আমজাদিয়ায় এক কোণে ওদের টেবিলের সামনে রয়েছে শওকত। মাথাটা সে ঠেকিয়ে রেখেছে পেছনের দেওয়ালে। সামনে এ্যাঁশট্রেতে মোটা চুরুট থেকে পাতলা ধোঁয়া জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আনোয়ার সামনে এসে বলে, একা যে?
এর জবাব আমি কি করে দেবো? যারা আসেনি তাদের জবাব দেওয়ার দায়িত্ব কি আমার? এই কথার সঙ্গে নিঃশব্দ হাসিতে তার মস্ত বড়ো মুখ ভরে যায়, চোখজোড়া ঢুলুচুলু। ওসমান জিগ্যেস করে, আপনার খবর কি?
সার্থী হ্যাঁয় খুবসুরত-মওসম কা ইয়ে খবর হ্যাঁয়। শওকত গুনগুন করে গানটার সুর ভাজে। সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আরো ছড়িয়ে বসে চোখ বন্ধ করে।
চা খেতে খেতে আনোয়ার জিগ্যেস করে, ওসমান, তোমার ছুটি নেওয়ার কি করলে? ওসমান আমতা আমতা করে, একটু মুশকিল হচ্ছে দোস্ত। আমাদের সেকশনে একজন ছুটি নিয়েছে, তার আর ফেরার নাম নেই।’
‘আরে তোমার তো মেলা ছুটি পাওনা! একবার এ্যাঁপ্লাই করেই দ্যাখো না! ওসমান আমতা করে, না আবার একটা প্রাইভেট ট্যুইশনি নিতে হলো, এবার পরীক্ষা দেবে।
‘ইন্টারমিডিয়েট? না। এসএসসি, মানে ম্যাট্রিক দেবে।’ ‘এখন পরীক্ষা কোথায়? চলো তো যাই। ঘুরে এসে তৈরি করে দিও।’ ওসমান সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে বলে, কিন্তু অঙ্কে খুব কাঁচা। তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করা যাবে না। ওসমান ভাবে, ভালো করে দেখিয়ে না দিলে রানুট এবারও ফেল করবে। দায়িত্ব নিয়ে এভাবে কেটে পড়াটা কি ঠিক?
এইসব গাধাগরুকে পড়াও কেন? তুমি না ভালো ছেলে না হলেতো পড়াও না। একটা ব্লান্ট ছাত্রকে পড়াতে বিরক্ত লাগে না?
এইবার রানুর জন্য ওসমানের খুব খারাপ লাগে। মনে হচ্ছে একই অঙ্ক বারবার ভুল করার অপরাধে বাইরের একটা লোক এসে রানুকে বিশ্রীভাবে হেনস্থা করছে। খাতা থেকে মুখ তুলে রানু ওসমানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রানুর মুখ আস্তে আস্তে ঝাপশা হয়ে আসে, তখন রানু কি রঞ্জু কার মুখ ঠিক ঠাহর করা যায় না।
ওসমান গম্ভীর হয়ে বলে, নিতে হলো। প্রিন্সিপলে অতোটা স্টিক করাটা আমাদের পোষায় না ভাই!’
এদিকে ঝিমুনি বা তন্দ্রা থেকে সোজা হয়ে বসে নিভে-যাওয়া চুরুটে আগুন ধরাতে শওকত জিগ্যেস করে, এই রান্ট স্টুডেন্টটা কোন জেনডারের? উল্টোদিকের টেবিল থেকে উঠে আসে খালেদ। ঐ টেবিলটা থাকে কবিদের দখলে, খালেদও কবিতা না গল্প কি যেন লেখে। খালেদ এসেই শওকতকে বলে, কি ওস্তাদ, আউট হয়ে গেছেন নাকি?
শওকত হাসে, এতো তাড়াতাড়ি? গুলসিতান থেকে পাঁচটা পেগ দিয়ে বউনি করে এলাম।
পাঁচ পেগ মেরে দিলেন? পাঁচ পেগের কথা তার বিশ্বাস হয়নি। বিশ্বাস করার কোনো কারণও নাই। কি খেলেন? আনোয়ার জিগ্যেস করলে শওকত ফের হাসে, এই শীতে আর কি চলবে? দিস ওয়েদার হুইসপারস, হুইস্কি! হুইস্কি!
খালেদ বলে, চলেন। এবার হাক্কায় একটু বঙ্গজননীর সেবা করা যাক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শওকত বলে,আসেন না! আনোয়ার, একটা পাইট মেরে আসি।
আনোয়ার সরাসরি না করে, না, এক জায়গায় যেতে হবে।’
খালেদ একটু ঠাট্টা করে বিপ্লব ত্বরান্বিত করার কাজে?
শওকত তখন ওসমানকে আহবান জানায়, ওসমান?
ওসমান সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আনোয়ারের দিকে না তাকিয়েই কাল দ্যাখা হবে দোস্ত’ বলে শওকত ও খালেদের সঙ্গে সে বেরিয়ে যায়।
চিলেকোঠার সেপাই – ১২
বললাম না আছে! তুমি কি আমার থাইকা বেশি জানো?
‘তুই তো সব জানিস’
ওসমানের একটু ঘুম পাচ্ছিলো, রানু ও রঞ্জকে ঘরে দেখে বিছানা থেকে উঠে বসলো। রাত্রিটা বিশ্রী কেটেছে, ঘুম হতে পারে এই আশায় অনেকক্ষণ ধরে মাস্টারবেশন করে, কিন্তু একটু তন্দ্রায় গড়াতে না গড়াতে পানিটোলার চাপা গলিতে সারি সারি খাটা পায়খানার বালতির পাশ দিয়ে কার সঙ্গে হেঁটে যাবার স্বপ্ন দ্যাখে এবং স্বপ্লের মধ্যেই গুয়ের গন্ধে জেগে উঠে ছাদে গিয়ে বমি করে ফেললো। বমির পর আর ঘুম হলো না। সকাল থেকে এ পর্যন্ত ৪টে এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট এবং অফিস থেকে ফেরার পথে আনন্দময়ী হিন্দু হোটেলে বাট মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বেশ ভালো লাগছিলো। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারলে সন্ধ্যাটা চমৎকার কাটতো।
আপনে কখন আসছেন? রানুর এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই রঞ্জু বলে, ‘নেন, আমারে কয়টা ট্রানশেন দ্যাখাইয়া দেন। ইস্কুল টিস্কুল হয় না, আব্বা অস্থির হইয়া থাকে। আপারে বললাম, চলো খাতাপত্র নিয়ে চলো। না। যদি না থাকে?—এখন যাও, খাতা বই নিয়া আবার আসো খালি আপ-ডাউন মারো৷’
রানু জিগ্যেস করে, খাওয়া দাওয়া করবেন না?
‘খেয়ে এসেছি।
‘এখন বিশ্রাম করবেন?
আরে না না! দুপুরে আমি কখনো ঘুমাই না। একেবারেই না। নেভার ওসমান এতোটা তাড়াহুড়া করে বলে যে, মনে হয় এই বিবৃতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কথার এই দ্রুত ও অস্থিরগতি নিজের কানেই মাত্রাছাড়ানো মনে হলে তাকে ফের বলতে হয়, গত বৎসর দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম মাত্র একদিন। তাও ছুটির দিন ছিলো, দুপুরবেলা ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিলো, না ঘুমিয়ে উপায় ছিলো না।
রঞ্জু হাসতে হাসতে জিগ্যেস করে, তারিখ মনে আছে?
খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে সায়েবি উচ্চারণে ওসমান বলার চেষ্টা করে, জানুয়ারি দ্য টুয়েন্টি সেকেন্ড, নাইনটিন হান্ড্রেড এ্যাঁন্ড সিক্সটি এইট এডি।
জানুয়ারি মাসে বৃষ্টি হয়? রঞ্জুর এই সংশোধনী বাক্যে হাসির হল্লা ওঠে, ওসমানের মাথার ভেতর ঘুমের যে প্রস্তুতি চলছিলো তার আর লেশমাত্র বাকি থাকে না। ভাইবোনকে বসতে বলে সে ১টা সিগ্রেট ধরায়। রন্ধুকে বলে, তোমার ট্রানশেন দেখি।’
রানুর সঙ্গে কথা বলার আগে সিগ্রেটে খুব জোরে টান দেয়, কিছুক্ষণ কাশে, তারপর টোক গেলে বার কয়েক। বলে, তোমার ঐকিক নিয়ম না আজ?
ভাইবোন। গায়ের রঙ দুজনের প্রায় একই রকমের শ্যামলা।
সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ঢেউ তোলানো ২ জোড়া নীলচে ঠোঁট। নাকের নিচে ঠোঁটের ওপর ছোটো ভাঁজও দুজনের একরকম। দুজনের নাকও বোধ হয় এক মাপের, স্কেল দিয়ে মেপে দ্যাখা যায়। তবে রানুর নাকের ডগায় ও নাকের নিচে ছোটো ভাঁজটিতে বিন্দু বিন্দু কয়েক ফোটা ঘাম। কিন্তু রঞ্জুর মুখের কোথাও ঘামের চিহ্নমাত্র নাই। ওসমান নিজের নাকের ডগা ও নাকের নিচে আঙুল বুলিয়ে নিলো, নাঃ। একবারে শুকনা খ খ করছে। রানুর ও রঞ্জুর দুজনেরই হাসি হাসি মুখ, কিন্তু রানুর নাক ও ঠোঁটের ওপরকার একক ঢেউটির নাতিশীতোষ্ণ নোনতা শিশিরবিন্দু তাকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে। সিলেটের ধোঁয়ার পাতলা পর্দা ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো রানুর ঘামের বিন্দুগুলোকে অনেক বড়ো করে দাখায়। মনে হয় তার নাকের ডগায় ও ঠোঁটের ওপরকার ঢেউয়ে শিশিরবিন্দু সব বৃষ্টির ফোটা হয়ে টলটল করছে। ওসমানের পিপাসা পায়, রানুর নাকের ডগায় ও ঠোঁটের ওপরকার ঢেউতে মুখ রেখে সমস্ত জলবিন্দু শুষে নেওয়ার জন্য সে ছটফট কর। ১টা চুমুক দিলে হয়তো সারাদিন আর পানি খেতে হবে না। সিগ্রেটে টান দিতে ভুলে গিয়ে ওসমান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। রঞ্জ বলে, ‘ছোটপা, তুমি থাকো। আমি তোমার বইখাতা নিয়া আসি।
আমার বই খুঁজতে গিয়া আমার সব বইপত্র তুই ওলটপালট কবি। আমি যাই।’ ওসমান বলে, রানু, তুমি বই খাতা আনোনি কেন? রানু, কথাটা বলতে ওসমানের জিভ শিরশির করে, এই শব্দটি বলতে তার স্বেদবিন্দু পানের পিপাসা শতগুণে বেড়ে গেলো। নামটির উচ্চারণে তার ঠোঁট ও জিভ ছাড়িয়ে সেই পিপাসা যেন দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। ওসমান তখন তক্তপোষের সামনে টেবিলে টেনে এনে টেবিলের এপারে ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে। রঞ্জ ও রানু এখন ওর মুখোমুখি। পিপাসা নিভিয়ে দেওয়ার কিছুমাত্র ইচ্ছা ওর নাই, চোখ জোড়া দিয়ে যতোটা পারা যায় রানুর ঘামের বিন্দু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পিপাসার তীব্রতা ক্রমে বাড়ে, তা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ওসমান হুকুম দেয়, রানু এখন আবার নিচে যাবে কেন? রঞ্জ যাও, ওর অঙ্ক বই খাতা নিয়ে এসো।
রানু বলে, দাখ, বইপত্র ওলটপালট করিস না। জবাব না দিয়ে লাফাতে লাফাতে রঞ্জ নিচে নামে। ওসমানের মুখোমুখি একা বসে রয়েছে রানু। ওসমান কি এখনই অঙ্কের কথা বলবে? নাকি আগে রানুর নাকের ডগা ও তার নিচেকার ঘামের ফোটা শুষে নেওয়ার পিপাসার কথা জানাবে? কথাটা শুরু করে কিভাবে? সে এই নিয়ে একটু প্রবলেমে পড়ে। রানু বলে, অনেক রাত্রে ফিরছেন, না?
হ্যাঁ, তুমি জানলে কি করে? সিঁড়ি দিয়া আপনার ওঠার আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙছে। রানুর সেকেন্ড ব্র্যাকেট মার্কা ঠোঁটজোড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে-আসা এই সব শব্দ তার নকের ডগা ও তার নিচেকার বিন্দু বিন্দুলিকার পানের জন্য ওসমানের পিপাসায় ইন্ধন জোগায়।
আপনে এতো রাত্রে আসেন, ভয় লাগে না? ভয় কিসের? ওসমান বলে বটে, কিন্তু তার তীব্র স্বেদতৃষ্ণা তার ধ্বনিপ্রবাহের স্বাচ্ছদ্য নষ্ট করে, বাক্য কাপে। রানু কিন্তু অনায়াসে বলে, রাস্তাঘাটে আজকাল কতোরকম গোলামাল। কোনদিন কি হইতে পারে আপনে জানেন?
কোনো উদ্বেগ বা ভয় বা আবেগে নয়, রানুর গলার স্বর হয়তো সর্দিতে একটু ভারি। ওসমানের সবগুলো আঙুল সেই ভারিস্বরে একটু একটু কাপে। সে নিজের হাত মুঠি করে, ফের খোলে। এতে আঙুলের ব্যায়াম হয়, কিন্তু কাপুনি থামে না। আঙুল বেয়ে এই কাপুনি শেষ পর্যন্ত শালার মাথায় চড়ে না বসে। এটার প্রতিবিধান খুব জরুরি। সে করে কি তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা এগিয়ে রানুর নাকের ডগায় ছুয়ে আস্তে আস্তে ঘামের বিন্দুগুলো মুছে ফেলে, তারপর ব্লটিং পেপার চেপে রাখার ভঙ্গিতে তর্জনীটাও আস্তে করে ঠেসে ধরে রানুর নাকের নিচেকার ছোটো ভাজের ওপর। রঞ্জুর ভাঁজটাও অবিকল এই রকম। ওসমানের নিজের নাকের নিচেও এরকম নিশ্চয়ই একটা ভাঁজ আছে। তার মতো গোঁফের আগাছা উঠে রঞ্জুর ভাঁজটাজগুলো আড়ালে পড়ে যাবে, রানুরটা এমনি স্থির ঢেউ হয়ে সারাজীবন সকালে বিকালে একটি দুটি করে ঘামের বিন্দু ফুটিয়ে তুলবে।
হাত সরিয়ে নিতে নিতে ওসমান বলে, রাত্রিবেলা ভয় পেয়ে আজ বিকালবেলা পর্যন্ত ঘামছো, না?
১টি পলকের জন্য রানু তার চোখজোড়া যতোটা পারে ফাক করে ওসমানকে দ্যাখে, তারপর মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে বসে। এভাবে বসেই তার কালো ও সরু আঙুল দিয়ে সে তার নাক ও নাকের নিচে, এমনকি ঠোঁট ও চিবুক পর্যন্ত ভালো করে মোছে। ওসমানের ছোঁয়ায় কি তার সুড়সুড়ি লাগছিলো?
ওসমান হঠাৎ কথা বলতে শুরু করে। খুব সিরিয়াস গোছের কথা। যেমন, ঐকিক নিয়মটা রানুর ভালো করে রপ্ত করা দরকার। যেমন, ঐকিক নিয়ম একবার রপ্ত করতে পারলে এই সব অঙ্ক একেবারে জলবৎ। যেমন, অঙ্কে ভালো করতে না পারলে পরীক্ষায় কেউ ভালো ফল করতে পারে না। যেমন, অঙ্কে নম্বর ওঠে সলিড এবং নম্বর মানে ভালো নম্বর। অঙ্কে বেশি না, সত্তর পচাত্তর তুলতে পারলে রানু এমন কি ফাস্ট ডিভিশনও পেতে পারে। ফাস্ট ডিভিশন পাওয়া এমন কিছু নয়।
রানুর বই খাতা নিয়ে রঞ্জু এসে পড়ে, বলে, ছোটাপা, তুমি পড়ো, আমারে বাইরে যাইতে হইবো।
‘এখন আবার বাইরে কি রে? বিকাল হইতে না হইতে খেলা? ওর ঘামের বিন্দু নিশ্চিহ্ন হবার পর এটাই রানুর প্রথম কথা। রানুর কণ্ঠ থেকে ভিজে ভিজে ধ্বনিও কি কেউ শুষে নিলো? রানু যদি এই কাঠকাঠ গলায় হঠাৎ বলে, রঙ্গু, তুই যাবি তো আমি কি এখানে একলা থাকবো? কিংবা রানু যদি তার পুত্ৰশোককাতর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আম্মা, আমারে তোমরা পড়াইতে পাঠাও কার কাছে? সে আমার শরীরে হাত দিতে চায়! কিংবা ওসমানের চোখে চোখ রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘খালি লেখাপড়াই শিখছেন, বাপমা ভদ্রতা শেখায় নাই? ভদ্রলোকের মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন না। কথাটা মনে রাখবেন!’ —তাহলে কি হবে?—এরকম কিছু হলে তার প্রতিক্রিয়া কি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে না পেরে ওসমান গনি চোখে মুখে এক ধরনের বেপরোয়া ভঙ্গি তৈরি করে এবং বুক চিতিয়ে বসে ওদের কথাবার্তা শোনে।
রঞ্জু বলে, ‘জী না! এখন আবার খেলতে যাবো নাকি? আম্মা বলছে দোকানে যাইতে আদা আর তেল আনতে বলছে।
রঙ্গু চলে যায়। রানুও চলে যাওয়ার সম্ভাবনায় ওসমান প্রস্তুত হয়ে থাকে। এই দৃশ্য দ্যাখা থেকে রেহাই পাবার জন্যে সিগ্রেট ধরালে ভালো হয়। কিন্তু কিংস্টকের প্যাকেট খুঁজে পাওয়া যায় না। লাভের মধ্যে খোঁজবার কাজটি জুটে গেলো। সিগ্রেট খুঁজতে খুঁজতে রানুর ক্রুদ্ধ অন্তর্ধান ঘটলেও বরং বাচোয়া।
শেষ পর্যন্ত সিগ্রেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে ওসমান যখন ওর দিকে তাকালে রানু তখন নিবিষ্টচিত্তে পাটিগণিতের পাতা ওল্টাচ্ছে। একটু অন্যদিকে তাকিয়ে ওসমান বলে, ’দেখি।’ কয়েক মিনিটের মধ্যে ওসমান ঐকিক নিয়মের মধ্যে দারুণভাবে ডুবে গেলো। রানুকে কতোভাবে বোঝাবার চেষ্টাই সে যে করে। নিয়ম সম্বন্ধে অনেকক্ষণ ধরে বলে ১টার পর ১টা অঙ্ক কষে দ্যাখায়। ওসমান ১টি পলকও থামে না। ১টি অঙ্কের উত্তর লিখতে না লিখতে আরেকটিতে হাত দেয় এবং রানু বুঝলো কি বুঝলো না জিগ্যেস করার অবসর পর্যন্ত তার হয় না। রানুই শেষ পর্যন্ত বলে , দ্যান। বুঝলাম তো, দ্যান’
রানুর এই অতিরিক্ত সপ্রতিভ ভঙ্গির সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণে খুব ছোট্রো ১টি হাসির বাঁকা আভাস সম্পূর্ণ খাপ খেয়ে গেছে। সেই আভাস অবিচলিত রেখে রানু বলে, আমারে অতো বুঝাইতে লাগে না। দ্যান!
হ্যাঁ হ্যাঁ। সে তো বটেই। ওসমান এমনভাবে বলে যেন এতোক্ষণ ধরে অঙ্ক বোঝানোটা তার অপরাধ হয়ে গেছে।
রানু অঙ্ক কষে আর ক্র একটুখানি তুলে ওসমানের দিকে দ্যাখে। ওসমানও আড়চোখে তাকায় বটে, তবে তার মনোযোগের ১০০ ভাগই রানুর অঙ্কের দিকে। রানু ১টার পর ১টা অঙ্ক ভুল করে যাচ্ছে। এতো ভুল দেখেও ওসমান বিরক্ত হয় না বা হতাশ হয় না। তার আফসোস এই যে, তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য আঙুল থেকে কায়দা করে ২টোকে সে আলাদা করে রেখেছিলো। কিন্তু অঙ্ক কষার জন্যে কলম ধরার ফলে ২টো আঙুল থেকে সমস্ত শিশিরবিন্দু কি একেবারে উৰে গেলো? আড়চোখে একবার দাখা গেলো যে রানুর নকের ডগায় কি তার নিচে ছোট্রো ভাজের ওপর ঘামের ফোটার আর চিহ্নমাত্র নাই। এদিকে রানুর ভুল অঙ্ক কষারও বিরাম নাই। রঙ্কুটার একটু বোকামির জন্য-কি দরকার ছিলো তার নিচে যাওয়ার-মেয়েটার নাকের ডগা খটখটে খা খা হয়ে গেলো। ঐ শ্যামবর্ণের মুখে আর রইলোটা কি? একটু আগে ওসমানের ছিলো ভয়, রানুর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার ভয়। সেটা বরং ভালো, এখন ক্লান্ত ও ভোতা ধরনের অনুভূতি সমস্ত শরীর জুড়ে দাপট মারে। কিছুক্ষণের মধ্যে এই অনুভূতির কারণ বা উৎস সে ভুলে যায়, ফলে অকারণ হতাশা চেপে বসে আরো জোরেসোরে। তার বুক থেকে ছড়াতে ছড়াতে ওপরের দিকে মাথার শীর্ষভাগ এবং নিচে পেটের ডানদিক পর্যন্ত তার ডালপালা পৌঁছে যায়। পেটের চিনচিনে ব্যথা ফের জেগে ওঠে। ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়ে এবং ১টা পর্যায়ে এসে আর বাড়ে না, সেখানেই থেকে যায়। তবে এতে লাভ হয় বৈকি! একটু আগেকার ভয় বা ভোতা অবসাদ-সবই এই ব্যথায় একদেহে হয় লীন এবং তাদের আলাদা করে টের পেতে হয় না। এই ব্যথাটা ডাক্তারদের বুঝিয়ে বলাও মুশকিল। এর নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নাই। বুকের মাঝখানটা এই ছটফট করলো, ভালো করে বোঝাবার আগেই সরে পড়লো নিচের দিকে, বুক ও পেটের মাঝখানকার কোনো ফাঁকে-ফোকরে। সেখানে ভালো করে জানান দিতে না দিতেই একটুখানি ঢেউ খেলিয়ে নেমে গেলো আরো নিচে পেটের নিভৃত কোনো কোণে। আসন পেতে বসে শালার ব্যথা সেখানে জিরিয়ে নেয়, একটু মনোযোগ দিলে ওসমান নিজের এ্যাঁবডোমেনের দেওয়ালে তার ঝিমুনি টের পায়। মাথা নিচু করে অন্ধ করতে থাকা রানুর চিবুক মাঝে মাঝে আলাদা করে দাখা যাচ্ছে। একবার মনে হলো রঙু বোধহয় একমনে ট্রানস্লেশন করে যাচ্ছে। একটু পর এই চিবুকের খানিকটা নিচে একটু বাঁদিকে দাখা যাবে তার শার্টের পকেটে আঁকা রয়েছে খয়েরি সুতার প্যাগোড়া। সঙ্গে সঙ্গে এ্যাঁবডোমেনের ব্যথা আরো নিচে নামে, শিরশির করতে করতে রক্তস্রোতকে ওভারটেক করে পৌঁছে যায় তার উরু জোড়ার মাঝখানে, রঞ্জকে ভালো করে দ্যাখার জন্য ওসমান সামনে তাকায়। কোথায় রঞ্জু? রঞ্জু তো এখন গেছে দোকানে, আদা, রওন, তেল কেনার নাম করে রাস্তায় দুটো তিনটে চক্কর না দিয়ে সে কি আর ফিরবে?
রানু মুখ তুলে বলে, দ্যাখেন, কতোগুলি করলাম। আরো করি?
করো। ওসমানের পেটের ব্যথা ফিরে আসে যথাস্থানে। অফিসে কামালের কাছ থেকে এই ব্যথাটা সম্বন্ধে জেনে নেওয়া দরকার। প্রেমের মতো রোগেও ওর খুব আগ্রহ। এর আগে ক্যান্সার ছিলো কামালের ফেভারিট। কিন্তু বছর দেড়েক আগে ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর কামাল ক্যান্সার-চর্চায় ক্ষান্ত দিয়েছে। আজকাল ওর প্রিয় প্রসঙ্গ হলো প্রেমিকা এবং ডিউওডিনাল আলসার। তার নিজের হাঁপানি, কিন্তু হাঁপানি সম্বন্ধে সে কখনো কিছু বলে না। আবার ডিউওডিনাল আলসারের ব্যাপারে এতো উৎসাহ যে, কথাটার উচ্চারণ ব্যাপারেও কামাল খুব শুচিবায়ুগ্ৰস্ত, কখনো ডিউভীনাল বা ডুইডিনাল বলবে না। ওসমানের পেটের এই অনিয়মিত ব্যাথা, তার এ্যাঁসিডিটি কি শেষ পর্যন্ত ঐ রোগ বলে সনাক্ত হবে? নামটা গালভরা, কিন্তু কামালের মুখে এই রোগের বর্ণনা শুনে শুনে এর ওপর ওসমানের অরুচি ধরে গেছে। পেটের ছোটো অন্ত্র ফুলে গিয়ে নাকি ফুটো হয়ে এমন ব্যথা শুরু হয়ে যে রোগী ব্যথা ছাড়া শরীরকে আর কোনোভাবেই অনুভব করতে পারে না। আচ্ছা, দীপচাদের কি এই রোগই হয়েছিলো? হঠাৎ করে গতরাত্রিতে দাখা স্বপ্লের মধ্যে পানিটোলার চাপা গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ওসমানের বুকে খচ করে ওঠে, স্বপ্নের ভেতর সঙ্গেকার লোকটিকে তখন চিনতে পারেনি, এক্ষুনি চিনলো, আরে সে তো দীপচাদ! মরার এতোদিন পর দীপচাদ মুচি স্বপ্লের মধ্যে এসে ওসমানকে নিয়ে কোথায় যাত্রা করেছিলো?
দীপচাদ মরেছে সে কি আজকের কথা? অন্ত্রের ব্যাথায় নিংড়ে যেতে যেতে দীপচাদ প্রথমে স্টেশনের পাশে তার বসবার জায়গাটা ছাড়লো, কাজকাম সব বন্ধ হলো, কিছুদিন পর মেল ট্রেন পাস করার সময় হলে নিজেই কষ্ট করে গিয়ে শুয়ে রইলো রেল লাইনের ওপর। বর্ধমান মেল বেগুনবাড়ি স্টেশন ক্রস করে রাত ৩টের দিকে, সকালে খবর পেয়ে ওসমানের বাবা ছেলের হাত ধরে চললো রেল লাইনের দিকে। বাপ বেটাকে একসঙ্গে যেতে দেখে পেছন থেকে ডাকে ওসমানের মা, আবার রঞ্জকে সাথে নিচ্ছে দ্যাখো।’
কেন? যাক না ‘ রাত পোয়াতি না পোয়াতি দুধের ছেলেটাকে মুচির মড়া দাখাতি নে যাচ্ছে? মুচি হয়েছে তো হলোটা কি? গোলমালের সময় লাইনের ওপারে সব শয়তানি আয়োজনের খবর দিতো কে? এই দীপচাঁদ মুচির মুখে খবর না এলে আমরা সাবধান হতি পারতাম?
আহা! সে কি না করিছি? রাতে ঘুম ভাঙলি পর যে ছেলে ভয়ে ঠকঠক করি কাপে সাত সকালে তাকে তুমি নে যাও রেলে-কাটা মড়া দাখাতি?
পুরুষ মানুষের অতো ভয় পেতি হবে না। ইব্রাহিম শেখের কাছে বেটাছেলে মাত্রেই পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষের ভয় পাওয়া, লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখা, মাথায় বড়ো চুল রাখা–এসব তার অসহ্য। তা লোকটার নামডাকও ছিলো গোয়াতুমির জন্যেই। লাইনের ওপারে বেগুনবাড়ি গ্রামের বোসদের খুব দাপট, এই বোসরা তাজহাট, রাবড়া—এই গ্রামগুলোতে কয়েকবার খোঁচা দিলেও গোয়ালঘূর্ণিতে হামলা করার সাহস পায়নি। গোয়ালঘূর্ণির কয়েক ঘর মুচি কি এর আশেপাশের জেলেদের পটাবার চেষ্টা করেও বাবুরা সুবিধা করতে পারলো না। শেখেরা কি কম দাপটে ছিলো? দেশভাগের পরেও ২ বছর ১৪ই আগস্ট এলে পাকিস্তানের নিশান ওড়াবার জন্য ইব্রাহিম শেখের হাত নিসপিস করতো। গ্রামের ছেলেছোকরাদের প্রথম প্রথম কী উৎসাহ ইব্রাহিম ভাই, ঝাণ্ডা ওড়ান দিনি, বেগুনবাড়ির মালাউনরা কিছু করতি আসে তো বাছাধনদের রেললাইন পার হয়ে আর বাড়ি ফিরি যেতি হবে না।
পরে সে উৎসাহ আর ছিলো না। গ্রামের খন্দকারদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে ইব্রাহিম শেখ সপরিবারে গেলো ঢাকায়, এসে বছর তিনেক যেতে না যেতেই পাকিস্তান বা পাকিস্তানের পতাকা কোনো ব্যাপারেই তার একটুও আগ্রহ রইলো না, ফের গ্রামেই ফিরে গেলো। শুরু হলো উঠতে বসতে নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমিনকে মোনাফেক আর বেঈমান বলে গাল দেওয়া।
তো ওসমানের হাত ধরে নিয়ে চললো ইব্রাহিম। বাইরে উঠান পেরিয়ে বড়ো তরফের বাধানো ঘটওয়ালা পুকুর। ঘাটের ইটগুলো তখন বড়োমিয়ার দাঁতের মতো খসে খসে পড়ছে। পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে ২০০/২৫০ গজ গেলে বুড়োবটতলা। এই বটতলা ছিলো ওসমানের খেলার জায়গা। এখান থেকে বাকনিলে ছিপছিপে ১টা পথ, সেই পথে খানিকটা গেলে ইটখোলা বিলের শুরু। বিলের পারে দীপচাদের মাটির ঘর। ঘরের আশেপাশে কি বিলের ধারে মুখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে চরে বেড়ায় দীপচাঁদের এক পাল শুওর। দীপচাদের বৌ মুনিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে বাঁশের ধামা বোনে আর দুর্বোধ্য ভাষায় স্বামীকে কি দেবতাদের কি নিজের অদৃষ্টকে যা তা বকাকি করে। কখনো কখনো মুনিয়া বিলের পানিতে বাসন মাজে, গা ধোয়। বর্ষাকালে পদ্মফুলে বুক উঁচু করে ইটখোলার বিল আকাশের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য অনেকটা ওপরে উঠে আসে। তখন মেজাজ ভালো থাকলে মুনিয়া পদ্মবীজ খেতে দেবে বলে ওসমানকে বটতলা থেকে ডেকে আনে। সেদিন দীপচাদের শুওরগুলো আপন মনে মাটি খুঁড়ছিলো, বাড়ির ভেতর থেকে আসছিলো মুনিয়ার একটানা কান্নার শব্দ।
ইব্রাহিমের ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে আসে সুখনলাল। এ লোকটিকেও ওসমান চেনে, স্টেশনের জায়গা থেকে দীপচাঁদ সরে আসার পর ওখানে বসে জুতো সেলাই করে। দীপচাদ অসুখে পড়বর পর থেকে সুখনলাল ও মুনিয়াকে নিয়ে নানারকম মুখরোচক কথা চলে আসছে। সুখনলালকে দেখে ওসমানের তৎকালীন কচি হাড়গুলো সিটকে এসেছিলো; দীপচাঁদের রেলেকাটা মুণ্ডু যদি তার সঙ্গে গড়িয়ে বাইরে চলে আসে!—কিন্তু না, সুখনলাল জানায় শবদেহ এখনো রেললাইনের ধারে; দারোগাবাবুর হুকুম, পুলিসের লোক না পৌছা পর্যন্ত সরানো চলবে না। আশেপাশের গ্রামে জাতভাইদের খবর দেওয়া হয়েছে, তারা এসে লাশ ঘিরে বসে রয়েছে। দীপচাদের এক ভাগ্নে বুলবুলিয়া আজ সকালে পাইটখানেক পচানি টেনে সুখনলালের গায়ে অকারণে হাত তুলেছে, আর মুখ খারাপ যা করেছে মিয়াদের সামনে উচ্চারণ করলেও সুখনলালের পাপ হবে। মিয়াদের গ্রামে, মিয়াদের জমিতেই তো বুলবুলিয়ার বাস, সুখনলালও মিয়াদের জমিতেই জীবন কাটালো, ইব্রাহিম শেখ কি এর কোনো বিহিত করবে না?
ওদিকে দীপচাদের ঘরের ভিতর কয়েক মিনিট বিরতির পর মুনিয়া ফের কাঁদেতে শুরু করে। ইব্রাহিম শেখ ওসমানকে বলে, ‘তুই বাড়ি যা রঞ্জু। ওসমান তবু তার সঙ্গে হাঁটলে ইব্রাহিম ধমক দেয়, বললাম না, বাড়ি যা!
‘না আমি যাবো তোমার সঙ্গে। ওসমান জেদ ধরে, আমাকে মরামানুষ দ্যাখাতি হবে।’ আবার কথা বলে!’ ইব্রাহিম ধমক দেওয়ার পর লোভ দ্যাখায়, যা। আমি ফেরার সময় স্টেশনের বাজার থেকে সন্দেশ আনবো’খন। যা!’
‘না আমি সন্দেশ খাবো না। রেলে-কাটা মানুষ দেখবো! আমি কোনোদিন দেখিনি, আজ দেখবো, এ্যাঁ! ইব্রাহিম শেখ কিন্তু চটে ওঠেনি, বরং আরো নরম হয়ে বলে,তুই যা বাবা! কাল তাজহাট থেকে টিয়া এনে দেবো, কেমন? এখন যা!
ট্রেনের তলায় আত্মহত্যাকারী দীপচাদকে দ্যাখানো থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহিম শেখ শেষ পর্যন্ত ওসমানের অনেক দিনের আবদার পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। জ্যান্ত পাখি পাবার আশায় ওসমানের রেলে-কাটা মড়া দ্যাখার লোভ ছাড়তে হয়। আজ দ্যাখা, এতোদিন পর দীপচাদ নিজেই তার স্বপ্লের মধ্যে এসে হাজির হলো। সেদিন তাকে কেমন দ্যাখাচ্ছিলো?-লুঙি গিরের ওপর তোলা, গায়ে টুইলের হাফহাতা শার্ট, হাতে জুলছে কাচি সিগ্রেট—ইব্রাহিম শেখ দীর্ঘ পা ফেলে চলে যায় রেললাইনের দিকে; রোগা প্যাকাটি সুখনলাল যাচ্ছে পেছন পেছন, নালিশ করে, মাঝে মাঝ থুথু ফেলে, ফের নালিশ করে। কিছু দূর যাবার পর হাবু মল্লিকের ডাঙা-জমির বাবলা ঝোপের আড়ালে চলে গেলে ওদের আর দ্যাখা যায় না। আর এদিকে বিলের তীরে দাঁড়িয়ে ওসমান তার সর্বাঙ্গে শোনে মুনিয়ার একটানা কান্নার ধ্বনি। এই জায়গাটায় মুনিয়া বাসন মাজে আর গোসল করে বলে এখানে কোনো পদ্মফুল নাই। পানিতে ওসমানের ছায়া পড়ে, পানির পাতলা ঢেউতে তার সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো ঠোঁটজোড়া বারবার স্থানচু্যত হয়, শার্টের বুকপকেটে এস্ত্রয়ডারি-করা প্যাগোড়া পানির অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে। দীপচাদের বাড়ির পেছনের আউশের খেত থেকে কালচে হলুদ রঙের গন্ধ এসে দীপচাদের বৌয়ের কান্নার সঙ্গে মিশে ধ্বনি, গন্ধ ও রঙের বিন্যাস নষ্ট করে দেয়। বিলের পানিতে শ্রীমান রঞ্জু তখন ওসমানের মুখোমুখি শুয়ে একটু ভয়ে ও একটু কামনায় কাপে। ওসমান নয়ন ভরে পানির সেই রঞ্জকে দেখছে, রঞ্জু পানি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে তার সামনে, সে খেয়াল করেনি।
হঠাৎ রঞ্জুর কথা শুনে সে মাথা উঁচু করে তাকালো। আপনার ঘুম পাইতাছে। আপনি ঘুমান, আমি যাই।’ না, রঞ্জু নয়, কথা বলছে রানু ওসমান বিব্রত হয়, হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে কেন, বুঝতে পাচ্ছি না।
রাত্রে ঘুমাইবেন না কতো রাত্রে বাসায় ফেরেন, ঠিকমতো ঘুমান না কেন? এই অতি অল্প সময়ের তন্দ্রা কেটে যাওয়ায় ওসমানের চোখের ভেতরটা করকর করে, ভ্রজোড়া থেকে শুরু করে গোটা কপাল পর্যন্ত মাথার অর্ধেকটা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। তোষকের নিচে থেকে ২টো নোভালজিন ট্যাবলেট মুখে দিয়ে সে পানি খায়।
টেবিলের ওপরকার শূন্যতায় রানুর খোলা চুলের হান্ধা গন্ধ। ওসমান এখন সোজা হয়ে বসেছে, ২টো নোভালজিনে তার কাজ হচ্ছে, মাথা ব্যথা আস্তে আস্তে সেরে যাচ্ছে। ওসমান বলে, কৈ তোমার খাতাটা দেখি!
আজ থাক! আপনার শরীর বোধ হয় খারাপ। ওষুধ খাইবেন!’ না। একটু মাথা ব্যথা করছিলো, পাঁচ মিনিটে সেরে যাবে।’ নাঃ! ঐকিক নিয়ম রানুর মাথায় একেবারে ঢোকেনি। বছর ধরে পড়লেও ওর খুলি ভেদ করা অসম্ভব। আনোয়ারের সঙ্গে বরং ওদের গ্রামে গেলে হতো। গ্রামে গ্রামে মানুষ সংঘবদ্ধ হচ্ছে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রুখে দাঁড়াচ্ছে। এই সব দ্যাখা ছেড়ে সে কি-না পড়ে রইলো এই রান্ট মেয়েটাকে অঙ্ক কষাবার মতলবে? ওসমানের পেটের ব্যথাটা চিনচিন চিনচিন করে ওঠে। নাঃ খেলেই হতো এ্যাঁসিড হচ্ছে, রাত্রে ঘুম হলো না, এর ওপর এ্যাঁনালজেসিক ট্যাবলেট না খেলেই হতো। রানুর অঙ্কের ভুল শোধরাতে পেট ও বুক জুড়ে টক-তেতো স্রোতের উজান-ভাটা শুরু হলো। এখন একটু শুতে পারলে ভালো হয়। ওসমানকে বলতেই হলো, ‘আজ বরং থাক। কাল এসো, কেমন?
রানু জিগ্যেস করে, খুব খারাপ লাগতাছে, না? গলার কাছে টক-তেতো স্রোতের একটা দমক সামলাতে সামলাতে হাসে, না হঠাৎ খুব ঘুম পাচ্ছে। নাইনটিন সিক্সটি নাইনের গোড়াতেই দিবানিদ্রা, বছরটা মনে হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটবে।
রানু কিন্তু একটুও না হেসে উঠে দাঁড়ায়। ওসমান দাঁড়িয়েছে তার গা ঘেঁষে। রানুর শ্যামবর্ণ নাকের শীর্ষে ঘামের অনেকগুলো টাটকা বিন্দু জমেছে, তার নাকের নিচে ঠোঁটের ওপরকার ছোটো নিখুঁত ঢেউতে বড়ো বড়ো ঘামের ফোটা টলটল করে। ওসমান ইচ্ছা করলে একটু ঝুঁকে রানুর নাকের ডগায় এবং তার নিচে মুখ লাগিয়ে এক চুমুকে সমস্ত স্বেদবিন্দু টেনে নিতে পারে। তার বদলে সে তার নিজের হাতের তর্জনী চোষে। রানু একটু অবাক হয়ে তাকালে ওসমান পানি-ওঠা মুখে তরল স্বরে বলে, কাল এসো, কেমন? এই সময় এসো, কেমন?
বইপত্র নিয়ে রানু সিঁড়িতে নামবার সঙ্গে সঙ্গে ওসমান দরজা বন্ধ করে দেয়। ডান হাতের তর্জনী তার মুখেই রয়ে গেছে। কোনো নোনতা স্বাদ না পেয়ে সে তর্জনীটা আরো ভালো করে চোষে। টক-তেতো স্বাদের তর্জনী চুষতে চুষতে অন্য দরজা দিয়ে ওসমান বেরিয়ে যায় ছাদে। ছাদের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে ওসমান একটু উপুড় হতে না হতে তার হড়হড় করে বমি হয়ে গেলো।
চিলেকোঠার সেপাই – ১৩
ইউনিভারসিটির যে ছেলেটি আজ পুলিসের গুলিতে মারা গেছে খিজির তাকে দ্যাখেনি। পুলিসের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ার তাগিদে যদি মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে না পড়ে তাহলে ঐ সময়টা সে থাকে ঢাকা হল আর পিজির মাঝামাঝি। ছেলেটা গুলিবিদ্ধ হয় ওখানেই। ধরো, খিজির আলি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে না চুকে মিছিলের সঙ্গে যদি থাকতো, তাহলে? পুলিসের লরি ছিলো পিজির পাশে রশিদ বিল্ডিঙের সামনে। গুলি করা হয়েছে ওখান থেকেই। ধরো, খিজির ওর পাশেই আছে, শ্লোগান দিতে দিতে চলেছে, এমন সময় গুলি এসে ওর হাত ঘেঁষে ঢুকলো ওর পাশের ছেলেটির বুকে। এমন তো হতে পারতো যে, গুলিবিদ্ধ ছেলেটি ওর গায়েই ঢলে পড়লো। লোকজন সবাই দৌড়াচ্ছে, সেও দৌড়াচ্ছে, গুলিবিদ্ধ তরুণের মৃতদেহ কোলো নিয়ে দৌড়াতে তার একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। –তাহলে? এই সব ভাবতে ভাবতে কাচা গুয়ের গন্ধ নাকে ঝাপ্টা মারলে বোঝা যায় যে, তাদের বস্তি এসে গেছে। —কিন্তু তার হাউস কি কেউ দমিয়ে রাখতে পারে-আচ্ছা তার গায়েও তো এই গুলি লাগতে পারতো! পুলিসের বুলেট কি শিক্ষিত অশিক্ষিতে, ধনী গরীবে, ছাত্র মজুরে ভেদ করে?–নাঃ! বুকে গুলি লাগানো ঠিক হবে না। কয়েকটাকে সাফ না করে এখন মরাটা ঠিক নয়। ঠিক আছে, ধরে বা পায়ে গুলি লাগলে এমন কিছু অসুবিধা হয় না। অনেকদিন রিকশা চালিয়ে পা ২টো তার লোহার পিলার। আবার এখন স্কুটার চালায়, রিকশা চালানো ছেড়ে দেওয়ায় পিলারজোড়ায় বাত ঢুকেছে, বৃষ্টি বাদলায় ভিজলে পা ২টো টনটন করে। ১টা গুলি লাগলে রক্ত বেরিয়ে বাতের ব্যথা চিরকালের মতো সারতো।
ঘরের বাপ তুলে ঢোকার পরও শ্লোগান, গুলিবর্ষণ ও টিয়ার গ্যাসের শব্দমুখর চান খার পুল ও নিমতলী এলাকা মাথার মধ্যে গমগম করে। মেঝেতে বসে গপ গপ করে ভাত খাওয়ার পর থালে হাত ধুচ্ছে, বিছানার ওপর থেকে জুম্মনের মা বলে, ব্যাকটি খাইলা?
‘তুই খাস নাই? জিগাইছিলা? জিন্দেগিতে জিগাইছো? আছে খালি নিজের প্যাটখান লইয়া। খালি হান্দাও আল্লা রে আল্লা, এই হাড্ডি কয়খানের মইদ্যে মনে লয় দুই তিনখান ঠিলা ছুপাইয়া রাখছে!’
বিছানার এদিকে বসতে বসতে খিজির বলে, তর মহাজনের প্যাটের মইদ্যে কলতাবাজারের পানির টাঙ্কি ফিট কইরা রাখছে। মাহাজনের প্যাট থাইকা দুই চার ঠিলা তুই লইয়া আইছস ?
বলতে বলতে খিজির বিছানার এক প্রান্তে শোয়, ডানদিকের বগল চুলকাতে চুলকাতে ভাবে, এই বাহু দিয়ে গুলিটা ঠেকাতে পারলে ইউনিভারসিটির ছেলেটা আজ মরে না। কিন্তু এখন ঝামেলা জুম্মনের মা, রাত্রে এর প্যাচাল পাড়া বন্ধ করে কে?
অক্কর্ম। ভ্যাদাইমা মরদ একখান! আউজকা গাড়ি লইয়া বারাইছিলা, গাড়ি চালাইছো? ঘরের খরচ চালাইবো তোমার বাপে?
এবার খিজিরের মেজাজ একেবারে খিচড়ে যায়, বলে আমার বাপে চালাবো ক্যালায়? তর মাহাজন বাপের লগে রাইত ভইরা ডাংগুলি খেলবার পারলি না? এখানে আইলি ক্যালায়? রাইত বাজে একটা আর খানকি মাগী অহন কলের গান একখান ছাড়লো।
এবার জুম্মনের মায়ের কলের গান চলে দারুণ স্পীডে, মাহাজন কার বাপ লাগে মহল্লার ব্যাকটি মানু জানে আমার মায়েরে মাহাজনে জিন্দেগিতে দেখছে? আমাগো বাপ থাকে একজন!
খিজির ভাবে মিছিলের জায়গাটা অমন করে ছেড়ে দৌড় দেওয়াটা ঠিক হয়নি। একটা চিলও তো সে পুলিসের গায়ে লাগাতে পারলো না।
গাড়ি লইয়া বারাও, রাস্তার মইদ্যে গাড়ি ছাইড়া দিয়া টাঙ্কি মারবার যাও, না? খিজির এবার অবাক হয়, এ বেটি জানলো কিভাবে? বলে, ‘তরে এইগুলি কইলো ক্যাঠায়? তর মহাজন বাপে, না? তর মহাজনের মাথার উপরে ঠাঠা পড়বো, বুজলি?
আস্তে কও, আস্তে কও। মাহাজনের ঘরে থাকো আবার তারে উল্টা-পাল্টা কথা কও, শরম করে না?
মাগনা থাকি? ভাড়া দেই না? কিন্তু জুম্মনের মা বারবার একই প্রসঙ্গে তোলে, সকালবেলা বেবি ট্যাকসি নিয়ে সে বেরুলো, আর মানুষের পাগলামি দ্যাখার জন্যে গাড়ি ছেড়ে দিলো মাঝপথে? এসবের মানে কি? মহাজন না হয় লোক খারাপ। তাই সই। কিন্তু আলাউদ্দিন মিয়া খিজিরের এই বান্দর নাচ দ্যাখার পাগলামি সহ্য করবে কদিন?
খিজির ফের জিগ্যেস করে, আমি জিগাই, তবে এই চাপাগুলি ছাড়ছে ক্যাঠায়? বলার লোকের কি অভাব? আজ বিকালবেলা আলাউদ্দিন মিয়া নিজেই গিয়েছিলো রহমতউল্লার বাড়ি। গিয়েই বলে, মামু, ইউনিভারসিটির ইস্টুডেন মরছে, পুলিসে গুলি চালাইছিলো। ইট্ হুঁশিয়ার হইয়া থাইকেন পাবলিকে আইয়ুব খানের উপরে যা চেতছে না! মোনেম খানের মাতম আরম্ভ হইয়া গেছে!’
তোমরা আইয়ুব খানের বালটা ছিড়বা’ রহমতউল্লা রাগ করে, আর কয়টার লাশ ফালায়া দিলেই এই হাউকাউ বন হইয়া যাইবো।
আলাউদ্দিন কিন্তু রাগ করে না, স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে, মনে হয় না। ইউনিভারসিটি ছাত্ৰ মইরা নূরুল আমিন খতম হইয়া গেছে না? আপনে এটু হুঁশিয়ার থাইকেন। আমলিগোলার মুসলিম লীগ অফিস ভাইঙ্গা দিছে।’
রহমতউল্লা মেয়েকে হাক দিয়ে চা দিতে বলে, মেয়ে গেছে পাশের বাড়িতে বেড়াতে। চা নিয়ে আসে জুম্মনের মা। টেবিলে বাকেরখানি, পনির ও চা রেখে সে চলে যাচ্ছিলো, আলাউদ্দিন বলে, খিজিরে এইগুলি কি করে? বেবি ট্যাকসি লইয়া বারাইয়া রাস্তার মইদ্যে গাড়ি দিয়া গেছে আরেকজনেরে। গাড়ি লইয়া ঐ হালায় যুদি পলাইতো!
মহাজন একটু রাগ ও একটু অভিমানে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, তোমরা তো আমার ইজ্জত রাখবা না! তুমি অরে খেদাইয়া দিলে পরের দিনই আমি খানকির বাচ্চাটারে লাথি দিয়া বাইর কইরা দেই! আমার জুম্মনের মায়েরে আবার বিয়া দিমু কামরুদিনের লগে।
‘কামরুদিন? উই বিয়া করবো? ‘পসা দিলে করবো না? দোলাই খালের রাস্তা করতাছি, মিস্ত্রী আমার কম লাগে? মহাজন খিজিরের নামে কতো অভিযোগ করে। তারই খেয়ে মানুষ হলো, আর সে কি-না ভিক্টোরিয়া পার্কে তারই গিবত করে! মিয়া, বোঝো তো, দিন খারাপ। নইলে এইগুলি কীড়া উড়ারে পায়ের একখান উঙলি দিয়া এক্কেরে মাটির মইদ্যে হান্দাইয়া দিবার পারি।
মামা ভাগ্লের কথা শুনতে শুনতে জুম্মনের মা বেশ ভয় পেয়েছে জুম্মনকে কি এজন্যেই মহাজন আজ পাঠিয়ে দিলো মালীবাগে কামরুদ্দিনকে খুঁজতে?
আজ সন্ধ্যাবেলা আলাউদ্দিন মিয়া খিজিরকে একটু বকেছে। যাকে তাকে এভাবে গাড়ি দেওয়া সে পছন্দ করে না। খিজিরের অবশ্য মনে হলো গাড়িটা সে নিজেই গ্যারেজে রেখে গেলে পারতো। দিনকাল ভালো না, গাড়ি নিয়ে কে কোথায় উধাও হয় তার ঠিক আছে? ১টি বেবি ট্যাকসি হারালে সায়েবের কতোগুলো টাকা নষ্ট নীলখেতে ইউনিভারসিটির সামনে ছেলেদের ভীড় দেখে সে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। নিউ মার্কেট থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাচ্ছিলো কমলাপুর স্টেশন, নীলখেতে ছেলেদের মিছিল দেখে তার ইচ্ছা করছিলো, এক্ষুনি এদের সঙ্গে ভীড়ে যায়। খুব শ্লোগান চলছে তখন, মিছিল যাচ্ছে ফুলার রোডের দিকে। পেছনে মেয়েদের হলের সামনে পুলিসের গাড়ি, রাস্তায় পুলিসের কাটাতারের ব্যারিকেন্ড। কমলাপুরে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলো গ্যারেজের দিক, গ্যারেজের আশেপাশে রঙ্গু, করিম, হোসেন-এরা সব ঘুরঘুর করছে, এদের কাউকে বেবি ট্যাকসি দিয়ে ৫টা টাকা নেবে, বিকালে এদের কাছ থেকে টাকা তুলে সায়েবকে দিলেই চলবে। সারাদিন গাড়ি চালালো কে আলাউদ্দিন কি আর তাই তদন্ত করতে যাবে? কিন্তু মতিঝিলে স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে দ্যাখে আদম আলি দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসের জন্যে। বেচারার গাল টাল বসে গিয়েছে, খোঁচা খোঁচা দাড়ির অর্ধেকের বেশি পাকা। বছর খানেক আগেও আলাউদিনের বেবি ট্যাকসি চালাতো, কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলো চাষ করতে করতে। মাঝখানে খিজির একদিন দ্যাখে মাথায় তরকারির ঝাকা নিয়ে আলু পটল কাচামরিচ শুটকি’ বলে চ্যাচাতে চাচাতে কে এম দাশ লেন ধরে হাঁটছে। আজ স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে আদম আলিকে ডেকে ওর পাশে বসিয়ে খিজির বলে, ‘গাড়ি চালাইবি?’ কৃতজ্ঞতায় হালার গেরাইম্যাটা কথা বলতে পারে না। গুলিস্তানের কাছে নেমে খিজির বলে, পাঁচটা টাকা দে, বাকি পসা দিবি রাইত আটটা বাজলে, গ্যারেজের সামনে থাকুম। আবার সায়েবরে কইস না!
ড্রাইভারের সিটে বসে আদম আলি লাইসেন্স চায়, পুলিস ধরলে আবার কিছু পয়সা খসবে!
পুলিসের মায়েরে বাপ! ব্যাকটি পুলিস অহন ইউনিভারসিটির মইদ্যে’
খিজির পুলিসকে গালি দেয় কিন্তু আদম আলির হাতে লাইসেন্স বা বুক দিতেও রাজি হয় না, কিয়ের লাইসেন্স, তুই যা গিয়া!
খানিকটা বাসে এবং বেশির ভাগ হেঁটে ও দৌড়ে খিজির মিছিল ধরলো শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনারে মিটিং চলছিলো বলে মিছিলটা ধরতে পারলো। মিছিলের সঙ্গে এগিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ গেটে এসেছে, দ্যাখে হাসপাতালের ভেতর থেকে ছেলেরা পুলিসের দিকে ঢ়িল ছুড়ছে। রেলিঙ টপকে খিজিরও ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। গুলি চলার সঙ্গে সঙ্গে খিজির মেডিক্যাল কলেজের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে পিজি হাসপাতালে। কিছুদিন আগেও এখানে ইউনিভারসিটি ছিলো। মহল্লার ২টো মেয়েকে রিকশায় নিয়ে খিজির এখানে নিয়মিত আসতো। লোকজন সব উল্টেদিকে দৌড়াচ্ছে, আর সে কিনা পাগলের মতো ছোটে পিজির গেটের দিকে। গেঠে পুলিসের মস্ত ৩টে লরি। ফের পেছনে গিয়ে বেলতলার ধারে পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে উঠে দাঁড়ালো রশিদ বিল্ডিঙের শেষ মাথায়। পুলিস ও ইপিআরের ট্রাক এখন চলে যাচ্ছে নাজিমুদিন রোডের দিকে। খিজিরের চারদিকে পলায়মান মানুষের প্রচণ্ড চাপ। গুলি, গুলি’, ‘মারা গেছে, না মরেনি, রিডিং হচ্ছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছে’-এই সব সংলাপের মধ্যে মানুষ এলোপাথাড়ি দৌড়ায়। টিবি ক্লিনিক থেকে এগিয়ে আসছে লাল গাড়িটা। এবার শুরু হলো কাদুনে গ্যাস ছোড়া। ঢাকা হলের ছাদ থেকে ইটপাটকেল ও বোতল এসে পড়ছে পুলিসের ওপর। পুলিস পিছে হটছে, তারা ঢুকে পড়ছে রেললাইনের ধারে বস্তিতে। মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে এসে পুলিস ও ইপিআরের লোকজন বস্তির ভেতর এলোপাথাড়ি মারধোর শুরু করলো। পুলিস ও ইপিআরের সম্মিলিত শক্তিতে বস্তি জুড়ে শুরু হলো তছনছ কাণ্ড। এই সব ইট-চাপা ও হার্ডবোর্ডের বাড়ি ভাঙার জন্য তাদের বুলডোজার ব্যবহার করতে হয় না।-রাইফেলের বঁটই যথেষ্ট। এক পাল হাতি যেন দৌড়ে চলে যাচ্ছে বস্তির ওপর দিয়ে। বাড়িঘর সব টপাটপ পড়ে যায়। এর ওপর মানুষের পিঠে, বুকে, পাছায় ও মাথায় রাইফেলের বাটের বাড়ি।
‘আল্লা গো, মা গো’, ‘বাবা আমরা গরিব মানুষ, কিছু জানি না’, ‘বাবা আপনে আমার ধর্মের বাপ!—নারী-পুরুষ-বালক-বালিকার আর্তনাদ ও কাকুতি-মিনতি, বস্তির মানুষের ছোটাছুটি, আবার ওদিক থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটার শব্দ। খিজির দৌড়াচ্ছে। তার কানে তখন শ্লোগান-পিপাসা। শ্লোগান শুনলেই বুঝবে যে, মানুষ পুলিসকে রুখে দাঁড়িয়েছে। রেল লাইনে লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়াচ্ছে, এমন সময় দ্যাখা গেলো জুম্মনকে, জুম্মন দৌড়াচ্ছিলো উল্টোদিকে। জুম্মনকে ডাকতে খিজির একটু দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘাড়ে পড়ে রাইফেলের বাটের বাড়ি। খিজিরকে ফের দৌড়াতে হয়। পুলিসের লোক ঘরে ঘরে ঢুকে ঘর ভেঙে দিচ্ছে, মাটির কলসি হাড়িকুড়ি ভাঙার আওয়াজ ক্রমে বেড়েই চলে। এরই মধ্যে সব অমূল্য রত্নসামগ্রী সরাবার জন্য কেউ কেউ ভাঙা ঘরে মাথা ঢুকিয়ে পাছায় ও পিঠে রাইফেলের বাটের গুতো খায়। জুম্মনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানে এতোক্ষণে মনে হলো, আরে জুম্মন তো বিছানায় নাই। খিজির জিগ্যেস করে, জুম্মনে কই?
আইবো না। জুম্মনের মা জবাব দেয়, অর বাপেরে মাহাজনে মানা কইরা দিছে।’ কি? মিস্ত্রীরে ডাইকা কইছে, পোলায় থাকবো বাপের কাছে। তোমারে আমি থাকবার জায়গা দিমু|
ক্যামনে? মাহাজনে তোমারে এহানে থাকবার দিবো না। কয় আমার বাড়ি থাইকা আমার লগে দুশমনি করবো! ঠিকই তো। মাহাজনে সইজ্য করবো ক্যালায়?’
সন্ধ্যাবেলা আজ জুম্মন ও জুম্মনের মায়ের সামনেই বাড়িওয়ালা কামরুদিনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, মিয়া নিজের বিবি পোলা লইয়া থাকে। ঐ নিমকহারামটারে আমি খাদাইয়া দেই! দোলাই খালের উপরে রাস্তার কাম চলে পুরাদমে, তোমার কামের অভাব হইবে না।’
কামরুদিন জবাব দেয়নি। জুম্মনের মা তখন পাকা উঠানের এক কোণে কলপাড়ে বাসন মাজছিলো আর তার দিকে বারবার দেখছিলো। –
বাড়িওয়ালার খুব রাগ, অর রোয়াবিটা দেখছোঁ? মিটিঙের মইদ্যে আমার নামে গিবত করে, বুঝলা? খানকির পয়দা-আর কি হইবো, কও? থাকতি কান্দুপটির মইদো, মায়ের ভাউরা হইয়া থাকতি বইনের ভাউরা হইয়া থাকতি মায়ের বইনের কাস্টমারের লাথি চটকানা খাইয়া দিন গুজরান করতি, ভালো হইতো না? আমি থাকবার জায়গা দিচ্ছি, খাওন দিয়া বড়ো করছি, খানকির পুতের আহন পাখনা গঙ্গাইছে! এইসব শুনতে শুনতে জুম্মনের মায়ের ছাইমাখা খড়-ধরা কালো হাত চলছিলো অতিরিক্ত দ্রুতবেগে।
তুই কি কইলি? খিজির আলি বৌকে জিগ্যেস করে, তুই কিছু কইলি না? জুম্মনের মা মাঝে মাঝে মিথ্যা কথা বলে, কিন্তু কোনো কথা বাড়িয়ে বলতে পারে না। তবে খিজির আলি সম্বন্ধে বাড়িওয়ালার গালিগুলো এতোটা হুবহু না বললেও তো পারতো। সুযোগ পেয়ে মাগী নিজেই কি তাকে গাল দিয়ে সুখ করে নিচ্ছে?
খিজির বলে, আমি মাহাজনের নামে গিবত কি করছি? মহল্লার মানু ঐদিন তারে ধইরা ছেইচা ফলাইতো না? আমি ঝুটা কথা কইছি? অর আপন ভাইগ্লাই তো আমাগো সর্দার, আমরা তো আলাউদ্দিন মিয়ার লগেই আছি। ভাইগ্রামিটিং করতাছেন? মিছিল করতাছে না? কার লগে ভূমি কার বিচার করো? কৈ তার ভাইগ্না, সায়েব মানু, দুইদিন বাদে বলে মাহাজনে নিজের মাইয়ার লগে বিয়া দিবো। গোলাম হইয়া তুমি তার সাথে এক লগে নাম ল্যাখাও? হায়রে মরদ কৈ মহারানী, কৈ চুতমারানী’
খিজিরের ইচ্ছা করে একটা ঘুষিতে মাগীর চোপাখান ফলাফালা কইরা ফালায়। কিন্তু তার সুযোগ না দিয়ে জুম্মনের মা বলে, এই মিছিল উছিলের হাউকাউ দেইখা মাহাজন খামোশমাইরা রইছে, নাইলে তোমারে উঠাইতে তার কতোক্ষণ?
উঠাইয়া দিলে যামু গিয়া। ঢাকার শহরের মইদ্যে জায়গার অভাব? আমারে কাম দিবো? তোমারে উঠাইয়া দিয়া মাহাজনে মিস্ত্রীর লগে আমারে বিয়া না দিয়া কাম দিবো?
এহানে কাম করবি না। কাম করলে কামের অভাব আছে? ‘আরে বাবা! মরদের লাহান কথা কইলা একখান মাহাজনে আমার পোলারে রিকশা কইরা দিবো, আমারে থাকতে দিবো। এইগুলি ছাইড়া তোমার সিনার মইদ্যে গিয়া ছুপাইয়া থাকুম, না? তাও তো খালি হাড্ডি কয়খান আছে। ঐ হাড্ডির খাঁচার মইদ্যে আমারে রাখতে পারবা? ভাদাইমা মরদ একখান!
এর মধ্যে গলা ভরে টালমাটাল গান নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো বজলু। ছুকেই দরজায় বসে হড়হড় করে বমি করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো বজলুর বৌয়ের চিৎকার, রাইতে গু-গবর খাইয়া বাড়ি আইছে, অহন এইগুলি সাফ করে ক্যাঠায়? এইগুলি ধোয় কাঠায়? এরপর বমি করার আওয়াজ সাঙ্গ হলে আওয়াজ ওঠে মারধোর করার। ১টা চড়ে মেয়েটা চেচিয়ে ওঠে, দ্বিতীয় চড়ে চুপ। তারপর বজলু তাকে মেঝেতে ফেলে দমাদম লাথি মারে। লাথির প্রবাহে বিরতি পড়তেই বজলুর বৌ বিড়বিড় করে, পুলিসের বাড়ি খাইয়া চোট্টাটার ত্যাজ বাড়ছে, না? জবাব বজলুফের লাথি মারতে শুরু করে। মেয়েটা ভয়ানক তাড়া, মার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য যা করে মাতালকে উস্কে দেওয়ার জন্য তাই যথেষ্ট। এদিকে জুম্মনের মা বিড়বিড় করে, হায়রে। পাঁচ মাসের পোয়াতিটা হায়রে! তারপর পুরনো প্রসঙ্গ তুলে সে প্রায় মিনতির স্বরে বলে, তুমি না, বুজলা, মাহাজনেরে কও, মাহাজনেরে ভালো কইরা কইলেই—?
কিন্তু তার কোনো কথা খিজিরের কানে যায় না। পোয়াতি বৌকে বজলু লাথি মারছে। খিজিরের চোখের ভেতর থেকে রক্তের একটানা স্রোত বেরিয়ে কোনো একটি দালানের সিঁড়ির তলা ভাসিয়ে দেয়, রক্তের মধ্যে শরীর ডুবিয়ে পড়ে থাকে বজলুর বৌ।
খিজির এক লাফে উঠে বাইরে যায়। মাতালটাকে ফেলে দেওয়ার জন্য ১টা লাথিই যথেষ্ট। মাটিতে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বজলু জড়ানো গলায় গাল দেয়, তুই কাঠা? নিজেরটারে তামাম দিন বন্ধক রাখস মাহাজনের কাছে, রাইতে আইছস আমারটারে ধরতে, না? তরে ফালাইয়া একদিন টেংরি দুইখান না ভাঙছি তো আমি হালায় বাপের পয়দা না। মাহাজনেভি হুকুম দিছে। খানকির বাচ্চাটারে একদিন এক্কেরে মাইরা বস্তার মইদ্যে বাইদা হালায় ফালাইয়া রাখুম ম্যানহোলের মইদ্যো খাড়া’ বজলুর জড়ানো কথা কিন্তু সব বোঝা যায়।
জুম্মনের মা ঘুমিয়ে পড়েছে। খিজির একটু রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ওদিকে শ্যাওলা-পড়া, খয়েরি রঙের দোতলা তিনতলা বাড়ির ফাঁক দিয়ে দ্যাখা যায় মস্ত বড়ো চাদ। ফাঁকা রাস্তা জুড়ে ময়লা আবর্জনা চাদের আলোতে জড়ানো। খিজিরের বুক ভয়ানক ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে। মহাজন কি বজলুকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে? শরীরটা শীতশীত করছে। ঘরে ঢোকা দরকার। কাল হরতাল। এখান থেকে মিছিল নিয়ে যেতে হবে ইউনিভারসিটি। আলাউদ্দিন মিয়া ঐ বেবি ট্যাকসি নিয়ে বকবিকি করার পর বারবার বলে দিয়েছে খিজির যেন রিকশাওয়ালাদের নিয়ে সকাল বেলাতেই অফিসের সামনে হাজির হয়। শ্লোগান কি হবে সায়েব তাও ঠিক করে দিয়েছে। নাঃ! এখন ঘুমানো দরকার, কাল ভোরে উঠতে হবে।
চিলেকোঠার সেপাই – ১৪
‘আকবর ভায়ের ব্যাটা? দাঁড়াও, ভালো করা দেখ্যা নেই।’ আনোয়ারের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর খয়বার গাজী তাকে বসতে বলে, তার পাশে জালাল মাস্টার। তারপর ১টি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খয়বার গাজী অনুযোগ করে, তোমরা বাপু বাপদাদার ভিটাত আসবারই চাও না, একবার ফুচকিও পাড়ো না! তোমার মামু আর বছর জাতীয় পরিষদে কনটেস্ট করলো, আমার এখানে আসছিলো। আমার কুটুম্ব, ভায়ের সম্বান্ধী, আবার তোমার চাচীরও কি রকম ভাই হয়। তো কল্যাম, সিরাজ ভাই, আমার কিছু কওয়ার দরকার নাই। আমার ইউনিয়নের মেম্বর এগারোটা -একটা জোলা আর একটা কৈবর্ত-বাকি নয়টা ভোট আপনের। তা ফুল মার্কার টিকেট নিবার পারলেন না?-ওয়াদা দিলাম। কিন্তু বাবা জামানা খারাপ, মানুষ হলো মোনাফেক। মানুষের ঈমান নাই। ভোটের আগের রাতে মটোর সাইকেল নিয়া দুইজন মানুষ আসলো, ভটভটিওয়ালারা টাকার বস্তা নিয়া আসছিলো, সব ভোট পড়লো ফুল মার্কাত। আমার ভোটটা নষ্ট হলো একটি প্রসঙ্গ থেকে আরেকটি এসে পড়ে। কোনোটাই ভালোভাবে শেষ হয় না। খয়বার গাজী কথা বলে একটু ধীরে, বিলম্বিত লয়ে, কিন্তু লোকটা খুব স্টেডি, থামে না। মাঝে মাঝে বিরতি দিলেও এমন একটা ভঙ্গি করে যেন তার বাক্য অসম্পূর্ণ রয়েছে, ঠিক পরবর্তী সময়টিও তার জন্যেই নির্ধারিত, অন্য কারো তাতে ভাগ বসাবার সুযোগ থাকে না। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে সিগ্রেটে টান দেয় বা তার সামনে লাঙ্গল-কাধে মাঠের-দিকে-রওয়ানা হওয়া কিষানের উদ্দেশে নির্দেশ পাঠায় বা সশব্দে থুথু ফেলে বা উচ্চকণ্ঠে আল্লার নাম নেয়। এরকম ১টি ফাঁক পেয়ে আনোয়ার বলে ফেলে, ‘জী। বেসিক ডেমোক্র্যাটদের প্রায় সবাই টাকা নিয়ে ভোট দিয়েছে, সব জায়গাতেই তাই হয়েছে।’
মুখে একটু জর্দা পুরে ডান হাত তুলে খয়বার গাজী তাকে থামিয়ে দেয়, তারপর বলে, বাপু, বেসিক ডেমোক্র্যাসিকও আর আর এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যানচাইজ কও, আইয়ুব খান কও আর শেখ মুজিব কও, দ্যাশের মানুষের ঈমান ঠিক নাই। ঈমান না থাকলে কেডা কি করবো। না কি কও? হঠাৎ ভেতর বাড়ির দিকে মুখ করে লোকটা হুঙ্কার ছাড়ে, ক্যারে সাকাত আলি, নাশতা হলো?
আনোয়ার ক্ষীণকণ্ঠে একটু ভদ্রতা করার চেষ্টা করে, না, নাশতা থাক। বাড়িতে বলে আসিনি, নাশতা করে রাখবে, আপনি আর কষ্ট করবেন না। খয়বার গাজী হাসে। এই হাসিতে আনোয়ারের প্রতি নাশতা খাওয়ার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।
একটু অস্বস্তিকর হলেও লোকটাকে আনোয়ারের খারাপ লাগছে না। জালাল মাস্টারের অনুরোধেই আসতে হয়েছে, কাল সন্ধ্যায় জালাল ফুপা বার বার বলছিলো, দ্যাখে বাপু, চ্যাংড়া প্যাংড়ার কথাত কৰ্ণপাত করো না। খয়বার গাজীর সাথে বিবাদ করলে চেংটু কও আর অর বাপ কও, কারো পরিণতি ভালো হবার পারে না। কারণ কি? কারণটাও ব্যাখ্যা করে সে নিজেই। নাদু পরামাণিক ও তার ছেলে চেংটুর নামে খয়বার গাজী যে ফৌজদারী মামলা করেছে তাতে অপরাধ প্রমাণিত হলে বাপব্যাটার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল একেবারে অনিবার্য। নাদু কি মামলার খরচ যোগাতে পারবে? আরো, খয়বারের কি? ১৫ দিন পরপর সে টাউনে যায়, চাঁদে চাদে তার মোকদ্দমা। এর সঙ্গে নাদুর নামে ১টা মামলা জুড়ে দিলে তার কি এসে যায়? আনোয়ার গিয়ে যুদ খয়বার গাজীকে একবার বলে তো সে মামলাটা তুলে নিতে পারে। আনোয়ার তবু আসতে চায়নি। চেন্টুর কথা না হয় ছেড়েই দিলো, ছোড়াটা মনে হয় সব সময় টং হয়ে আছে, কিন্তু জালাল মাস্টার, এমন কি নাদু পরামাণিকের কথাতেও বোঝা যাচ্ছে যে, খয়বার গাজী লোকটা বিপজ্জনক। ১টা সুযোগ এসে পড়েছে, এখনি চিরকালের জন্য এদের উৎখাত করা সম্ভব। চারদিকে মানুষের ভাব যা দ্যাখ্যা যাচ্ছে তাতে মামলা যারা করে তারা তো নস্যি, মামলার রায় দেনেওয়ালারাই টেকে কি-না দ্যাখো!
কিন্তু ঝামেলা বাধায় নাদু পরামাণিক, চাচামিয়া’ দ্যাখেন, গরীব মানুষ হামরা, বেন্ন্যা মানুষ, আপনাগোরে পায়ের তলাতে পড়া আছি বাপদাদার আমল থাকা। হামার তিনকাল যায়া এখন এককালোতে ঠেকছে, হামি তো বুঝি বাপজান, হামি সোগলি বুঝি।’
বাপের বিবেচনাবোধে চেন্টুর আস্থা নাই, হু! তুমি কি বোঝো? নাদু জবাব দেয় আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে, চ্যাংড়াপ্যাংড়ার ইগল্যান, নাফপাড়া ব্যারাম কয়দিনের, কন? যিগল্যান ইশকুল কলেজোত পড়ে দুইদিন বাদে সিগল্যান ব্যামাক যাবো টাউনেত, অদেক যাবো জেলের ভাত খাবার। খয়বার গাজী তখন হামাক মাটির তলাত পুত্যা খুবো, মাটির উপরে ঘাস জালাবো, কেউ ফুচকি দিয়াও দেখবো না।
তারপর সে খয়বারের সঙ্গে আনোয়ারের বড়োচাচার আত্মীয়তার কথা বলে, বড়োচাৰ্চী ডালেপালায় খয়বারের মামাতো বোন। আনোয়ার কথাটা বললে গাজী তাকে না করতে পারবে না। হাজার হলেও ভদ্রলোক, আর যা-ই হোক খয়বার গাজীর বংশ তো ভালো। ছোটলোকের বাচ্চারা মেম্বার হয়ে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের গম মেরে বড়োলোক হয়, খয়বার তো সেরকম লোক নয়। কতো পুরানো বংশ, নইলে আনোয়ারদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা হয় কি করে?
বুঝলাম তো তা গোরু চুরির সোম্বাদ নিয়া তুমি থানাত গেলে তার গাওত লাগে কিসক?
চেংটুর এই অভিযোগ নাদু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে আনোয়ার তাকে থামিয়ে দিয়েছিলো, তারপর চেংটু যখন তার ভাইপোকে কুকুর ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন আপনিও রামদা হাতে তার সঙ্গে ছিলেন,—এই কথাটা খয়বার গাজী থানায় গিয়ে বললে৷ কি করে, বলেন?
জবাব না দিয়ে নাদু মাথা নিচু করে থাকে। সে বসেছিলো হাঁটু ভেঙ্গে,-আর দশজন চাষা যেভাবে বসে,—তার বড়ো পাকা দাড়ি এলোমেলোভাবে ছড়ানো, শীতে সেগুলো কেমন খাড়া খাড়া হয়ে গেছে, এতো ঘন দাড়িতেও তাই চেহারায় সৌম্য ভাব আসে না। তার দীর্ঘ দেহ সর্বদাই নোয়ানো, আনোয়ারের কথা শুনতে শুনতে তার ঘাড় এতোটা নুয়ে পড়ে যে, মনে হয় খয়বার গাজীর সমস্ত অপরাধের জন্যে দায়ী সে একা। আনোয়ারের দিকে সে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায়, পরশু জালাল মাস্টারের কাছে সে তার পর্যবেক্ষণ জানিয়ে দিয়েছে যে, আনোয়ারের দাদাজীর সঙ্গে আনোয়ারের চেহারার সাদৃশ্য খুব স্পষ্ট। তা তার পূর্বপুরুষের আমলের এক চাকরের প্রতি সে কি তার মরহুম দাদাজীর মতো একটু করুণাহাদয় হতে পারে না? খয়বার গাজীর কাছে একবার যেতে তার আপত্তিটা কি? আবার জালাল মাস্টারও বারবার চাপ দেয়। এ লোকটার কথা ফেলা মুশকিল। স্থানীয় হাই স্কুলে কুাস এইট পর্যন্ত ৪০ বছর ধরে বাঙলা পড়বার পর লোকটা এখন ঘরেই বসে থাকে। সংসার দ্যাখে, মানে শ্বশুরের দেওয়া কয়েক বিঘা জমির তদারকি করে। মাসে দুমাসে বিষাদ-সিন্ধু, মোস্তফা-চরিত, কাসাসুল আম্বিয়া বা তাপস-চরিতমালা ও রবি ঠাকুরের চয়নিক পড়ে বাঙলা ভাষার চর্চাটা চাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এই ভাষার ওপর দখল বোঝা যায় তার কথাবার্তায়, খয়বার গাজীর সহনশীলতার অভাব আছে, কিন্তু তার হৃদয় পরিষ্কার। আর তোমার বড়ো চাচীর তাই সাক্ষাৎ আত্মীয়, সম্পর্কে ফুফাতো ভাই। আর তোমার পিতার সাথে তার হৃদ্যতা কি এক আধ বৎসরের? চল্লিশ পঞ্চাশ বৎসরের বন্ধুত্ব, প্রায় সমবয়স্ক, ইস্কুলে সহপাঠী না হলেও খেলার সাখী। শৈশবের বন্ধুত্বের কাছে আত্মীয়তা কুটুম্বিতা কিছু নয়। তুমি একটা আবদার করলে গাজী কি হেলা করবার পারে?
কিন্তু খয়বার গাজীর বৈঠকখানার বারান্দায় বসে জালাল মাস্টারের বাকপটুতার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। বারান্দার ধার ঘেঁষে শেফালি গাছ, টুপটাপ ফুল পড়ে শিশির-ভেজা সাদাটে সবুজ ঘাসের জমিতে নক্সী কাথা বোনা হয়ে চলেছে, জালাল মাস্টার তাই দ্যাখে। সামনের এই খালি জমির পর ঘাট-বাধানো পুকুর, শীতের পুকুরে স্থির পানির ওপর আবছা ধোঁয়া, জালালউদ্দিন তাও দ্যাখে। একটু পশ্চিমে আনোয়ারদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় শিমুল গাছের মাথায় লালেচ রোদ হলদে হয়ে আসছে, লোকটা তাও দ্যাখে। তাহলে আনোয়ার কথাটা পড়ে কিভাবে?
লুঙ্গি পরা ১টি ছেলে এসে দাঁড়ালে খয়বার গাজী আনোয়ারকে বলে, চলো বাবা, ঘরে নাশতা করি। গরিবের বাড়িতে আসছে বাবা, কি দিয়া যত্ন করি? একটা খবর দিয়া আসা লাগে, গায়ের মদ্যে থাকি, বুঝলা না?—উপস্থিত কিছু পাওয়া যায় না।
না নাকি যে বলেন। নানা, তাতে কি? আনোয়ারের এসব বাকপ্রয়াস খয়বার গাজীর বিপুল বিনয়ের তোড়ে কোথায় ভেসে যায় তার আর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।
বৈঠকখানায় শতরঞ্চি পাতা তক্তপোষে দস্তরখান বিছানো। গোলাপি ও বেগুনি রঙের বড়ো বড়ো ফুলপাতা-আঁকা মোটা ও বড়ো চীনেমাটির প্লেটে প্রথমে পরোটা ও পায়রার গোশতের ভুনা খাওয়া হলো। তারপর মুড়ি দিয়ে পায়েস। পায়েস খেতে খেতে জালাল মাস্টারের বারবার ইঙ্গিত সত্ত্বেও আনোয়ার কথাটা তুলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত মাস্টার বলে, ‘ভাইজান, এই চ্যাংড়া আপনার কাছে একটা অনুরোধ, একটা আবদার নিয়া আসছে।’ খয়বার গাজী সাড়া না দিয়ে তার পায়েসমাখা আঙুল চোষে। সবগুলো আঙুল পরিষ্কার করে হঠাৎ বলে, কি বাবা? কও, কও।’
জালাল মাস্টার বলে, নাদু পরামাণিক ধরেন এদের বাড়িতে আজ সুদীর্ঘ-। চিলমচিতে হাত ধুতে ধুতে খয়বার গাজী তাকে থামিয়ে দেয়, জালাল মিয়া কন ক্যা? এই চ্যাংড়া নাকি কবো। তাকই কবার দ্যান না!
আনোয়ার অনেকক্ষণ থেকে মনে মনে রিহার্সেল দিচ্ছিলো। এবার বলেই ফেলে, নাদুর বিরুদ্ধে মামলাটা তুলে নিলে ভালো হতো। বেচারা খুব ভেঙে পড়েছে। গরিব লোক, শরীর খারাপ, সেরকম খাটতেও পারে না। লোকটা এমনিতে খুব ভালো, অনেস্ট লোক-।
‘না, নাদু তো মানুষ খারাপ না, অপরিবর্তিত গলায় খয়বার গাজী বলে, ছোটো জাতের মদ্যেও আল্লা ইশজ্ঞান দেয়, নাদুরও হুশজ্ঞান কম নাই। কিন্তু তার ব্যাটা? উই যে অকামটা করছে আর শালার কথাবার্তা যেমন শুনি, এখন তার সাথে কি করি কও তো? বিশ পঁচিশ বছর আগে হলেও বাপজানের দোনলা বন্দুকখান বার করা শালাক গাঙের কিনারে নিয়া ফালায়া দিল্যামনি তা বাপু দিনকাল এখন খারাপ। এখন সোগলি শালা বড়োলোক, -চাষাভুষা-জোলা-নাপিত কৈবর্ত-কামার-কুমার-সোগলিক তোয়াজ করা চলা নাগে। চেংটুক নিয়া এখন কি করি কও তো বাপু জালাল মিয়াই কন তো, চেংটুর লাকান একটা শয়তানের সাথে কি করি? আজ লাই দিলে কাল আপনার মাথাত লাথি মারবো। এ্যাঁক নিয়া কি করি আপনেই কন?
চেংটুর ব্যাপারে জালাল মাস্টারও খয়বার গাজীর সঙ্গে একমত। ছেলেপিলে আদব কায়দা ভুলে যাচ্ছে। যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে চায় না।
আল্লা সব মানুষকে সমান মনোযোগ দিয়ে সৃষ্টি করেছে এ কথা অবশ্য ঠিক। সব মানুষের প্রতি আল্লার প্রীতি ভালোবাসাও সমান। কিন্তু হাতে পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না, এক বাপের পাঁচটা ছেলে যেমন সমান বুদ্ধি-বিবেচনা পায় না, সমাজের সব মানুষ তেমনি একই আসন পেতে পারে না। এই যে চেংটু, একে একা দোষ দিয়ে লাভ কি? আজকাল এই বয়সের সব ছেলেই এরকম হচ্ছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবেই এর কারণ বলে জালাল মাস্টার মনে করে। উপযুক্ত জ্ঞানলাভ না হলে আদবকায়দা রপ্ত করা অসম্ভব, আদবকায়দা হলো শিক্ষার ১টি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে নাদুটা মানুষ খুব ভালো। মনিবের হিত ছাড়া তাই কোনোদিন অহিত চায় নাই, মিয়াদের ইষ্ট ছাড়া তাই কোনো দিন অনিষ্ট করে নাই।’
খয়বার গাজী একটু বিরক্ত হয়, খবর কি আমি কম রাখি? আপনি জামাই মানুষ, উদিনক্যা আসছেন, আপনে কি জানেন? এর দাদার আমল থাকা এই বাবাজীদের বাড়িতে যারা কাম করে সবাইকে আমি চিনি।
বারান্দায় বসে পান খেতে খয়বার গাজী আনোয়ারকে বলে, তুমি একটা আবদার নিয়া আসছে, আমি কি না করবার পারি? চেংটুক কয়ো একবার আমার সাথে যেন দ্যাখা করে। চেংটুর কথা শুনবো, আমার ভাইস্তা আফসারের কথাও শোনা দরকার। চেংটু বেয়াদবি করছে আফসারের সাথে, আমার সামনে আফসারের কাছে যদি মাফ চায়, আফসার যদি মাফ করে তো আমি মামলা তুল্যা নেবো। একটু থেমে সে বলে, আফসারেক আমি বুঝায়। বলবো, চ্যাংড়া প্যাংড়া একটা ভুল করা বসছে, আফসার মাফ করা দেবে।
এতো সহজে কাজ হবে আনোয়ার ধারণা করতে পারেনি। জালাল মাস্টারের অনুমান তাহলে অভ্রান্ত, সে একবার দ্যাখা করলে খয়বার গাজী অস্বীকার করতে পারবে না। হাজার হলেও আব্বার ছেলেবেলার খেলার সার্থী। কিন্তু খয়বার গাজী মামলা তুলে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তে জালাল মাস্টারকে একটুও খুশি মনে হচ্ছে না। কেন? গ্রামের লোকদের আবেগ প্রকাশের ব্যাপারটা আনোয়ারের কাছে বড়ো এলোমেলো ঠেকে।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে কোটা বার করে মুখে জর্দা ফেলে খয়বার গাজী বলে, বাবাজী, তুমি আসছো আমার এই গরিবখানায় এক সন্ধ্যা ডালভাত খাওয়া লাগবে। কিন্তু না, দুইটা ডালভাত খায়া যাবা। ওয়াদা করা যাও, ঐ্যা?
আনোয়ার কি রাজি না হয়ে পারে? সে কেবল এদিক ওদিক দ্যাখে। শেফালি গাছের নিচে ফুল এখন মাত্র কয়েকটি। ওরা খেতে বসলে কেউ এসে নিয়ে গেছে। পুকুরের বাধানো ঘাটের দুই পাশে মস্ত ২টো গাছ, ১টা তো বকুল, আরেকটা কি? কনক-চাপা হতে পারে, হাটখোলা রোডের ১টা বাড়িতে এরকম গাছ দেখিয়ে ওসমান একদিন ওটা কনক-চাপা বলে সনাক্ত করেছিলো। পুকুরের বা পাশে নতুন খড়ের টাটকা হলুদ রঙের গাদা। তার নিচে নতুন একটি সাদা বাছুর কচি মুখে খড়ের একটি গাছা নিয়ে খেলা করে। কচি নরম রোদ এসে পড়েছে বারান্দা জুড়ে।
পুকুরের ওপর পাতলা ধোঁয়া আস্তে হারিয়ে যায়, সেখানকার নতুন রোদের কাপন যেন ঢেউ তুলছে খয়বার গাজীর ভরা গলায়, এই যে পুষ্করনি, তোমার বাপের কয়ো ভাই সাতার শিখছে এটি। তোমার দাদা বড়ো শক্ত মানুষ ছিলো গো, ছেলেপেলেক ইদারার তোলা পানি ছাড়া গোসল করবার দেয় নাই। বড়োমিয়া বিছনা ছাড়ছে রাত থাকতে, বেলা ওঠার আগে বাড়ির ছেলেপেলে সব কয়টাক উঠায়া দিছে। নামাজ পড়া লাগছে বাড়ির সব মানষেক জায়গির, কিষান, চাকরপাট-সোগলি নামাজ পড়ছে তার বাড়িত। নামাজ পড়া হলে তিন ব্যাটাক পড়বার বসায়া তার অন্য কাম। তোমাদের বাড়িতে দুইজন তিনজন জায়গির থাকছে বারো মাস। সকালবেলা তোমার বাপচাচাগোরে পড়া দাখায়া দিছে তারাই। এই তো জালাল মিয়াও ছিলো। ক্যাগো, আকবর ভায়েক আপনে পড়ান নাই?
‘না, আমি যখন আসি আকবর ভাই তখন কলকাতার কলেজে পড়ে। ‘ছ। আপনে তাহলে এই চ্যাংড়ার ছোটোচাচাক পড়াচ্ছেন, না? জালাল মাস্টারের জবাবের অপেক্ষা না করে সে নিজেই মনে করতে পারে, না, আপনে পড়বেন ক্যামন করা? জাহাঙ্গীর তো তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবো।’
জালাল মাস্টারকে একটু ছোটো করার এই সংক্ষিপ্ত তৎপরতা কিন্তু খয়বার গাজীর স্মৃতি-আপ্লুত আচ্ছন্নতায় এতোটুকু চিড় ধরায় না, তার গলা নেমে আসে খাদে, সে বিড়বিড় করেই চলে, দেখতে দেখতে দিন গেলো! সময়ের দ্রুতগতির কথা ভেবে সে ১টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এই দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয় তার কথায়, দিন কি বস্যা থাকে? এই বারান্দার উপর বস্যা কতো গপ্পো, কতো খেলা, কতো গান শোনা, মনে হয় সেদিনকার কথা কলকাতা গেলো, কলেজ ছুটি হলে বাড়িতে আসছে, ছুটির মধ্যে সারাটা দিন বস্যা থাকছে এই বারান্দায়, এই বৈঠকখানায়, ঐ পুকুরের ঘাটে। ছুটির মধ্যে আসা খালি গান শুনছে। আকবর ভায়ের ছিলো গান শোনার নেশা।
লোকটা বলে কি? আনোয়ার ওর বাবাকে গান শুনতে দেখতো বটে, কিন্তু তাকে ঠিক নেশা বলা যায় না।
খয়বার আলি বলে, তোমার দাদা ছিলো কড়া মুসল্লি মানুষ, গান বাজনা আমোদ ফুর্তি ছিলো তার দুই চোক্ষের বিষ। আমার বাপজান আছিলো খুব হাউসআলা মানুষ, মাসের মধ্যে না হলেও পনেরো দিন টাউনে থাকছে। বাড়িত থাকলে একদিন দুইদিন অন্তর খাসি জৰো করো, পোলাও-কোৰ্মা খাও। এই থানার মধ্যে প্রথম কলের গান কেনে বাপজান, পদুমশহরের জগদীশ সেন কিনলো তার ছয় মাস পর। তোমার বাপ করছে কি-? বলতে বলতে খয়বার হাসে, গান-পাগলা মানুষ, করছে কি ছুটির সময় কলকাতা থাকা নতুন নতুন রেকর্ড নিয়া আসছে। সায়গল, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়ার যতো রেকর্ড আমার বাড়িতে আছে সব তোমার বাপের কেনা। আব্বাসউদিনের রেকর্ড প্রথম কিন্যা আনলো আমার বাপজান। ১টি মহাকৌতুককর বিষয় বর্ণনার ভঙিতে খয়বার হাসে, আকবর ভাই আবার ঐ রেকর্ডই নিয়া আসলো পুজার ছুটির সময়।
খয়বার গাজীর বিরামহীন সংলাপে আনোয়ারের কাছে তার বাবা ক্রমেই ঝাপশা মানুষ পরিণত হয়। আনোয়ার তো কোনোদিন আব্বাকে একটা রেকর্ডও কিনতে দ্যাখেনি। অথচ ওদের স্টোরিও রেকর্ড-প্লেয়ারের জন্য ভাইয়া-ভাবী মাসে অন্তত একটা লংপ্লে কেনে, এমন কি সিক্সটি ফাইভ পর্যন্ত কলকাতা থেকেও মাঝে মাঝে রেকর্ড আসতো। ঝাপশা বাবাকে শপষ্ট করার জন্য আনোয়ার জিগ্যোস করে, আব্বা রেকর্ড কিনতেন?
হ্যাঁ বাপু, এবার বলে জালাল মাস্টার, খয়বার ভায়ের বাবার ঢালাও আদেশ ছিলো, নতুন গান বার হলেই নিয়া আসবা, অর্থ যা লাগে চিন্তা করব না। মরহুম পিতার প্রসঙ্গ তোলায় খয়বার গাজী জালাল মাস্টারের ওপর একটু প্রসন্ন হয়, জালাল মিয়া ঠিক কথা কছেন। বাপজান হাউস করা হরমোনিয়াম কিনছে, তাই নিজে গান করছে ছয়মাসে নয়মাসে একবার। হারমোনিয়াম বাজাছে আকবর ভাই, একোটা গান একবার, বড়েজোর দুইবার শুনলে ঠিক তুল্য নিবার পারতো, তাই না জালাল মিয়া?
ঠিক কছেন। তার স্মরণ শক্তি ছিলো অসাধারণ একবার একটা পুস্তক পড়লে’আরে আপনে কি দেখছেন? খয়বার গাজী তাকে থামিয়ে দেয়, তোমার দাদার হাউস ছিলো এক ব্যাটাক উকিল বানাবো। বড়ো ব্যাটা, তোমার বড়োচাচার শরীরটা নরম, কলকাতার হোস্টেলের খাবার সহ্য হলো না, আইএ পাস করা বাড়িতে আসলো। আর গেলো না, সংসার দ্যাখা আরম্ভ করলো। মানুষের নসিব! তোমার বাপ বিএ পাস করা ল’য়েত ভর্তি হলো, পরের বছর বড়ো মিয়া মারা গেলো। তোমার বড়োচাচা পড়ার খরচ কুলাবার পারে না। ল’ পড়ার জন্যেই আকবর ভাই বিয়া করলো, কি মনে করা এক বছর বাদে পড়া বাদ দিলো, চাকরি নিলো। আকবার ভাই উকিল হলে এই তামাম ডিস্ট্রিষ্ট্রের মধ্যে তার সাথে পারে কেডা?
আনোয়ার ভাবে উকিল না হয়েও আব্বা এমন কি খারাপ করেছে? পার্টিশনের সময় পাকিস্তানে অপশন দিয়ে এসেই ওয়ারিতে বাড়ি কিনেছে, ব্যাংকে টাকা যা রেখে গেছে তাই নিয়ে ব্যবসা করে ভাইয়া দিব্যি রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘আকবর ভায়ের ছোটোভাইটা জাহাঙ্গীরও খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো। জালাল মাস্টার এই মন্তব্য করে ফের খয়বার গাজীর ধমক খায়, জাহাঙ্গীরকে আপনে আর কয়দিন দেখছেন? এই চাচাটিকে আনোয়ার অবশ্য একেবারেই দ্যাথেনি, জাহাঙ্গীর হোসেন মারা গেছে তার জনের আগে। আব্বা তার সম্মন্ধে খুব একটা কথা বলতো না, আম্মাও না। বড়োচাচার বোধ হয় বেশ দুর্বলতা আছে, ভাইয়া পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে চিঠি লিখলে বড়োচাচা জবাবে লিখতো, তোমার নিকট আমাদের প্রত্যাশা অনেক। জাহাঙ্গীর জীবিত থাকিলে আজ বড়ো আনন্দিত হইত। উহার মেধার লক্ষণ বংশে কেবল তোমার মধ্যে লক্ষ করা যায়। আজ খয়বার গাজীও তার প্রসঙ্গে উচ্ছসিত হয়ে উঠলো, হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর ছিলো স্কলার ছাত্র। একটা স্টুডেন্ট বটে। ওরকম তুখোড় ছাত্র এই গোটিয়া, পদুমশহর, দরগাতলা, চন্দনসহ, কর্ণিবাড়ি-এই অঞ্চলে জন্ম হয় নাই। এমনকি পার্টিশনের আগে, তখন মোসলমানের স্থান কোটে? সেই সময় হিন্দুগোরে মধ্যেও এরকম মেরিট এই অঞ্চলে একটাও আছিলো না গো। জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পর্কে খয়বার গাজীর দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক বিবৃতি আর শেষ হয় না। কুস সিক্সে পড়ার সময় সে ম্যাট্রিক ক্লাসের টেস্ট পেপার দেখে অঙ্ক করতো। ‘ক্সাস নাইনে যখন পড়ে, এবার জালাল মাস্টার প্রায় জোর করে স্মৃতি ঘটে, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কেশব মিত্রের ফেয়ার-অয়েল বস্তৃতা করলো ইংরাজিত, যারাই শুনছে তারাই বলছে, মনে হলে বিলাত থাকা সদ্য আগত ইংরাজ ভাষণ দিতেছে! তো সেই ছেলে, ঐ বয়সে অতো মেধা, —মুরুব্বিদের কেউ কেউ বলতো এতোটা ভালো নয়। সন্দেহ করতো, খয়বার গাজী বলে, চ্যাংড়ার সাথে তেনাদের কেউ আছেন। না হলে এই বয়সের চ্যাংড়া এতো বুদ্ধি পায় কোটে? তেনারা মানে কারা?–আনোয়ার বুঝতে পারে না।-আরে আগুনের জীব! তবুও বোঝে না! খয়বার গাজী বিরক্ত হয়, জীন জীন চেনো না?—মুরুব্বিদের অনুমান কি ভুল হতে পারে? ম্যাট্রিকে ২টো লেটার পেলো, ডিস্ট্রিক্টে ফাস্ট, তখন বাপু হিন্দুরা আছিলো, পরীক্ষা দিলাম আর পাস করলাম-অতো সোজা না! কলেজে ভর্তি হলো কলকাতায়। আকবর ভাই তখন পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকে, জাহাঙ্গীর তার বাসায় থেকে কলেজ করতে লাগলো। বছর না ঘুরতে জাহাঙ্গীরকে গ্রামে নিয়ে আসা হলো, তার হাতে পায়ে শিকল পরানো, তার মাথা কামানো। চোখজোড়া তার অষ্টপ্রহর লাল, মানুষ দেখলে চিৎকার করে, না দেখলেও আকাশের দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দে কার উদ্দেশে গালাগালি করে। কি ব্যাপার? জোনপুরের মৌলবি সাহেবের ভাগ্নে,—জবরদস্ত পীরসায়েব, নৌকা করে যমুনার শাখানদী বাঙালি দিয়ে যাচ্ছিলো মুরিদ বাড়ি, নাদু পরামাণিকের কাছে খবর পেয়ে আনোয়ারের বড়োচাচা নিজে গিয়ে নৌকা থামিয়ে পীরসায়েবের হাতে পায়ে ধরে। পীরসায়েব এসে জাহাঙ্গীরের রোগ সনাক্ত করে ফেললো। কলকাতায় কোথায় কোন অজায়গায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করছিলো, সঙ্গেকার জীন তাই খেপে গিয়ে একটা বদম্বভাব জীনকে তার ওপর আসর করিয়ে দিয়ে নিজে সরে পড়েছে। বদ জীন ঝেড়ে ফেলা পীরসায়েবের কাছে ভালভাত, জাহাঙ্গীরকে বেঁধে কয়েকটা আয়াত পড়তে পড়তে ঝাড়ুর বাড়ি মারলে শয়তানটা বাপ বাপ করে পালাবে। কিন্তু পীরসায়েব তা করতে নারাজ; কারণ তাতে ভালো জীন অসম্ভষ্ট হয়।
জীন হলো ফেরেস্তাদের মতো, তাকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি পীরসায়েব নেয় কি করে? —তা কলকাতায় গিয়ে জাহাঙ্গীরের মতিভ্রম ঘটেছিলো বৈ কি। কয়েকটা হিন্দু কমুনিস্টের সঙ্গে তার মেলামেশা শুরু হয়। এতো পরহেজগার পরিবারের ছেলে, সে নাকি নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছিলো, আল্লা রসুল নিয়ে ঠাট্টা পর্যন্ত করতো!—আহারে, হিন্দু কমু্যনিস্টদের পাল্লায় পড়ে পাগল না হলে জাহাঙ্গীর এই এলাকা কি, এই জেলার একটা মাথা হতে পারতো। এই নিয়ে খয়বার গাজী ও জালাল মাস্টারের পালা করে আক্ষেপ প্রকাশের আর শেষ হয় না। কতোক্ষণ চলতো কে জানে? ১টি মোটর সাইকেলের আওয়াজে ২জনেই থামে এবং তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। শিমুল গাছের নিচে এলে হোল্ডা আরোহীকে দু’জনেই চিনতে পারে, জালাল মাস্টার বলে, ফকিরগোরে আসমত না?
খয়বার গাজী সেদিক থেকে চোখ ফেরায় আনোয়ারের দিকে, কয়টা দিন থাকবা তো বাবা? ‘জী, কলেজ তো আজকাল প্রায় বন্ধই থাকে। কোনো অজুহাত পেলেই গভমেন্ট একেবারে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত— ?
‘শিক্ষার বিস্তার হয় কেমন করা? জালাল মাস্টার শিক্ষাবিস্তারে বাধাবিপত্তি নিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেছিলো, হোন্ডা এসে পড়ায় তাকে থামতে হয়। হোন্ডার আরোহী হোল্ডা দাঁড় করাতে করাতে বলে, মাস্টার সায়েব সকালবেলা কি দরবার নিয়া আসছেন?
কিন্তু খয়বার গাজীর সঙ্গে তার জরুরি আলাপ, তাই প্রশ্নের জবাব না শুনেই সে এগিয়ে আসে, ওদিককার খবর শুনছেন? হোসেন চাচামিয়া খবর পাঠাচ্ছে। কথা আছে।’
খয়বার তাকে বৈঠকখানায় বসতে বলে নিজে উঠে দাঁড়ায়। আনোয়ার ও জালালের সঙ্গে সে বারান্দা থেকে নিচে নামে। আনোয়ারের পিঠে হাত রেখে বলে, বাবা, কথাটা যেন মনে থাকে। একদিন অ্যাসা ভাত খায়া যাওয়া লাগবো। আকবর ভায়ের ব্যাটা, আমার নিজের ঘরের মানুষ, তোমাকে আমি মুখে না কলেও তোমার একদিন আসা লাগে। তার মুখের জর্দা ও পানের গন্ধ আনোয়ারের মাথার ভেতরে ঢুকে তাকে একটু আচ্ছন্ন করে, তার হাতের মস্ত থাবা দিয়ে আনোয়ারের পিঠ সে আলগোছে চাপ দেয়। খয়বার গাজীর হাতের মধ্যে দিয়ে বহুকাল আগেকার বাপের-ভয়ে-তটস্থ গান-পাগল ১টি তরুণ আনোয়ারের শিরদাঁড়ায় সারেগামা সাধে, আনোয়ারের পিঠ শিরশির করে।
বারান্দার নিচে শুকনো শিশিরের দাগ লাগা ঘাসের ধারালো রেড়ে গলা-বসানো শেফালি ফুল আস্তে আস্তে কুঁকড়ে যাচ্ছে।
শিমুলগাছের কাছাকাছি এসে জালাল মাস্টার পেছনে তাকায়। ঐ সঙ্গে তাকায় আনোয়ারও। হোন্ডাওয়ালা ছেলেটির সঙ্গে খরবার গাজী কথা বলছে, কথা বলতে বলতে ২জনে এগিয়ে যাচ্ছে পুকুর ঘাটের দিকে।
আরো কয়েক পা ইটার পর জালাল বলে, ‘খালি খালি কষ্ট করলা, কোনো কাম হলো না বাপু।
আনোয়ার ঠিকমতো শুনতে পায় না। তার চোখের ঠিক সামনে মস্ত শিমুলগাছ জুড়ে টকটকে লাল রঙ। এর উপর নীল আকাশ। হাঙ্কা ফেনার মতো মেঘ উড়ে বেড়ায় নির্ভার শরীরে। এই লাল, ঐ নীল ও সাদা দেখে দেখে আশ আর মেটে না। কতোকাল আগে আনোয়ারের বাপও এই রাস্তায় এই রঙবাহার দেখতো? ছোটোচাচার হাতের শিকল বড়ো হতে হতে সমস্ত দৃশ্যে কালোর দাপট বিস্তার করলে আনােয়ারের বড়ো অগস্তি লাগে। জালাল মাস্টার এই অস্বস্তি থেকে তাকে একরকম উদ্ধার করে, খালি পথশ্ৰম। খালি খালি আসা হলো।
কেন? আনোয়ার অবাক হয়, মামলা তুলে নেবে বললেন তো’। তুমি বুঝবার পারো নাই আনোয়ার, গাজীর শর্ত পালন করা দুঃসাধ্য। শর্ত? জিগ্যেস করতে করতে আনোয়ারের মনে পড়ে, চেন্টুর আসার কথা বলছেন তো? চেন্টু মাফ চাইবে না?
কথা তো তা নয় বাবা, দিনকাল ততো সুবিধার নয়, খয়বার গাজী চট করা কিছু করবার পারতিছে না। না হলে চেন্টু যা করছে কোনদিন তার লাশ পড়া থাকতো। চেংটুক বাড়ির সীমানার মধ্যে পালে পরে কি করবো তা অকল্পনীয়। নিজে কিছুই করবো না, হয়তো সামনে থাকবেই না, আফসার গাজীকে হাত তুলব্যার মান করা দিবো। দুইজনে ঘরের মধ্যে থাকা খালি ইশারা করবো, কাম সারবো বাড়ির কামলাপাট।