• আমাদের সম্পর্কে
  • যোগাযোগ
  • গোপনীয়তা নীতি
মঙ্গলবার, জুন 10, 2025
  • Login
BnBoi.Com
  • বাংলাদেশী লেখক
    • অতুলচন্দ্র গুপ্ত
    • অভিজিৎ রায়
    • আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
    • আনিসুল হক
    • আবু ইসহাক
    • আবু রুশদ
    • আবুল আসাদ
    • আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
    • আবুল বাশার
    • আরজ আলী মাতুব্বর
    • আল মাহমুদ
    • আসাদ চৌধুরী
    • আহমদ ছফা
    • আহমদ শরীফ
    • ইমদাদুল হক মিলন
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
    • কাসেম বিন আবুবাকার
    • জসীম উদ্দীন
    • তসলিমা নাসরিন
    • দাউদ হায়দার
    • দীনেশচন্দ্র সেন
    • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
    • নিমাই ভট্টাচার্য
    • প্রফুল্ল রায়
    • প্রমথ চৌধুরী
    • ময়ূখ চৌধুরী
    • মহাদেব সাহা
    • মাহমুদুল হক
    • মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    • হুমায়ূন আহমেদ
  • ইন্ডিয়ান লেখক
    • অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
    • অতুল সুর
    • অদ্রীশ বর্ধন
    • অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • অনীশ দেব
    • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • অমিয়ভূষণ মজুমদার
    • আশাপূর্ণা দেবী
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
    • কাজী নজরুল ইসলাম
    • ক্ষিতিমোহন সেন
    • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    • তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
    • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
    • নারায়ণ সান্যাল
    • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    • নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    • পাঁচকড়ি দে
    • পূর্ণেন্দু পত্রী
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • বিমল মিত্র
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়
  • বিভাগসমূহ
    • আত্মজীবনী
    • ইতিহাস
    • উপন্যাস
    • কবিতা
    • কল্পকাহিনী
    • কাব্যগ্রন্থ
    • খেলাধুলার বই
    • গল্পের বই
    • গোয়েন্দা কাহিনী
    • ছোট গল্প
    • জীবনী
    • দর্শন
    • ধর্মীয় বই
    • নাটকের বই
    • প্রবন্ধ
    • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
    • বৈজ্ঞানিক বই
    • ভূতের গল্প
    • মুক্তিযুদ্ধের-বই
    • রহস্যময় গল্পের বই
    • রোমাঞ্চকর গল্প
    • রোম্যান্টিক গল্পের বই
    • শিক্ষামূলক বই
    • সমগ্র
  • সিরিজ বই
    • মিসির আলী সমগ্র
    • হিমু সিরিজ
No Result
View All Result
  • বাংলাদেশী লেখক
    • অতুলচন্দ্র গুপ্ত
    • অভিজিৎ রায়
    • আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
    • আনিসুল হক
    • আবু ইসহাক
    • আবু রুশদ
    • আবুল আসাদ
    • আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
    • আবুল বাশার
    • আরজ আলী মাতুব্বর
    • আল মাহমুদ
    • আসাদ চৌধুরী
    • আহমদ ছফা
    • আহমদ শরীফ
    • ইমদাদুল হক মিলন
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
    • কাসেম বিন আবুবাকার
    • জসীম উদ্দীন
    • তসলিমা নাসরিন
    • দাউদ হায়দার
    • দীনেশচন্দ্র সেন
    • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
    • নিমাই ভট্টাচার্য
    • প্রফুল্ল রায়
    • প্রমথ চৌধুরী
    • ময়ূখ চৌধুরী
    • মহাদেব সাহা
    • মাহমুদুল হক
    • মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    • হুমায়ূন আহমেদ
  • ইন্ডিয়ান লেখক
    • অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
    • অতুল সুর
    • অদ্রীশ বর্ধন
    • অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • অনীশ দেব
    • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • অমিয়ভূষণ মজুমদার
    • আশাপূর্ণা দেবী
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
    • কাজী নজরুল ইসলাম
    • ক্ষিতিমোহন সেন
    • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    • তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
    • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
    • নারায়ণ সান্যাল
    • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    • নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    • পাঁচকড়ি দে
    • পূর্ণেন্দু পত্রী
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • বিমল মিত্র
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়
  • বিভাগসমূহ
    • আত্মজীবনী
    • ইতিহাস
    • উপন্যাস
    • কবিতা
    • কল্পকাহিনী
    • কাব্যগ্রন্থ
    • খেলাধুলার বই
    • গল্পের বই
    • গোয়েন্দা কাহিনী
    • ছোট গল্প
    • জীবনী
    • দর্শন
    • ধর্মীয় বই
    • নাটকের বই
    • প্রবন্ধ
    • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
    • বৈজ্ঞানিক বই
    • ভূতের গল্প
    • মুক্তিযুদ্ধের-বই
    • রহস্যময় গল্পের বই
    • রোমাঞ্চকর গল্প
    • রোম্যান্টিক গল্পের বই
    • শিক্ষামূলক বই
    • সমগ্র
  • সিরিজ বই
    • মিসির আলী সমগ্র
    • হিমু সিরিজ
No Result
View All Result
BnBoi.Com
No Result
View All Result

চিলেকোঠার সেপাই (উপন্যাস) – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

Chilekothar Sepai by Akhteruzzaman Elias

রাত্রি ১০টায় মনে হচ্ছে গভীর রাত্রি। জালাল মাস্টারের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি যেতে ছোটোখাটো একটা গ্রাম পেরোতে হয়। এই গোটা গ্রাম জুড়ে ওদের আত্মীয়স্বজন, ওদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি। বাড়িঘর সব হাতের ডানদিকে। বেশির ভাগই টিনের ঘর, মাঝে মাঝে একতলা দালান। কারো কারো বৈঠকখানায় খড়ের পুরু ছাউনি। তারার খুব আবছা আলোয় রাস্তা কোথাও চওড়া হয়ে যায়, কোথাও গাছপালার ছায়া পড়ায় সঙ্কীর্ণ হতে হতে পরিণত হয়েছে সরু রেখায়। মাঝে মাঝে কারো বাশঝাড়ের কয়েকটা বাঁশ নুয়ে পড়ায় একেকটা তোরণের মতো হয়েছে। বাঁদিকের জমির কোথাও কোথাও ধান কাটা হয়ে গেছে, সেখানে কেবল কুয়াশা। কোনো কোনো জমিতে মরিচ গাছ। ডানদিকের উঠানগুলোতে লাল মরিচ বিছানো, টিনের ছাদে ছাদে পাকা মরিচের লাল রঙ, লাল রঙের বিছানা। অন্ধকারেও লাল রঙ একটু আলাদা। অন্ধকারের কালো রঙ ও মরিচের লাল রঙ ছাপিয়ে ওঠে ভয়াবহ নীরবতা, এই গ্রামে কি ঝিঝি পোকাও ডাকে না? চেংটু হেঁটে যাচ্ছে সামনে, গায়ে তার টুটাফাটা কাঁথা, এই কথার নিচে একটুও না কেঁপে কি করে যে শীত ঠেকায় সে-ই জানে। এই সব কাথায় দুর্গন্ধের আর শেষ থাকে না। নিজের নাকটাকে আনোয়ার এখন পর্যন্ত ঠিক আয়ত্তে আনতে পারেনি, ইচ্ছা করেই তাই সে একটু তফাতে হাঁটে। কোনো কোনো বাড়ির উঠান থেকে নতুন সেদ্ধ-করা ধানের গন্ধ পাকা মরিচ বা অন্য কেনো কিছুর গন্ধের সঙ্গে মিশে এদিক ওদিক ভাসে। এই শীত, এই বিচিত্র গন্ধ, এই আবছা আলো—সব কিছুই নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা যেতো। কিন্তু চেংটুর সাঙ্ঘাতিক নীরবতাকে জেদ বলে মনে হওয়ায় আনোয়ারের সারা শরীরে তেতো স্বাদ। তার রাগ হয়। চেংটুক এই জেদ কি শোষিত মানুষের ডিফেন্স? আনোয়ারকে সে তার প্রতিপক্ষের লোক ভাবে নাকি? কেন? আদর্শ কিংবা রাজনীতি যদি ছেড়েও দেওয়া যায়,–সবাই শেষ পর্যন্ত এসব বহন করতে পারে না,-কিন্তু আনোয়ারের রুচির ওপর তো তার আস্থা থাকা উচিত। খয়বার গাজীর মতো আনোয়ার কি কখনো কোনো নিঃস্ব মানুষকে সর্বস্বাস্ত করার ফন্দি আঁটতে পারে? মিয়াবাড়ির ছেলে বলে সে কি চেংটুর কাছে সন্দেহজনক চরিত্র? তাহলে মাস্টার? জালাল মাস্টারের কাছে আশ্রয় চাইতে চেষ্ট্রর ভয় হয় না। জালালউদ্দিন কি খয়বার গাজীর ইজ্জতের বাহার ঠিক রাখার জন্য উদগীব নয়? চরম সঙ্কটের সময় সে কি চেন্টুর পক্ষে থাকবে? তবে? রাজনৈতিক শিক্ষা নাই বলে চাষা ও দিনমজুর মানুষ চিনতে ভুল করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আনোয়ারের ক্ষোভ দূর করতে পারে না। ক্ষুব্ধ শরীরে হাটতে হাটতে সে শোনে, কেটা যায়?
ডানদিকে জুম্মার ঘরের পাকা দালান। দালানের উঁচু বারান্দায় বসে-থাকা ১টি মানুষের অস্পষ্ট কাঠামো। কয়েক পলক পর বোঝা যায় লোকটি অজু করছে। বদন হাতে রেখে লোকটি ফের জিগ্যেস করে, কেটা যায় গো! চেংটু জবাব দেয়, হামরা হুজুর।’
হামরা কারা? লোকটির মোটা স্বর একটু সন্দেহপ্রবণও বটে, নাদুর ব্যাটা না? কোটে যাস? চেংটু থামে না, এমনকি তার পদক্ষেপও ধীরগতি হয় না।
বদনা হাতে লোকটি জানতে চায়, সাথে কেটা রে? দাঁড়িয়ে আনোয়ার জবাব দেয়, জী, আমার নাম আনোয়ার।’ চেংটু চাপা গলায় বলে, পাও চালান ভাইজান। চেচিয়ে আনোয়ারের পরিচয় দেয়, বড়োমিয়ার নাতি।’
লোকটি শব্দ করে কুলকুচো করে। এর মধ্যে ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। হাটতে হাটতে আনোয়ার বলে, কে চেংটু? ‘কারী সায়েব। ‘কে? ‘কারী সায়েব। জুম্মাঘরেত থাকে। কোরান শরীফ পড়ে। এক বছরের উপরে মোয়াজ্জিন গেছে বাড়িত, কারী সায়েব আজানও দেয়। কয়েক পা হেঁটে চেন্টু বলে, এমনি মানুষ ভালো। কিন্তু দোষের মধ্যে ঐ একটাই।’ বলতে বলতে সে হাসে, ‘খালি কথা কয়। হয় কোরান শরীফ পড়বো, না হলে কথা কবো। মুখ বন্ধ হয় না। একবার টাডনেত যাবো, কথা কতে কতে মটর চল্যা গেছে, দিশা পায় নাই। বাকসো সামান আছিলো মটরের মদ্যে, আর পায় নাই। চেংটু বেশ জোরে হাসে, আনোয়ারও হাসে। একটু বেশিই হাসে।
সেই হাসিটা ঠোঁটে সেঁটে রেখে বা দিকে তাকালে দ্যাখা যায় বেশ বড়ো একটা মজা পুকুর। পুকুরটা আনোয়ার ভালো করে চেনে, এর নাম বৈরাগীর দিঘি। বৈরাগীর দিঘির পর বিঘা তিনেক চাষের জমি, তারপর অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে এই জমি যেন হঠাৎ করে ফেঁপে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। না। ভুলটা আনোয়ারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভাঙে। অন্ধকার রাত্রে বৈরাগীর ভিটার বটগাছের অদ্ভুত জবুথবু চেহারা হয়েছে! দিনের বেলা এই গাছের কি গম্ভীর মূর্তি। চারদিকে ছড়ানো শিকড়বাকড়ের মধ্যে তার বিস্তৃত ও বর্ধমান রূপ দেখে সবাই মোহিত ও ভীত হয়ে পড়ে। পুরো সাড়ে তিন বিঘা জমি গ্রাস করার পরও তার থামবার লক্ষণ নাই, সে কেবল বেড়েই চলেছে। আরো তিন বিঘা জমি পেরিয়ে এই দিঘি পর্যন্ত পৌঁছলে হয়তো তার সম্প্রসারণের পিপাসা মিটবে। জমাট-বাধা অন্ধকার আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লে আনোয়ারের চোখে বটগাছের চেহারা নির্দিষ্ট আকার পায়। সমস্ত শরীরটাকে গুটিয়ে ফেলে বটগাছ যেন ঘুমাচ্ছে। নিশ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা তার শরীরে স্পষ্ট। প্রাচীন বটবৃক্ষের এই বিশ্রামের দৃশ্যে অভিভূত আনোয়ার একটু পিছিয়ে পড়েছিলো। চেন্টু বলে, পাও চালান। পা চালিয়ে চেন্টুর পাশে এসে পড়লে সে জিগ্যেস করে, আপনে ঢাকাত যাবেন কোন দিন?
ঠিক নাই। কয়েকদিন থাকবো, বেশ কয়েকদিন। কেন? না, এমনি!’ কিছুক্ষণ পর চেংটু ফের জানতে চায়, জালাল মিয়া কয় আপনে বলে সংগ্রামের একজন নেতা? ইস্কুল কলেজের চ্যাংড়া প্যাংড়া আপনাক খুব মানে, না? মিছিল বার করলেই তো পুলিশ গুলি করে। ছাত্রগোরে ভয়ডর নাই, না?
এই চাষা ছেলেটির কাছে তাকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে জালাল মাস্টারের ওপর তার রাগ হয়। জালাল মাস্টার হয়তো তাকে ভালোই বাসে। জালাল মাস্টার আবার খয়বার গাজীর জন্যে তাকে ব্যবহার করছে না তো? আসল কথাটা বলা দরকার। কিন্তু কি করে বলবে? সে জবাব দেয়, রাজনীতি তো করিই। কিন্তু নেতাগোছের কেউ নই। নেতা হওয়ার জন্য আমরা রাজনীতি করি না।’
তাহলে? কিসের জন্যে করেন? চেংটুর এই প্রশ্নে কোনো শ্লেষ নাই, তার কথার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় যে, নেতৃত্ব অর্জন ছাড়া রাজনীতিতে তৎপর লোকজনের আর কি লক্ষ্য থাকতে পারে সে জানে না। এই লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করার মধ্যে চেংটু দোষেরও কিছু দেখতে পায় না।
আনোয়ার বলে, রাজনীতি ছাড়া মানুষ ভালোভাবে বাচতে পারে না। রাজনীতি ছাড়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ, মানে একতাবদ্ধ, মানে একজোট হবে কি করে? কিসের জোরে? একজোট না হলে ধরে খয়বার গাজীর মতো লোকদের তোমরা ঠেকাতে পারবে?—খুব চেষ্টা করেও কথাগুলো এর চেয়ে সহজ করে বলা গেলো না। আর কিভাবে কথাটা পরিষ্কার করা যায় আনোয়ার তাই ভাবে। কিন্তু তার কথার মাঝখানে চেংটু বলে, ‘আলিবক্স ভাই কয়, আর বেশিদিন লাগবো না। হামাগোরে গাওত হামরা বিচার বসামু!
‘আলিবক্স?
‘চেনেন না, না? সিন্দুরিয়া চরের। শঙ্করপুর চেনেন তো? শঙ্করপুর ভাঙলে পরে পুবে সিন্দুরিয়া চরে উঠছে। মাদারগঞ্জ কলেজত পড়ে। সিন্দুরিয়াত আদালত বসছিলো, মেলা কিষানপাট জড়ো করা ডাকাত-মারা চরত গেছিলো। যাগোরে গোরু চুরি হছিলো, সোগলিক নিয়া গেছিলো, সোগলি ঠিক করছিলো খয়বার গাজীর বাগান থাকা গোরু নিয়া গোরুর মালিকগোরে ফেরত দিবো।’
পারেনি?’
না। খয়বার গাজীর মানুষ মেলা, হাতিয়ারও মেলা। আলিবক্স ভাই কুলাবার পারে নাই, নাও নিয়া আবার সর্যা গেছে। তবে চেংটু এতে হতাশ নয়। কয়বার ঠেকাবো কন? এই শালা খয়বার গাজী মানষের পয়দা না। কতো গরিব মানুষের উজিওজগার তাই বন্ধ করা দিছে! গোরু হারালে চাষামানুষ কাম করবার পারে? হামরা আর বিচার করমু। অর ভাইয়ের ব্যাটা আফসার গাজী, মিয়াবাড়ির অশিদুল, ফকিরবাড়ির ফরিদ,-সোগলির বিচার হবো। আফসার শালা আছে খালি মাগীমানষের পাছত, চাষাভূষার ঘরত এ্যাঁন সুন্দর মাগীমানুষ দেখলে তাই খালি ফাল পড়ে। আর শালা অশিদুল করে কি জানেন?—এক জমিত কাকো তাই দুই তিনবারের বেশি বর্গ করবার দিবো না। শালা এক জমি পাঁচজনের কাছে বর্গ দেয়, বর্গাদাররা কাইজা করে অশিদ মিয়া মজা মারে। তাই—। চেংটু হঠাৎ থেমে যায়। তার কি মনে পড়ে গেছে যে, রশিদুল হক লোকটি আনোয়ারের বাপের চাচাতো ভাইও বটে? আরে বাবা, তাতে আনোয়ারের কি? রশীদ মিয়া পুরা টাউট, ঢাকায় গিয়ে আনোয়ারের মাকে পটিয়ে ১০০টা টাকা বাগিয়ে এনেছিলো, সেই ব্যথা আম্মা এখন পর্যন্ত তুলতে পারেনি।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, কারা বিচার করবে?
হামরাই। হামি আলিবক্স ভাইয়েক কছি, বৈরাগীর ভিটার বটগাছের তলাত আদালত বসবো, বিচার হবো ওটি!
আনোয়ার উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে, সত্যি?
হামি মিছা কথা কইনা ভাইজান চেংটুর গলায় তলানি পড়ে। সে ফের চুপ করে যায়। আনোয়ারকে সে ঠিক বুঝতে পারে না কেন? নিজেকে ঠিকমতো প্রকাশ করার জন্যে আনোয়ার ছটফট করে, নানাভাবে সে শব্দ খোজে, বাক্য ঠিক করে, কিন্তু কিছুঁতেই সম্পূর্ণ তৈরী হতে পারে না। এইরকম ভাবতে ভাবতে একবার বলে, বিচার করাই দরকার। আমাদের দলের ছেলেরা, এইতো কাছেই, সিরাজগঞ্জ মহকুমা চেনো?-সিরাজগঞ্জের গ্রামে গণআদালত করেছে। কিন্তু এখানে তো আবার ভদ্রলোক, মানে জোতদার, মানে অবস্থাপন্ন লোক বেশি, এখানে গণআদালত করা কি সুবিধা হবে?
না, এটি বড়োলোক বেশি কৈ? এই কয়টা ঘরই আপনার চোখত পড়ছে? মাঠের ঐপারে তো সোগলি হামাগোরে চাষাভূষার গাও। ঐ যে বটগাছের ঐপারে জমি– ‘ বটগাছের মাথার দিকে তাকিয়ে চেংটু হঠাৎ নীরব হয় এবং থমকে দাঁড়ায়। আনোয়ার জিগ্যেস করে, কি হলো?
চুপ করেন!
চারদিকে ভয়াবহ নীরবতা। চেংটুর চোখ বটগাছের মাথার ওপর। সুতরাং সেদিকেই না তাকিয়ে আনোয়ারের উপায় নাই। সেখানে কি? কুয়াশা টাঙানো বটগাছ যেন সমস্ত প্রান্তর জুড়ে রাজত্ব করে। তার চোখের পলক পড়ে না। বটগাছের ঝাঁকড়া মাথায় চেংটু কি দেখছে? টিনের কি খড়ের চাল ও উঠান থেকে পাকা মরিচের গন্ধ আসছিলো, সুযোগ পেয়ে তাও শালা উধাও। সেদ্ধ-করা ধানের সুবাসও কি হাওয়া হয়ে গেলো? কান দুটোও মনে হয় বটগাছ দ্যাখার কজে নিয়োজিত। এখন যাবতীয় আওয়াজ লুপ্ত। গাছ থেকে শিশিরবিন্দু পড়ার মৃদু, অতিমৃদু ধ্বনিটুকুও লুফে নেয় শীতের শুকনা মাটি। আনোয়ারের বুকে টিপটপ আওয়াজ হয়, তাও তার সমস্ত বোধের বাইরেই থাকে। এইভাবে কতোক্ষণ কেটে গেছে আনোয়ার জানে না। হঠাৎ শুনলো, চলেন।
কোনো কথা না বলে দুজনে চলতে শুরু করলে চেন্টু বলে, উড়া গেলো, দেখলেন? কি?
দেখলেন না? ঐ পুবকোণের মগডাল থাকা একটা উড়াল দিলো, সোজা উত্তরের মুখে গেলো, দেখলেন না?
কি গেলো? কি?’
চেন্টু চুপ করে থাকে, আনোয়ার অস্থির হয়ে ওঠে, কি?
আত্রে নাম নেওয়া হয় না, আত্রে তেনাগোরে নাম নেওয়া মানা।
আনোয়ারের সারা গা ছমছম করে উঠলো। চেংটুর পিঠে ডান হাত রেখে তার কাঁথা খামচে ধরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, ‘জীন?
চেন্টু বলে, কল্যাম না? আতোত নাম নেওয়া হয় না। হাটতে হাঁটতে আনোয়ারের মুখের দিকে তাকায়, ভয় পালেন?
না? আনোয়ার একটু হাসার চেষ্টা করলে তার মুখের অসহায়ত্ব আরো প্রকট হয়, তবে অন্ধকারে তাও অদৃশ্যই থাকে। কিন্তু তার পিঠের ওপর আনোয়ারের হাত চেষ্ট্রকে সব বুঝিয়ে দেয়। চেংটু নরম করে বলে, ভয় করেন কিসক? কিছু কবে না। এটিকার পুরানা বাসেন্দা। কাকো কিছু কয় না।
শুকনা কাটা-কাটা টোক গিলে আনোয়ার বলে, থাকলে তো বলবো’ অশরীরী জীবের অস্তিত্বের প্রতি আনোয়ারের এই অবিশ্বাস ঘোষণা এতো ক্ষীণ যে, প্রায় শোনাই যায় না। অথবা শুনতে পারলেও চেন্টু পাত্তা দেয় না। খুব স্বাভাবিক গলায় সে বলে, অনেকদিনের বাসেন্দা। মুরুব্বিরা কয়, তার সবই ভালো, যতো কিছুই হোক এটিই থাকে। নড়ে না। খালি বিবাদ দেখলে তার গাও জ্বলে। বিবাদ তাই সহ্য করবার পারে না।
বিবাদ ?
ছু বিবাদ! গায়ের মদ্যে গোলমাল কি ঝগড়া-কাজিয়া, বিবাদ-বিসম্বাদ, লাঠালাঠি, মারামারির দিশা পালে উত্তরের মুখে তাই উড়াল দেয়!
উত্তরে?
ছু ছোটো থাকতে দাদার কাছে শুনছি চান্দের পয়লা সাত দিনের মধ্যে বৈরাগীর ভিটার বটৰিরিক্ষের এই পুরানা বাসেন্দা উত্তরের মুখে উড়াল দিলে গায়ের মানুষ ভয়ে সিটকা নাগছে, বড়োলোকরা মিলাদ দিছে, শিরনি দিছে, মানত করছে। জুম্বার ঘরত নফল নামাজ পড়ছে।
এবার হবে না?
আপনাগোরে বাড়িত একবার ডাকাত পড়ছিলো, আপনার দাদার আমলে। হুনছি তার সাতদিন আগে পুরানা বাসেন্দা এই জায়গা ছাড়া চলা গেছিলো।’
‘তো এবার মিলাদ দেবে না? নফল নামাজ পড়বে না? আনোয়ার বেশ সহজ হয়ে আসছে, তার কথায় ভয়ের জায়গায় ঠাট্টার একটুখানি ঝাপ্টা লক্ষ করা যায়, মিলাদ না দিলে আবার ঝগড়া বিবাদ লাগতে পারে না?
চেংটু বলে, কেউ দেখলে তো দেখছে কেটা? আপনেও তো দেখলেন না?
তুমি দেখেছে। তুমি বললেই সবাই জানবে। কাল তুমি সবাইকে বলবে না? চেন্টু হটতে হাটতে বলে, হামার গরজ? চেষ্ট্র ফের চুপ করে থাকে। ১টা ২টো ৩টে ৪টে ৫টা ৬টা ৭টা ৮টা কদম ফেলা হয়, ছেলেটা আর কথাই বলে না। এদিকে মানুষের কথা ছাড়া আনোয়ারের গতি নাই, ওপরে তাকাতে সে ইতস্তত করে: কি জানি মাথার ওপর বিশাল শূন্যতায় কেউ হয়তো দীর্ঘ অগ্নিময় উড়াল দিচ্ছে। সেই উড়ালের হিসহিস ধ্বনি না শোনার জন্যে কানজোড়া তার বন্ধ রাখা দরকার। চেন্টুটা দিব্যি সামনে সামনে হেঁটে চলেছে, এর পরেও তার পাটলে না। চেন্টুর কথায় যা হয়নি, ওর নীরবতায় বটগাছের অশরীর জীব প্রতি মুহুর্তে আকৃতি পাওয়ার পায়তার করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অদৃশ্য বলে সেগুলোকে হাত পা মুণ্ডু বলে সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু চেন্টুর এই নীরবতা অব্যাহত থাকলে আনোয়ারের সামনে সশরীরে আসতে জীনের আর কতোক্ষণ আনোয়ারের রাগ হয়, অশিক্ষিত মূৰ্খ ছোকরা কুসংস্কারের ডিপো। কিন্তু বিভ্রম দ্যাখার জন্যে চেংটুর ওপর এই রাগ তেমন জমে না। বরং প্রতিটি নীরব পদক্ষেপে তার নিজেরই জীন দ্যাখার সম্ভাবনা বেড়ে চলে। তখন চেংটুর দ্যাখা এই বিভ্রম থেকে রেহাই পাবার জন্য শ্লেষখচিত কণ্ঠে আনোয়ার বলে, ‘জীন উড়াল দিলো, সবাইকে খবর দিতে হবে না? ঝগড়া বিবাদ হলে সকলেরই বিপদ।
কিসক? চেংটুর কথায় পাল্টা ক্রোধ। ঠাট্টাবিদ্রুপ বোঝা এই ইডিয়টটার সাধ্যের বাইরে। ঠাট্টার জবাবে রাগ না করে করবেটা কি? সে বলে, ‘সোগলির বিপদ হবো কিসক? হামাগোরে আবার বিপদ কি? হামাগোরে জমি নাই, জিরাত নাই, ঘর নাই, ভিটা নাই, ধান নাই মরিচ নাই,-বিপদ বিসস্বাদ হলে হামাগোরে নোকসান কি?
জীনের উড়াল দেওয়ায় বিভ্রমটার ওপর কতো আস্থা থাকার ফলে ছোকরা পরম বিশ্বাসের সঙ্গে এরকম ভবিষ্যৎ বাণী ছাড়ে। আনোয়ারের পক্ষে এখন এমনকি সামনে তাকানো পর্যন্ত মুশকিল। উত্তর কোনদিকে দিক জানা থাকলে চোখে সামলানো সহজ হতো। এখন মনে হয় শালা সবদিকই উত্তর! সবদিকেই বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দার দীর্ঘ উড়াল। প্রায় জোর করে আনোয়ার বলে, দ্যাখে চেন্টু জীন টিন কোনো কথা নয়। কিছু করতে হলে নিজেদেরই করতে হয়। জীন কি সাহায্য করতে পারে? খুব জোর দিয়ে বললেও ওপরদিকে তাকাবার মতো বল আনোয়ার পায় না।
চেন্টু বলে, সাহায্য করবো কিসক? আগুনের জানতো, তাই সোম্বাদ পায় আগে। ২জনে ফের চুপচাপ হাঁটে। আপনে? হঠাৎ চেংটুর গলা শুনে চমকে উঠে আনোয়ার চোখ বন্ধ করে, এক পলকের জন্য মনে হয়, উড়াল-দেওয়া জীন কি ডাঙায় এসে নামলো? তবে মুহুর্তের মধ্যে কাঁঠালতলায় গায়ে শাল জড়ানো এবং মাথা ও কানে মাঙ্কি ক্যাপ পরা বড়োচাচাকে চিনতে পেরে আনোয়ার বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ে। এবার সে মহা ডাটে তাকায় ওপরের দিকে। ওপরে কাঁঠালগাছের ঝাঁকড়া মাথা। আর কি? কুয়াশার মসলিন মোড়ানো তারা বসানো আকাশ। শীতের রাত্রে গ্রামের আকাশ বড়ো মোলায়েম।
বড়োচাচা বলে, এতো রাত করলি?
এই শীতের রাত্রে বড়োচাচা একা দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রতীক্ষা করছে। বড়োচাচা কাউকে ডেকে বলে, তুই এখন যা। রাত হছে।’
আবার কে? ভাঙা দালানের স্তুপের আড়ালে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে? ১টা হাফ-হাতা জামার ওপর হাতজোড়া বুকে আড়াআড়িভাবে রেখে লোকটা শীত ঠেকাবার চেষ্টা করছে। বড়োচাচার লম্বা চওড়া কাঠামোটার পেছনে যেতে যেতে এবং ইচ্ছামতো উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম-আকাশের সবদিক দেখতে দেখতে আনোয়ার শোনে যে, লোকটা চেংটুকে বলছে, তুই আসছস? মাস্টারের বাড়িতে তোক রাখা হলো কিসক? তোর বুকের বল বেশি বাড়ছে, না? এই সব বাক্যের আওয়াজ চাপা, কিন্তু স্বর বেশ ভারি। এ তো নাদু পরামাণিক নাদু এতোক্ষণ ধরে পাহারা দিচ্ছিলো বড়োচাচাকে। আর তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এলো নাদুর ছেলে। চেংটুর কাছ থেকে ভালো করে বিদায় করে বিদায় নেওয়া দরকার। পেছনে তাকালে চোখে পড়ে যে, বাপ ব্যাটা ২জনে ২দিকে চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চেংটু জোড়াপুকুর পার হয়ে গেলো। আবছা আলোয় মনে হয় চেংটু যেন পায়ে পাল খাটিয়ে নিয়েছে। না, তার ছায়া পর্যন্ত এখন দ্যাখা যাচ্ছে না।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৭

দুপুরবেলা ভাত খেয়ে আনোয়ার আবিষ্কার করলে যে, সিগ্রেটের স্টক প্রায় শেষ। সিগ্রেটের কথা বলতে মন্টু প্রস্তাব করে, আজ বিকালে চন্দনদহ চলেন।
সিগ্রেট কিনতে দুমাইল যাবো? জালাল ফুপার বাড়ির সঙ্গে ছোটো দোকানটা থেকে নিয়ে আয় না!
দূর ওখানে তিন মাসের বাসি সিগারেট। চন্দনদহ বাজারে আজ যাত্রা আছে। যাত্রা দেখবেন? আব্বাকে বলেন, আপনি গেলে আমাকেও যেতে দেবে।
সিরাজগঞ্জের নামকরা অপেরা পার্টি। চন্দনদহের নতুন কলেজের ফান্ড তৈরির জন্য সিরাজদ্দৌলা পালার আয়োজন। ঐ অপেরা পার্টির আরো ভালো ভালো পালা আছে, কিন্তু কলেজের সাহায্যে টাকা তোলা হচ্ছে, যে সে বই হলে চলে না। স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল করে যাত্রা, চারদিকে বাশের বেড়া। সামিয়ানার নিচে চাটাই পেতে খড় বিছানো রয়েছে, মঞ্চের সামনে তিন সারি চেয়ার। আনোয়ারকে খাতির করে সামনে বসতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু বিনয় করে সে বসেছে দ্বিতীয় সারিতে। ওর পাশের চেয়ারে মন্টু। কয়েক মিনিট পর আফসার গাজী টুকতেই সামনের সারির অনেকেই উঠে দাঁড়ালো। আফসার ১টা চেয়ারে বসে পাশের লোকটিকে বলে, ‘প্রিন্সিপ্যাল সায়েব বসেন। তারপর কার কথা শুনে সে তাকালো পেছনে, আনোয়ারকে বলে, ‘আকবর চাচার ব্যাটা না? আরে সামনে এসো, সামনে এসো। বসে বসেই আনোয়ারের হাত ধরে তাকে সামনের সারিতে টেনে আনে, প্রিন্সিপ্যাল চালান হয়ে যায় দ্বিতীয় সারিতে আনোয়ারের চেয়ারে। আনোয়ার ভালো করে আফসারকে দ্যাখে, এই লোকটিকেই চেংটু কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলো! লোকটা খুব মিশুক, আবার এক আধ পাইট টেনেও এসেছে। মঞ্চের চেয়ে আনোয়ারের দিকেই তার মনোযোগ বেশি, তুমি আমার চেয়ে অন্তত দশ বারো বছরের জুনিয়ার তো হবেই। তোমার বড়োভাইও আমার জুনিয়ার।’ বলে সে হাসে। তারপর আনোয়ারের ডান হাতটা নিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দেয় তার কোটের পকেটে, আনোয়ারের হাত ঠেকে একটা বোতলে, পাইটের সাইজের বোতল। আফসার তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, চলবে?
তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলে, কেরুর সিংহ মার্কা এখানে?’ – আনোয়ারের অবাক-হওয়া দেখে সে হাসে, ক্ষতি কি? কে কি বলবে? এখানে না চাইলে বাইরে চলো, বাজারে আমার রাইস মিল। বাসাও আছে।’
আনোয়ার না করলে লোকটা বলে, বুঝছি! বাড়িতে তো আসো না, বাড়ি এসে ক্যারেক্টারটা দ্যাখাতে চাও একেবারে ধোপাবাড়ির ইঞ্জি-করা শার্ট ভালো! ভালো! আমরা ভাই গ্রামেই থাকি, ভালো কও, মন্দ কও, দরবেশ কও, লোফার কও-সব খোলাখুলি, ওপেন টু অল –না কি কোস রে আবুলের বাপ? কিন্তু তার পায়ের সামনে নিচে বসা লোকটি কিছু না বলায় সে ধমক দেয়, ক্যারে শ্যালা, কথা কোস না কিসক? এতেও আবুলের বাপ সাড়া না দিলে সে বলেই চলে, তোমারা আসো দেশ দেখতে, এ্যাঁ? দুদিন থাকবে, চাষা-ভূষাদের উস্কে দিয়ে ঢাকা যাবে, ঢাকায় সব বড়ো বড়ো হোটেল, বার তো আছেই, না কি বলো?
লোকটা একনাগাড়ে কথা বলেই চলে। একটু টিপসি হলেও কথাবার্তা কিন্তু বেসামাল নয়। এদিকে পালা যে কখন শুরু হবে কিছু বোঝা যায় না। স্টেজে ১টি মেয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফায়, তার লিকলিকে পা ২টো চোপ্ত পাজামায় মোড়ানো, মাংসহীন, উরু ও পাছা নিয়ে সে কতোরকম ক্যারদানি মারে, দেখে মেয়েটার জন্যে আনোয়ারের খারাপই লাগে, পায়ের ব্যথায় বেচার রাত্রে ঘুমাতে পারবে কি-না সন্দেহ। রোগ পটকা মেয়েটার বুক বেঢপ রকমের উঁচু, গ্যাটিস-মারা স্তন দুটো সে এমনভাবে এগিয়ে ধরে যে, যে কেউ হাত দিলে তার ভেতরকার কাপড় না হার্ডবোর্ড সব বেরিয়ে পড়তে পারে। স্নো পাউডার ও রুজের পলেস্তারার নিচে তার মুখের বসস্তের দাগ হাজাগের চড়া আলোয় অনেকগুলো কুতকুতে চোখের মতো পিটপিট করে। আফসার গাজীর দিকে চোখ রেখে তার শরীরের ব্যস্ত তৎপরতা পরিচালিত হয়। চোখের ইশারায় আফসার একবার দেখিয়ে দেয় আনোয়ারকে, কি গো সুন্দরী, আমার ভাইটাক চোখত পড়ে না? ভালো করা নাচ ঢাকার নেতামানুষ, একদিন মন্ত্রী হবো, দেখিসা তারপর আনোয়ারের দিকে ঝুঁকে সে বলে, তুমি তো ভাই রাজধানীর মস্তান, বলে তো ভালো মাল পাওয়া যায় কোথায়? বলে তো?-পারলে না?– বাদামতলী বলো, কান্দুপট্টি বলো, কুমারটুলী বলো, গঙ্গাজলী বলো,-নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের কাছে এসব একেবারে নস্যি। আর লাহোর যদি যাও তো এসব মনে হবে চুলার লাকড়ি। লাহোর কলকাতা কিছু বাকি রাখিনি। হীরামন্ডি কও, সোনাগাছি কও-পাকিস্তান হিন্দুস্থান সব চষ্যা বেড়ছি! কথার তোড়ে তার আঞ্চলিক বুলি বেরিয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে, একদিন শুনলাম বাদামতলী উঠে গেছে। আমি বলি, হায় হায় ঢাকা তো অন্ধকার হয়ে গেলো- কিসের কি? এখন গোটা ঢাকা শহর দেখি শালার একখান বেশ্যাপাড়া রাস্তায় মাগীরা সব কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশায় তোলো, জায়গায় নিয়ে কাজ সারো
আনোয়ার ভয় পায় যে, আফসার গাজীর বেশ্যাগমনের বর্ণনা এভাবে অব্যাহত থাকলে যাত্রা দ্যাখার বারোটা বাজবে। যে লোকটি নাম-ভূমিকায় নেমেছে, চলচ্চিত্র অভিনেতা আনোয়ার হোসেন তার আদর্শ। সিরাজদ্দৌলা’ ছবির সংলাপ সে হুবহু মুখস্থ বলে, চোখ বড়ো করে এদিক ওদিক তাকায়। আফসার গাজী কথা বলা বন্ধ করে ঢুলুঢুলু চোখ যতোটা পারে খুলে তার গতিবিধি দাখে। একেকটি দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে রিকেটগ্ৰস্ত মেয়েটি মঞ্চে নামে, লাফায় ও লাফাতে লাফাতে হাপায়। তার কৃত্রিম স্তন ও অকৃত্রিম উরু-পাছ এবং সিরাজদৌলার দেশপ্রেম আফসার গাজীকে ক্রমেই উত্তেজিত করে তোলে। মেয়েটি এলে সে একেকবার হাত পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, তবে মঞ্চ অনেক দূরে, তার ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়। আর নবাব সিরাজদ্দৌলাকে দেখলে সে বুক টান করে বসে। পরাজিত সিরাজদ্দৌলা বন্দি হবার পর তার শক্ররা যখন তাকে কাটার আসনে বসিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে, চেয়ার থেকে আফসার গাজী চিৎকার করে ওঠে, শালারা তোরা হাসিস দ্যাশের স্বাধীনতা যায়, তোরা মজা করিস। গাদারের পয়দা গাদ্দার। বাঙলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিলুপ্তিতে লোকটা ক্ষোভে ছটফট করে। এরপর শক্রদের সামনে নিজের ও দেশের দুর্ভাগ্যে সিরাজদ্দৌলা যখন খুব চটপটে গলায় বিলাপ করছে এবং দর্শকমণ্ডলী চোখের পানির ট্রান্সপারেন্ট পর্দা ভেদ করে তাই দেখছে, অফসার গাজী হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, থামো, থামো বাড়ার এ্যাঁকটো করো আনোয়ার হোসেনের লাকান হলো না। আবার করো।
এদিকে আনোয়ার ভাবে পাবলিক এই উত্তেজিত দর্শককে ধরে মার না দেয়। নবাব সিরাজদ্দৌলার আঠালো সংলাপের মাঝখানে আফসার ফের হুকুম ছাড়ে, কল্যাম না শালা রিপিট করো। কানোত কথা যায় না, না?
বিড়িটা হাত থেকে ফেলে যাত্রার অধিকারী মঞ্চে উঠে বাঙলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতিকে কি নির্দেশ দেয়, নবাব ঐ সংলাপের পুনরাবৃত্তি করে।
আনোয়ার নবাব সিরাজদ্দৌলার কথা একরকম ভুলেই যায়। তার অবিচল দৃষ্টি তার পাশে-বসা আফসার গাজীর দিকে। তার চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে আসছে, মনে হয় নেশা বোধ হয় জমছে। যাত্রার ঐ দৃশ্য শেষ হতে না হতে সে চেচিয়ে ওঠে, অনেকটা হছে। আবার করো। দোবারা এরশাদ। লোকটা বোধ হয় হীরামণ্ডি কি সোনাগাছির কোনো বাইজির আসর রিপিট করছে।
যাত্রার অধিকারী মশাই এবার মঞ্চে না উঠে জোড়হাতে এসে দাঁড়ায় আফসারের সামনে। বলে, ‘হুজুর এক সিন বারবার রিপিট করলে বোঝেন তো পাবলিকে
আফসার গাজী অধিকারীকে ঢালাও নির্দেশ দেয়, পাবলিকের গোয়া মরো এই আদেশ পালনে অধিকারী মশাই তার সম্মতি বা অপারগতা জানাবার আগেই পেছন থেকে চিৎকার শোনা যায়, হামরা পয়সা খরচ করা দেখবার আসছি। একজনের কথাত সব হবো? অডিয়েন্স পেছনে তাকায়, আনোয়ারও ঘাড় ফেরালো। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে লোকটি
তাকে সে চিনতে পারে। কাল দুপরে আনোয়ারদের কাঁঠালতলায় জালাল মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছিলো, এর নাম করমালি, জালাল মাস্টারের জমির বর্গাচাষী। বৈরাগীর ভিটা পার হয়ে কয়েক বিঘা জমি আছে জালাল মাস্টারের, সেই জমির ওপারে তালপোতাগ্রামে এদের বাড়ি। লোকটার দাত অস্বাভাবিক উঁচু বলে একে ১বার দেখলে ভোলা যায় না। তো তার এই চিৎকারের সঙ্গে ৩ সারি চেয়ারের দর্শকদের ভেতর থেকেও তাকে সমর্থন জানানো হয়, যাত্রার মাঝখানে আফসার ভাই কি আরম্ভ করলো? এমনকি গাজীদের কলেজে-পড়া একটি ছেলেও বলে ওঠে, মাতলামি করার আর জায়গা পায়নি, না?
এরপর পেছন থেকে একসঙ্গে এমন হৈ চৈ শুরু হয় যে, কারো কথাই স্পষ্ট বোঝা যায় না। এর মধ্যে ২/১ টি বাক্য বেশ পরিষ্কার, যেমন, মাস্টার, তুমি পয়সা নিছো সোগলির কাছ থাকা আর যাত্রা দ্যাখাবা খালি একজনেকি?
তুমি এক চোখত নুন ব্যাচো এক চোখত তাল ব্যাচো, না? ‘চিয়ারত বস্যা তাই লবাব হছে নাকি? হামরা পয়সা দিয়া ঢুকছি, চিয়ারত বস্যা মাগনা দেখি না।
লবাব সিরাজদ্দৌলার লাতি। শালাক এ্যাঁকটো করবার দিলেই হয় এইসব উক্তির ফলে চেয়ারে উপৰিষ্ট দর্শকরা উসখুস করে এবং হঠাৎ চুপ করে যায়। পেছনের কোলাহল অব্যাহত থাকে। চেয়ারে বসা ১জন দর্শক, আনোয়ারদের এক আত্মীয়, দাঁড়িয়ে ধমক দেয়, করমালি থাম! কি শুরু করলি?
‘দ্যাখেন না ভাইজান খালি ক্যাচাল করবো! ইগল্যান করলে যাত্রা হবো? করমালির অভিযোগ শেষ হতে না হতে আফসার গাজী শক্তি পুনরুদ্ধারে ব্যাপৃত হয়, শালা বেন্ন্যার বাচ্চাগুলাক ঢুকাছে সামিয়ানার তলাত। ট্যাকার গরম দ্যাখাস? এই শালার কলেজের নাম করা যাই যা খুশি করবো?
আনোয়ার মৃদু গলায় বলে, আঃ! আপনি কি শুরু করলেন? আফসার এবার দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে আনোয়ারের দিকে, আরে ভাই, দ্যাথো না। আমার দাদার দান-করা এই জায়গা-এখানে শালারা আমাকে বেইজ্জত করে। আমার দাদার জায়গা আর তোমার দাদার টাকায় এই স্কুলের দালান,—এখানে আমাদের সঙ্গে নিমকহারামি করে !
স্কুলের জায়গাটা গাজীদের দেওয়া, এটা ঠিক। কিন্তু এই স্কুল ভবন নির্মাণে তার নিজের পূর্বপুরুষদের কোনোরকম অবদানের কথা আনোয়ারের জানা নাই। ওর দাদা স্কুলের জন্য টাকা দিলে জালাল মাস্টার অন্তত একদিন না একদিন বলতো। তবে আফসারের এই তথ্য চ্যালেঞ্জ না করে সে বলে, আপনি বরং বাইরে যান। আপনার শরীর ভালো না।
বাইরে যাবো কেন হে? আমার জায়গা ছেড়ে বাইরে যাবে আমি? আফসার গাজীর বাক্যে যাত্রার প্রভাব লক্ষ করা যায়, ‘ছোটোলোকের দাপট সহ্য করবো আমি।
তাহলে চুপচাপ বসেন। এবার আনোয়ারের অসহ্য ঠেকে, দাপট তো দ্যাখ্যাচ্ছেন আপনি সবাই চুপচাপ শুনছিলো, আপনিই তো গোলমাল শুরু করলেন।
আফসার গাজীও ধৈর্য রাখতে পারে না, নেতাগিরি দ্যাখাবার আসছে, না? হৰো না! লাভ হবো না, তোমার মামু আসছিলো ভোট নিবার, ভোট পায় নাই। তোমাকও ভোট দেওয়া হবো না, বুঝল্যা?
‘ভোটের কথা কি হলো? আপনি তো ইতরামো করছেন। হয় চুপচাপ বসেন, নয় বেরিয়ে যান।’ এই সময় চেয়ারের দ্বিতীয় সারি থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানী হামিদ মণ্ডল এসে আফসারকে একরকম জোর করে বসিয়ে দেয়। লোকটি খয়বার গাজীর খাস লোক। তার অনুপস্থিতিতে তার ভাইপোর নিরাপত্তা ও কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রাখাও হামিদের কর্তব্য। আফসার গাজী এবার নেতিয়ে পড়ে। সে বেশ জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে শুরু করে। আনোয়ার বুঝতে পাচ্ছে যে, ওর নেশা কিন্তু একেবারে কেটে গেছে। কিন্তু আপাতত কিছুই করা সম্ভব নয়, তাই মাতলামোর ভাণ করে, কিছুই না বোঝার ভাব করেও খানিকটা উদ্ধার পায়।
যাত্রার প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে করমালি দাঁড়ায় আনোয়ারের পাশে। বলে, ‘চলেন। মন্টু জিগ্যেস করে, তুই বাড়ি যাবি না?
চলেন, আপনাগোরে বাড়ির উপর দিয়া যামু।
আনোয়ার একটু অবাক হয়, বেশ ঘোরা হবে না?
অল্প এ্যাঁনা !
মন্টু বলে, চল যে অকামটা করলি আজ তুই খালি লাফ পাড়িস মন্টু বেশ বিরক্ত। আফসার গাজীকে সে দুইচোক্ষে দেখতে পারে না, এতোক্ষণ ছিলো, ভালো করে কথাও বলেনি। তার অপমানে মন্টু বেশ খুশি। কিন্তু তাই বলে করমালি এভাবে কথা বলবে কেন?
একটু দূরে আবুলের বাপের পাশে দাঁড়িয়ে আফসার গাজী ডাকে, মন্টু শোনা’
এরা একটু দাঁড়ায়। মন্টু ফিরে এলে করমালি জিগ্যেস করে, কি কলো?
কিছু না!
তাই বাড়িতে যাবো না?
না! আজ বাজারে থাকবে।
আনোয়ার বলে, কেন? বাজারে থাকবে কেন?
মন্টু জবাব দেয়, কি জানি? বোধহয় নষ্টামি ফষ্টামি করবে। এইসব মানুষ শয়তানের হাড্‌ডি। এইসব মানুষের সাথে লাগা ভালো না, বুঝলেন? আমাকে বলে কি, আনোয়ার ইচ্ছা করলে আমার সাথে থাকতে পারে। আপনাকে কিসব খাওয়াতে চায়! লোকটার ছোটো বড়ো জ্ঞান নাই!’
করমালি তার বড়ো দাঁতে হাসে, বাড়িত যাবো না ভয়ে! ভয় পাছে, বুঝলেন না? ইন্দুরের জান নিয়া তাই নাফ পড়ে। রাত হছে তো, ঘাটা ধরা যাবো, ভয় করে। হামরা ইগল্যান বুঝি না? হাটতে হাটতে বলে, ’অর কল্লাখান দিয়া কেড়া কি করবো? অরটিংটিঙী কল্লাখানের কানা পয়সা দাম আছে? অর চাচা খয়বার গাজী সন্ধ্যা হতে না হতে বাড়ির মধ্যে সান্ধায়, তামাম আত বাড়িত ডাকাত পড়লেও বারাবার সাহস পায় না। আর উই তো ইন্দুরের বাচ্চাও না।
করমালি কথা বলে একটু বেশি। এটা বরং ভালো। আনোয়ারের এতে সুবিধাই হয়। চেন্টুর মতো হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে আনোয়ারের অকারণ অপরাধবোধটিকে কাটার মতো উস্কে তোলে না। চেংটু চুপ করলেই মনে হয় খুব মনোযোগ দিয়ে সে যেন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে।
সেদিন কাঁঠালতলায় করমালি এসেই আনোয়ারকে দেখিয়ে জালাল মাস্টারকে জিগ্যেস করছিলো, বড়োমিয়ার নাতি, না? চেংটুর মুখোত শুনলাম ঢাকাত থাকা আসছে? তা কতোদিন থাকার নিয়ত করা আসছেন?
জালাল মাস্টার সব প্রশ্নের জবাব বলে, করমালি, আরেকটা হাল দিয়া গম বুন্যা দে। করমালি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, গোরু পাই না সরকার। হামার গোরু তো গেছে– ‘
‘গোরু কি আর নাই? তোর গাওত গোরু কি খালি তোরই আছিলো?
না চাচামিয়া, করমালি ফের হাসে, হামাক কেউ গোরু দিবার চায় না। সোগলি ভয় করে, হামাক গোরু দিলে তার নিজের গোরুখানও চুরি হয়া যাবো।
মানে?-মানে তো করমালির কাছেও দুর্বোধ্য। তার গোরু চুরি হয়েছে, এতে অন্যদের ধারণা যে, গোরুচোরেরা তার ওপর অসন্তুষ্ট। তার প্রায় একঘরে হবার দশা, তার সঙ্গে কথা বলার সময় সবাই এদিক ওদিক দ্যাখে, তার বাপটার সঙ্গে পর্যন্ত ভালো করে কথা বলতে চায় না। এমনকি করমালির প্রতিবেশী, তার জ্যাঠা, বাপের বড়ো ভাই, সে আরো বেশি সাবধান। গোরু চাইলে নানা বাহানা দ্যাখায়। তার কথাবার্তা বড়োলোকদের মতো। কি রকম?-না, আজ গোরু দেওয়া যাবে না। কেন? গোরুকে বেশি খাটানো ঠিক নয়। ১ জোড়া গোরু, ৭/৮ দিন টানা খাটনি পড়লো, ২টো দিন আরাম করুক। আবার করমালির ফুপাতো ভাই না ভাইপো, সে আজ-দেবো কাল-দেবো করছিলো, তার গোরু শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেলো কিসমত সাকিদার।
কিসমত হলো খয়বার গাজীর পুরনো বর্গাদার, সে চাইলে তাকে গোরু না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এখন করমালি গোরু পায় কোথায়? জালাল মাস্টারও ঘাবড়ে যায়, এখন চাষ করবি কি দিয়া? আমার গোরুও তো একটা মরলো, একটা বেচা দিলাম।
করমালি ১টি সমাধান প্রস্তাব করে, এজন্যেই তার এখানে আসা। কি প্রস্তাব? জালাল মাস্টার নিজে একবার তাদের গ্রামে গিয়ে যদি গোরুওয়ালাদের কাউকে বলে তো কাজ হয়। কিন্তু জালাল মাস্টারের সময় কোথায়?—না, সময় একবার করে নিতেই হবে। গোরু নাই বলে করমালিকে বর্গাচাষ থেকে সে যদি খারিজ করে তো বেচারা একেবারে পথে বসবে।
এটা কয়েকদিন আগের কথা। এখন যাত্রা দেখে ফেরার পথে করমালি এক মুহুর্তের জন্য কথা থামায় না। প্রথমে কথা চললো সিরাজদ্দৌলা নিয়ে। পালার কাহিনী সে অর্ধেক বোঝেনি, মীরজাফর ও মোহনলালের ভূমিকা সম্বন্ধে একেক মন্তব্য করে। তবে খয়বার গাজীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চত, এবার তার মরণ ঠেকায় কোন বাপের ব্যাটা? কিভাবে?–আনোয়ারের এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সে দেখিয়ে দেয় মন্টুকে, মন্টু ভাইজানেক পুস করেন তো! তাই তো তার মামুই হয়। তাই কবো, খয়বার গাজী কতোগুলো মানুষের সব্বোনাশ করছে!’
তাতে তার অসুবিধাটা হচ্ছে কি? ‘বোঝেন না? এতোগুলা মানুষের শাপমণ্যি লাগলে তার উপরে আল্লার গজব পড়বো না? এই সব নিয়তিবাদী লোকজন কি করবে? মানুষের অভিশাপই যদি কাউকে প্রাপ্য দণ্ড দিতে পারে তো বিপ্লবের এতো প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার কি?
সাথে আপনেও তালপোতাত আসেন। সেদিন না কোল্যাম কোনো শালা গোরু দিব্যার চায় না, অ্যাসা দ্যাখেন, কি তামশা আরম্ভ হছে।’

চিলেকোঠার সেপাই – ১৮

বৈরাগীর ভিটার বটগাছের বিশাল সাম্রাজ্যে হাঁটতে হাটতে জালাল মাস্টারের অন্যমনস্কতা আনোয়ারের চোখে পড়ে, এতোটা সময় ধরে এরকম চুপচাপ থাকা জালাল মাস্টারের স্বভাবের বাইরে। এই বটগাছ নিয়ে লোকটার খুব বড়াই, এই নিয়ে কথা বলতে পারলে লোকটা বাচে।
এই গাছ অনেক দিনের, না? আনোয়ারের এই প্রশ্নে জালাল মাস্টারের নীরবতা ভাঙে, কিন্তু সে তোলে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ, এই ছোড়াটা আমাকে উভয় সঙ্কটে ফালালো। কি বিপদ হলো কও তো বাপু!
কি রকম?
‘যার গোরু নাই তাক কি বর্গ দেওয়া যায়? করমালির বাপেরও একাধিক গোরু আছিলো না। কোনো কোনো সময় একাধিক গোরু হছে তো কার্তিক মাসে নির্ঘাত একটা বেচ্যাদিছে। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর সাথে তার সদ্ভাব আছিলো, কাম ঠিকই চালায়া নিছে। ফসলও মোটামুটি ঠিকই দিছে।’
করমালি দেয় না?
বয়স কম তো! বাহানা করে বেশি। একটু খরা হলো তো কিছুমাপ করেন। অর বাপের আমলেও এরকম হছে, তা বাপটা আছিলো নরম মানুষ, কছে, আপনে কম নিলে আপনে মরবেন না, হামাগোরে কম হলে তো বেছোলবিটি নিয়া মর্যা যামু। কিন্তু এই ছোড়ার কথাবার্তা ত্যারা ত্যারা!
কি রকম?
‘ধরো, কবে, সার ভালো কিন্যা দিলেন না, ফসল কম হলো হামার কি দোষ? আপনে জমি দিয়া তো খালাস, মেনুত যা করছি এই ফসলে তার এক আনা দামও ওঠে না। এই সব কথা কয়।-আবার পরিশ্রমও যে নিষ্ঠা সহকারে করে তাও না!’-আপাতত করমালির আর তেমন কোনো দোষ খুঁজে না পেয়ে জালাল মাস্টার একটু দমে যায়। বটসম্রাজ্যের শেষের দিকে এসে সে তার দ্বিধার কথা জানায়, ‘দ্যাখো তো, করমালি গোরু জোগাড় করবার না পারে তো কি বিপদ। এখন যদি কেউ ওকে গোরু না-ই দেয় তো আমার জমি দেওয়া লাগে ওর জ্যাঠাক। দরিদ্র চাষা, ওর অন্ন বিনষ্ট করাটা মানবিক কাম হয় না। কিন্তু আমি করি কি?
‘ওকে গোরু দিতে গ্রামের লোকে এতো ভয় পায় কেন?
এসব করমালির কল্পনাপ্রসূত বাক্য হবার পারে। এখন দ্যাখো, আমি কি করি? ঐ জমির ধান কাটা হছে কোনদিন ফসলও এবার ভালো দিবার পারলো না, এদিকে এখন পর্যন্ত হালও দিবার পারলো না। গম বুনবো, তো হল দিবো কোনদিন, বীজ বুনবো কোনদিন!’
জালাল মাস্টারের সমস্যা আনোয়ার বুঝতে পারে বৈ কি! করমালির ওপর সে আর কতোদিন নির্ভর করবে? এখন গোরুওয়ালা কোনো চাষাকে বর্গ দিয়ে গম বুনতে না পারলে গম তুলবে কবে? এই জমিগুলো তার তিন ফসলী, গম তোলার পর অন্য ফসল বুনতে পারে। তবে জালাল মাস্টার বিবেচক ধরনের লোক বলে এতোদিন ধৈর্য ধরলো। জালাল মাস্টারের শ্বশুরের আমল থেকে এসব জমিতে করমালির বাপদাদারা বর্গাচাষ করে আসছে, হঠাৎ ছাটাই করতে তার বাধো বাধো ঠেকে।
কিছুদিন আগে করতো করমালির বাপ, বছর পাচেক হলো সে বাতে পঙ্গ। বয়স ৫০ হয়নি, শক্ত তামাটে পাকা দাড়ি, খরখরে শক্ত চুল, বাতে বাকচোরা হাত পা ও কোমর এবং ঘন ঘন কাশির কল্যাণে তার হাল হয়েছে ৭০/৭২ বছরের অথর্ব বুড়োর মতো। কারো কাছ থেকে চেয়ে-নেওয়া পুরানো জরাজীর্ণ কোট ও দুর্গন্ধময় ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে কুণ্ডুলি পাকিয়ে একটা বস্তার মতো সে শুয়েছিলো তার বাড়ির বাইরে, শুকনা কলাপাতার পর্দার ধার ঘেঁষে। সেখানটায় বেশ রোদ। সূর্যের দিকে মুখ রেখে পুরু ও ফাটা ঠোঁটজোড়া অনেকটা ফাক করে লোকটা রোদ খাবার চেষ্টা করছিলো। জালাল মাস্টারকে দ্যাখামাত্র কাউকে ডাকার উদ্দেশ্যে সে হাউমাউ করে চ্যাচাতে শুরু করে। তার কাশির দমক ওঠে, শ্লেষ্মার্ধ্বনিমুখর গলা তার আর থামে না, আনোয়ার ভয় পায়, কাশতে কাশতেই বুড়োর সবটা বাতাস বেরিয়ে না যায়। তার বাকপ্রয়াস ও তুমুল কাশির জবাব আসে উত্তরদিকের বাঁশঝাড়ের ওপার থেকে, ‘চাচামিয়া, ও চাচামিয়া, এক ঘড়ি খাড়ান গো, হামরা আসি! জালাল মাস্টার ও আনোয়ার সেদিকে তাকালে তার লম্বা লম্বা দাঁতে করমালি মহামধুর হাসি ছাড়ে। জোয়ালের পাতায় বুক পেতে করমালি গোরুর প্রকসি মারার চেষ্টা করছে। ঐ জোয়ালের পাতার আরেক দিকে বুক পেতে রেখেছে একটু বয়স্ক আরেকজন। লাঙল ধরে তাদের পেছনে পেছনে চলেছে ৮/১০ বছরের ১টি বালক। এই ছোকরা আবার হেট হেট শব্দ করে বাপচাচার বয়সী লোক ২জনকে গোরুর সম্পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করছে। করমালির সঙ্গী জোয়াল থেকে নিজের বুক সরিয়ে নিচ্ছিলো, কিন্তু করমালি বাধা দেয়, আরো খানিক দ্যাখো না গো গোরু পারলে হামরা পারমুনা কিসক? এখনি হ্যাঁপসা গেলা? কিন্তু জোয়ালের পাতা থেকে তার সঙ্গীর বুক প্রত্যাহার করার কারণ তার কুন্তি নয়, ২জন ভদ্রলোকের সামনে গোরুর ভূমিকার অবতীর্ণ হতে লোকটির বাধো বাধো ঠেকছে। একটু পর করমালি বালকটিকে কি নির্দেশ দিয়ে রওয়ানা হয়, তার সঙ্গীটি কিন্তু আসে না। আরেকটু দূরে একটা তালগাছের নিচে বসে ইকো-হাতে বসে-থাকা এক বুড়োর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে।
করমালি এসেই তাদের দিকে এক প্রস্থ হাসি বিতরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু খুব হাঁপাচ্ছে বলে তার হাসি ঠিক হাসির আকার পায় না। শুকনা কলাপাতার পর্দা সরিয়ে সে ভেতরে যায় এবং ফের বেরিয়ে আসে বাশের চটাই হাতে। চাটাই পাতবার মতো জায়গার বড়ো অভাব। বিঘার পর বিঘা চাষের জমির পাশে করমালিদের ১মাত্র ঘর ও বাইরের উঠান এমন জড়সড় হয়ে রয়েছে যে, হাত পা ছড়াবার জায়গা পর্যন্ত নাই। এরই ১দিকে কলাগাছের ছোটো ঝাড়ের সঙ্গে লাগোয়া গোরুর জাবনা খাবার মাটির গামলা। তবে গোরু নাই বলে জায়গাটা খালি। করমালি বাশের বাতা ঘেরা গামলার পাশে চাটাই পেতে দিলো। জালাল মাস্টার বসতে বসতে বলে, করমালি, মুখেত তালি!’ জালাল মাস্টারের এই ছন্দোবদ্ধ রসিকতায় করমালি শব্দ করে হাসে, তবে হাঁপাতে হাপাতেই সে বলে, চাচামিয়া, হাল দেওয়া শুরু করলাম। ধরেন দিনা সতেকের মদ্যে গম বোনা যাবো। বেছন তো আরো লাগবো চাচামিয়া!’
‘পাঁচ সের গম দিলাম যে খাওয়া সারা?
এক বিঘা জমিত কম করা হলেও দশ সের গম লাগে!
আর পাঁচ সের দিবা তোমরা, আদি নিছো, বিছন দিবা না?
তা দিমু| কিন্তু চাচামিয়া আপনের পাঁচ সের গমের আট আনা গেছে পোকের ভোগেতা মিছা কথা কবার জায়গা পাস না? কোনদিন আবার বলবি গমের মধ্যে হাতা লাগছে।’ গমের বীজে চালের হাতি পোকা ধরার ঠাট্টা করে করমালির পোকার পেটে গমের বীজ যাবার তথ্য একেবারে প্রত্যাখ্যান করা হলো। ৩/৪ বছর হলো এদিকে গমের চাষ হচ্ছে, জালাল মাস্টার ১ বিঘা জমিতে গম করতে চায়। সপ্তাহ দুয়েক আগে করমালিকে গমের বীজ দিয়েছে ৫ সের, বাকিটা দেবে করমালি, এর মধ্যে তার অর্ধেক গেলো পোকার ভোগে,—এ কথা বিশ্বাস করবে কে? আবার এটাও এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, গোরু জোগাড় করা করমালির সাধ্যের বাইরে। তার কাছে জমি বর্গ দিলে এবারকার ফসল আর ঘরে আসবে না। কিন্তু কথাটা জালাল মাস্টার বলে কি করে? আহা কতোকাল ধরে এরা এই জমি চাষ করে! জালাল মাস্টার মুখের হাসি বজায় রেখেই বলে, ‘মোহাম্মদ করম আলি মণ্ডল, মনুষ্য জাতি হইতে তোমাকে খারিজ করা হইল। তোমাকে দিয়া কাম হবো? গোরু হাল বয়, ইহাই গোরুর কর্ম, ইহাই গোরুর ধর্ম, কিন্তু ফসল উৎপাদনের দায়িত্ব কি গোরুর উপর অর্পণ করিতে পারো ?
এবার কথা বলে করমালির বাবা। জোয়ালের পাতায় বুক দিয়ে গোরুর ভূমিকা পালন করার ব্যাপারে সে সন্দেহ প্রকাশ করলে করমালি চড়া গলায় জবাব দেয়, ‘গোরু পারলে মানুষ পারবো না কিসক?
পারলু না তো কাল থাকা কবেজের সাথে তিন শতাংশ জমিত হাল দিবার পারলু? তা অবশ্য পারেনি, করমালিকে তাই চুপ করে থাকতে হয়। প্রবলভাবে কাশতে কাশতে করমালির বাবা যা বলে তা থেকে এই তথ্য উদ্ধার করা যায় যে, চষা জমিতে মই দেওয়ার সময় গোরুর বদল মানুষ কাজ করতে পারে, সে নিজেও দড়ি ধরে মই টেনেছে। মইয়ের ওপর থাকতো শিশু করমালি বা তার ভাই বরকতালি, সেও তখন বালক। কিন্তু শীতকালের এই শক্ত মাটিতে লাঙল টানা কি মানুষের কর্ম? আল্লা তাহলে গোরু পয়দা করেছে কেন? জালাল মাস্টার বলে, ‘তুই না আমাক আসতে বললি? তোর জ্যাঠা কৈ? তাক কয়া দেখি, এখন হাল গোরু দিবো, ফসল উঠলে তুই উপযুক্ত-।
তার গোরু কোটে? করমালির এই নির্লিপ্ত প্রশ্নে জালাল মাস্টার অবাক হয়, বিরক্তও হয়, মানে?
করমালি হাসে, গোরুর প্রকসি দেওয়াজনিত কারণে কুস্তি তার এখন কেটে গেছে। বড়ো বড়োদাঁতে সে বিরাট হাসি ছাড়ে, চাচামিয়া, গোরু এটেকার কারু নাই। তালপোতার ব্যামাক মানুষের এখন চারটা করা পাও নাগবো, পছন্দ হলে সোগলির মাথাত জোড়া জোড়া শিঙের বন্দোবস্ত করেন।
এরপর মহা উৎসাহে করমালি জানায় যে, গত কয়েক রাত্রে এই গ্রামের প্রায় সব চাষীর বাড়ি থেকে গোরু চুরি হয়েছে। প্রথম চুরি হলো তার নিজের গোরু, তাতে তার প্রায় একঘরে হবার দশা হয়েছিলো। তারপর উত্তরপাড়ার ২টো ঘর থেকে গেলো জোড়া জোড়া বলদ। করমালির জ্যাঠা আরো সাবধান হয়, সামনাসামনি হলেও করমালির দিকে এমনভাবে তাকায় যেন তার সামনে কোনো লোক নাই। পশ্চিমে শেখপাড়ায় এক রাত্রে ৩ ঘর চাষার ২টো গাই, ৩টে বলদ ও ১টা এঁড়ে চুরি হলে জ্যাঠা ধুনট গিয়ে লোহার শিকল ও তালা নিয়ে এলো। ধুনট থেকে জ্যাঠা আসছে, করমালি বসেছিলো বড়ো রাস্তার মোড়ে গাবগাছতলায়, জ্যাঠা তাকে এড়াবার জন্য জমির ভেতর নামলো, নতুন-কেনা দামী জিনিষগুলোর দামটা পর্যন্ত জিগ্যেস করার সুযোগ দিলো না। আল্লার কি কাজ, করমালি চোখজোড়া ছোটো করে হাসে, সেই রাত্রেই নতুন শেকল তালা ভেঙে চোর ঢুকলো জ্যাঠার ঘরে, গাই নিলো, বকনাটা নিলো, বলদ নিলো, যাবার সময় উপরি নিলো শেকল ও তালা। পরদিন শেখপাড়ার গোরুগুলো যাওয়ার পর করমালি এখন একঘরে হওয়া থেকে মুক্ত হয়েছে। লোকে এখন তাকে আর এড়িয়ে চলে না। আবার চাষের জন্য গোরু ভাড়া পাওয়ার সম্ভাবনাও এখন একেবারে শূন্য।
দেখতে দেখতে ৭/৮ জন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। এদের ১জন হলো করমালির ঐ সঙ্গী, ওর সঙ্গে জোয়ালে বুক দিয়ে লাঙল টানার চেষ্টা করছিলো। তার নীরব ও কখনো হাই-তোলা মুখ ও প্রায় নিশ্চল কালোকিষ্টি গতর দেখে মনে হয় না যে, করমালির উত্তেজিত কথা তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। আর সবার সঙ্গে সে কখনো তাকিয়ে থাকে করমালির দিকে, কখনো দ্যাখে আনোয়ারকে। করমালির সঙ্গী হঠাৎ তার নিজের গোরু চুরি হওয়ার বর্ণনা দিতে শুরু করে, ঐ আত্ৰে হামি নিজে শুতা থাকলাম গোলের মদ্যে, ছোটো এ্যাঁন গোল হামার, তারই মদ্যে হাতপাও মেলা দেই কোটে?–আর মশা! হায়রে মশা গো মশা! মশার কামড় খাতে খাতে তামান আত দুই চোখের পাতা এক করবার পারি নাই। তার দীর্ঘ বিবৃতির শেষ ভাগ বিশ্বাস করা একটু কঠিন। গোরুচোর গোয়ালঘরের বেড়া কেটে ঢুকে বলদের দড়ি ধরে চলে গেলো; গাইটা বাধা ছিলো একদিকে বাঁশের থামের সঙ্গে, অন্যদিকে খুঁটির সঙ্গে বাধা। দড়ি খুলেছে, খুঁটি উপড়ে ফেলেছে, বলদ গেছে, গাই গেছে,-কাবেজের বিনিদ্র নিশিযাপনের কথা বিশ্বাস করে কে? এই নিয়ে সবাই একটু হাসাহসি করলে কাবেজ বলে, না চাচামিয়া, ঘুম লয়, আরা কি যান ছিটা দেয়। মন্তর পড়া ঘরের মদ্যে বালু ছিটায়, হামি চ্যাতনই প্যালাম না দিশা পালে এক শালাক জান লিয়া যাবার দেই? শালার ব্যাটা শালারা!
করমালির নিয়ে-আসা পান খেয়ে জালাল মাস্টার ও আনোয়ার উঠছে এমন সময় একটু দূরের তালগাছতলা থেকে এসে দাঁড়ায় করমালির জ্যাঠা। লোকটার বয়স ৫৫-এর মধ্যেই, তার পাকা দাড়ি তামাটে সাদা, মাথার চুল বেশ কম। লম্বা ও রোগা লোকটির কোমর একটু বাঁকা, বাঁকা শরীরটাকে আরেকটু নুইয়ে সে দাঁড়ায় জালাল মাস্টারের মুখোমুখি।
জালাল মাস্টার তাকে জিগ্যেস করে, ক্যাগো পচার বাপ, আমেশা নিরাময় হছে? তার পুরনো রোগ সম্বন্ধে জালাল মাস্টারের উদ্বেগ দেখে পচার বাপ কৃতজ্ঞতায় আরো নুয়ে পড়ে। করমালি বলে, আর আমেশা। জ্যাঠোর গোরু তো গেলোই, তার তালাও গেছে, শেকলও গেছে। এখন তো হাগা ফির নয় করা শুরু হবো। নয়া শিকলখান গো ধুনটের হাট থাকা কিনছিলা না জ্যাঠো করমালির উঁচু দাঁতের স্পর্শে তার কথাগুলো ঝনঝন করে বাজে,কিন্তু তার কথায় পচার বাপ কান দেয় না। জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আস্তে বলে, ‘দ্যাখেন তো গো মাস্টার সায়েব, কারুবারু করা গোরুবাছুরগুলান পাওয়া যায় নাকি?
করমালি ফের এগিয়ে আসে, পাবা না কিসক? খুতির মদ্যে টাকা পঞ্চাশটা লিয়া ডাকাত-মারা চরত যাও। টাকা দিবা, তোমার হাতোত শালারা গোরুর দড়ি তুল্যা দিবো। দড়ি ধর্যা বিসমিল্লা কয়া বাড়ি বিলা ঘাটা ধরো।
‘দ্যাখ করমালি, পচার বাপ রাগ করে, আলতু ফালতু কথা কস না।
ফালতু কথা কমুকিসক? উত্তরপাড়ার ল্যাংড়া নবেজ বলা বলদখান লিয়া আসছে, তাক পুছ করা দ্যাখা!
নবেজক তুই কোটে দেখলুঃ নবেজের ভাই জানে না আর তুই জানিস, না?
নবেজের ভাই কাবেজ কোনো মন্তব্য না করে গম্ভীর হয়ে থাকে। গত বছর নবেজের সঙ্গে সে পৃথগন্ন হয়েছে, দুইভায়ের সম্পর্কে এখনও খারাপ।
করমালি বলে, ‘ভাই হলে কি হয়, কাবেজ কি জানে?
নবেজ তোক কছে না? পচার বাপ রেখে গেলে করমালিও কড়া জবাব দেয়, ই, নবেজ তো হামাক সবই কছে।

চিলেকোঠার সেপাই – ১৯

নবেজ অবশ্য ব্যাপারটি গোপন রাখবার জন্যে চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু করমালিকে তার সব কথা বলতে হয়েছে। করমালি অতো সোজা মানুষ নয়।
১দিন খুব ভোরে, ফর্স হতে না হতে নবেজউদ্দিন রওয়ানা দিয়েছিলো তার সাদা বলদের খোজে। তার নিজের নৌকা নাই, নৌকা ভাড়া করতে গেলে খরচ পড়ে ১৫/২০ টাকা। বড়ো বড়ো খেয়ানৌকায় উঠে সে একেকটা চরে গেছে, চরপার হয়েছে হেঁটে, চরের আরেক মাথায় এসে ফের অপেক্ষা করেছে আর ১টি খেয়ানৌকার জন্য। যমুনার ১চর থেকে আরেক চরে খেয়ানৌকায় পার হওয়া মানে এই উঠলাম-আর-নামলাম নয়। ঘন্টার পর ঘণ্টা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়ানৌকা আসে, নৌকা একবার চলতে শুরু করলে ওপারে পৌছাতে ফের দেড় ঘণ্টা দুই ঘণ্টার ধাক্কা। এইভাবে সারাটি দিন এবং ১টি রাত্রি হেঁটে ও খেয়ানৌকায় পার হয়ে নবেজ পৌঁছেছিলো ডাকাত-মারা চরে। ফিরে এসেছে ১দিন পর। গোরুর দড়ি ধরে নবেজ যখন ফিরছে, ধারাবর্ষ চরের এদিকে খেয়ানৌকা থেকে তাকে দেখতে পায় আসমত আলি। খেয়ানৌকা দেখে নবেজ মুখ ফিরিয়েছিলো অন্যদিকে, আসমত অনেক ডাকাডাকি করলেও তার দিকে তাকায়নি। আসমত মরিচ বেচতে এসেছিলো ধুনটে, সে এই বৃত্তান্ত বলে করমালির ভাই বরকতালিকে। বরকতালির কাছে শুনে করমালি সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় উত্তরপাড়া।
বিকালবেলা নবেজউদ্দিন কাথা গায়ে শুয়ে ছিলো ঘরের ভেতর মাচার ওপর। নবেজের বৌ করমালির কিরকম ভাগ্নী হয়, গলা খাকারি দিয়ে করমালি সোজা টুকে পড়ে শুকন কলাপাতা ঘেরা উঠানে। মানুষের সাড়া পেয়ে মাচা থেকে নবেজ নিচে নামে এবং মাচার তলে বসে থাকে মাথা গুঁজে। তার বৌয়ের চোখের ইশারায় জানতে পেরে করমালি তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। নবেজ কথাই বলতে চায় না। গ্রামের মানুষের চোখ এড়াবার জন্য আজ ৩দিন থেকে সে কোথায় কোথায় ঘোরে-তার বৌ পর্যন্ত বলতে পারে না। বৌটা খুব বিরক্ত,-গোরু নিয়ে এলো, কিন্তু কিভাবে উদ্ধার হলো, কি সমাচার-সব কিছু সে চেপে রাখতে চায়। বৌ এদিক ওদিক থেকে নানারকম কথা শুনে তাকে খয়বার গাজীর কথা জিগ্যেস করে, ক্যাগো, গাজীর বেটা বলে ডাকাত-মারা চরত দুনিয়ার গোরু জড়ো করছে? নবেজ তাতে বৌয়ের চুল ধরে ঘাড়ে একটা থাপ্পড় মারে, আত নাই দিন নাই, খালি খয়বার গাজীর কথা কস ক্যা? খয়বার গাজীর সাথে তোর মায়ের নিকা দিবু? কাদো কাদো গলায় নবেজের বৌ করমালির কাছে সব বললে নবেজের হাত ধরে টানতে টানতে করমালি তাকে নিয়ে আসে নিজেদের পাড়ায়। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কুয়াশায়, অন্ধকারে, নাড়ার ধোঁয়ায় কিছুই ভালো করে দ্যাখা যায় না। পচার বাপের গোয়াল ঘরের পেছনে সারের গাদার পাশে তাকে বসিয়ে করমালি সোজাসুজি জিগ্যেস করে, কও তো দামান, গোরু ফেরত পাওয়া গেলো কেমন কর্যা?
নবেজউদ্দিন কথা বলবে কি?-তার ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলা, হাত-পা কাপা দেখে মনে হয় তাকে যেন গলা টিপে মারার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে। সে কি তবে চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছে? বেশ তো, তাতে ক্ষতি কি? করমালি তাকে অভয় দেয়, তারাও না হয় বাটপাড়ি করবে, তাতে নবেজের অপরাধ বিভক্ত হয়ে তারভার লাঘব হবে। নবেজ তবু কাপে হয়তো করমালির হাত থেকে নিজের রোগা-পটক গলা বাচাবার জন্যে সে জানায় যে, সে গিয়েছিলো ডাকাতমারা চরে। না, না, তার কোনা দোষ নাই, এটা তার নিজের সিদ্ধান্ত নয়। খয়বার গাজীর খাস বর্গাদার কিসমত সাকিদারের পরামর্শে সে ওদিকে রওয়ানা হয়। মাসে ১০ টাকা হার সুদে কিসমত তাকে ৬০ টাকা ধারও দেয়। নগদ ৫০ টাকা এবং এই ব্যাপারে পূর্ণ নীরবতা পালনের অঙ্গীকার দিয়ে সে তার গোরু ফেরত পেয়েছে। কোরান শরীফ ছুয়ে নবেজ কথা দিয়ে এসেছে যে, কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির কানে এই কথা দেবে না। এই কথা ফাঁস হয়ে গেলে নবেজউদিনের কপালে যে কি আছে তা কেবল সে-ই জানে, আর জানে খয়বার গাজী, আর জানে খয়বার গাজীর প্রধান সহকারী ও অংশীদার হোসেন আলি ফকির। এদের নাম বলতে বলতে সে কাপে এবং কিছুক্ষণ পর তার ভাগ্য সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞাতদের তালিকায় সর্বজ্ঞ আল্লাতালার নাম যোগ করে। এতো কথা বলে ফেলার পর নবেজউদ্দিন কিছুক্ষণ কাঁদে এবং নাক চোখ না মুছেই করমালির ঠোঁটের বিড়িটা চেয়ে নিয়ে কয়েকটা টান দেয়।
বিড়ি খেয়ে সে ঘ্যানঘান করতে শুরু করে নতুন উদ্যমে। এই বিশাল পৃথিবীতে করমালি ছাড়া কোনো কাকপক্ষীও এসব কথা জানে না। করমালির হাতে তার জীবনমরণ, করমালির মুখ থেকে এইসব কথাবার্তা বেরিয়ে পড়ে তো খয়বার গাজীর লোকজন নবেজউদ্দিনকে বাড়ি থেকে, গ্রাম থেকে তো বটেই, এই সাধের দুনিয়া থেকেও তাকে উৎখাত করবে। অথচ এবার বর্গাচাষ করে সে ফসল পেয়েছে ভালোই, বাড়ির পেছনে খাইখালাসি দেওয়া ১০ শতাংশ জমিটাও তার উদ্ধার হয়ে যাবে। এবার এমন কি বর্ষাতে তার বৌটাকে বাপের বাড়ি না পাঠালেও চলবে। ৫০টা টাকা গেছে, তা যাক। ওদেরও তো খরচা আছে। গোরু নিয়ে গেছে, গোরুকে জাবনা দিতে হয়েছে, গোরু দ্যাখাশোনার জন্যে কতোগুলো লোক পুষতে হয়। তারপর থানা সামলাও রে, আইয়ুব খার পাটির মেম্বারদের সামলাও রে, এমএনএ, এমপিএ, চেয়ারম্যান-কিসব হাবিজাবি, এদের কি লেখাজোকা আছে? এদের আদর্যত্ন করো, খাতিরদারি করো টাকা তো ওদেরও যায়! না, মামু খয়বার গাজী মানুষ খারাপ না। কলকাঠি নাড়ে সব হোসেন আলি ফকির!’ খয়বার গাজী চরের দিকে কোনোদিন পা-ও মাড়ায় না। আসল শয়তান হলো হোসেন ফকির। কার গোরু নিতে হবে, কার কতো জরিমানা ধার্য করা হবে, গোরু ফেরত দেওয়া যাবে না কাকে, কাকে মেরে পুঁতে ফেলতে হবে যমুনার নতুন চরে—সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক হোসেন আলি। খয়বার হাজার হলেও ভালো বংশের মানুষ, তার ছেলেপেলে সব লেখাপড়া জানা শহুরে লোক, তার এক ছেলে বিলাত থেকে ঘুরে এসেছে। না, হোসেন আলি ফকিরের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নেওয়া ছাড়া এইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খয়বার গাজীর কিছুমাত্র যোগ নাই।-নবেজউদ্দিন এক নাগাড়ে কথা বলে, কথা বলার পালা এখন তার। ৫০ টাকা জরিমানা দেওয়ার কথটা বলে এতো ভয় পেয়েছে যে, খয়বার গাজীর প্রতিশোধের কথা ভেবে সে নিজেই খয়বারের পক্ষে যুক্তি তৈরি করছে। খয়বার গাজী ভালো, সে নিষ্পাপ পুরুষ—এমনকি নিজের মধ্যেও এই বিশ্বাস খাড়া করার জন্যে নবেজ তখন অস্থির। কিন্তু এইসব বলতে বলতে তার বোধোদয় ঘটে যে, দাপট হোসেন আলিরও কম নয়। গতবার বড়ো ভোটের সময় আইয়ুব খানের ফুল মার্ক ক্যান্ডিডেটের পক্ষে এই এলাকার মৌলিক গণতন্ত্রীদের সংগঠিত করেছে তো সে-ই। হারিকেন মার্কার ক্যান্ডিডেট ছিলো খয়বারের কি রকম আত্মীয়, খয়বার তাই একটু চুপচাপ ছিলো। এমএনএ হওয়ার পর ফুল মার্কা শালা এদিকে এসে খয়বার গাজীর বাড়িতে যতোই উঠুক, সে চেয়ারম্যান হোক আর মেম্বার হোক, কাজের মানুষ হলো হোসেন আলি। এই যে মেম্বারগুলো,-বেঈমানের বেঈমান, মোনাফেকের বাপ মোনাফেক-এদের সামলায় কে? হোসেন আলি ছাড়া আবার কে? সুতরাং হোসেন আলিকেও ভয় পাওয়া নবেজউদিনের কর্তব্য এবং তাই সে বলে, তারই দোষ দেই কি? চরের মদ্যে তার দাপট কি আজকালকার কথা গো? তা অবশ্য ঠিক। ২৫/২৬ বছর আগে যমুনায় ডাকাত-মারা চর যখন জেগে ওঠে তখন থেকে সেখানে তার বাথান। চরের একদিক ভাঙে, বাথানও সরে যায় অনদিকে। জামালপুর মহকুমার চর থেকে এমনকি বীর এলাকা থেকে গোরু বাছুর মোষ সব নৌকায় ভাসিয়ে সে নিয়ে আসতো এদিকের চরে। ওদিকে বালিজুড়ি, এদিকে ডাকাত-মারা চর-এই ২জায়গার নাম শুনলে গোরুওয়ালা চাষার বুক কাপে কি আজ থেকে? হোসেন আলির মস্ত বড়ো জলঙ্গি নৌকা যমুনার কোনো ঘাটে বাধা দেখলে সেই এলাকার মানুষ রাত জেগে গোয়াল পাহারা দেয়। এসব কি আজকের কথা? গোরওয়ালাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের ফন্দি কিন্তু তার মাথায় আসেনি। এই শালা খয়বারের বুদ্ধিতে তার এই ব্যবসার শুরু। খয়বার গাজীর কথা না শুনলেও আজকাল তার চলে না। ইউনিয়ন বোর্ড, আইয়ুব খানের পাটি, ভোট –এসবের মধ্যে না থাকলে এখন কোথাও সুবিধা করা মুশকিল। একবার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের গম সবটাই বেচে দেওয়ার সুযোগ করে দিলো খয়বার, তখন থেকে এসব লাইনে ঢুকলোসে। না, হোসেন আলি মানুষ ভালো, তার দেলটা পরিষ্কার।
এসব এলোমেলো কথা শোনার পর করমালিকে চুপচাপ থাকতে দেখে নবেজের ভয় ফের মাথাচাড়া দেয়। তার শ্বাসকষ্ট হবো হবো করে, হঠাৎ করে করমালির একটা হাত ধরে বলে, তোমার পাওত পড়ি মামু, ইগল্যান কতা কাকো কবা না। করমালি উঠে দাঁড়ালে নবেজ ফের তার হাত ধরে, মামু ইগল্যান কথা অস্ট্র হলে হামার বাড়িঘর ব্যমাক পুড়া দিবো গো! তুমি হামাক জবান দ্যাও, কাকো কয়া দিবা না, কও!
এদিকে পচার বাপের ছেলে পচা তখন গোয়ালঘরে ঢুকেছে। নবেজউদ্দিন করমালির প্রতিশ্রুতি না নিয়েই আড়ালে চলে যায়।
সেই রাত্রিটা করমালির খুব অস্থির কাটে। সারারাত ছটফট করে একটু ঘুমিয়েছে, ভোরবেলার দিকে স্বপ্ন দ্যাখে, চষা জমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নবেজউদ্দিন, নবেজের হাতে মাছ ধরার তরা জাল। নবেজের আগে আগে এক ভদ্রলোক। ‘কেডা গো? নবেজ জবাব দেয়, চিনলা না? হোসেন আলি ফকিরের ব্যাটা। করমালি জানতে চায়, কোটে যাও?’ নবেজ হাসতে হাসতে বলে, টাউনেত থাকে, বাড়িত আসা মাছ ধরার সখ হছে! স্বপ্লের মধ্যেই করমালির মনে হয়, হোসেন আলির ছেলে মাছ ধরা দাখার জন্য এই গ্রামে আসবে কেন? এই কথা ভাবতে ভাবতে নবেজ কোথায় উধাও হয়, পাটকিলে রঙের একটা কুকুর সেই ছিপছিপে ভদ্রলোককে তাড়া করে। করমালি বলে, ‘তু তু ধর শালাক ধরা ভদ্রলোক সামনের দিকে দৌড়ায় এবং কুকুর ঘেউঘেউ করতে করতে তার পেছনে ছোটে।
কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজে করমালির ঘুম ভাঙ্গে। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। বাইরে একটা কুকুর অবিরাম ডেকে চলেছে। করমালির তলপেটে তখন বেগ হচ্ছে, পানি ভরা মাটির বদনা হাতে সে বেরিয়ে পড়লো।
বাইরে কুয়াশা। বাড়ির সামনে কলাগাছের পেছন দিকে তাকিয়ে নেড়ি কুত্তাটা ডেকেই চলে। কলাগাছের ঝাড়ের ওদিকে জমির আলের দিকে যাচ্ছিলো করমালি, হঠাৎ চমকে উঠে দ্যাখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে নবেজ। কুকুরের ভয়ে কাঁপতে পারে, আবার শীতও পড়েছে সাঙ্ঘাতিক, তার গায়ে পোষাক বলতে কেবল ১টি জামা, নবেজ তাই শীতেও কাঁপতে পারে।
কারমালি বলে, ক্যাগো তুমি? এই জাড়ের মদ্যে খাড়া হয়া আছো? কি সমাচার?
এবার কাপে নবেজের গলা, না এমনি!’
একটু-আগে-দ্যাখা স্বপ্ন এবং একটু-আগে-বোধ-করা তলপেটের বেগ ভুলে করমালি তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নবেজ হঠাৎ তার পায়ের ওপর পড়ে যায়, একটু হলেই করমালির বদনা তার মাথায় পড়তো। নবেজ কাঁদতে কাঁদতে বলে, মামু, তুমি হামাক বাঁচাও কাল তোমাক কি কছি না কছি হামি দিশা পাই নাই। অরা মানুষ খুব ভালো মামু, মানুষ খারাপ লয়। হোসেন ফকির মানুষ লয় বাপু উদিনক্য শালা হামার টাকা লিয়া আঙুলেত ছাপ দিয়া এটা এটা করা গোণে আর কয়, শালা ছোটোজাতের পয়দা, ইগল্যান কথা আষ্ট্র হলে তোর জান থাকবো না। মামু, তার কি? তার কিছু হবে না। হামাক ঝাড়ে বংশে শ্যাষ করবো! মামু, তুমি হামার ধর্মের ভাই, তোমাক কারুবারু করি, কাকো কিছু কয়ো না! তুমি হামাক জবান দ্যাও সে কিছুঁতেই করমালির পা ছাড়ে না। এদিকে করমালির পায়খানার চাপ ফের ফিরে এসেছে, সে পা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, দিলাম!’
কিন্তু কথা দিলেও নবেজউদিনের গোরু ফেরত পাওয়ার ঘটনা করমালি যাকে পায় তাকেই বলে।
খালি খালি মানুষটাক নিয়া টানাটানি করব, টাকা না দিলে গোরু অরা দিবে। না-পচার বাপ জ্যাঠাকে এই কথা বলে নবেজউদিনের কাহিনী সে বিস্তৃতভাবে বলার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু পচার বাপ তাকে আমল না দিয়ে দাঁড়ায় জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে। তার ফ্যাসফেসে গলা যতোটা পারে কোমল করে সে বলে, আপনে কলে পরে তারা শুনবো গো! হামরা চাষাভূষা মুখ্য মানুষ, হামাগোরে মূল্য কি? আপনে শিক্ষিত মানুষ, তাইও শিক্ষিত। হামরা গরিব-গরবা চাষা, হামাক বেচলেও দশ টাকা বারাবো না, ছেঁচলেও বারাবো না। আপনে এ্যাঁন কয়া দ্যাখেন, এই গায়ের সোগলি আপনেক মানে। খালি এই গেরাম কিসক, তামান ইউনিয়নের মদ্যে আপনের একটা কথা ফালাবার পারবো কেটা?
জালাল মাস্টার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বেঢপ খাচার মতো বুক থেকে তার ফসফস করে বাতাস বেরোয়, কিন্তু সেটা হাঁপানির টান নয়। তার নিজের সম্বন্ধে প্রকাশিত পচার বাপের মতামত সে সম্পূর্ণ অনুমোদন করে, তা ধরো, আমি কথা একটা কলে কেউ ফালাবার পারবো না। তার প্রভাবাধীন এলাকা সে আরো সম্প্রসারিত করতে চায়, এতদঞ্চলে, এই তামাম থানার যতো বড়ো অফিসার দেখবা, ম্যাজিস্ট্রেট কও পুলিশ কও আর জজ হাকিম ৬াক্তার ইঞ্জিনিয়ার-যার কাছে যে কামে যাই আমাক প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা কারো নাই।’ বলতে বলতে সে একটু থামে, হয়তো নিজের সম্বন্ধে এতোটা বলে ফেলে সে একটু লজ্জা পেয়েছে কিংবা আনোয়ারের সামনে একটু সঙ্কোচও হতে পারে। এবার একটু বিনীত ভঙ্গিতে বলে, তা কাকো তো কোনোদিন কোনো অনুরোধ করি নাই, তাই-।
করমালি বলে, আপনে গেলে খালি খালি বেইজ্জত হবেন। টাকা না হলে গোরুর একটা খুরও দিবো না!
জালাল মাস্টার সোজা হাটতে শুরু করে। এখনো তার নাক দিয়ে ফসফস করে বাতাস বেরিয়ে আসছে। করমালির ওপর সে বিরক্ত, তার ফুলে-ওঠা বুকটাকে ছোড়া একেবারে ফুটো করে দিয়েছে। মাঠের ভেতর আল পেরিয়ে দুজনেই এসে পড়েছে বৈরাগীর ভিটার কাছাকাছি। কয়েক পা পর বটগাছের এলাকা। পেছন থেকে ডাকে পচার বাপ, ও ভাইজান পা চালিয়ে জালালউদিনের পাশে এসে বলে, ভাইজান, কথাটা শোনেন। চ্যাংড়াপ্যাংড়ার কথা থোন! আপনে চলেন, হামরাও যামো!’
‘কোথায়?
গাজীর ব্যাটার কাছে না যান তো ডাকাত-মারা চর চলেন।’ আনোয়ারকে দেখিয়ে পচার বাপ বলে, এই চ্যাংড়ার চাচার নাও বান্দা আছে খালের ধারে, তাই তো আপনের সম্বন্ধীই হয়, আপনে কলেই নাও পাওয়া যাবো। খালেত এখন পানি নাই, তো নাও হামি কান্দোত করা নিয়া যামু মুলবাড়ির ঘাট।
নৌকা না হয় হলো, চরে অনর্থক যায়া ফল কি? বলতে বলতে জালাল মাস্টার বটগাছের দিকে হাঁটে।
আনোয়ারের চোখের সামনে এখন কেবল বটগাছ। পাশে জালাল মাস্টার, পাশে পচার বাপ, পেছনে মাঠের ওপার থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে করমালি, করমালির ছোটো বাড়ির সামনে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা চাষারা। কিন্তু বটগাছের এলাকায় পা দিয়ে সাঙ্ঘাতিক নির্জন মনে হচ্ছে। যেন জনমানবহীন বড়ো ১টি প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছে। জালাল মাস্টার বলে, বুঝল্যা আনোয়ার, এই বটগাছের বয়স কম করা হলেও আড়াইশো বছর তো হবেই ধরো—। কিন্তু পচার বাপ তাকে কথা শেষ করতে দেয় না, ‘কথাটা শোনেন ভাইজান ডাকাত-মারা চরেত হোসেন ফকিরেক কলে কাম হবো। হোসেন ফকির এখন থাকে ঐ চরেত, কিন্তু বাড়িঘর, জোতজমি, চাষবাস সব ধারাবর্ষা চরের মদ্যে। ধারাবর্ষা চরে মিয়াগোরে জমির বর্গাও তারই হাতোত আছিলো। এবার সে তাকায় আনোয়ারের দিকে, আপনের দাদার আমল থাকা হোসেন ফকিরের বাপ ঐ জমিত বাস করে। আপনের দাদা বড়োমিয়ার মেলা জমি তাই বর্গ নিছিলো, আপনের বাপচাচারা সব বেচ্যা দিছে তারই কাছে। অনেকদিনের কায়েমি চর, ধান পাট কালাই খুব ভালো হয়। আপনে গেলেও খুব কাম হলোনি গো!
কিন্তু আনোয়ার তখন দুই চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে বিশাল বটপ্রসাদ। যেদিকে চোখ পড়ে কেবল গাছের ঝুড়ি। অজস্র ঝুড়ি নেমে এসেছে ওপরের ডাল থেকে। অনেকগুলো ঝুড়ি দেখতে মোটা থামের মতো। এরকম থাম যে কতো গুণে শেষ করা যাবে না। আবার অনেকগুলো ঝোলে দড়ির মতো। মোটা থামগুলোর শরীরে শাদা কষ। স্নান ধূসর বাকলের ওপর এই কষ দেখে পুরনো বাড়ির নোনা-ধরা থামের কথা মনে পড়ে। আর ঝুলন্ত ঝুড়িগুলো একাগ্রচিত্তে মাটির দিকে নামছে, একদিন এরাও মাটি ছোবে, চুকে পড়বে মাটির ভেতর, পরিণত হবে একেকটি স্তম্ভে। কুড়ি ও থামের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেছে ১টা রাস্তা, রাস্তায় সাইকেলের চাকার দাগ। ১টা জায়গায় থাম ও ঝুলন্ত ঝুড়ি এমনভাবে সাজানো যে, একটু-ভাঙা পুরনো খিলানের মতো মনে হয়। এই সব থাম, কাণ্ড, ডালপালা, ঝুলন্ত ঝুড়ি নিয়ে বটবৃক্ষ কি কেবল বেড়েই চলবে? জালাল মাস্টার ও পচার বাপের সঙ্গে আনোয়ার বট এলাকার একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো কয়েক রকম পাখির বিচিত্র কলরব। এই কোলাহল এরকম আকস্মিক মনে হচ্ছে কেন? এটা কি এতোক্ষণ স্থগিত ছিলো? মাঠ থেকে, এমন কি বটগাছের তোরণে পা দিয়েও তো এর কিছুই বোঝা যায়নি। এর মানে কি? কিন্তু মানে বোঝার আগেই পচার বাপের প্রতি জালাল মাস্টারের কথা শোনা যায়, না, না, আনোয়ার যাবে কোথায়? ধারাবর্ষা কি এখানে?
‘না, আমার আপত্তি নেই। চলেন না। কবে যাবেন? আনোয়ার রাজি হওয়ায় পচার বাপ তার হাত জড়িয়ে ধরে, যাবেন? তুমি, আপনে, আপনে গেলে গরিবের বড়ো উপকার হয় বাবা। হোসেন আলী ফকিরকে কয়া বলা হামার গুনা গরিটা মাপ করায়া দাও বাপ। আল্লা আপনার ভালো করবো বাবা!
‘গুনাগারি? আনোয়ার দাঁড়ায়, গুনাগরি কিসের?
ঐ তো হলো বাপ। জরিমানা আর কি? পচার বাপ বোঝাতে চেষ্টা করে, জরিমানা কও দণ্ড কও, ট্যাকসো কও, খাজনা কও—ইগল্যান কি?-মানুষের পাপগুনার শাস্তি, নাকি কন, ভাইজান? মানুষের পাপের শাস্তি সম্বন্ধে তার মতামতের অনুমোদন লাভের জন্যে জালাল মাস্টারের দিকে তাকিয়ে পচার বাপ আনোয়ারকে বলে, ‘একদিক চলেন বাবা ফজরের আজানের আগেই নৌকা দিয়া মেলা করলে আগাবেলার মদ্যেই ধারাবর্ষা যায়া ওঠা যাবো। তাক বাড়িতে না পালে যামো ডাকাত-মারা চর। দুইটা চর এক্কেরে কাছাকাছি।
যাবো। কবে যাবেন?’
কিন্তু ইতস্তত করে জালাল মাস্টার, না বাপু টাউনের অধিবাসী। নদী খাল চরের মদ্যে ঘোরাঘুরি করলে একটা রোগ ধরতে কতোক্ষণ?
না আমার কোনা অসুবিধা হবে না।’ আনোয়ারের জেদ বেশ টের পাওয়া যায়। জালাল মাস্টার কিছু না বলে কেবল বটগাছের সাম্রাজ্য দ্যাখে।
আপনে বাড়িত যায়া বোঝেন আজ পাছাবেলা আপনের বাড়িত যামো, তখন না হয় তারিখ ঠিক করা যাবো। তো বাবা, গেলে দুই একের মদ্যেই যাওয়া লাগবো। নিচু ও শপষ্টভাবে কেবল আনোয়ারের উদ্দেশে বলে পচার বাপ তার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। তার চলে যাওয়াটা একটু আকস্মিক, তার অনুরোধে আনোয়ারের সায় পেয়ে সে হয়তো অভিভূত, তাই ঠিকঠাক নিয়মমতো বিদায় নিতে ভুলে যায়। আবার এও হতে পারে যে, আনোয়ারকে সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগ সে দিতে চায় না।
কিন্তু এসব নিয়ে আনোয়ার মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না। জালাল মাস্টারের মতো সেও তখন সম্পূর্ণভাবে বটগাছের কজায়।

চিলেকোঠার সেপাই – ২০

ঝুলন্ত ও মাটিতে-গাথা ঝুড়ির মাঝে মাঝে শুকনা পাতা, হলদে ঘাসে-ঢাকা জমির কোথাও কোথাও ছেটো বড়ো আকারের রোদ ও ছায়ার কারুকাজ। রোদ এখানে ঢোকার ফাক পেলো কোথায়? আনোয়ার তখন তাকায় ওপরদিকে। মাথার ওপর বটশাখার বীমের ওপর ঘন বটপাতার বিস্তৃত ছাদ। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ ও ফিকে লাল গোল ফল। গুচ্ছ গুচ্ছ ফল ঘিরে কলরব!—ডালের সঙ্গে ঝুলছে, বাদুড়, ডালপালার ফাঁকে চলন্ত পাতার মতো চরে বেড়ায় শালিক। আর খুব ছোটো ছোটো হরিয়াল দফায় দফায় উড়ে অতিক্রম করছে স্বল্পতম দূরত্ব। একটু করে ঠোকর দিচ্ছে লাল ফলের পাতলা রোয়াওয়ালা চামড়ায়। ফের উঠে যাচ্ছে আরেকটি ফলগুচ্ছের দিকে। বটপ্রাসাদের ছাদে চলমান প্রাণীদের কোলাহলের সঙ্গে ঠাসবুলুনি পাতার স্পন্দন। পাখি ও পাতার মিলিত গতিবিধি অপরিচিত কোনো ভাষার মতো আনোয়ারের কানে অভিনব ঠেকে। বটছাদ তার কাছে অনেক দূরের কিছু বলে মনে হয়, সে মাথা নামিয়ে নেয় নিচের দিকে। নিচে রোদ ও ছায়ার আলপনার তলায় ল্যাজ ও মুণ্ডুদিব্যি মাটিতে ডুবিয়ে পিঠ উঁচু করে শুয়ে রয়েছে এক মাতাল অজগর। অজগর সাপটির বোধ হয় বোধশোধ লোপ পেয়েছে, আর এদিকে আনোয়ারের সামনে অজগরটি ছাড়া সব কিছু হাওয়া হয়ে যায়। হঠাৎ করে অজগর সাপ নিশ্বাস ফেললে বটতলার শুকনা পাতা ও ধুলোবালি উড়ে গিয়ে পড়ে দূরের ধান-কটা জমিতে, বুক দিয়ে জোয়াল ঠেলার চেষ্টা খান্ত দিয়ে করমালি সেখানে কোদাল কুপিয়ে চাষ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ধুলোবালি কি শুকন পাতার সঙ্গে আনোয়ারও সেখানে ছিটকে যেতে পারলে ভালো হতো। এ ছাড়া এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কি কোনো উপায় নাই? এই অজগরের গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে কতোক্ষণ? না, উপায় পাওয়া যায়, কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে বটে, কিন্তু ‘আনোয়ার, তোমাকে আগেই বলছিলাম, মনে আছে? জালাল মাস্টারের প্রশ্নবোধক বাক্যে সে চমকে ওঠে। জালালউদ্দিন দাঁড়িয়ে রয়েছে বুক চিতিয়ে, তার ডান পায়ের নিচে অজগর সাপের ফুলে-ওঠা পিঠ। আনোয়ার নিজে নিজেই লজ্জা পায়, বটগাছের শিকড় শালা কি ভয়ানক ভয় দ্যাখাতেই পারে। গাছের শিকড় অজগরের দেহের বিভ্রম তৈরি করে কিভাবে? সে কি কেবল বয়সের জোরে? নাকি, একই বস্তু শিকড় ও অজগরের দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম? এসব কি এখানকার পুরনো বাসিন্দার কারসাজি?
আনোয়ার, জালাল মাস্টার ফের বলে, এই গাছের বয়স কম করা ধরলেও দুইশো তো হবেই। বেশিও হবার পারে!
প্রমাণ কি? জিগ্যেস করার আগেই জালাল মাস্টার বলে, দেখবা? ঝুড়ির ফাঁকে ফাঁকে তাদের হটতে হয়। সরু মোটা, কিলবিল করা ও পিঠ-উঁচু অনেক শিকড়, সেগুলো ডিঙিয়ে, নতুন পুরনো বেশ কয়েকটা কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে জালাল মাস্টার ও আনোয়ার এসে দাঁড়ায় মোটামেটা ১টা কাণ্ডের সামনে মস্ত মোটা কাণ্ড, কিন্তু সবচেয়ে মোটা নয়। তবে চেহারায় এর বয়স ধরা পড়ে প্রকটভাবে। রোগশয্যায় শুয়ে ছাদের সিলিঙের দিকে ভোতা ভোতা চোখে তাকিয়ে-থাকা বুড়ো মানুষের ভাঙা গালের মতো কাগুটির শরীর মাঝে মাঝে তোবড়ানো, তার এখানে ওখানে গর্ত। এর একদিকে উইপোকার একটা টিবি। এই ঢিবির সংযোজনে শরীরের আয়তন বাড়েনি, মনে হয় এটা দিয়ে তার পড়ে পড়ে গতরটা ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।
‘দ্যাখো। জালাল মাস্টারের তর্জনী অনুসরণ করে আনোয়ার মাটির দিকে দ্যাখে। ইঞ্চি দুয়েক উঁচু বাধানো একটি ইটের বেদি। চুনসুরকির খাবলা খাবলা প্লাস্টার এবং তার নিচে পাতলা চওড়া ইট। এটা দেখিয়ে জালাল মাস্টার বটগাছের বয়স বোঝায় কি করে?
জালাল মাস্টার গম্ভীর হয়ে বলে, বৈরাগীর ঘর। এইখানে বৈরাগী বসবাস করছে।
বৈরাগী কে? আনোয়ার জিজ্ঞেস করে, বৈরাগীর ভিটা তো সবাই বলে, কিন্তু বৈরাগীটা কে?
কে?
আনোয়ারের দিকে না তাকিয়েই জালাল মাস্টার বলে, বৈরাগীটা নয়। এককালের সম্মানিত ব্যক্তি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ!
ও, বৈরাগী তাহলে সত্যি সত্যি ছিলো? আমি ভেবেছি স্রেফ গল্প!
‘গল্প হবে কেন? ইতিহাসের কথা। ইতিহাসের কথা নিয়া মানুষ গল্প করে না? নাটক নভেল লেখে, বায়োস্কোপ করে। ইতিহাস কি তাই কেচ্ছা হয় যায়?
বৈরাগীর ব্যাপারে জালাল মাস্টারের উৎসাহের অন্ত নাই। অতিরিক্ত উৎসাহে প্রায় ১৫/২০ সেকেন্ড সে কথাই বলতে পারে না কেবল এদিক ওদিক দ্যাখে। তারপর বিড়বিড় করে, হু! দদুইশো ববছর তো হলোই।’
একটুখানি তোতলালেও কয়েকটি বাক্যের ঘষায় তার জিভ হাল্কা হয় এবং মুখ দিয়ে কথা বেরোতে শুরু করে প্রবল-তোড়ে-আসা বমির মতো। মনে হয় কিছুই সে রেখে দিতে পাচ্ছে না, ২শতাব্দী আগেকার সব ঘটনা ও দৃশ্য যেন তার নিজের চোখে দ্যাখ্যা, সেই সব উগড়ে ফেলার জন্যে একেবারে অস্থির!
দুশো বছর?
আনোয়ারের সংশয় দেখে জালাল মাস্টার চটে যায়, কেন, ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে, কোম্পানি আমলের শুরুতে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কথা কি আনোয়ার জানে না? —সে তো জানেই। মজনু ফকির, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক-এদের কথা কেন জানে? —যদি জানে তো এতো সন্দেহ করার কি আছে?
কিন্তু ঐ বিদ্রোহের সঙ্গে বটগাছের সম্পর্ক কি? এই বটতলা থেকে কি বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিলো?
আনোয়ার ঠাট্টা করলে এবার জালাল মাস্টার আর রাগ করে না, বরং এতে তার উৎসাহ বাড়ে। বটগাছের গহীন ভেতরে এই ভাঙাচোরা পাকা জায়গার সঙ্গে বিদ্রোহের একজন নেতার স্মৃতি জড়িত। ইতিহাস বইয়ের ওপর কি সব সময় সম্পূর্ণ নির্ভর করা আনোয়ারের উচিত? ইতিহাস বই যারা লেখে তাদের চেয়েও অন্তরঙ্গ মানুষের কাছে এসব কথা শোনা, তাহলে অবিশ্বাস করে কি করে?
শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা গেলো কোথায়?
জালাল মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মনে হয় পরাজিত বিদ্রোহীদের পরিণতির সঙ্গে তার নিজের ভাগ্যও জড়িত। একটু থেমে নিজের দীর্ঘশ্বাসটি সে হজম করে। তারপর জানায় যে, ইংরেজদের হাতে তখন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এদেশী বড়োলোকেরা পরিণত হলো তাদের লাঠিয়ালে। মার খেয়ে সন্ন্যাসী-ফকিরের দল ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। যমুনা তখন ছোটো নদী, খাল বললেও চলে, তার পশ্চিম তীরে নওখিলা পরগণার এক প্রান্তে বনজঙ্গল। বনেজঙ্গলে লুকিয়ে তারা আরো বড়ো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ভবানী পাঠক কিছুদিনের জন্য এদিকে আসেন। আনোয়ার বোধ হয় জানেন যে, শেষের দিকে ভবানী পাঠক ও মজনু শাহ একজোট হয়েছিলেন। তো এখানে এসে ভবানী পাঠক মিলিত হন ফকিরদের পলাতক কিছু কর্মীর সঙ্গে। বটগাছের তলায় এই বেদী ভবানী পাঠকের তৈরি। তার কি স্থায়ী ঠিকানা থাকতে পারে? ভবানী পাঠক তাই বিদ্রোহীদের সঙ্গে কখনো চলে যান মহাস্থান, বাঙালি নদী পেরিয়ে, করতোয়া পেরিয়ে মহাস্থান-ফকিরদের বড়ো ঘাটি। কখনো বা ঘোড়াঘাট। আবার গঙ্গা পার হয়ে বিহার। কিন্তু বিদ্ৰোহ আস্তে আস্তে নিভে যায়। বিদ্রোহ নির্বাপিত হওয়ার গল্প বলতে বলতে জালালউদিনের কণ্ঠও মিইয়ে আসে, খানদানীরা কেউ অগ্রসর হয়া ফকির-সন্ন্যাসীদের সহায়তা করলো না। তার সব নীরব হয়া থাকলো।
না নীরব ঠিক থাকেনি। আনোয়ার বলে, ইংরেজদের চাকর-বাকরে পরিণত হয়ে তার হামলে পড়লো দেশবাসীর ওপর।
‘দেশের মানুষ কি করে, কও? ফকির-সন্ন্যাসীরা কি করতে পারে? যতোই কও বাপু, শিক্ষিত মানুষ, বড়ো ঘরের মানুষ যদি নেতৃত্ব না দেয় তো কিছুই হয় না। জালাল মাস্টার হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, দ্যাখো, মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম, জওহরলাল নেহরু, ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়াদি—এই সব বড়ে বড়ো ঘরের উচ্চ শিক্ষিত মানুষ অগ্রসর না হলে দেশে স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয়?
উপমহাদেশের এতো সব নেতার নাম ও জালাল মাস্টারের অলঙ্কারসমৃদ্ধ বাক্য আনোয়ারকে মুগ্ধ করে না, সে বরং পাল্টা জিগ্যেস করে, কিন্তু আন্দোলন যদি ঐসব বড়ো বড়ো ঘরের বিরুদ্ধে হয়?
বিদেশীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, তার আবার বড়ো ঘর ছোটো ঘর কি? দেশের সকল অধিবাসীর সংগ্রাম।
কিন্তু বড়ো ঘরের মানুষদের যদি বিদেশী শাসকরা পোষে, তাহলে? এই দুইয়ের স্বার্থ যদি এক হয় তাহলে বড়ো ঘরের শিক্ষিত মানুষ বিদ্রোহীদের সঙ্গে আসবে কেন?
এসব কথা জালাল মাস্টারের মাথায় ঢুকতে চায় না। ঢোকাবার সখও নাই তার। সে তখন ব্যস্ত সন্ন্যাসীকে নিয়ে। বটতলার এই আস্তানা থেকে তার নিয়মিত অন্তর্ধানের কথা সে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে। কোথায় যুদ্ধে আহত হয়ে সন্ন্যাসী একবার ফিরে এসেছিলেন। একটু সুস্থ হলে মজনু শাহের কয়েকজন সাগরেদকে নিয়ে তিনি চলে যান পশ্চিমে। সেই যুবকদের কয়েকজন ফিরে আসে, কিন্তু সন্ন্যাসীকে আর দাখা যায়নি। বটগাছের নিচে মজনু শাহ কি মুসা শাহ-জালাল মাস্টার ঠিক বলতে পারে না,-এই ২জনের ১জনের প্রধান সাগরেদ সুলতান শাহ ১টি মক্তব খোলে। সুলতান শাহ চিরকুমার, তার মৃত্যুর পর তাই ভাইপোর ছেলে কুদ্দুস শাহ করলো পাঠশালা। আবদুল কুদুসের পাঠশালা, এই অঞ্চলে খুব নামকরা ইস্কুল। নদীতে গোসল করতে গিয়ে কুদ্দুস মৌলবি কুমিরের ভোগ হলো। তারপর কোথায় মক্তব? কোথায় পাঠশালা? বৈরাগীর ভিটা তখন থেকে খালি পড়ে থাকে। দুশো পৌনে দুশো বছর আগেকার কার্যকলাপ জালাল মাস্টার যেন চোখের সামনে দেখতে পায়। কুদ্দুস মৌলবির কথা আনোয়ার আগেও তার কাছে কয়েকবার শুনেছে, এই লোকটি জালাল মাস্টারের প্রপিতামহ। এখন তার সম্বন্ধে বলতে বলতে জালাল মাস্টার হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের কারণ কি? না, এতো বড়ো মানুষের ভিটা, তার সবটা আর কি-না একটা গাছের কজায় চলে যাচ্ছে। আরে বাবা, আল্লাহর জায়গা-বসত করো, আবাদ করো, লাঙল দাও, ফসল হোক, খাও, সংসার বাড়ুক। তা না করলে? না করলে কি হতে পারে তা এই বটগাছ থেকেই বুঝতে পারো। দ্যাখো না শালার বটগাছ কি রকম ছড়িয়ে পড়ছে। এখানকার এক ছটাক জমিও কি হেলাফেলার বস্তু? এই সব জায়গা হাজার বছর ধরে সুপ্ত ছিলো নদীর জলধারার নিচে, তা নদী থেকে উঠে এসেছে, সেও কয়েক শো বছর তো হবেই। ফসল ফলাবার জন্যে তার প্রচণ্ড কামনা পানির নিচে চাপা পড়েছিলো, জেগে উঠে তাই শরীর বিছিয়ে সে তৈরি হয়ে রয়েছে। লাঙল ছোঁয়ালেই এখানে ফসল জমির কামুক শরীরে মানুষের গতর খাটালেই শস্য। অথচ দাখো, বটগাছ কিনা দিনের পর দিন মাটি দখল করে চলে। বটগাছ এদিকে বাড়ে, ওদিকে বাড়ে, ৩ বিঘা সাড়ে ৩ বিঘা জমি তো খেয়েই ফেলেছে, মাঠের ওপারে তালপোতার মানুষ ভয় পায়, একটা ডাল যদি কোনোরকমে ওদিকে যায় তো সেখান থেকে ঝুড়ি ঝুলে পড়বে, শিকড় বেরুবে, তারপর গ্রাম কি আর লোকালয় থাকবে?
আনোয়ার অবাক হয়, তাই কি হয়? যেখানে মানুষ বসবাস করছে, চাষবাস হচ্ছে, সেখানে গাছ বাড়ে কি করে?
না গো, তোমরা জানো না। এই গাছের লোভ বড়ো বেশি। মনে হয় ব্যামাক জমি না খালে এর খিদা মিটবে না। জালাল মাস্টার চোখ দিয়ে বটগাছ চাটে, আস্তে আস্তে হাঁটে, বলে, তৃতীয় রিপু শালার বড়ো উগ্ন। প্রথম রিপুর কথা আল্লাই জানো শেষ বাক্যটিকে রসিকতা বলে মনে করে সে নিজেই একচেট হেসে নেয়, হাসি থামলে বলে, কখন মাথা তুল্যা শালা মানুষের ঘরবাড়ির মধ্যে থাম্বা তোলে কেউ কবার পারে?
গাছের এরকম স্বেচ্ছাচারী সম্পপ্রসারণের কথা আনোয়ার বিশ্বাস করে না। কিন্তু সেই কথা সরাসরি বলাটাও বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে, সে জিগ্যেস করে, তা লোকে গাছ কাটে না কেন? গাছ কেটে ফেললেই তো হয়!
জালাল মাস্টার হঠৎ একেবারে চুপ করে। চুপচাপ সে হাঁটে, একটু পেছনে হাঁটে আনোয়ার। মাথার ওপর বটপ্রাসাদের শেষ অংশ। এদিকটায় রোদ বেশ উজ্জ্বল। পায়ের নিচে বটপাতার ছোটো ছোটো স্তুপ ক্রমেই আরো ছোটো হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে বোটা থেকে কি পাখির ঠোঁট থেকে খসে পড়ে পাকা বটফল। এইসব পাতা ও ফল পায়ে মাড়িয়ে কি পাশ কাটিয়ে তারা হাঁটে। এই ২জন মানুষের নীরবতার সুযোগে গাছ ভর্তি শালিক ও হরিয়ালের ধ্বনি উচ্চকণ্ঠ হয়। আনোয়ার কথা বলতে শুরু করলে সেই আওয়াজ ফের পেছনে পড়ে যায়। এই যে জমির ওপর এই মোটা ডালটা এগিয়ে এসেছে, এর থেকেই তো ঝুড়ি নামবে। ঝুড়ি ঢুকে পড়বে মাটির ভেতর, এইভাবে মাটি মানুষের হাতছাড়া হচ্ছে। কালই করমালিকে বলে এই ডাল কেটে ফেলার বন্দোবস্ত করুক না জালাল মাস্টার!
বটগাছের সীমা পার হয়ে জমির আলে পা দিয়ে জালাল মাস্টার বলে, ‘পুরান গাছ প্রাচীন কালের বৃক্ষ, বহুদিনের সাক্ষী। তাজিম করা কথা কওয়া দরকার।
জি?
না, ধরে এতোদিনের সাক্ষী। এই গাছ হলো এই এলাকার মুরুব্বি। এ্যাঁর দেহে আঘাত দিলে মুরুৰ্ব্বিক অপমান করা হয় না?
আনোয়ার হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঠের ওপারে গ্রাম দেখতে দেখতে জালাল মাস্টার বলে, বুঝলা না? গাছের আত্মা থাকে না?
‘গাছের আত্মা? মানে?
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আত্মা মানো? জালাল মাস্টার বিরক্ত হয়, গাছেরও আত্মা থাকে। বিজ্ঞানেই তো বলে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কি আবিষ্কার করছে, কও তো বাবা?
‘সে তো প্রাণ। গাছের প্রাণ আছে।’
ঐ তো। জীবের বয়স হলে তারা আল্লার রহমত পায়। পুরান গাছেরও রুহু থাকে। গাছের দেহে ব্যথা দিলে আত্মা কষ্ট পায়।’
কি রকম?
এই গাছে আঘাত করলে তার ভালো হয় না। গাছ রুষ্ট হয়।
ভালো হয় না মানে?
অমঙ্গল ঘটে।
কিভাবে? কতোভাবে হবার পারে। জালালউদ্দিন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তোমার বাপু আজকালকার শিক্ষিত চ্যাংড়াপ্যাংড়া সবই ন্যাংটা করা দেখবার চাও। মুরুব্বি মানো না! কিছুক্ষণ চুপচাপ ইটার পর সে বলে, কেউ এই গাছের ডাল কাটলে কি দেহের কোনো জায়গায় কোপ দিলে সেই মানুষের অকল্যাণ ঘটে। তার ক্ষতি একটা না একটা হবেই।’
‘সত্যি?
হ্যাঁ, তোমার সাথে মিথ্যা উক্তি করলে আমার লাভ কি? আনোয়ারের বিস্ময়কে স্বতঃস্ফূর্ত সশ্রদ্ধ ভয় বলে গণ্য করে জালালউদ্দিন উৎসাহিত হয়, তো কি? কুড়ালের কোপ দিলে সেই মানুষ রক্তবমি করতে করতে মরবে। না হলে মাথাত বায়ু চড়ে, তখন নিজেই গলাত দড়ি দিয়া মরে।’
বলেন কি? আনোয়ারের মনে পড়ে জিনের কথা, চেংটু বলছিলো এখানে নাকি জীন থাকে?
আরে ঐ ব্যাটার কথা থোও। জালাল মাস্টার চেংটুর ওপর বিরক্ত হয়েছে, জীন থাকলে আছে তো ঐ চেন্টুর কথা বাদ দাও। শালা হস্তিমূখ, শিক্ষা নাই, দীক্ষা নাই, মাথা গরম, জীন-পর নিয়া কথা কোস তুই কোন আক্কেলে?
আনোয়ার জিগ্যেস করে, এখানে কেউ মারা গেছে এভাবে?
অনেক! জালাল মাস্টার পেছনদিকে মুখ করলে আনোয়ারও সেদিকে তাকায়। শীতকালের রোদ নিদ্বিধায় শুয়ে থাকে সমস্ত মাঠ জুড়ে। মাঠের পর বটগাছকে এখান থেকে সুদূর ও নির্বিকার বনের মতো মনে হচ্ছে। ঐ বটবনের ভেতরকার অধিবাসী শালিক হরিয়ালের ঐকতান এখন বনের বাইরে আসতে না আসতে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মাঠের রোদের নিচু স্বরের সঙ্গীতের বিস্তৃত ধ্বনিতে। কানে বাজছে অন্য কোনো তৃতীয় ধ্বনি। জালাল মাস্টার তার স্বর হঠাৎ খাদে নামায়, ফিসফিস করে, গোটা ইউনিয়ন যদি হিসাব করো তো গড় ৩০/৪০ বছরে কম করা হলেও জনা দশেক মানুষের অপঘাতে মৃত্যু ঘটছে। অভাবে পড়লে চাষাভূষা মানুষের দিশা থাকে না, বিবেচনা বোধ লুপ্ত হয়, বাজারে নিয়া বেচার জন্য গাছের ডাল কাটে। কেউ কেউ কোপ মারার সাথে রক্তবমি করা মৃত্যুবরণ করছে, কেউ আবার বাড়িত যায়া গাছের সাথে দড়ি ঝুলায়া মরছে।’
‘সে তো দারিদ্রের জন্যেও হতে পারে। খেতে পায় না, ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে না- প্রতিবাদ করলেও আনোয়ারের গলাও এখন নিচু।
এইসব কথা বেশি না কওয়াই ভালো! জালাল মাস্টার বিষয়টির উপসংহার টানতে চাইলেও আনোয়ারের বুক শিরশির করে। রোদ কি ঠিক কি একটু দূরের গ্রাম, এমনকি গোটা বটবৃক্ষ ছাড়িয়ে অন্য ১টি ছায়া তার চোখে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে এই অনুমানে সে ওপরের দিকে তাকায়। না, সেখানে বিশাল শূন্যতায় কাপে কেবল সাদা। তবু, বটগাছের প্রাচীনতম বাসিন্দার উড়ালের ফলে ১টি শিক্ষা হিসহিস করে ওঠে যদি আনোয়ার জালাল মাস্টারের গা ঘেঁষে হাঁটে।

চিলেকোঠার সেপাই – ২১

রায়সায়েবের বাজারের পুলের মুখে মসজিদের উল্টোদিকে বন্ধ হার্ডওয়্যার দোকানের রকে দাঁড়ালে মানুষের আর শেষ দ্যাখা যায় না। ওসমান প্রথমে তাকায় উত্তরে। কালো কালো হাজার হাজার মাথা এগিয়ে আসছে অখণ্ড স্রোতোধারার মতো। এই বিপুল স্রোতের মধ্যে ঘাইমারা রুইকাতলার কাক নিয়ে গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে কোটি ঢেউয়ের ঢল। দক্ষিণে তাকালেও দ্যাখা যায় এই সোতোধারা কেবল এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ক্যালেন্ডারে যা-ই থাক, ঢাকায় আজ আষাঢ় মাস। উত্তর থেকে আসে বরফ-গলা শহরের স্রোত, উপচে উঠে মানুষ গড়িয়ে পড়ছে পাশের গলিতে উপগলিতে। গলি-উপগলি ভরা কেবল মানুষ, দুই পাশের বাড়িগুলোর ছাদ পর্যন্ত মানুষ। গলি উপগলি থেকে স্রোত এসে মেশে মূলধারার সঙ্গে, মানুষ বাড়ে, নবাবপুর সামলাতে পারে না, মানুষের প্রবাহ ফের গড়িয়ে পড়ে পাশের ফাকা গলিতে। ফাকা গলি কি আর আছে? সব জায়গা কানায় কানায় ভরা। ঢাকায় কি এতো লোক বাস করে? মনে হয় ঢাকা শহর তার ৩৫০/৪০০ বছরের বুড়ো হাবড়া রোগাপটকা লোনা-ধরা গতর ঝেড়ে উঠে ছুটতে শুরু করেছে সামনের দিকে। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। ওসমানের বুক ধক করে ওঠে, এই এতোদিনকার শহর কি আজ তার সব মানুষ, সব রাস্তা গলি উপগলি, বাড়িঘর, সব অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে গড়িয়ে পড়বে বুড়িগঙ্গার অতল নিচে। না দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তার শীতের শীর্ণ তনু একেবারে নিচে ফেলে উঠে এসেছে বিপুল স্ফীত হয়ে, বুড়িগঙ্গার অজস্র তরঙ্গরাশির সক্রিয় অংশগ্রহণ না হলে কি এরকম জলদমন্দ্র ধ্বনি উঠতে পারে, আসাদের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করে ওসমান, না হে, মিছিলের মাথা দ্যাখা যায় না। অনেক সামনে উঁচু ১টা বাশের মাথায় ওড়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের লাল ঝাণ্ডা। বাঁশের মাথায় এই শার্ট হলো দস্তি দারের হাতের লাললণ্ঠন। নদীর জাহাজ নয়, নদীই আজ ছুটতে শুরু করেছে দস্তিদারের লাল লষ্ঠনের পেছনে। এই পাগলপারা জলোস্রোতকে আজ সামলায় কে? ভরা বুকেও ওসমানের একটু খারাপ লাগে বৈ কি?-আনোয়ারটা এসব দেখতে পারলো না। এতো বড়ো মিছিল ঢাকায় কোনোদিন বেরিয়েছে? বেচারা কোথায় কোন গ্রামে গেলো, গ্রামে যতো আন্দোলন হোক, এতো মানুষ কি একসঙ্গে দ্যাখা যাবে? কাল ইউনিভারসিটির ছেলেকে মেরে ফেললো আইয়ুব খানের পুলিস, এতো বড়ো বিক্ষোভ ঘটে যায়, আনোয়ার কিছুই দেখতে পারলো না। আনোয়ার কি জানে যে ঢাকা এতো মানুষকে ঠাই দিতে পারে? সেই কোন ছেলেবেলায়, ৪ বছর বয়সে ওসমান ঢাকায় এসেছে। দিন যায়, লোকসংখ্যা বাড়ে, এলাকা প্রসারিত হয়। কিন্তু না, এতো মানুষ ঢাকায় সে কোনোদিন দ্যাখেনি। কোন বইতে যেন পড়েছে, শায়েস্তা খান কার আমলে ঢাকায় লোকসংখ্যা নাকি লন্ডনের চেয়ে বেশি ছিলো। সে কবে? কতোকাল আগে? ওসমানের বুক ছমছম করে: এই এতো মানুষের সবাই কি তার মতো শ্বাসপ্রশ্বাসনেওয়া মাছ-ভাত খাওয়া সাধারণ মানুষ? এই যে জনপ্রবাহ, এর অনেকের কাপড় চোপড়, চেহারা তার কাছে অপরিচিত ঠেকছে? এরা কে? তার মানে, অনেক কাল আগেকার মানুষও কি মিছিলে যোগ দিয়েছে? ঐ তো, মিছিলের মাঝখানে ইসলাম খাঁর আমলের খাটো-ধুতিপরা ঢাকাবাসী! এমনকি তারো আগে চালের বস্তা বোঝাই নৌকা বেয়ে যারা সোনারগাও যাতায়াত করতো তারাও এসেছে। বাঙলা বাজার, তাঁতীবাজারের মানুষ লুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তো ইব্রাহিম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি-পরা সেপাইরা। শায়েস্তা খাঁর টাকায়-আট-মণ-চালের আমলে না-খেয়ে-মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই,-কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মোগলের হাতে মার-খাওয়া, মগের হাতে মারখাওয়া, কোম্পানীর বেনেদের হাতে মার-খাওয়া—সব মানুষ না এলে এই মিছিল কি এতো বড়ো হয়? রেসকোর্সের কালীবাড়ির ইটের শুকনা পরত খুলে খাড়া হাতে নেমে এসেছে মারাঠা পুরোহিত, মজনু শাহের ফকিররা এসেছে, ঐ তো বুড়ো আঙুল-কটা মুষ্ঠির ঘাই ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে মসলিন তাঁতী, তাদের কালে কালো খালি গা রোদে ঝলসায়। ৪০০০ টাকা দামের জামদানী-বানানো তাঁতীদের না-খাওয়া হাড্‌ডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলছে। সায়েবদের হাতে গুলিবিদ্ধ বাবুবাজার মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন মুসল্লিরা চলেছে, বিড়বিড় করে আয়াত পড়ার বদলে তারা আজ হুঙ্কার দিচ্ছে, বৃথা যেতে দেবো না লালমুখে৷ সাহেবদের লেলিয়ে-দেওয়া নবাব আবদুল গনি-রূপলাল মোহিনীমোহনের শ্বাদন্তের কামড়েক্ষতবিক্ষত লালবাগ কেল্লার সেপাইরা আসে, ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে গলায় দড়ি ছিঁড়ে নেমে আসে মীরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, সন্দ্বীপ-সিরাজগঞ্জ-গোয়ালদের সেপাই। না হে, তাতেও কুলায় না। যুগান্তর অনুশীলনের বেনিয়ান ও ধুতি-পরা মাতৃভক্ত যুবকেরা আসে, তাদের মাঝখানে কলতাবাজারে নিহত ছেলে ২টিকে আলাদা করে চেনা যায়। নারিন্দার পুলের তলা থেকে দোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। ঐ তো বরকত মাথার খুলি উড়ে গেছে, দেখে একটু ভয় পেলেও ওসমান সামলে ওঠে। এতো মানুষ। নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠেছে আজ, ঢাকা আজ সকাল-দুপর-বিকাল-রাত্রি বিস্মৃত, আর তার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ নাই, সপ্তদশঅষ্টাদশ-ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত। সীমাহীন কাল সীমাহীন স্থান অধিকারের জন্য ঢাকা শহর আজ একাগ্রচিত্ত। ওসমানের বুক কাপে এই বিশাল প্রবাহের সঙ্গে সে কতোদূর যেতে পারবে? কতোদূর? গোলক পাল লেনের মুখে কলের নিচে কাঁপতেথাকা কলসি যেমন পানিতে ভরে স্থির হয়, আমাদের ওসমান গনির বুকটাও দেখতে দেখতে পূর্ণ হলো, এই অবিচ্ছিন্ন স্রোতোধারার ক্ষুদ্রতম ১টি কণা হয়েও তো সে এই হৃৎপিণ্ডে তাপ বোধ করতে পারছে। তাই বা কম কি? ভরা-বুকে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে সে হুঙ্কার দেয়, বৃথা যেতে দেবো না।
ওসমান!
ওসমান প্রথমে এই ডাক শোনে নি। আরেকবার ডাকলে সে চমকে ওঠে, কে ডাকে? মজনু ফকিরের কোনো কর্মী তাকে চেনে? নাকি ভিক্টোরিয়া পার্কের পামগাছ থেকে দড়ি ছিঁড়ে-আসা-বেরিলির সেপাই? নাকি সোমেন চন্দ?-কে ডাকে? তার শরীর শিরশির করে। তাকে কে চেনে? এখানে কে চেনে?
‘ওসমান! এই যে!
কে?
আরে রকে দাঁড়িয়ে কি করছেন? আসেন। শওকতের হাতের চুরুট নিভে গেছে, ফের ধরাতে ধরাতে বলে, ‘আসেন।
শওকতের পাশে চলতে চলতে ওসমান এদিক ওদিক তাকায়। ঐ লোকগুলো গেলো কোথায়? আনোয়ার থাকলে এসব কথা বলা যেতো। শওকত বিশ্বাস করবে না।
বেলাগড়ায়। বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি ইসলামপুর ধরে আরেকটি স্রোতোধারা বইছে। চাপা রাস্তায় অকুলান হয় বলে উঁচু উঁচু বাড়ির মাথা থেকে পা পর্যন্ত থৈ থৈ করে মানুষ, কেবল মানুষের পাক, মানুষের ঢেউ।
বাবুবাজারে পৌঁছে শওকত বলে, ‘চলেন কিছু খেয়ে নিই। সোয়া তিনটে বেজে গেছে। কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছা ওসমানের একেবারেই নাই। যতোই বাজুক, হোক না শীতকাল, ঢাকায় আজ ভরা বর্ষা। বর্ষাকালের মেঘহীন আকাশে কিসের দুপুর, কিসের বিকাল? এই তো একটু গেলেই বাবুবাজারের পুল, তারপর দুদিকে কেমিক্যাল ও পারফিউমারি দোকান, সুগন্ধের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে কিছুটা পার হলেই চকবাজারের ফাঁড়ি, সেখানে একটা চক্কর দিয়ে এই সোতোধারা চলে যাবে জেলখানার দিকে, জেলখানার পাশ দিয়ে নাজিমুদিন রোড। জেলখানার দেওয়াল ঘেঁষে যাবার সময় এর ঢেউ কি আরো উত্তাল হয়ে উঠবে না? এমন তো হতে পারে জেলখানার কাছে পৌছুলে এই ঢলের মুখে ভেঙে পড়লো জেলখানার মস্ত উঁচু দেওয়াল হতে পারে না? ভেঙে পড়লো জেলখানা, জেলখানার নিচে লুকিয়ে থাকা ইব্রাহিম খাঁর দুর্গ, সাহাজাদা খুররমের দুর্গ? ওদিকে চলবে এই প্লাবনের ভাঙন, আর সে কি না বাবুবাজারের কোনো এক নিচু ছাদ-চাপা রেস্টুরেন্টে বসে রুটি-গোশত গিলবে?
না, না। চলেন। শহীদ মিনার পৌঁছে না হয় কিছু খেয়ে নেবো।
‘আরে আমরা খেতে খেতে মিছিল আর কতোদূর যাবে? এতো বড়ো মিছিল, এর শেষ মাথা আসার আগেই আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাবে।’
ওসমান কোনো খুঁকি নিতে চায় না, মিছিল যদি তাদের ছেড়ে এগিয়ে যায় বলে, দরকার কি? রেক্সে গিয়ে পরোটা-শিককাবাব খাওয়াবো। এখন চলেন।’
শওকতকে ঠেকানো অতো সোজা নয়, হু কেয়ার্স ফর পরোটা-শিককাবাব? চলেন, পালোয়ানের দোকানে মোরগ পোলাও মেরে দিই।
কিন্তু ওসমানের ভয় হয় মূল স্রোতোধারা থেকে ছিটকে পড়ে একটি নিঃসঙ্গ জলবিন্দুর মতো সে আবার হাওয়ায় শোষিত না হয়। খুব আস্তে করে বলে, আপনি খেয়ে নিন। আমি যাই। কিন্তু এই কথা এতো আস্তে বলা হয়েছে যে, শওকত তাতে কান দেয় না। কিংবা শওকতের চুরুটের গন্ধে কি তার খিদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে? চুপচাপ সে শওকতকে অনুসরণ করে। ওসমানের পাশ দিয়ে মিছিল গর্জন করতে করতে সামনের দিকে চলে।
রাস্তা থেকে খুব সরু ও ছোটো গলি, তারপর ২টো ৩টে ধাপ নিচে নামতে হয়। ঘরে ঢোকার আগেই মোরগ পোলাওয়ের গন্ধ মাথা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করে। ওরা বসার কিছুক্ষণের মধ্যে ২টো প্লেট আসে, পোলাওয়ের ওপরে ২টো মুরগির রান। পাশে এনামেলের ২টো পিরিচে কলজে ও গিলা।
খেতে খেতে মুখ তুললে দেওয়ালের আয়নায় ওসমান বাঁকা-চোরা প্রতিফলন দ্যাখে। চারিদকের দেওয়াল জুড়ে আয়না, যেদিক তাকানো যায় মোগর-পোলাওতে-মনোযোগী মানুষের মুখ। এতো মানুষের প্রতিকৃতির মধ্যে ওসমান নিজেরটা খোজে। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে না পেরে তার গলা শুকিয়ে আসে, তার মুখ কোথায়? আয়নায় সবাই আছে, তো সে নাই কেন? এতো মানুষের মধ্যে সে কি তবে হারিয়ে গেলো? তাহলে মিছিলে লক্ষ মানুষের মধ্যে তার গতি হবে কি? খাওয়া স্থগিত রেখে ওসমান আয়নায় নিজের চেহারা সনাক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শওকত জিগ্যেস করে, কি হলো? আর এক হাফ আনতে বলি? বলতে বলতে শওকত হাত তুললে আয়নায় তার প্রতিকৃতি আলাদা করে বোঝা যায়। পাশে ওসমান। স্বস্তি পেয়ে ওসমান ফের রান চিবায়। তবে আয়নায় তাকে বেশিরকম ইয়াং লাগছে, চেহারাটা একেবারে বালকোচিত হয়ে গেছে। মুরগির রানের হাড়ের ভেতরকার কচুকুচে শাস তার দাঁতে জিভে টাকরায় ও গালের ভেতরদিকের দেওয়ালে অপূর্ব স্বাদ ঘনীভূত করে তোলে। এই স্বাদ কি তার জিভের ও মুখের এতোকালের আস্তরণ ভেদ করে কতোকাল আগেকার অন্য ১টি মুরগির অন্য ১টি রানের পিষ্ট আমিষকে উথিত করে তুলছে? এইতো আয়নার দ্যাখা, দিব্যি বালক হয়ে ওসমান পোলাওয়ের এাস মুখে নিচ্ছে। তার সামনে কে? একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারে যে, সামনে ক্যান্টেন। কাপ্টেনকে মনে নাই? কুাস সিক্সে, কুসি সেভেনে ক্যাপ্টেন আর ওসমান একই বেঞ্চে বসতো, বাইরে বেড়াতো এক সঙ্গে। প্রথমদিকে কিন্তু এতো খাতির ছিলো না। স্যার কাসে ঢোকার আগে গোলমাল করার জন্যে ছেলেদের নাম লেখার দায়িত্ব ছিলো ক্যাপ্টেনের, তাকে তাই যমের মতো ভয় করতো সবাই। তাকে তোয়াজ করতে করতেই খাতির জমে গেলো। আজ এতোকাল পর ক্যাস্টেনের সঙ্গে সে এই দোকানে বসে মোরগ-পোলাও খাচ্ছে ওসমানের হাসিও পায়, এতোকাল আগেকার সব ঘটনা, ঠিক মনে থাকে। আবার দাখা পরশুদিন পড়া বই দিব্যি ভুলে যাই।-ওসমান চারদিকে তাকায়, এখানে এর আগে একবারই এসেছিলো; না, সব অমনি আছে। সামার ভ্যাকেশনের আগের দিন স্যারদের সেবার মোরগ-পোলাও খাওয়ানো হলো। ছুটির আগের দিন ওদের স্কুলে ক্লাসে ছোটো উৎসব হতো। হেড স্যারের নেতৃত্বে
পাকিস্তান জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ /পুরব বাঙালার শ্যামলিমায়/পঞ্চ নদীর তীরে অরুশিমায়/’-আর কোনো লাইন মনে নাই। গান করতে করতে কেউ হেসে ফেললেও স্যরর সেদিন কিছু বলতো না। গানের পর হেডসরের বক্তৃতা, তারপর খাওয়া দাওয়া। প্রস্তুতি চলতো কয়েকদিন আগে থেকে। সাররা ক্কাসে এসে উস্কে দিয়ে যেতো। রমিজ স্যর হয়তো বললো, কি রেকটাবানরের দল, এবারও কি কদলীভক্ষণ? গতবার এই ছেলেদের কুাসে সিঙাড়া মিষ্টি কম পড়ায় ঐ স্যরদের কেবল কলা খেয়ে বিদায় নিতে হয়েছিলো। রমিজ স্যর তাই মনে করিয়ে দিলো, ‘শোন, ‘ক্সাস ফোরের সব বাচ্চা বাচ্চা ছেলে, এবার পরোটা-কাবাব-পনিরের ব্যবস্থা করছে! তোমরা সব ধাড়িগুলো ডালে বসে কদলী সেবন করো। আবার সারদাবাবু এসে উপদেশ দেয়, এবার কালচান্দরে আগেই বইলা রাখিস। কাস সিক্স আষ্ট আনা প্লেট মিষ্টি দিবো, আগে অর্ডার না দিলে ফকির মধ্যে পড়বি কইয়া রাখলাম!’
সাইনু পালোয়ানের দোকানে আগেই বলা ছিলো, সেবার কুস সেভেন মোরগ-পোলাও দিয়ে সবাইকে থ করে দেবে! ক্যাপ্টেন খুব ভোরে জানলার কাছে এসে ডাকে, এই রঞ্জ, ওঠ। রঞ্জ তো রাত থাকতে জেগে বসে আছে, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বেরিয়ে দ্যাখে তাদের রাজার দেউড়ির ভাঙাচোরা বাড়িঘরের ছাদে, লোনা-ধরা দেওয়ালে, খোয়া ও পিচ-ওঠা গলিতে কী সুন্দর গোলাপি রঙের ভোর। কয়েক পা হেঁটে ক্যাপ্টেন বলে, ল, মালাউনটারে লগে লই। শঙ্করকে মালাউন বলে ওর প্রতি নিজের দুর্বলতাকে ক্যাপ্টেন আড়াল করতে চায়। রঞ্জ এসব তখনই বুঝতো বুঝতো না কে? কুসে স্যর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যাদের নামে শাস্তিবিধানের সুপারিশ করা হয় তাদের মধ্যে শঙ্কর কখনো থাকে না। আবার স্কুলের পায়খানার সারির পেছনে একদিন স্কুলে ছুটির পর ক্যাপ্টেন আর শঙ্করকে এক সঙ্গে প্যান্ট খোলা অবস্থায় দেখছে আমিন। ব্ল্যাকবোর্ডে কে যেন একদিন লিখেও রেখেছিলো ক্যাপ্টেন + শঙ্কর। রঙু এসব খুব বোঝে।
তাতীবাজার ঢুকে প্রসন্ন পোদ্দার লেনের উল্টোদিকে শঙ্করদের বাড়ি, বাড়ির সামনে হান্ধা নীল শাড়ি-পরা একটি মেয়ে টগর ফুল তুলছে। তার হাতে বেতের সাজিতে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা। গরমের ভোরবেলাটা কি ফর্সা, মেয়েটার গায়ের রঙ ফর্সা, ওর হাতের ফুলগুলো সাদা। ঝিররির করে হাওয়া বইলে মেয়েটার বাসি মাথায় এলোমেলা চুল একটু একটু ওড়ে। কয়েক গাছি চুলের নিচে ফর্স মুখ আরো ফর্স মনে হয়। ঠিক প্রতিমার মতো। স্কুলে সরস্বতী পূজার সময় একে বেদীতে বসিয়ে দিলে কার সাধ্য ধরে যে এ আসল দেবী নয়!
ক্যাপ্টেনকে দেখে সরস্বতী প্রতিমা বলে, কি কবীর, সব রেডি? মেয়েটির উঁচু-নিচু দাত দ্যাখা যায়, তাতে প্রতিমাত্ব অনেকটা কমে, ফলে সে আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কবীর বলে, ‘মেজদি, এতো ভোরে উঠছেন? ‘ভোর কোথায়? পোনে ছয়টা বাজে, সোয়া পাঁচটায় সূর্য ওঠে, এখন কি ভোর হলো? ফুল দিয়া পূজা করবেন মেজদি?
তোমাদের সারদের পূজা। শঙ্কর অর্ডার দিয়া রাখছে, ভোরবেলা ফুল চাই। রঞ্জর ইচ্ছা করে সে-ও একে মেজদি বলে ডাক। হিন্দুদের ডাকগুলো কি সুন্দর চেহারার সঙ্গে কি চমৎকার খাপ খায়! শরৎচন্দ্রের মেজদিদির চেহারা বোধহয় এরকম ছিলো। না, সে তো অনেক বড়ো, তার ছেলেও ছিলো ১টা। আর যে কেষ্ট না ফেষ্ট তাকে মেজদি বলে ডাকতো সেটা একটা গাধা। কয়েকদিন আগে রূপমহলে নিকৃত দেখেছে, সন্ধ্যারানীর সঙ্গে এই মেজদির মিল আছে নাকি? একদিন রাত্রে আব্বার নিয়ে-আসা কোন এক ম্যাগাজিনে সন্ধ্যারানীর ফুল-পেজ ছবিতে ওসমান চুপ চুপ করে কয়েকটা চুমুও খেয়েছে। সেই কথা মনে পড়লে রঞ্জর ঠোঁট শুকিয়ে এসেছিলো। আরে নাঃ! এই মেজদি কতো রোগা, কতো ফর্সা, কতো আবছা-আবছা।
মেজদি বলে, কবীর, যাও না। শঙ্কর তো এখনো ওঠে নাই। না ডাকলে ওর ঘুম ভাঙে? ক্যাপ্টেন গটগট করে ভেতর চলে যায়। শালার হাঁটুর নিচে এখনি লোম উঠেছে বড়ো বড়ো, ফেল করতে করতে ওঠে, নইলে এতোদিন কুসি নাইনে পড়তো! ভেতরে গেলো, রঞ্জকে একবার সঙ্গে যেতে বললো না পর্যন্ত!
তুমি ওদের সঙ্গে পড়ো, না? তার জবাব না শুনেই মেজদি ফের বলে, তোমাদের ইস্কুলই ভালো, আজ হইয়া ছুটি, না? আমাদের ছুটি হতে এখনো সাতদিন। পচা ইস্কুল। দেশে যাইতে যাইতে কাচা আম একটাও যদি পাই।’
ক্যাঠা রে আরতি? ক্যাঠা? কার লগে কথা কস, এ্যাঁ? কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসে এক প্রৌঢ়, ধুতিটা লুঙির মতো পরা, খালি গা খালি পা। বলে, কি চায়?
একটু রাগ ও একটু ভয় মেশানো গলায় আরতি বলে, ‘পটুর ক্লাসমেট বাবা’ রাত পোয়াইতে না পোয়াইতে বাবুর ইয়ারবন্ধুরা সব আইস পড়ছে? বাবাকে সামলাবার জন্য আরতি বলে, ‘মর্নিং স্কুল চলতাছে তো, তাই ডাকতে আসছে। নিশ্বাসের একই টানে রঞ্জকে জিগ্যেস করে, ও মা তোমার নামই শুনি নাই। তোমার নাম যেন কি?’
শেখ মোহাম্মদ ওসমান গণি। এবার শঙ্করের বাবা হঠাৎ বলে, ‘পল্টরে ডাইকা দে। ওসমানকে জিগ্যেস করে, পল্টর কুাসমেট?
‘জী। জবাব শুনে লোকটা চ্যাচায়, অরে ডাইকা দে না পন্টু, উঠলি না? নয়টা না বাজলে বাবুর ঘুম ভাঙবে না। মানুষ খাড়াইয়া থাকবো?
তার ব্যস্ততা বাড়াবাড়ি ঠেকে। চারদিকের কেমন ফাঁকা ফাকা। কয়েক মাস আগে রায়ট হয়ে গেছে, কোনো কোনো বাড়িতে লোকজন নাই, অনেকে হয়তো কোনোদিন ফিরবেও না। কয়েকটি বাড়িতে মেয়েরা নাই, তাদের ইন্ডিয়া পাঠিয়ে পুরুষগুলো সিচুয়েশন দেখছে। শঙ্করের বাবার উদ্বেগ ও ধমক এই বাড়িতে একটু কাপন তোলে, সেই কাপুনি বশ করার জন্যেই যেন আরতি ফের জিগ্যেস করে, কি নাম যেন বললে?
রঞ্জু!’ নাম জিগ্যেস করলে ওসমান কখনো কিন্তু ডাকনাম বলে না। কেউ জানতে চাইলে পুরো নাম না বললে আব্বা খুব রাগ করে। ইব্রাহিম শেখের কাছে নাম মানে পুরো নাম, তোমার নাম শেখ মোহাম্মদ ওসমান গনি। নাম জানতে চাইলে তো বললে, রঞ্জ কি তোমার নাম? তোমাকে যেমন বাবা বারু বলি, তেমনি রঞ্জও বলি। সবসময় আসল নাম বলবে। নইলে দুটো খাসি জবাই করে আকিকা দেওয়ার কি দরকার ছিলো?
কিন্তু মেজদির সামনে ওসমান রঞ্জুই থাকতে চায়। মেজদি কি তাকে ওসমান বলে ডাকবে? দূর! তাই কি হয়?
আরতি বলে, রঞ্জু ওসমান না কি যেন বললে? এই কথায় ওসমান লজ্জায় মরে যায়। সে যেন প্রত্যাখ্যাত হলো। কি থেকে প্রত্যাখ্যাত? সহপাঠীর বোনের কাছে তার ডাকনামটা নিবেদন করেছিলো, তাই কি নাকচ হয়ে গেলো? –রপ্পুটা বড়ডো ছেলেমানুষ ছিলো শওকতের মুখোমুখি মোরগ পোলাও খেতে খেতে ওসমান গনি আপন মনে হাসে, ছেলেবেলায় সে বড়ডো সেন্টিমেন্টাল ছিলো! কি কথায় যে রাগ হতো, কোন কথায় যে তার অপমান বোধে টং করে বাড়ি লাগতো আরতিকে মেজদি বলে ডাকার সাধটা একেবারে নিভে গিয়েছিলো।
শাখারি বাজার দিয়ে বেরিয়ে ৩জন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফুলের ডালা নিয়ে বসে ছিলো ২জন মালী। রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা চলতে শুরু করেছে। ফুলের ডালার বিপরীত দিকে মাঠা মাখন নিয়ে বসেছে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা বুড়োটা। সেখানে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন কি হিসাব করে, তারপর বলে, ‘মাঠা খাইবি?
এর মধ্যে কালাচাঁদের দোকানের ঝাড়পোঁছ শেষ হয়। হাড়িতে মিষ্টি ও ঝুড়িতে ফুল দিয়ে শঙ্কর একটা রিকশায় উঠলে ক্যাপ্টেন বলে, চল না, এক প্লেট খাইয়া এক লগে যামু! না। মোরগ পোলাও খেয়ে শঙ্কর জাত নষ্ট করবে না। ওর বাবা প্রায়ই বলে, রায়টে যখন বেঁচে গেছে তার মানে ভগবানের একটা ইঙ্গিত রয়েছে ভগবানে প্রাণটা রক্ষা করলো, জাত বাঁচাবার দায়িত্ব তার সৃষ্টির। হরেন ডাক্তারকে কে বোঝাবে যে আরতির বড়োবোন সবিতার দিকে তাহের গুণ্ডার একটা চোখ বিশেষভাবে সাটা ছিলো বলে ওরা প্রাণে বেঁচে গেছে। রায়টের পর পরই সবিতাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতায়। দূর সম্পর্কের মামার বাড়িতে রেখে তার বিয়ের চেষ্টা চলছে। এরপর রায়ট বাধলে জাত ও প্রাণ ২টোর ১টাও সামলাবার দায়িত্ব ভগবান নেবে কি-না সন্দেহ।
সাইনু পালোয়ান নিজে তদারক করে হাড়িতে ৫০ প্লেট মোরগ-পোলাও পরিপাটি করে গুছিয়ে দিলো। সঙ্গে ৫৫টা কাঁঠাল-পাতার ঠোঙা। ক্যাপ্টেন ও রন্ধু ২প্লেট খায় ফ্রি। খাওয়ার জন্যে ব্যবহৃত সেই সব দাঁতে অনেক খাবার চিবানো হয়েছে, জিভে আস্তরণ পড়েছে, অথচ দ্যাখা এখনো তারিয়ে তারিয়ে গলা পর্যন্ত সেই স্বাদ নেওয়া যাচ্ছে। ক্যাস্টেন খেতে খেতে বলছিলো, আমরা খাইছি কেউরে কইবি না, বুঝলি? জলদি খা’
জলদি করেন। চুরুট ধরাতে ধরাতে এখানে এখন তাড়া দিচ্ছে শওকত। তার মুখ দাখা যায় না, ওসমান বলে, রিকশায় যাবো, স্কুলে যেতে কতোক্ষণ লাগবে?
রিকশায় যাবেন? কোন স্কুলে? শওকতের হাসির শব্দে ও চুরুটের গন্ধে ওসমানের ঘোর কাটে।
ওসমান একটু হাপায়। কয়েকটি মিনিটের মধ্যে এতোগুলো বৎসর পারাপার করার ধকল কি কম? তার আর উঠতে ইচ্ছা করে না। ধীরেসুস্থে হাত ধুয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। শওকত তখন বিল শোধ করছে। ওসমান দেওয়ালের আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আরে একি! রঞ্জ এসে পড়লো কখন? রঞ্জুর সঙ্গে কি রানুও আছে? সামনের পারদ-ওঠা আয়নায় মঞ্জুর প্রতিকৃতি, তার হাওয়াই শার্টের পকেটে এম্বডারি করা প্যাগোড়া। রঞ্জকে দাখার জন্য সে পেছনদিকে মুখ ঘোরায়, নাঃ রঞ্ছ কোথায়। রঙ্গু এখানে আসবে কোথেকে? এইসব ৫০/৬০ বছরের আয়নায় মানুষকে যে কিরকম দ্যাখায়! ওসমান ঘুরে দাঁড়ালে আয়না থেকে রন্থ অদৃশ্য হয়।
আয়নায় রন্ধুকে দেখছে মনে করে যে চঞ্চলতা ও উত্তেজনা হয়েছিলো তা কেটে যাওয়ায় ওসমানের মাথা ও বুক খুব খালি খালি লাগে। অবসাদ আরো বাড়ে। মিছিলের ল্যাজের পাতলা অংশটি তাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দোকান থেকে সিগ্রেট কিনে ওসমান সিগেট ধরায়। মিছিলের গর্জনে তার ভয় হয়, এর ভেতর ঢুকে সে কি সমান তালে হাটতে পারবে? এমনকি শ্লোগানও দিতে পারবে কি? এতো মানুষের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে তাকে চিনবে কে? শওকতকে বলে, আপনি যান, আমি ফিরে যাবো।
মানে?
আমার শরীরটা খারাপ। খুব টায়ার্ড। আমি বরং বাসায় যাই।
বাসায় যেতে হলেও তো হেঁটেই যেতে হবে। তার চেয়ে চলেন, একটু তাড়াতড়ি হেঁটে মিছিলের মাঝামাঝি চলে গেলে দেখবেন ভালো লাগবে।
শওকতের যুক্তি ও পরামর্শে ওসমান ভূ কোচকীয়, এই লোকটা অন্যের প্রব্লেম বুঝতে পারে না। এর কথার প্রতিবাদ করাও মুশকিল। তার খুব বমি বমি লাগছে। আস্তে আস্তে বলে, ‘না, আমি চলি।
শওকত তাড়াতাড়ি মিছিলে যাবার জন্য উদগ্রীব, আপনি বোধহয় খুব সিক। একা যেতে পারবেন?
খুব!

চিলেকোঠার সেপাই – ২২

শাঁখারি পট্টিতে ঢুকে পলেস্তারা-খসা ও ইট বার-করা চুনসুরকির উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে ওসমান হাঁটছে আর সেই সব বাড়িঘরের শুকিয়ে-যাওয়া মজ্জার গভীর ভেতরকার শাস থেকে সোদা সোদা ও ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে তার শরীরে। ফলে অবসাদ একটু একটু করে কাটে, শরীর ফুরফুরে মনে হয়। সেই হাওয়ার একেকটা দমক এসে হাথায় ঝাপটা মারে: ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এই রাস্তায় হঁটিতে হাটতে এরই একটা গলি ধরে সে ঢুকে পড়েছে তাতীবাজার, কিংবা বেরিয়ে গেছে ইসলামপুরের দিকে। না, শঙ্করদের বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। ক্যাপ্টেন ঐ একদিনই ওকে নিয়ে গিয়েছিলো, তা শঙ্করের কাছে যাবার সময় ক্যাস্টের কোনোদিন কাউকে সঙ্গে নিতো না। ওসমান পরে হয়তো যেতো, কিন্তু ম্যাট্রিক পাস করে আরতি কলকাতা চলে গেলো, মাস ছয়েকের মধ্যে গেলো শঙ্করদের বাড়ির আর সবাই। হ্যাঁ, ওসমানের সব মনে আছে। যতোই ইন্ডিয়া নিয়ে যাক, ঐ খাটো-ধুতি খালি গা, খালি পা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সাধ্য কি ওদের দুই ভাইবোনকে এই পাড়া থেকে শেকড়বাকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে? ওসমান এইতো শপষ্ট দেখতে পাচ্ছে, অপরিবর্তিত শাখারি পটির কলের ধারে ধারে কলসি, বালতি ও হাড়ির সারি। পাশে পাশে দাঁড়ানো শাড়ি ও ফ্রকওয়ালা ফ্যাকাশে ফর্স মুখের মেয়েগুলো। মেয়েদের ঝগড়া চলছে, তাদের নালিশ চলছে, তাদের স্বর এই আবদেরে আবদেরে, আবার পরের মুহুর্তে ঝাঁঝালো। ওসমান একটা গা-ঝাড়া নিশ্বাস ফেলে: না, এখানে অবিকল সব একই রকম রয়ে গেছে। ফ্রকের নিচে তাদের চিকন বা শাসালো পাগুলো এবং শাড়ির তলায় তাদের নিস্তেজ বা চাঙা বুক একইভাবে পুরুষের শরীরে হাওয়া খেলায়। খোঁচা খোঁচা কালো-সাদা দাড়িওয়ালা যে প্রৌঢ় লোকটি ওসমানের, এমন কি ওসমানের বাপ-দাদার জন্মেরও আগে থেকে পূর্ব পুরুষের সঙ্কীর্ণ বারান্দায় বসে রাস্তার নোঙরা নালায় সশব্দে খুধু ফেলতে ফেলতে মস্ত ভাঙা-চাদের মতো করাতে শাখ কাটতো, তার খুধু ফেলা ও শাখ কাটা আজো অব্যাহত রয়েছে। এমন কি এই ২টো নির্ধারিত কাজের মধ্যে সময় করে নিয়ে কলের পাশে পানির প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের কলাগাছের মতো পাগুলোর দিকে তার শ্যাওলা-পড়া চোখে তাকাবার অভ্যাস থেকেও লোকটা ছাটাই হয়নি।
তাঁতীবাজারে ঢুকেও ওসমান বেশ ধীরে সুস্থে হাঁটে। কিন্তু যে জায়গায় এসে সে থামবো থামবো করে সেখানকার চেহারা একটু পাল্টে গেছে। কয়েকটা বাড়ি ভেঙেচুরে এমন আকার দেওয়া হয়েছে যে ওসমানকে বারবার ওপরে নিচে এবং ডাইনে ও বায়ে তাকাতে হয়। চেনা জায়গায় থাকার ফুরফুরে ভাবটা নষ্ট হওয়ার দশা ঘটলে ওসমান টগর বা গন্ধরাজ বা শেফালি ফুলের গাছ দ্যাখার জন্য ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকায়। ১টি পুরনো অপরিবর্তিত বাড়ি তার তীক্ষ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। না, সেই বারান্দায় ঝুলও টবে অৰ্কিড, বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরতির বয়সের একটি মেয়ে। না, এই মেয়েটির পরনে সালওয়ার-কামিজ। এ বাড়ি হতেই পারে না। এরকম পর পর কয়েকটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। না, এ বাড়ি নয়। ওসমান অস্বস্তি বোধ করে এবং তার বুকের নিচে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। অথচ এরকম হওয়ার কোনো কারণ নাই। সকালবেলা ঘর থেকে বেরুবার সময় নোভালজিন ও এ্যাঁন্টাসিড ২টো করে ট্যাবলেট খেয়েছে। আবার এখন খিদে পাওয়াও উচিত নয়, একটু আগে পেট ভরে মোরগ-পোলাও খাওয়া হলো। দুৰ্ত্তোরি। তার খুব রাগ হয়। রাগের টার্গেট না পাওয়ার উত্তেজনায় ছটফট করে এবং দ্রুত পায়ে এ-গলি সে-গলি হয়ে বেরিয়ে আসে কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। আর হরতাল বলে এই রাস্তায় লোকজন কম। ছোট্রো ১টি রেস্টুরেন্টের সামনে কয়েকজন তরুণ দাঁড়িয়ে মিছিলের গল্প করছে। কিন্তু এই রাস্তাটি তার চোখে ধাবমান ছবিই রয়ে যায়, কোনো দৃশ্যে স্থির হবার সুযোগ পায় না। ওসমান বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে, মিছিলটাও মিস করলো, এখন কোথাও পৌছুঁতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৌছুঁতে হবে কোথায়? কৈলাস ঘোষ লেনের ১টি বাড়ির সামনে এসে দুরুদুরু বুকে সে বাড়িটাকে সনাক্ত করার চেষ্টা করে। এইতো ছোটো দোতলা বাড়ি, রাস্তার ঠিক ওপরে উঁচু ইট-বের-করা খয়েরি রঙের বারান্দা। দোতলা বরাদায় শিশু বটগাছের রোগা ডালপালার ভারে ঝুলে পড়েছে কার্নিশের অংশ। না। এই বাড়ি তাকে প্রতারিত করেনি। ওসমান একটু একটু হাঁপায় এবং সক্তজ্ঞ চোখে বাড়িটার দিকে দ্যাখে। এইতো নিচে রাস্তার দিকে জানলাওয়ালা ঘরটিতে ক্যাপ্টেন থাকে। সিমেন্টের প্ল্যাপে পা রেখে বারান্দায় উঠে সে আঁশ ওঠা, বৃষ্টির ঝাপ্টায় রেখা-রেখা-দাগ-হয়ে-যাওয়া এবং রোদে এবড়োখেবড়ো কাঠের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। কিন্তু ভেতর থেকে সাড়াশব্দ নাই। একটু বিরতি দিয়ে ওসমান এদিক-ওদিক দ্যাখে। উল্টোদিকের ডাস্টবিনটাও আছে, কেবল ড্রামের জায়গায় সিমেন্টের নিচু দেওয়াল। মুখ ফিরিয়ে সে ফের কড়া নাড়ে এবং ডাকে, ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন ২বার ডাকার পরও তার খুব হাসি পায়, এতোদিন পর ক্যাপ্টেন বলে ডাকলো কি করে? একি? সে কি এখনো কুাস VIB না VIIA-তে পড়ে? তাহলে কি ঘোরের মধ্যে ফের অনেকদিন আগে চলে গিয়েছিলো? এরকম যাওয়া যায়? খুশি ও কৌতুকে তার এতো হাসি পায় যে ঠোঠে হাত দিয়ে হাসি চাপতে হয়। ক্যাপ্টেন শালা আসুক, ওসমান বলবে, কি ক্যাপ্টেন চিনতে পারো? চিনতে পারলে ওসমান বলবে, দোস্ত তোমাকে শালা এতো ভয় পেতাম যে আজও নাম ধরে ডাকতে সাহস হয় না! ক্যাপ্টেন বলবে, রংবাজি ছাড়, তুই শালা আছিলি কৈ? ইস্কুলে থাকতে চিকনা আছিলি, অহনও আমসিই রইলি!’ ওসমান বলবে, তুমি আমাদের বডি-বিল্ডার ক্যাপ্টেন, তোমার সামনে সবাই আমসি’ ক্যাপ্টেন একটু হাসবে না দোস্ত বডি আর রাখতে পারলাম কৈ?
এই কাল্পনিক কথোপকথন স্থগিত রেখে ওসমান ফের ডাকে, কবীর। কবীর। এই কবীর। এইভাবে কয়েকবার ডাকার পর ওপর থেকে জবাব আসে, কে? ওপরের বারান্দার দিকে তাকাবার জন্যে ওসমানকে রাস্তায় নামতে হয়। দোতলার বারান্দায় একজন প্রৌঢ় মহিলা, ফর্স গালের মেচেতা থেকে তাকে কবীরের মা বলে চেনা গেলো, কাঠের রেলিঙে হাত রেখে জিগ্যেস করে, ‘কাকে চান?
‘কবীর আছে? ওসমান বলে, কবীর আছে? আমাকে চিনলেন না খালাম্মা?
এর আগে কবীরের মায়ের সঙ্গে ওসমানের তেমন কথাবার্তা হয়নি। ওসমান সাধারণ রাস্তা থেকেই কবীরকে ডাকতো, কবীর থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। আবার কোনো কোনোদিন ওপর থেকে টানা গলায় জবাব এসেছে না-ই!’ কবীরের মা একদিন বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেছিলো, তোমাদের ইস্কুল খুলবে কবে? ইস্কুল কি সারা বছর বন্ধই থাকে? আজ এতোদিন পর মহিলাকে খালাম্মা বলে ডাকতে ওসমানের ভালো লাগলো। মহিলা তার পুরু লেন্সের চশমা-পরা ২চোখের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওসমানকে চেনার চেষ্টা করে। ওসমান বলে, ‘আমার নাম রঞ্জ, কবীরের সঙ্গে ইস্কুলে পড়তাম।
মহিলার পাশে কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ২২/২৩ বছরের একটি যুবকের দিকে চোখ পড়লে ওসমান হাসে, ঐ তো ক্যাপ্টেন তার দিকে চোখ রেখে কি বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু না, সঙ্গে সঙ্গে সে সামলে ওঠে, ক্যাপ্টেন আমাদের আরো কালো, তার বয়স আরো বেশি। ক্যাপ্টেনের নাকের পাশে এরকম কালো তিল নাই। একেও চিনতে পারলো, এ হলো কবীরের ভাই। সগীর কি এতো বড়ো হয়ে গেছে? মায়ের ইঙ্গিতে সগীর ওসমানকে ডাকে, ওপরে আসেন।
নিচের দরজা খুলে যায়। দরজার ডান দিকে সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে রঞ্জু ওর ক্লাসের আরো ২জন ছেলের সঙ্গে একবার ওপরে উঠেছিলো। কবীরের বাবা মা সেদিন সারাদিনের জন্য কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলো। ওপরতলার বারান্দায় বসে গরমের একটি দীর্ঘ দুপুর ওরা ক্যারাম খেলে কাটিয়ে দেয়। সেই সময় কিন্তু সিঁড়ির এই ধাপগুলোকে আরো উঁচু মনে হতো। ক্যারাম খেলতে সেদিন ভয়ও হচ্ছিলো, ঘোড়ার গাড়ি করে কবীরের মা আবার কখন
এসে পড়ে। আর সেই মহিলার আহ্বানে ওসমান লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে। মোটা ও ভাঙা গলায় ঘরের ভেতর থেকে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি শোনা যায়, কে? কেডা? অ কবীরের মা, কেড়া কথা কয়? কিন্তু ওসমান ছাড়া এই গোঙনি কারো কান স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। গোঙনি আসছে সিঁড়ির ডানদিক থেকে, কবীরের ভাইয়ের পেছনে পেছনে ওসমান ঢুকলো বা দিকের ঘরে।
ঘরে ৩ রকম ৩টে চেয়ার। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ওসমান এবং মাদুর-পাতা তক্তপোষে বসে কবীরের মা। আরো আসন শূন্য থাকা সত্ত্বেও অন্য সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। চেয়ারে বসতে বসতে ওসমান বলে, কবীর বাসায় নেই? জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করেই বলে, ক্লাস এইট পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আপনাদের এই বাড়িতে কতো এসেছি? তারপর সে তাকায় সগীরের দিকে, তোমার নাম তো সগীর, না? আমাকে তুমি চিনতে পাচ্ছো?
ভাইয়ার সব বন্ধুরেই তো চিনি। কয় বছরে আরো ভালো কইরা চিনলাম। এর পরও ওসমানের মুড অবিকৃত থাকে, খালাম্মা, এই বরাদায় আমরা একদিন সারা দুপুর ক্যারাম খেলে গিয়েছি, আপনারা কোথায় যেন গিয়েছিলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে প্রায় আপন মনে বলে, ইস! কতোদিন হয়ে গেলো!
কবীরের মা আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, আপনে ইন্ডিয়া চইলা গেছিলেন না?
‘আট দশ মাসের জন্যে। আমার বাবা-মা আর ফিরলেন না। আমি ফিরে এসে অন্য স্কুলে ভর্তি হলাম। সেই থেকে কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেলো।
আপনার বাবা মা ইন্ডিয়া থাকে?
কতোদিন হয়ে গেলো, এই মহিলার সঙ্গে ওসমানের কোনোদিন তেমন আলাপও হয়নি, অথচ দাখো, সব মনে রেখেছে। ছেলেবেলার বন্ধুর মা, নিজের মায়ের চেয়ে কম কি? কথা বলতে গেলে তার গলা থেকে আঠোলো ধ্বনি বেরোয়, আব্বা ইন্ডিয়ায় থাকে। গ্রামের বাড়িতে। আম্মা মারা গেছে এখান থেকে যাবার পর কয়েক বছরের মধ্যেই। তার বলার ইচ্ছা ছিলো, আমার মা নেই খালাম্মা! কিন্তু ২/১বার চেষ্টা করে ঐ বাক্য নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে সে বলে, আমাকে আপনি বলছেন কেন?
আপনি বোধ হয়— ‘
ওসমান তাকে জোরেসোরে বাধা দেয়, আমাকে আপনি বলবেন না খালাম্মা। আমি কবীরের খুব ছেলেবেলার বন্ধু। আমার নাম রঙ্গু, মনে পড়ে?
কবীরের মা তার অনুরোধ মেনে নেয়, তোমার নাম কি কইলা? তাইলে ওসমান কার নাম?
রঙ্গু এবার নিভু-নিভু হয়ে যায়, তবু যতোটা পারে জোর দিয়ে বলে, আমারই নাম। কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধব সব ডাক-নামেই ডাকতো।
আচ্ছা। তুমি পরে আর্মনিটোলা থাকতা না?
‘জী। সেই জন্যেই তো আর্মানিটোলা স্কুলে ভর্তি হলাম। ওসমান ফের উৎসাহিত হয়।
‘কার বাড়ি জায়গির থাকতা না?
ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে ওসমান বাস করতে শুরু করে তার এক চাচার সঙ্গে, বাপের মামাতো ভাই। চাচাতো ভাইবোন ছিলো মেলা, তাদের পড়াতে হতো, চাচার স্ত্রী ঠিক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করতো না। আজ কবীরের মায়ের গলায় জায়গির কথাটি ওর খারাপ লাগলো। আমার চাচা-চাচী যে ব্যবহার করেছে তাতে কথাটার প্রতিবাদ করাও যায় না। তবে কবীরের সঙ্গে দাখা করার প্রবল স্পৃহা এইসব ফালতু ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম। সে জিগ্যেস করে, খালাম্মা, কবীর এলে আমার কথা বলবেন। ওকে বাসায় পাওয়া যায় কখন?
কবীরের মা ওসমানের চোখে ১বার সরাসরি তাকায়, তারপর হঠাৎ বলে, কবীর মারা গেছে।
ওসমান জিগ্যেস করে, কোথায় গেছে?
কবীরের মা একই ভঙ্গিতে তার বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু দ্বিতীয়বার শোনার আগেই ওসমান তার বন্ধুর পরিণতি বুঝতে পেরেছে। ভয়ানক বিচলিত গলায় সে বলে, কি? মারা গেছে?
তুমি জানো না?
না তো। কিন্তু আর কিছু জিগ্যেস করার মতো শক্তি তার হয় না।
এইতো পাঁচ বছর হইয়া গেলো। চৌষট্টি সালে রায়ট হইছিলো মনে আছে?
‘রায়টে মারা গেছে?
‘না। রায়টের আগের দিন।’
এইবার ওসমান নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেয়, কি হয়েছিলো?
কবীরের মা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরে ভয়ানক নীরবতা, এমনকি পাশের ঘরের গোঙানিও ফিরে যাচ্ছে দরজার কপাট থেকে। কিছুক্ষণ পর সগীর তার বড়োভাইয়ের মৃত্যুর কারণ জানায়, ‘খুন হইছে। গট কিলড়’
কিভাবে? কারা মারলো? কেন? ওসমান নিস্তেজ গলায় জিগ্যেস করে। কবীরের স্থায়ী অনুপস্থিতি তাকে এতোটা বিচলিত করেছে যে তার কারণ জানবার কৌতূহল তৈরি করার শক্তিও সে খুঁজে পায় না।
আর কারা? সগীর বলে, সেই সব কথা তুইলা লাভ কি? ভাইয়ার বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কারা? কার কার সাথে বিজনেস করতে নামলো, তারাই মারছে।
তারপর সবাই ফের নীরব হলে পাশের ঘরের গোঙানির আওয়াজ ফাক বুঝে ঘরে ঢুকে পড়ে, ’অ করীরের মা, অ হাসিনা, কেডারে? কথা কয় কেডা? কবীরের মা তার কিশোরী কন্যাকে হুকুম দেয়, হাসিনা দ্যাখ তো তর বাপে কি চায়? দ্যাখ না।’
কিন্তু বাপের বক্তব্য কি জিজ্ঞাসায় হাসিনার কোনো উৎসাহ নাই। দরজার চৌকাঠ ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে!
সঙ্গীর হঠাৎ খ্যাক করে ওঠে, যা না! এখানে কি দ্যাখস? যা।’ সেই বিরক্তি অক্ষত রেখে ওসমানকে বলে, ‘আপনে কিছুই জানেন না? পাঁচ বছর বাদে আসছেন বন্ধুর খবর লইতে? এতোদিন পুলিসের ভয়ে আসেন নাই?
কবীরের মা উঠে দাঁড়ায়, যাই। অর বাপের শরীর খুব খারাপ, সাত বচ্ছর প্যারালাইসিসে পইড়া রইছে। অপরিবর্তিত স্বরে ওসমানকে বলে, আমাদের উপরে খুব জুলুম গেছে। পুলিসের লোক একটা বচ্ছর খুব জ্বালাইছে। আবার কতো মানুষ যে আসছে, কেউ কয়, কবীর আমার সাথে বিজনেস করার কথা কইয়া পাঁচ হাজার টাকা নিছিলো। কেউ কয় কবীর হাওলাত নিছে তিন হাজার টাকা। আমরা খুব ভুগছি!
বন্ধুর জন্যে শোক ওসমানের দানা বাধতে পারে না। সগীরের কিংবা তার মায়ের কথাবাতায় যে অপমান বোধ করবে মনে সেরকম বলও পায় না।
বিদায় দেওয়ার জন্যে নিচে এসে সগীর বলে, ‘আপনে আছেন কোথায়?’
আমি লক্ষ্মীবাজার থাকি।
না, আই মিন আপনি কোন প্রফেশনে আছেন? কি করেন?
ইপিআইডিসি-তে কাজ করি।
‘কোন সেকশনে। কি পোস্টে?
ওসমানের জবাবে সগীর উৎসাহিত হয়, টাকা পয়সার জায়গা। আমি ফ্লাইং বিজনেস করি, আমারে একটু হেল্প কইরেন। ভাইয়া বিজনেসে নামলো, কতোগুলি শয়তানের পাল্লায় পইড়া লস দিলো। জানটা পর্যন্ত দিতে হইলো। নিজে মরলো, ফ্যামিলিটা রুইন কইরা দিয়ে গেলো। আপনারে কই, আব্বার স্ট্রোকের কজটা কি?-ভাইয়ার ডেথ।’
ওর বাবা তো কবীর নিহত হওয়ার আগে থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিন্তু এসব প্রশ্ন করে লাভ কি?
ওসমান রাস্তায় নামলে সগীর বলে, ‘আপনের এ্যাডরেসটা দিলেন না? ওসমান তার ঠিকানা দিলে সগীরও রাস্তায় নামে, তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, আমারে একশোটা টাকা দিতে পারেন? সামনের মাসে বিল উঠাইয়া আপনার বাসায় পৌছাইয়া দিয়া আসবো।
ওসমান বিব্রত হয়, টাকা তো নেই।’ আরে দেন না। সামনের মাসে মোটা বিল পাবো, ওয়াপদায় আড়ইশো ফ্যান সাপ্লাই দিলাম। আপনার বাসার এ্যাডরেস তো রাখলাম, মাসের ফাস্ট উইকে দিয়া আসবো। ওসমানের বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে তার দয়া হয়, কতো আছে? যা পারেন দেন।
প্যান্টের পকেট থেকে ১০ টাকার ১টা নোট বের করে ওসমান বলে, আর টাকা তিনেক সঙ্গে থাকলো। এই নেন। সগীরকে সে কখন থেকে আপনি করে বলতে শুরু করেছে নিজেও খেয়াল করেনি।
নোটটা হাতে নিয়ে সগীর তেতো হাসি ছাড়ে, ওনলি এ টেনার?
ওসমান এগিয়ে যেতে যেতে সগীরের উচ্চকণ্ঠ স্বাগতোক্তি শোনে, কি সব ফ্রেন্ড। দশটা টাকা দিতে জান বারাইয়া যায়, দোস্তের খবর নিতে আসছে।’
রাস্তা চিনতে ওসমানের অসুবিধা হয়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে চাপা প্যান্ট পরা কয়েকটা ছোকরা পোজ মোর দাঁড়িয়ে আশেপাশের বাড়ির জানলা ও দোতলার বারান্দা সার্ডে করছে। ওসমান এদের কাউকে চেনে না। ১টা সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় কথা বলছে৩জন লোক। কারা? কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে? উপচে-পড়া ডাস্টবিনে সামনের ২টো পা তুলে দিয়ে ১টা নেড়ি কুত্তা খাবার খোজে, এই কুকুর জাতটাকে বিশ্বাস নাই, ওসমানের দিকে হঠাৎ তেড়ে আসতে কতোক্ষণ? শাঁখারি পট্টির এই মাথায় চায়ের দোকানটা নতুন, দোকানের মুখে তন্দুরের ভেতর থেকে লোহার আকসি দিয়ে রুটি বার করে আনছে গেঞ্জি পর ১টি বালক, ব্যাটা কাজ করতে করতে ওসমানের দিকে তাকালো কেন? দোকানের ভেতর তারস্বরে হিন্দী গান চলছে, গানের সুরটা ওসমান কোনোদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারলো না। একবার ইচ্ছা হয়, শাঁখারি পট্টি ক্রস করে ইসলামপুর হয়ে চলে যায় চকবাজার। কিন্তু শাখারি রাস্তা যদি ঠিকমতো চিনতে না পারে? তাহলে? চকবাজার গিয়ে এখন লাভ কি? এই ১ঘন্টায় মিছিল কতোদূর চলে গেছে। শহীদ মিনারে মিলিত হয়েছে বিশাল সমাবেশে। রিকশা নাই, বাস নাই, স্কুটার নাই,-ওসমান কি অতোটা হাটতে পারবে? মিছিলে থাকলে মাইলের পর মাইল হাঁটলেও গায়ে লাগে না, ক্যাপ্টেনের খোজ করতে এসে সব বরবাদ হয়ে গেলো।

চিলেকোঠার সেপাই – ২৩

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসের লোকজন বেরিয়ে আসে সকাল ১০টার আগেই। মতিঝিলে বিরাট মিছিল। মিছিল ডিআইটির সামনে পৌছুলে স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শোনা যায়, ‘আরে চেয়ারম্যান, ডিআইটির চেয়ারম্যান মিছিলে ওসমান ছিলো মিছিলের মাঝামাঝি। সেদিন সে বেশ ব্যস্ত। তাদের যাদের অফিসার বলা হয় এই মিছিলে তাদের নামবার ব্যাপারে প্রেম-পত্র-লেখা কামালের সঙ্গে সে-ও বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলো। কামালের এখন প্রচুর অবসর, মালীবাগের প্রেমিকার কাছে তার হাপানির ব্যাপার ফাঁস হয়ে গেছে, প্রেমিকা ইদানীং রোগমুক্ত ১জন ছেলের সঙ্গে প্রত্যেক দিন চাইনীজ খেয়ে বেড়াচ্ছে। মিছিলের মাঝখানে চলতে চলতে কামাল ওসমানকে একটু ধাক্কা দেয়, দ্যাখেন না, ডিআইটির চেয়ারম্যান পর্যন্ত নেমে এসেছে।’
এ্যাঁ। এরা এ্যাঁকশনে নামলে আইয়ুব খান টিকতে পারে? ওদের সেকশনের প্রধান খলিলুর রহমান অন্য সংস্থার চেয়ারম্যানকে মিছিলে দেখে গদগদ হয়ে বলে, ‘আরে, ওরা হইল সব সিএসপি। পাকিস্তানের প্রথম দিকের সিএসপি। বিলিয়ান্ট প্রোডাক্টস অব দি ইউনিভারসিটি। এরা কেউরে পরোয়া করে?
কিন্তু কামাল কথাটা অগ্রাহ্য করে, কতো সিএসপি দেখলাম! কৈ আমাদের চেয়ারম্যান নামুক তো!
খলিলুর রহমান দমে না, আস্তে করে বলে, সকলের নামার দরকার কি? সরকারের মধ্যে থাইকাও সরকারের বারোটা বাজান যায়।’
সেক্রেটারিয়েটের কাছে এলে মিছিলের মূল প্রবাহ চলে যায় প্রেস কুবের দিকে। আর ছোটো ১টি ধারা টোকে আবদুল গনি রোডে। সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটে সার করে দাঁড়ানো হেলমেট ও রাইফেলধারী পুলিস। মিছিলের লোকজন রাস্তার মোড়ে সাজানো ব্যারিকেড সরিয়ে সমবেত হয় ঐ গেটের দুইদিকে। নতুন স্লোগান শোনা যায়, সেক্রেটারিয়েটের ভাইয়েরা’-বেরিয়ে এসো বেরিয়ে এসো। আইয়ুব খানের দালালদের জ্বলিয়ে মারো, পুড়িয়ে মারো’ পুলিসের সারির পেছনে গেটের ভেতরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ১টার পর ১টা স্লোগান তাদের শরীরে ঝাপ্টা দিচ্ছে। মিছিল থেকে বেশ কিছু লোক লাফিয়ে উঠে পড়ে সেক্রেটারিয়েটের দেওয়ালে। হঠাৎ কি করে পুলিসের দুর্ভেদ্য সারি ভেঙে পড়ে, হুহু করে বেরিয়ে আসে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা। আবদুল গনি রোড উপচে পড়ে মানুষে। বিপুল সমাবেশ চলতে শুরু করে কার্জন হলের দিকে। ওসমানও ঐদিকে রওয়ানা হয়েছিলো, হঠাৎ সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনে ওসমানের সমস্ত শরীর ও মাথা কেমন ফাঁকা ফাকা মনে হয়। ও দ্যাখেনি, তবে মনে হচ্ছে গুলিটা চলে গেছে ওর মাথা কিংবা বুকের ঠিক পাশ দিয়ে। লোকজনের এলোমেলো ছোটাছুটির মধ্যে সে এসে পড়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে,জিপিও-র কাছাকাছি। ছোটাছুটি করতে করতেই লোকজন স্লোগান দিয়ে চলেছে, ‘ধ্বংস হোক, নিপাত যাকা’ ১রাউণ্ড গুলির পর আর কোনো আওয়াজ নাই। মানুষ ফের দাঁড়ায় এবং ওসমানের চোখে পড়ে লাল রঙের সেই গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে জিপিও-র সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। গাড়িটা দেখে ওসমানের গা ছমছম করে অনেকক্ষণ ধরে তো সে এখানেই রয়েছে, এই রায়টকার কখন এলো? কিভাবে এসে পৌছুলো? এতো মানুষের চলমান স্রোত উজিয়ে এলো? ওই লাল গাড়িটাকে লোকে আক্রমণ করে না কেন? ওসমান তার ছমছম-করা গা একবার ঝাকালো, এই শালদের ভয় পেলেই এদের লাই দেওয়া হয়। যা হয় হোক, এই জায়গা ছেড়ে সে নড়বে না।
ওখান থেকে সত্যি সে অনেকক্ষণ সরেনি। আর আর মানুষের সঙ্গে সে-ও এদিক ওদিক থেকে কাঠের টুকরা কাগজ, গাছের শুকনা পাতা জোগাড় করে পাক-বাগিচার উল্টোদিকের ফুটপাথে স্তুপ করে ফেললো। আইয়ুব খানের মস্ত ১টা ছবি রেখে সেই স্তুপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে ওসমান তার প্যান্টের পকেট থেকে অফিসের একটা কাগজ ও লন্ত্রির রিসিট বার করে সেই স্তুপে অগুলি দিলো। আগুনের শিখার চারপাশে স্লোগান ওঠে, দিকে দিকে আগুন জ্বলো’–’আগুন জ্বলো আগুন জ্বালো! জাগো জাগো’—‘বাঙালি জাগো!’
এর মধ্যে তোপখানা রোড ও পল্টনের মোড়ে ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সামনে লোহার রডের সঙ্গে টাইট করে লাগানো মস্ত সাইনবোর্ড নিয়ে আসা হয়েছে। এটা হলো আইয়ুব খানের শাসনের ১০ বছর পূর্তির বাহাদুরি ঘোষণার বিজ্ঞাপন। আগুনের ভেতর বোর্ডটা ফেলতেই মানুষ সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো। এতো বড়ো টিনের বোর্ড দেখতে দেখতে দুমড়ে যায়। ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের পাশে সেক্রেটারিয়েটের গেট, সেই গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছিলো দমকলের গাড়ি। লোকজন ঐ গাড়ির দিকে ছুটে যেতেই সেটা ব্যাক গিয়ারে চলে গেলো ভেতরে।
দমকলের গাড়ির পলায়ন দেখে ওসমানের হাসি পায়, মানুষের বাড়িঘর দোকানপাট পুড়ে সাফ হয়ে গেলেও এই শালাদের টিকিট দ্যাখা যায় না। আর দ্যাখে আইয়ুব খানের বাহাদুরির বিবরণ বাঁচাবার জন্য শুওরের বাচ্চারা কেমন তৎপর। এইরকম ভাবতে ভাবতে ফট করে পর পর ২বার আওয়াজ হয়, ২টো শেল ফাটে এবং বাতাস হয়ে ওঠে ঝাঝালো। লাল রায়ট-কার থেকে টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছে। ঝাঁঝালো বাতাসে ওসমানের চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে, চোখ দারুনরকম জুলছে, নিশ্বাস নেওয়াটা এখন কষ্টের কাজ।
রায়ট কার মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেলো কোথায়? মানুষ এখন ছুটে চলেছে স্টেডিয়ামের দিকে। আউটার স্টেডিয়ামে খুব ভিড়। এই ভিড়ে ওসমান স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ভিড় ঠেলে ঠেলে অকারণে সে এদিকে-ওদিক ঘোরে। এরকম ঘুরতে ঘুরতে মাইকের একটি হনের সামনে এসে শুনতে পায় যে সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটের সামনে গুলিবর্ষণে দুজন মারা গেছে। তাদের লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তরুণ কোনো নেতার কণ্ঠ শোনা যায়, ভাইসব, স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনেমের লেলিয়ে দেওয়া কুকুরের গুলিতে আজ নিহত হয়েছে আমাদের দুজন ভাই। ভাইসব, আমাদের শহীদ মকবুলার রহমান ও রুস্তম আলির লাশ এক্ষুনি এসে পড়বে। শহীদ আসাদুজ্জামানের শোক-সভা আজ জানাজার পরিণত হলো কেন? কার জন্যে? ভাইসব-।
সমবেত জনতা বারবার তাকায় স্টেডিয়ামের গেটের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে কালো কাপড়ে ঢাকা দুটো মৃতদেহ কালো কালো চুলের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ভেসে আসে। তাদের বহনকারীদের দ্যাখা যায় না, মনে হচ্ছে শহীদদের লাশ যেন শূন্যে সাতার দিয়ে এগিয়ে আসছে।
ওসমানের বুকে খচ করে একটা কাটা বেঁধে গুলির সময় সে তো ঠিক ঐ জায়গাটাতেই ছিলো। ওসমান হয়তো একটুর জন্যে বিরাট এই সমাবেশের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হতে পারলো না! আহা, মানুষের উড়ন্ত চুলের টেউয়ে সাতরাবার কি সুযোগ সে হারালো।—তবে এই ক্ষোভ তার স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ১টি মুহূর্তের জন্য। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে মাইকে হঠাৎ বিকট স্বরে টাটা আওয়াজ হয়, এই আওয়াজে তার মগ্নতা ভাঙে এবং মনে হয়, আহা! একটুর জন্য সে বেঁচে গেছে। নইলে এই সমাবেশ, শহীদদের প্রতি সম্মান দ্যাখাবার জন্য মানুষের এই আকুলতা-কিছুই দ্যাখা হতো না। সে যে বেঁচে গেছে এবং বেঁচে আছে-এই বোধ চাঙা হয়ে ওঠায় ভিড় ঠেলে ওসমান এদিক ওদিক ঘোরে। ভিড়ের মধ্যে পান বিড়ি সিগেটওয়ালারা; হাতে লোহার চুলায় কেতলি নিয়ে চা বিক্রি করে এক ছোকরা। এমনকি স্টেডিয়ামের গেটে চটপটি ফুচকার ঠেলাগাড়ি। ১প্লেট চটপটি ও ৪টে ফুচকা খেয়ে ওসমান চা খেলো। খালি পেটে তেঁতুল-গোলা পানিতে চোবানো ফুচকা খেয়েও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কালো কাপড়ে ঢাকা নিহত মকবুলার রহমান ও রুস্তম আলি যেদিক দিয়ে এসেছিলো সেই গেট দিয়েই ফের উড়ে গেলো আজিমপুরের দিকে। সেদিকে না গিয়ে ওসমান চললে বাদিকে, মতিঝিলের দিক থেকে অনেক লোক ছুটে আসে, অনেকে ঐদিকেই যেতে শুরু করে। লোকজন যারা আসছে এবং যাচ্ছে সকলেরই হস্তদন্ত ভাব। মাথার উপর হালকা কালো রঙের ধোঁয়া। সম্প্রসারণমাণ একটি ছাদের মতো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত মতিঝিলে। একটু এগিয়ে গেলে দ্যাখা যায় মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বলছে। অফিসের সামনে জ্বলন্ত ২টো গাড়ি। এর মধ্যে উত্তেজিত মানুষের স্লোগান, আইয়ুবের দালাল, আইয়ুবের দালাল’-‘হুশিয়ার ইশিয়ার’ অফিসের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় ওসমানের গায়ে আগুনের তাপ লাগে, তার শরীর নিসপিস করে, সে কি কোনোভাবেই এই কর্মযজ্ঞে একটু অংশ নিতে পারে না? এর মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারের উল্টোদিকের ১টি বাড়িতে। এখানে আগুন লাগানো হলো কেন? একটু এগিয়ে যেতে শোনা যায় যে এটা মুসলিম লীগের ১ এমএনএ-র বাড়ি। লোকজন মন্তব্য করে, চুতমারানি, চুরি চামারি কইরা কি মহল বানাইছে একখান, ল, অহন ল! বইয়া বইয়া খা।’
চারদিকের আগুনের ধোঁয়ায় শীতকালের সন্ধ্যা নামে আরো তাড়াতাড়ি। কিন্তু লোকজন কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে না, মনে হয় আরো অনেক কিছু পোড়াবার দায়িত্ব সবার ঘাড়ে, দাঁড়াবার সময় তো নাই। অজস্র মানুষের সঙ্গে ওসমান গড়িয়ে পড়ে জিন্না এ্যাঁভেনুর বড়ো প্রবাহে। দোকানপাট সব বন্ধ, কিন্তু রাস্তা তাতে স্থগিত থাকেনি। রাস্তার ২দিকে আলো জ্বলছে। রাস্তা এখানে চওড়া বলে জনস্রোত একটু পাতলা। ইপিআরটিসি টার্মিনালের সামনে জটলা, টার্মিনালের গেটের পিলার ২টোর গোল গোল সিমেন্টের মাথা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙছে ২জন শ্রমিক যুবক, লোকজন চিৎকার করে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। এই টার্মিনালের পেছনে গভর্নর হাউস এখন পর্যন্ত অক্ষত। এই বাড়িটা জালানো খুব দরকার। কিন্তু ওসমান একা একা কি করে যায়? একা তার কিছু করবারই নাই, সে হলো এই বিশাল জনস্রোতের ১টি ঢেউ, ধাক্কায় ধাক্কায় গড়িয়ে চলেছে সামনের দিকে।
জিন্না এ্যাঁভেনু্য পার হবার আগেই নবাবপুর রোডে ২ পাশে আলো নিভে গেলো। নবাবপুর ১টা ল্যাম্পোস্টের ঘিঞ্জি মাথার জটায় আগুন লেগেছে। ওসমানের পাশে কে যেন বলে, ওদিকে যাবেন না, ইলেকট্রিক তারে আগুন ধরেছে আরজু হোটেলে। নিচে রেস্টরেন্টের মস্ত দরজায় আগুন জ্বলছে, দোতলাতেও আগুন। উল্টোদিকের আমজাদিয়া হোটেল থেকে চেয়ার টেবিল এনে তাও কিছু কিছু পোড়ানো হচ্ছে। তাদের আড়ড়ার কেন্দ্রেও ক্ষত বিক্ষত দেখে ওসমানের একটু খারাপ লাগে বৈ কি! কিন্তু কারেন্ট চলে যাওয়ায় অন্ধকার নবাবপুরে এই ১টি মাত্র জায়গায় আলো জ্বলছে, লেলিহান উর্ধ্বমুখ শিখা ভালো করে দ্যাখার জন্য জুত করে দাঁড়াবে বলে ওসমান ১টা জায়গা খোজে। অন্ধকারে লোকজনকে সব ছায়া ছায়া মনে হচ্ছে। এই ছায়াসমূহের মধ্যে আগুনের শিখায় দপ করে ওঠে হাড্‌ডি খিজিরের ভাঙাচোরা গাল। তার ১টি হাতে রয়েছে প্লায়ার। ব্যাটা বোধহয় গ্যারেজে কাজ করতে করতে হঠাৎ চলে এসেছে, জিনিসটা রেখে আসতে মনে ছিলো না। তার অন্য হাতটি ওপরে তুলে ধরা। এখান থেকে তার ভাঙা গালের উঁচু হাড়গুলো আগুনের আভায় লাল দ্যাখাচ্ছে, তাকে হঠাৎ খুব বিশিষ্ট বলে মনে হয়। খিজিরকে ডাকার জন্য ওসমান একটু এগিয়ে যায়, ভিড়ের মধ্যে যতোটা এগোনো সম্ভব। কিন্তু ওসমানের ডাক তার কানে পৌছুচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ডে সে মহা মগ্ন মনে হয়, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে-ই। এখন দগ্ধ বাড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মসূচী দেওয়ার কথা ভাবছে।
এর মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, কারফ্যু, কারফ্যু দিছে।’ সাড়ে সাতটা থাইকা কারফ্যু। বাড়ি যান, সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি যান। আবার কে যেন চিৎকার করে বলে, কারফ্যুর মারে বাপ। আমরা কারফ্যু মানি না! অন্ধকার নবাবপুর জুড়ে স্লোগান ওঠে, আইয়ুব শাহী’-‘ধ্বংস হোক!
লোকজন কিন্তু কমতে শুরু করে। কোন ১টি ট্রানজিস্টর সেট থেকে শোনা যায়, সাড়ে সাতটা থেকে শহরে করফু জারি হয়েছে। কতিপয় দুস্কৃতিকারী শহরে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে, সরকারী ও বেসরকারী সম্পত্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। আইন রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে ও নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। রাস্তায় কাউকে দ্যাখামাত্র সেনাবাহিনীর লোক সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করবে। এর পর লোকজন দ্রুত হাটতে থাকে। ১টি গুলির আওয়াজ আসে, একটু বিরতি দিয়ে আরো কয়েকবার গুলি চলে। কয়েকটি লোক গুলিস্তানের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে, বড়োকাটরায় পাবলিকে মুসলিম লীগ অফিসে আগুন দিছে। পুলিস গুলি করতাছে।’
খিজিরের সঙ্গে কথা না বলে ওসমান ভালোই করেছে। একবার দেখতে পারলে ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল হতো। ঠিক এই সময় খিজির এসে দাঁড়ায় তার পাশে, ‘আপনে? চলেন!
চলো’ ওসমান কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চায় না। এখানে থাকার জন্যে অনুরোধ করার কোনো সুযোগই খিজিরকে দেবে না। তাড়াতাড়ি চলো। সাড়ে সাতটা থেকে কারফ্যু, সোয়া সাতটা বোধহয় বাজে।
‘চলেন।’ খিজির কি ভয় পেয়েছে? তাহলে অন্ধকারে আগুনের আঁচে লাল মুখটা কি ওসমান ভুল দেখলো?
হাটতে হাটতে খিজির বলে, চলেন ঠাঁটারি বাজার দিয়া বারাই। দেইখেন, দেইখা পাও ফালায়েন, তারতুর ব্যাক পইড়া রইছে!
বঁদিকের রাস্তার মাথায় লম্বা লম্বা ইলেকট্রিক তার পড়ে রয়েছে মুখ থুবড়ে, বিদ্যুৎইন তারগুলো নিশপন্দ পড়ে থাকে মরা সাপের মতো। খিজির ভয় পেয়েছে ভেবে ওসমান স্বস্তি পায়, ওসমানের পদক্ষেপ তাই বেশ দৃপ্ত।
ওসমান জিগ্যেস করে, হোটেলে আগুন লাগাবার মানে কি? এটা কি গভমেন্টের বাড়ি? লাগাইবো না? খিজির খুব উত্তেজিত, মিছিল যায় আর হোটেলের মালিক হালায় উপর থাইক্যা দুইটা পানিভরা ঠিলা ফালাইয়া দেয়। এতোগুলি মানুষরে বেইজ্জত করে, হালাগো হিন্মতটা দেখছেন? বুঝলেন না? সইবার পারে না। গরীব মানুষ সিনা ফুলাইয়া রাস্তার মইদ্যে নাড়া লাগায়া হাঁটে, হালাগো কইলজা এক্কেরে ফালা হইয়া যায়! এতোগুলা মাইনষেরে তরা বেইজ্জত করস, পাবলিকে উংলি চুষবো? ওরা দুজন হাটছিলো বিসিসি রোড ধরে, তাদের পাশে আগুন ধরা হোটেলের দেওয়ালে। কথা বলতে বলতে খিজির হঠাৎ থামে। কি হলো? খুব মোটা-সোটা ১টা লোক হোটেলের পেছন দিয়ে বেরিয়ে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। তার পাশ দিয়ে লোকজন ছুটে যাচ্ছে হনহন করে। খিজির ফিসফিস করে, ফ্যাটি সোহরাব মালুম হয়! হায় হায়! চাল্লি হালায় বহুত মুসিবতে পড়েছে!’ ১ ভদ্রলোক হাটতে হাটতে বলে, ‘হ্যাঁ, হোটেলে ছিলো। আগুন লাগার পর বেরোতে গিয়ে হয়তো পড়ে গেছে! লোকটি চলে যায়, আরেকজন গতি কমিয়ে বলে, ঐ বডি নিয়ে এখন যাবে কি করে? সে-ও চলে যায়।
খিজির বলে, খাড়ান! মোটা লোকটির দিকে তাকিয়ে ওসমানের হাসি পায়। চলচ্চিত্রের কুাউন হয়ে লোকটা তার উপযুক্ত পেশা বেছে নিয়েছে। এতো বেঢপ মোটা যে কোনোরকম অভিনয় না করলেও তার চলে, তাকে দ্যাখামাত্র দর্শক হাসতে শুরু করে। কিন্তু তার দিকে ভালো করে তাকাবার পর ওসমানের হাসি মুছে যায়। তার ডান পায়ের পাতা আগুনে অনেকটা ঝলসে গেছে, পোড়া প্যাটের ফাক দিয়ে পায়ের ওপর ১টা ফোস্কা দ্যাখা যাচ্ছে, ফোস্কাটা মনে হয় বেশ বড়ো, তার শরীরের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়েছে। ব্যাটা কি পরিমাণে মদ টেনে ঘুমিয়েছিলো, এাঁ?ঠাঁটারি বাজার, আলু বাজার এমনকি এদিকে সিদিক বাজারের মানুষ পর্যন্ত এই আগুন-লাগা দেখে ছোটাছুটি করছে, আর সে কি-না তার বিশাল শরীরটাকে বিশালতর প্যান্টশার্টের ভেতর গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমায়? আহা, বেচারা এখন যায় কোথায়? শরীর দেখে মনে হয় সুস্থ অবস্থাতেই সে ঠিকমতো হাটতে পারে না, আর এখন তো রীতিমতো আহত।
ফ্যাটি সোহরাবের হাত ধরে খিজির বলে, ‘হায় হায়! আপ কেতনা মাল পিয়া থা ওস্তাদ? তামাম দুনিয়াক আদমি হালা হাউকাউ কর রাহা, আওর আপ আরামসে নিদ রাহা? তারপর তার পিঠে হাত রেখে বলে, মেরা হাত পাকড়িয়ে! কৌতুক-অভিনেতা ফ্যাটি সোহরাব কোকাতে কোকাতে জানায় যে আলুবাজারে লুৎফর রহমান লেনে তার বন্ধু থাকে, একটা রিকশায় উঠিয়ে দিলে সে সেখানে যেতে পারে। খিজির ফের হাসে, রিকশা কাহা ওস্তাদ? আজ ইস্ট্রাইক নেহি? তার হাসি আর থামে না, হাসতে হাসতে কোনো চলচ্চিত্রে এই অভিনেতার ১টি সংলাপ আওড়ায়, আরে বেগমসাব, তড়পাতে কিউ? ফিকির মত কিজিয়ে আগর আপ গির যায়ে তো ম্যায় খামোশ বয়ঠে কায়সে ইস দরিয়া মে দোনো কেলিয়ে কাফি জায়গা নেহি মিলেগা? ওসমান বলে, বাদ দাও খিজির, তাড়াতাড়ি চলো। খিজিরটা কি গাধা নাকি? এ কি রঙ্গতামাসার সময়? আর আহত মানুষটাকে নিয়ে সে কি শুরু করলো? খিজিরের কি দয়ামায়া নাই? খুব বিরক্ত হয়ে খিজিরকে সে ধমকায়, ভদ্রলোককে ছেড়ে দাও খিজির চলো, তাড়াতাড়ি চলো চল্লি-সম্বন্ধে ভদ্রলোক বলায় খিজির ফের একচোট হাসে, তারপর বলে, ‘ছাড়লে যাইবো কৈ? পায়ের মইদ্যে বহুত চোট পাইছে। দেখছেন? বলতে বলতে তার হাসির নতুন দমক ওঠে, ওস্তাদ, ডাকু লড়কি মে আপ ক্যায়সা করকে গিরা থা, ইয়াদ হ্যাঁয়?
ওসমান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, লোকটার কি কিছুমাত্র বিবেচনা বোধ নাই? একটু আগেই না এর রাগী ও ভাঙ্গাচোরা গাল গরম লোহার মতো ভয়ানক দ্যাখাচ্ছিলো! অথচ কিছুক্ষণ যেতে না যেতে তার এ কি তামাশা? খিজির বলে, ‘চলিয়ে ওস্তাদ, আপকো আলুবাজার পৌঁছ দে। তারপর সেই বিশাল মোটা দেহটি তার হাড়গিলা গতর দিয়ে ঠেক, দিয়ে সামনে যেতে যেতে ওসমানকে বলে, ‘আপনে যান গিয়া৷ ইনারে দোস্তের বাড়ি দিয়া আহি!
ওসমান অস্থির হয়ে বলে, কারফ্যু আরম্ভ হয়ে গেছে। তুমি ফিরবে কিভাবে? ফ্যাটি সোহরাবের শরীরের দিকে তাকিয়ে খিজিরের বোধহয় আরো ফিল্যের কথা মনে পড়ে, কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে বলে, কি করুম? মোটা মানুষ, পাও একখান তো গেছে, একলা যাইবো ক্যামনে?
আবার কোথেকে স্লোগান ও গুলিবর্ষণের আওয়াজ আসে। লোকটিকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে খিজির বলে, বহুত ভারি মাল! দশখান মাইনষের লাশ মালুম লয় পাকিন কইরা ফালাইয়া রাখছে!’ ফ্যাটি সোহরাবকে ধরে এগোতে এগোতে খিজির একবার পেছনে তাকায়, আপনে যান গিয়া!
১টি কথা না বলে ওসমান হন হন করে উল্লোদিকে হাঁটে। র্যাঙ্কিনস্ট্রিটেও কারেন্ট নাই। অন্ধকার বাড়ির সামনে জটলা করে লোকজন ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়ে। ফাঁকা হয়ে আসছে। ওদিকে কোথায় গুলি হচ্ছে তো হচ্ছেই। কারফ্যু শুরু হয়ে গেছে, কখন মিলিটারির লরি এসে ব্রাশ-ফায়ার শুরু করবে! বনগ্রামের মাথায় কয়েকজন লোক দেখে সে ঐ রাস্তাতেই ঢোকে এবং বনগ্রাম লেন হয়ে হেয়ার স্ট্রিটের এপারে ও ওপারের মুচিপাড়া পেরিয়ে পৌঁছে যায় গোপীকিষণ লেনে। এখানটা ঘোরতর অন্ধকার ও সাঙ্ঘাতিক নির্জন। এখন এই রাস্তার শেষে টিপু সুলতান রোড ধরে গেলে তার আর রক্ষা নাই, ঐ রাস্তাটা একেবারে খোলা, নারিন্দা বা নবাবপুর যে কোনো দিক থেকে আর্মির গাড়ি আসতে পারে। সে তাই নবাব স্ট্রিটে পা দিয়ে ফের র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের দিকে রওয়ানা হলো। অন্ধকার ও ছমছমে নির্জন রাস্তা! কারফ্যু আর আর্মি! আর্মি আর কাফু উদ্বেগ ও ভয়ে ওসমান খুব তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গন্তব্য ও হটবার উদ্দেশ্য হঠাৎ ঝাপশা হয়ে আসে। বুকের টিপ টপ আওয়াজ কানে বাজে প্রায় ঘন্টাধ্বনির মতো। এতো জোরে ঘন্টা বাজায় কোন দপ্তরি? রঞ্জুর কি স্কুল ছুটি হলো? স্কুল ছুটির পর ক্যাপ্টেনের পেছনে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন শালা আছে শঙ্করের সঙ্গে কেটে পড়ার তালে। যাক ওরা যেখানে খুশি যাক, রঙ্গু একা একা তাতী বাজারে গিয়ে আরতির সঙ্গে একটু গল্প করবে। ক্যাপ্টেন জানতেও পারবে না। কোথেকে একটা ঘর্ষর আওয়াজ এসে তাকে চমকে দিলো, একি, ক্যাপ্টেনকে গুলি করে মেরে ফেললো নাকি?—আওয়াজটা আসছে ওপর থেকে। ওপরের দিকে ঘাড় তুলে ওসমান দ্যাখে একটু দূরে দৈনিক পয়গাম অফিসের ছাদে জলপাই রঙের পোষাক ও হেলমেট পরা আর্মির লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে সার বেঁধে। ওখান থেকেই মাইকে কারফ্যু জারি ও কারফ্যু অমান্যকারীদের শাস্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। ঐসব লোকের হাতে অটোমেটিক ফায়ার আর্মস। তাহলে ক্যাপ্টেন আসে কি করে? সমস্ত ব্যাপাটা বড়ো রহস্যময় ঠেকে। হয়তো এই রহস্যময় ও অলৌকিক দৃশ্যের তাড়ায় তার পা ২টো পরিণত হয় ডানায় এবং সে প্রায় উড়ে চলে। র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের টিপু সুলতান রোড ক্রস করে ওসমান পৌঁছে যায় ভজহরি সাহা স্ট্রিটে। পদ্মনিধি লেন পার হয়ে পুকুরের ধার দিয়ে হেঁটে দোলাই খালের ওপর এবড়োখেবড়ো-করে-ফেলা নতুন মাটির স্তুপ ডিঙিয়ে কলতাবাজারে পৌঁছেও তার ভয় কাটে না। এদিক কম হলেও লোকজন চলাচল করছে। এদের মধ্যে নিহত ক্যাপ্টেন শালাও থাকতে পারে। আর্মির সঙ্গে একজোট হয়ে ও কি তাকে তাড়া করছে? বাড়িতে যেতে হলে লক্ষ্মীবাজারের সদর রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয়। তবে এমন সব গলি উপগলি আছে যেগুলো তাকে প্রায় কোলে করে নিয়ে আস্তে রেখে দেয় এমন জায়গায় যেখান থেকে ঠিক ৫টা ৬টা স্টেপ পার হলেই বাড়িতে ঢোকার দরজা। ভেজানো দরজা ঠেলতেই খুলে গেলো। তবু বলা যায় না! আর্মির গাড়ি কিংবা নিহত কাপ্টেন তার পিঠ তাক করে ট্রিগার ছুড়লেই সিঁড়ি থেকে সে গড়িয়ে পড়বে নিচে। না, তা হতে দেওয়া যায় না। এতো জনাকীর্ণ রাস্তাঘাট, এতো মিছিল, এই রাগী শহর-সব, সবই অব্যাহত চলবে, আর সেই কেবল মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে এই সিঁড়ির নিচে? অতো সোজা?
ওসমান লাফিয়ে ওপরে উঠছিলো। দোতলা অতিক্রম করে গেলে পেছন থেকে তীব্ৰগতিতে এসে বিদ্ধ করে ২টো শব্দ, এতোক্ষণে আসলেন? আরো ২টো ৩টে ধাপ পেরিয়ে ওসমান পেছনে তাকায়। রানুকে সম্পূর্ণ দেখতে না দেখতে তার চোখজোড়া শাস্তিতে বুজে আসে। রানুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের রেশ তার কানে গুনগুন করে। ওসমান খুব ঝান্ত পায়ে এবার আস্তে আস্তে আরো ২টো ধাপ ওঠে, রানুর শুকনা গলার ফ্যাসফেসে ধ্বনিও তার সঙ্গে ওপরে ওঠতে থাকে। এবার সে নামে, ঘুরে দাঁড়িয়ে সরাসরি রানুর দিকে তাকায়। ঘোলাটে আলোতে তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রানু নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।
কয়েক পলক দাঁড়িয়ে ওসমান ফের নেমে এসে ধাক্কা দেয় রঞ্জুদের দরজায়, ডাকে, রানু রানু। এই দরজায় এসে সে রানুকে কখনো ডাকেনি। এখানে এলে রঞ্জু বলে ডাকতে তার ভালো লাগে এবং এই নামটা বেশ মোলায়েম ও স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা যায়। আজ কিন্তু রানুকে ডাকতে তার একটুও সঙ্কোচ হলো না।
দরজা খুললো রঞ্জ। খুলেই বলে, আপনে গেছিলেন কৈ কন তো? সন্ধ্যাবেলা না কারফ্যু দিছে! আমি ভাবলাম উনি হয়তো আর্মির হাতে গুলি টুলি খাইছেন? গুলি লাগলে আর আসতেন ক্যামনে?
ওসমানের একটু খারাপ লাগে। রঞ্জু কি ওসমানের মৃত্যু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলো না? দ্যাখা হওয়া দরকার রানুর সঙ্গে। রানু কোথায় গেলো? রঞ্জকে পাত্তা না দেওয়ার জন্যেই সে জোরে জোরে জিগ্যেস করে, রানু কোথায়?
জানেন, আজ কতো জায়গায় আগুন দিছে? পাবলিকে মিলিটারি টিলিটারি কিছু মানে না। দরজায় দাঁড়িয়ে রঞ্জ এক নাগাড়ে কথা বলে। ছেলেটার এই ১টা দোষ রানু কিন্তু এরকম নয়। রানু বরং তার কথাই শুনবে। ওসমানের এখন ১জন শ্রোতা চাই। তারানু ছাড়া তার কথা আর শুনবে কে? দরজায় দাঁড়িয়েই সে উঁচু গলায় বলে, ‘আরে আমি তো বাইরেই ছিলাম। দুপরবেলা সেক্রেটারিয়েটের সামনে আগুন জ্বালানো হলো আমার সামনে। মর্নিং নিউজ অফিস পোড়ানো হলো আমার সামনে। তারপর, আরজু হোটেল চেনো? আমার সামনে আগুন জ্বালালো। বড়ো কাটরায় মুসলিম লীগ অফিস পুড়ে শেষ। গভর্নর হাউসে গেলাম, মোনেম খান কোনদিক দিয়ে পালিয়ে গেছে, না হলে ব্যাটা পুড়ে মরতো! তার কথার সবটা সত্যি নয়, কিন্তু বলতে বলতে কোনটা ঘটেছে আর কোনটি ঘটেনি ওসমান নিজেই বুঝতে পারে না।
তার কথা শুনে দরজায় চলে এসেছে মকবুল হোসেন, ‘ভেতরে আসেন, ভেতরে আসেন। বসেন। আপনে সারাটা দিন আছিলেন কৈ, কন তো? রানু বললো আপনে ঘরে ফেরেন নাই। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। বসেন। ঘরে একটা ভাঙা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসতে যাচ্ছিলো ওসমান। মকবুল হোসেন একেবারে হা হা করে ওঠে, আরে এই চেয়ারে বসেন। এখানে বসেন।
ওসমান বিনা দ্বিধায় এই সম্মান গ্রহণ করে এবং হাতল ছাড়া ভালো চেয়ারটিতে বসে সারা দিনের দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাড়ে।
মকবুল হোসেন বলে, যাই কন, এইগুলি বাড়াবাড়ি। শৃঙ্খলা না থাকলে মানুষ সুখে থাকে ক্যামনে, কন? গভমেন্ট খারাপ, তো এ্যাঁরে সরাইয়া অন্য গভমেন্ট বসাও। কিন্তু এইরকম হট্টগোল কইরা, জ্বালাইয়া পুড়াইয়া লাভ কি?
ওসমান বেশ জোর গলায় জবাব দেয়, বাড়াবাড়ি করছে কে? কথা বললেই গুলি, টিয়ার গ্যাস। মানুষের মিনিমাম রাইট নেই। গভমেন্ট বাড়াবাড়ি করলে পাবলিক এ ছাড়া কি করতে পারে?
রানু আসে চা ও টোস্ট বিস্কুট নিয়ে। সরকারের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে জনতার কার্যকলাপে সে ঘোরতর সমর্থন জানায়, মানুষ খালি বইসা মার খাবে? পুলিশ মিলিটারি যদি গুণ্ডার মতো হয় তো মানুষ কি করতে পারে?
রানুর মন্তব্যে অভিভূত ওসমান কোনো কথা বলতে পারে না। তখন ভেতর থেকে আসে রানুর মায়ের একটানা কান্নার শব্দ। বাইরে আজ কোথায় কোথায় গুলিবর্ষণের খবর শোনবার পর থেকে মহিলা এভাবে কেদেই চলেছে। ওসমানের মনে হয় আজকের সব ঘটনার এতোটা বর্ণনা সে না দিলেই পারতো। চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়, যাই ঘরে যাই। রাত হলো!
আপনে তো খান, নাই? রাত্রে খাবেন কোথায়? রানুর এই কথায় মকবুল হোসেন মহা হৈচৈ করে। তাইতো, কারফ্যুর ভেতর ওসমান আবার খেতে যাবে কি করে? ওসমান এদের সঙ্গে খেতে রাজি হলে মকবুল হোসেন ভেতরে গেলো।
রানু বলে, ঠিক আছে, আপনে যান। হাতমুখ ধুইয়া বিশ্রাম করেন। রঙ্গু ভাত দিয়া আসবে।
ওসমান তার দিকে সরাসরি তাকায়, তুমি যাবে না? বলেই ফের যোগ করে, তোমার পড়াশোনা কি মাথায় উঠলো?
ভাত তরকারি নিয়ে এসেছিলো মকবুল হোসেন। বেশ স্বাভাবিক গলায় ওসমান বলে, কাল বোধহয় অফিস টফিস হবে না। রানুকে বইপত্র নিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। পরীক্ষা তো এসে গেলো।
খাওয়ার পর ওসমান সটান শুয়ে পড়ে। এক নাগাড়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রানুর এতোক্ষণে আসলেন’-শব্দ দুটোর রেশ কানে গুনগুন করলে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসলো না, রানু কোথায়? মাথার ওপর এক ঝাক মশার বিরতিহীন গুঞ্জন। লেপের বাইরে বেরিয়ে-পড়া পায়ের পাতায় এখনো শুড় আটকে রয়েছে বেশ কয়েকটা মশা। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লে ঘুম আর ভালো করে জমে না। সিঁড়ির দিককার দরজায় হাল্কা পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে কি? রানু কি পা টিপে পা টিপে ওর কাছে আসছে? রানু যদি এসে ওর পাশে বসে, যদি বলে, মশা খাইয়া একেবারে শেষ কইরা ফালাইলো-দূরা তাই কি হয়? কয়দিন আগে অফিসের বস ১৯৬৯ সালের ১টা ডায়েরি দিয়েছে, কাল রানু পড়তে এলে ওটা ওকে দিয়ে দেবে। রানু কি বিছানায় ওর পাশে বসবে? সেই সময় ওর গলা জড়িয়ে ধরে ওকে পাশে শুইয়ে দেওয়া যায় না?-দূর। এই মেয়েটার ভাবনা তার ঘুমটা নষ্ট করে দিলো। ছাদে একটু পায়চারি করে আসবে নাকি? গা থেকে লেপ সরিয়ে ওসমান একবার ওঠার উদ্যোগ নিলো। না, ঠাণ্ডা লাগছে। লেপটা গায়ে দিতেও ইচ্ছা করে না। এর মধ্যে কুস্তিতে চোখ জড়িয়ে আসে। কিন্তু মতিঝিল কি নবাবপুরের আগুনের আঁচে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। পাতলা ঘুম কি তন্দ্রায় আগুনের শিখার পাশে দ্যাখা যায় হাজার হাজার মানুষের লালচে শক্ত মুখ। কিন্তু ওসমান নিজেকে কোথাও খুঁজে পায় না। স্বপ্নে মানুষের ভিড়ে নিজের চেহারা ঠাহর করতে গিয়ে তার চোখ খচখচ করে। একবার খিজিরের মতো কাউকে দ্যাখা গেলো। হ্যাঁ, খিজিরই তো। ঐতো ১ হাতে প্লায়ার, অন্য হাতে কোরোসিন তেলের গ্যালন ভরা টিন। স্বপ্লের মধ্যেই মনে হয়, খিজিরের হাতে তো টিন ছিলো না। তাহলে ওটা কে? ১বার দ্যাখে খিজির তার লাল রেখা-উপরেখা খচিত চোখে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আগুনের শিখায় অতো দাখার বস্তু কি আছে? খিজির মনে হয় শিখার ভেতরকার শাস দেখে নেওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। স্বপ্নে দ্যাখা এই আগুনের ওমে ভোরের দিকে ওসমান গড়িয়ে পড়ে গভীর ঘুমের ভেতর।

চিলেকোঠার সেপাই – ২৪

খিজিরকে নিয়ে রহমতউল্লার সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলে। ছেলেবেলা থেকে সে তার কাছেই মানুষ হলো, অথচ তার বেয়াদবি এখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তার বস্তি থেকে তাকে উঠিয়ে দেওয়া দরকার। তবে ন্যায়নিষ্ঠার খাতিরে বাড়িওয়ালা জুম্মনের মাকে থাকতে দেবে। কারণ, শয়তানি করবো একজন আর তার গুণাগারি দিবো আরেকজনে? হাজব্যান্ডের লাইগা তো ওয়াইফরে পানিশমেন্ট দিবার পারি না।
খিজিরকে বস্তি থেকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর রহমতউল্লা তার বাড়ির বাইরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে গা এলিয়ে অপরাধ ও শাস্তি সম্বন্ধে তার মতামত ব্যক্ত করছিলো। বলতে বলতে সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ঐ হালায় একটা নিমকহারাম, জাউরা চোদা, আর খাচরামির লাইগা অর বৌরে খাদাইমু ক্যান? অরে অর্ডার দিচ্ছি, তুই একলাই ভাগ। তার মুখে পানের পিক। আজকাল জর্দা-দেওয়া পানের পিক গিললে মাথাটা কেমন চক্কর দেয়, ঘাড়ের রগ টনটন করে। কথা বন্ধ করে রহমতউল্লা পিকদান নিয়ে আসার জন্য কাকে ইশারা করে। ছোকরামতো এক চাকর পিকদান আনতে গেলে তার কথা স্থগিত থাকে। এই নীরবতার প্রথম ২০/৩০ সেকেন্ড সবাই চুপচাপ ছিলো, কিন্তু এরপর সমবেত মানুষের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যায়। কে যেন বলে, অর বৌ একলা থাকবো ক্যামনে?
‘আরে অর আবার বৌ? বজলুর ভাঙা গলা ঘর্ষর করে ওঠে, জাউরা হালার আবার বাপই কি আর বিবিই কি?’
আলাউদ্দিন মিয়ার ১জন রিকশাওয়ালা বলে, উই গেলে কি আর বৌরে রাইখা যাইবো? বৌ ভি অর লগেই যাইবো!
রহমতউল্লার ১ রাজমিস্ত্রী মনিবের মতে সায় দেয়, বৌরে তোমাহাজনে বাইন্ধ্যা রাখবো না। মাহাজনের কথা হইলো, চোরের লাইগা চোরের বিবিরে তো ধরা যায় না।’
আরে মিয়া রাখো মহাজনের সমর্থককেও বজলু কথা বলতে দেবে না। ওর মেজাজটা আজ চড়া। ম্যাটিনি-শোর আগে বিশ্ৰী কাণ্ড ঘটে গেলো। গুলিস্তানে আজ নীলো-ওয়াহিদ মুরাদের নতুন ছবি ছাড়লো, বেলা সাড়ে দশটা থেকে হলের সামনে হাউস ফুল ঝুলছে। ‘হাউস ফুল অবশ্য বজলুরাই করে রাখে। তা ম্যাটিনিতে ভিড়ও হয়েছিলো খুব। ম্যানেজার ও দারোয়ানকে খাজনা দেওয়ার পর কম করে হলেও ২০টা টাকা ওর হাতে থাকতো, কিন্তু শালার পাবলিক হঠাৎ খুব গরম হয়ে উঠলো। রিয়ার স্টল ডিসি, রিয়ার স্টল ডিসি বলতে বলতে হলের সামনে রেলিঙের ধার ঘেঁষে বজলু ঘোরাঘুরি করছে, হঠাৎ একসঙ্গে ঝাপিয়ে পড়লো কমসে কম ১০/১৫ জন লোক। সঙ্গে এলোপাথাড়ি কিলঘুষি ও গালাগালি, শালা র্যাক করো, না? দাঁড়া শালা, তোদের ব্ল্যাক করা দেখিয়ে দিচ্ছি।’ এদের বেশির ভাগই কলেজ ইউনিভারসিটির ছাত্র, একেকটা নম্বরি বিচ্ছ। তার পিঠের বা দিকটা এখনো টনটন করছে, সোজা হয়ে বসে থাকতে পাচ্ছে না। আলাউদ্দিন মিয়ার রিকশাওয়ালাকে সে জোরে ধমক দেয়, চুপমার রে, তুই জানস কি? কামরুদিনের বৌরে ভাগাইয়া লইয়া আনছে। অর আবার বৌ কাঠা? কামরুদিনে মনে করলে নিজে বৌ লইয়া ঘর করবো, কার কি?
এর মধ্যে পিকদানী এসে যায়, শ্লেষ্মা কক্ষসহ অনেকটা পিক ফেলে রহমতউল্লা হাতের তেলোয় ঠোঁটের কোণ মেছে। কফমুক্ত গলায় রহমতউল্লা দ্বিধাহীন ও স্পষ্ট বাণী ছাড়ে, কামরুদিনে তো অর পোলারে লইয়া আলাদা থাকে। আমি কই মায়েরে ছাইড়া পোলায় থাকে ক্যামনে? এই নিমকহারাম কি কামরুদিনের পোলারে দেখবো, কও?
খিজিরে তো জুম্মনরে লগে রাখবার চায়। উই তো না করে নাই। রহমতউল্লাহর গ্যারেজের আরেক রিকশাওয়ালা এই মন্তব্য করলে বজলু তার পিঠের ব্যথা অস্বীকার করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, ‘তুই হইলি বাঙ্গুচোদা একখান খিজিয়া হালায় নিমকহারামের পয়দা নিমকহারাম। ঘরের মইদ্যে মহাজন অরে থাকবার দিছে, অর মায়েরে ভি থাকবার দিছিলো, অর খাওয়াইয়া বড়ো করছে, বিয়া দিছে, কাম দিছে। অহন মালিকের গিবত কইরা বেড়ায়, মিটিঙের মইদ্যে ফল পাড়ো ঐ হালায় মাইনষের পোলারে রাখবো নিজের কাছে?
রহমতউল্লার উত্তেজনা বোঝা যায় না। ডাক্তার তাকে উত্তেজিত হতে না করেছে। তার ব্লাড প্রেশার আজকাল বেশ বেশি, ওপরে ২০০ এবং নিচে ১০০/১১০ এমনকি ১২০ পর্যন্ত ওঠে। কপাল কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে সে বজলুর কথা শোনে।
সেদিন রাত্রে বস্তির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে বজলু। সঙ্গে আরো কয়েকজন, এসব ব্যাপারে অন্তত ৩ জন না হলে কাজ হয় না। খিজিরকে বস্তিতে ঢুকতে দেখে বজলু বলে, খিজিরা, তর লগে কথা আছে?
কি? কিন্তু বজলু কথাটা বলে না। তার সঙ্গীরা সব তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। কিছুক্ষণ পর খিজির বলে সর,ঘরে যাই।
অপমানিত হওয়ার মতো ভঙ্গি করে বজলু, কইলাম না কথা আছে।’
কি কথা জলদি ক। স্বর একটু নামিয়ে বজলু বলে, কাউলকা তুই এই ঘর ছাইড়া দিবি। মাহাজনের হুকুম’ খিজির এবার সোজাসুজি বজলুর চোখের দিকে তাকায়। রাস্তার ল্যাপোস্টে বাব আজ কয়েকদিন জ্বলছে না, জায়গাটা এমনিতে অন্ধকার, এর ওপর খিজিরের গলার ছায়া পড়ায় বজলুর মুখের কোনো অংশই বিশেষভাবে দাখা যায় না। অন্ধকার বজলুর দিকে দেখতে দেখতে খিজির বলে, মহাজনে আমারে কইলেই পারে তরে পাঠাইছে ক্যালায়? আমি ভাড়া দেই তরে?
খিজিরের এই বিরক্তি ওদের বেশ সুযোগ করে দিলো। বজলুর এক সঙ্গী বলে, হাড্‌ডির মনে লয় নয়া নয়া পালিশ লাগতাছে। বহুত গিরিজ মালুম হয়।
লোকটিকে খিজির ভালো করে দ্যাখে। এ লোকটিও রিকশাওয়ালা, গোপীবাগ ন৷ টিকাটুলির দিকের ১ গ্যারেজ থেকে রিকশা নেয়। আর যে লোকটি চুপ করে আছে সে হলে বজলুর সিনেমা হলের সহকর্মী, মধুমিতার পেছনে ১টি দেওয়ালের এপাশে ওপাশে ওদের ভালো ১টা আড়ড়া আছে, খিজির কয়েক বার এদের কাছ থেকে টিকেট কিনেছে। বজলুর এই সহকর্মী এবার প্রায় আপন মনে বলে, যার খায় যার পরে, তারেই ধইরা হোগা মারে? লোকটির ছন্দোবদ্ধ বাক্যের জবাবে খিজির ব্যবহার করে সরল গদ্য, মাগনা খাই না, খাইট খাই। মাগনা থাকি না, ভাড়া দিয়া থাকি।
বজলু বলে, কাম তো করে তর বৌ। মাহাজনের বাড়ির মইদ্যে তারে নাম ল্যাখাইয়া তুমি হালায় তামান দিন বাউলি মারো অহন আবার মাহাজনেরে বেইজ্জত করবার চাস, না? মাহাজনের বালটা ছিড়বার পারবি?’
বজলুর সিনেমা হলের সঙ্গী এগিয়ে আসে, ফালতু কথা, আজাইরা বাতচিত কইরা লাভ কি? তোমারে খবর দিয়া গেলাম, তুমি মাহাজনের ঘর ছাড়বা।
ছাড়ম’। বলতে বলতে খিজির বস্তির ভেতর ঢোকে, মগর মহাজনে আমারে কইবো না? ভাড়া বাকি রাখছি? কইলো আর উঠলাম? আমার বৌ-পোলা আছে না? আগো দরিয়ার মইদ্যে ভাসাইয়া দিমু?
বজলুর ঘরের ভেতর থেকে খিলখিল করে হেসে ওঠে ওরা বৌ, হাসির সঙ্গতে তার এইসব কথা শুরু হয়, ‘হ, পোলাপান দিয়া ঘর এক্কেরে ভরাইয়া দিছে। আঁটকুইড়া, আটকুইড়ার বাচ্চা আটকুইড়া, অর আবার পোলাপানের হাউস’
বজলুর সিনেমার সহকর্মী লোকটি হো হো করে হাসে, আরে আটকুইড়ার বাপে আটকুইড়া হয় ক্যামনে? বাপে পয়দা না করলে আটকুইড়া হালায় দুনিয়ার মইদ্যে আইবার পারে?’
বজলুর বৌ বাইরে এসে দাঁড়ায়, তার গলায় খিলখিল হাসির রেশ রয়েই গেছে হয়, হয়। কতো কি হইতে পারে। বুইড়া একদিন যার লগে হুইছে অহন ধরছে তার পোলার বৌরে দুইদিন বাদে আবার এই মাগীর পোলারে দিয়া গতর টিপাইয়া লইবো কতো দেখলাম! আরো কতো দেখুম!
বজলুর সহকর্মী ফের হাসে। এই হাসাহাসিতে চটে গিয়ে বজলু ধমক দেয়, চুপ কর। তুই এখানে কি করব? ঘরে যা!
বজলুর বৌ তবু দাঁড়িয়ে রইলো দেখে বজলু তাড়া দেয়, মাগী গেলি? কি হইছে? তুমি একলাই চিল্লাইবার পারে, আমাগো মুখ নাই? বজলু এবার তারস্বরে চ্যাচায়, রাইত বাজে বারোটা না একটা, মরদ মানুষ দেইখা খানকি মাগীর খাউজানি উঠেছে, না? যা!
তুমি তো পট্টির মইদ্যে গতরখান ঝাইড়া আইলা, নিজের বিবিরে খানকি কইতে শরম করে না? বজলুর বৌ অবিরাম কথা বলে, কেমুন মরদ, এ্যাঁ? মাহাজনে তরে জুম্মনের মায়ের চুচির ধামাটা হাতের মইদ্যে তুইলা দিবো? রাইত একটার সময় নিজের বৌ পোলারে রাইখা মাহাজনের ভাউরামি করো কোন আক্কেলে, এ্যাঁ? আরে বেজাতের পয়দা, ঐ মাগীর উংলিটা কি ধরবার দিবো তরে? বজলুর বৌয়ের চিৎকারে রহমতউল্লার ছোটো উপনিবেশটিতে কারো কারো ঘুম ভাঙে, কেউ ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরে। ১টা ঝামেলার সম্ভাবনা আঁচ করে বজলুর রিকশাওয়ালা সঙ্গী খিজিরকে বলে, তুমি মিয়া রংবাজি ছাড়ো। কাউলকা তুমি এই ঘর ছাড়বা। তোমার বৌ মাহাজনের বাড়ি কাম করে, মাহাজনে তারেই খালি থাকবার অর্ডার দিছে।’
খিজির বলে, ঠিক আছে! মাহাজনের লগে কথা কই তোমরা কি মাহাজনের মানিজার? ঠোঠের দুই কোণ বাঁকা করে সে ফের বলে, ভাড়া দেই মাহাজনের হাতে, কথা কইলে তার লগেই কমু। মাহাজনে যুদিল ভাড়া উড়া বাড়াইতে চায় তে খোলাসা কইরা কইলেই পারে!’
খিজিরের এরকম ভদ্রলোক ধরনের চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথায় লোকটি জড়সড় হয়ে তাকে দ্যাথে। এমনকি এই কথার তোড়ে জুম্মনের মা পর্যন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বস্তি মাত করে স্বামীকে বকে, এই তারা কথা কইয়াই তো মরলা। থাকার মইদ্যে আছে কি? না, ঐ চোপাখান! গতরের মইদ্যে নাই আধাপায়া গোশতো, পাদ দিলে খটখটাইয়া বাজে, তার চোপাখান দ্যাখো? জুম্মনের মায়ের এই সংলাপে বস্তি বেশ গুলজার হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি নিজের বেয়ের চুল ধরে টানছে বজলু। এখানে আসার আগে ৩জনে পাইট তিনেক মাল টেনে এসেছে, তাতে পিঠের ব্যথা বোঝা যাচ্ছিলো না। ব্যথাটা আবার চাগিয়ে উঠলো, ওদিকে হাতের কবজিতে জোর কম। গালাগালি করার শক্তিও তার প্রায় নিঃশেষিত, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বৌকে মারা ও গাল দেওয়া-এই ২টো কাজ একসঙ্গে করা একটু কঠিন। তার নীরবতার সুযোগে আমার গতরে হাত দিবি না কইলাম! খানকি পট্টির মইদ্যে গিয়া তর মায়েরে বইনেরে চুল ধইরা টান, বাল ধইরা টান’-এই বাক্যসমূহের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে বজলুর বৌ। ১বার বজলুর হ্যাঁচক টানে তার মাথাটা স্বামীর বুকে লাগার সঙ্গে সঙ্গে ঐ মাথা দিয়েই সে এমন গুতো দেয় যে লোকটা দড়াম করে পড়ে যায় ছোটো উঠানের এপাশ ওপাশ জুড়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বীরত্বের অবসান ঘটে এবং প্রায় কাদা কাদো গলায় বলে, আমারে ম্যাইরা ফালাইলো, খানকি মাগি আমারে খতম কইরা দিলো!
রিকশাওয়ালা সঙ্গী তাকে তুলতে গেলে তার শরীরের ভারে নিজেই পড়ে পড়ো হয়ে কোনোরকমে সামলে ওঠে। তখন বজলুর দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে সবাই জুম্মনের মায়ের আক্ষেপ শুনতে শুনতে তার মুখ ও বুক দেখতে শুরু করে।
আমি কই, মাহাজনের কাছে যাও। গিয়া কও, ভুল ১টা হইয়া গেছে, এইসব মাপ কইরা দেন। জুম্মনের মায়ের গলার স্বর এখন অনেকটা নিচু। গলা আরো নামিয়ে সে বলে, গিয়া কও আপনার ভাইগ্লার কাম করি, মহল্লায় তার মিটিঙের মইদ্যে না থাকলে চাকরি থাকবো? আসলে এইভাবে সে মহাজনের বিরুদ্ধে খিজিরের কথিত তৎপরতার একটি কৈফিয়ৎ দাঁড় করাতে চায়। কিন্তু খিজির বলে, ‘আরে তুই চুপ কর না! মিটিঙে যাই কি আলাউদ্দিন মিয়ার লাইগা? তামাম ঢাকার মানুষ মিটিং করে না? মানুষ চেতছে, তর মহাজনের বাপের বাপ, দাদার দাদা, আইয়ুব খানের দিন বলে খতম হইয়া আইতাছে, তার হোগার মইদ্যে আড়াই ইঞ্চি মোটা পাইপ ঢোকে, তার ফাল-পাড়া দ্যাখে ক্যাঠায়? আর তর মহাজনের পাছ খাউজায়, না? আরো তর মাহাজনে তো কীড়ার ভি অধম!
বজলুচিৎপটাং হয়ে শুয়ে রয়েছে ছোট্রো সরু উঠানে, ১টা পা তার নিজের ঘরের দরজায় কাছে। তার বড়ো বড়ো নিশ্বাসের আওয়াজে মনে হয় লোকটা গভীর ঘুমে অচেতন। এদিকে থিজিরের চটাং চটাং কথা শুনে বজলুর সঙ্গীরা একটু ঘাবড়ে গেছে। কিংবা বজলুকে ছাড়া চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার ঘুম থেকে উঠে এসেছে বস্তির কয়েকজন পুরুষ। এতো রাত্রে বজলুদের এই অভিযানে ওদের সায় না-ও থাকতে পারে। সিনেমার সহকর্মী বজলুর বৌকে বলে, ঐটারে ভিতরে ঢুকাইয়া দেই?
থাউক না! ফজলুকে ঐ অবস্থায় রেখে বাইরে চলে যেতে যেতে বজলুর এক সঙ্গী খিজিরকে বলে, খিজিরা, লেকচার রাখ। লেকচারের মায়রে বাপ! কাউলকা ঘর খালি করবি, বুঝলি? কামরুদিনে এই ঘর ভাড়া লইবো, বৌ-পোলা লইয়া থাকবো!
সবাই যার যার ঘরে চলে যাওয়ার পর আধ ঘন্টার মধ্যে মানুষের ঘুমের গম্ভীর ও একটানা আওয়াজ সমস্ত বস্তি জুড়ে সরব কুয়াশার মতো কুগুলি পাকিয়ে ফেরে। এমনকি মেঝেতে শুয়ে থাকা খিজিরের কথা-মোড়ানো অন্ধকার কাঠামো দেখে জুম্মনের মা বোঝে সেও ঘুমিয়ে পড়েছে। কবরেও এর চেয়ে চঞ্চলতা থাকে। থাকে না? মরা মানুষের গোরআজাব নাই? এই লোকটা কি মরার চেয়েও অসার-আরে, কাল রাত্রে কোথায় থাকবি, কোথায় থাকবে তোর রোয়াবি? মাটিতে শুলেও মাথার ওপর ১টা ছাদ আছে, এখানে থেকে বার হয়ে ছাদ পাবি?—ফালতু ফুটানি জুম্মনের মায়ের দুই চোক্ষের বিষ? এই হার্ডডিসার মানুষটার আছে কি যে দিনরাত খালি বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে গোলমাল করবে? এমনিতে তো লোকটা খারাপ ছিলো না। বস্তির আর সকলের মতো দিনরাত কথায় কথায় বৌয়ের গায়ে হাত তোলে না। কখনো কখনো মদ খেয়ে এসে কোনো কারণে মেজাজ চড়ে গেলে চড়টা চাপড়টা দেয় বটে, কিন্তু প্রথম কয়েকটা লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে খিজিরের সরু ও শক্ত আঙুলগুলো আপনিই সিটকে আসে, হাত ২টোই যেন কুঁকড়ে যায়, সে তখন নিজের ১ হাত অন্য হাতের ওপর ঘষতে থাকে। এরকম ঘষতে কিছুই না বলে হঠাৎ বাইরে চলে যায় এবং সেদিন ফেরে একেবারে গভীর রাতে, আরো ১টা পাইট গিলে। আজকাল অবশ্য গায়ে হাত তোলে আরো কম। তা জুম্মনের মায়ের ওপর তার রাগ করার সময়ই বা কোথায়? আলাউদ্দিন মিয়ার গ্যারেজের কাজের সঙ্গে তার নতুন চাকরি জুটেছে রাজ্যের মানুষ জুটিয়ে মিছিল করা আর মিটিং করা আর নামী মানী মানুষের হোগায় উলিবাজি করা। এভাবে কতোদিন চালাবে? জুম্মনের মা কি ততোদিন পর্যন্ত বসে থাকবে? কিসের গরজ তার? আবার সে কি ইচ্ছা করলেই হাড্‌ডি খিজিরের মতিবদলের জন্যে বসে থাকতে পারে? এর মধ্যে কামরুদিন এসে তার ছেলেসুদ্ধ তাকে দখল করে নেবে না? মহাজন কামরুদিনকে প্রায় প্রতিদিন খবর পাঠচ্ছে, দোলাই খালের ওপর রাস্তা তৈরির কাজে তাকে দরকার। অথচ দাখো, এই মহাজনই কিছুদিন আগে প্রচার করেছিলো যে ভারা থেকে পড়ে গিয়ে কামরুদিনের হাত পা ভেঙে গেছে, জোগানদারের কাজ করার ক্ষমতা তার চিরকালের জন্য শেষ। মহাজনের এখন দরকার, এখন শোন যাচ্ছে তার মতো মিস্ত্রি এই এলাকায় ১টাও নাই। একবার জুম্মনের মাকে খিজিরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মহাজন যে ছ্যাকটা তাকে দিয়ে দিয়েছে কামরুদিন কি সহজে আসে? পুরনো বৌ ও ছেলের সঙ্গে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার টোপ দেখিয়ে তাকে পটাবার চেষ্টা চলছে।–নাকি খিজিরকে চিরকালের জন্যে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে তাকে কামরুদিনের সঙ্গে সেঁটে দেওযার মতলব করে মহাজন? -কামরুদিনের ঠাং ভাঙার গল্প সত্যি হলেই বরং ভালো হতো।–নাঃ তা কেন? কামরুদিনের সঙ্গে থাকলে জুম্মনের একটা গতি হয়। পোলার দিকে ওস্তাগারের খুব টান! জুম্মনের জনের পর বাচ্চার জন্যে কতো জিনিস যে সে নিয়ে এসেছিলো তার লেখাজোকা নাই। ঐ খুশিতে বৌয়ের জন্যেও কামরুদিন টেবিলিন না কেরিলিনের শাড়ি নিয়ে আসে। ওস্তাগার তখন কাজ করে র্যাঙ্কিনস্ট্রিটের মস্ত এক বাড়িতে, পুরনো বড়ো বাড়ি, সারা বছর ধরে টুকটাক মেরামত, ছোটোখাটো নতুন কাজ লেগেই থাকতো। বৌকে নতুন শাড়ি পরিয়ে, ৪২ দিনের বাচ্চাকে নিয়ে কামরুদিন গেলো মনিবের বাড়ি। মনিবের বৌ বাচ্চার হাতে ৫টা টাকা দেয় আর জুম্মনের মায়ের পরনের শাড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে। মনিবের বড়ো বেটার বৌ বলে, ও আম্মা, নতুন একটা শাড়ি উঠলে তা পরার জো নেই। মিঞ্জি জোগানদান দারোয়ান ড্রাইভারের বৌ-ঝি সবাই যদি এই শাড়ি পরে তো আমরা কি করি? শাশুড়ি মাগী অ্যাবার ঠেস দিয়ে বলে, কি জানি বাপু, চলনসই একটা কাপড় নিতে আমাদের পাছ ফাটে, এদের এতো পয়সা যে কোথেকে জোটে? তোমার শ্বশুর সাদাসিধে মানুষ, রড সিমেন্টের কি দশা হচ্ছে, কোনো খোজ রাখে?—মনিবের বেটার বৌয়ের কথা শুনে জুম্মনের মা খুব খুশি, এতে বড়ো ঘরের বৌ,-সেও কিনা জুম্মনের মায়ের শাড়ি দেখে হিংসায় মরে! রাত্রিবেলা রসিয়ে রসিয়ে এসব গল্প করলে কামরুদিন একেবারে উঠে বসলো, ‘সোহরাব সাবের বিবি এই কথা কইছে? ঐ কাপড় পিন্দন বাদ দে।
জুম্মনের মা অবাক। কেন? কামরুদিন ধমক দেয়, আবার কথা? কইলাম পিন্দিস না। পরে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলে, মালিকের লগে পাল্লা দেওন ভালো না, বুঝলি? যার নেমক খাই তার উপরে টেক্কা মারতে গেলে খোদায় ভি গোস্বা হয়। গজব পড়ে, রোজগারপতি পাইড়া যায়। জুম্মনের মা মন খারাপ করে পাশ ফিরে শোয়। তা মন খারাপ হলেই কি রাগ কমে? আর বিবিসাব যে তোমারে চোর কইলো, তুমি রড-সিমেন্ট সরাও
‘চোর? কইছে তা কি হইছে? মায়ের লাহান বুড়া মানুষ, একটা কথা কইছে তো তাই লইয়া মাতম করতে হইবে?
দেদারসে রড-সিমেন্ট সরালেও কামরুদিন মালিককে ভক্তি করতো খুব। চুরি-ছ্যাচরামি একটু আধটু না করলে কি সংসার চলে? তাই নিয়ে মালিক তো কথা বলবেই। মালিকের বড়ো ধরনের লোকসান না করে এদিক ওদিক করার মধ্যে কোনো দোষ নাই। তবে হ্যাঁ, মালিকের সঙ্গে বেয়াদবি করা কি মালিকের মনে কষ্ট দেওয়া গুনা। মালিকের উন্নতি মানে তার উন্নতি, মালিক বড়ো হলে সেও বড়ো হবে। বেশির ভাগ কস্ট্রাক্টর তো আগে ওস্তাগর ছিলো, বড়ো জোর এজি অফিসের কেরানী বা ওয়াপদার ওয়ার্ক সুপার-ভাইজার। পয়সাকড়ি চালাচালি করে আর আল্লারসুল গওসল আজমের দোয়ার বরকতে তারা আজ বড়ো বড়ো কন্ট্রাক্টর সাপ্লায়ার। মালিক হলো বাপমা; খাওয়া বলো পরা বলো, আরাম বলো ফুর্তি বলো, সবই মালিকের বরকতে। মালিক যদি চড়টা চটকানটা দেয় তো মাথা পেতে নাও। কেন, বাপমা ছেলেমেয়েকে মারে না? এই বিবেচনা না থাকলে উন্নতি করা যায়?–আর খিজির? -খিজিরের ওপর জুম্মনের মা ভরসা করবে কোন আক্কেলে?-তুই হইলি পাছাফুটা জাহেল, তুই যাস মহাজনের পিছে লাগতে?-ভিক্টোরিয়া পার্কে সেদিন খিজিরের কারবারটার বৃত্তান্ত শুনে রহমতউল্লার হাপানি-পোষা, কোনেদিকে-না-তাকানো বিবিটা নতুন করে হাসফাস করে আর বলে, ‘খানকির পুতে এইগুলি করে কি? অতোগুলো মানুষের সামনে মাহাজনের গীবত করছে। দিনকাল খারাপ, পাবলিকে যুদিল চেইতা এই বাড়িতে আগুন লাগাইয়া দিতো! শুনে জুম্মনের মা ভয়ে বাঁচে না! এই যে চারদিকে নাকি সব আগুন লাগানো শুরু হয়েছে, আমাদের মহাজনের বাড়িতে যদি আগুন লাগায়! আর পাবলিক কি খালি আগুন লাগিয়েই ক্ষান্ত দেবে? মহাজনকে চুল ধরে বাইরে টেনে আনবে না? তারপর ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে নিয়ে মারধোর করে যদি রাস্তায় রিকশা, স্কুটার, ট্রাক, বাস সব জাম, রিকশাওয়ালা রিকশা ছেড়ে, স্কুটার ড্রাইভার স্কুটার ছেড়ে, ট্রাক ড্রাইভার ট্রাক রেখে এসে এলোপাথাড়ি কিলঘুষি চালাতো মহাজনের ওপর।-বস্তির অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে জুম্মনের মায়ের ভয় জ্বলে ওঠে উত্তেজনা হয়ে, সে ছটফট করে। কেন? না, পাবলিক এসে মহাজনের চোখ দুটো উপড়ে নিচ্ছে, বলছে, হালায় অজাতের পয়দা, তরে আউজকা জানে খতম করুম’ চোখজোড়া গেলে এই বুড়ো কি সময় অসময়ে তার দিকে তাকাতে পারবে?—বুইড়া হালার হাউস কতো ঘরে তর বিবি আছে, একটা বিবি তো মরছে, পোলায় বাইচা থাকলে তার পোলাপানের ভি বিয়ার বয়স হইতো!—আর তুই কিনাট্যারাইয়া টারাইয়াতর কামের মাতরির সিনা দাখসােতর মুখের মইদ্যে ম্যাচবাত্তি জ্বালাইয়া দিলে খিজিরে কি বেইনসাফির কামটা করতো? তর গুনাগরি দিতে হইবো না? আল্লার দুনিয়ার বিচার নাই? বেলাহাজ, বেশরম বুইড়া মরুদ-আল্লার বিচারের ওপর ভরসা করেও জুম্মনের মায়ের উত্তেজনা কমে না। কিন্তু বেশি উত্তেজনা তার সহ্য হয় না। সারাদিন একটানা কাজ করেও তার শরীর এলিয়ে পড়েনি, বরং রহমতউল্লা মহাজনের জ্বলন্ত মুখের কথা ভেবে উত্তেজনায় তার গা মাথা হাত পাহি হি করে কাপে। খিজিরের পাশ ফেরার সঙ্গে হঠাৎ-নিশ্বাসের আওয়াজে তার ছটফট-করা শরীরে উস্কে ওঠে নতুন স্বস্তি: এই বুইড়াই তো মাথার উপরে একখান ছাদ দিয়া রাখছে।—মহাজনের বস্তিতে ভাড়া হয়তো একটু বেশি, কিন্তু এরকম নিশ্চিও কাজের সুযোগ সে পাৰে কোথায়? আবার সুবিধা কতো-বিবিসায়েব বারোমাস বিছানায়, একমাত্র মেয়ে থাকে স্নো-পাউডার-লিপস্টিক আর রেডিও নিয়ে। কাজের মাতরির সঙ্গে খ্যাচাখেচি করার কেউ নাই। প্রতিদিন ইচ্ছামতো কাজ করো, এটা সেটা মুখে দাও, ঘরে ফেরার সময় গামলা ঠেসে ভাত নাও, আর সুযোগ বুঝে মেয়েটার ড্রেসিং টেবিল থেকে ক্ষো পাউডার হাতাও। এরকম আর কোথায় পারে? তার দিকে বুড়োর হেঁদলকুতকুতে চোখজোড়া না থাকলে কি এতো সুখ তার কপালে জোটে? যতোই হোক, বুড়ো কিন্তু এ পর্যন্ত বাড়াবাড়ি কিছু করেনি। করার লোভ যে ১৬ আনার জায়গায় ১৮ আনা তা তার বুকের দিকে বুড়োর আঠালো চাউনি দেখেই বোঝা যায়। এই লোভটা থাকলেই জুম্মনের মা এই বাড়িতে টিকে যাবে। তা যাই বলো, জোয়ান মনিবও ২/৪টা তার দ্যাখা আছে, ওগুলোকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। একদিন সম্বন্ধীর গায়ে-হলুদের উৎসব কি শালীর ছেলের পানচিনিতে বৌকে পাঠিয়ে দিয়ে কাজের মাতারির হাতে ৫টা টাকা গুঁজে পাশে নিয়ে শুয়ে পড়বে। তাও কিন্তু বিছানায় নয়। শোবার ঘর তাদের মসজিদ, সব সময় পাক সাফ রাখা চাই। ভাড়ার ঘর কি রান্নাঘর, এমনকি বাথরুমেও কারবার সারতে তাদের আপত্তি নাই। এরকম ২দিন, ৩দিন, বড়োজোর ৪ দিন করলেই সায়েবদের সখ মিটে যায়। তারপর নিজের নিজের পটের-বিবি মার্ক বৌদের ওপর মোহাব্বত উথলে ওঠে তাদের। সায়েব মানুষরা সব কতো ঢঙ জানে, কয়েকদিন একটু চোর চোর ভাব করে থাকবে। তারপর নিজেদের অপকর্মের জন্যে তার রাগ ঝাড়বে চাকরানীর ওপর। তাকে বিদায় করতে পারলে তখন বাঁচে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করে তো এই বুড়োর কাছে একেবারে নিশ্চিন্ত। বুড়োর দৌড় যে কতোদূর তা ঈদের আগের রাত্রেই বেশ বোঝা গেছে। হাত ধরার বেশি ক্ষমতা তার নাই। এর বিনিময়ে জুম্মনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। খিজিরের ওপর ভরসা করলে কি ছেলে তার বড়ো হতে পারবে? ভাদাইম খিজিরের কি বুদ্ধিশুদ্ধি কোনোদিন হবে? নিমকহারামটা, তুই আছস BBBBBBB BBB BBB BB BBS BBB BBB B BB BBBBB BBB BBS তর মায়ের লগে মাহাজনে কি করছে না করছে এই মহল্লার মইদো ঐ খবর জানে না ক্যাঠায়? আরে তর যে আলাউদ্দিন মিয়া-এতো সভা মিটিং করে আর লেকচার ঝাড়ে, মাইনষে কয় স্যায় মন্ত্রী ভি হইবার পারে-তো আলাউদ্দিন মিয়া ভি দেহি একদিন বাদে বাদে মহাজনের বাড়ি গিয়া তার মাইয়ার লগে ফাসুর ফুসুর করে, মহাজনরে দেখলে সালামালেকুম মামুজান, শরীর কেমুন? বেলাড প্রেশারটা রেগুলার দেইখেন কইয়া খাড়া হয়, আর তুই কোন বান্দির বাচ্চা তার নামে দুনিয়া শুইদ্যা গিবত কইরা বেড়াস। জিন্দেগীতে তর কিছু হইবো?–রাগে জুম্মনের মায়ের সমস্ত গা নতুন করে কাপে। কিন্তু এইসব কথা তার মাথা জুড়ে বলকায়, মুখ দিয়ে বেরোয় না। মুখ দিয়ে এর বদলে বেরিয়ে আসে রাত্রে খাওয়া কাচকি মাছের দোপেয়াজি দিয়ে মাথা ঠাণ্ড ভাতের গন্ধওয়ালা পানি। কিন্তু খিজিরের শরীর ডিঙিয়ে যাওয়াও তো সম্ভব নয়। তাই বমির অনেকটা গড়িয়ে পড়ে খিজিরের গায়ের কাথায়। খিজির উঠে বসলে জুম্মনের মা দরজায় বসে ওয়াক ওয়াক করে বমি করে। ছোটো উঠানে বজলুর শরীরটা এখন নাই, নইলে বমিতে সেটা ভেসে যেতো।
জুম্মনের মা তক্তপোষে এসে বসলে খিজির বলে, কি হইছে? কাঁথার বমি-লাগা অংশটা পায়ের কাছে দিয়ে শুতে শুতে খিজির জিগ্যেস করে, মাহাজনে মনে লয় ঠাইসা খাওয়াইছে? কি দিয়া হান্দাইয়া দিলো?
এখন জুম্মনের মায়ের কোনো রাগ নাই। তার সমস্ত বুক ও মাথা জুড়ে উদ্বেগ। ৮ বছর আগেকার চেনা অনুভূতির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে সমস্ত শরীর জুড়ে। ঐ সময় গা এইভাবে গোলাতো! তাইতো। গত ২/৩ মাস তার নিয়মিত শরীর খারাপটা হয়নি। আজ দুপুরে মহাজনের বাড়িতে রান্না করতে করতে চুলার পাড় ভেঙে একটু পোড়ামাটি মুখে দিয়েছিলো। কালকেও খেয়েছে। পরশু? বোধহয়। তার আগের দিন? কি জানি!—এখন তাহলে কি হবে? খিজির ফের ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল যাকে ঘর ছাড়তে হবে, বৌ থাকে কি না থাকে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই, সেই মানুষ এভাবে শুয়ে থাকে কি করে?-কাল থেকে হয়তো এই লোকটিকে নাও দ্যাখা যেতে পারে।-দেহি তো হাড্‌ডি চোদায় ক্যামনে ঘুমায়া-খিজিরের মুখ দাখার জন্য জুম্মনের মা আড়চোখে নিচের দিকে তাকায়। আড়চোখে দ্যাখার দরকার ছিলো না। ইচ্ছা করলেও খিজির তাকে দেখতে পারতো না। আবার খিজিরের মুখ দ্যাখাও জুম্মনের মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ঘরে ঘনঘোট অন্ধকার। বাইরে রাস্তার ল্যাম্পোস্টে বান্ধটা নষ্ট। খিজিরের কালো মুখ কাথায় ঢাকা।

চিলেকোঠার সেপাই – ২৫

বস্তির ঘর কিন্তু খিজির ছাড়লো না। রহমতউল্লা তাকে ডেকে পাঠায় না, আবার মহাজনের সঙ্গে দ্যাখা করার মতো সময় কোথায় খিজিরের? প্যাসেঞ্জারবিহীন খালি রিকশা নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মিছিল বার হবে, সেই ব্যাপারে সে খুব ব্যস্ত। আলাউদ্দিন মিয়ার ঘরে ঘন ঘন মিটিং হচ্ছে। ইউনিয়নের লোকজন আসছে, ছাত্ররা আসছে, আলাউদ্দিন মিয়ার দলের লোকজনও এই ব্যাপারে আজকাল খুব তৎপর। দাবী-দাওয়া কি কি পেশ করা হবে তাই নিয়ে ৩/৪দিন ধরে খুব হাউকাউ চললো। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবের মুক্তি, ছাত্রদের এগারো দফা, আইয়ুব খান ও মোনেম খানের পদত্যাগ,–এসবের সঙ্গে টায়ার টিউবের দাম বাড়ার অজুহাতে রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে মহাজনদের বেশি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করা, ইচ্ছামতো রিকশাওয়ালা বদলানো বন্ধ করা, এ্যাঁক্সিডেন্ট হলে রিকশার ক্ষয়ক্ষতির ভার মহাজনের ওপর আরেকটু বর্তনো–এসব দাবীও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কথা ছিলো বেলা ২টার দিকে রিকশাওয়ালারা খালি রিকশা নিয়ে হাজির হবে বায়তুল মোকারম ৷ মিটিং সেরে খালি রিকশার মিছিল। কিন্তু ঘাপলা শুরু হলো সেদিন সকালবেলা। গ্যারেজে এতো রিকশাওয়ালা দেখে খিজির অবাক, আরে, মিছিল বারাইবো দুইটো বাজে, রাইত না পোয়াইতে তোমরা আইছো?
১ রিকশাওয়ালা বলে, এই বেলা গাড়ি চালাইলে মিছিলের লোকসান কি? আলাউদ্দিন মিয়ারও সেই মত, সকাল থেকে গাড়ি বন্ধ থাকবে কেন? গরিব লোকজন ১ বেলা গাড়ি চালিয়ে ২টো পয়সা রোজগার করবে না?
খিজিরের চিন্তা, গাড়ি একবার বারাইয়া পড়লে কহন আহে কিছু ঠিক নাই। আমাগো আবার পরথম যাইতে হইবো ভিক্টোরিয়া পার্ক। দ্যাড়টার মইদ্যে না গেলে দুইটা বাজলে বায়তুল মোকাররম যাইবার পারুম? মিছিল আরম্ভ করতে দেরি হইয়া যাইবো না?
আলাউদ্দিন মিয়া ঠোঁট থাকায়, মিছিলের গরজ মনে লয় আমার থাইকা তরই বেশি? রিকশাওয়ালা হাসে। কারো কোনো সন্দেহ নাই যে মিটিং বলো, মিছিল বলো, আন্দোলন বলো, সংগ্রাম বলে-এসব ব্যাপারে মহল্লায় আলাউদ্দিন মিয়া ১ নম্বর। আস্তে অস্তে সে জানায়, গরিব মানুষের দেশ, তাদের ভালোমন্দ না দেখলে কি চলে? তোমরা অহন গাড়ি লইয়া যাও। বারোটার মইদ্যে ফেরত আইবা। তাইলে খাওন দাওন সাইরা দুইটার মইদ্যে বারাইতে কেউরো দেরি হইবো না।
কিন্তু বিকালে যাদের রিকশা নেওয়ার কথা এই সিদ্ধান্ত তাদের সায় নাই, আমরা তাইলে কি গুনা করলাম? আমাগো রোজগারপতি হইবো না, আমরা খালি প্যাট বাজাইতে বাজাইতে মিছিল করুম?
খালি মালপানির ধাদা করলে আন্দোলন চলবো?—আলাউদ্দিন মিয়া প্রায় রাগ করে বেরিয়ে যায়। এই ব্যাপারে খিজির তার সায়েবের সঙ্গে একমত। কিন্তু এসব কথাই আবার খিজিরের মুখে শুনে সবাই হাসে। হাসাহসি শেষ হলে ধমক দেয়, চাপাবাজি রাখৰে। প্যাট খালি রাখলে কাম হইবো?
কিছুক্ষণ পর আলাউদ্দিন মিয়া ফিরে এসে ফের প্রথম থেকে সব শোনে এবং মন্তব্য করে যে পেটের ধাদা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ দূর করতে না পারলে পেটের জন্যে প্রয়োজনীয় অন্ন আদায় করা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানের। ৭কোটি মানুষের বাচার স্বার্থে নিজেদের সংকীর্ণ স্বাৰ্থ বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর লোকটা বক্তৃতা ঝাড়ে ৫টা মিনিট ধরে। তার বলার ঢঙ এতো ভালো যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কারো হয় না। এমনকি সকালে রিকশা চালাবার সুযোগ-পাওয়া ১ রিকশাওয়ালা আজ বায়তুল মোকাররমে তাকে বক্তৃতা করার জন্যে অনুরোধ পর্যন্ত করে। —আজ বাদে কাল পার্টির সিটি কমিটির এ্যাঁসিস্ট্যান্ট অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হতে যাচ্ছে আলাউদ্দিন মিয়া বায়তুল মোকাররম কেন, পল্টন ময়দানেই বক্তৃতা করার কতো সুযোগ পাবে। এ জন্যে কোনো রিকশাওয়ালার সুপারিশ দরকার হবে না।
বেলা সাড়ে বারোটায় ইউনিয়নের ২ জন লোক এসে রাগ করে, আপনারা এই বেলা গাড়ি চালাতে দিলেন কেন? বাসাবো, মুগদাপাড়া, খিলগাও, মালিবাগে কোনো রিকশা বেরোয়নি। গুলিস্তানে এসে দেখি চারদিকে রিকশা’
‘আরে ভাই, না ছাড়লে কি করি? আলাউদ্দিন মিয়া কৈফিয়ৎ দেয়, গরির মানুষ, অগো রোজগার করতে দিবেন না?
পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার পরা লোকটি তবু মানতে চায় না, না ঠিক করেননি। যাদের বিকালে রিকশা চালাবার কথা তারা হয়তো রাগ করে আসবে না। আবার যারা রিকশা চালিয়ে ফিরবে তারা টায়ার্ড হয়ে যাবে না। মিছিলে যাবে কি করে? বিশ্রাম নেবে না তারা? ১টা রিকশার চেসিসের সঙ্গে ফ্রকের যোগাযোগ স্কু-ড্রাইভার দিয়ে টাইট করতে করতে খিজির বলে, মিছিলে যাইবো তার আবার আরাম করতে হইবো ক্যালায়?’
সব মানুষেরই বিশ্রাম চাই ভাই রিকশাওয়ালাও মানুষ। মানুষ কথাটির ওপর জোর দিয়ে ইউনিয়নের নেতা রিকশাওয়ালাদের উন্নত পর্যায়ে ঠেলে তুলতে চায়। এই নিয়ে সে আরো কিছু ভালো ভালো কথা বলে, পুরু ঠোঁট ফাক করে খিজির সব শোনে। হাজার হলেও এরা লেখাপড়া জানা মানুষ,-ভদ্রলোকের ছেলে, আবার রিকশাওয়ালাদের জন্যে কতো কাজ করছে। এরা যা বোঝে তা খিজিরের মাথায় ঢুকবে কোথেকে?
বেলা দেড়টার দিকে রিকশাওয়ালারা সব রিকশা নিয়ে ফিরতে শুরু করে। উদ্বিগ্ন খিজির উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, আর একটা ঘণ্টা খাপ মাইরা আইলেই পারতি!
রিকশাওয়ালা চটে যায়, মাহাজনে ভাড়া লইবো পুরাটা, আর আমরা চালাইলেই দোষ?
আজাইরা প্যাচাল পাড়িস না! আউজকা ভাড়া লইবো ক্যাঠায়?’ ভাড়ার কথা কইয়া গাড়ি দিছে! মহাজনরে জিগা না। জিগ্যেস করার সুযোগ পাওয়া যায় না। ২টে বাজতে আলাউদ্দিন মিয়া এসে হস্তদন্ত হয়ে ভাড়া চেয়ে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে চ্যাচায়, ব্যাক গাড়ি আইছে? কেউরে বাড়ি যাইতে দিবি না। ঐ দোকানে ডালপুরি ভাঁজতে কইছি, বেশি কইরা ভাঁজবো খাইয়া মিছিলে চলো। মহল্লা থাইকা মানুষ কম হইলে বেইজ্জত হইতে হইবো!
রহমতউল্লার চায়ের দোকানে দারুণ ভিড়, ২জন লোক ডালপুরি ভাঁজতে ও পয়সা নিতে হিমসিম খাচ্ছে। আলাউদ্দিন মিয়া ঐ দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ইউনিয়নের নেতার সঙ্গে চা খায় আর একবার একে ধমকায়, একবার ওকে ধমকায়, এতোক্ষণ ধইরা খাইলে চলবো? যা না, মহল্লার মইদ্যে যতোগুলি গ্যারেজ আছে, একটা ঘূর্ণ দিয়ে আয়। ব্যাকটি ডেরাইভাররে লইয়া আইবি। ইউনিয়নের পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলারওয়ালাকে বলে, কি ভাই? কইছিলাম না? ডাক দিলে মানুষের অভাব হইবো না। দেরি দেইখা ঘাবড়ান, আমরা অতো জলদি ঘাবড়াই না। পলিটিক্স করি বিশ বচ্ছরের উপরে- আলাউদ্দিন মিয়া একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে, তার পরনে খন্দরের পাটভাঙা পাঞ্জাবি, ঘাড়ের ওপর ভাঁজ করা খন্দরের চাদর। ১টা মিটিং তার খুব দরকার।
মিটিং মিছিলের জন্য খিজির আলিও উদগ্রীব। রিকশা-মিছিলের জন্যে সে বেছে রেখেছে আলাউদ্দিন মিয়ার নতুন গাড়িটা। মাহুতটুলির ফকির মোহাম্মদ মিন্ত্রীর তৈরি,-দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। হুডের সঙ্গে লাগানো নানারকম ঝালর, হুডের সামনের দিকটায় পর্দার মতো গুটিয়ে রাখা গোলাপি রঙের পাতলা নাইলন। ২দিকে ঝুলছে প্লাস্টিকের লিচু ও আঙুরের গুচ্ছ। রিকশার পেছনে টিনের বোর্ড লাগানো। বোর্ডে আঁকা বহুবর্ণ ছবি। লাল-সবুজ পাহাড়ের উপত্যকায় নীল-হলুদ দোতলা প্রাসাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে লাল টকটকে মোটরগাড়ি। একটু দূরে পাহাড়ি নদী, নদীর ব্রিজের ওপর চলছে ট্রেন, ট্রেনের ওপরে উড়ন্ত এ্যাঁরোপ্লেন। নীল-হলুদ প্রাসাদের সামনে গিটার হাতে ত্রিভঙ্গমূর্তি যুবক, তাকে ঘিরে অপূর্ব ভঙ্গিতে নাচে কয়েকটা ডানাকাটা পরী। আহা, এই রিকশার প্যাডেলে পা ছোঁয়ালেই দুলদুল ঘোড়ার মতো উড়াল যা দেবে একখানা!—রাস্তার সমস্ত গাড়ি,–ট্রাক, বাস, বেবি ট্যাকসি, পেরাইভেট—সব ওভারটেক করে ছুটে যাবে সবচেয়ে আগে।
এইটা রাখ!’ আলাউদ্দিন মিয়া রিকশার হ্যাঁন্ডেলে হাত দিলো।
আমার নিজের হাতে রাখুম! কিছু হইবো না! দরকার নাই। গোলমালের টাইম। নয়া গাড়ি বাইর করনের কাম নাই।’ পুরানো ১টি রিকশা নিতে বলা হয় তাকে, ওটার বেল ঠিকমতো বাজে না। খিজির ক্ষুড্রাইভার দিয়ে বেলের ঢাকনি লাগাচ্ছে, বাইরে একটি উত্তেজিত সরব জটলা ক্রমে উচ্চকণ্ঠ হয়ে ওঠে। রহমতউল্লাহ মহাজনের গ্যারেজে আবার কি হলো?
নিজের গ্যারেজের দরজায় সমবেত রিকশাওয়ালা এবং ইউনিয়নের লোকজনের উদ্দেশে রহমতউল্লা ক্রমাগত হাত ও মুখ নাড়াচ্ছে, ‘মিটিং করো, মিছিল করো, নাচো, গাও—যা খুশি করবা। মগর আমার গাড়ি লইয়া ফুর্তি করবার দিমু না! আমি রিকশা করছি কি ঐগুলি লইয়া রোডের মইদ্যে ফুর্তি করনের লাইগা?
সব মাহাজনে দিতাছে, আপনে দিবেন না ক্যালায়? যাগো গরজ আছে তারা দিবো! আমার গরজ নাই!’ পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার এসে দাঁড়ায় তার সামনে, সবাই তো দিচ্ছে। আপনাকেও দিতে হবে।’
আপনার হুকুমে? মনে লয় ওয়ারেন্ট লইয়া আইছেন? – দিতে হইবো রিকশাওয়ালাদের গুনগুন পরিণত হয় গর্জনে, ‘গাড়ি দিতে হইবো!
‘একটা বেলা গাড়ি দিবার চায় না! মাহাজনে কতো খাইবো? আপনারা চুপ করেন। আমাকে বলতে দিন! পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার চিৎকার করে সবাইকে থামিয়ে রহমতউল্লার জন্যে গলাটা একটু নামায়, দ্যাখেন, এরা রোজ আপনার রিকশা চালায়। আপনাকে বোনাস দিতে হয় না, বেতন বাড়াবার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি বরং এদের কাছ থেকে পয়সা পান, নগদ পয়সা আপনার ইন্ডাস্ট্রি থাকলে হরতাল হতো, ছুটি চাইতো, বেতন বাড়াবার দাবী করতো। আমার রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা কোনো দাবী করে না। আজ, শুধু একবেলার জন্যে আপনার রিকশাগুলো চায়, প্যাসেঞ্জার নেবে না, পয়সা কামাবে না। আপনার দিতে আপত্তি কি?
রহমতউল্লা ভ্ৰ কুঁচকে তার দিকে তাকায়, ঐগুলি লেকচার পল্টন ময়দানে দিয়েন। আমার সাফ কথা, রিকশা ভাড়া দিয়া খাই, রিকশা লইয়া ফুর্তি আমি করবার দিমু না! গাড়ি লইলে ভাড়া দিতে হইবো। ইউনিয়নের আরেকজন এগিয়ে আসে, ঠিক আছে। আপনার রিকশা আপনি রেখে দিন। আমাদের কিছু করার নেই। আপনার রিকশা যারা চালায় তারাই যা করার করবে। আমাদের সঙ্গে কো-অপারেশন আপনি যখন করবেন না তখন আমরাও আপনাকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারবো না।’
আপনাগো কাছে আমি হেল্প চাইমু ক্যান? আরে, আমার মহল্লায় আইয়া আপনেরা হেল্প করবেন আমারে? রহমতউল্লা একবার পেছনে তাকাতে বজলু এসে হাজির হয় একেবারে সামনে। তার আশেপাশে কয়েকজন লোকও যে তার সঙ্গী তা বোঝা যাচ্ছে তাদের দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে।
রিকশা তো আমরাই চালাই। বজলুর রাত-জাগা গলা খনখন করে ওঠে, আমাগো মহল্লার মইদ্যে আইয়া গরম দ্যাহায় ক্যাঠা? রিকশা তো আমরা ভি চালাই। আমাগো মাহাজনেরে গরম দ্যাহায় ক্যাঠায়?
পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার বজলুর কথার তোড়ে একটু পিছিয়ে আসে, কি গরম দ্যাখালাম?
‘তো এইগুলি কি কইতাছেন? গাড়ি আপনারা জোর কইরা লইবেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আলাউদ্দিন মিয়া ধমক দেয়, বজলু থামলি?
তুই ফাল পাড়স ক্যালায়? রহমতউল্লাও বজলুকে থামতে বলে আলাউদ্দিন মিয়াকে উদ্দেশ করে অভিযোগ করে, তোমার মানুষজন কি আরম্ভ করছে? রিকশা কি জোর কইরা দখল করবো? ডাকাইত আইলে আমার মানষে ঠ্যাকাইবো না? ব্যাকটি কি নিমকহারাম হইয়া গেছে?
খিজির আলি জিভের কাপন আর ধরে রাখতে পারে না, ঐ সায়েবে বেইনসাফ কথাটা কইছে কি? মাহাজন, আপনের গাড়ি চাইয়া আমরা কি গুনা করছি?
লগে গাদ্দারি করস? তর গাদ্দারির মায়েরে বাপ! হাড্‌ডি হালায় চোপা মারে কতো? তর চোপারে টিকটিকি দিয়া চোদাই!’
বা হাতে প্লায়ার ও কু-ড্রাইভার এবং ডান হাতটি মুষ্টিবদ্ধ করে বজলুর দিকে এগিয়ে আসে খিজির, গুলিস্তান, মধুমিতা আর অভিসারের কাউন্টারের মইদ্যে তর মায়েরে চোদা পুলিশের লাঠি দিয়া। আয়, এই প্লাসখান দিয়া তর বিচি দুইখান ছেইচা পাঙখাবরফ বানাইয়া দেই। কিন্তু খিজিরের এই ঘোষণার সঙ্গে তার কাজের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য ঘটে না, বজলুর নিম্নাঙ্গ বাদ দিয়ে প্লায়ার দিয়ে সে আঘাত করে বসে বজলুর কপালে। আর বজলু করলো কি, খুব জোরে একটা ঘুষি লাগালো খিজিরের বুকে। তার লক্ষ্য ছিলো খিজিরের মুখ। কিন্তু খিজির বেশ লম্বা বলে বজলুর ঘুষি অতোদূর পৌঁছতেও পারে না। বজলুর ডান হাতের মধ্যময় ছুচলো লোহা আটকানো আংটি খিজিরের হাড্‌ডিসার বুকে লেগে ঠন করে আওয়াজ করে, তার সমস্ত শরীর নড়ে ওঠে দারুণভাবে। পরের ঘুষিটি লাগে তার কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে বজলুর সিনেমা হলের এক সহকর্মীর এক থাপ্পড় লাগে তার পিঠে এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। তবে হঠাৎ করে দেলোয়ারের হাতে বজলুকে মার খেতে দেখে খিজির সামলে নেয় এবং পেটের নিচে একটি ঘুষি খেতে সে তার প্রায়ার ও শকু-ড্রাইভার-ধরা হাত দিয়ে দারুণ জোরে আঘাত করে বজলুর ঘাড়ে। বজলু মাথা তুলতে না তুলতে খিজিরের ঐ হাত আছড়ে পড়ে ওর পিঠে ও কোমরে। বজলুর সঙ্গ। ২জন কিন্তু খিজিরের পেটে ও হাঁটুতে মেরেই চলেছে। তবে বজলুর পতনে তারা একটু দিশেহারা।
মারামারি চলছে, এদিকে মার হালার মাহাজানের দালালরে মার! চুতমারানিরে উপ্ত কইরা ফালাইয়া খানকির বাচ্চার হোগার মইদ্যে ইস্পোক হান্দাইয়া দে-প্রভৃতি সং ঘোষণা করতে করতে বেশ কিছু লোক ঢুকে পড়েছে রহমতউল্লার গ্যারেজের ভেতর। চল, চল, গাড়ি লইয়া বারাইয়া পড়’, ‘গাড়ি দিবো না কইলেই হইলো? এইসব কথা বলছে আর টানাটানি করছে রহমতউল্লার রিকশা নিয়ে। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে একেকটি গাড়ির পেছনে ৩/৪ জন লোক। শুরু হয় নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, কি মিয়া, তোমারে তো এই মাহাজনের গাড়ি চালাইতে দেহি নাই!’
আমি গাড়ি চালাই না তো কি করি? তুই ক্যাঠ্যায়? এই কথা বলায় অপরিচিত লোকটি ১ রিকশাওয়ালার ঘুষি খায়, তার পক্ষে আরেকজন জেনুইন রিকশাওয়ালা তেড়ে এলে মারামারি জমে ওঠে। এই অবস্থায় আসল হোক, নকল হোক-রিকশাওয়ালারা রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামে কি করে?
রহমতউল্লা প্রাণপণে চ্যাচায়, আরে আমার বজলুটারে মাইরা ফালাইলো রে! ধর না, আরে ধর না! তার আহবানে সাড়া দিয়ে কে ১জন বজলুকে-প্রহাররত কোনো রিকশাওয়ালার কোমরে লাথি মারে, সে পড়ে যায় খিজিরের পিঠে, খিজির পড়তে পড়তে টান দেয় বজলুর শার্টের কলার ধরে। শার্টের কলার ও পিঠ সম্পূর্ণ ছিঁড়ে গেলো। তার জামার নিচে গেঞ্জি নাই। সে যে এতোটা রোগা তা কিন্তু তার ১মাত্র খাকি শার্ট-ঢাকা অবস্থায় কখনো বোঝা যায়নি। তার পিঠের এপাশ-ওপাশে জুড়ে একটা কাটা দাগ, এ দাগটা পুরনো, কিন্তু নিচের রক্ত চিহ্নগুলো টাটকা। বজলু পড়ে গিয়ে মার খেয়েই ভেতর থেকে কে একজন এসে খিজিরের কোমরে কষে লাথি লাগালে সে নিচে পড়ে যায়। তখন তার ওপর ঘুষি পড়তে থাকে বৃষ্টির মতো।
গ্যারেজের ভেতরেও মারামারি। আলাউদ্দিন মিয়া আহত লোকটিকে টেনে বাইরে এনে হুঙ্কার ছাড়ে, শুওরের বাচ্চারা, থামলি? নিজের শরীরটা সে গলিয়ে দেয় ভিড়ের ভেতর এবং খিজিরের হাত ধরে বলে, ’ওঠ। গতরের মইদ্যে নাই এক ছটাক গোসতো, হাড্‌ডির উপরে আর কতো মাইর খাইবি? বজলুর সঙ্গী তখন সরে যায়, কিম্ভ কয়েকজন রিকশাওয়ালা তাকে ধরে দমাদম মারতে শুরু করে।
আমার মানুষগুলিরে কেমুন মারতাছে, তোমার নজরে পড়ে না। রহমতউল্লার অভিযোগেরে জবাবে আলাউদ্দিন মিয়া সমান উত্তেজনায় তাকে সতর্ক করে দেয়, ‘আপনের ভাড়াইটা গুণ্ডাগুলিরে সামলান। নইলে পাবলিকে আপনার গাড়িগুড়ি আমান রাখবো না কইলাম!’
আমার ভাড়াইটা মানুষ লাগে না। আমার বালা-মুসিবত দেখলে মহল্লার ব্যাকটি মানুষ বাপাইয়া পড়বো, বুঝলা?
কিন্তু বজলু ছাড়া রহমতউল্লার লোকজন সবাই দেখতে দেখতে কেটে পড়ে। রক্তাক্ত শরীরে চিৎপটাং শুয়ে রয়েছে বজলু, তার পাশে তার ১ সঙ্গী, সে-ও বোধ হয় অজ্ঞান, কিংবা অজ্ঞান হওয়ার ভাণ করছে। টলতে টলতে খিজির ঢুকে পড়েছে রহমতউল্লার গ্যারেজে, মেঝেতে রাখা রিকশার একটা সিটে ধপ করে বসে সে ঢালাও হুকুম ছাড়ে, গাড়ি লইয়া বারাইয়া পড়ো, মিটিঙের টাইম যায় গিয়া। সত্যি সত্যি রিকশাগুলো বেরিয়ে যেতে থাকে। আলাউদ্দিন মিয়া চোখ ছোটো করে তাকিয়ে থাকে রহমতউল্লার দিকে। সঙ্কুচিত চোখজোড়ায় তার আগুন জ্বলে বুই কাতলারা বলে হাসফাস করছে, আর কোথাকার কোন মহাজন এখন পর্যন্ত দাপট দ্যাখাতে সাহস পায় এখানে—তার ব্লাড প্রেসার হয়তো বেড়ে গেছে, কিংবা পরিস্থিতি প্রতিকূল—যে কোনো কারণে রহমতউল্লার জেদি মুখে পড়ে কালো ছায়া, সেই মুখ একদিকে যেমন অসহায় তেমনি বিরক্ত, সেখানে ঝাপশা হয়ে ফোটে সিতারার মুখ। আলাউদ্দিন মিয়া চোখ ফেরায় গ্যারেজের দিকে। আরে, মামুর গ্যারেজ তো সাফ হয়ে যাচ্ছে। তার চোখ যেমন জ্বলে উঠেছিলো, তেমনি নিভেও যায় দপ করে।
যারা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ লোক অপরিচিত। আর এই রিকশাওয়ালা জাতটাকে সে ভালোভাবে চেনে, এদের ওপর বিশ্বাস রাখা কঠিন। এরা আন্দোলনের কি বোঝে? রাজনীতির কি বোঝে? আইয়ুব খানের দালালের গ্যারেজ সাফ করে এদের মাথায় কি খেয়াল চাপে, কে জানে? এদের ছাড়া আন্দোলন হয় না, কিন্তু এদের হাতে আন্দোলন চলে গেলে মুশকিল। রহমতউল্লার গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে সব যাচ্ছে হাফিজ মিয়ার গ্যারেজের দিকে। পাতলা খান লেনের সবগুলো গ্যারেজের মালিকরা আলাউদ্দিন মিয়াদের দলের লোক। কিন্তু মুখগুলোর কি দলমত জ্ঞান কিছু আছে?—কি করা যায়?-ইউনিয়নের লোকজন শালারা কেটে পড়লো কোথায়? শালদের খালি লম্বা লম্বা পাঞ্জাবি আর আরো লম্বা কথাবার্তা। খালি চাপাবাজিা-স্টেজে উঠে মাইক সামনে পেলেই খালি মেহনতি মানুষ আর শোষণ আর বিপ্লবের ওপর বাখোয়াজি-এখন সব গেলো কোথায়?-অস্থির হয়ে আলাউদ্দিন মিয়া রাস্তার দিকে যাচ্ছে, এমন সময় চলে আসে ইউনিয়নের কয়েকজন লোক। সঙ্গে আলতাফ ও ইউনিভারসিটির ৫/৬ জন ছাত্র।
আলতাফ বলে, ‘খুব মারামারি করলেন। চলেন।
ছেলেরা খুব খুশি, দালালরা খুব টাইট হয়েছে, না?
আলাউদ্দিন মিয়া গম্ভীর হয়ে গেছে, ‘পাবলিকে বহুত রাউডি ব্যবহার করতাছে।
করুক না রিকশা দিতে দালালদের এতো আপত্তি কেন?
‘আরে মিয়া রাখেন।’ আলাউদ্দিন মিয়া রাগে ফেটে পড়ে, নীলখেতে বইয়া দাশ চালাইতে চান? নেতা হইয়া বইছেন জানেন এদিককার বেশির ভাগ রিকশার গ্যারেজের মালিক আমাগো মানুষ। কলুটোলার হাফিজ মিয়ার গ্যারেজে গিয়া তার পোলারে মাইর দিছে, খবর পাইছেন? এইগুলি সামলাইতে পারবেন?
রিকশাগুলো বড়ো রাস্তায় উঠে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোলাহল বেশ স্পষ্ট। কে যেন বলছে, কিয়ের মাহাজন? গাড়ি চালাই আমরা, একটা দিন গাড়ি লইয়া মিছিল করবার দিবো না?
চল না বে। দেহি চুতমারানি গাড়ি ফেরত পায় ক্যামনে, দেখুম!
ইউনিয়নের লোকজন, ছাত্রনেতৃবৃন্দ ও আলতাফের সঙ্গে আলাউদ্দিন মিয়া হাজির হয় বড়ো রাস্তার মোড়ে। যতোটা সম্ভব গম্ভীর ও যতোটা সম্ভব মিষ্টি গলা তৈরি করার অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করে সে, কি পাগলামো করস? মাহাজনরে কইয়া গাড়ি লইবি না?
আউজকা মহাজন নাই।
আরে পাগলা! মাহাজন ত থাকবোই। আলাউদ্দিন মিয়া প্রাণপন চেষ্টায় হাসে, তরা ভি মহাজন হইবার পারস একদিন তহন তগো গাড়ি না কইয়া বাইর করতে দিবি?
আলাউদ্দিন মিয়ার কথায় কাজ হয় না। রিকশা নিয়ে গ্যারেজে ফেরত যেতে কেউ রাজি নয়। রিকশা যারা পায়নি তারা রওয়ানা হয় অন্য কোনো গ্যারেজের দিকে। বোঝা যাচ্ছে, কুঞ্জবাবু লেনের আলম মেম্বারের গ্যারেজ এদের গন্তব্য। এখন আলাউদ্দিন মিয়া কি করতে পারে? ইউনিয়নের আরো লোক এসে জানায় যে শহরের অন্যান্য জায়গা থেকেও এরকম আসছে, গ্যারেজের মালিকরা রিকশা দিতে রাজি নয়।
আলাউদ্দিন মিয়া দোষ দেয় ইউনিয়নের লোকদের, এইগুলি প্রোগ্রাম করনের আগে আপনারা মাহাজনগো লগে আলাপ করবেন না?
ইউনিয়নের লোক চার্জ করে ছাত্রনেতাদের, কথা ছিলো বিকালবেলা হরতাল, রিকশা স্ট্রাইক, বায়তুল মোকাররমে সমাবেশের পর মিছিল। রিকশা নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম আপনাদের।
ছাত্রনেতা কৈফিয়ৎ দেয়, কেন, আমরা তো ইউনিয়নকে ইনফর্ম করেছি!
পরে করেছেন। ডিসিশন নিয়ে, কাগজে খবর পাঠিয়ে তারপর আমাদের জানিয়েছেন। এরকম করলে মুভমেন্ট চলে?
কুঞ্জুবাবু লেনের ওদিক থেকে স্লোগান শোনা যাচ্ছে, মাহাজনের গদিতে’-‘আগুন জ্বলো একসাথে’।
এসব শ্লোগান আলাউদ্দিন মিয়া কম শোনেনি। সে নিজেও অনেক মিটিঙে মিছিলে গেছে যেখানে এইসব স্লোগান দেওয়া হয়; এখন কিন্তু এই কথাগুলো বড়ো অস্বস্তিকর। সবাইকে হঠাৎ সে তাড়া দেয়, চলেন, চলেন। আলম মেম্বারের গ্যারেজের কিছু হইলে বহুত মুসিবত হইবো!’ আলম মেম্বারের চাঁদা ছাড়া এই মহল্লায় একটা মিটিং পর্যন্ত আয়োজন করা মুশকিল। এদিকে খোড়াতে খোড়াতে এসে পড়েছে খিজির। পাজামা-পাঞ্জাবিমাফলারওয়ালা নেতা তাকে অনুরোধ করে, ভাই তুমি গিয়ে ওদের ফিরিয়ে নিয়ে এসো।
আপনার মাথা খারাপ? আলাউদ্দিন মিয়া তাকে থামিয়ে দেয়, অরে দেখলে রিকশাআলারা আরো চেতবো। কইবো মাহাজনের গুণ্ডারা অরে মাইর দিছে, আমরা ভি মহাজনগো ছাড়ম না! মহাজনগো মইদ্যে ভি আমাগো মানুষ বহুত, জাহেলগুলি কি এইটা বুঝবো?
আলম মেম্বারের তালা-লাগানো গ্যারেজের বাশের দরশা ভেঙে কয়েকজন ততোক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ইউনিয়নের নেতার পিঠে হাতের চাপ দিয়ে আলাউদ্দিন মিয়া ফিসফিস করে, সামলাইতে পারবে? দরজা ভাঙা গ্যারেজের উল্টোদিকে একটি বাড়ির ঝুলন্ত সিমেন্টের পাদানীতে দাঁড়িয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলার সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, ভাইসব! আমাদের, আজ আমাদের যে আন্দোলন চলছে, আমাদের লুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার, মেহনতি মানুষের বাঁচার অধিকার ও আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলন নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের ভেতর অনুপ্রবেশকারী একদল হঠকারী লোক-।
প্যাচাল পাড়েন ক্যান? কামের কথা কন!’ হাঁটুতে আলাউদ্দিন মিয়ার খোঁচা খেয়ে
আপনারা মহাজনদের রিকশা ফেরত দিয়ে মিছিলে আসুন। মহাজনদের মধ্যে যারা দালাল তাদের আমরা সমুচিত শাস্তি দেওয়ায় ব্যবস্থা করবো।’
কিন্তু তার বক্তৃতায় কারো মনোযোগ নাই। গ্যারেজ থেকে রিকশার পর রিকশা বেরিয়ে আসছে। পাজামা-পাঞ্জাবি-মাফলারকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সিমেন্টে খুলও পাদানী দখল করে আলতাফ। এলোমোলো চুলের আলতাফকে লাল পুলওভারে চমৎকার মানিয়েছে। গড়গড় করে সে আওড়ায়, ভাইসব গত বাইশ বছর ধরে বাঙালির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্ৰ চলে আসছে। পশ্চিম পাকিস্তানের এই শোষণ আমরা অনেক সহ্য করেছি, আজ আমরা সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। বাঙালির স্বার্থরক্ষার দাবি জোরদার করে তোলার জন্যে আমাদের জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলার শিকার। তার ছয় দফা দাবি আদায়ের জন্যে আমাদের মরণপণ সংগ্রাম চলছে। কোনোরকম হঠকারিতার সুযোগ দিয়ে এই আন্দোলন যেন বানচাল না হয় সেজন্যে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শুধু ভাঙাচোরা আর জ্বালানো পোড়ানোর কথা বলে আমরা যেন বাঙালির মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি সেজন্যে
ছাত্রদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আলতাফের বক্তৃতার মাঝে মাঝে তারা স্লোগান দেয়, ছয় দফার সংগ্রাম—চলবেই চলবে। তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা। আরো ছাত্র আসে এবং এইসব স্লোগান গোট মহল্লা গমগম করে।
সিমেন্টের ঝুলন্ত পাদানী থেকে নেমে এসে আলতাফ সবাইকে আহবান জানায়, এখন এইসব গোলমাল ছেড়ে মিটিঙে চলেন। তাড়াতাড়ি চলেন।
আলাউদ্দিন মিয়া কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের কাছে গিয়ে বলে, ‘গাড়ি রাইখা যা? ছাত্রদেরও অভিন্ন মত, তাড়াতাড়ি চলেন ভাই। মানুষ যাবে হেঁটে আর আপনার যাবেন রিকশা চালিয়ে, এটা কেমন দাখাবে?
রিকশা কেউ ফেরত দেয় না। তবে রিকশা যারা পায়নি সেইসব রিকশাওয়ালা আর কোনো গ্যারেজে না গিয়ে রওয়ানা হয় সোজা বড়ো রাস্তার দিকে। খিজির আলির সঙ্গেও রিকশা নাই, হাটতে হাটতে সেটের পায় যে বজলু তার বা পায়ের হাঁটুটা বেশ ভালোরকম জখম করে দিয়েছে।
বায়তুল মোকাররমের সমাবেশের পরও আলতাফ কিন্তু তার কথা ভোলেনি। বেৰি ট্যাক্সি করে তাকে নিয়ে গিয়েছে মেডিক্যাল কলেজ। ছোকরা ডাক্তারদের অনেকে আলতাফকে চেনে, মানেও খুব। খিজিরের পায়ে, হাতে ও ঘাড়ে ব্যাণ্ডেজ করা হলো, ইঞ্জেকশন দিলো গোটা দুয়েক। এমনকি ফেরার সময় আলতাফ সায়েব তাকে একটা রিকশায় পর্যন্ত উঠিয়ে দিলো। বারবার বললো, তুমি অন্তত সপ্তাহখানেক বিশ্রাম নিও। আলাউদ্দিন ভাইকে আমি বলেছি, উনি ছুটি দেবেন।
আলাউদ্দিন মিয়া কিন্তু সত্যি তাকে কয়েকদিন কাজ করা থেকে অব্যাহতি দিলো, কয়টা দিন কাম করনের দরকার নাই। মামুর বস্তি থাইকা চইলা আয়। আমার গ্যারেজের মইদ্যে থাকবি। মামুরে যা চেতাইয়া রাখছস। আবার কেউরে দিয়া মামু তরে এমুন জখম করাইবে৷ কি এক্কেরে খতম হইয়া যাইবি।’

চিলেকোঠার সেপাই – ২৬

৪/৫ দিনের মধ্যে খিজির আলি মোটামুটি সেরে ওঠে। হাঁটুর ব্যথাটা কমতেই সে যায় বস্তিতে তার নিজের ঘরে। রাত তখন ৯টা হবে, জুম্মনের মা ফেরেনি। শত্ৰু-ড্রাইভার ও প্লায়ার ছাড়াও খিজিরের হাতে সাইকেলের নতুন ১টা চেন। সেদিন গোলমালের সুযোগে রহমতউল্লার গ্যারেজ থেকে হাতানো। নতুন মাল-অন্ধকারেও চকচক করছে।-একদিন চানস্ মেলা তো একটা দিয়া চুতমারানি বজলুটারে চাবকাইয়া এক্কেরে ফিনিস কইরা ফালান যায়—এখন এই জিনিসগুলো একটু আড়ালে রাখা দরকার। খিজির ঘরের ভেতর নিভৃত ১টি কোণ খোজে। কিন্তু দ্যাখো, এইটুকু ঘর, তার ভেতর মাল-সামান কতো! মাটির হাড়ি ৩টে, ৩টে সরা, এালুমিনিয়ামের বাটি ১টা, টিনের থাল মগ এমনকি কাচের গ্লাস পর্যন্ত আছে। আবার দ্যাখো, রুটি বেলার বেলুন। পিড়ি নাই তো বেলুন দিয়ে হবে কি?—মহাজনের বাড়ি থেকে হাতাবার সময় জুম্মনের মায়ের ছুশজ্ঞান লোপ পায়। আরে এটা কি?-হাত ঝুলিয়ে ঠাহর করতে না পেরে খিজির হাতড়ে হাতড়ে কুপি বার করে জ্বালায়। আরে বাবা! এ তো চাবি-লাগানো খেলনা-গাড়ি জুম্মন আলির আবির্ভাবের পর মহাজনের বাড়ি থেকে জুম্মনের মা তাহলে দামী দামী খেলনাও সরাতে শুরু করেছে। মোটর গাড়িটা একবার চালিয়ে দেখলে হতো!—না থাক। কোনো রকমে তার নিজের ৩টে জিনিস লুকিয়ে রেখে কেটে পড়তে হবে। বজলু শালা ভাঙা হাতপা নিয়ে পড়ে থাকলে কি হবে, মহাজনের লোকবলের কি কোনো ঘাটতি আছে?-কিন্তু এগুলো সে রাখে কোথায়? তক্তপোষের নিচে স্প্রিংওয়ালায় মোটরগাড়ির পাশে ২টো ইটের ওপর রাখা কাঠের টুকরা, শবনম ও সাবিহার রঙিন ছবিওয়ালা কাগজে ঢাকা এই কাঠের ওপর মো, পাউডার, নারকেল তেল, লিপস্টিক, এমনকি শ্যামপুর খালি বোতল। সবগুলো রহমতউল্লার মেয়ের ড্রেসিং টেবিলের মাল। খিজির উপুড় হয়ে জোরে নিশ্বাস নিলে ঘরের অক্সিজেনের-অভাবে-রুগ্ন বাতাস তার নাকের সামনে পাকা সিকনির মতো ঝোলে। নাকের তেজি একটা ফুয়ে খিজির সেটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে, কিন্তু তা না করে সেটাকে সে ঝুলতে দেয়। স্নো-পাউডারের গন্ধে বস্তির জলহাওয়ার আঁটোসাটো মরা গেরো খুলে যাচ্ছে, সবকিছু বেশ হালকা হয়ে আসছে। এই স্নো-পাউডার-লিপস্টিক-নেল পালিশ-নারকেল তেল রাখার কাঠের টুকরার নিচে রেখে দেয় তার স্কু-ড্রাইভার ও প্লায়ার। সাইকেলের চেন বিছিয়ে রাখে একেবারে পেছনে, যক্ষের সাপ হয়ে সেটা আগলে রাখবে তার শত্ৰু-ড্রাইভার ও প্লায়ারকে। যাক বাঞ্চোতগুলি এটু আরাম করুক। সেদিন খুব কাজ করেছে ব্যাটারা, বজলুদের মার যা সামলানো গেছে তা এদের জন্যেই। আবার এর মধ্যেই এদের খাটনি শুরু হবে, যাক কয়েকটা দিন আরাম করুক। স্ক্রু-ড্রাইভার, প্লায়ার ও চেনের ওপর বাৎসল্য খিজির বড়ো বড়ো করে কয়েকটা নিশ্বাস ছাড়ে। এই সরব নিশ্বাসের জবাব আসে পাশ থেকে, জড়ানো এ ঐ ধ্বনি শুনে সে চমকে ওঠে।—কে?—বস্তির ভারি গন্ধে মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যায় এবং কুপিট তুলে খিজির দ্যাখে তক্তপোষের ওপর ঘুমিয়ে রয়েছে জুম্মন আলি। তার গায়ের কাথা ঝুলে পড়েছে একদিকে, তার বুকের সবটাই কাঁথার বাইরে। জুম্মনের গায়ে কথা ভালো করে টেনে দিতে দিতে খিজির তার মুখটা ভালো করে দ্যাখে। বসন্ত হওয়ার আগে জুম্মনের মায়ের মুখটাও হয়তো এমনি পিছলা লাগতো। জুম্মনের মায়ের অনেক আগেকার, তার সঙ্গে দ্যাখা হওয়ারও আগেকার চেহারা ভালো করে ঠাহর করার জন্য বা হাতের আঙুলগুলো খিজির আলগোছে রাখে জুম্মনের গালে। জুম্মনের চোখজোড়া সম্পূর্ণ খুলে যায় এবং ফুফু’ বলে সে ২বার ডাকে। তার গালে ও লালচে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে খিজির বলে, ডরাস না! তুই কহন আইলি? জুম্মনের ঘুম একেবারে ভেঙে গেলে ভীতু চোখে সে খিজিরকে দ্যাখে এবং দরজার দিকে সেই চোখজোড়া ফিরিয়ে ভয়-পাওয়া গলায় বলে, ‘মা!’
দরজায় সত্যি সত্যি জুম্মনের মা! ৫ দিন পর স্বামীকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া কি হলো বোঝা কঠিন। ঝাপশা আলোতে তার মুখের ভাঁজ, গর্ত ও বসন্তের দাগ সব সমান। মাকে দেখে জুম্মন ফের ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু একটু আগে তার ভয় পাওয়াটা ধাক্কা দেয় খিজিরকে। বেদম মার-খাওয়া বুকে ও পিঠে নতুন ব্যথা চিনচিন করে আমার খায়, আমার ভাড়া করা ঘরের মইদ্যে আমার খ্যাতার নিচে নিন্দ পাড়ে, আবার নবাবের বাচ্চা আমারে দেইখ্যা কেমুন নাখোশ হইয়া মায়েরে ডাকে। আমি কি কুত্তা না মিলিটারি? পুলিশ না মহাজন? আমারে দেইখা ডরাইবো ক্যালায়? খিজিরের ইচ্ছা করে পাছায় ২টো লাথি দিয়ে খানকির বাচ্চাকে পাঠিয়ে দেয় মালিবাগ কি নাজিমুদ্দিন রোডের রেল লাইনের ধারে।
মেঝেতে বসে জুম্মনের মা গামছার গেরো খুলে এ্যাঁলুমিনিয়ামের গামলা ধার করে টিনের থালায় ভাত বাড়ে, থালাটা এগিয়ে দেয় খিজিরের দিকে, লও। গোরুর গোশতের ভুনা পাকাইয়াছিলাম।
মাহাজনরে কয়বার মারা দিয়া গোশতো লইয়া আইলি? খানকি মাগীর কামাই আমার বালে ভি খায় না! –
আরেকটি থালে জুম্মনের মা ভাত তরকারি সাজায়, রাইতে এইগুলি ভালো লাগে না? মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে সে প্রায় কাতরায়, তোমার ত্যাজেই তোমারে খাইছে। গরিব মানুষের এমুন ত্যাজ খোদা সইজ্য করে না! ’ বলতে বলতে সে ভাত খায়। ২/৩ গ্রাস মুখে তোলার পর তার গ্রাসের পরিমাণ ও খাওয়ার গতি বাড়ে। খিদে যেরকম পেয়েছে, সব ভাত আবার খেয়ে না ফেলে। থালার ভাত আঙুলের দাগে বিভক্ত করতে করতে ছেলেকে ডাকে, এই জুম্মন, ওঠ ভাত খাইবি তে ওঠ। কিন্তু জুম্মনের ওঠবার কোনো লক্ষণ নাই। জুম্মনের মা ফের বিড়বিড় করে জানায় যে বিবিসায়েব আর সিতারাকে পটিয়ে মহাজনকে দিয়ে খিজিরের উচ্ছেদ সে প্রায় ঠেকিয়ে এনেছিলো। কিন্তু নিজের ভালো না চাইলে কেউ তাকে সাহায্য করতে পারে? সেদিন দুপুরে খিজির যে কাণ্ডটা করলো, এরপর কোন মানুষটা তাকে তার বাড়িতে ভাড়াটে হিসাবে থাকতে দেবে—এইসব বলার ফাঁকে ছেলেকে সে ফের ডাকে, শুওরের বাচ্চা, উঠলি? গোশতো ফুরাইয়া গেলে ঘ্যানঘ্যান করবার পারবি না কইলাম!’ এই সতর্কবাণীতে কাজ হয়। বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে বসে জুম্মন মায়ের পাত থেকে ঘন সুরুয়া মাখা ভাত খায়। শুকনা শক্ত হাড় নিয়ে ঘুম-জড়ানো গলায় সে প্যান প্যান করে, গোশতো কই? খালি হাড্‌ডি লইয়া আইছো!
তর বাপে তরে ডুমা ডুমা গোশতো পাকাইয়া পঠাইয়া দিছে, না? খা হারামজাদা। খাইলে খা, নইলে উইঠা যা গলা ও চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করা সে অব্যাহত রাখে, যার ঘরে থাকবা, যার খাইয়া মানুষ হইলা, তারই মাল সামান লুট করবার চাও। তার গ্যারেজ খালি করনের লাইগা চোরচোট্টো লইয়া দল পাকাও! বিবিসাবে ভি চেতছে, কয় আগিলা জামান হইলে মাহাজনে তোমারে জানে খতম কইরা গতরখান নর্দমার মইদ্যে ফালাইয়া দিতো। অহন—। খিজির নিজেও ভাত খেতে শুরু করেছে, গোশতের টুকরাগুলো সব তার পাতেই, গোশত মুখে সে জবাব দেয়, তার মাহাজনের ভাউরা চুতমারানি বজলুটারে মাইরা লাশ বানাইয়া দিলাম হেই কথা মাহাজনেরে মনে করাইয়া দিস! ঐটারে বহাইয়া দিছি, এ্যার বাদে ধরুম মাহাজনের! আরে, পাবলিকে তো মাহাজনের গ্যারেজ উরেজ, বাড়িঘর ব্যাকটি জ্বালাইয়া দিতো, আমার লাইগা বাইচ গেছে।’
কথাটা সে শুনেছে আলতাফের মুখে। ঐদিন তাকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে ডাক্তার বন্ধুদের সামনে আলতাফ বলছিলো, সিচুয়েশন এমনটাফ হয়ে গিয়েছিলো যে এই লোকটা বললেই সব রিকশাওয়ালা একজোট হয়ে রিকশামালিকদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো। তখন কিন্তু খিজির খুব খেয়াল করেনি, জুম্মনের মায়ের বিলাপ শুনে সেদিনকার কথাটা খুব দামী হয়ে ওঠে, বুঝলি? ইউনিভারসিটির মইদো, মেডিকেলের মইদ্যে ব্যাকটির খালি এক কথা, খিজির আলি কইলেই রিকশাআলার মাহাজনের গ্যারাজ উরাজ পুড়াইয়া দিতো!
তুমি আগুন দিবার মানা করছিলা? জুম্মনের মায়ের ডান হাত থমকে থাকে তার পাতের ওপর, এই সুযোগে সপাসপ গ্রাস মুখে তোলে জুম্মন, ভাতের মাঝখানে মায়ের আঙুলে চিহ্নিত সীমারেখার ওপার থেকেও সে অকাতরে ভাত টানে। জুম্মনের ভাত খাওয়ার চপচপ আওয়াজ ছাপিয়ে ওঠে জুম্মনের মায়ের উত্তেজিত ও রাগী গলা, ক্যালায়? তুমি আগুন দিবার দিলা না ক্যালায়? মইনষে যে কয় মহাজনে তোমার বাপ লাগে, মিছা কয় না। পাবলিকে মহাজনরে জ্বালাইয়া দিবো, গুড়াইয়া মারবো, খতম করবো,-তোমার কি? তুমি কাঠা? -আমি জিগাই, তুমি গ্যারেজের মইদ্যে আগুন দিবার দিলা না ক্যালয়?
ভাতের শেষ গ্রাসটি থালা ও মুখের মাঝখানে ঝুলিয়ে রেখে খিজির বৌয়ের দ্রুত ও উত্তেজিত সংলাপ শোনে। মেয়েটা খেপে গেলো নাকি? কুপির কালচে হলদে আগুন কি দপ করে জ্বলে উঠলো তার মাথার চুলে?
কথা কও না ক্যান? মাহাজনের বাড়ির মইদ্যে তুমি আগুন জ্বালাইবার দিলা না ক্যালায়? বলতে বলতে এটো হাতে জুম্মনের মা খিজিরের বুকের ওপর জামা খামচে ধরে। খিজির এর জবার দেবে কি?-আগুন কি খিজির ইচ্ছা করলেই লাগাতে পারে?-এতনা আসানি নেহি হ্যাঁয় রে মাগী আলাউদ্দিন মিয়ার হুকুম ছাড়া খিজির কি করবে। ইউনিয়নের পাঞ্জামা-পাঞ্জাবি-চশমারা কতো এলেমদার লোক, তারা না চাইলে সে আগুন জ্বালায় কি করে?-সেদিনকার কথা ভাবতে ভাবতে কুপির শিখাটিকে সে স্বচ্ছ হতে দ্যাখে। নাঃ এখন যাওয়ার দরকার। উঠতে গেলে হাঁটু খচখচ করে।
এদিকে জুম্মনের মা কি যেন বলতে চায়। শুরু করে মাঝপথে থেমে ফের বলে, ‘গতরের মইদ্যে বহুত চোট পাইছো, না? মেডিকলের ডাক্তারে কি কইছে?
কিয়ের চোট? তগো বজলুরে কেমুন কিমা বানাইয়া দিছিদ্যাহস নাই?
একটা খবর তো জানো না?
কি? খিজির এবার বসে পড়ে তক্তপোষের এক ধারে।
জবাব না দিয়ে জুম্মনের মা এটো থালাবাসন গুছিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত হলে খিজির আরাম পায়। বৌয়ের কথা শোনার অজুহাতে আরো কিছুক্ষণ সে এখানে বসে থাকতে পারে। তবে জুম্মনের মা ফের তার হাঁটুর ব্যথার কথা তুললে খিজির একটু খিচড়ে যায়, ‘সোয়াগ থো! কি কথা কইলি না? মালপানি লাগবো? মালপানি চাইলেই বা সে দেবে কোথেকে? অথচ ঝাঝালো করে বলে, কতো লাগবো?
না।
তাইলে? খিজির অসহিষ্ণু ওয়ে ওঠে, কইবি তোক নাইলে আমি যাই গিয়া।
এরপরেও একটু সময় নিয়ে জুম্মনের মা মিনমিন করে কি যে বলে খিজিরের মাথায় ঢোকে না, কি কইলি?
জুম্মনের মা তার বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলে খিজির চিৎকার করে ওঠে, কি? কি কইলি? তারপর একটু আস্তে জিগ্যেস করে, ক্যাঠায় কইলো? জুম্মনের মা ছেলের গায়ে কথা জড়িয়ে দেয়। খিজির বলে, হাচা কস?
তাইলে কি?’
‘ঈমানে?
‘ঈমানে!
বুঝলি ক্যামনে? ক্যাঠায় কইলো?
কইবো ক্যাঠায়? খিজিরের প্রতি বাৎসল্য ও কৌতুকে জুম্মনের মায়ের কালো মুখে হাসি উপচে পড়ে, তার বসন্তের দাগগুলো প্রসারিত হয়, পোয়াতি হইলাম আমি, আর আমি বুঝুম না?
হাঁটুর ব্যথা খিজির এখন বিশেষভাবে বুঝতে পাচ্ছে না। সারা শরীর জুড়ে নতুন ধরনের স্পন্দন। এই নতুন ছটফটানি তার অপরিচিত। মাথার ভেতরকার একটা জাম যেন কেটে যাচ্ছে, রিকশার প্যাডেলে দাঁড়িয়ে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে, সামনের মাল বোঝাই ট্রাক তার রিকশাকে সাইড দেওয়ার জন্যে রাস্তার ধার ঘেঁষে চলতে শুরু করেছে। কিন্তু সামনের রাস্তা বড়ডো ফাকা, এই মস্ত রাস্তায় কি তার রিকশা ছাড়া কোনো গাড়ি নাই? এই খা খাঁ রাস্তায় রিকশা চালাবার সুযোগ পেয়ে সে একটু বিচলিত হয়। নতুন অৰ্পিত দায়িত্বভারে তার হাড্‌ডিসর্বস্ব বুক চওড়া হতে থাকে।—দুত্তোরি শালা। তার কাজের কি শেষ আছে? এর ওপর এই খানকি মাগীটা কি-না তার বীজ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!—আহা! এই নিয়ে মাগীটাকে মশলা বাটতে হয়, কাপড় কাচতে হয়, রান্না করতে হয়। আর মাহাজনের যা খাসলত,-একটা আমান খচ্চর, জাউরার পয়দা জাউরা–তার ঘরে জুম্মনের মাকে সে রাখে কি করে?-এই সময় কুপির লালচে হলুদ আলো মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো তরল লাল আগুন হয়ে। সমস্ত ঘর ভাসে লাল রক্তে, রক্তের ভেতর শুয়ে থাকে ন্যাংটা মেয়েমানুষ।-বস্তির কাচা ও ভ্যাপসা ঘর দুলতে থাকে পাকা দোতলা বাড়ির সিঁড়ির নিচে। দোলে, দোলে। মায়ের রক্তাক্ত ন্যাংটা গতর থেকে চোখ ফেরাবার জন্য তাকে মাথা ঘোরাতে হলো। সৌভাগ্যক্রমে হঠাৎ করে নর্দমা থেকে পাওয়া গুমুতের গন্ধের ১টি ঝাপটায় মাথা ফের ফিরে আসে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে। সে তোলে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ, মনে লয় হাঁটুখান খাম কইরা দিছে।’
জুম্মনের মা তার পাশে বসে স্বামীর হাঁটুতে হাত রাখে, পাওখান গরম ঠাহে।
খিজির সেই হাত সরিয়ে দেয় না, বলে, তুই মাহাজনের ঘরেই কাম করব? এই বস্তির মইদ্যেই থাকবি?
বৌয়ের মুখে হ্যাঁ শোনবার আগেই তাড়াহুড়া করে খিজির হুকুম ছাড়ে, থাক! এখানেই থাক। আমি কৈ থাকি ঠিক নাই। অহন আমার বহুত কাম মাস মাস ভাড়া পঠাইয়া দিমু! তর পয়সাকড়ি লাগলে জুম্মনরে দিয়া খবর দিস খিজির উঠে দাঁড়ালে জুম্মনের মা বলে,
আউজকা না হয় তুমি এহানেই থাকো।
না যাই। সায়েবের গ্যারেজে থাকতে হইবো। বললেও বৌয়ের আরেকটি অনুরোধের আশায় খিজির দাঁড়িয়ে থাকে। রাইতটা থাকো না! আমি না হয় বিবিসায়েবরে দিয়া মাহাজনরে কওয়ামু, তোমার শরীলটা খারাপ। দুই চাইরটা দিন না হয় থাকলা!
মাহাজনেরে কি কইবি মাগী? খিজির ফের চটে যায়, ‘তর মহাজনে জান লইয়া মহল্লা থাইকা ফোটনের তালে মালসামান বাদে, হেই খবর রাখস?
এরপর নরম করে কথা বলা তার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। দরজায় পা দিয়ে জুম্মনের মায়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সে তাকে সাবধান করে দেয়, হুশিয়ার থাকবি তুই খানকিটা জিন্দা থাকস আর নাই থাকস, তর প্যাটেরটার কোন জখম উখম হইলে তরে এক্কেরে জানে মাইরা ফালামু, কইয়া দিলাম!

চিলেকোঠার সেপাই – ২৭

জুম্মনের মা, এইগুলি কি শুনি? কয়মাস চলে? কামরুদিনের প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে ভয় পেয়ে জুম্মনের মা সত্যি কথাটাই বলে। জবাব শুনে কামরুদিন স্বস্তি পায়, তাইলে চিন্তা নাই। দুই চাইর দিনের মইদ্যে প্যাট খসাইয়া ফালা!
জুম্মনের মা উসখুস করে। গতকাল সন্ধ্যায় ঘরে ডেকে নিয়ে কামরুদ্দিনকে মহাজন তাহলে পটিয়ে ফেলেছে।
কামরুদিনের অসম্ভষ্ট চেহারা দেখে রহমতউল্লা কাল খুব হাসছিলো। পরিণত ও অভিজ্ঞ বয়স্ক মানুষের সস্নেহ হাসি, তাতে প্রশ্ৰয় মেশানো। কামরুদ্দিন হলো বড়ো ঘরের ছেলে, তার পূর্বপৃরুষরা সব কীর্তিমান রাজমিস্ত্রি, নবাব বাড়ির গম্বুজটা তার দাদার বাপের তৈরি। আর সে কি-না নিকা করবে যে মেয়েমানুষকে তার পেটে এখন ছোটোলোকের সন্তান? না, না, কামরুদিন তো বটেই, রহমতউল্লাও এটা বরদাশত করে কি করে?–তবে এটা কি কোনো সমস্যা হলো? কতো উপায় বেরিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায়, রাস্তার মোড়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর ক্লিনিক। ২/৩ মাসের পোয়াতি হলে তো কথাই নাই, ক্লিনিকে একবার নিতে পারলেই হয়। আধা ঘণ্টা ভি লাগবে না, খালাস কইরা দিবো। জুম্মনের মায়েরে শাড়ি দিবো একখান, নগদটাকা দিবো কুড়িটা। দেশে অবাঞ্ছিত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রহমতউল্লা বড়ো উদ্বিগ্ন। এই যে সরকারের উন্নয়নের তোড়, ১০ বছরের ডেভেলপমেন্ট, সব ব্যর্থ হবে লোকে যদি সন্তান জন্ম দেওয়ার কাজে একটু চিলা দিতে না পারে।
মহাজনের শিখিয়ে দেওয়া পরিকল্পনার কথা কামরুদিনের মুখে শুনে জুম্মনের মা হেসে গড়িয়ে পড়ে, কি যে কন আপনে অহনতরি পোলাপানই রইলেন।’
‘ক্যামনে?
তয় কি? এইটা কি পুরান বাড়ির ছাদ পাইলেন? লোহার একটা বাড়ি মাইরা পলেস্তারা খসাইয়া ছাদ ফালাইয়া নয়া ঢালাই আরম্ভ করলেন। জুম্মনের মা বানানো হাসিটাকে কষ্ট করে টিকিয়ে রাখে, পয়দা হওনের আগে জানটারে কবচ করবার চান?
পরপর কয়েকদিন একইভাবে হেসে আর কথা বলে জুম্মনের মা কামরুদ্দিনকে একটুও ভেজাতে পারলো না। আবার মহাজনের ভাতের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ার পরিকল্পনাতেও জুম্মনের মা রাজি হয় না। কামরুদিন একদিন চটে যায়, ঠিক আছে। ঐ ভ্যাদাইমার লগে পইড়া থাক। জুম্মনরে আমার কাছে পাঠাইয়া দিস।’
জুম্মনের ব্যাপারে জুম্মনের মা কামরুদিনের ওপরেই বা ভরসা করে কিভাবে? মহাজন তার জন্যে বর্ণমালা এনে দিয়েছে, কাল পয়সা দিলো আদর্শ লিপি কিনতে। স্কুলে ভর্তি হলে সব খরচ জোগাবে মহাজন। মহাজন যদি সাহায্য করে তো আল্লার মেহেরবানীতে জুম্মন এমনকি ম্যাট্রিক পাস করতে পারে একদিন মহাজন যদি ১টা রিকশা কিনে দেয়, রিকশার ভাড়া যদি দিতে না হয় তো সেটা চালিয়ে জুম্মন তার নিজেই একদিন কতো রিকশার মালিক হবে। বেবি ট্যাকসি একটা কিনতে হবে কতোক্ষণ?—খিজিরের সঙ্গে থাকলে?—অসম্ভব! পেটেরটা দুনিয়ার মুখ দ্যাখার পর খিজির তো জুম্মনকে সহ্যই করতে পারবে না।
এর মধ্যে খিজির একদিন এসেছিলো। তখন অনেক রাত, মহাজনের বাড়ি থেকে ফিরে জুম্মনের মা কেবল খেতে বসেছে। খিজিরকে দেখে খাওয়া দাওয়া তার মাথায় উঠলো। ‘চোরের লাহান কি করতে আইছো? বাপ হওনের হাউস করো, পোলারে খাওয়াইতে পারবা? পরাইতে পারবা? বাপ হইবার চাও!—হায়রে মরদ!’
খিজির বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। বজলু শালার ঘরে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বস্তি ছাড়লে কি হয়, এই মহল্লা খিজির ছাড়বে না। জুম্মনের মাকে পাহারা দেওয়ার জন্য কাছাকাছি থাকা দরকার। আলাউদ্দিন মিয়া অবশ্য কথা দিয়েছে, খিজিরকে যে করে হোক এই এলাকাতেই থাকার বন্দোবস্ত করে দেবে। মহাজনের বস্তিতে কামরুদিনের বসবাসের সম্ভাবনার কথা শুনে আলাউদ্দিন মিয়া একটু ভাবনায় পড়েছে। রহমতউল্লা তাহলে মহল্লায় নিজের শক্তিবৃদ্ধির আয়োজন করছে? কামরুদিন এসে পড়লে খিজিরকে আলাউদ্দিন মিয়ার দরকার হবে আরো বেশি। বড়ো কথা, খিজিরের মতো এরকম জেনুইন ওয়ার্কার পাবে কোথায়? মামুজান অবশ্য কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, মহল্লার নেতৃত্ব তার হাত থেকে প্রায় যায় যায়। সেদিনকার পোলাপান—এখনো হাফপ্যান্ট পরে-তারা কিনা রহমতউল্লার বাড়ির সামনে দিয়ে হঁটিতে হাঁটতে একসঙ্গে চিৎকার করে, আইয়ুব খানের দালালরা -ভুট্টা দিয়া ছাতু খা’ মুশকিল হয় সিতারাকে নিয়ে। আলাউদ্দিন তাকে অনেকটা হাত করে এনেছে, তবে বাপের সম্বন্ধে এইসব টিটকিরি তার গায়ে লাগে, আলাউদ্দিন মিয়া গেলেই প্যানপান করে, আপনেরা আব্বার লগে কি শুরু করছেন?
আরে পোলাপানের কথা ছাড়ো!’
পোলাপানে তো আপনারই সাগরেদ। খিজিরটারে আব্বায় খেদাইয়া দিলো, অরে জায়গা দিলেন আপনে আব্বায় কয়, ভাইগ্লা কুনোদিন আপন হইতে পারে না! এখন মামুজানের মেয়েটিও যদি তাকে আপন করে নিতে অস্বীকার করে এই ভাবনায় আলাউদ্দিন মিয়ার প্রেমগদগদ বুক নেতিয়ে পড়ে। খিজিরকে ডেকে বলে, দাখ, মামু বুইড়া মানুষ, তারে ইজ্জত করতে হয়। তুই আমার গ্যারেজের মইদ্যে থাকস, মামুজানে কয়, ভাইগ্রা আমারে বেইজ্জত করবার লাইগা অরে রাখছে!’
এই মহল্লা ছেড়ে খিজির এখন কোথাও যেতে পারবে না। এই ব্যাপারে আলাউদ্দিন মিয়া তার সঙ্গে একমত। কিন্তু জুম্মনের মায়ের পেটে গচ্ছিত তার সন্তানের নিরাপত্তার জন্যে খিজিরের উদ্বেগ দেখে আলাউদ্দিন মিয়া অবাক, তুই হালায় আদমি না পায়জামা? আরে আউজকা বাদে কাউলকা ঐ মাগী বলে নিকা বইবো কামরুদিনের লগে, তার প্যাটের বাচ্চার লাইগা তুই দিওয়ানা হইয়া গেলি? খিজির এই ধিক্কারে কোনো সাড়া না দেওয়ায় আলাউদ্দিন তার পরিকল্পনার কথা ফিসফিস করে জানায়, ‘শোন। মামানীরে আমি হিন্ট দিয়া রাখছি, জুম্মনের মায়ের ক্যারেক্টার খারাপ, অরে রাইখা ঘরের বদনাম হইতাছে। দুইটা দিন যাইতে দে না। কামরুদিনের লগে নিকা বইবো তো, দুইটারে একলগে খেদাইমু মহল্লার ধারে কাছে ভি আইবার পারবো না!’
রাত ১টার দিকে রিকশা নিয়ে এসে খিজির দ্যাখে গ্যারেজে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জুলছে ৪টে। কাল ভোরবেলা থেকে পরশু বিকালের জনসভা সার্থক করার প্রস্তুতি শুরু হবে। এখন সেই প্রস্তুতির প্রস্তুতি। ছাত্রকর্মীদের কেউ কেউ বসে পোস্টার লিখছে, চাটাইয়ের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে বড়ো বড়ো পোস্টার। ১টি পোস্টারে ১জন সৈন্যের ছবি। তার মাথায় হেলমেট, কোমরে ফিট করা পিস্তল, হাতে রাইফেল। তাক-করা রাইফেলের সামনে হাজার হাজার মানুষের মিছিল। সৈন্যের চোখ দুটো কালো কাপড়ে ঢাকা। এর মানে কি? যে ছেলেটি ছবি আঁকছিলো সে বুঝিয়ে বলে যে মিলিটারির লোকজন অন্ধের মতো মানুষ হত্যা করে চলেছে।-কেন, মিলিটারির লোক কি কানা?—ছেলেটি গম্ভীর হয়ে বলে, ‘কানাই তো। কানা বলেই নির্বিচারে নরহত্যা চালাতে পারে।
কি জানি? খিজিরের কিন্তু মনে হয় না। আইয়ুব খান কি অন্ধ? শয়তানের চোখ বরং সংখ্যায় অনেক বেশি, আগে পিছে সে অনেক কিছু দেখতে পায়। তার হাত থেকে বাচতে হলে তার চোখগুলো চিরকালের জন্য অন্ধ করে দেওয়া দরকার। কথাটা ভাবতে ভাবতে খিজির গ্যারেজের ১ কোণে বিছানা পাতার উদ্যোগ নেয়। ১টি ছেলে বলে, ‘আজ এখানে শোবে কোথায়? আমরা আজ গোটা ঘর দখল করেছি।
তাদের পোস্টারের রঙ এখনো কাচা, পোস্টার মেলে রাখতে না পারলে ছবি লেস্টে যাবে। অনেক জায়গা দরকার, আরেকটি ছেলে বলে, আলাউদ্দিন ভাই বলছিলো তুমি নাকি আজ ওসমান সায়েবের ঘরে শোবে।’

Page 6 of 17
Prev1...567...17Next
Previous Post

ছোটগল্প সংকলন – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

Next Post

খোয়াবনামা (উপন্যাস) – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

Next Post

খোয়াবনামা (উপন্যাস) - আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

অসীমানন্দ মহারাজের গল্প - অসীমানন্দ মহারাজ

মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সাম্প্রতিক প্রকাশনাসমূহ

  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৫: ভূমিকম্প – শামসুদ্দীন নওয়াব
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৮: বিভীষিকার প্রহর – রকিব হাসান
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৭: বড়দিনের ছুটি – রকিব হাসান
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৭: আলাস্কা অভিযান – রকিব হাসান
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৭: আমিই কিশোর – রকিব হাসান

বিভাগসমূহ

  • আত্মজীবনী
  • ইতিহাস
  • উপন্যাস
  • কবিতা
  • কাব্যগ্রন্থ
  • গল্পের বই
  • গোয়েন্দা কাহিনী
  • ছোট গল্প
  • জীবনী
  • দর্শন
  • ধর্মীয় বই
  • নাটকের বই
  • প্রবন্ধ
  • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
  • বৈজ্ঞানিক বই
  • ভূতের গল্প
  • রহস্যময় গল্পের বই
  • রোমাঞ্চকর গল্প
  • রোম্যান্টিক গল্পের বই
  • শিক্ষামূলক বই
  • আমাদের সম্পর্কে
  • যোগাযোগ
  • গোপনীয়তা নীতি

© 2023 BnBoi - All Right Reserved

No Result
View All Result
  • বাংলাদেশী লেখক
    • অতুলচন্দ্র গুপ্ত
    • অভিজিৎ রায়
    • আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
    • আনিসুল হক
    • আবু ইসহাক
    • আবু রুশদ
    • আবুল আসাদ
    • আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
    • আবুল বাশার
    • আরজ আলী মাতুব্বর
    • আল মাহমুদ
    • আসাদ চৌধুরী
    • আহমদ ছফা
    • আহমদ শরীফ
    • ইমদাদুল হক মিলন
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
    • কাসেম বিন আবুবাকার
    • জসীম উদ্দীন
    • তসলিমা নাসরিন
    • দাউদ হায়দার
    • দীনেশচন্দ্র সেন
    • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
    • নিমাই ভট্টাচার্য
    • প্রফুল্ল রায়
    • প্রমথ চৌধুরী
    • ময়ূখ চৌধুরী
    • মহাদেব সাহা
    • মাহমুদুল হক
    • মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    • হুমায়ূন আহমেদ
  • ইন্ডিয়ান লেখক
    • অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
    • অতুল সুর
    • অদ্রীশ বর্ধন
    • অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • অনীশ দেব
    • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • অমিয়ভূষণ মজুমদার
    • আশাপূর্ণা দেবী
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
    • কাজী নজরুল ইসলাম
    • ক্ষিতিমোহন সেন
    • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    • তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
    • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
    • নারায়ণ সান্যাল
    • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    • নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    • পাঁচকড়ি দে
    • পূর্ণেন্দু পত্রী
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • বিমল মিত্র
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়
  • বিভাগসমূহ
    • আত্মজীবনী
    • ইতিহাস
    • উপন্যাস
    • কবিতা
    • কল্পকাহিনী
    • কাব্যগ্রন্থ
    • খেলাধুলার বই
    • গল্পের বই
    • গোয়েন্দা কাহিনী
    • ছোট গল্প
    • জীবনী
    • দর্শন
    • ধর্মীয় বই
    • নাটকের বই
    • প্রবন্ধ
    • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
    • বৈজ্ঞানিক বই
    • ভূতের গল্প
    • মুক্তিযুদ্ধের-বই
    • রহস্যময় গল্পের বই
    • রোমাঞ্চকর গল্প
    • রোম্যান্টিক গল্পের বই
    • শিক্ষামূলক বই
    • সমগ্র
  • সিরিজ বই
    • মিসির আলী সমগ্র
    • হিমু সিরিজ

© 2023 BnBoi - All Right Reserved

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In