তাই কি?-ঘরে ফিরে প্যান্ট শার্ট না খুলেই বিছানায় শুয়ে ওসমান এই সমস্যার সমাধান খোজার চেষ্টা করে। ঠিক সমস্যা নয়, প্রশ্ন বলা চলে।—রানুর বাবা মকবুল হোসেন তার ওপর কতোটা ভরসা করে? তা করে বৈকি! কারফ্যুর সময় রাস্তায় কোনো আওয়াজ হলে ছুটে চলে আসে এই ঘরে। লোকটা বেশিরকম ভীতু, কোনো বিপদের আঁচ করলেই ওসমানের সঙ্গে তাই নিয়ে কথা বলে ভয়ের ধারটা ভোতা করে নেয়। মকবুল হোসেন এলে রহমতউল্লার প্রস্তাবটা সরাসরি বলা ঠিক হবে? লোকটা যাচ্ছেতাই রকম মেরুদণ্ডহীন। বাড়িওয়ালাকে স্পষ্ট ভাবে হ্যাঁ বলেনি কেন? মেয়ের বাপ হয়ে সে কি বুঝতে পাচ্ছে না যে রানুক্রমেই তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে? গতকাল, না পরশু? নাকি তার আগের দিন? কবে যেন বিকালবেলা, হ্যাঁ বিকালবেলাটা ঠিক মনে আছে, রানুকে দেখে ওসমানের মাথা ঝিমঝিম করছিলো। ওসমান তখন বাইরে থেকে ফিরছে, রাস্তা থেকে ওপরে চোখ মেলে দ্যাখে রানু শাড়ি তুলে নিচ্ছে রেলিঙ থেকে। তার চোখে হঠাৎ ফোকাস মারে রানুর চোখ। হ্যাঁ, রানুর চোখ আলোয় ঝকঝক করছে। এতো আলোয় ওসমানের চোখে ধাঁধা লাগে, অন্ধকার স্যাঁতসেতে সিঁড়িতে বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সে মনে করতে চেষ্টা করে, ঠিক এরকম ধারালো চোখ সে আর কোথায় দেখেছে? কোথায়? এক্ষুনি মনে পড়লো, হ্যাঁ, এই চোখ একদিন ঠিকরে পড়েছিলো রহমতউল্লার দিকে। রহমাতউল্লা ভাগ্যিস ঐ চোখে চোখ রাখেনি, নইলে শালা মহাজনের জং-ধরা চোখজোড়া পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। ঐ চোখজোড়া ছিলো রানুর বোবা বোনের। পরশু বিকালবেলা রানু কি তার চোখের কোটরে বোনের চোখের মণি সেট করে নিয়েছিলো? এটা যদি পার্মানেন্ট হয় তো মকবুল হোসেনের কপালে দুঃখ আছে।
আপনের বই। রঙ্গু খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে বসতে বসতে ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারের পাতায় মোড়ানো একটা বই ওসমানের হাতে তুলে দেয়, আপাকে পড়তে দিছিলেন না? নেন।’
টেবিলে পথের পাঁচালী রাখতে রাখতে ওসমান ওপরের মলাট দ্যাখে, বাঃ! খুব সুন্দর মলাট দিয়েছে তো?
আপা দিছে। বইটা খুইলা দ্যাখেন। ‘আজ তোমরা পড়তে এলে না যে? আপনে তো ঘরেই ছিলেন না। আমি বই নিয়া দুইতিনবার আসলাম। খুইলা দ্যাখেন না!
‘কেন? পাতাটাতা ছিড়তে পারে। আপায় বললো, বই ফেরত নেওয়ার সময় দেইখা নিতে হয়।
করুণ চোখ করে ওসমান তাকায় রঞ্জুর দিকে। রানু তার সম্বন্ধে ভাবেটা কি? রানু যদি ওসমানের ১টি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলে তো তাতে কি এসে যায়? রানুর কাছে ওসমান কি ১জন অতি সতর্ক, স্বার্থপর ও মালিকানা সচেতন ব্যক্তি?
খোলেন না’। রঞ্জু অধৈর্য হয়ে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় তার পাশে বসে পথের পাঁচালীর মাঝামাঝি খুলে ফেললে ওসমানের চোখে পড়ে রুলটানা কাগজের ছোটো ১টি টুকরা। সেখানে রানুর হাতের লেখা। ওসমান পর পর কয়েকটি টোক গেলে এবং হঠাৎভয়-পাওয়া ছেলের মতো রানুর লেখা চিরকুট ওভারটেক করে চোখ গুঁজে দিলো চিরকুটের নিচে বইয়ের মুদ্রিত লাইনগুলোর ওপর দুপুরে কেহ বাড়ি নাই, কৌটাটা হাতে লইয়া অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, বৈশাখ দুপুরের তপ্ত রৌদ্রভরা নিৰ্জ্জনতায় বাশবনের শনশন শব্দ অনেক দূরের বার্তার মত কানে আসে। আপন মনে বলিল-দিদি হতভাগী চুরি করে এনে ওই কলসীটার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিইছিলো !
কিন্তু দুর্গার সিঁদুর কৌটা চুরি আবিষ্কারের গ্লানি ও দুঃখ ওসমানকে একটুও আড়াল দেয় না; দুর্গার মতো বোন তার কোনোদিন ছিলো না বলে তার অকালমৃত্যুর শোক থেকে সে নিদারুণভাবে বঞ্চিত। রানুর চিরকুটটা তাকে পড়তেই হয়: বাড়িওয়ালা আজও এসেছিল। অব্বাকে দেখা করতে বলিয়াছে। আমার ভয় লাগে। কাহারও ইচ্ছা হইলে দায়িত্ব পালন করুক -পড়া শেষ হতে না হতে ওসমানের শরীরের রক্ত সব মাথায় ওঠে, মাথার করোটি ভেদ করে উপচে ছলকে পড়ার উপক্রম হয়। হয়তো তাই সামলাবার জন্যে মনোযোগ দেয় রানুর বানান ভুলে। রানুর বাক্যবিন্যাসের সাধু ও চলিত রীতির গোলমাল বড়ো প্রকট। অঙ্ক করাবার ফাঁকে ফাঁকে রানুর বাঙলাটাও দাখা দরকার। রানুর আঙুল ধরে ধরে তার বানান ঠিক করে দেবে। ওসমান এখনি নিজের হাতে রানুর কালো ও রোগা আঙুলের নরম স্পর্শ পাচ্ছে। শরীরের পুলকে এক পলকের জন্য চোখ বন্ধ করলে রানুর চোখের মণি ঝকঝক করে ওঠে। সেই ধারালো আভায় তার নিজের চোখের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে ভেৰে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে পাশে তাকায়, সেখানে রঞ্জুর মুখ। চট করে চোখ ফিরিয়ে নেয় রানুর চিঠিতে। ১বার ২বার ৩বার ৪বার ৫বার পড়তে পড়তে রানুর চোখ থেকে ধার-করাআলোতে উদ্ভাসিত তার চোখ দিয়ে শুষে নেওয়া হয় চিঠির আভা ৷ আভা মিলিয়ে গেলে পড়ে থাকে চিঠির ধড়, প্রাণহীন চিঠির লাশ বড়ো অস্বস্তিকর। রানুর এই চিঠি লেখার মানে কি? রানুকে তো ঘুণাক্ষরেও ওসমান কোনো দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেনি। তাহলে? রানু কি চায় যে বাবাকে বলে হার্ডওয়্যার, রেশন দোকান ও স্কুল ভেঙে তৈরি মার্কেটের মালিকের সঙ্গে তার বিয়েটা ওসমান ঠেকিয়ে দিক ? কোনো মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন প্রতিহত করতে ওসমান সবসময় প্রস্তুত। বিশেষ করে সেই মেয়ে যদি তার সাহায্য চায় তো কথাই নাই, তার নিরাপত্তার জন্যে এগিয়ে না যাওয়া আর রায়টের সময় আক্রান্ত কোনো মহিলার আর্তনাদে সাড়া না দেওয়া একই ধরনের অপরাধ। কিন্তু রানু এখানে গোটা ব্যাপারটাকে প্যাচালো ও গোলমেলে করে ফেলছে। রামু যে শুধু একা বাঁচাতে চাইছে তা নয়। ওসমানের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে। ওসমানকে সে পালাতে বাধ্য করতে চায়। ওসমান কোথেকে পালাবে? —কিংবা রানুকে নিয়ে কোথায় পালাবে? আর রানুকে নিয়ে পালাবে কিভাবে? সামনে, পেছনে, ডানদিকে সব গলি, সরু ও রোগ গলি। গলির মোড়ে মোড়ে ময়লা-উপচানো ডাস্টবিন, খোলা ম্যানহোল, নালায় থিকথিক করছে গুমুত গলির মাথায় মাথায় জড়ানো জাপটানো তারের জটওটায়ালা মাথার পোল থেকে ঝুলছে ইলেকট্রসিটির ছেঁড়া তার। আবার দাখো, বড়ো রাস্তায় ট্রাফিক জাম, রিকশায়, ট্রাকে, বাসে, স্কুটারে, ঠেলাগাড়িতে, কারে, হোণ্ডায়, সাইকেলে গেরো-লাগা জামের ভেতর চলা কি সোজা কাজ? আর শালা ট্রাফিক পুলিস কি-না তাকে দেখতে পেয়ে ট্রাফিক জাম ছাড়াবার কাজ বাদ দিয়ে, ট্রাক ড্রাইভারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া স্থগিত রেখে বাশি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। তার পিঠের ওপর রানুর জ্যান্ত ধড়, এই ধড় নিয়ে দৌড়বার গতি পাওয়া যায় না। এই বিছানা, এই চিলেকোঠার ঘর, এই বাড়ি থেকে দৌড়ে পালাবার জন্যে ওসমানের পায়ের পাতা কাপে ডান পাৰিছানা থেকে নিচে নামিয়ে দিলে সেটা মেঝে স্পর্শ করে ও সেখানেই একটু একটু দোলে। পায়ের দুলুনি স সা করে বাড়ে এবং ধাক্কা খায় রঞ্জুর বা পায়ের সঙ্গে। এমনি সাদামাটা করে বললে, তার ডান পায়ে সে মৃদু লাথি দিতে থাকে রঙ্কুর বা পায়ে। রঞ্ছ একটু সরে বসেও রেহাই পায় না, কারণ ওসমানের পায়ের কাপন বেড়েই চলে। এখন নিজের বা পাটি নামিয়ে দিলেই ওসমান ছুটে বেরিয়ে একটা দৌড় দিতে পারে বাইরে। রানু কিন্তু বুঝতেই পারবে না, ভো দৌড়ে ওসমান চলে যাবে, চলে যাবে তাদের কলপাড়ে। টিউবওয়েলের হ্যাঁণ্ডেল ধরে পাম্প করে কলসিতে পানি ভরছে আম্মা। কলপাড় পার হয়ে ছাইগাদার পাশে নেবুতলায় দাঁড়িয়ে সে ডাক শোনে, রঞ্জ রঞ্জ কিন্তু ওসমান দাঁড়াতে পাচ্ছে কৈ? তার পায়ে যেন পাল খাটানো হয়েছে, ডাঙার ওপর তরতর করে পা বেয়ে নিয়ে সে চলে বিলের কিনার ঘেঁষে, পার হয়ে যায় দীপচাদ মুচির বাড়ি, আরেকটু, আর একটুখানি গেলেই রেললাইন। রানু যে কখন খসে পড়েছে পিঠ থেকে ওসমান খেয়াল করেনি। দুর্গটিা থাকলে আজ একসঙ্গে রেলগাড়ি দাখা যেতো। অনেক দূর থেকে দুর্গা তাকে ডাকে, রঞ্জু! রঞ্জু!—দুর্গা? না আম্মা?—ওসমান বিড়বিড় করে সেই ঝাপশা ডাকের প্রতিধ্বনি করে, রঞ্জু! রঞ্জু!
জী? চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় রঞ্জু, ওসমানের দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকায়, কি হলো?
ওসমানও উঠে দাঁড়ালে রঞ্জ সিঁড়ির দিকের দরজায় সরে যায়, আমি এখন যাই। আপনি কিছু লেইখা দিবেন?
ওসমান হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ে, পরে। এ্যাঁ? পরে কেমন?