নিচে রাস্তায় বেশ বড়ো ধরনের জটলা। চট করে হাড্ডি খিজিরকে চোখে পড়ে। তার গলাও সবচেয়ে উঁচু, আমি নিজে দেখছি মাহাজনে উনারে ধামকি দিতাছে, মাহাজনে কয় পুলিসে এক পোলারে মারছে, বাকিটারে পুলিসের হাতে তুইলা দিমু আমি নিজে। কি চোট ছাড়তাছে। আমাগো সায়েবে না গেলে মনে লয় দুইচইরখান চটকানা ভি মাইরা দিতো।’
আঃ! তুই চিল্লাস ক্যালায়? আলাউদ্দিন মিয়া ধমক দেয়, কিন্তু তেমন জোরে নয়। আলতাফকে দেখে সে অনুযোগ করে, আপনে তো পিঠটান দিলেন, পোলাপানে আমারে কয়, মিটিং তো আর ধইরা রাখতে পারি না। পাবলিকে শহীদের ভাইয়েরে দ্যাখবার চায়।
আলতাফ বলে, আমি তো ওদের ঘরে গিয়েছিলাম। শুনি ওর ছোটো ভাই গেছে নরসিংদি আর বাপ কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে।
খাইবো ক্যালায়? খিজির আলি ফের এগিয়ে আসে, বাড়িআলা কাউলকা রাইতে একবার ধামকি দিয়া গেছে, রঞ্জুরে জানি মিটিঙেনা পাঠায়। আবার আউজকা মকবুল সাবরে ধইরা লইয়া গেছে। মহল্লার পোলাপান না গেলে তো মাইর দিতো। মিটিঙের মইদ্যে উনিরে এই কথাগুলি কইতে হইবো। ব্যাকটি কইয়া দিবো। মাহাজনে কি কইরা তারে বেইজ্জতি করছে পাবলিকরে কইয়া দিবো। উত্তেজনা ও আবেগে খিজির কাপে, মহল্লার মাইনষে আউজকা মাহাজনরে বানাইয়া ছাড়বো’
‘তুই চুপ কর না। তাকে ধমকে থামায় আলাউদ্দিন, বাঙ্গুর লাহান খালি প্যাচাল পাড়স। মিটিঙের মইদ্যে এইগুলি কইবো ক্যালায়? মিটিঙের এজেন্ডা আছে না?
এইসব হৈচৈ ও লোকজনের মাঝামাঝি হাতে-কাচা ঘি রঙের শার্ট ও সবুজ চেক চেক লুঙির ভেতর থর থর করে কাপে মকবুল হোসেন।
তার ঠোঁটের কাপন দেখেই রঞ্জু ওপরের দিকে তাকায়। ওদের বারান্দায় রেলিঙে কুকে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রানু। রানুর মুখ ভয়ানক ফ্যাকাশে। আহা! মেয়েটা নিশ্চয় খুব ভয় পেয়েছে। চারপাশের কোলাহল ওসমানের কানে বাজে আবহ-সঙ্গীতের মতো, এসব ছাপিয়ে শোনা যায় রানুর মিনতি, আপনে একটু বলেন না। আব্বারে মিটিঙে নিলে আব্বা কিছু বলতে পারবে না, আব্বা এক্কেবারে সাদাসিধা মানুষ! আব্বারে আপনে ঘরে নিয়া যান। ওসমান ফের ওপরে তাকায়,–না, কোথায় রানু? ইশারায় তাকে ডেকে রানু কি এই সব কথা তাকে বলতে পারতো না? ওসমান ভাবে, যাই, রানুকে বলে আসি, আমি তো আছি। তোমার বাবাকে আমি দেখবো। তুমি কিছু ভেবো না।-কিন্তু রানুর সঙ্গে এইসব কথাবার্তা বলার বা তার ওপর রানুর আস্থা উপভোগ করার কপাল কি ওসমানের হবে? লোকজন শালা ছুটছে।
ছুটন্ত জটলার ভেতর থেকে হঠাৎ স্লোগান ওঠে শহীদের রক্ত’-বৃথা যেতে দেবে না। এরপর ফের স্লোগান আরু তালেবের রক্ত-বৃথা যেতে দেবে না। এরকম ২/৩ বার স্লোগান দেওয়ার পর খিজিরের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়, আইয়ুবের দালাল মাহাজন।’ কিন্তু এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না। দ্বিগুণ শক্তিতে খিজির চিৎকার করে, আইয়ুবের দালাল মহাজন? এবার জবাব আসে, ‘ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক!’ তারপর ফের স্লোগান ওঠে, মাহাজনের জুলুম, মাহাজনের জুলুম’–’চলবে না, চলবে না। খিজির এবার ফের নতুন প্লোগান তোলে, মানুষরে ডাইকা বেইজ্জতি করা’-‘চলবে না চলবে না’ পাড়ার ছেলেরা মনে হয় মজা পেয়েছে, খিজিরের রাগ তারা উপভোগ করে। রঞ্জুর বাবার ঠোঁট আরো তীব্রভাবে কাপে, ওসমানের ভয় হয়, এরা কি রহমতউল্লার বাড়ি থেকে রানুদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করছে? আলাউদ্দিন মিয়া ছিলো মিছিলের পুরোভাগে, খিজিরের দিকে তাকিয়ে সে একটু থামে। মিছিল এগিয়ে চলে। ওপরের দিকে চামড়া জড়ানো হাড্ডিসর্বস্ব হাত ওঠানো খিজির তার সামনে এলে আলাউদ্দিন চোখ ঘুরিয়ে একটু নিচুস্বরে বলে, ‘খ্যাচরামো করনের জায়গা পাইলি না, না? এইগুলি কি কস হারামজাদা, এইগুলি কি? খামোস মাইরা থাক।
কিন্তু আনোয়ার এগিয়ে আসে, কেন? মহাজন তো খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিলে ক্ষতি কি?
খিজির আলি ভরসা পেয়ে বলে, আরে আমি তো তাই কই রঞ্জুর বাপে ইস্টেজের উপর খাড়াইয়া কউক, মাহাজন আমারে লইয়া গিয়া বেইজ্জত করছে! আপনেরা বিচার করেন।’
আনোয়ার সায় দেয়, বলুক না! আইয়ুব খানের লোক্যাল এজেন্টদের এক্সপোজ করা দরকার।
আলাউদ্দিন মিয়া কিন্তু আনোয়ারের দিকে মনোযোগ দেয় না। এমন কটমট করে খিজিরের দিকে সে তাকায় যে, মনে হয় ওকে আচ্ছা করে পেটাতে পারলে তার শীররটা জুড়ায়। কিন্তু মামার বদভ্যাসগুলো তার ওপর বর্তায়নি। চাকরের গায়ে সে কখনো হাত তোলে না, পারতপক্ষে মুখও খারাপ করে না। তাহলে কি খিজিরকে আজ বরখাস্ত করে দেবে? তবে আপাতত সেই কাজ স্থগিত রেখে আনোয়ারকে বলে, আপনেরা আমাগো মহল্লার খবর রাখেন না, তাই এইসব কথা কন রহমতউল্লা সর্দাররে ওপেনলি কনডেম করলে মহল্লায় রি-এ্যাঁকশন খারাপ হইবো, বুঝলেন না?
আলতাফ এবার এগিয়ে আসে আনোয়ারের সমর্থনে, মুসলিম লীগের এইসব পচারদি মালের বিরুদ্ধে কথা বললে কার গায়ে লাগবে?
দরকার কি? আলাউদ্দিন তর্ক করে, মকবুল সাব মঞ্চে দাঁড়াইয়া কইবো, তার পোলারে পুলিসে গুলি করছে তার পোলারে মারার ফলে তাদের ফ্যামিলিতে মুসিবত নাইম আসছে, তার পোলা ছিলো ফ্যামিলির ওনলি আর্নিং মেম্বার।-এইগুলি বলুক। আমাদের দরকার পাবলিকের সিমপ্যাথি, না কি কন?
আনোয়ার তবু গো ছাড়ে না, স্টেজে উঠে কান্নাকাটি করার দরকার কি? এতো নাটক হচ্ছে না, পাবলিক কাদানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং মহাজনের শয়তানিটা এক্সপোজ করলে কাজ হয়। তাই না আলতাফ ?
আলতাফ এবার আলাউদিনের ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে, ঐ লোকটাকে এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনাকে পুলিশ এ্যাঁরেস্ট করে যখন তখন এই লোক পুলিশকে ঠেকাতে এসেছিল? তার স্বর একটু নরম হলো, আপনি সেই কবে থেকে পলিটিক্স করছেন, এতো সাফার করলেন, তবু এদের চিনতে পারেন না?
‘ঐগুলি কথা কইয়া ফায়দা কি, কন? আলতাফকে থামিয়ে দিলেও আলাউদ্দিন নিজেই ঐসব কথা শুরু করে, মুসলিম লীগের এগেন্সটে কথা বললে যখন গুনা হইতো, বুঝলেন, গুনা হইতো, জমাতে নমাজ ভি পড়বার দিতো না, আমরা তখন ছোটো আছিলাম, তখন থাইকা জানটারে বাজি রাইখা চোঙা ফুকতাছি। ঐ যে মুজিব ভাইয়ের পিছে খাড়াইছি, আর ইমাম বদলাই নাই, তার পিছনেই রইছি! একটু থেমে সে ফের বলে, ‘মহল্লার মইদ্যে কার কি রকম ইজ্জত আমরা জানি না?
চিলেকোঠার সেপাই – ১১
কথা বলতে বলতে শ্লোগান দিতে দিতে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে, পার্কের ভেতর থেকে আসে বক্তৃতার আওয়াজ। আরো একটু এগোলে কথাগুলো স্পষ্ট হয়, ভাইসব, তেইশ বছর থেকে সোনার বাঙলার সম্পদে ফুলে ফেপে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙলাকে শোষণ করে গড়ে তোলা হয় করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ। পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিতে খাল কেটে আজ ফসল ফলানো হচ্ছে, সেসব কার টাকায়? আমাদের বন্যা সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। আমাদের কৃষক আজ পাটের দাম পায় না, বাঙলার ছাত্রসমাজ আমাদের এখানে তৈরি কাগজ কিনতে বাধ্য হয় বেশি দামে, বাঙালি বলে ভালো চাকরি থেকে আমরা বঞ্চিত। আমাদের অধিকার আদায়ের কথা বলার জন্য আমাদের নেতাকে কারাবন্দি হতে হয়, মিথ্যা ষড়যন্ত্রের মামলা চাপিয়ে তাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ফন্দি আঁটে আইয়ুব খান। ভাইসব, আমরা বাহান্ন সালে রক্ত দিয়েছে, বাষট্টিতে রক্ত দিয়েছি, উনসত্ত্বরের সূত্রপাত রক্তপাতের ভেতর। ভাইসব—।
ভিক্টোরিয়া পার্ক ভর্তি মানুষ। শহীদ মিনারের বিশাল বেদীতে অনেক লোক, এদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতা ও কর্মী। বেদীর চারদিকে সিঁড়িতেও ছেলেরা বসে রয়েছে, কারো কারো হাতে পোস্টার-সটা বাশের চাটাই। পাশের রেলিঙটপকে উপচে পড়েছে মানুষ, দেওয়াল ঘেঁষে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বা হাঁটতে হাঁটতে বক্তৃতা শুনছে। পূর্বদিকের গেট থেকে ফুচকাওয়ালা ঘুঘনিওয়ালাদের সরে যেতে হয়েছে ওপারে ইসলামিয়া কলেজের গেটে। এখান থেকে উল্টোদিকে ট্যাকসি-স্ট্যাণ্ডে ৩টে ট্রাক,ট্রাকে রাইফেল হাতে সদাপ্রস্তুত পুলিসবাহিনী। শীতের বিকালবেলাটা গড়িয়ে পড়েছে এই পার্কে, শেষ-রোদ লেগে শহীদ মিনারের গম্বুজ লালচে শাদা রঙে হাসছে। মাইকে এখন অন্য একটি কণ্ঠ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পাকিস্তানে তাদের পা-চাটা দালাল আইয়ুব খান ও তার চেলাচামুণ্ডাদের দিয়ে এদেশের মানুষকে শোষণ করে চলেছে। এদেশের সাধারণ মানুষের পেটে আজ ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই। অথচ সর্বহারা মানুষের শ্রমে উপার্জিত টাকায় কিছু মানুষ প্রতিদিন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। ঋণ ও সাহায্য নেওয়ার নাম করে সাম্রাজ্যবাদের পোষা কুকুর আইয়ুব খান দেশকে, দেশের মানুষকে বন্ধক দিয়ে রেখেছে বিদেশী প্রভুর কাছে। আজ বিশ্বের সর্বত্র, এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকায় সর্বহারা মানুষ জেগে উঠেছে, সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল মুৎসুদীদের দিন শেষ হয়ে এসেছে, কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষ আজ-।
একটু গম্ভীর ও একটু হাসিহাসি মুখ করে আলাউদ্দিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। ১টি ছেলে এসে বলে, আলাতাফ ভাই, ওপরে চলেন। আলতাফ মাথা নাড়ে, ছাত্রদের মিটিং, আমরা শুনতে এসেছি।
আলাউদ্দিন মিয়ার পেছনে খিজিরও সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। কিন্তু বেদী পর্যন্ত না উঠে বসে পড়ে সিঁড়ির ওপরের দিকে একটি ধাপে। খিজির আলির পেছনে ছিলো মকবুল হোসেন। খিজির বসার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ওর পাশে দাঁড়ায়। আলাউদ্দিন উদ্যোক্তাদের একজনকে পাশে ডেকে কানের কাছে মুখ এনেকি বলে আর সেই উদ্যোক্তা দাঁড়ায় বক্তৃতারত ছেলেটির পাশে। ছেলেটি বলে, ‘ভাইসব, আর মাত্র একটি কথা বলেই আমি বিদায় নেবো। আমি কেবল এই কথা বলতে চাই যে, শুধু সরকার বদলালেই আমাদের দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটবে না। সাম্রাজ্যবাদীরা চায় না যে আমদের ঘুণে-ধরা সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী সমাজে ব্যবস্থা থেকে আমরা মুক্ত হই। তারা তাই তাদের নানা রকম রঙ-বেরঙের দালাল দিয়ে—’ তার বক্তৃতা শোনা যায় না, বেদীর নিচেই একটি জটলা স্লোগান দিতে শুরু করে, জাগো জাগো’-‘বাঙালি জাগো। পণ্ডি, না ঢাকা?—‘ঢাকা ঢাকা। আগরতলা ষড়যন্ত্ৰ’-মানি না মানি না।
এর মধ্যে অন্য একটি তরুণ মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশে রঞ্জুর বাবার পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলাউদ্দিন মিয়া। মাইকে শোনা যায়, ভাইসব, আপনারা বসে পড়ুন, বসে পড়ুন আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের মহান শহীদ ভাইয়ের মহান পিতা। আপনারা জানেন, এখানে বক্তা বড়ো উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং বড়ডো তাড়াতাড়ি কথা বলতে থাকে; একই সঙ্গে মাইকে কোকো আওয়াজ শুরু হওয়ায় তার কথা কিছু বোঝা যায় না। একবার শোনা যায়, আমরা জানি, আমরা জানি, আমরা জানি- তার জানা জিনিসটা বলার সুযোগ পায় না, আরেকজন এসে মাইক দখল করে এবং বলে, গত ৮ই ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত ওয়াপদার তরুণ কর্মচারী শহীদ আবু তালেবের পিতা এখন আপনাদের সামনে কিছু বলবেন। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দক্ষিণ দিকের গেটের পামগাছের নিচে জটলা থেকে শ্লোগান ওঠে, সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা’-‘হুশিয়ার হুঁশিয়ার। দুনিয়ার মজদুর’—এক হও’, ‘কেউ খাবে, কেউ খাবে না’– তা হবে না, তা হবে না’, ‘জোতদারের গদিতে –‘আগুন জ্বালো এক সাথে। মিল মালিকের গদিতে—আগুন জ্বলো এক সাথে।’
এইসব শ্লোগান চলছে, তখন আবার বেদীর নিচে সেই জটলা থেকে দক্ষিণ দিকে মুখ করে কয়েকজন শ্লোগান দেয়, বাঙলার মজদুর’—এক হও, ছয় দফা ছয় দফা’-‘মানতে হবে মানতে হবে, আগরতলা ষড়যন্ত্র’—মানি না মানি না’, শেখ মুজিবের শেখ মুজিবের —মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।’
দুটো জটলা চিৎকার করার ভঙ্গি এমন যে, মনে হয় তারা যেন পরস্পরের দিকে শ্লোগান ছোড়াছুড়ি করছে। শ্রোতাদের বেশির ভাগই দুই দিকের শ্লোগানেই সাড়া দিচ্ছিলো। কিন্তু শ্লোগান আর থামে না দেখে লোকজন এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করে। কিছু কিছু লোক রেলিঙের বাইরে যাবার উদ্যোগ নেয়। খিজির দাঁড়িয়ে মঞ্চে ওঠে এবং সেখান থেকে গোটা পার্কটাকে ভালো করে দ্যাখার চেষ্টা করে। মঞ্চে সবাই শিক্ষিত লোকজন। বেশির ভাগই ইউনিভারসিটি বা কলেজের ছাত্র, অন্তত ভদ্রলোক তা বটেই। কিন্তু এদের মধ্যে দাঁড়ালেও কেউ তাকে খেয়াল করে না, যেভাবে শ্লোগান-পাল্টা শ্লোগান চলছে তাতে মিটিঙের পরিণতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। আলাউদ্দিনও ঘাবড়ে গিয়েছিলো বৈকি! তার অনেক দিনের অভিজ্ঞতা, সে জানে যেন এসব ব্যাপার কেবল শব্দবাণে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছাত্রদের মধ্যে কি ধরনের ঐক্য স্থাপিত হয়েছে কে জানে? ইউনিভারসিটিতে বছরের পর বছর ধরে ল ক্লাসে পড়ে-থাকা নেতাগুলো কি কিছুই আঁচ করতে পারে না? কৰ্মীদের অস্ত্র কখন যে মুখ থেকে হাতে সরে কোন শালা জানে?—আলাউদ্দিন তাই খিজিরকে একটু চোখ টিপে দেয়, সে যেন তার সামনেই একটু আড়াআড়িভাবে দাঁড়ায়। কিন্তু এই বাঙ্গুটার বুদ্ধি দাখো ব্যাট তার ইশারার কি বুঝলো, হাত দিয়ে মাইকের স্ট্যান্ড ধরে ফেললো। তারস্বরে খিজির চ্যাচাতে শুরু করে, ভাইসব ভাইসব, আপনেরা খালি খালি চিল্লাচিল্লি করেন ক্যালায়? খামোস মাইরা মিটিং হোনবার পারেন না? পাঁচজনে দশজনে একলগে নামছেন, খালি চিল্লাচিল্লি করবেন তো খালি হাউকাউ হইবো, কাম হইবো আপনের কেলাটা কাম করেন একলগে, হাউকাউ কইরেন না। হালার গ্যাঞ্জাম তো বহুত করছেন, অহন আল্লার ওয়াস্তে চোপাগুলিরে এটু আরাম দেন। খিজির আলির দৈর্ঘ্য ও কৃশতা, তার ভাঙাচোরা গাল, কাটখোটা মার্কা চেহারা, কালচে পুরু ঠোঁট কিংবা তার ঘোরতর স্থানীয় উচ্চারণে শ্রোতাদের মধ্যে দারুণ হাসাহসি শুরু হয়। এমনকি আলাউদ্দিনও হাসতে হাসতে তার পিঠে হাত রেখে বলে, ‘ল হইছে!’ লোকজন খুব হাসছে। যারা তাকে চেনে তারা তো হাসছেই, তারা জানে যে, কোথাও কোনো গোলমাল কি জটলা দেখলেই হাড্ডি খিজির সেখানে হাজির হয়ে চাপাবাজি করে। শ্রোতাদের বেশির ভাগই তাকে চেনে না, তারা আরো হাসছে। মাইকের সামনে এখন মকবুল হোসেন। কিন্তু লোকজন খিজিরের উচ্চারণ ভঙ্গি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মুখ ভাংচাচ্ছে, মকবুল হোসেনের দিকে তাদের মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়? আনোয়ার ও আলতাফ শ্লোগান ও পাল্টা শ্লোগানে আড়ষ্ট হয়ে পরস্পরের দিকে না তাকাবার চেষ্টা করছিলো। খিজিরের এই কাণ্ড দেখে তারা সহজ হলো নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহসি করে। শ্লোগান বন্ধ করে ছেলেরা নিজেদের অজান্তেই খিজিরের আহবান মেনে নিয়েছে। খিজিরের প্রতি ঠাট্টা, কৌতুক ও বিদ্রুপের অভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন জটলার ছেলেদের পরস্পরের প্রতি তেতো মনোভাব স্থগিত রইলো। আলাউদ্দিন মিয়া ঠোঁটে হাসি বিছিয়ে রেখেই ঘোষণা করে, এখন আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন শহীদ আবু তালেবের পিতা জনাব মকবুল হোসেন সাহেব।’ শ্রোতারা মোটামুটি চুপচাপ হয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু মকবুল হোসেনজিভ দিয়ে ঠোঁট মোছে, বারবার মেছে। আমি বলার পর সে টোক গেলে এবং ফের শুরু হয় তার জিভ দিয়ে ঠোঁট মোছার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার পেছন থেকে একজন তরুণ নেতা বলে, বলেন না, বলেন না। এই গলা মাইকে বড়ো স্পষ্ট, বলেন, আইয়ুব-মোনেমের লেলিয়ে-দেওয়া পুলিসবাহিনী আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে। কথাগুলো আস্তে বললেও মাইকে শোনা যায়। এবার শ্রোতাদের মধ্যে সাঙ্গাতিক নীরবতা। মকবুল হোসেনের ঠোঁট কাপে। পেছনের ছেলেটি ফের বলে, বলেন, বলেন। মকবুল হোসেন আস্তে আস্তে বলে, আমার ছেলে, আরু তালেব, আমার বড়োছেলে মোহাম্মদ আরু তালেব গত মাসের ৮ তারিখে নিউমার্কেটের সামনে নীলখেতের মোড়ে পুলিসের গুলিতে
তরুণ ছাত্রনেতা প্রম্পট করে, বলেন মিছিল থেকে—’ মকবুল হেসেন বিড়বিড় করে,মিছিল থেকে মারা গেছে।’ ছাত্রনেতা ফের প্রম্পট করে, বলেন, আমার একটি ছেলে মারা গেছে, কিন্তু আমার ছেলের মতো লক্ষ লক্ষ ছেলেকে আজ আইয়ুব শাহী উচ্ছেদ করার জনো- ৷
কিন্তু মকবুল হোসেনের ভারি গলায় বলা হয়ে যায়, আমার একটি ছেলে মারা গেছে, কিন্তু আমার আরেকটি ছেলে আছে। তাকে যদি না বাচাতে পারি? তাকে ক্যামনে বাঁচাই, ক্যামনে বাঁচাই? সে কাঁদতে শুরু করায় তার কথা একেবারে নেতিয়ে পড়ে। সে চোখে হাত দেয় না, নাক মোছে না। নাক থেকে চোখ থেকে পাতলা পানি গড়িয়ে পড়ছে। জনসভা নির্বাক হয়ে তার কান্নাজড়ানো ধ্বনি শোনে। মকবুল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়ে খিজির বলে, মাহাজনে আপনেরে বেইজ্জত করছে, কন আরে কন না, কন না। কাব্দেন ক্যালায়?
আলাউদ্দিন মকবুল হোসেনের ঘাড়ে আলগা করে হাত রাখে। লোকটি একটু ঝুঁকে পড়ে। তারপর আলাউদিনের ঘাড়ে মুখ গুঁজে সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।
খিজির বেশ উত্তেজিত। তার ঠোঁটজোড়া এমন বেসামালভাবে কাপে যে, ভয় হয় ঐ দুটো তার মুখ থেকে খসে নিচে না পড়ে। অস্থির ঠোঁটজোড়া থেকে বেরিয়ে আসে, কাব্দেন ক্যালায়? কথাটা কইবার পারলেন না? কন না। ডর কিয়ের? আমরা এ্যাঁতোটি মানুষ আছি না? কান্দনের কি হইলো? কইয়া ফালান, মাহাজনে আপনেরে ডাইকা লইয়া কেমুন বেইজ্জত করলো, কন না।’
মঞ্চের ও সিঁড়ির লোকজন সমস্ত অডিয়েন্সের সঙ্গে মাইকে মকবুল হোসেনের ফোপানি শুনতে শুনতে তার প্রতি সহানুভূতিতে ও তার পুত্ৰশোকে বেশ বুদ হয়ে বসে ছিলো। খিজিরের এই সব উত্তেজিত অনুরোধও মাইকে ধরা পড়ায় মকবুল হোসেনের ফোঁপানি বারবার বিঘ্নিত হয়। লোকজনের মেজাজ চড়ে যায়, একজন বলে,আঃ! আরেকজন বলে, আপদটা এই দ্বিতীয়জনের গলায় শিশুদের কোলাহলে কাঁচা-ঘুম-ভাঙা মানুষের বিরক্তি, কুট্টিটার কমনসেন্স নাই!’
মকবুল হোসেন তার বুকে মাথা রাখায় আলাউদ্দিন বড়ো অভিভূত। সমস্ত শ্রোতার চোখ এখন তার দিকে। তাকে দুই হাতে প্রায় আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে ধরতে কৃতজগদগদ কণ্ঠে আলাউদ্দিন ঘর্ঘর করে, ভাইসব, এটু শক্ত হইতে চেষ্টা করেন। একটু থেমে সে বলে, শক্ত হন, ডর কইরেন না, রহমতউল্লা সর্দাররে আমি সামলাইবার পারুম!’
মিটিং শেষ হলে রিকশা আর পাওয়া যায় না। ওসমান ও আনোয়ারকে হাটতে হলো একেবারে রথখোলার মোড় পর্যন্ত। রিকশায় উঠে লাভটা কি হলো? মানুষে, গাড়িতে, স্কুটারে, রিকশায়, সাইকেলে নবাবপুর একেবারে ঠাসা। ওদের রিকশা কিছুক্ষণ চলে, ফের থামে। সামনে যানবাহনের স্রোত থামে, ওদের রিকশাও থামে, রাস্তাফের চলতে শুরু করলে রিকশাও চলে।
মিটিং থেকে বেরুবার পর থেকেই আনোয়ারের মেজাজ চড়ে আছে, ব্যাটারা আছে খালি নিজেদের নিয়ে। নিজেদের লিডার, নিজেদের পার্টি ছাড়া কথা নেই। ওসমান বলে, নিজেদের কথা বলবে না কেন? পার্টিগুলো তো আর মার্জড হয়ে যায়নি।’
‘আরে ভাই, পাবলিকমিটিং তো সেমিনার নয়। সেমিনারে না হয় নিজের নিজের বক্তব্য বলতে পারে। এই পর্যন্ত বলে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা ১টি দোকানের সামনেসিমেন্ট আনলোড-করা ট্রাকের উদ্দেশে আনোয়ার গালাগালি করে, তারপর ফের বলে, শুধু নিজেদের কথাই বলবে তো ইউনিটি করার দরকার কি?
বলতে দাও না’, ওসমান এমন করে বলে যেন মিটিঙে দলের বক্তব্য প্রকাশ করতে দেওয়ার মালিক আনোয়ার, বলতে দাও। দাখো মানুষ কার প্রোগ্রাম এ্যাঁকসেপ্ট করে।’
আরে নাঃ এর মধ্যে যদি বুঝতে পারে যে, অন্য কোনো পার্টির প্রোগ্রামে মানুষ সাড়া দিচ্ছে তো ব্যাটারা নিজেরাই সেই ইসু নিজেদের নামে চালাবে।’
তাহলে তো ভালোই। ওসমান হাসে, মনে করে তোমাদের প্রোগ্রাম ওরা এ্যাঁকসেস্ট করলো, তাহলে কি তোমাদের বিজয় হলো না?
না। আমাদের প্রোগ্রাম ওরা নেবে শ্লোগান হিসাবে। কোনো প্রোগ্রামের পপুলারিটি বুঝে তাই নিয়ে শ্লোগান ঝাড়বে। এককালে অটোনমির নামে খড়গহস্ত ছিলো, পাকিস্তানের কনস্টিটিউশনে নাকি ৯৯% অটোনমি দেওয়া হয়েছে। আবার দাখো এরাই এখন আটোনমির চ্যাম্পিয়ন। এরপর দেখবে সোস্যালিজমকে নেবে শ্লোগান হিসাবে। অথচ কোনো ইসুকে এরা পিপলের কাছে নিয়ে যায়নি। যে কোনো পার্টির যে কোনো প্রোগ্রাম মানুষের মধ্যে পপুলার হলে সেটার শ্লোগানটা এরা পিক আপ করে নিয়েছে।
কিন্তু একই প্ল্যাটফর্ম থেকে সবাই বললে লোকে কিন্তু বুঝতে পারে কার কথা জেনুইন, কারটা শুধু চাল মারা। এছাড়া কাজ করতে করতে ওয়ার্কারদের মধ্যে পরস্পরের মতামত সহ্য করার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।’
এখানে কি ধৈর্য পরীক্ষা আর পরমতসহিষ্ণুতার ট্রায়াল দেওয়া চলবে? কৈ, ঐ লোকটাকে তো বলতে দেওয়া হলো না?
কোন লোক? আরে ঐ যে রিকশাওয়ালা না স্কুটার ড্রাইভার!—ঐ যে তোমাদের আলাউদ্দিন মিয়ার এমপ্লয়ি-ওকে তো বলতে দেওয়া হলো না! মতামতের আদান-প্রদান কি খালি ভদ্রলোকদের মধ্যে চালাচালি হবে?
ওসমান এবার বিরক্ত হয়, তুমি বোঝে না! খিজিরকে বলতে দিলে বাড়িওয়ালা চটে গিয়ে আরু তালেবের বাবাকেও শহীদ করে ছাড়তো, অন্তত ঐ বাড়িতে থাকতে দিতো না।’
কেন? বাড়িওয়ালা কি ফ্রি থাকতে দেয়? ফ্রি থাকবে? ওসমান ফিক করে হাসে, তিন তারিখের মধ্যে ভাড়া না দিলে দিনে দুবার, এক সপ্তাহ পার হলে দিনে চারবার তাগাদা দেয়।
তাহলে এতো ভয় পাবার কি আছে? এই বাড়ি ছাড়লে আর বাড়ি পাবে না? পাবে না কেন? তবে ভাড়া বেশি দিতে হয়। বাড়ি বদলানো মানেই বেশি ভাড়ায় যাওয়া। আবার এই বাড়িতে যারা আসবে তাদেরও বর্তমান ভাড়া বেশি দিতে হবে। প্ররেমটা তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না—। ওসমানকে কথা শেষ করতে দেয় না আনোয়ার, বুঝি। ঢাকায় বাড়িওয়ালা শালারা একেকটা থরো-ব্রেড হারামজাদা! দফায় দফায় ভাড়া বাড়াচ্ছে। এখন তো বছর বছর বাড়ে, এরপর ঈদে বাড়াবে, মহরমে বাড়াবে। শীতে বাড়াবে, গরমে বাড়াবে।’
ওসমান হো হো করে হাসে, রোদে বাড়াবে, ছায়ায় বাড়াবে।’ তারপর ধরো বাঙালি জাতীয়তাবাদের তোড় যেভাবে আসছে তাতে মনে হয় শহীদ দিবস উপলক্ষেও বাড়াবে, পয়লা বৈশাখে বাড়াবে।’ আনোয়ার হাসতে হাসতে বললে ওসমান খুশি হয়। আনোয়ারও তো বাড়িওয়ালা। যাক, ওসমানের কথায় সে রাগ করেনি। হাসি থামিয়ে আনোয়ার বলে, আমাদের বাড়িতেও তো দেখি। আম্মা আর ভাইয়া ভাড়া বাড়াবার ব্যাপারে সব সময় একমত!
ওসমান বিব্রত হয়, না সবাই তো একরকম নয়। তবে ধরে বাড়ি ভাড়া দেওয়াটা এখন একরকম ব্যবসা।’
ব্যবসা কি বলছো? জমিদারী, জমিদারী!’ আনোয়ার অতিরিক্ত উত্তেজনা প্রকাশ করে, এ শালা আরেকটা পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট। লর্ড মাউন্টব্যাটেন’স পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট নাইন্টিন ফোর্টি সেভেন। এদিক ওদিক করে একটা বাড়ি বানাও, এক বাড়ি ভাড়ার টাকায় আরেকটা বাড়ি করো। সেকেন্ড টাইমে একটু পশ এরিয়ায়, থার্ড টাইমে গুলশান। ব্যস এক জেনারেশনেই বুর্জেয়া’
বাড়িওয়ালাদের সম্বন্ধে কথা উঠলে আনোয়ার একটু বাড়াবাড়ি রকম চটে। অবশ্য ওদের বাড়ির বিশেষ ধরনের সুবিধা সে খুব একটা নেয় না! তার কলেজের চাকরির রোজগারের বড়ো ১টা অংশ তুলে দেয় মার হাতে। বাড়ির যে অংশে ভাড়াটেরা থাকে সেদিকে পারতপক্ষে পা মাড়ায় না। তাহলে এই বাড়িভাড়ার প্রসঙ্গ উঠলে সে এতো চড়া-গলা হয় কেন? ওসমান এ নিয়ে কোনোদিন ভাবেনি, এখনো ভাবলো না। তবে ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে। একজনের পরিবারের দুর্বল দিক যে কথায় এসে পড়ে তা এড়িয়ে চললে কি ভালো হয় না? ওসমান তাই আগের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চায়, খিজিরকে বলতে দিলে হতো কি, ও হয়তো রহমতউল্লা সর্দারের নামে যা তা বলতো, মিটিঙে ক্যাওস হতে পারতো!
রাখো! বাড়িওয়ালা যতো শক্তিশালী হোক না, মানুষ যেখানে টোটাল এক্সপ্লয়টেশনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সেখানে তার পজিশন আর কি এমন শক্ত?
সামনের ট্রাক সিমেন্টের বস্তা নামিয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো। কিন্তু আলুবাজারের মোড়ে ফের জাম। ওসমান সেই ট্র্যাফিক জামের কারণ খুঁজতে খুঁজতে বলে, না, আবু তালেবের বাবাকে যদি উৎখাত করে তো তার সমস্ত কষ্টটা বহন করতে হবে তাকে নিজেকে। আমাদের বাড়িওয়ালার যারা অপোজিট গ্রুপের লোক, তারাও তাকে কম ভাড়ায় বাড়ি দেবে না। টাকা পয়সার ব্যাপারে লোকটা একটু ট্রাবলে আছে, তালেব মারা যাবার পর—।’ ওসমানকে আনোয়ার মাঝখানে থামিয়ে দেয়, যার ছেলে মারা যায় পুলিসের গুলিতে তার আবার ভয় কি ? তার হারাবার আর কি আছে?
আছে। আরো একটি ছেলে। দুটো মেয়ে আছে— ‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নাকি? আনোয়ারের এই ঠাট্টায় ওসমান সাড়া দিতে পারে না। আনোয়ার বলে, ‘আর কি আছে, বললে না?
‘আর কি থাকবে, বলো? ছোটোখাটো চাকরি আছে, খেটেখুটে খায়, সাহসটা কম। ওর বলতে ইচ্ছা করছিলো যে, মবকুল হোসেন গরিব মানুষ, চট করে বিপ্লব করা তার পোষায় না। আনোয়ার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ঢাকা শহর বলে তোমাদের এইসব রহমতউল্লা এখন পর্যন্ত দাপটে আছে। গ্রামে অবস্থা অন্যরকম। তোমাকে বললাম, চলো একবার ঘুরে আসি। সামনের সপ্তাহে চলো।’
‘তোমার কলেজ? ‘আরে কলেজ তো সব সময় বন্ধ। একবার ছেলেরা স্ট্রাইক করে, একবার গভমেন্ট বন্ধ করে দেয়। বাকি সময়টা হয় রোববার, নয় ভ্যাকেশন। চলো, ঘুরে আসবে।’