এর জন্যেই ডেকেছিলাম, যান।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম। শুনুন, আপনার শরীর বেশি খারাপ মনে হচ্ছে। আজ দিনটা বরং রেস্ট দিন। ঘণ্টা খানিক থেকে ফাইলপত্র অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান।
মুনা থ্যাংক ইউ বলতে গিয়েও বলতে পারল না। এই লোকটির সামনে সে ঠিক সহজ হতে পারে না। মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার যাই।
ঠিক আছে যান। তারেক সাহেব থাকলে একটু পাঠিয়ে দেবেন।
জি আচ্ছা স্যার।
ঘণ্টা খানিক থেকে চলে যেতে বললেও মুনা লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত থাকল। জমে থাকা কাজগুলি নিখুঁতভাবে করতে চেষ্টা করল। মাথা হালকা হয়ে আছে। খুব মন দিয়ে কিছু পড়তে গেলেই আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়। তারেক একবার বলেই ফেলল, ঘুমাচ্ছেন নাকি আপা?
নারে ভাই। মাথা ঘুরছে।
বড় সাহেব যেতে বলেছে চলে যান না। জরুরি কাজ যা আছে দিয়ে যান আমার টেবিলে, অবসর পেলে করে দেব।
কাজ তেমন নেই কিছু।
তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন? মুনিরকে বলেন একটা রিকশা ডেকে দেবে।
মুনা মুনিরকে ডাকল। অফিসের আশপাশে রিকশা পাওয়া যায় না। মোড় থেকে ডেকে আনতে হয়। এ রকম এক অন্ধগলিতে এত বড় অফিস কোম্পানি কেন বানাল কে জানে। অফিস থাকবে মতিঝিলে।
তারেক, যাই ভাই।
ঠিক আছে আপা যান। কাল কথা হবে। বাসার দিকেই তো যাবেন?
হুঁ।
মুনা অফিসের এই একটিমাত্র ছেলেকে নাম ধরে ডাকে এবং তুমি বলে। যদিও সে নিশ্চিত তারেক বয়সে বড়ই হবে। তুমি ডাকার ব্যাপারটিও কিভাবে শুরু হয়েছে মুনা নিজেও জানে না। প্রায় অবাক হয়েই এক’দিন সে লক্ষ্য করেছে তারেক আপনি বললেও সে নিজে বলছে তুমি। মামুনের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা এত পাকাপাকি না থাকলে অফিসে এই নিয়ে একটা আলোচনা হত। পাল বাবু সস্তা ধরনের কিছু রসিকতা করারও চেষ্টা করতেন।
রিকশায় উঠেই মুনার মনে হল বাসায় এই সময় ফিরে কোনো লাভ নেই। দুপুরে ঘুমুলেই সারাটা বিকাল এবং সারাটা সন্ধ্যা তার খুব খারাপ কাটে। রাতের বেলা ঘুম আসে না। রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। মুনা রিকশাওয়ালাকে বলল মগবাজারের দিকে যেতে। এ সময় মামুনের মেসে থাকার কথা নয়। তাকে পাওয়া যাবে না এটা প্রায় একশ ভাগ সত্যি। তবু একবার দেখে গেলে ক্ষতি নেই কোনো। না পাওয়া গেলে কলেজে গিয়ে খোঁজ নেয়া যাবে। কোন বইতে যেন পড়েছিল পুরুষরা সবচে খুশি হয় যখন তারা মেয়েদের কাছ থেকে সিগারেট উপহার পায়। মামুনকে সে আগেও কয়েকবার সিগারেট দিয়েছে, কোনোলারই মনে হয়নি সে খুব খুশি হয়েছে। এমন ভাবে প্যাকেট খুলেছে যেন এটা তার প্রাপ্য। আজও তাই করবে।
মামুন মেসে ছিল না। তার পাশের রুমের আলম সাহেব বললেন, উনি তো টেলিগ্রাম পেয়ে দেশে গেছেন। তার এক বোন মারা গেছে, আপনি কিছু জানেন না?
না।
অনেক দিন ধরে অসুস্থ ছিল। উনার সবচে ছোট বোন।
মুনা একটু বিব্রত বোধ করতে লাগল। এত বড় একটা ব্যাপার মামুন তাকে কোনোদিন বলেনি। তার একটি ছোট বোন আছে তা সে জানত কিন্তু এই বোনের এমন একটা অসুখ তা মামুন কোনোদিন বলেনি।
বসবেন আপনি?
জি না, বসব না। ও দেশে গেছে কবে?
পরশু সকালে। টেলিগ্রাম এসেছে তার আগের রাত্রে। ট্রেন ছিল না, যেতে পারেনি।
কবে আসবে কিছু বলে গেছে?
জি না কিছু বলেনি। আজ-কালের মধ্যে এসে পড়বে। মরবার পর তো আর কিছু করার থাকে না, শুধু শুধু ঘরে বসে থেকে হয়টা কি?
মুনা ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে রিকশায় উঠল। কড়া রোদ এসেছে। চকচক করছে চারদিক। তাকালেই মাথা ধরে যায়। মুনা হ্যান্ড ব্যাগ খুলে সানগ্লাস বের করল। রোদটা খুব চোখে লাগছে।
সানগ্নাস ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। চোখে পরিবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক কেমন মেঘলা হয়ে যায়। একটু যেন মন খারাপ ও লাগে। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট ভাবে তার মনে হতে লাগল–মামুন কখনো তার নিজের ভাই-বোন-মা-বাবার কথা নিয়ে তার সঙ্গে গল্প করেনি। এমন একজন অসুস্থ বোন ছিল তার এটাও পর্যন্ত বলেনি। না বলার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। মুনার খুব জানতে ইচ্ছে হল এই বোনটি কি ওর খুব আদরের ছিল? নামই বা কি তার? নাম মামুন বলেছিল, খুবই কমন একটা নাম বলে এখন মনে পড়ছে না। রোকেয়া বা সাবিহা জাতীয়।