এতো রাতেও ওসমান সায়েবের ঘরে আলো জুলছে। ওসমান বলে, ‘থাকো না? দাঁড়াও, মেঝেতে একটা সতরঞ্চি পেতে দিই!’
খিজির আসায় ওসমান বেশ খুশি। আনোয়ারকে চিঠি লেখার পর কেমন ফাকা ফাকা ঠেকছিলো। খিজিরকে পেয়ে মাথাটাকে ব্যস্ত রাখা যাবে। ওসমান একটা কিং স্টক এগিয়ে দিলে খিজির বলে, আমার বিড়ি আছিলো।
থাক না। তুমি তো এই সিগ্রেটই খাও দেখি।’
কয়দিন হইলো বিড়ি ধরছি। সিগারেটে জুত পাই না। বিড়িটা ধরাইয়া দুইটা টান দিলে শরীলটা গরম হইয়া ওঠে!’
কিন্তু ওসমানের দেওয়া কিং স্টর্কে তার প্রাণপণে টান দেওয়া দেখে মনে হয় না যে সিগ্রেটে তার কিছুমাত্র অরুচি ধরেছে।
চিলেকোঠার সেপাই – ২৮
ওসমানের ঐ চিঠি আনোয়ার পায়নি। এর ১টি কারণ এই হতে পারে যে চিঠিটা শেষ পর্যন্ত ডাকবাক্সে ফেলা হয়নি। ডাকে ফেললেও আনোয়ার ওটা সময়মতো পেতো কি-না সন্দেহ। আনোয়ার তখন ধারাবর্ষা চরে।
হোসেন আলি ফকির বসেছিলো হাতলওয়ালা ১টা চেয়ারে, হাঁটু-গোটানো পাজোড়া তার চেয়ারের ওপর ওঠানো। আনোয়ার বসেছে তার সামনে ১টি টুলে। খালি বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে করমালি। লম্বা চওড়া দশাসই ১ জোয়ান চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে হোসেন আলির ঘাড় ও পিঠ দলাইমলাই করে। হোসেন আলির মুখ থেকে মাঝে মাঝে সুখের ধ্বনি বেরোয়, আঃ। আস্তে! শালার হাত কিবা! মোষের পাও এ্যাঁর চায়া নরম হয়।
হোসেন আলির চোখের সামনে বিশাল চর। কালচে হলুদ জ্যোৎস্নায় নিকানো। আর আনোয়ারের পিঠ ফেরানো রয়েছে চরের দিকে, তার সামনে যমুনা। খুব উঁচু পাড় থেকে খাড়া মাটি লাফিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে নদীর স্রোতে। শীতকালের নিরীহ নদীর চলাচলও এই নির্জন জায়গায় ছলাৎ ছলাৎ করে প্রতিধ্বনিত হয়। নদীর ওপার দাখা যায় না। মনে হয় নদী হঠাৎ করে ঢুকে পড়েছে কুয়াশার খাপের মধ্যে।
ওরা বসেছিলো ঘরের পাশে। চালের পুরু খড়ের প্রসারিত ভাগ ওদের মাথার ওপর। মানুষের হাতে ছাওয়া হলে কি হবে, চাঁদের আলোয় খড়ের চাল বড়ো নির্লিপ্ত ও আদিম। যমুনার পানিহাওয়ায় হোসেন আলি ফকিরের স্বর মোটা ও ভারি। সে একনাগাড়ে কথা বলায় যমুনার পাশাপাশি আরেকটি ধ্বনিস্রোত বয়ে চলেছে। আনোয়ারের আবেদন শোনার পর সে জানায় যে, খয়বার গাজীর ১টা চিরকুট নিয়ে এলে ভালো হতো। খোয়াড়ের আসল পরিচালক তো খয়বার গাজী, শুধু তদারক করার কাজটা দেওয়া হয়েছে তাকে।
খোয়াড়? এখানে খোয়াড় আছে নাকি? আনোয়ার অবাক হলে হোসেন আলি জানায় যে খয়বার গাজীর মস্ত বাথানের সঙ্গে ডাকাত-মারা চরে একটা খোয়াড় করা হয়েছে। সরকারী আইন অনুসারে করা, সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত খোয়াড়। খোয়াড় তো আসলে সরকারের সম্পত্তি, পয়সা দিয়ে খয়বার গাজী কয়েক বছরের জন্য ডেকে নিয়েছে।–তা খোয়াড় কেন?-অসাবধান, দায়িত্বহীন ও পরিশ্রীকাতর লোকজন নিজেদের গোরুবাছুর দিয়ে অন্যের জমির ফসল নষ্ট করে, জমির মালিক সেগুলো ধরে নিয়ে আসে এখানে। উপযুক্ত জরিমান দিয়ে প্রকৃত মালিক নিজেদের গোরুবাছুর খালাস করে নেয়। খয়বার গাজীর অনুরোধে তাকে খোয়াড়ের তদারক করতে হয়, নইলে এসব কাজ করতে তার ভালো লাগে না।
‘আমি নিজেই এসেছি, খয়বার গাজী সায়েব জানেন না যে আমি এখানে আসবো। আনোয়ার এই কথা বললে হোসেন আলি অন্য প্রসঙ্গ তোলে। খয়বার গাজীর কথা বাদ দিয়ে সে তখন বলে নিজের কথা। প্রথম কথা, বাঁচতে তার আর ভালো লাগে না। ৩ কুড়ির ওপর বয়স হলো, সংসার ও পৃথিবীতে অরুচি ধরে গেছে। যমুনা ১৭বার তার ঘর ভেঙেছে। এই শালার নদী, শালী বেশ্যার অধম। কারো প্রতি তার মায়ামোহাব্বত নাই। ঘর ভাঙতে ভাঙতে হোসেন আলির এমন অবস্থা যে জীবনের বিভিন্ন সময়ে বসবাস-করা চরসমূহের কালানুক্রমিক তালিকাও সে দিতে পারে না। বাপজানের কাছে শুনেছে, তার জন্ম হয় যে চরে সেটা ছিলো মাদারগঞ্জ থানায়। হ্যাঁ, পুব পাড়ে। মাদারগঞ্জ থানা, জামালপুর মহকুমা, ময়মনসিং জেলা। তার ছেলেবেলায় চর-দখল নিয়ে মারামারি হলে বাপজানকে পুলিশ ধরে নিয়ে আটকে রাখে সিরাজগঞ্জ জেল হাজতে, পাবনা জেলায়। যৌবনকালে মামলা করতে তাকে যেতে হতো গাইবান্ধা শহরে, জেলা রংপুর। তখন তারা চর হাসুয়ার বাসিন্দা। বছর সাতেক হলো বসবাস করছে এই ধারাবর্ষায়, ভেবেছিলো বাকি জীবনটা এখানেই কাটাবে। তা আর হলো কৈ?—কেন? এই চরে পলি পড়ছে পুবদিকে, ভাঙন শুরু হয়েছে পশ্চিমে। এই যে নদী, কয়েক বছর আগে ছিলো আরো পোয়া মাইল পশ্চিমে। গত বর্ষায় পোয়া মাইল ভেঙেছে, আরেকটা ছোবল দিলেই খড়ের এই চারচালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই ভাঙাগড়া আর মারামারি আর ভালো লাগে না। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন শান্তিতে থাকবে বলে খোয়াড় তদারকির নিরিবিলি কাজটা সে নিয়েছিলো। তখন কি জানে যে এখানেও এতো ঝামেলা, এতো ঝঞ্চাট? হিংসুটে লোকের কি অভাব? কার কাছে কিসব উল্টাপাল্টা খবর পেয়ে পুলিশ এসেছিলো, ধকল সামলাতে হয়েছে হোসেন আলিকেই। পুলিশ তো পুলিশ, পুলিশের বাপ এসে কি করবে তার? খোদ এমএনএ সায়েবের শেয়ার আছে খোয়াড়ের ব্যবসায়, গতবার ইলেকশনে এই এলাকার বিডি মেম্বারের ভোট জোগাড় করে তাকে পাস করিয়ে দিলো কে?–হোসেন আলি ছাড়া আবার কে? এমএনএ সায়েবের ওঠাবসা মন্ত্রীগবর্নরের সঙ্গে, এবার কেউ গোলমাল করলে টাইট করার জন্যে দরকার হলে মিলিটারি নিয়ে আসবে। মিলিটারির ডাণ্ডা না পড়লে মানুষ ঠিক পথে চলে না। হোসেন আলি আক্ষেপ করে, মানুষ কি আর সেই আগের মানুষ আছে? আল্লারসুল মানে না, মানীকে সম্মান করে না, ভদ্রলোকের ইজ্জত দেয় না। এই যমুনা পার হলে পুবে মাদারগঞ্জ থানা, সেখানে মানুষ চরম বেয়াদব হয়ে উঠেছে, খাজনা বন্ধ করার পায়তারা করছে। কোন বিডি মেম্বারের ধানের গোলা লুট করেছে, তহশীলদারের অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোর-ডাকাতের রাজস্ব শুরু হয়ে যাচ্ছে। আরে, সার্কেল অফিসার উচ্চশিক্ষিত ও সদ্বংশজাত ভদ্রলোক,-তার বাড়ি ঘেরাও করে চাষারা তার বৌ-ঝির হাত ধরে টানাটানি করে। এই জাতের ওপর গজব পড়বে না তো কি আল্লার রহমত নাজেল হবে?
না সরকার, মেয়ামানুষের গাওত হাত তোলা হয় নাই! করমালির কথায় হোসেন ফকিরের দীর্ঘ ও একটানা বাক্যস্রোত বাধা পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফের উপচে ওঠে, মিছা কথা কল্যাম? একটা অফিসারের বাড়ির মদ্যে চাষাভুষারা ঢুকা পড়ে, এটা জুলুম হলো না? ফুসে উঠতে উঠতে হোসেন আলি হঠাৎ নিভে যায়। আনোয়ার কিন্তু একটু ভয়ই পেয়েছিলো, করমালির উদ্ধত বাক্যে হোসেন আলি চট করে ১টা কিছু করে না ফেলে। এর মধ্যেই হোসেন আলির জীবনের অনেক বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী শোনা হয়েছে। তার শতকরা ৫০ ভাগ সত্যি হলেও সে ভয়াবহ বিপজ্জনক চরিত্র। হাসিয়া, বর্শা ও বল্লা নিয়ে বাপজানের সঙ্গে সে যে কতো জায়গায় কাজিয়া করতে গেছে তার হিসাবনিকাস নাই। এই হাতে সে খুন করেছে অন্তত ১৪জন মানুষ। আবার কোটকাচারি করতেও তার জুড়ি মেলা ভার। ফৌজদারী আইনে তার দখল দেখে বাঘা বাঘা উকিল মোক্তার থ হয়ে গেছে। কামিনীবাবু, গাইবন্ধার বাঘা উকিল কামিনী চক্রবর্তী পর্যন্ত বলেছিলো, ‘হোসেন, ল্যাখাপড়া করলে বড়ো ব্যারিস্টার হইতে পারতিস’ এ কথা কেন বলেছিলো?—হোসেন আলি একটুখানি হেসে বয়ান করে উগল্যান কি আজকার কথা বাপুঃ –সেবার খুব মজা হয়। সদ্য জেগে-ওঠা বাঘুরিয়া চরে হোসেন তখন সবে ঘরদোর তুলে বাস করার আয়োজন করছিলো। শিমুলবাড়ির তালুকদাররা যায় সেই চর দখল করতে। তাদের লাঠিয়াল ছিলো কাগমারীর, কাগমারীর লাঠিয়ালদের তখন খুব নাম। তাদের সঙ্গে পারা কঠিন। অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে হোসেন আলি ছিপনৌকা করে চম্পট দিলো সোজা সিরাজগঞ্জের দিকে। তবে পালাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নিজের দুজন কিষানকে তার গোয়ালঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেয়। সিরাজগঞ্জ কোর্টে মামলা ঠুকে দিলো, তালুকদারেরা তার বাড়িতে চড়াও হয়ে তার খাস ২জন কামলাকে পুড়িয়ে মেরেছে। এই ১ বুদ্ধির জোরে তালুকদারদের ৪ লাঠিয়ালের যাবজ্জীবন।-তো সেটা বৃটিশ আমল বাপু, তখন যে সে লোক হাকিম হতে পারতো না, চাষাভূষার বেটারা সব পায়ের তলায় পড়ে থাকতো। তা, এখন কি অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো নাকি যে করমালির কথায় হোসেন আলি সেভাবে জ্বলে উঠলো না? করমালির কথার জবাবে সে কেবল বিড়বিড় করে, বেশি কথা কস না। কিন্তু তার এই আদেশ তেমন শোনা যায় না, তার গলায় ঘন শ্রেম্ম।
সের দেড়েক মোষের দুধ দিয়ে প্রায় ঐ পরিমাণ ভাত খেয়ে করমালি চলে যায় ঘাটে, সে রাত্রিকাটাবে নৌকায়, পচার বাপের সঙ্গে। ভদ্রতাবোধ থেকে হতে পারে, আবার ভয়েও হতে পারে,-আনোয়ার হোসেন আলির আতিথ্য গ্রহণ করে। মোষের দুধ দিয়ে ভাত খেয়ে সে শুয়ে পড়ে হোসেন আলির অড়বিহীন লেপের নিচে। তার জন্য নিজের বিছানা ছেড়ে হোসেন আলি শুয়েছে মস্ত একটা কাঠের বাক্সের ওপর। শোবার পরও তার কথা শেষ হয় না: এই ভদ্রলোক-বিবর্জিত চরে আনোয়ারকে উপযুক্ত আদর যত্ন করতে না পেরে সে মরমে মরে যাচ্ছে। এখানে কি মানুষ থাকতে পারে? মেঘনা কি রমনা সিগ্রেট কিনতে হলেও ২ ঘন্টার পথ ধরে নৌকায় যেতে হয় চালুয়াবাড়ি। এদিকে চরের পশ্চিমে ভাঙন শুরু হওয়ায় হোসেন আলি তার ৩টে বৌয়ের সবকটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে পুৰে। তাদের বাথান বলো, খোয়াড় বলো সব ঐদিকেই। ওদিকটায় চর পড়ছে, ডাকাত-মারা চরের সঙ্গে এই ধারাবর্ষা এক হয়ে গেলে সেখানে হোসেন আলি স্থায়ীভাবে বাস করবে। টিনের আটচালা ঘর তুলবে, আম কঁঠালের গাছ লাগাবে।
এতো কথা বলে, কিন্তু কাজের কথা তুললেই বাক্য হয়ে আসে সংক্ষিপ্ত। যেমন, গোরু কার? আপনাগোরে তো নয়?
করমালির গোরু, ওর জ্যাঠা পচার বাপের গোরু। ‘দ্যাখা যাক। হোসেন আলি সশব্দে হাই তোলে। আনোয়ারেরও চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।
ঘণ্টা দুয়েক পর পেটে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা শুরু হলে আনোয়ারের ঘুম ভাঙে। ঘর অন্ধকার। কিন্তু ভেজানো দরজার ফাক দিয়ে দেড় ইঞ্চি চওড়া আলোর রেখা ভেতরে এসেছে। আনোয়ার উঠে দরজা সম্পূর্ণ খুললে জ্যোৎস্নার আলো ঘর জুড়ে থইথই করে। হোসেন আলি ফকিরের বিছানা ফাকা। দরজার পাশে রাখা পানি ভরা বদনাটা হাতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তলপেটের বেগ তীব্র হয়ে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে আনোয়ার এদিক ওদিক তাকাতেই লোহার শাবল লাগানো বাঁশ হাতে এগিয়ে আসে মস্ত এক জোয়ান। আঙুল দিয়ে লোকটা সামনের দিক নির্দেশ করে, ঐ জায়গাত বসেন।
কোথায়? পায়খানা কোথায়?’
ঐ সোতার ধারত বসেন।
মোষের দুধ খাওয়ার ফল প্রায় হাতে হাতে পাওয়া গেলো। এর ওপর নদীর পানিতে এরা এক দানা ফিটকিরি পর্যন্ত দেয় না। আমাশার আর দোষ কি? পায়খানা করে হোসেন আলির ঘরে ফিরতে দরজার সামনে বল্লমধারী ঐ যুবককে দেখে আনোয়ার এবার ভয় পায়। পেটের ব্যথাটা তখন খুব মোচড় দিচ্ছিলো বলে ভয় পাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। দশাসই চেহারার তরুণ মেয়েলি ভঙ্গিতে হাসে, যান, আপনে নিন্দ পাড়েন। আত এখনো মেলা আছে।’
সে তো ঘড়ি দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু হোসেন আলি কোথায়?
লোকটা পায়চারি করে, হাটতে হাটতে জবাব দেয়, তাই গেছে বাথানের দিকে।
কেন? হঠাৎ এতো রাত্রে?
পুব পাড় থাকা মানুষ আসছে। গোরুবাছুর ডাকাতি করবার আসছে। লোকটির বিশাল শরীর আচঞ্চল, মুখের হাসি হাসি ভাব অবিকৃত। এমনকি বাথান আক্রমণের খবর দেওয়ার সময়ও তার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। পূর্ব দিক থেকে দুৰ্বত্তের দল এসেছে লাঠিসোটা নিয়ে। হোসেন আলির লোকজনও প্রস্তুত। ওখানে সুবিধা করতে না পেরে ডাকাতরা আবার নৌকা নিয়ে পশ্চিমদিকে এসে হোসেন আলির বাড়িতে হামলা চালাতে পারে, তাই বল্লম ও হাসুয়াধারী কয়েকজন লোককে এখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তবে গত বর্ষায় ভাঙন হয়েছে বলে এদিককার পাড় খুব খাড়া, নৌকা ভেড়ানো কঠিন। নৌকা থেকে অস্ত্র ছুড়ে মারলেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বারো আনা। লোকটি অকারণে ফিসফিস করে কথা বলে, শুনল্যাম বাথানের একটা জ্বলঙ্গি শালারা নিয়া গেছে।
গোরু বহন করার বড়ো বড়ো জলঙ্গি নৌকা না দেখলেও জিনিসটা সম্বন্ধে আনোয়ার মেলা কথা শুনেছে। ৫০/৬০ হাত লম্বা এইসব নৌকায় কাঠের ঘের দেওয়া ঘর থাকে, ঘরের ভেতর চোখে খুলি-আঁটা গেরুবাছুর থাকার ব্যবস্থা। সংগঠিত লোকজন না হলে হোসেন আলির বাথান থেকে জলঙ্গি নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এতো সাহস কাঁদের?
কিন্তু এতো সব কথা এই লোকটি হয়তো জানে না। এদিকে আনোয়ারের তলপেটে ফের প্রবল বেগ শুরু হয়। আরো ২বার পায়খানা করলে ব্যথা থিতিয়ে আসে, তখন ঘুম পায়।
সকালবেলা দলবল নিয়ে হোসেন আলি ঘরে ফেরে এবং সকলের কোলাহলে আনোয়ার ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সকলেই দাবী করে যে আক্রমণকারীদের সফলভাবে হটানো গেছে এবং ১টি জলঙ্গি নৌকা নিয়ে গেলেও দুৰ্বত্তরা ১৫/২০ টির বেশি গোরু তুলতে পারেনি। তাদের সর্দার আলিবক্সের ডান হাতে বর্শা বেঁধানো হয়েছে, এ সম্মন্ধে এরা সবাই নিশ্চিত। এছাড়া আরো কয়েকজন জখম হয়েছে। এদের পক্ষে আহতের সংখ্যা মাত্র ৪, এবং এদের আঘাত তেমন মারাত্বক নয়। ২ জনের ১টা করে চোখ নষ্ট হয়েছে, ১ জনের উরু বোধহয় আর কোনো কাজে লাগবে না।
চুপ কর শালা মাগীমানষের দল দুটা চারটা জান নিবার পারলা না তো কিসের বাল ছেড়ো হে? পারে খালি আড়াই সের তিন সের চালের ভাত খাবার আর নিন্দ পাড়বার, না? আলিবঙ্গ শালার লাশ আনবার পারলু না তো কিসের মর্দানি দ্যাখাস?’ হোসেন আলি তার লোকজনের তৎপরতায় সম্ভষ্ট নয়, এই চরুয়াগুলা, বুঝলেন? আনোয়ারের মনোযোগ আকর্ষণ করে সে, শালারা একোটা বেজন্মর পয়দা বেজন্ম। শালারা খালি ভাত খাবো আর মাগীর ঠ্যাঙোতে ঠ্যাং থুয়া নিন্দ পাডুবো হামার বলে গোয়ার মদ্যে নোয়ার কাটি ঘোরে, শালারা দিশ পায় না।’ আলিবক্সকে হাতের ভেতর না পেয়ে লোকটা ঘর তোলপাড় করে, শালা বলে রাজা হবার চায়! শালা বেন্নার ব্যাটা, কলেঞ্জেত পড়া হালুয়া চাষার ব্যাটা আজ ধরাক সরা জ্ঞান করে। এটা কোন আলিবক্স? চেষ্ট্র যার কথা বলেছিলো এ কি সেই লোক? **মালিকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবে। এই সময় পচার বাপকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হয় করমালি। এদের দেখে হোসেন আলির লাফালাফি আরো বাড়ে, গোরু নিৰ্যা তো হামার কাছে আসছে কিসক? যাও, আলিবক্সের সাথে জোট পাকাও
পচার বাপ হাত জোড় করে দাঁড়ায়, উগল্যান কথা কয়েন না সরকার ইবলিসের নেভূড় ধরমু হামরা? হামাগোরে আখেরাত নাই?
আলিবক্সকে সরাসরি শয়তানের সঙ্গে তুলনা করায় হোসেন আলির ছটফটানি কমে। কাঠের লম্বা সিন্দুকে স্থির হয়ে বসে আস্তে আস্তে পা নাচায়। তোমাগোরে গোরু নিবা তো বাথানে যাও। ওটি মানুষজন আছে, হিসাব নিকাশ করা নাগবো না?
ধপ করে মেঝেতে বসে পচার বাপ হোসেন আলির পা চেপে ধরে। হুজুর, আপনে হামার ধর্মের বাপ। হামি বেন্ন্যা মানুষ আট শতাংশ জমিও নাই বাবা। আর বছর খরার সময় দশ শতাংশ জমি বেচ্যা খালাম। গোরু না থাকলে হামাক জমি বর্গা দিবো কেটা? উপাস কর্যা মরমু বাপ, পরিবার ছেলেপোল নিয়া উপাস করা লাগবো হামার গোরুবাছুর, বলদট না পালে হামি মর্যা যামু বাপ!’
জ্যাঠার এইসব কাকুতি মিনতি করমালি চুপচাপ দেখছিলো। হঠাৎ সে করলো কি, ২হাত জ্যাঠার ২ বগলের নিচে রেখে হ্যাঁচক টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। পায়ের ওপর থেকে পচার বাপের জোড়াহাত সরে যাওয়ায় হোসেন আলির শরীরের ওজন একটু কমে এবং ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় বসে বসেই সে একটু টাল খায়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা শরীরে পচার বাপকে সে বকে, তোমরা কোটে কোটে গোরু ছাড়া দিয়া রাখো, কারভিউ খিলাও, মানষে ত্যক্ত হয়৷ গোরু নিয়া এটি দিয়া গেছে। সরকারী খোয়াড়, সরকারেক ট্যাকসো দিয়া তোমরা গোরু নিয়া যাও, কান্দাকাটি করো কিসক? পচার বাপ এখন ফ্যাচফাচ করে কাঁদে, না সরকার। গোরু বাছুর হামার গোলের মদ্যে বান্দা আছিলো। ধুনট হাটোত থাকা হামিলিজে শিকল কিন্যালিয়া আসছিলাম বাপো, আতোত শিকল খুল্যা গোরু নিয়া আসছে। হামার গোরু-‘
রাগে হোসেন আলি উঠে দাঁড়ায়, জমিত মুখ না দিলে মানষে খালি খালি তোমার গোরু নিয়া খোঁয়াড়ত দিবো? হামি মানুষ পাঠায়া তোর গোরু চুরি কর্যা নিয়া আসছি? কথা কস, শালা শয়তান বুড়ো!’
না হুজুর। হামি ঐ কথা কই নাই। দ্বিগুণ বেগে ফ্যাচফাচ করতে করতে পচার বাপ তার বিবৃতি সংশোধন করে, না হুজুর হামি বুড়া মানুষ, মুখ্য জাহেল মানুষ, বেন্ন্যা মানুষকথা কবার পারি না হুজুর! হামাক মাপ করেন!
শিথিল কথাবার্তা বলার পক্ষে তার বার্ধক্য বা মূর্খতা বা অন্ত্যজ শ্রেণীতে তার অবস্থানের কৈফিয়ৎ হোসেন আলি গ্রাহ্য করে না। এই অবিশ্বাস জানাবার উদ্দেশ্যে সে বিকটভাবে চ্যাচায়, বুড়া, এক পাও তোর কবরের মদ্যে, তাও তুই মিছা কথা কস! তোর আল্লা-রসুলের ভয় নাই? তোর আখেরাত নাই? আল্লা, রসুল ও আখেরাতের প্রসঙ্গ এনে হোসেন আলি নিজেই একটু নরম হয় এবং হঠাৎ করে বলে, চলো বাথান মুখে চলো। দাখা যাবো কার গোরু এটি কিসক আসে!
চিলেকোঠার সেপাই – ২৯
‘দ্যাখেন, লোকটা খুব গরিব। গোরু না পেলে একেবারে পথে বসবে। বেচারার গোরুগুলো’-আনোয়ারের অনুরোধ শেষ হতে না হতে হোসেন আলি রাজি হয়, ‘গোরু তো তাই পারেই। তা ধরেন আইন একটা আছে, জরিমানা দিয়া খোয়াড় থাকা গোরু খালাস করা লাগে।
জরিমানা?
সরকারী আইন। জরিমানার আট আনা গওরমেন্টের। আর আট আনার দুই আনা যাই গোরু নিয়া আসে তার। তারপরে ধরেন—।
‘জরিমানার ভাগ গভমেন্টকে দিতে হয়?
‘তো কি? আনোয়ারের অজ্ঞতা দেখে হোসেন আলি অবাক, মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাকসো দেয়, জরিমানা দেয়, দণ্ড দেয়,—তবে না গওরমেন্ট চলে। শিক্ষিত মানুষ হয়া আপনে বোঝেন না?
পচার বাপ, করমালি ও ফকিরের লোকজন আসছে ওদের পেছনে পেছনে। পচার বাপের ফোৎ ফোৎ কান্না কখনো বাড়ে, কখনো কমে। ওদের বাদিকে এবার মস্ত গমের জমি। গমগাছের বাড়ন দেখে পচার বাপ ও করমালি মুগ্ধ। অভিভূত পচার বাপের কান্নার স্বস্তিকর বিরতি ঘটে। রাত্রে ভালো করে বুঝতে পারেনি, আনোয়ার এখন চরটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। লোকবসতি খুব কম, বেশির ভাগ ফসলের জমি। কোথাও কোথাও ধান কাটা হয়ে গেছে, কিছু কিছু লোক ইদুরের গর্তে হাত দিয়ে ধান সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত, গর্তে হাত রেখে তারা আনোয়ারকে দ্যাখে। হাটতে হাটতে নদী হঠাৎ আড়ালে পড়ে যায়, নদী তখন হাজিরা জানান দেয় স্রোতের কলরবে। আরো কিছুক্ষণ হাটার পর জমি নেমে গেছে বেশ নিচুতে। এখানে ভেরেণ্ডা গাছ ও জিগাগাছের লম্বা সারি। নিচে নামবার সময় আনোয়ার প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো, হোসেন আলি ওর হাত ধরে সামলে নেয়। নিচে কেবলি বালু, মাটি এখনো জমাট বাঁধেনি, বহুকাল মাটির নিচে ডুবে থাকার পর বছর দুয়েক হলো চরটা গতর তুলেছে। কোনো কোনো জায়গায় বালুর ওপর পানির ঢেউয়ের দাগ এখনো মুছে যায়নি। অনেক দূর পর্যন্ত গাছপালা নাই, ধুধু করে বালু দূরে দূরে কাটাওয়ালা ঝাউগাছ মানুষের কোমর পর্যন্ত মাথা তুলেছে। এখান থেকে ডাকাত-মারা চর দাখা যাচ্ছে, উঁচু জমির ওপর ফের ভেরেণ্ডা ও জিগাগাছের সারি দিয়ে শুরু হয়েছে ঐ চরের সীমানা। হোসেন আলির এক সঙ্গী বলে, *আর তিন চারটা বর্ষা গাও যদি টান্টিবাল্টি না করে তো ধারাবর্ষার সাথে ডাকাত-মারা চর একত্তর হয়া যাবো।’
হোসেন আলি এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুমোদন করে, এখনি তো একটা চরই ঠেকে। সাত আট বছর আগেও এই জায়গাত জাহাজের খাটাল আছিলো কেউ বুঝবার পারবো?
পচার বাপ পা ফেলছে খুব জোরে জোরে। বালুর ওপর হাটা কঠিন, লোকটা তরু অনেকটা সামনে চলে গেছে। ডাকাত-মারা চরের বাথান দ্যাখা যাচ্ছে, খড়ের চালার নিচে সারি সারি গোরু, প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাধা পুরনো চরের শক্ত মাটিতে উঠলে আনোয়ার গোরু বাছুরের গায়ের গন্ধ পায়। হোসেন আলি পচার বাপকে ডাকে, এই বুড়ার ব্যাটা, এক কাম করো। তোমার গোরু আগে খুঁজা বাইর করো, না পারো তো ঐ যে খোয়াড়ের সরকার আছে তার কাছে পুছ করো। জরিমানা যা হয় দিয়া গোরু নিয়া যাও।
পচার বাপ নতুন উদ্যমে কাঁদে, ট্যাকা তো দিব্যার পারমুনা বাপ! আপনাগোরে পায়ের তলাত পড়া আছি, দয়া হামাক করাই নাগবো কাদুক আর কথা বলুক, পচার বাপের পায়ের গতি কিন্তু অব্যাহত থাকে।
আনোয়ার এবার একটু শক্ত করে বলে, টাকা নিলে এদের ওপর জুলুম করা হবে।
আপনার তো গাঁওত বাস করেন নাই। ইগল্যান বেন্ন্যা জাতের স্বভাব জানেন না। মাথার উপরে লাঠির ডাং ন মারলে শালারা কোমরের গেরো খুলবো না। আপনার দাদা, আপনার বাপের দাদা হলে ঠিকই বুঝলোনি। না হলে তারা সম্পত্তি করবার পারে? ধারাবর্ষার অর্ধেক আছিলো আপনার দাদার জোত, আপনার লাকান ভালো মানুষ হলে তাই কিছু করবার পারলোনি?’
সুযোগ পেয়ে হোসেন আলি তাকে ভালোই ল্যাং মারলো। গ্রামের এইসব নিমভদর লোকের বাঁকাচোরা কথার জবার দেওয়া আনোয়ারের পক্ষে অসম্ভব। আবার দ্যাখো, কথাটা বলেই হোসেন আলি লম্বা লম্বা পা ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেলো। করমালি পাশে দাঁড়িয়ে আনোয়ারের কানে প্রায় ফিসফিস করে, ভাইজান, হামার জ্যাঠোর মাথা খারাপ হছে। একলা গোরু লিয়া গেলে জ্যাঠোক গায়ের মদ্যে ঢাকব্যার দিবো? ঘাটার উপরে গাবগাছতলাত চেন্টু খাড়া হয়া থাকবো না? গোরু জ্যাঠো একলাই নিবো? হামরা?
বাথানের বাইরে নদীর ধারে বেঞ্চ পেতে আনোয়ারকে বসতে দিয়ে হোসেন আলি বেশ উদার হয়ে যায়, বুড়ো মানুষ, আবার আপনে সাথে আসছেন, এখন কি করি, কন তো? আপনের বাপ-দাদা হামাগোরে জন্যে কি না করছে? আপনাকে হামি না করি কেমন করা ? কিন্তু আইনের বরখেলাপ সে করতে পারে না, সেজন্যই তো এতো সমস্যা, এখন গওরমেন্টের খোয়াড়, জরিমানা না নিয়া গোরু দিলে হামার মুসিবত। দেখি, কিছু মাপসাপ করব্যার পারি নাকি!
আনোয়ারকে বসিয়ে রেখে হোসেন আলি বাথানে ঢোকে, সঙ্গে পচার বাপ। আনোয়ারও সঙ্গে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিলো, হোসেন আলি বাধা দেয়, আপনে বসেন। বাথানের মদ্যে খালি গোবর আর চোনা, হাটবার পারবেন না। তার লোকজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে আনোয়ারের পক্ষে ভেতরে যাওয়া অসম্ভব। করমালি এর মধ্যে কোথেকে ঘুরে এসে বসে পড়ে আনোয়ারের পাশে। নিজেদের গ্রামে হলে তার পাশে করমালি কিন্তু কিছুঁতেই বসতে পারতো না। আনোয়ার আরো অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে, কি মনে হচ্ছে?
জ্যাঠার জরিমানা হবো মেলা। তিনটা গোরু-দ্যাড়শো টাকা, আবার শিকল দিয়া ব্যান্ধ্যা গুছিলো, তার জরিমানা পনরো ট্যাকা, তালা লাগছিলো, তার দশ টাকা। কতো হলো? দুইশো টাকার উপরে হলো না?
না। পৌনে দুশো। শিকল-তালা লাগাবার জন্য আবার আলাদা জরিমানা?
পচার বাপের সঙ্গে হোসেন আলি এসে পড়লে করমালি উঠে দাঁড়ায়। হোসেন আলি পাশে বসতে বসতে বলে, দণ্ড হছে পুরা একশো পঁচিশ টাকা।
পচার বাপ এবার হামলে কাঁদছে, গোরু ওর পাওয়া গেছে ২টো, বকনাটার কোনো পাত্তা নাই। কি সুন্দর বকনাটা তার, আর কটা মাস গেলে গাভীন হতো। আল্লা! তার একি বিপদ! আল্লা! আল্লাগো!
তা গোরু তুমি সামলাবার পারো না, কান্দো কিসক? তা একদিক থাকা ভালোই হছে, হোসেন আলি সাম্ভুনা দেয়, ঐ গোরুটা থাকলে তো পঞ্চাশ টাকা বেশি দণ্ড দেওয়া লাগতো।
‘দুটো গোরুর জন্য আপনার হিসাবে জরিমানা হয় একশো টাকা। আর পঁচিশ টাকা কিসের? আনোয়ার প্রায় চার্জ করার মতো করে বললে হোসেন আলি কৈফিয়ৎ দেয়, যার জমির ফসল গিলছে তাক ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগবো!
জমির ফসল খেলো কার? এ তো আপনারা ওর তালা আর শিকলের জরিমানা ধরেছেন।
আনোয়ার এই নিয়া ঝামেলা বাধাতে পারে ভেবে পচার বাপ এবার তার হাত চেপে ধরে, এটি বিবাদ করেন না বাবা! হামার গোরু বড়ো বজাত। কার ভিউয়েত মুখ দিয়ে, কার কতো লোকসান করছে আল্লাই জানো কোমরে বাধা লাল রঙের কাপড়ের থলি বার করে ১ টাকার ১৪টা নোট ও কিছু রেজকি হাতে ঢেলে সে হোসেন আলির হাতে দেওয়ার চেষ্টা করে, টাকা পনেরোটা নিয়া হামার গোরু নিয়া দেন বাবা।
ঐ টাকা হোসেন আলি ছুয়েও দ্যাখে না, শোনো, পুরাপুরি একশো টাকা দিয়া গোরু নিয়া যাও। এই চ্যাংড়াক নিয়া আসছে। মানী মানষের ব্যাটা, মানী মানষের ভাইগ্না, পঁচিশ ট্যাকা মাপ কর্যা দিলাম।
১০০ টাকার কথায় পচার বাপ আর্তস্বরে কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতেই সে জানায় যে তার সারা জীবনের সঞ্চয় সে নিয়ে এসেছে, ২০ টাকার বেশি ১টি পয়সাও তার কাছে নাই। হোসেন আলি পরামর্শ দেয়, তাহলে ঐ ২০ টাকা নিয়ে সে বাড়ি চলে যাক, ৮৫ টাকার কমে গোরু দেওয়া যাবে না। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে নানারকম কান্নাকাটি, গালাগালি ও টানাহাচড়া চলে। আনোয়ার বিরক্ত হয়ে নিচে নতুন চরে এসে নদী দাখে। পচার বাপ শেষ পর্যন্ত ৬৭ টাকা দিয়ে তার বলদ ও গাইয়ের দড়ি হাতে পায়। আনোয়ারকে ডেকে হোসেন আলি বলে, আপনে সাথে আসছেন, লোকসান করা গোরু দিলাম। করমালিকে সে মাত্র ৪০ টাকার বিনিময়ে তার গোরু দেওয়ার প্রস্তাব করে। ‘তুইও গোরু নিয়া যা। না হয় ৩৫ টাকাই দে। বড়ো মানষের ব্যাটাক সাথ করা আসছস, কি করি? দেওয়াই লাগে। কিন্তু রশিদ দিবার পারমুনা। সরকারী আইন, কড়ায়গণ্ডায় টাকা পরিশোধ না করলে রশিদ দেওয়া হবে না। করমালির প্রতিক্রিয়া বড়ো উদ্ধত, টাকা কোটে সরকার? ট্যাকা নাই। তার রাগ ঝাড়ে সে পচার বাপের ওপর, যাও, গোরু লিয়া বাড়ি বিলা ঘাটা ধরে। ট্যাকালিয়া তুমি গোরু লিছো, হামাগোরে সাথে তোমার সাথ কি?
গোরু ২টো পেয়ে পচার বাপ তার বকনা ও ৬৭ টাকার শোক ভুলে যায়, একবার সে হাত বুলায় তার বলদের গায়ে, মুখে ও মাথায়, একবার সে এটুলি বেছে দেয় তার গাইয়ের পিঠ থেকে। তার ধৈর্য ছিলো না। নদীর কিনার ধরে সে রওয়ানা হলো বাড়ির দিকে। হেটে হেঁটে একেকটা চর পাড়ি দেবে, মাঝে মাঝে নদী পার হবে খেয়ানৌকায়। বেলা থাকতে রওয়ানা হলো, আগামীকাল দুপুরবেলার আগেই গাইবলদ নিয়ে বাড়ি পৌঁছবে।
আনোয়ার পড়ে গেছে মহা ফ্যাসাদে। নৌকায় আর কতোদিন? ৩দিন তো হয়েই গেলো। এখানে বাস করাটা কাজে লাগলেও না হয় কথা ছিলো। লাভটা হচ্ছে কি? করমালির মাথায় কি করে ঢুকেছে যে টাকা পয়সা না দিয়েই সে গোরু নিয়ে যেতে পারবে। তার গোরু তো বটেই, গ্রামের সকলের গোরু এই হোসেন ফকিরের নৌকায় ভরেই সে নিয়ে যাবে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে সে নোতুন খবর আনে, পুবের দিকে খালি এক কথা। -শালা হোসেন ফকিরেক জবো করো। বোঝেন না, শালাটাসকা ম্যারা গেছে। হামাক কিছু করার পারে না, আপনে আছেন তো উই মনে করছে, বিপদ এ্যাঁটা হলে আপনেক ধরা উই পার হবো শালা মানুষ চেনে নাই। আনোয়ার একটু আঁচ করে বৈ কি? সেদিন মূলবাড়ি খাট থেকে নৌকায় ধারাবর্ষা চরে আসার সময় কোনো কোনো চরে বা খেয়ানৌকায় গোরু নিয়ে অনেককে যেতে দাখা গেছে। জরিমান ট্যাক্স দিয়ে নিজের গোরু নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলো। পরদিন থেকে এদের সংখ্যা বেশ কম। পরশু তবু কয়েকজন গেলো, কাল গোরু নিয়ে কাউকেই যেতে দ্যাখা যায়নি। করমালি এর কারণ ব্যাখ্যা করে, ‘দুইটা দিন দ্যাখেন না। আলিবক্স ভাই ঢোল দিছে, হোসেন আলিক জরিমানা দিলে তার পরিণতি ভালো হবো না।
সেদিন সন্ধ্যার আগে ঘাটে এলো হোসেন ফকির নিজেই। হাতে গামছা-বাধা বাটি। ইয়াসিন সায়েবের ভাগ্নে, আকবর সায়েবের ছেলে, সর্বোপরি তার এককালের মুরুব্বি বড়োমিয়ার মেজোনাতি এখানে এসে নৌকায় বাস করে, এই দুঃখে সে কাতর। পাঙাস মাছের ঝোল ও পাবদা মাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেতে খেতে আনোয়ার তার আক্ষেপ শোনে। ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা একটু একটু দোলে, আনোয়ার ভাত খায় আর হোসেন আলির মুখে তার বাবার গল্প শোনে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে তার বাবা এখানে এসেছিলো রেডক্রসের সাহায্য বিলি করতে, আনোয়ারের তখন জন্মই হয়নি, তার বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দুধ, কাপড়, দেশলাই—এইসব বিতরণ করেছিলো এই হোসেন আলি ফকির। বাবার এই ধরনের জনসেবামূলক তৎপরতার কথা আনোয়ার কোনোদিন শোনেনি। মনোযোগ দিয়ে এইসব শুনতে শুনতে হোসেন আলির ওপর বিরাগে একটু নরম প্রলেপ পড়ে। সেইসব দিন আর নাই, সেইসব মানুষই বা কোথায়?–হোসেন আলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, এখন হলো চোর ডাকাতের রাজত্ব। আগের রাত্রে ডাকাত-মারা চরে বাথানের উত্তরপ্রান্তে কারা এসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ডাকাতদের অবশ্য হটানো গেছে। কিন্তু পালাবার মুহুর্তে বাথানের একদিকে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় ৮/১০টা গোরু পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তবে হোসেন বীরদৰ্পে জানায় যে, সে একটুও ঘাবড়ায়নি। খয়বার গাজীর কাছে লোক পাঠানো হয়েছে, এমএনএ সায়েবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গওরমেন্টের খোয়াড়-এর লাভের ভাগ মন্ত্রী গবর্নর পর্যন্ত ভোগ করে -এখানে আগুন লাগাবার পরিণতি যে কি ভয়াবহ হবে শালারা বুঝতে পাচ্ছে না। এমএনএ কি মন্ত্রী যদি মিলিটারি পাঠিয়ে দেয় তো পুবপাড়ের ঐসব ডাকাতদের লাশে যমুনায় স্রোত মন্থর হয়ে উঠবে -তবে তার দুঃখ ঐ গোরুগুলোর জন্য। আল্লার অবলা জীব, ঘরে আগুন লাগলে দড়ি কি শিকল ছিঁড়ে পালাবার উপায় নাই যাদের, তাদের যারা পুড়িয়ে মারে, আল্লার গজব থেকে তাদের রেহাই নাই।-এই আক্ষেপ শুনে আনোয়ারের মাথা দপ করে জ্বলে ওঠে। শালার ভণ্ডামির সীমা নাই। বদমাইসটার মুখের ওপর পাঙাস মাছের ঝোল-মাখা ভাত উগরে দিতে পারলে আনোয়ারের মাথার আগুনটা নেভে। তা আর হয়ে ওঠে না। কয়েক বেলা ধরে করমালির রান্না করা ছোটো মাছের প্রচণ্ড ঝাল চচ্চড়িতে-ঝলসানো জিভে পাঙাস মাছের ঝোল মোলায়েম প্রলেপ দিয়ে আরামে গলা দিয়ে নেমে যায়। খালি বাটি নিয়ে হোসেন আলি চলে গেলে করমালি বলে, শালা ফকিরের ব্যাটার জান সিটক্যা গেছে মনে করছে আলিবক্স ভায়ের সাথে আপনের সাট থাকবার পারে। তাই আপনেক এতো খাতির করব্যা নাগছে!
আনোয়ার ভাবে আলিবক্সের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা কল্পনা করে বলে হোসেন আলি তাকে সমীহ করে কেন? হোসেন আলি ফকিরকে অনুরোধ করে এবং ভয় দেখিয়ে গ্রামের গোরুগুলো উদ্ধার করার জন্য তার উদ্যোগ কি সাহসের পরিচয় নাই?–লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আনোয়ার নৌকার নিচে পানির ছলাৎ ছলাৎ স্রোত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার স্রোতের আওয়াজেই তার ঘুম ভাঙে, নৌকা মনে হয় চলতে শুরু করেছে, নিচের ঢেউ সে বুঝতে পাচ্ছে সারা শরীর জুড়ে। আনোয়ার উঠে বসে, করমালি, কি ব্যাপার?
ভাইজান, ভয় পায়েন না। ঘোড়ার ডাক শোনেন? ভাটি বিল্যামেলা করছি, বাথান পার হয়া জাহাজের খাটাল ধরা গেলে রাত এক পহর থাকতে পুবপাড় পৌছা যামু।
তুমি যাচ্ছে কোথায়?
পুব পাড়। নদীতে বান আলে সিন্দুরিয়া চরত ওঠা যাবো।
বান আসবে কেন? নাকি হোসেন আলির লোক ধরতে আসছে?
কোটে হোসেন আলি? ঘোড়ার ডাক শুন্যা ব্যামাক মানুষ ঘরের মদ্যে সান্দছে।
ব্যাপারটা কি? গোরুর দুঃখে পাগল হয়ে করমালি কি ঘোড়ার ডাক শুনতে পাচ্ছে? করমালির ব্যাখ্যা আরো বিভ্রান্তিকর, নদীর অনেক ভেতর থেকে সমবেত ঘোড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে। সে তার বাপদাদার কাছে শুনেছে যে, নদীতে ভয়ঙ্কর বান ডাকার আগে যমুনা নদীর ঘোড়ার পাল উচ্চরবে হেষার্ধ্বনি দিয়ে সবাইকে জানান দিয়ে যায়। করমালির কানের বিএম দেখে আনোয়ার কঠিন গলায় নির্দেশ দেয়, ‘পাগলামি করো না। নৌকা তীরে ভেড়াও।’
দেখতে দেখতে নৌকা চলে এসেছে বাথানের ধারে। বাঁধান পেরিয়ে যাবার পর দাখা গেলো আরেকটি ছিপ নৌকা আসছে তাদের দিকে। ঐ নৌকা থেকে কে ডাকে, করমালি!’ করমালি সাড়া দিলে ফের শোনা যায়, ‘আনোয়ার ভাই আছে? ঘোড়ার ডাক শুনা ভয় পাবার মানা কর।
করমালি আস্তে করে বলে, আলিবক্স ভাই আসছে। আপনের সাথে কথা কৰো। ছিপনৌকা কাছাকাছি আসতে আনোয়ারদের নৌকা প্রবলভাবে দুলে ওঠে। আনোয়ার আরে গেলো। গেলো।’ বলে চিৎকার করে ওঠে, ছিপনৌকা থেকে তাদের নৌকায় লাফিয়ে-পড়া লোকটি ২ পায়ের ভার এদিক ওদিক করে ব্যালান্স সামলে নিলো। লুঙি-পরা ও চাদরজড়ানো যুবকের কালো মুখে চাদের হলদে আলোর আভা, কিন্তু তার চেহারা অস্পষ্ট। আনোয়ারের সারা শরীর টলে ওঠে হোসেন আলির আতিথেয়তা গ্রহণের অপরাধে করমালি কি তাকে সমর্পণ করছে আলিবক্সের হাতে? আলিবক্স কি তাকে শ্রেণীশক্র হিসাবে চিহ্নিত করবে?
ছইয়ের ভেতর ঢোকার আগেই আলিবক্স বলে, করমালি, নাও ফেরা, ধারাবর্ষ মুখে চল। নৌকা উল্টোদিকে চলতে শুরু করে, কিন্তু করমালি খুব উদ্বিগ্ন, ভাইজান, বান আসলে পরে নাও ভাসায়া নিবো। ধারাবর্ষাত গেলে তখন হোসেন ফকিরের বাড়িত ওঠা ছাড়া আর বুদ্ধি থাকবে না। ঐ বাড়িত গেলে আপনের জান থাকবে? –
আরে বলদ, মাঘ মাসোত নদীত বান আসে? তুমিও কি টাউনের ভদ্রনোক হয়৷ গেলা?
ঘোড়ার ডাক শোনেন নাই? নদীর মদ্যে কতো ঘোড়া ডাক পাড়ে শুনছেন? আমাক ঠগা ঠাওরাস? তামাম নদীর মদ্যে ঘোড়া খালি তড়পাতিছে। বিপদ দেখলে যমুনার ঘোড়া ডাকে। বিপদ কি যমুনা একলাই করে? মানুষ মানুষের মুসিবত করে না?
আনোয়ারের পাশে বসে বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বিড়ির গোড়াটা এগিয়ে ধরে করমালির দিকে। তারপর বলে, কালই আপনার সাথে কথাবার্তা কওয়ার নিয়ত করছিলাম। শালা হোসেন ফকিরের মানুষ এমন করা ধাওয়া করলো, আগে আমরা অগো বলটা বুঝবার পারি নাই। পরে এমন অবস্থা হলো কি বাথানেত আগুন দিবার না পারলে আমরা আর পলাবার পারি না। আনোয়ার একটা সিগ্রেট দিলে সেটা ধরিয়ে আলিবক্স তার আসার উদ্দেশ্য জানায়, ‘আজ আপনের সাথে নিরিবিলি কথা কওয়া যাবো। ঘোড়ার ডাক শুনছে, হোসেন ফকিরের বাপের ক্ষমতা হবে না যে বার হয় আমাক ধরবার আসে ব্যামাক মানুষ আজ ঘরের মদ্যো’
আলিবক্সের মুখেও যমুনার গভীর ভেতর থেকে ঘোড়ার ডাক শোনার কথা শুনে আনোয়ার বিগড়ে যায়, হায়রে, এই আমাদের বাম রাজনৈতিক কর্মী। এর সঙ্গে নিরিবিলি কি পরামর্শ করবে? জিগ্যেস করে, আপনি মাদারগঞ্জ কলেজের ছাত্র?
হ্যাঁ। তা শোনেন— ‘ বি এসসি পড়েন না? সায়েন্স পড়েন, লেফট পলিটিক্স করেন আর এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন?
বিএ পড়ি। এইচ এছ ছি পাস করছিলাম সাইন্স নিয়া। মাদরগঞ্জ কলেজে বি এছছি নাই, তাই বিএ পড়তিছি?
তার আসল প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো বলে নয়, এইচ এস সি ও বিএসসি কথাগুলো আলিবক্স যথাক্রমে এইচ এছ ছি ও বি এছছি উচ্চারণ করায় আনোয়ারের কান শিরশির করে। তার মূল প্রশ্ন বা কান শিরশির করাকে আলিবক্স তোয়াক্কা করে না। আপনারা ঢাকাত বস্যা বড়ো বড়ো কথা কন আর পার্টি ভাঙেন। মতিন ভাই আমাগোরে এলাকায় আসলো, দল থাকা ভালো ভালো কয়েকটা কর্মী আলাদা হয়া গেলো। এরকম করলে কাম হয়? জনগণতান্ত্রিক কন আর স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক কন, উপনিবেশ কন আর আধা উপনিবেশ কন, গায়ের মদ্যেকার শয়তানগুলাক শাষ করবার না পারলে কোনো কাম হবো না।
‘সে তো বটেই। কিন্তু এইসব শয়তানের মুরুব্বিরা তো থাকে ঢাকা ইসলামাবাদ।’
‘গায়ের মানুষ তো অগোরে চেনে না। আর এই শয়তানগুলা শাষ হলে মুরুব্বির খাড়াবো কোন জমির উপরে? আমরা পুবের চর এলাকাত সব একসাথে শয়তান খতমের কামে নামছি!’
‘পাটি ভাগ হলো তো একসঙ্গে কাজ করছেন কি করে?
একজোট না হয়া আমাগোরে পথ আছিলো না ভাইজান। সার্কেল অফিসার আর তশীলদার,—এই দুই শয়তান মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করা তুলছিলো। এটার মদ্যে খাজনা বসায়, এই মানষেক জমি থাকা ভিটা থাকা উচ্ছেদ করে, এ্যাঁক ধর্যা থানাত দেয়, অক ধরা বেগার খাটায়। তশীলদার চাকরি করতিছে ছয় বছর, এর মদ্যে জমি করছে একুশ বিঘা, পুকুর নিছে দুইটা। মানষে একজোট হয় এমন দাবাড় দিছে যে দোনো শয়তান পাছার কাপড় তুল্যা দৌড় মারছে ময়মনসিং মুখে।
এরা তো আবার ফিরে আসবে। দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আসবে। পুলিশ ব্যাটালিয়ন নিয়ে আসবে। তখন?
তা আসবো। মিলিটারিও আনবার পারে। তা এই সার্কেল অফিসার কন আর তশীলদার কন আর এমএনএ মন্ত্রী যাই কন না এদের ভরসা হলো আপনাগোরে ওটি খয়বার গাজী, আমাগোর এলাকাত হামিদ তালুকদার, মাদারী আখন্দ। আবার খয়বার গাজীর বারো আনা ভরসা হোসেন ফকিরের উপরে। এই শয়তানগুলাক শাষ করবার পারলে এমএনএ, মন্ত্রী কারো ক্ষমতা নাই যে এই এলাকায় যমুনার পুব পশ্চিম কন্ট্রোল করে।’
তখন পুলিস মিলিটারি ক্যাম্প করবে আপনার পাশের এলাকায়, না হলে পাশের জেলায়!
তা ঠিক। আলিবক্স আনোয়ারের সঙ্গে একমত হয়েও হতাশ হয় না, তাই তো কই কি সোগলি যার যার এলাকায় কাম করলে শয়তানগুলাক শাষ করা যায়, তখন পুলিস মিলিটারি পাত্তা পাবো কোটে?
আলিবক্স বেশি সরলীকরণ করছে, আনোয়ার এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু ঠিক কিভাবে ওর যুক্তি খণ্ডন করবে তাও বুঝতে পারে না। শ্রেণীশক্ৰ খতম করার প্রোগ্রাম তো ওদেরও আছে, কিন্তু গ্রামে কিছু লোক মেরে ফেললেই কি রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়বে? এদের দাপট যতোদিন থাকবে এই রাষ্ট্র কাঠামোতে ততোদিন কোনো চিড় ধরানো অসম্ভব। কিম্ভআনোয়ার কিছু বলার আগেই আলিবক্স প্রস্তাব করে আনোয়ার ভাই, আপনে আজই বাড়িমুখে রওয়ানা হন। কাল সকালবেলা পৌঁছবেন তালপোতাত করমালির বাড়িত যারা চেংটু, বান্দু শেখ, করমালি—এদের সাথে কথাবার্তা কন। অন্তত পঞ্চাশ ষাটজন মানুষ সাথে করা চেংটুক আপনে কালই ধারাবর্ষ মুখে পাঠায় দেন। পশ্চিম থাকা আসবো অরা, পুব থাকা আসবো আমরা। হোসেন আলির বাথান পরশু রাতের মদ্যেই আমরা দখল কর্যা শালাক বক্তা কবর দেমো তার ওপর এতোটা আস্থা স্থাপন করায় কৃতজ্ঞতায় আনোয়ার অবিরাম কথা বলতে শুরু করে, আমাদের পশ্চিম পাড়ে মানুষ নিজেরাই স্পনটেনিয়াসলি এগিয়ে আসছে। দলের জন্য অপেক্ষা করেনি-।
পার্টি না থাকলে মানুষের উৎসাহ শেষ পর্যন্ত থাকবে না। আপনে আজই মেলা করেন, রাতে রাতে নাও বায়া যাবো করমালি। যমুনার মদ্যে ঘোড়ার ডাক শুনা মানুষ খুব পাইছে। আসলে এটা বানের নিশানা নয়, শীতের সময় বান হবে কেন? বিপদ তো মানুষও করবার পার, এখন সকলের একজোট হওয়া দরকার। মানষেক এইভাবে কওয়া লাগবে।
‘ঘোড়ার ডাক আপনি শুনলেন কোথায়? আলিবক্সের আস্থাভাজন হওয়ায় আনোয়ার তাকে সরাসরি জিগ্যেস করে, মানুষ কি বলে, কি শোনে, আপনি পার্টির লোক হয়ে চট করে তা মেনে নেন কি করে? মানুষের কুসংস্কার বাড়তে সাহায্য করলে শেষ পর্যন্ত লাভ হয় কাঁদের? রিএ্যাকশনারিয়া তো এইসব ক্যাপিটাল করে এক্সপ্লয়েট করে।
কি যে কন’ আনোয়ারের অবিশ্বাসে আলিবক্স ক্ষুব্ধ হলো, শোনেন যমুনার ভেতর অনেকদিন বাদে বাদে ঘোড়ার ডাক শোনা যায়। তাহলে বুঝবেন চর এলাকায় বড়ো কোনো বালা মুসিবত আছে।
আমার বাপদাদারা আছিলো শঙ্করপুরের মানুষ –কায়েমি চর আছিলো গো! হাই ইসকুল, ইউনিয়ন বোর্ড অফিস, সাহাদের টিনের গুদাম, গাছগাছালিসব আছিলো। সেই চর যেদিন ভাঙা শুরু হলো তার দিন পনেরো ষোলো আগে নদীর মধ্যে কম করা হলেও দুইশো আড়াইশো ঘোড়া একসাথে উরুজোগার দিয়া ডাকছে।’ আপনি জানলেন কি করে? আপনি শুনেছেন? আমার বাপে কছে, দাদায় কছে। চাষা মানুষ হলে কি হয়, বাপ আমার পাঁচ ওকতো নামাজ পড়ছে! তাই মিছা কথা কওয়ার মানুষ আছিলো না! নামাজ পড়ার সঙ্গে সত্যনিষ্ঠ হওয়ার সম্পর্ক কি? নামাজ পড়তে পড়তে খয়বার গাজীর কপালে কড়া পড়ে গেছে, মিথ্যা কথা বলা তার স্বভাব। তাহলে?–কিন্তু তর্ক করার সময় পাওয়া যায় না। ভাইজান, বাথানের গোরুবাছুর ঘোড়ার ডাক শুনবার পাছে! করমালি ভয়ে চিৎকার করে উঠলে বিপুল সংখ্যক গোরুবাছুরের সমবেত ও এলোমেলো হাম্বা রব শুতে পায় সবাই। আনোয়ার পর্যন্ত ভয় পায়, কি ব্যাপার, বাথানে কি আগুন টাগুন লাগলো?
আরে নাঃ। শোনেন না? হাজার ঘোড়া ডাক পাড়ে। গোরুবাছুর ভয় পাবো না? করমালিকে নৌকা ভেড়াতে বলে আলিবক্স লাফিয়ে ডাঙায় নামে, রওয়ানা হয় উল্টোদিকে, যেতে যেতে করমালিকে তাড়া দেয়, তরা করা যা। কাল ব্যায়না চেংটুর সাথে কথা কয়৷ পাছাবেলার মদ্যে মানুষজন নিয়া মেলা করবু।
আরে আপনি এখানে নামছেন কেন? আনায়ার চিৎকার করে, এখানে নামছেন কেন? হোসেন ফকিরের মানুষ টের পেলে—।
একটু এগিয়ে আলিবক্স তার ছিপনৌকায় উঠতে উঠতে চিৎকার করে, করমালি, কিনার দিয়া যাস। ভয় করিস না, কিছু হবো না। আলিবক্সের ছিপনৌকা মেঘের ছায়ার মতো নদীর আড়াআড়ি গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো।
ধারাবর্ষার চরও দেখতে দেখতে সরে যাচ্ছে। হোসেন আলির বাড়ির দিক থেকে কে যেন চিৎকার করে আজান দিচ্ছে। আবার কোথেকে ভেসে আসছে হাঁস-মুরগির আতঙ্কিত ডাক ব্যাপার কি? চরের সবাই কি ঘোড়ার ডাক শুনতে পাচ্ছে? নদীর পানির দিকে কান পেতে আনোয়ার ঘোড়ার ডাক শোনার জন্য একাগ্রচিত্ত হয়। না। শীতকালের যমুনা ছলাৎ ছলাৎ করে বয়ে চলে। এমনকি ডাঙার শঙ্কা ও আর্তরব নদীকে এতোটুকু স্পর্শ করতে পাচ্ছে না।
করমালি দাঁড় বাইতেই থাকে। ডাঙা থেকে ভেসে আসা দূরের আওয়াজ, ক-র-মা-লি, নাও ভিড়াও চরের পশ্চিম মুড়াত নদীর মদ্যে ঘোড়ার ডাক শোনা যায়। হোসেন ফকির খবর দিছে, আকবর সায়েবের ব্যাটাক তার ঘরত যাবার কছে। বান আলে বিপদ হবো। ও ক-র-মা-লি!’
আনোয়ার স্থির গলায় নির্দেশ দেয়, করমালি, তাড়াতাড়ি চলো। সকালের আগেই মূলবাড়ি ঘাটে পৌছা চাই।’
চিলেকোঠার সেপাই – ৩০
এখন পর্যন্ত পচার বাপের কোনো খবর নাই। গোরু নিয়ে হেঁটে রওয়ানা হলেও ৪টে চর ও ৩টে খেয়ানৌকা পার হতে দেড় দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়।
জালাল মাস্টার বলে, তোমরা রাস্তায় তাকে দ্যাখো নাই? না। আনোয়ার ও করমালি তো এসেছে রাত্রে, রাত্রিবেলা কি দেখবে? তাদের রাস্তাও ছিলো আলাদা। হঠাৎ মুখ খোলে নবেজউদ্দিন, চাচামিয়াকে অরা অশিদ দিছিলো? কিসের রশিদ?-নবেজউদ্দিন কথা বলে কম, এতো লোকের সামনে কিছু বলা তার পক্ষে আরে৷ কঠিন। সবাই মিলে তার ওপর হামলে পড়লে সে জানাতে বাধ্য হয় যে জরিমান নিয়ে গোরু ফেরত দেওয়ার সময় হোসেন ফকির একটা কাগজে সই করে, সেই কাগজে কিসব লেখা থাকে। সেটাই হলো হোসেন আলির দেওয়া ছাড়পত্র। চরের মাঝে মাঝে কয়েকটা চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, পশ্চিমে আসার পথে প্রধান চেকপোস্টটি চালুয়াবাড়ি খেয়া-ঘাটের পোয়া মাইল দক্ষিণে। রশিদ দ্যাখাতে না পারলে ওরা ধরে নেয় যে এই গোরু হোসেন আলির বাথান থেকে চুরি-করা। গোরু কেড়ে নিয়ে তখন ওদের নিয়ম মতো শাস্তি দেয়।
আনোয়ারের মনে পড়ে, তাইতো হোসেন ফকির বলছিলো সম্পূর্ণ জরিমান না দিলে রশিদ দেওয়া হয় না। তবে পচার বাপ রশিদ নিলো কি-না খেয়াল করিনি।’
নবেজউদ্দিন অবাক হয়, জরিমানা ব্যামাক না নিয়াই গোরু দিলো? জালাল মাস্টার মাথা নাড়ে, রশিদ নেওয়া উচিত ছিলো।
কিসের রশিদ?’ করমালি তার বাড়ির ভেতর থেকে পান এনে সকলের সামনে রাখে। শালা মনে হয় তশীলদার হছে। গোরুচোরের অশিদ নেওয়া লাগবো কিসক? পুবের মানুষ সব খাড়া হয় আছে, পশ্চিম থাকা হামরা একবার যাই তো পুবের মানষের সাথে একত্তর হয়া হোসেন ফকিরের গুষ্টি সাফ করা হবো। কি কন আনোয়ার ভাই?
কিন্তু কথাটা আনোয়ার কিভাবে পাড়বে বুঝতে পাচ্ছে না। ভোরবেলা বাড়ি পৌঁছে চেংটুকে সব বলা হয়েছে, মনে হয় তার কাছে আলিবক্স খবর পাঠিয়েছে আগেই। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর করমালির বাড়ির সামনে জালাল মাস্টারের চাষের জমিতে মিলিত হওয়ার বুদ্ধি চেষ্ট্রর, এখানে প্রায় ২৫/৩০ জন লোক এসেছে তারই কথায়। কিন্তু জালালউদ্দিনকে আসতে বললো কেন? আজ রাত্রে এতোগুলো মানুষের ধারাবর্ষ যাত্রার প্রস্তাব জালাল মাস্টার নাকচ করলে এদের সবাইকে রাজি করানো মুশকিল হবে। লোকটাকে এরা সবাই মানে।
হামরা ইগল্যান বুঝি। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ায় বাদু শেখ, তাই পাদে, তাই কোতে, গুছিটায় কলাপাতে। প্রবাদটি ব্যাখ্যাও করে সে, হাগে খয়বার গাজী, গু ছিটায় হোসেন আলি। ধরলে দুয়োটাকই ধরা লাগে।
নাদু পরামাণিক প্রতিবাদ করে, খয়বার গাজী থাকে এটি, আর চর হলো তোমার পাঁচ ছয় কোশ ভটিত। আসুন্দা কথা কস কিসক?
এই সময় কাঁদতে কাঁদতে আসে ১১/১২ বছরের ১টি ছেলে। ময়লা গেঞ্জি গায়ে, গেঞ্জিটা তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের লোক পরলে ফিট করতো। ছেলেটির সবুজ ডোর-কাটা লুঙি হাঁটুর কাছে তোলা। চোখের পানিতে তার খড়ি-ওঠা কালো গালে কাদার পলেস্তারা পড়েছে। এ হলো পচার বাপের নাতি, পচার ৩ কি ৪ নম্বর পয়দা। নোনা পানিতে জড়ানো বিলাপ থেকে তার দুঃখের কারণ বোঝা কঠিন। মনোযোগ দিয়ে তার বিলাপ ও বাক্য শুনে করমালি চিৎকার করে, ‘কি কস? কেডা কলো? তাঁই কোটে? করমালি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পচার বাপের বাড়ির দিকে যায় এবং তাকে অনুসরণ করে জমায়েতের আর্ধেক লোক। কয়েক মিনিটের মধ্যে চেষ্ট্র গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। কি খবর?-পচার সম্বন্ধী তার জামাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে যে চালুয়াবাড়ি চরে কাশবনের ভেতর পড়ে রয়েছে পচার বাপের লাশ। পচার সম্বন্ধীর জামাইকেও চেষ্ট্র ধরে এনেছে। এতোগুলো মানুষের সমবেত জেরার জবাবে সে জানায় যে গতকাল তার শ্বশুর গিয়েছিলো চালুয়াবাড়ি হাট, নৌকা থেকে পচার বাপের লাশ দেখে ভয়ে বাড়ি ফিরে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
করমালি কাঁদে আর হায় হায় করে, পচার বাপের বাড়িতে সাবালক পুরুষমানুষ কেউ নাই। পচা তার জোয়ান ছেলেকে নিয়ে গেছে পশ্চিমে, খিয়ার অঞ্চলে। সে কি এখানে? বাঙালি নদী পেরিয়ে ৭ ক্রোশ পথ হেঁটে করতোয়া, করতোয়ার ওপার বগুড়া থেকে ট্রেন চেপে যেতে হয়। তালোড়াও যেতে পারে, কাহালুও যেতে পারে। এমন কি দুপচাচিয়৷ আদমদিঘিও হতে পারে। খিয়ার এলাকায় এখন ধান কাটার ধুম। ১০/১৫ দিন আগে তার এামে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নাই। এখন খরচাপাতি করে কে? করমালির ঘরে কাল সকালের ভাত পর্যন্ত নাই। বাশের খুঁটি কেটে পচার বাপ তার সারা জীবনের সঞ্চয় সব নিয়ে গেলো গোরু খালাস করতে। তার পয়সা বেশির ভাগই বেঁচে গেলো, কিন্তু ভোগে লাগলো না। কোমরের টাকার খুতি কি লাশের সঙ্গে গাথা থাকবে?
অতো চিন্তা করিস কেন? জালাল মাস্টার ধরা গলায় আশ্বাস দেয়, আমরা কি জীবিত নাই? পচার বাপ তোর জ্যাঠা হয়, আমার কি কেউ নয়? সে কি দীর্ঘকাল আমার জমি বর্গাচাষ করে নাই? এখন লাশ আনার বন্দোবস্ত করা লাগে। মোসলমানের লাশ, মাটির মধ্যে না যাওয়া পর্যন্ত তার উপরে আজাব হবে। জালালউদ্দিনের আশ্বাসবাণী শুনে করমালি গলা ছেড়ে কাঁদে, ও জ্যাটো! জ্যাটো গো! ডাকাতগোরে ঘর থাকা তুমি গোরু আনবার গেলা কিসক গো? তার এই প্রশ্নবোধক বিলাপে ওদিকে তার বাপের ঘর ও পচার ঘরে প্রবলরকম কোলাহল শুরু হয়। হাত ও পাছায় ভর করে ছেচড়ে ছেচড়ে, প্রায় গড়িয়ে চলে আসে করমালির বাপ। বাতে পঙ্গু লোকটি খুব শব্দ করে কাদতেও পারে না, কেবল ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করে। নিহত ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকদিন থেকে খারাপ। তার বিলাপেও এই তথ্য উপস্থিত। যেমন তাদের বাপ মরলে তার জমির ১০ আনা ভাগ দখল করে নেয় পচার বাপ। এই নিয়ে মামলা করতে গিয়ে তার ২১ শতাংশ জমি বিক্রি করে করমালির বাপ আজ নিঃস্ব চাষা। নামমাত্র দামে তার সব জমি কিনে নিলো আফসার গাজী। আবার মামলায় পচার বাপকে সাহায্য করে খয়বার গাজী। বগুড়ার হামিদ মুক্তারের কাছে এমনকি চিঠিও নাকি দিয়েছিলো পচার বাপের কাছ থেকে কম পয়সা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় করমালির বাপ বিলাপ করে, মিয়াভাই গো! খয়বার গাজীর বুদ্ধি নিয়া হামার সৰ্ব্বোনাশ করল্যা, আবার তারই মানষের হাতোত তুমি জান দিলা গো! আনোয়ার উসখুস করে, আজকের দিনটা করমালির বাপ এইসব প্রসঙ্গ না তুললেই পারে। আবার দ্যাখো, করমালির মামা মন্তাজ কানা সায় দেয় ভগ্নীপতির কথায়, মানুষটা বড়ো ভয়পাদুরা আছিলো গো। গাজীগোরে কাকো দেখলে তাই ভয়ে সিটকা লাগছে, আবার তাই মরে খয়বার গাজীর ইশারায়! এই ধরনের কথাবার্তা জালালউদ্দিন পছন্দ করে না, আন্দাজে কথা কওয়া কি ভালো? খয়বার মিয়ার হাত আছে, তুমি জানো ? সে পরামর্শ দেয়, থানায় একটা এজাহার করা লাগে, আজই করলে ভালো হয়।
থানা পুলিস সব খয়বার গাজীর খুতির মদ্যে। বান্দু শেখ পুলিস সম্বন্ধে তার মতামত জানালে জালালউদ্দিন নতুন পথ খোজে, তাহলে ডিসি সায়েবের বরাবর একটা পিটিশন করা হোক। পিটিশনের কপি দেওয়া লাগবো এসপি সায়েবের কাছে। এসপি সায়েবের অফিসের হেড ক্লার্ক আফাজ মিয়া আমার ছাত্র না হলেও তমিজের ভায়রা ভাই। তমিজ আমার সাক্ষাৎ ছাত্র, এখনো দ্যাখা হলে পায়ে হাত দিয়া সালাম করে।’
প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে জালালউদিনের প্রভাব প্রতিপত্তির বর্ণনা থামিয়ে দেয় কানা মন্তাজ, উগলান সবই খয়বার গাজীর কেনা।
মারলে খয়বার গাজীর মানষেই মারছে। হোসেন অলিও তো তারই চাকরি করে।’ চেন্টুর কথা থেকে মনে হয় এই ব্যাপারে সে একেবারে নিশ্চিত, এখন সোগলির যাওয়া লাগে চালুয়াবাড়ি। সোগলি না গেলে চাচার লাশ দিবো না
চলো, আর বুদ্ধি নাই, চলো।’ চেংটু হাত তুলে সবাইকে থামায়, ‘পদুমশহর, কর্ণিবাড়ি, দরগাতলাত খবর দেওয়া হছে। জোড়গাছাত খবর দিবো বান্দু, ঘাটাল থাকা নাও নিয়া আসবো কাবেজ। পচার বাপের লাশ না পাওয়া গেলে যাওয়া লাগবো ধারাবর্ষা। হোসেন ফকিরের সাথে বোঝপড়া হবো। চলো!
সবাই হৈ চৈ করে ওটে, চলো। লাঠি সড়কি নেওয়া লাগবে না? লাগবো না? দাও কুড়াল লাঠি সড়কি বল্লা বাটি-যাই যা পারো ন্যাও। ‘হোসেন ফকিরেব নিৰ্ব্বংশ করো’ , উত্তেজিত শব্দমালা ক্রমেই তেজী ও দ্রুত হয়। জালালউদ্দিন ভয় পায়, এই মূখদের কাণ্ডজ্ঞানের বড়ো অভাব। হোসেন ফকিরের গায়ে হাত তোলার পরিণতি কি হতে পারে এরা কি আন্দাজ করতে পারছে? আনোয়ারের বিবেচনাবোধে তার আস্থা একটু বেশি, আনোয়ার, এতো তাড়াতাড়ি ধৈর্যচ্যুতি ঘটা কি ভালো?
কি করবে বলেন? নিরীহ বুড়ো মানুষটাকে মেরে ফেললো, ধৈর্য থাকে কি করে! ভাইজান, আপনের সাথে আলিবক্স ভায়ের কথাবার্তা তো হয়াই গেছে। করমালি সামনে এসে বলে, ‘আপনে থাকলে হামরা হিরদয়ে বল পাই।’ আনোয়ার দেখছিলো, এতো সিরিয়াস ১টা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাকে ১ বার কেউ জিগ্যেসও করলো না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো ভূমিকাই নাই। সুতরাং এর পরিণতিতেও তার দায়িত্ব থাকার কথা নয়। দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে আনোয়ার লঘুভার হয় বটে, কিন্তু নিজের ভার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের নিচের মাটিও ঝুরঝুর করে সরে পড়ে। করমালির অনুরোধে দাঁড়াবার জায়গাটি ফের জমে শক্ত হয়।
বান্দু শেখ এসে বলে, ‘ভাইজান, আপনেক যাওয়াই লাগবো।
গেলে তাড়াতাড়ি চলো। তোমার তৈরি হয়ে নাও! রাত হচ্ছে কিন্তু। আনোয়ার শুনতে পাচ্ছে যে হোসেন আলি ফকির ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মেরে পচার বাপের মৃতদেহ ছিনিয়ে আনার সমবেত সংকল্প ঘোষণার চিৎকার বটগাছের শিশির-ভেজ পাতায় সপসপ এবং নিচের শুকনা পাতায় সরসর সাড়া তুলছে। চাদের অল্প আলোয় দ্যাখা যায় যে গোটা বটগাছ তার ডালপালা, পাতার বহর, ঝুড়ি, থাম, শিকড় ও ছাদ নিয়ে তিরতির করে কাপছে। আর ঐ জীন? না, বটগাছের পুরনো বাসিন্দার কোনো সাড়া নাই, মানুষের সমবেত আওয়াজে টিকতে না পেরে সে শালা নতুন করে উড়াল দিয়েছে অন্য কোথাও। মাটিতে বসে থেকেও আনোয়ারের পা কাপে। এটা আর কতোক্ষণ? সকলের সঙ্গে একবার রওয়ানা হলে পায়ের কাপন, বুকের কাপন কোথায় যাবে! এরকম সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ জীবনে কবার আসে? এইতো, রাত থাকতে থাকতে ৫০/৬০ জন মানুষের সঙ্গে সে রওয়ানা হবে চালুয়াবাড়ি। পচার বাপের হত্যাকারীদের খতম করে যমুনা পার হয়ে ধারাবর্ষা। হোসেন আলিকে ধরে নিয়ে সোজা ডাকাত-মারা চর। বাথানের সব গোরু খুলে দাও, খতম করো হোসেন আলি ফকিরকে!—মনে পড়ে?—একবার নিজের কিষানকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছিলি, মনে আছে?—এইবার বুঝবি মানুষের হাতে মরতে কেমন লাগে। ধারাবর্ষা থেকে ফিরে এসে ধরে খয়রার গাজীকে। ব্যাটা এখান থেকে কলকাঠি নাড়ো, মানুষের গোরু চুরি করে তার কাছ থেকেই আদায় করো। কারো জমিতে তারা বর্গ করতে না পারে সেই ফন্দি আঁটে? সবাই এসে তোমার পায়ে পড়ুক, তুমি ইচ্ছামতো মানুষের ভিটাটুকু পর্যন্ত কজা করে তাকে তোমার গোলাম বানাও।-এইবার? এইতো ভেতর থেকে ভাঙতে শুরু করেছে, ওপরটা আপনাআপনি ধসে পড়তে আর কতোক্ষণ?
‘না, আনোয়ারের যায়া কাম নাই।’ জালালউদিনের অভিভাবকসুলভ নির্দেশে আনোয়ার এমন ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকায় যে, লোকটা এই আবছা আলোতেও তার তীব্রতা আঁচ করে মুখ ফেরায়। আরো ঠাণ্ডা বাক্যে আনোয়ার তার সিদ্ধান্ত জানায়, ‘আমি তো যাবোই। চেংটু বলে, ‘ভাইজান আপনের যাওয়া হবে না। গোলমাল তো ভালোমতোই হবো, কার বাশের ডাং যে কার উপরে পড়বো দিশা পাওয়া যাবো না। ঘাটাও আপনে ভালো করা চেনেন না !’
চেংটুর ওপর সরাসরি রাগ করা যায় না। আনোয়ারের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমি কি বাচ্চা ছেলে? না একটা গাধা যে গোলমাল হলে সামলাতে পারবো না? পথঘাট চিনতে পারবো না কেন? আনোয়ারের উত্তেজনা চাপা থাকে না, তোমাদের বুকে সাহস আছে, আর আমার বুক হলো হাড্ডিমাংসের পিণ্ড?
না না ভাইজান হামি সেই কথা কই নাই। আপনে গেলে আপনাক মানা করে কেটা? আপনে থাকলে হামরা থাকমু আপনার পাছে। আপনে যা করেন, যা হুকুম করবেন, উরুজোগার দিয়া হামরা তাই করমু!’
আনোয়ার বড়ো কাচুমাচু হয়। ছি, ছি সে কি নেতৃত্বের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে? চেষ্ট্র তাকে ভাবলো কি? সে যা বলবে এরা তাই করবে—সে এরকম চাইবে কেন? এ পর্যন্ত এদের কোনো নির্দেশই তো সে দেয়নি। সে শুধু ওদের সঙ্গে থাকবে, সহকর্মী হয়ে তাদের কাজে অংশ নেবে। এতে চেংটু আপত্তি করে কেন?
চেন্টু তার হাত ধরে একরকম হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় করমালির ঘরের সামনে গোরুর জাবনা খাওয়ার গামলার পাশে। মোলায়েম ও নিচু গলায় সে মিনতি করে, আপনে এটি থাকলে হামাগোরে একটা কাজ হয় ভাইজান আর কেউ ঐ কাম পারবো না। আলিবক্স ভাইও কয়া দিছে, আপনি ছাড়া আর কারো উপরে ঐ কামের ভার যেন না দেই!
তাকে তাহলে থাকতে হচ্ছে আলিবক্সের নির্দেশে?-আনোয়ারের বুক একটু সঙ্কুচিত হয়, সেখানে জানান দিয়ে যায় চিনচিন ব্যথা। এর চেয়ে চেংটুর নির্দেশ মানা অনেক সহজ। তবে এখানে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের কথা শুনে আনোয়ার আর কথা বলতে পারে না। কি?–না, সবাই চরের দিকে চলে গেলে আনোয়ার যেন খয়বার গাজীর ওপর চোখ রাখে। ওরা যে অনেক শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে এ ব্যাপারে চেংটু নিঃসন্দেহ। এসে ধরা হবে খয়বার গাজীকে। এবার তার চূড়ান্ত বিচারের পালা। আনোয়ার লক্ষ্য রাখবে, খয়বার গাজী যেন গ্রাম ছেড়ে পালাতে না পারে। কিভাবে?–চেংটু ভয়ে ভয়ে হাসে, ধরেন আপনেও বড়োলোকের ঘরের ছেলে, তাইও বড়োলোক! চেংটুর কথাটা বুঝতে পারায় তাকে বড়োলোক বলা সত্ত্বেও আনোয়ার রাগ করে না। ২জনেই ভদরলোক বলে আনোয়ারের পক্ষে খয়বারের গতিবিধি অনুসরণ করা একটু সহজ। তার গতিবিধি সন্দেহজনক হলে আনোয়ার তাকে ফুসলে ফসলে, মিথ্যা কথা বলে, দরকার হলে নিজেদের বাড়িতে রেখে দেবে। খয়বার গাজীর বিচার করতে পারলে একটা কাজের মতো কাজ হয়। এর অনেকটা নির্ভর করছে আনোয়ারের ওপর।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩১
সকাল বেলা আনোয়ার মন্তাজ কানার কাছে প্রতিদিন খবর পায়, খয়বার গাজী বহাল তবিয়তে আছে। তবে পরশু থেকে বিকালবেলা বৈঠকখানার উঁচু বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে সূর্যাস্ত দ্যাখা স্থগিত রেখেছে। আজ সন্ধ্যায় করমালির ঘরের সামনে মন্তাজ কানার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আনোয়ারের একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা বাজলো। এসে দ্যাখে ভেতর-বাড়ির চওড়া বারান্দায় বসে খয়বার গাজী ও জালালউদ্দিন সেমাই খাচ্ছে। আনোয়ারকে দেখে খয়বার গাজী মুখ ভরে হাসে, বাবাজী, আমার ওদিক আর গেলা না তো চরের মধ্যে গেছিলা শুনলাম। আমি জানলে আফসারকে সাথে দিতাম, এখন হাসের মৌসুম, আফসারের হাতের টিপ খুব ভালো। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সে তোলে আনোয়ারদের চর এলাকার জমিজমার কথা, জমাজমির তদবির করা আসলা? নিজে না দেখলে জমি বেহাত হয়ে যায় বাবা। আকবর ভায়েক কত কছি, চরের মধ্যে আপনাদের জমি উঠতিছে, দাখিলা দ্যাখেন, খতিয়ান দ্যাখেন। আকবর ভাই গাও করে নাই। তা তুমি জমি দ্যাখাশোনা করতিছ, জালাল মিয়া কলো। ভালো। করাই লাগবো। দিন কি সবসময় একরকম যায়?
সম্পত্তির প্রতি আনোয়ারের আকর্ষণের দিকে লোকটা বিশ্রী ইঙ্গিত দিলো। ব্যক্তিমালিকানার প্রতি মোহ আনোয়ারের কাছে অরুচিকর ও নিচু ধরনের প্রবৃত্তি বলে মনে হয়। তবে রুচির চেয়েও জরুরি দরকার থাকে। আনোয়ারের কোনো কথা কি আচরণে খয়বার যেন সন্দেহ করতে না পারে। এখন তার কোনো কথার প্রতিবাদ করা ঠিক নয়। মন্তাজ কাল খবর দিলো যে চেন্টু, বান্দু শেখ, করমালিরা চালুয়াবাড়ি হয়ে ধারাবর্ষা ও ডাকাত-মারা চর পৌঁছতে পৌঁছতে শখানেকের বেশি লোক তাদের সঙ্গী জুটে গেছে।
আবার বড়োচাচীর সঙ্গে দ্যাখা করার জন্য খয়বার ভেতরের ঘরে গেলে জালাল মাস্টার আনোয়ারের কানের কাছে মুখ এনে তার ভয়ের কথা জানায়, সমাচার খুব খারাপ। ডাকাতমারার চরের বাথান শুনলাম লুটপাট হছে। হোসেন আলির বাড়িত নাকি আগুন ধরায়া দিছে। কও তো বাপু, এটা কি মনুষ্যত্ব?
‘হোসেন আলিও শুনি লুটপাট চুরিচামারি করেই গোরুর বাথান করেছে। আস্তে বাবা, আস্তে। খয়বার ভাই শুনবো। এতো বড়ো নামী মানুষটা। কাল থাকা চিন্তায় চিন্তায় শরীরখান অর্ধেক করা ফালালো!
জালালউদিনের কাছেও আনোয়ার সাবধান হওয়ার চেষ্টা করে, খয়বার চাচার ভয় কি? আমিও তো সেই কথা কলাম। জালাল মাস্টার হাই তোলে, হাই তুলতে তুলতে কথা বলায় তার শব্দ বাঁকা হয়ে যায়, তবে ধরে বিষয় সম্পত্তিআলা মানুষ তো, ওদিককার চরের দশ আনার মালিক তাই নিজে, দুশ্চিন্তা একটু হবোই।
ঘুমে তার চোখ দুলে আসছিলো, এমন সময় খয়বার গাজী জালাল মিয়া, শুনছেন? বলে এই ঘরে ঢুকলে জালালউদ্দিন সোজা হয়ে বসে।
ধারাবর্ষার দুই পাশেই নদীর মধ্যে ঘোড়ার ডাক শোনা গেছে। কন তো কি বিপদের কথা!
আনোয়ার জিগ্যেস করে, আপনি কোনোদিন ঘোড়ার ডাক শুনেছেন? না বাবা। চরের দিকে আমরা যাইই না, আগে যখন বয়স আছিলো তখন শিকার টিকার করবার গেছি। তাও বছরের মধ্যে ঐ একবারই। গত দশ বছর ওদিক যাওয়া হয় নাই। সে বেশ দুশ্চিন্তগ্রস্ত, কি মুসিবতের কথা কন তো? তা এখন কি বান হবার পারে?
তাকে সান্তুনা দেওয়ার চেষ্টা করে জালালউদ্দিন, বান কোনো কথা নয়। বড়ো ধরনের বালা মুসিবত, সংকট, বিপদ, আপদ, দুর্যোগ, বিপর্যয় সামনে থাকলে যমুনার মধ্যে দেড়শো দুইশো ঘোড়া সংকেত দেয়। আনোয়ারের আস্থা অর্জনের জন্যে জালালউদ্দিন প্রস্তুতি নেয়, ইতিহাসে আছে– ‘
ইতিহাস ভূগোলের চর্চা আঁচ করে খয়বার গাজী ফের বড়োচাচার ঘরে চলে গেলে আনোয়ার বলে, নদীর ভেতর ঘোড়া চরে বেড়ায়, এ কথা ইতিহাসে থাকবে কেন?
‘আরে নদী ছিলো কোথায়? ইতিহাস চর্চার উৎসাহে জালালউদিনের চোখ থেকে ঘুম চলে যায় কোথায়, দেড়শো পোনে দুইশো বছর আগে ওখানে গভীর অরণ্য। যমুনা তখন একটা খাল, কোম্পানীর ম্যাপে পাবা যমুনা ক্যানেল।
বেশ তো, ভূমিকম্পে ব্ৰহ্মপুত্রের কোর্স চেঞ্জ হলে যমুনা নদী বড়ো হলো। কিন্তু এর সঙ্গে ঘোড়ার ডাকের সম্পর্ক কি? আনোয়ারের সংশয় জালালউদ্দিনকে অনুপ্রেরিত করে তোলে। সে তখন যমুনা নদীর ভেতরকার হেষাধ্বনির ঐতিহাসিক সূত্র বিশ্লেষণ করে। কিরকম?—ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে মজনু শাহের অনুসারীদের অনেকেই আশ্রয় নেয় যমুনা খালের পশ্চিমে। আহত মজনু শাহ গঙ্গা পার হয়ে পালাবার সময় মারা যায় বিহারের কোনো গ্রামে। তার মৃত্যুর মুহুর্তে সমস্ত ঘোড়া একসঙ্গে চিৎকার করে চরম অশুভ সংবাদটি তার অনুসারীদের জানাবার চেষ্টা করেছিলো।
‘কোথায় বিহার, কোথায় মজনু শাহ্, আর এখানে তার অশ্ববাহিনী তা আঁচ করে কিভাবে? আনোয়ারের সংশয়ে জালালউদ্দিন আরো মরিয়া হয়ে উঠে, আরে বাবা, সায়েন্সেই তো বলে, ইতর প্রাণীর কোনো কোনো বোধ মানুষের অপেক্ষা বহুগুণ প্রবল।’ শক্ত শক্ত কথায় যমুনার ভেতর হেষাধ্বনির ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে জালালউদিনের উৎসাহ দেখে আনোয়ারের চোখের পলক পড়ে না।
খয়বার গাজী খাবে বলে মুরগি জবাই করা হয়েছিলো। রান্নাবান্না শেষ হলে খেতে খেতে রাত ১১টা। জালালউদ্দিন অবশ্য বিদায় হয়েছে আগেই। খাওয়ার পর খয়বার গাজী বেরিয়ে তার বাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে যাত্রা করায় আনোয়ারের খটকা লাগে; লোকটা কি পালাবার তালে আছে? খয়বার গাজীর পাশে লাঠি হাতে ২ জন লম্বা চওড়া কিষাণ। পেছনে জবুথবু নাদু পরমাণিক।
‘চাচা, কোথায় যাচ্ছেন? আনোয়ারের ডাকে খয়বার চমকে উঠে। মাথার ওপর কাঁঠালগাছের প্রসারিত ডাল। বঁদিকে ভাঙা দালানের স্তৃপ। দালানের পাশে খড়ের গাদার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১টা সাদা গোরু। তার ল্যাজ নাড়ার আওয়াজ ঝাপশা হয়ে কানে আসে, সেই মৃদু আওয়াজে নীরবতা আরো গাঢ় হয়। আবার কাঁঠালগাছে কোনো দোয়েলের ছোট্টো ডানার ঝাপটানি প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি কাঁঠাল পাতায়। ঝটপট ও শিরশির ধ্বনিতে জায়গাটির পরিধি কমে।
তুমি? খয়বার গাজী তার দিকে ভালো করে তাকায়, যাই বাবা, একটু হাটাইটি করা আসি।
গ্রামের প্রান্তে গাবগাছতলায় পাহারা দিচ্ছে বান্দু শেখ। তবে এই বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালাতে পারলে সে পৌঁছে যাবে পদুমশহরে তার ছেলের খালু-শ্বশুরের বাড়ি। ভোরবেলা উঠে ভাগবে বগুড়ায়। না, তাকে পালাবার সুযোগ দেওয়া হবে না। কাল পরশুর মধ্যে চেন্টু, আলিবক্স, করমালি, বান্দু শেখ ফিরে না আসা পর্যন্ত এই দায়িত্ব থেকে আনোয়ারের মুক্তি নাই।
ইঙ্গিতে খয়বার গাজীকে একটু আড়ালে নিয়ে আনোয়ার নিচু গলায় বলে, আপনি আজ কোথাও যাবেন না। আমাদের বাড়িতেই থাকেন।’
কেন? ১টি মাত্র শব্দে খয়বার গাজী সারা জীবনের আতঙ্ক শতকরা ১০০ ভাগ প্রকাশিত হয়। তার মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে কাগজের মতো। তার চোখ থেকে প্রাণ উধাও হয়, নিশ্বাসের জরদার গন্ধ পরিণত হয় কপূরের গন্ধে।
আপনি যাবেন না, এখানেই থাকেন। অবস্থা ভালো না। তুমি জানো? আনোয়ার কিছুই না বললে হঠাৎ করে খয়বার তার হাত ধরে ফেলে, বাবা, এই বেন্ন্যার বাচ্চারা গায়ের মধ্যে ভদরলোক থাকবার দিবো না। আজ লাগছে আমরা পিছনে, কাল ধরবো তোমার চাচাক, পরশুদিন তোমাকেও ছাড়বো না।
খয়বার গাজীর সঙ্গে ঘরে ফিরে দ্যাখা গেলো বড়োচাচা আনোয়ারের ঘরেই আরেকটি পালঙ এনে বিছানা করার জন্যে মন্টুকে নির্দেশ দিচ্ছে। তার মানে খয়বার যে রাতটা এখানেই কাটাবে তা আগেই ঠিক করা হয়েছে। কাঁঠালতলায় কিন্তু লোকটা এমন একটা ভাব করলো যে আনোয়ারের পরামর্শেই সে এই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। এর মানে কি? আনোয়ার আরো সতর্ক হয়। খয়বার আলাদা বিছানা করতে দেবে না, নানা ভাইজান এতো রাতে ঝামেলা করবেন না। এতো বড়ো পালঙ, আমি এর এক কিনারে পড়া থাকমু। আমার আবার শোয়ার সাথে সাথে ঘুম, এক ঘুমে ফজর।’
বড়োচাচা, আনোয়ার, এমনকি মন্টুও বুঝতে পারে, খয়বার গাজী একা এক বিছানায় শুতে সাহস পাচ্ছে না। এমন হতে পারে যে, আনোয়ারের ওপর তার ভরসা হয়েছে, দরকার হলে তাকে জড়িয়ে ঘুমাবে। আবার আনোয়ারকে যদি প্রতিপক্ষের লোক বলে ধরে নিয়ে থাকে তাহলেও অনোয়ারের আড়ালে থেকে শক্রর হাত থেকে বাঁচতে পারবে।
ইজি চেয়ারে বসে বড়োচাচা হাই তোলে। মন্টু এসে পরিষ্কার অড় লাগানো বালিস ও লেপ নিয়ে এলে বড়োচাচা উঠে দাঁড়ায়, রাত মেলা হছে। শুয়া পড়ো।’
চিলেকোঠার সেপাই – ৩২
বিপুল সংখ্যক ঘোড়ার সমবেত ডাক শুনে আনোয়ারের ঘুম ভাঙে, মনে হয় নৌকার ওপর সে শুয়ে রয়েছে, নদীর ভেতরকার অপরিচিত কোনো আওয়াজে নৌকা দুলছে। ভালোভাবে চোখ মেললে ভুলটা ভাঙে। কোথায় যেন অনেক লোক একসঙ্গে কথা বলছে। কারা? বেলা কি অনেক হয়ে গেছে? মন্টু আজ আগেই উঠে পড়েছে, হঠাৎ ওর এতো সুমতি? আনোয়ার বরং আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে। চোখ বন্ধ করতে না করতে একটা মোটা গলা সশব্দ ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে কানের ওপর, আরে আছে, এটি আছে! নিজের বাড়ি বাদ দিলে তামাম গাওয়ের মদ্যে তার থাকার জায়গা এই বাড়ি ছাড়া আর কোটে আছে গো?
আনোয়ারের মাথা থেকে ঘুমের শেষ তলানিটুকু পর্যন্ত উৰে যায়। বুক ধক করে ওঠে, খয়বার গাজী কোথায়?—পাশে চাদর ঠাণ্ডা, পায়ের কাছে এলোমেলো গোটানো লেপ, সেটাও ঠাণ্ডা। মানে অনেকক্ষণ আগেই সে চলে গেছে। টেবিলে হ্যারিকেন নেভানো। বাইরের দিককার দরজা বন্ধ। ভেতরের বারান্দায় যাবার দরজা দ্যাখার জন্য আনোয়ার উঠে বসলো। দরজা খোলা। কখন খুললো?—শকুনটা এই দরজা দিয়ে উড়ে গেছে। আনোয়ারের এভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। চেংটু, করমালি, বান্দু শেখ, কানা মন্তাজ-এদের কাছে সে কি কৈফিয়ৎ দেবে? আলিবক্স তো মনে হয় তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনবে।
‘খয়বার গাজীক বার করা দ্যাও। বাইরের সমবেত মানুষের চিৎকার ক্রমে স্পষ্ট হয়, কুত্তার বাচ্চা এটি আছে!’
‘বার হ শালা, গোরুচোরের সর্দার বার হয় আয়! তোর গোয়ার মদ্যে আছেলা বাঁশ সান্দায়া দেওয়া হবো, বারা!
আনোয়ার হয়তো এরকমই চাইছিলো। কিন্তু সত্যি সত্যি এরকম হলে তার করার কি আছে তা বুঝতে পাচ্ছে না।
বড়োচাচা এসে বসলো আনোয়ারের খাটে। চোখেমুখ নিদ্রাহীনতার ছাপ। এলোমেলো চুল। চাপা গলায় বলে, অনেক মানুষ। একশো দেড়শোর কম নয়। সব চরের মানুষ। চরুয়ারা ডাকাতি ছাড়া কিছু বোঝে না। ফেরোশাস পিপল! কি করি এখন?
আনোয়ার জিগ্যেস করে, খয়বার চাচা কোথায়? কি জানি?’ বড়োচাচা, খয়বার গাজী সায়েবকে না পেলে এরা যাবে না। কোথায় গেছে? ‘জানি না বাবা। ‘ঘর থেকে বেরিয়েছে ভেতরের দরজা খুলে। আপনি বুঝতেই পারলেন না? আনোয়ারের কথার আঁচে বড়োচাচাও উত্তপ্ত হয়, তোমার পাশেই তো শুয়েছিলো, তুমি টের পেলে না?
এই বাড়ির লোকজনের সাহায্য ছাড়া খয়বার গাজী বেরুতেই পারে না। তার মানে আনোয়ারের ওপর এদের আস্থা নাই; থাকলে তাকে না জানিয়ে খয়বারকে পার করে দেয়? এদের অবিশ্বাস অর্জনকে কৃতিত্ব বলে ধরে নিয়ে আনোয়ার তৃপ্তি পায়; এরা বুঝতে পেরেছে যে আনোয়ার আসলে এদের লোক নয়, সে আছে প্রতিপক্ষের সঙ্গে। এই তৃপ্তি তার রাগের উত্তেজিত স্তরটাকে মুছে ফেলে, পরিণত ও অভিজ্ঞ স্বরে সে জানতে চায়, লোকজন বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লে কি করবেন?
‘চুকলে তো কাউকে রেহাই দেবে না বড়োচাচ ভয়ে কাপছে, কাপুনির ফলে তার কথা সোজাসুজি বেরুতে পারে না।
ওদিকে সমবেত ধ্বনি ক্রমে উচ্চকণ্ঠ হয়। বড়েচাচার সঙ্গে আনোয়ার নাশতা খাচ্ছে, মন্টু এসে বলে ২৫/৩০ জন লোক ভাঙা দালানের স্তুপে ওঠার চেষ্টা করায় ইট চুন সুরকি সব গড়িয়ে নিচে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি ওখান থেকে গড়িয়ে পড়ায় একজনের পা পর্যন্ত ভেঙে গেছে। কয়েকজন এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে খরগাদার সামনে। আনোয়ার অবাক হয়ে ভাবে লোকজন এখন পর্যন্ত ভেতরে হামলা করে না কেন? একি তাদের ভয়? না বিবেচনাবোধ?
ধীর লয়ে ও নিচু গলায় বড়োচাচী অভিযোগ করে, খয়বার মিয়া মানুষ সোজা নয়। গোলপুকুরের বারো আনা মাছ যায় রশিদের ভোগে। রশিদকে উস্কানি দেয় কে? খয়বার গাজী নিজে। মহিলার মৃদুস্বরের বিলাপ অব্যাহত থাকে। আনোয়ারের বাপচাচার আপন চাচাতো ভাই এই রশিদ মিয়া। তার বাপ মরেছে তার দাদা বেঁচে থাকতে। সে সম্পত্তি পায় কোন আইনে? অথচ, খয়বারের প্ররোচনায় পড়ে নিজের রক্তের সম্পর্কের ভাইদের হেনস্থা করার মতো ফন্দিই সে করে।—দাখো না বাবা, এই খয়বার মিয়ার জন্যে চর এলাকায় আমাদের কোনো জমি উঠলে আমরা তার দখল পাই না, যমুনার মদ্যে কোনো জমি উঠলেই ভোগ করবে খয়বার মিয়া! জমি দখলের ব্যাপারটা আগে একচেটিয়া ছিলো আনোয়ারের দাদা এবং দাদার বাপের। শ্বশুরবংশের হাত থেকে কাজটা ফসকে গেছে বলে বড়োচাচীর আক্ষেপের আর শেষ নাই। বড়োচাচীর চরিত্র বিশ্লেষণ অবশ্য বস্তুনিষ্ঠ। খয়বার গাজীর ভালো দিকটাও তার ক্ষোভের অন্তর্গত হয়। যেমন, মানুষটার একটা বড়ো গুণ, আত্মীয়স্বজন কারো অসুখবিসুখ হলে জান দিয়া খাটে। তোমার বড়োচাচার যেবার নিমুনিয়া হলো, ডাক্তার ডাকা, ওষুধ নিয়া আসা থাকা শুরু করা ঘড়ি ঘড়ি অ্যাসা ওষুধ-পত্র খিলানসব করছে এই খয়বার মিয়া। এরই মধ্যে বেলীকে দিয়ে বড়োচাচী হামানদিস্তায় পান ছেঁচে নেয়, পান খায় এবং আঙুলে চুন নিয়ে জিভে ঘষে। আত্মীয়স্বজনের মদ্যে তাই সহ্য করবার পারে না খালি জালাল মিয়াক। তাই সামনে না থাকলে তাক কয় ঘর-জামাই। আর সামনে থাকলে খালি ঠ্যাঙামারা কথা। আবার দ্যাখো, আল্লার কি কাম, জালাল মিয়া না হলে এতোক্ষণ তার জান থাকে? রাতে জালাল মিয়া না আসলে—।’
আনোয়ার এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে। জালাল ফুপা এসেছিলেন? কখন? কতো রাত্রে?
ফজরের আজান পড়ার আগেই আসছিলো। নাদুর কাছে খবর পায়া নিজে আসছে।’ বাইরে যাবার জন্যে আনোয়ার এবার উঠে পড়ে। বড়োচাচা আস্তে করে ডাকে, ‘আনু, বাবা, খয়বার গাজী হাজার হলেও এই এলাকার একটা মাথা। আমাদের আত্মীয়। তোমার বাপের খুব বাল্যকালের বন্ধু। কথাটা মনে রাখবা। শোনো—।
আনোয়ার আর দাঁড়ায় না। বাইরে এতো লোক আনোয়ারের পা একটু কাপে, এরা তাকেও তো ধরতে পারে। ভাঙা দালানের স্তুপের সামনে সে পৌঁছতে কয়েকজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়, ক্যাগে? বড়োমানষের ব্যাটা! আসামী কোটে? তার কোটে নুকা খুছেন?
সরো, সরো! তোমরা কার সাথে কি কও?’ কানা মন্তাজ দৌড়ে এসে সবাইকে সরিয়ে দেয়, মানুষ না চিনা আও করো? হামাগোরে নিজেগোরে মানুষ। কানা মন্তাজ তাকে নিজেদের মানুষ বলে পরিচিত করায় আনোয়ার অভিভূত হয়ে তার পিঠে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে দেয়, চেংটু কোথায়? করমালি কোথায়?
চেন্টু একটা খাচা নিয়া গেছে চন্দনদহ বাজার। খাচার মদে আফসার গাজীকে ধরা আনবো। অনেক মানুষ গেলো, চেংটু কয়, হামি না থাকলে শালাক বক্তাই ককবর দিবো। করমালি সম্বন্ধে খবর দেওয়ার আগেই ওরা এসে পড়ে করমালির সামনে। করমালি বসেছিলো কাঁঠালতলায়, মাটির সঙ্গে বাঁশের খুঁটি দিয়ে গাথা কাঠের বেঞ্চ, বেঞ্চের ঠিক পাশে, খুঁটির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে। তার বা পা ভাঁজ করা, ডান পা মাটিতে ছড়ানো। ডান পায়ের লুঙিউরু পর্যন্ত গোটানো। ঐ পায়ে হাঁটু পর্যন্ত বড়ো বড়ো ৩/৪ টে ফোস্কা, কয়েকটা জায়গায় ফোস্কা ফেটে লাল দগদগে ঘা।
এ কি? করমালি পা পুড়ে গেছে? ‘পুড়া গেলো ভাইজান। বড়ো বড়ো দাঁতে করমালি হাসতে চেষ্টা করলেও লাল লাল চোখ ও দাত-চাপা ঠোঁটের বেড়িয়ে-পড়া অংশে তার কষ্ট আড়াল করতে পারে না। বান্দু শেখ বলে, হোসেন ফকির ধাক্কা দিয়া আগুনের মদ্যে ফালায়া দিছিলো।
হামিও ছাড়ি নাই। করমালি হাত দিয়ে তার পাদ্যাখায়, এই পাওদিয়াই শালাক লাথি দিয়া আগুনের মদ্যে ফালায়া দিছি। তারপরে সোগলি মিল্যা বাশ দিয়া কোবান দিতে দিতে শালার জান কবচ করা হলো।
করমালির গোঙানি চলতে থাকে, কয়েকজন চিৎকার করে, কৈ? ঐ খানদানি শয়তান কোটে? শালা কোটে সটকালো?
আপনারা কয়েকজন আমার সঙ্গে আসেন। আনোয়ার এদিক ওদিন তাকিয়ে কানা মন্তাজকে ডাকে, মন্তাঞ্জ এসো, বান্দু চলো। করমালি তুমি বরং বাড়ি যাও, এই পানিয়ে ঘোরাঘুরি করো না। একটু থেমে শক্তি সঞ্চয় করে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সবাইকে নির্দেশ দেয়, চলেন। বেশি চ্যাচাবেন না। খয়বার গাজী আছে জালাল মাস্টার সায়েবের বাড়ি।
করমালি চমকে ওঠে, মাস্টার সায়েবের বাড়ি? মনে হচ্ছে তার জ্যাঠার মৃতদেহ দেখতে না পারার বেদনা বা তার পায়ের আঙুল থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুড়ে যাওয়ার কষ্ট মান হয়ে গেছে, ‘না ভাইজান, তার বাড়িতে যাওয়া যাবো না।’
সমবেত মানুষ গর্জন করে, কিসক? করমালি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আনোয়ার বলে, কেন?
না, তাই মানুষটা বড়ো সিধা গো বিপদে আপদে হামাগোরে সাথে সাথে থাকে। তার বাড়িতে যায়া হামলা করাটা—।
জালাল মাস্টার সায়েব কেমন লোক সেটা আমাদের দাখার কথা নয়। তার বাড়িতে এক শয়তানকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন, সুতরাং—।’ আনোয়ারের এই কথা ছাপিয়ে ওঠে একটি ভাঙা গলার বাক্য, আমরা তো তার কোনো লোকসান করতিছি না। খয়বার মিয়াক নিয়া আমরা চলা আসমু। না কি কন আনোয়ার ভাই?
আলিবক্সকে সামনে রেখে এসে কথা বলতে দেখে আনোয়ারের বুকে ছোটো ১টি কাটা বাধে, এখন বোঝা যাচ্ছে যে এই লোকটির জন্যই এতোগুলো মানুষ সংগঠিতভাবে ঘোরফেরা করছে, হঠাৎ খেপে গিয়ে আনোয়ারদের বাড়ির ভেতর হামলা করেনি। এখন আনোয়ারের বিশেষ কি আর করার রইলো? তবে সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা হাল্কা হয়, আলিবক্স থাকলে ঝামেলা অনেক এড়ানো যায়।