আনোয়ার, বাবা তুমি আকবর ভাইজানের পুত্র হয়া, নিজে একজন উচ্চশিক্ষিত সুবিবেচক অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও নিজের মানুষের সর্বনাশ করতে আসছো? জালালউদিনের মিনতির জবাবে একটি নির্লিপ্ত চেহারা তৈরি করার জন্যে আনোয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে, আমার নিজের মানুষ কে? চোর-ডাকাত-রক্ত-চোষারা আমার নিজের মানুষ হতে পারে না।
খয়বার গাজী বসেছিলো মাথা নিচু করে। তার হাতের সিগ্রেটের মাথায় ছাই জমেছে আধ ইঞ্চিরও বেশি, যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। আনোয়ারের জবাব শুনে ছাই ঝেড়ে সিগ্রেটে সে খুব জোরে টান দেয়, সিগ্রেটের আগুনে আঁচ তার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠে। কিন্তু তার কথায় সেই আঁচ টের পাওয়া যায় না বাবা, যারা নিজেদের মানুষ, তারা নিজেদেরই থাকে। বাপদাদার রক্ত শরীর থ্যাক বার করা দিবার পারো? আনোয়ার জানে বাপদাদার রক্ত শরীর থেকে নিষ্কাশন করা অসম্ভব। কিন্তু খয়বার গাজী বলো আর তার নিজের বাপদাদা বলো—, তারা কতোদিন আগে কিভাবে স্বতন্ত্র রক্তপ্রবাহ তৈরি করলা? একটি প্রবল ভূমিকম্পে ব্ৰহ্মপুত্রের মূল গতিপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়। সবার থেকে আলাদা হওয়ার জন্যে তাদের ভূমিকম্পটা ঘটলো কবে?—এসব কথা বলার সময় এখানে নাই। আনোয়ার আরো কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে, আপনি হুকুম দিয়ে কতো মানুষ মেরে ফেলেছেন তার হিসাব এই এলাকার অনেকেই জানে। আপনি কয়েক হাজার গোরু চুরি করিয়ে বাথান বানিয়ে রেখেছেন। জমির লোভে আপনি কতো লোককে পথে বসিয়েছেন। আপনি— ’
জমি থাকলেই জমির সখ থাকে বাবা। তোমার বড়োচাচাক জিগ্যাস করা দেখো, তোমার দাদা পরদাদার জমির হাউস কিরকম আছিলো। সিগ্রেট হাতে খয়বার গাজী উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালে আলিবক্স বলে, গাজীসায়েব, পলাবার চেষ্টা করলে কিন্তু আপনারই লোকসান। এই বাড়ির চার দিকে মানুষ মোতায়েন করা আছে।
‘উনাকে নিয়ে আপনারা কোথায় যাত্রা করবেন? জালাল মাস্টার জানতে চাইলে আলিবক্স হাসিমুখে জবাব দেয়, আপনিও সঙ্গে চলেন না। কাছেই, আপনাগোরে এলাকার মধ্যেই।’
খয়বার গাজী কিন্তু আলিবক্সের দিকে ফিরেও দ্যাখে না। সে সম্বোধন করে জালালউদ্দিনকে, আমি ভয় পাই না। আনোয়ার আছে, যতোই পাগলামি করুক, রক্তের সম্পর্ক তো একটা আছে। ভদরলোকের ঘরের শিক্ষিত ছেলে, চাচার সাথে কতো পাষাণ হবার পারে? জীবনে অন্যায় করি নাই। আমার আল্লা ভরসা।’
দরজার বাইরে এসে খয়বার গাজী থমকে দাঁড়ায়। আনোয়ার কিংবা আল্লার শরণাপন্ন হওয়া থেকে বিরত হয়ে সে তাকায় আলিবক্সের দিকে, বাবা আমি কি দোষ করলাম? চরের মধ্যে কে কি করে, আমার কি দোষ? বুড়া বয়সে আমাক বেইজ্জত করেন কেন?
আলিবক্স আস্তে করে হাত রেখে খয়বারের পিঠে, ভয় পান কেন? আজ আপনার বিচার হবো। বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে আপনাক আমরা ইজ্জত করা বাড়ি পৌছাইয়া দিমু| সে ডান হাত দিয়ে খয়বারের বাম হাত ধরে সামনে পা বাড়ায়।
জালালউদিনের বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে মস্ত বড়ো একটা বাশের খাচা। এটা কখন এলো? আলিবক্স বলে, আফসার গাজীকে পাওয়া যায় নাই।’
এর মধ্যে জালাল মাস্টারের বাড়ির সামনে লোকজনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। খয়বার গাজীকে দেখে সবাই হঠাৎ চুপ করে। তাকে নিয়ে রাস্তায় নামলে কে যেন চিৎকার করে উঠে, শালাক ঐ খাচার মধ্যে তোলো।
চারদিক থেকে এই সমর্থন পাওয়া যায়, তোলো! তোলো!
শালা খানদানী শয়তান গো! বাচার মদ্যে তুল্য জুতা দিয়া সালাম করে।’
আলিবক্স হাত তোলে, দরকার নাই। গাজী সায়েবের বিচার হবো। এখন ইনার শরীলে কেউ হাত দিবা না কলাম।—কৈ চেংটু কৈ?
‘চেংটু গেছে বৈরাগীর ভিটা। জায়গা ঠিক করবার গেছে। বিচার হবো বটগাছের নিচে।
‘খাঁচটা পেলেন কোথায়? আনোয়ারের কৌতুহল দেখে আলিবক্স হাসে, আর বলবেন না, আমাগোরে গায়ের চ্যাংড়াপ্যাংড়ার বুদ্ধি। এর মধ্যে সিন্দুরিয়ার বিডি মেম্বর কাঁদের মণ্ডলেক ধর্যা নিয়া আসছে!’
খাচার ভেতর?
হুঁ! আলিবক্স হাসতে হাসতে বলে যে সিন্দুরিয়ার মৌলিক গণতন্ত্রী আবদুল কাঁদের মণ্ডল মাদারগঞ্জ থানার গোরুচুরির ব্যাপারে হোসেন আলির প্রধান প্রতিনিধি। এ ছাড়া গত আকালের সময় সে এবং তার ছেলে একেকজন চাষাকে ২০ সের ৩০ সের ধান দিয়ে তাদের সর্বস্ব লিখিয়ে নিয়েছে। পরে এই নিয়ে একটু কথাবার্তা বললে ২জনকে সে মেরেও ফেলেছে। তা এইবার লোকটা পড়েছে বেকায়দায়। এই খাচায় করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত-মারা চরে। খাচা দেখে চেংটু আবদার করে, এই খাচা তাদের চাই, এর ভেতর ঢোকানো হবে আফসার গাজীকে।
তা আপনাদের ঐ মেম্বরের কি হলো?
আনোয়ারের প্রশ্নের দিকে আলিবক্সের মনোযোগ নাই, আফসার গাজী মনে হয় পলায়া বগুড়ার দিকে গেছে।
‘ঐ মেম্বরের কি হলো, বললেন না?
আফসার গাজীকে ধরবার পারলে কাম হতো। ঐটা ধুরন্ধর শয়তান। বগুড়া থাকা ঢাকাত যাবো, ঢাকাত যায়া একটা ষড়যন্ত্র পাকায়া আসবো।’
আনোয়ার এবার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, আরে, সিন্দুরিয়ার মেম্বরকে নিয়ে কি করলেন?
ও হ্যাঁ। আলিবক্সের হঠাৎ মনে পড়ে, সিন্দুরিয়া প্রাইমারী ইস্কুলের মাঠে গণ-আদালতে কাঁদের মণ্ডলের মৃত্যু হইলো। খাচার মধ্যে ভইরা ঐটারে নিয়া গেলাম ডাকাত-মারা চর। ঐ আদালতের রায়ে হোসেন আলিরও মৃত্যুদণ্ড হয়। হোসেন আলির বাথানে আগুন ধরাইয়া দুইটারে একসাথে ফালাইয়া দেওয়া হইলো।’
‘মরে গেছে?
মরবো না? আগুনের মদ্যে ফালায়া চার ঘণ্টা বাদে দুইজনেক আলাদা চেনা যায় না। পুড়া অঙার। ধ্যাবড়া পায়ে জোরে জোরে কদম ফেলে আলিবক্স, তাড়াতাড়ি করেন। সমান তালে পা ফেলতে খয়বার গাজীকে একটু বেগ পেতে হয়। গ্রামের রাস্তায় অনভ্যস্ত পায়ে জোর কদম ফেলতে আনোয়ারেরও একটু অসুবিধা হয় বৈকি। তবে একটু চেষ্টা করে সে বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটে। তার সামনে ও পেছনে অনেক মানুষ।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৩
মঞ্চ ছিলো পল্টন ময়দানের শেষ মাথায়। এদিকে স্টেডিয়ামের বারান্দায় পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ধরাবার জন্য দেশলাইয়ের বাক্সে কাঠি ঠুকলো ওসমান, সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের নিচে, ৫ কি ৬ হাত সামনে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। ভারি চমৎকার তো! কি করে হলো? সিগ্রেট ফেলে দিয়ে ওসমান ছুটে চললো অগ্নিকুণ্ডের দিকে। তার জ্বালানো কাঠি থেকে অতোদূরে আগুন জুলবে, আর সে কি-না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ফুকবে এখানে? পায়ের আঙুলে চাপ দিয়ে একটু উঁচু হয়ে ওসমান দেখলো মঞ্চ থেকে আইয়ুব খানের বিশাল বপুটাকে ধরে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে আগুনের কুণ্ডে। ভিড়ের ভেতর এগিয়ে যাওয়ার কায়দা ওসমানের বেশ রপ্ত করা আছে। এর কনুইতে একটু ধাক্কা দিয়ে, ওর পিঠ একটুখানি ঠেলে,আবার কখনো মঞ্চের দিকে প্রবাহিত কোনো জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ২/৩ মিনিটের মধ্যে সে পৌঁছে যায় মঞ্চের সামনে। তার গায়ে আগুনের আঁচ লাগছে, কিন্তু আইয়ুব খানের দাহ দাখার স্পৃহায় সেটুকু সহ্য করতেই হবে। কিন্তু তার ভাগ্যটা খারাপ, আগুনে মুখ থুবড়ে-পড়া আইয়ুব খানের শরীর দেখতে পারলো কেবল পলকের জন্য। মঞ্চের ওপর থেকে এবং মঞ্চের পেছনে গ্যালারি থেকে ছুড়ে-ফেলা মোহাম্মদ আইয়ুব খানের ‘ফ্ৰেণ্ডস নট মাস্টাস বইয়ের ইংরেজি ও বাঙলা সংস্করণ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে তার রচয়িতার পিঠের ওপর। নিজের লেখা বইয়ের। অজস্র কপির আড়ালে আইয়ুব খান অদৃশ্য হয়ে যায়। ফ্রেণ্ডস নট মাস্টার্স-এর সবুজ ও সাদা মলাট আইয়ুব খানের অগ্নিশয্যায় পাকিস্তানী পতাকার বিভ্রম তৈরি করে ডানা ঝাপটায়। তারপর প্রেসিডেন্টের বপুর সঙ্গে চড়চড় আওয়াজ করে পোড়ে। বই ছাড়াও কাগজ, ছেঁড়া কাপড়, পুরনোটায়ার, টুকরা কাঠ ও জুতাস্যাণ্ডেলের জ্বালানির নিচে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষীণ কণ্ঠে ঘেউঘেউ করে। কিন্তু তাকে দ্যাখা যায় না। দগ্ধ প্রেসিডেন্টকে এক নজর দাখার আশায় ওসমান এদিক ওদিক থেকে ঝোকে, ওদিক থেকে ঝোকে। ১বার তার পায়ের পাতার একটুখানি দাখা গেলো। আরেকটু ঘুরে সামনে গেলে আরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিন্তু এই সময় তার পিঠে হাত পড়ে আলতাফের, এই ওসমান, ওসমান। আরে এতো কাছে চলে এসেছে ? আগুন ছড়িয়ে পড়লে মারা পড়বে।’
আগুন আর ছড়াবে কি করে? আইয়ুব খান পুড়ে শেষ। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালাম কিন্তু আমি।
তাই নাকি? প্রথমে মশাল জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আলতাফ তার হাত ধরে, চলো, মিটিং শেষ। চা খাবো।’
অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে স্টেডিয়ামের বারান্দায় পৌঁছে ফের ভিড় ঠেলতে হয়।
ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের মস্ত বড়ো ঘরটা লোকে ঠাসা। টেবিল ১টাও খালি নাই। যতো লোক বসে রয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ দাঁড়িয়ে রয়েছে চেয়ার খালি হওয়ার অপেক্ষায়। মাঝামাঝি ১টা টেবিল থেকে সিকানদার ডাকে, এই যে আলতাফ।
সিকানদারের সঙ্গে আলতাফ এবং ইফতিখারের সঙ্গে ওসমান চেয়ার ভাগাভাগি করে বসে। ওসমান বসেই খবর দেয়, আইয়ুব খানের ক্রিমেশন দেখলে না? এখন প্রেসিডেন্ট হবে কে?
আলতাফ রায় দিলো, পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সম্পূর্ণ পতন হয়ে গেছে। ওর বই বোধহয় আর একটাও থাকলো না।
বই কি বলছো? পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ জড়িয়ে ওকে পোড়ানো হলো। কেউ কেউ করে গোঙাচ্ছিলো।
শওকত হেসে ফেলে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে হি হাজ ফিজিক্যালি বিন বার্নট টু এ্যাঁশেস।
‘আরে তাই তো হলো! পুড়ে ছাই হবে না তো সোনার মূর্তিতে পরিণত হবে? আইয়ুব খানের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পোড়াবার বিবরণ দেওয়ার উপক্রম করলে ওসমানকে থামিয়ে দেয় শওকত, আইয়ুব খানের বই পোড়াবার দরকার কি? হিজ বুক ডাজ নট রিপ্রেজেন্ট হিম। হি ইজ এ সাব-লিটারেট জেনর্যাল লাইক এনি অফ হিজ সাবঅর্ডিনেন্টস ইন দি আর্মি। বই লেখা তার কাজ নয়, এই বই লিখেছে আলতাফ গওহর।
আলতাফ সায় দিলে শওকত বলে, সিভিল সার্ভিসের লোকজন সব সময় ডিক্টেটরদের ডোমেস্টিক সার্ডেন্টের সার্ভিস দেয়। খোজ নিয়ে দ্যাখেন আইয়ুব খান হাগলে ছুচে দেয় কারা? আবার তাদের নিজেদের হোগাও সবসময় ক্লিন করে রাখতে হয়-।
‘কেন? সকলের হাসির হুল্লোড়ে সিকানদার এই প্রশ্ন করে। হাসে না কেবল ওসমান। পুড়িয়ে ফেলার পর আইয়ুব খানের মলত্যাগ এবং সিভিল সার্ভেন্টদের দিয়ে শৌচকার্য করিয়ে নেওয়া তার কাছে বাহুল্য মনে হয়। মহা উৎসাহে সিকানদারের প্রশ্নের জবাব দেয় শওকত, দে হ্যাঁভ টু রিমেইন অলওয়েজ প্রিপেয়ারড টু গেট ফাকড় বাই দেয়ার মাস্টার এ্যাঁণ্ড দ্য মাস্টার মে রিফিউজ এ ডার্টি এ্যাঁনাস!
সবাই দ্বিগুণ তিনগুণ বেগে হাসে। শওকত হাসতে হাসতেই আলতাফকে বলে, যেসব বাঙালি ব্যুরোক্র্যাটের ওপর আপনারা ডিপেন্ড করছেন তারাও কিন্তু একসেপশন নয়।
আমরা নির্ভর করি পিপলের ওপর, সব বাঙালি আমাদের সঙ্গে আছে। বিশেষভাবে বাঙালি সার্ভেন্টরা, আর্মির প্রোমোশন-না পাওয়া-। সবাই। শোষিত বাঙালি মাত্রেই আমাদের সঙ্গে থাকবে। আগরতলা মামলা সাজিয়ে আইয়ুব খান বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে সিভিল সার্ভিস, আর্মি, নেডি, এয়ার ফোর্সের লোকজন-সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করলো। এই মামলা উইথড্র করতেই হবে, তখন কি নেতাকে এরা অস্বীকার করতে পারবে?
‘আগরতলা উইথড্র করা অসম্ভব। আর্মি টলারেট করবে না।’ আর্মির চেয়ে পিপল অনেক শক্তিশালী।’ আগরতলা উইথড্র করলে আর্মি আইয়ুব খানকে সরিয়ে দেবে। ওসমান এই সুযোগট নেয়, আরে আইয়ুব খানকে তো পুড়িয়ে মারা হলো। কিন্তু তার বিবৃতিতে পাত্তা না দিয়ে আলতাফ জবাব দেয় শওকতের কথার, মানুষ যেভাবে আগুন হয়ে আছে তাতে শেখ সাহেবকে রিলিজ না করলে সিচুয়েশন নর্মাল করা অসম্ভব।
তাহলে তাকে রিলিজ করে মানুষকে ঠাণ্ড করে মার্শাল ল ইমপোজ করতে পারে। আর্মি তখন আগরতলা উইথড্রলের কমপেনসেশন করবে ইন দেয়ার ওন ওয়ে। তখন রেসিস্ট করতে পারবেন?
নিশ্চয়ই। শেখ সাহেব বেরিয়ে এলে আন্দোলন আরো স্পষ্ট পথে, স্পষ্ট গন্তব্য ধরে চলবে। শুধু এজিটেটরদের দিয়ে আন্দোলন চলে না। নেতার হাতেই আন্দোলন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে চলতে পারে।’
শোনেন আলতাফ, শেখ সাহেব সবচেয়ে পপুলার নেতা, দেয়ার ইজ নো ডাউট এ্যাঁবাউট ইট। কিন্তু তার যে ধরনের পার্সোনালিটি, যে ধরনের পলিটিক্যাল ফেইথ এ্যাঁন্ড ব্যাকগ্রাউন্ড,—তা কি এই মুভমেন্টের লিডারশিপের জন্য এ্যাঁডেকুয়েট? সংগঠন আছে না? আমাদের মতো সংগঠন আর কি আছে, বলেন? কিন্তু আপনাদের সংগঠনের ক্যারেক্টার আর এই মুভমেন্টের ক্যারেক্টার আলাদা। দ্যাখা যাক। পিপল শেষ পর্যন্ত কাঁদের নেতৃত্ব মেনে নেয়। দেখবেন শেষ পর্যন্ত কে টেকে!’
আপনারা যদি টেকেন তো ওনলি এ্যাঁট দ্য কস্ট অব দ্য মুভমেন্ট। মুভমেন্টটাও নষ্ট হবে, আর্মি তখন আপনাদের শেষ করবে।’
অতো সোজা?’ এবার ওসমান তার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করার জন্য আরেকটি উদ্যোগ নেয়, আইয়ুব খানকে যেভাবে জ্যান্ত পোড়ানো হলো তাতে এই আন্দোলন নষ্ট করা– ‘
‘আরে রাখেন। শওকত বিরক্ত হয়ে বলে, কয়েকটা বই পোড়ালে আইয়ুব খান মরে না। আইয়ুব খান গেলে আরেক আইয়ুব খান আসবে। ওয়েস্ট পাকিস্তানের সব আইয়ুব খানকে শেষ করলে বাঙালিদের মধ্যে নতুন আইয়ুব খান এমার্জ করবে।’
অফিসে পরদিন কামালকে একা পেয়ে ওসমান কথাটা তুলতে গেলো, কাল পল্টনের মিটিঙে গেলেন না? স্টেজের সামনে আইয়ুব খানকে পোড়ানো হলো, দেখতে পারলেন না? আমি দেশলাইয়ের কাঠ জ্বালালাম—। কামালের সামনে খবরের কাগজ, কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা ছবি দেখিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ফ্রেণ্ডস নট মাস্টার্সের মেলা কপি পোড়ানো হলো। আগে থেকে জানলে অফিসের কপিগুলো নিয়ে যেতাম। গতবার অফিসে পঞ্চাশ কপি কেন হলো না?
আরে না। বই না। আমি নিজে দেখলাম পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ জড়িয়ে আইয়ুব খানের বডি আগুনে ছুড়ে ফেলা হলো।’
কামাল তার পাশে এসে দাঁড়ায়, আপনার শরীর খারাপ? আপনার চোখ এতো লাল কেন? রাত্রে ঘুম হয়নি?
ওসমান গতকালের দৃশ্য আরো বিশদ ব্যাখ্যা করতো, কিন্তু এর মধ্যে বসের ঘর থেকে কামালের ডাক আসে।
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে ঘরে ফেরার কিছুক্ষণ পর আসে রানু। আইয়ুব খানের খবরটা রানু বোধহয় জানে না। ওসমান কিছু বলার আগেই রানু জানায় যে সে ২টো খবর দিতে এসেছে। কাল বিকালবেলা বাড়িঅলা আসছিলো। আপনারে দ্যাখা করতে বলছে।
কি খবর বলো তো? কাল রাত্রে ফেরার সময় রাস্তায় তোতামিয়াও বললো। ব্যাপার কি?
রানু এবার দ্বিতীয় খবরটি বলে, আর ঐ যে আপনার সঙ্গে থাকে, রিকশাআলা, সে বইলা গেলো আজ বিকালে নাকি মিটিং। পাকিস্তান মাঠে মিটিং? পাকিস্তান মাঠ কোথায়?
আলাউদ্দিন মিয়া নাকি আপনারে মিটিঙে যাইতে বলছে। কিসের মিটিং? আচ্ছা পাকিস্তান মাঠ আর্মানিটোলায় না?
পাকিস্তান মাঠ আগা সাদেক রোডে। মিটিঙের কথা অবশ্য আলতাফও বলেছিলো- কিন্তু মিটিংসম্বন্ধে রানুর আগ্রহ নাই। সে নতুন প্রশ্ন করে, আচ্ছা, ঐ লোকটা, খিজির না মিজির, ও কি আপনার সঙ্গে সবসময় থাকবে?
কেন? খিজির সম্বন্ধে রানুর ওরকম তুচ্ছ করে কথা বলা ওসমানের কানে লাগে, কেন? ও তোমার কি ক্ষতি করলো?
আমার কি করবে? কিন্তু বাড়িআলা দেখলাম ওর উপরে খুব চেতা। ও নাকি পাকা চোর বাড়িআলার গ্যারেজে কাজ করতো, রিকশার পার্টস চুরি করলে বাড়িআলাওকে বার কইরা দিছে তো উঠছে আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজে। আবার আলাউদ্দিন মিয়ার স্কুটার বলে কারে বেইচা দিছে, তার ওখান থাইকা উঠছে আপনার ঘরে! বাড়িআলা বলে-।
বাড়িওয়ালা কি আমাকে ওয়ার্নিং দিতে এসেছিলো? শোনো, বাড়িওয়ালার তেজ আর বেশিদিন নেই। বাড়িওয়ালার যে বাপ, আরে বাপ কি?-বাপের বাপ, বাপের বাপের বাপ,- এই মেয়েটির কাছে আইয়ুব খানকে জীবন্ত দগ্ধ করার বিবরণ দিতে পারলে ভালো হয়, ঘটনাটিকে সে রূপক হিসাবে নেবে না, জলজ্যান্ত ঘটনা বলে বিশ্বাস করবে, গতকাল পল্টনের মিটিঙে আইয়ুব খানকে জ্যান্ত ধরে আগুনে পোড়ানো হলো। একেবারে ছাই হয়ে গেছে। আইয়ুব খানের দাহ আজ উদযাপন করা হবে পাকিস্তান মাঠে।
রানু তার বিবৃতিকে রূপক অর্থে নেয় না, আবার কোনো গুরুত্বও দেয় না। আঃ! আপনি চটেন কেন? আপনার সম্বন্ধে বরং ভালো ভালো কথা বললো, বলে, ওসমান সায়েব খুব ভদ্রলোক মানুষ, খিজিররে তাই না করতে পারে নাই। আমি শুইনা মনে মনে হাসি।
ওসমান খুব ভদ্রলোক-এই কথায় রানু হাসে কেন? ওসমানের কোনো আচরণে কি কোনোদিন অশোভন কোনো কিছু সে লক্ষ করেছে? নাকি তার ধারণা যে ওসমান ভদ্রতার ভাণ করে, আসলে সে পাকা শয়তান? ওসমানের স্বভাবে হিপ’ক্র্যাসির আবিষ্কার কি রানুর মনে মনে হাসার কারণ?
বাড়িওয়ালা তোমাদের বাসায় এসেছিলো কেন? ভাড়া বাড়াতে চায় নাকি? না, না। এই প্রথম দেখলাম বাড়ি ভাড়ার তুলনায় মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাক্স বেশি বইলা হায় হায় করলো না। রাত্রে স্বপ্লে নাকি ভাইয়ারে দেখছে! তাই আব্বার সঙ্গে দ্যাখা করতে আসছিলো। কয়, কয়টা অসৎ লিডারের পাল্লায় পইড়া দেশের জুয়েল জুয়েল ছেলেগুলি স্পয়েল হইতাছে। কয়, দ্যাখেন মরেও ভালোগুলি। কয়, চালাকগুলি মিটিঙে যায়, মিছিলে যায়, কিন্তু সেইগুলি মরে না। তাদের কিছু হয় না। ভাইয়ার কথা কয়, মরে খালি তালেবের মতো নিরীহ সাদাসিধা পোলাপান।
ওসমান আড়চোখে রানুর মুখ দ্যাখে। কথাগুলো কি বাড়িওয়ালার? নাকি ওসমান সম্বন্ধে নিজের মন্তব্য রানু সেট করে দিচ্ছে রহমতউল্লার মুখে। রানু কি তাকে খুব সতর্ক ও ভীতু গোছের মানুষ বলে গণ্য করে?-আজ, আজ নয় কাল-নাকি পরশু?-ওসমান যে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকে অগ্নিকুণ্ডতৈরি করলো, সেখানে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হলো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানকে,—সে কথা রানুকে বিশ্বাস করাবে সে কি করে? অকপটতা, মনোবল ও আন্তরিকতাকে আরু তালেবের মৃত্যুর কারণ ভেবে রানু তার সঙ্গে তুলনা করছে ওসমানের। ওসমান জানে যে তার মুখ দেখে রানু এইসব ভুল ধারণা করে বসে আছে। নাকি এটাই ঠিক? তার স্বভাবে তেজের অভাব বোধহয় তার মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠে। তাহলে আইয়ুব খানকে জ্যান্ত পোড়াবার অগ্নিকুণ্ডে সে প্রথম কাঠিটি ছুড়লো কি করে? সে বোধহয় ছোড়েনি। তাহলে কে ছুড়লো। ঠিক খবরটা দিতে পারবে কে? শওকত ছিলো, আলতাফ ছিলো, ইফতিখার ছিলো, সিকানদার ছিলো,-এদের কারো সঙ্গে দ্যাখা হলে জিগ্যেস করলেই তারা আসল তথ্য জানিয়ে দেবে। তাহলে তো একবার বাইরে যাওয়া দরকার। ঠিকঠাক জেনে এসে রানুকে বেশ বুক ফুলিয়ে বলা যায়, ‘আইয়ুব খানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মূলে কে, বলোতো রানু?—রানু বিবেচনা করে দেখতে পারে, পুলিসের গুলিতে নিহত হলেই কেউ উন্নত স্তরের জীবে রূপান্তরিত হয় না। তালেব কি খুব বীরপুরুষ ছিলো? দূর। সে মিছিলে গেছে হুজুগে মেতে নীলখেতের মোড়ে গুলিবর্ষণ শুরু হলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিয়েছে। তালেব তো কিছুদিন পাগলও ছিলো। অস্বাভাবিক প্রকৃতির বিকৃতমস্তিষ্ক এক যুবক প্রকৃত পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিসের হাতে মারা পড়েছে; এতে তার ছোটবোনের গর্ব করার কি হলো?—আবু তালেবকে পাগল বিবেচনা করে একটু চাঙা হতে না হতেই ওসমানের ভুলটা ভাঙে। নাঃ! পাগল হলে তালেব ওয়াপদায় চাকরি করতো কি করে? অবশ্য চাকরি ও মানসিক সুস্থতা অবিচ্ছেদ্য নয়, মানসিক সুস্থতা চাকরির কোনো শর্ত নয়। তবে পাড়ার লোকে কেউ বলেনি যে তালেবের কোনোরকম অস্বাভাবিকতা কোনোদিন লক্ষ করা গেছে। নাঃ! ওসমান একটি দীর্ঘশ্বাস চাপে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আরু তালেব সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ ছিলো। কিন্তু যাই হোক না কেন, রানু কি তার নিহত ভাইকে সামনে রেখে পৃথিবীর যাবতীয় পুরুষমানুষকে বিচার করবে? তাহলে তো শহীদ ছাড়া কাউকে তার পছন্দ হবে না। পুলিস-মিলিটারির গুলিতে শহীদের বৌ হিসাবে নিজেকে কল্পনা করে রানু কি খুব সুখ পায়?-ওসমান হেসে ফেললে রানু বলে, কি, হাসেন কেন?
‘এমনি। বাড়িআলা প্রশংসা করছে শুইনা খুব খুশি, না? রানুও হাসে, যান, বাড়িআলার সাথে আজ দ্যাখা করেন। কয়, আপনে নাকি রাগ করতে জানেন না? মুরুব্বি দেখলেই সালাম দেন, মাথা নিচা কইরা হঁটেন। দেখবেন, চোখ নিচের দিকে থাকলে সামনে কিছু দেখতে পারবেন না, কোনদিন গাড়ির তলায় চাপা পড়বেন!’
রানুর এই বিরামহীন সংলাপ হাসির কুচিতে খচখচ করে। প্রত্যেকটি কুচি ওসমানের কানে বেঁধে এবং তা অনূদিত হয় এইভাবে: তুমি শালা একটা মেরুদণ্ডহীন হিপ’ক্র্যাট। তোমার উচিত বাড়িওয়ালার সঙ্গে লাইন করা। রানু বলে, আপনারে যেমন পছন্দ, মনে হয় বাড়িআলা আপনের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চায়!
সম্বন্ধ? কিসের সম্বন্ধ? সম্বন্ধ বোঝেন না? ঢঙ করেন, না? বাড়িআলার মেয়ে আছে না একটা? খুব সুন্দর! গাড়ি পাইবেন, টেলিভিশন পাইবেন। বাড়ি তো আছেই!
রাজত্ব ও রাজকন্যা একসঙ্গে? ‘তো কি? ছেলেরা আবার কি চায়? গাড়ি না দেয়, রিকশা তো আছে! রিকশা ভরা গ্যারেজ পাইবেন! রানুর ঠোঁটের দুই কোণ সঙ্কুচিত হয়, রিকশার কথা বলার সময় জিভের তেতো ধাক্কায় শব্দগুলো বেশিরকম স্পষ্ট। ওসমান বলতে চাইলো, অনিশ্চিত রাজকন্যার আশায় থেকে নিশ্চিত রাজকন্যাটিকে সে হারাতে রাজি নয়।-কিন্তু ডায়ালগটি কিভাবে ছাড়বে তাই ঠিক করার আগেই রানু হঠাৎ দাঁড়ায় এবং তার চোখে চোখ রেখে বলে, আপনারা, আপনারা, আপনারা না-বাক্য স্থগিত রেখে সে মুখ ফেরায় অন্যদিকে। ফলে দ্যাখা যাচ্ছে তার প্রোফাইল। প্রোফাইলে রানু সবসময় বেটার, কিন্তু এখন তাকে অপরিচিত কোনো মেয়ের মতো লাগছে। ওসমানের খুব পিপাসা পায়, কিন্তু রানুর ঠোঁটের ওপরকার ভাঁজ ও নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু এক ফোটা জমেনি। পিপাসায় ওসমানের গলা শুকিয়ে আসে, ভাবে কুজো থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নেবে। কিন্তু রানুকে ডিঙিয়ে যায় কিভাবে? বিশেষ করে রানুর ঠোঁটজোড়া যেভাবে কাঁপছে তাতে একটা দুর্ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। তার সেকেন্ড ব্র্যাকেট মার্কা ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে হাল্কা বেগুনি থেকে গাঢ় বেগুনি হয়। রানুর ডান চোখের কোণে পানির ফোটা টলটল করে। নুন মেশানো হাল্কা ঘোলাটে পানির বিন্দুটা পড়ে গেলে মুখের ব্যালান্স নষ্ট হতে পারে,-ওসমান এরকম ভয় করতে করতে রানু তার বাক্য সম্পূর্ণ করে, আপনার না সব পারেন। সব পারেন। চোখের নোনতা শিশিরবিন্দু তার টলে পড়েছে, ডান গালে সরু রেখায় প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে চিবুকের ভৌলে। নোনতা ও ঈষৎ ঘোলা শিশিরের রোগা স্রোতে চুমুক দেওয়ার জন্য ওসমানের খটখটে ঠোঁট, জিভ ও টাকরা তিরতির করে কাপে। ওসমান হঠাৎ করে নিশ্চিত হলো যে আইয়ুব খানকে দগ্ধ করার জন্য তৈরি অগ্নিকুণ্ডে সে একটি জ্বলন্ত কাঠি ফেলেছিলো। খবরটা রানুকে এক্ষুনি দেওয়া দরকার। ওসমান দাঁড়িয়ে রানুর মাথার ওপর ও ঘাড়ে তার হাত রাখলে হাল্কা করে। কথা বলার আগে রানুকে আরেকটু কাছে টানে, একটি তীব্র চুমুতে তার গালের চোখের ও চিবুকের নোনা পানি সবটা শুষে নেবে। কিন্তু রানুর মাথার চুলের কাটা ওসমানের বুকের বাদিকে একটু একটু খোঁচা দিচ্ছে। এটা আবার এ্যাঁসিডিটির ব্যথা নয় তো? দুপুরবেলা খালি পেটে কাপের পর কাপ চা এবং ১টির পর ১টি সিগ্রেট খেলে এই জায়গাটার নিচে চিনচিন করে ব্যথা করে। ঘন্টাখানেক আগে ভরপেট খেয়ে এসেছে বলে সেই ব্যথা কি আরো ওপরে উঠে এলো? ঘরে এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট নাই, বেরিয়েই দুটো মেরে দেবে। কিন্তু তার নিজের ঘর থেকে তাকে এখন উদ্ধার করে কে? সে বিড়বিড় করে, একেবারে পাগল! ভাইটা ছিলো আস্ত পাগল, বোনটাও তাই।’
আবু তালেবকে ঘোরতর উন্মাদ বলে ঘোষণা করে ওসমান লঘুভার হয়। নিশ্চিন্ত মনে রানুকে চুমু খাবে বলে ওর গোটা মুখ জড়িয়ে ধরার জন্য ওসমান নিজের আঙুলগুলোকে তৈরি করতে করতেই তার হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে রানু ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৪
হাতের ফাক দিয়ে রানু বেরিয়ে গেলে মনে হয় খুব শীতের মধ্যে তার হাতের গ্লাভস খুলে গেলো। হাতদুটো বড়ো ঠাণ্ডা। হাতে হাত ঘষে শীত কাটাবার চেষ্টা করলে সারা শরীর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা হয়। কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় শুয়ে ওসমান লেপ টেনে নেয় গায়ে। লেপের কল্যাণে শরীরের তাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে, রানুকে ওসমান আর কোনোদিন এভাবে কাদতে কাদতে ফিরে যেতে দেবে না। এই কয়েক মিনিট আগে ওসমান ওকে ১টা ২টো কেন, অনায়েসে ১০০/১৫০ চুমু খেতে পারতো। এতো দ্বিধা করার কোনো মানে হয়? দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে যে কি-না আইয়ুব খানকে পুড়িয়ে মারার অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে, তার এতো দ্বিধা রানুকে চুমু খেতে?-ওসমানের শরীরে রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে ওঠে। দূর। চুমু খেতে খেতেই তাকে নিয়ে দিব্যি শুয়ে পড়তো এই সরু তক্তপোষে। না, এমন কিছু সরু নয়, দুজনে দিব্যি শোয়া যায়। বিকালবেলা ওর ঘরে আসবে কে? সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো বেগুনি ঠোঁটে কয়েকটা গাঢ় চুমু পড়লে রানুর সমস্ত শরীর একেবারে এলিয়ে পড়বে ওসমানের ওপর। তারপর তাকে জড়িয়ে শ্যামবর্ণের নোনতা ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে ‘রানু! আমার রানু! বলে ফিসফিস করে ডাকলে মেয়েটির সমস্ত শরীর সাড়া দিয়ে উঠবে। এই মুহুর্তে রানুর অশ্রু, ঘাম, রক্ত, মাংস, হাড় ও মজ্জায় ওসমান নিজেকে তীব্রভাবে অনুভব করছে। রানুকে চোখের সামনে একে নিতে নিতে ওসমান লুঙির গেরো খুলে ফেললো। রানুর বুকে মুখ গুঁজে দেওয়ার জন্য বালিশটা উল্টিয়ে ঠেকিয়ে রাখলো নিজের গালের সঙ্গে। কাত হয়ে শুয়ে ওসমান বাম হাতটি রাখলো নিজের উরুসন্ধিতে। রানুর সঙ্গে একাকার হওয়ার সমস্ত উত্তেজনা সংহত হয়েছে ওখানেই। ওসমানের হাতে এখন তার ফেপে-ওঠা শিশ্ন; এই পাপের ভেতর দিয়ে সে ঢুকে পড়বে রানুর একান্ত ভেতরে। অন্য হাতে জড়িয়ে ধরবে তার পিঠ, বালিশটা যেভাবে আঁকড়ে ধরলে ঠিক সেইভাবে। রানুর ঠোঁটে ও গালে প্রবলভাবে চুমু খাওয়া সে অব্যাহত রেখেছে। বঁ হাতে নিজের যৌনাঙ্গ ঝাকাচ্ছে এইতো, এই পেরেক দিয়ে রানুকে গেঁথে নেবে নিজের সঙ্গে। এদিকে রানুর বুকে হাত দিতে গিয়ে দ্যাখে, সেখানে খয়েরি সুতার এন্ত্রয়ডারি করা প্যাগোডা আঁকা হাওয়াই শার্টের পকেট। তাইতো, রানুর ঠোঁট পরিণত হয়েছে রঞ্জুর ঠোঁটে। রন্ধুকেই সে অবিরাম চুমু খেয়ে চলেছে। এটা হল কি করে? রঞ্জকে নিয়ে সে করবেটা কি? তার চাই রানুকে। শীতের ময়লা বিকালে চোখ ভরা পানি নিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে গেলো তার ঘর থেকে নিজের তীব্র রক্তসোতের ঘন নির্যাস রানুকে সমর্পণ করে ওসমান তার চোখের পানি পুষিয়ে দেবে। কিন্তু একি বিপর্যয়? মাঝখানে কোথেকে এসে ঝামেলা বাধায় রঞ্জু। তাকে ঠেকানো খুব শক্ত। রঞ্জুর গালে কষে একটা চড় দিলে হয়। কিন্তু তার বদলে সে কি-না ওর গালে অবিরাম চুমু খেয়ে চলেছে। রানুকে রঞ্জ সম্পূর্ণ হটিয়ে দিয়েছে, রানুর চিহ্নমাত্র দ্যাখা যাচ্ছে না। ওসমান এখন কি করবে? রঞ্জকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে ওসমান ওকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে সে বালিশের একটা কোণ খুব জোরে খামচে ধরে। কিন্তু নারীকষ্ঠের তীক্ষ আর্তনাদে তার হাত শিথিল হয়ে আসে, আমার রঞ্জুরে মেরি ফেললে গো’ এ তো তার মায়ের গলা। -আম্মার ভুল উদ্বেগে ওসমানের হাসি পায়, আম্মা যে কাকে কি ভাবে? —ওর জন্যে মাগুর মাছের ঝোল রাধলাম, জ্বর থেকে উঠি আজ পথ্যি করবে, ছেলেটা আমার এক লোকমা ভাত মুখে দিতি পারলে না গোr—তাইতো! ওসমান বড়ো বিচলিত হয়। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ওসমান দেখতে পায়, যাকে সে এতোক্ষণ চুমু খেয়ে চলেছে এবং রানুর পুনর্বাসনের জন্য যার গলা টিপে ধরেছে সে বোধহয় রন্ধু নয়, মানে রানুর ভাই রঙ্গু নয়।-তবে সে কে?—এতো সব ঝামেলার মধ্যেও ওসমানের বাম হাতের তৎপরতা কিন্তু একটুও থামেনি। হাতের ভেতর তীব্র ও দ্রুত স্পন্দন বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে তার লুঙি ভিজে যায় এবং হাত ও উরু চটচট করে। এতো দূর থেকে অন্য ১টি রাষ্ট্র থেকে তার মা এরকম বিলাপ করে কেন?-লুঙি গুছিয়ে পরতে পরতে ওসমান হাপায়। বুকে তার প্রবলরকম ওঠানামা চলে, ভয় হয় হার্টে আবার নতুন কোনো উপসর্গ দ্যাখা গেলো না তো? অনেক হার্টের রোগী আছে একটুখানি পরিশ্রমে হাসফাস করে। অনেকে বাথরুমে গিয়ে গুমুতের সঙ্গে প্রাণটিও ত্যাগ করে বসে। যৌন সঙ্গম করার সময়ও মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এইভাবে কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুর কারণ তার যৌনসঙ্গী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। আর এই একা, কেবল নিজের হাত সম্বল করে যৌন কামনা মেটাতে গিয়ে ওসমান যদি মরে যায়, তাহলে? এভাবে মারা গেলে তার মৃত্যুর কারণ ভয়াবহভাবে অজ্ঞাত রয়ে যাবে।-এই ভাবনা ওসমানকে নিস্তেজ করে ফেলে, স্তিমিত রক্তপ্রবাহে টিপটিপ আওয়াজ ক্রমে ঝাপশা হয়ে আসে। নিশ্বাস আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলে সে টলে পড়ে তন্দ্রায়। নিশ্বাসে নিশ্বাসে তন্দ্র থেকে ঘুমের ভেতর গড়াতে গড়াতে ওসমান দ্যাখে যে রঞ্জুর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে তার তক্তপোষ জুড়ে। রঞ্জুর গলায় ওসমানের আঙুলের দাগ নীল হয়ে বসেছে। তবে কি স্বপ্নে কি জাগরণে, হত্যাকারীর যে ভয় পাবার কথা, তা কিন্তু তার হয় না। সে বরং তারিয়ে তারিয়ে লাশটা দ্যাখে। তার দৃষ্টির ঘষায় রঞ্জুর গলার আঙুলের নীল মুছে যায় এবং এমনকি তার বয়সও বাড়তে থাকে। বয়সের সঙ্গে পাল্টায় চেহারা, শরীরের গড়ন। সেটা পরিণত হয় ওসমানের লাশে। একটুও চমকে না উঠে কিংবা দুঃখিত না হয়ে, এমনকি অবাক না হয়ে তক্তপোষে খুঁকে নিজের লাশে ওসমান বুলেট খুঁজতে থাকে। মিছিলে গুলি হলো, বুলেটটা শরীরের কোথায় লাগলো, এর মধ্যেই কি সে বেমালুম ভুলে গেলো? বুলেট না হোক, বুলেটের দাগ তো পাওয়া যাবে। ময়লা চাদর তুলে তন্ন তন্ন করে ওসমান গনি নিজের মৃতদেহে বুলেটের দাগ খোজে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে ওসমান মন খারাপ করে, আরেকটু সময় পেলে বুলেটটা সে ঠিকই বার করতে পারতো। তার ভাগ্যটা বরাবরই এমন, স্বপ্নে পরম কাম্য কিছু হাতের মুঠোয় আসার ঠিক আগের মুহুর্তে তার ঘুম ভেঙে যায়।
মশারি টাঙন নাই? কহন ঘুমাইলেন? ঘরে চোকে খিজির, মিটিঙে ভি গেলেন না। আমি বহুত বিচরাইলাম!’
বিছানায় বসে ওসমান সিগ্রেট ধরায়, পাকিস্তান মাঠে মিটিং কেমন হলো? মিটিং আরম্ভ হইলো মাগরের বাদ, আগে খালি গ্যাঞ্জাম, খালি হাউকাউ।
কেন? ‘মহল্লার সর্দাররে দেইখা পাবলিকে চেইতা গেছে। জিগায়, আরে আইতে কইলো काठाम्न ?’
আলতাফ কিন্তু আগেই এরকম সম্ভাবনা আঁচ করেছিলো। আলতাফদের দলের ১টি ছেলেকে নিয়ে ঐ সর্দার সায়েব কয়েকদিন আগে আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে দ্যাখা করতে আসে। ছেলেটি তার ভাইপো, লতিফ সর্দার আবার রহমতউল্লার কিরকম আত্মীয়।
আলাউদ্দিন মিয়ার অফিসে বসে সে ছোটোখাটো ১টা বস্তৃতা ছাড়ে। লোকটার বয়স ৭০-এর কাছাকছি, এর বেশির ভাগ সময় কেটেছে নবাববাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। হঠাৎ করে সে উপলব্ধি করেছে যে পাকিস্তান সরকার হলো ১ নম্বর গণবিরোধী শক্তি। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানের উদ্যোগে পাকিস্তানের পয়দা, বাঙলার মুসলমান ছিলো কায়েদে আজমের ১ নম্বর বাছ। অথচ, পূর্ব পাকিস্তানের ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা আজ চাকরি পায় না, পেলেও প্রমোশন হয় না, প্রমোশন পেলেও তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নাই। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের আর লাইসেন্স জোটে না, সব দখল করে নেয় পাঞ্জাবি হার্মাদরা। পাকিস্তান সরকারের এই শোষণমূলক নীতির প্রতিবাদে লতিফ সর্দার সায়েব মৌলিক গণতন্ত্রীর পদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে এসে শামিল হবে বিরোধী দলের আন্দোলনে। গণবিরোধী সরকারকে উৎখাত করার জন্যে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সে প্রস্তুত। এমনকি জনসেবার জন্যে সরকার তাকে তমঘায়ে খিদমত খেতাব দিয়েছিলো, গভর্নর হাউসের অনুষ্ঠানে মোনেম খান নিজে তাকে মেডেল পরিয়ে দেয়, সেই খেতাব সে প্রত্যাখ্যান করবে এবং মেডেল বেচে টাকাটা দান করবে আন্দোলনের তহবিলে। তার এতোসব সংকল্পের কথা শুনেও কিন্তু আলতাফের মন টলেনি। আলাউদ্দিন মিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর পরই আলতাফ ওর অবিশ্বাস ও অসন্তোষ দেখিয়েছিলো, লোকটা টাফ রি-এ্যাঁকশনারি। নবাববাড়ির বুটলিকার, মুসলিম লীগের মধ্যেও মুসলিম লীগার এখন হাওয়া বুঝে এদিকে আসতে চাইছে। এদের নেওয়া মানে পার্টির ইমেজ নষ্ট করা, এরা পার্টির লায়াবিলিটি হবে।’ আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য আলতাফের সঙ্গে একমত হয়নি, ধরেন, বেসিক ডেমোক্র্যাট খসাইতে পারলে গওর্মেন্টের একটা ইটা খইসা পড়ে, আইয়ুব খানেরে একটু জখম করতে পারেন। আরো দশটা বিডি উনারে ফলো করতে পারে, অন্তত ডরাইয়া যাইবো তো! কিছুক্ষণ তর্ক করে আলতাফ বেরিয়ে ওসমানকে বলে, নিজের মহল্লায় লোকটা খুব আনপপুলার। ওখানে আমাদের পার্টি অফিসে সুবিধা করতে না পেরে এসেছে এখানে। আগেই খবর পেয়েছি, ইকবাল হলের সঙ্গেও লাইন করার চেষ্টা করছে। এখন এই লোককে আমাদের সঙ্গে দেখে ওদের মহল্লার লোক এ্যাডভার্সলি রি-এ্যাঁক্ট করতে পারে। এখন খিজিরের কাছে একই ধরনের রিপোর্ট পেয়ে ওসমান জিগ্যেস করে, পাবলিক চটে গিয়েছিলো?
‘পাবলিকে কয়, সর্দার হালায় দশটা বচ্ছর মহল্লাটারে জ্বালায়া খাইছে। এ্যাঁর দোকান দখল করে, অর দোকান উঠাইয়া নিজের বাইরে বহায়। একটা ইস্কুলের নামে সরকার জায়গা দিছিলো, সর্দার নিজে ঐ ইস্কুলের কমিটির পেসিডেন। ইস্কুল বাদ দিয়া ঐ জায়গার মইদ্যে মার্কেট বানাইয়া দিছে! পোলার নামে, বিবির নামে, ভাই ভাইসতার নামে মহল্লার ব্যাকটি র্যাশন দোকান রাইখা দিছে। আবার দোকানের মাল দিবো না, নিজের বাড়ির মইদ্যে মাল রাখে, কাস্টমারে গেলে কয়েলে কয়, মাল নাইক্কা। চিনি, গম, চাইল, তাল ব্যাকটি বেলাকে বেচে – পাবলিক এইগুলি লইয়া মিটিঙের মইধ্যে হাউকাউ করলো-
আলতাফ কি বললো? ‘আলতাফ সাব যায় নাই। আমাগো আলাউদ্দিন সাব ভাষণ দিয়া বহুত কোশেশ করলো, মগর পাবলিকে শোনে না, কয়, লতিফ সর্দাররে বাইর কইরা না দিলে আমরা মিটিং ভাইঙা দিমু!
‘তারপর?
আমাগো সাবে বুদ্ধি কইরা ইউনিভারসিটির মইদ্যে খবর পাঠাইলো, ছাত্র লিডাররা আইয়া মাইক লইলো। অরা ধরেন ল্যাখাপড়া করা মানুষ, প্যাটের মইদ্যে এলেম আছে। কয়, সর্দার সাবে নিজের ভুল বুইঝা আমাগো লগে আইছে, উনারে দেইখা আরো বহুত মানুষ আইবো। কয়দিন গেলে আইয়ুব খানে মালুম পাইবো কি তার লগে আর কেউ নাই, তখন গদি ছাইড়া না দিয়া উই করবো কি? ঠিক কইছে না? ওসমান কোনো মতামত না দিলে খিজির দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে বিড়ি ধরায়। এরপরও ওসমান তার অপরিচিত ছাত্রনেতার বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না দেখে খিজির উসখুস করে। বিড়িতে লম্বা লম্বা টান দিয়ে বলে, মগর আমাগো মহল্লার মাহাজনে জিন্দেগিতে ঠিক হইবো না। আর কপালের মইদ্যে আল্লায় কি লেখছে আল্লাই জানে।
‘কেন? উনিও হয়তো ভুল বুঝতে পেরে—।’ নাঃ মাহাজনে মানুষের পয়দা না। দ্যাহেন না, আমি অর ঘর ছাড়লাম, আমাগো সাবের গ্যারেজ ভি ছাড়লাম, অহন তরি আমার লগে কি করতাছে জুম্মনরে দিয়া মায়ে ঐদিন খবর পাঠাইলো—।
জুম্মন? জুম্মনের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে? থাকবো না ক্যালায়? ওসমানকে অবাক হতে দেখে খিজির আরো অবাক হয়, ‘ডেলি ডেলি আমার কাছে আহে। জুম্মনে কয়, মায়ে যাইতে কইছে। কিজানি হইছে। তয় আমি গেছি পরে আর মায়ে কান্দে।
‘কাঁদে? তোমাকে দেখে কাঁদে ?
হ। কাব্দে আর কয় মাহাজনে কামরুদিন ওস্তাগররে ফুসলাইয়া অরে হাসপাতাল পাঠাইবার চায়! উই তো যাইবো না, মহাজনে কইছে ঠিক আছে, দাওয়াই বহুত আছে, এমুন দাওয়াই দিমু, মাগী মালুম ভি করবার পারবে না, প্যাটপুট খইসা এক্কেরে সাফ হইয়া যাইবো।’
তোমার বাচ্চার জন্যে জুম্মনের মায়ের অতোই টান তো তোমার সঙ্গে বেরিয়ে আসে না কেন?’
এবার খিজির দমে যায়। বিড়িতে ফের কয়েকটা টান দিয়ে বলে, জুম্মনরে মানুষ করবার চায়। বড়োলোকের বাড়ি কাম কইরা অর নজরখান হইছে বড়ো। খালি এক প্যাচাল পাড়ে, ল্যাহাপড়া শিখাইয়া জুম্মনরে বেবি ট্যাকসির মাহাজন বানাইবো!
তোমার সঙ্গে থাকলে জুম্মন মানুষ হবে না? এ ব্যাপারে খিজিরের সন্দেহ আছে! আমি একটা ভ্যাদাইমা মানুষ। কহন কৈ থাকি ঠিক নাই। পরের পোলারে হুদাহুদি লইয়া—। বিড়ির ধোঁয়ায় হঠাৎ তার বেদম কাশি আসে, কাশতে কাশতে উঠে ছাদে গিয়ে কফ ফেলে। ওসমান মশারি টাঙায়, খিজিরের ওপর তার রাগ হয়, লোকটা একেবারে অপদার্থ। রানু একদিন ঠিকই বলেছিলো, সাহস থাকলে বৌটার চুলের গোছা ধরে টেনে আনতো।
ঘরে এসে খিজির ফের মেঝেতে বসে। ‘আপনে অমাগো সায়েবরে এটু কইবার পারবেন?
আলাউদ্দিন মিয়াকে? কি?
খিজির মেঝেতে নিজের জন্য বিছানা পাতে, ওসমানের দিকে তাকায় না, বিছানা পাতায় সমস্ত মনোযোগ দিয়ে বলে, আপনে কইবেন, খিজিরের তো পোলাপান নাই। আর বৌয়ের প্যাটের বাচ্চাটারে মাহাজন যানি নষ্ট না করে।’ তারপর? বাচ্চ হলে তুমি কি করবে? লইয়া আহুম। একটা বিয়া করুম। ঐ বৌ পোলারে মানুষ করবো। খিজিরের এতো সহজ সিদ্ধান্তে ওসমান থ হয়ে যায়। নিজের বিছানা ছেড়ে খিজির এসে বসে ওসমানের তক্তপোষের পা ঘেঁষে, বেশিদিন না। কয়টা দিন যুদিল অর মায়ের প্যাটের মইদ্যে বাচ্চাটার জান কবচ করা ঠেকাইতে পারি তয় আমার আর চিন্তা নাই।’
কেন? মহাজন তো যে কোনো সময়- আরে না। আইয়ুব খানের দিন খতম হইয়া আইছে। বোঝেন না পাবলিকে কেমুন গরম অর নিজের মানুষ ব্যাকটি অর পাট্রি ছাইড়া কইটা পড়ে, আইয়ুব খানে থাকবার পারবো?
‘পারুম না? আইয়ুব খান মোনেম খানে খতম হইলে আমাগো মাহাজন হালার রোয়াবি থাকবো? তহন মহল্লা ছাইড়া হালায় কৈ পলাইবো দিশা পাইবো না। এই তো এই কয়ট দিন আউজকা আমাগো আলাউদ্দিন সাবে কইলো, আবার ইউনিভারসিটির ছাত্র ভি ভাষণ করলো, আর কয়টা দিন গেলে পুরা পাকিস্তান গওরমেন্ট উপ্ত হইয়া পড়বো।’
তাহলে তুমি এতো ঘাবড়াচ্ছে কেন? ঘাবড়াই না। তয় ধরেন আগেই যুদিল জুম্মনের মায়েরে কিছু করে, তাই হুঁশিয়ার থাকতে চাই। খালি এই কয়টা দিন। খিজিরের কিং স্টর্ক সিগেট ও বিড়ি খাওয়া এবং চিৎকার-করা গলা মিনতিতে খসখস করে, আপনে খালি কইয়েন, কয়টা দিন রাখতে পারলেই কাম হয়। মাহাজনের দিন এই খতম হইয়া আইলো।
কিন্তু আলাউদ্দিন মিয়ার কাছে এই আবেদন নিয়ে ওসমান যায় কি করে? লোকটা কি ওসমানকে সহ্য করতে পারবে? রানু যা বললো তাতে মনে হয় রহমতউল্লা তার মেয়ের সঙ্গে ওসমানের বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে। আলাউদ্দিন মিয়া তাহলে তো ওসমানের সঙ্গে কথাই বলবে না। রহমতউল্লার মেয়েটা দেখতে ভালো, ওসমান ২/৩ বার দেখেছে মেয়েটাও কি তাকে দেখেছে? ওসমানের প্রতি সিতারা কি দুর্বল? মেয়ের দুর্বলতা বুঝতে পেরে রহমতউল্লা হয়তো ওসমানকে ডেকে পাঠিয়েছে। রহমতউল্লার মেয়ে কি তাকে নিয়ে কখনো ভাবে? —মহাজনের মেয়ের ভাবনায় ওসমানের মাথায় বেশ ঝিরঝিরে হাওয়া বইতে থাকে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৫
আরে আসেন, আসেন। ওসমানকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আধশোয়া অবস্থা থেকে রহমতউল্লা ইজিচেয়ারের ক্যানভাসে একটু সোজা হয়ে বসলো, আপনার লগে আমার কথা আছে, বসেন। পাশেই হাতলওয়ালা চেয়ারে বসলো ওসমান, কিন্তু রহমতউল্লা কথা চালিয়ে যায় তার কয়েকজন মিস্ত্রীর সঙ্গে, দোলাই খালের উপর নির্মীয়মাণ রাস্তার কোনো অংশে সিমেন্টের অতিরিক্ত ব্যবহার হয়েছে বলে সে ঝাড়া ১০ মিনিট ধরে তাদের বকে। তারপর তাদের ছাটাই করার হুমকি দিয়ে রহমতউল্লাহ ইজি চেয়ারে আরাম করে ফিরে আসে তার প্রায় শোয়া অবস্থায়। ওসমানের মনে হয়, এতোক্ষণ বরং ভালো ছিলো। ওসমানকে এখন যদি সে তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তো সে জবাবটা দেবে কি? এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করবে কিভাবে? বলা যায় যে, তার বাবা বা কোনো গুরুজন এখানে নাই, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলে সে কিছুই করতে পারবে না। রহমতউল্লা বলবে, ওসমান তার বাবাকে চিঠি লিখুক। কিংবা ঠিকানা দিলে রহমতউল্লা নিজেই চিঠি লিখতে পারে।-ওসমানের বাড়িঘর নাই, সে বিয়ে করে কিভাবে? —রহমতউল্লা বলতে পারে, তাতে কি? তার নিজের মেলা বাড়ি আছে। না, রহমতউল্লার বাড়ি ওসমান কক্ষনো নিতে পারে না। তবে কি-না কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর এরকম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ভঙ্গি বিনীত হওয়া উচিত। রহমতউল্লার মেয়েকে সে কোনোভাবেই বিয়ে করতে যাচ্ছে না, সিতারার জন্য হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছে আলাউদ্দিন মিয়া। কিন্তু মেয়েটা সম্বন্ধে একটু বিবেচনা থাকা ভালো। রানুর সঙ্গে মাখামাখিটা বড়ডো বেশি হয়ে যাচ্ছে। রানুর ভাবনা মাঝে মাঝে এমন করে বেঁধে যে এতোটা উত্তেজনা সহ্য করা কঠিন। এমন কি তার এ্যাঁসিডিটি বেড়ে যাচ্ছে, যখন তখন মাথাও ধরে। নোভালজিন আর এ্যাঁন্টাসিডের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আর কতো সহ্য করা যায়?=বরং অন্য কেউ যদি তার মধ্যে একটু স্পন্দন তৈরি করতে পারে তো ১টা ব্যালান্স হয়, তখন এ্যাঁন্টাসিড আর নোভালজিনের জায়গায় রানু আর রহমতউল্লার মেয়ে তার ভেতর সামঞ্জস্য বিধানের দায়িত্বটা পালন করতে পারে।
আপনার লগে খিজিরে থাকে? মহাজনের এই প্রশ্ন শুনে ওসমান ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। চায়ের পেয়ালায় সশব্দে চুমুক দিয়ে রহমতউল্লা বলে, ঐটারে তো চিনেন না! নেমকহারামের বাচ্চা নেমকহারাম! চুরি চামারি কইরা আমার গ্যারেজটারে পল্টনের ময়দান বানাইবার তালে আছিলো। মনে লয় শেখ মুজিবের মিটিং করনের জায়গা বানাইবার নিয়ত করছিলো। আলাউদিনে ভি তারে রাখবার পারলো না! আপনারে কইয়া রাখলাম!’
আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ওসমানের এরকম প্রতক্ষ্য প্রতিক্রিয়া শুনে রহমতউল্লা নড়েচড়ে বসে। তা সে যতোই নডুক, ওসমান এখন অনেক কথা বলতে সক্ষম। মেয়ের সঙ্গে ওসমানের বিয়ে দেওয়া রহমতউল্লার সম্ভাব্য প্রস্তাবের কথা ভেবে সে একটু আগে মিষ্টি মিষ্টি লজ্জা পাচ্ছিলো—এই গ্রানিতে ওসমান বেপরোয়া হয়ে ওঠে, খিজিরিকে আমার খারাপ লোক মনে হয় না।
আপনেরা কারে খারাপ কন, কারে ভালো কন, সেইটা আপনেগো ব্যাপার। মগর ঘর যহন ভাড়া লইলেন তহন একলা থাকনের কথাই তো কইছিলেন। ‘না আমি একা থাকবো এরকম কথা বলে ভাড়া নিইনি।’ আহা, চ্যাতেন কেন? রহমতউল্লা চটে না, আপনার ভালার লাইগাই কইছিলাম। হালায় চোর তো আছেই, আবার আকামকুকাম যা তা করবার পারে। শুওরের বাচ্চার চোখ দুইখান দেখেছেন? মানুষ ভি খুন করবার পারে, বোঝেন?
‘না, আমার মনে হয় না। খিজির আমার সঙ্গেই থাকবে। আপনার যদি আপত্তি থাকে তো আপনি আমাকে লিখিতভাবে জানাবেন। যদি আমাকে উচ্ছেদ করতে চান তো উকিলের নোটিস পাঠাতে হবে। ওসমান উঠে দাঁড়ায়। এরপরও রহমতউল্লার কোনো বিকার নাই। চিৎকার করে কাজের লোককে পান আনতে বলে সে ওসমানকে হাত দিয়ে বসতে ইশারা করে, আরে বসেন। আপনার লগে কথা আছে কইলাম না? ওসমান ফের বসে, কিন্তু বিরক্ত হয়, এতোক্ষণ তাহলে হলোটা কি?
এর মধ্যে নারিন্দার মোড় থেকে কাঁঠালপাতার ঠোঙায় তেহরি এসে পড়লো। ২টো প্লেটে তেহারি সাজানো হলে খান’ বলে রহমতউল্লা ধোঁয়া-ওঠা তেহারির ভেতর থেকে ছোটো ছোটো গোশতের টুকরা গুছিয়ে একদিকে রাখলো। খেতে খেতে তার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি শুরু করলো, মকবুল সাবের মাইয়ারে তো আপনে পড়ান, না?
টেবিলের নিচে ওসমানের পা দ্রুত নড়তে শুরু করে, প্লেটের কোণ থেকে সে পরপর ৩বার সালাদের গাজর ও টোম্যাটো খেয়ে ফেলে।
মাইয়া তো মনে হয় ভালোই? ওসমান কিভাবে রহমতউল্লাকে প্রতিহত করবে মনে মনে তার প্ল্যান করতে চায়। কিন্তু হয় না। রানুর সঙ্গে ওসমানের মেলামেশার অছিলা তুলে বাড়িওয়ালা কি তাকে উচ্ছেদ করবে? কেন, ওসমান কি মাগনা থাকে?-খিজিরকে সহ্য করতে না পেরে আমাকে উচ্ছেদ করতে চাও এখন রানুর সঙ্গে আমার মেলামেশার অজুহাত ধরে। আর কাল যখন খিজির নিজেই এসে তোমার বাড়ি দখল করবে, তখন তাকে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা তোমার হবে? তখন?-ওসমানের এইসব নীরব উত্তেজনা চিড় খায় রহমতউল্লার ঘর্ঘর গলার আওয়াজে, কইলেন না, মাইয়া কেমুন?
‘কেন? একটা সম্বন্ধ করবার চাই। খাওয়া শেষ করে রহমতউল্লা টেবিলে রাখা চিলমচিতে হাত ধোয়, কুলকুচো করে এবং মুখ মুছে খিলাল করে। এই লাইগা আপনারে ডাকছিলাম। আমার এক সাড়ু ভাই, তার পোলার লগে বিয়া দিবার চায়। আমার সাভূভাইয়ের-।
আপনার সাডুভাই? হ। নবাবপুরে হার্ডওয়ারের দোকান আছে। নাজিরা বাজার আলাউদ্দিন রোডে সাইকেল পার্টসের দোকান। রেশন দোকান আছে কয়েকটা। আবার ওয়ার্ডের মেম্বার, বহুত পুরানা মেম্বার, নবাব সাবগো আমলে বাইশ পঞ্চায়েত আছিলো, নাম হুনছেন?–তহন থাইকাই ওরা- বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে পড়ে, আরে আপনে দেখছেন তো ঐদিন আইছিলো। এই পয়গাম ঠিক করতেই আমার কাছে আইছিলো। পরে আলাউদিনের কাছে গেলো। শুনলাম আপনাগো সাথে জয়েন করবার কথা কইছে।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ। পাকিস্তান মাঠে মিটিঙে বক্তৃতা করেছে। বিডি মেম্বার থেকে রিজাইন করলেন।
চিনছেন? রহমতউল্লা উৎসাহিত হয়, উনির পোলা। উনির বিবি, মানি আমার বিবিসায়েবের বড়োবোন মাইয়ারে দেখছে, পোলায় ভি দেখছে। দোনোজনের পছন্দ। পোলায় আবার মায়েরে ছাড়া কিছু বোঝে না। তা ঐদিন আমি গিয়া মাইয়ারে ডাইকা
কথাবার্তা কইলাম। রংটা ময়লা। তা হোক। এমনিতে আদব কায়দা জানে। ভালো। মকবুল মিয়ারে আমি কইছি।’
উনি কি বললেন? কি কইবো? পোলার তো টাকাপয়সার অভাব নাই। দোকানপাট, তেজারতি তো আছেই, অর বাপে আবার মার্কেট বানাইতাছে।’
ঐ যে স্কুল ভেঙে মার্কেট বানাচ্ছে? আরে, ঐটা লইয়াই তো ভাইসাবে আমার ফাইসা গেছে। ইস্কুলের লগে জমিন অগো, এজমালি সম্পত্তি। ইস্কুল বিল্ডিং বহুত পুরানা, নবাব সলিমুল্লা সাবের ভি আগে আতিকুল্লা সাব কয়দিনের লাইগা নবাব হইছিলো, উনার জমানার ইস্কুল। ইস্কুল বিল্ডিং ধইসা পড়ে দেইখা ঐটা মেরামত করনের কন্ট্রাক্ট পাইছিলো ভাইসাবে। ঐ বিল্ডিং মেরামত কইরা ফায়দা নাই, আবার ভাইঙা পড়বো। ইস্কুল ভাইঙা তাই নিজের জমিনের লগে মিলাইয়া মার্কেট তুইলা দিছে। পাবলিকে বহুত চেতছে। ভাইসাবে আমার একবার এদিক ফাল পাড়ে, একবার ওদিক ফাল পাড়ে। অহন তাই আওয়ামী লীগের লগে লাইন দিবার চায়। আমারে কয়, আপনে ঠিকই আছেন, আপনে পুরানা দল লইয়া থাকেন, আমি যাই অগো লগে। আমি কই, ভাইসাব পুরানা চাল ভাতে বাড়ে। একবার যে মসজিদের মইদ্যে—। এই দীর্ঘ সংলাপে ভায়রার বৈষয়িক ও রাজনৈতিক তৎপরতা সম্বন্ধে রহমতউল্লার মনোভাব বোঝা যায় না। এই নিয়ে ওসমানের মাথা ঘামাবার দরকার কি? রহমতউল্লার প্রস্তাবে মকবুল হোসেনের প্রতিক্রিয়া জানাটা বরং অনেক জরুরি। তা মকবুল সায়েব আপনাকে কি বললেন?’
উনার কথা ক্লিয়ার না। কয়, মাইয়া নাকি ল্যাখাপড়া করতে চায়। আবার পোলায় বিএ পাশ নাকি এইটা জিগায়। আরে, বিএ এমএ রাস্তার মইদ্যে গড়াগড়ি যাইতাছে।
‘আমি কি করবো?
আপনে এটু কইবেন। আপনে কইলে মনে লয় মাইয়া না করবো না। রহমতউল্লাহ মিষ্টি করে হাসে, ভালো কইরা বুঝাইয়া কইয়েন। এমুন দুলা পাইবো কে? আপনেরে মনে হইলো অর বাপে ভি খুব মানে।