ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘিরে ২বার চক্কর দেওয়ার পর ওসমান গনি একেবারে আড়ালে পড়ে গেলো। তাহলে সে রাস্তা ধরলো কোনদিকের ?—এখন থেকে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। ওসমান কোথায় যেতে পারে?
নর্থব্রুক হল রোড ধরে শ্যামবাজার গেলে সামনে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা পার হতে পারলে তাকে ঠেকায় কে?
ট্যাকসি-স্ট্যান্ডের ভেতর দিয়ে চিত্তরঞ্জন এ্যাঁভেনু বায়ে রেখে শাখারি পটি ক্রস করে চলে যেতে পারে ইসলামপুর। পাকুড়তলা, মিটফোর্ড, ইমামগঞ্জ পেরিয়ে চকবাজার। ব্যদিকে বড়ো কাটরার ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে সোয়ারি ঘাট। ওসমানের যেমন স্পিণ্ড তাতে মোগল আমলের বাড়ি-ঘর ছড়মুড় করে নদীতে টেনে ফেলে দিব্যি সাঁতরে সে চলে যেতে পারে নদীর ওপারে। ওপারে গ্রাম। ১টার পর ১টা গ্রাম যদি সে পেরিয়ে যায় তো তাকে ঠেকায় কে?
আবার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে জনসন রোড হয়ে নবাবপুর ধরে দৌড়ালে পৌঁছে যাবে গুলিস্তান। গুলিস্তান এলাকায় যানবাহনের অভাব হবে না। ১টা বাসে চাপতে পারলে চলে যেতে পারে অনেকদূর।
আরেকটি রাস্তার কথা বিবেচনার মধ্যে রাখা দরকার। ভিক্টোরিয়া পার্কের উত্তরে পুরনো পানির ট্যাঙ্কের সামনে দিয়ে কলতাবাজার হয়ে ওসমান ছুটতে পারে দোলাই খালের দিকে। খালে খিজিরের ছায়া দেখে তার সঙ্গলাভের উদ্দেশে পানিতে ডাইভ দেওয়াটা ওসমানের সমীচীন হবে না। ডাইভ দিতে গেলে ওসমান আহত হতে পারে। কারণ সেখানে পানির চিহ্নমাত্র নাই, খাল বুজে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। রহমতউল্লার মজুরেরা সেখানে ইট বিছায়, মেশিনে সুরকির সঙ্গে সিমেন্ট মেশায়, লম্বা লম্বারডের ওপর ঐগুলো ঢেলে রাস্তা বানায়। দিনের বেলা হলে আলাউদ্দিন মিয়াকে সেখানে পাওয়া যেতো। কারফ্যু বলে রাত্রে কাজ বন্ধ। দিনের বেলা হলে আর কেউ না হোক, জুম্মনটা ওসমানের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। কারফ্যুর দাপটে ছোড়াটা এখন কমলাপুর স্টেশন কি স্টেডিয়ামের বারান্দায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে সে ঘুমিয়েছিলো সদরঘাট টার্মিনালে। জাহাজ ভিড়বার সময় বাশির গম্ভীর আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেছে। জোড়াহাঁটুর মাঝখানে গুঁজে-রাখা প্রায়ার স্কু-ড্রাইভার খুঁজে না পেয়ে জুম্মন এদিক-ওদিক দেখছে। আচ্ছা, খিজির কি তার প্লায়ার ও কু-ড্রাইভারের জন্য জুম্মনকে রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছে? না, রাস্তায় লোক থাকবে কেন? রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সরকারী গাড়ি থেকে মাইকে প্রচারিত বিধি অনুসারে কারফ্যু বলবৎ থাকাকালে রাস্তায় কাউকে দ্যাখামাত্র গুলি করা হবে।
এই প্রসঙ্গে কারফ্যু প্রয়োগকারী সংস্থার খাকি পোষাকধারী সশস্ত্র সদস্যদের কথা মনে করা যায়। ১টি মাত্র বুলেট খরচ করে ওসমানের গতি তারা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে। তবে জানের ভয়ডর তাদের কম নয়। মানুষের বাধ্যতামূলক গৃহবাস সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে তারা মাথা গুঁজে দিয়েছে তাদের অস্ত্রসজ্জিত ছাউনির নিরাপদ গহ্বরে।
দোলাই খালের ওপর নির্মীয়মান রাস্তা ধরে ওসমান এতোক্ষণ হয়তো চলে গেছে বংশাল, নাজিরা বাজারের দিকে। বুজে-ফেলা দোলাই খালের বহুকাল-আগেকার দাঁড় টানার তালে তালে পা ফেলে সে বোধহয় ঢুকে পড়েছে এই খালের ধারের কোনো বস্তিতে। এমনও হতে পারে যে খিজিরের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ওসমান টু মেরে চলেছে বস্তির ঘরে ঘরে। জুম্মনকে হয়তো খিজির সঙ্গে নিতে চায়। বস্তি এলাকায় টায়ার ও ন্যাকড়াপোড়া লোমশ ধোঁয়ার ভেতর ঝুলতে ঝুলতে খিজির জুম্মনকে খুঁজতেও তো পারে। তা খিজিরের পক্ষে সেটা এমন কিছু নয়। কিন্তু জলজ্যান্ত ১টা শরীর নিয়ে ওসমানের তো হাটা ছাড়া আর গতি নাই। গ্রহ-নক্ষত্রের ফোকাসে গোলাপি নীল, নীলচে নীল, গোলাপি সাদা এবং নীলচে সাদা আকাশের নিচে এবং পানিকাদা কফথুথু গুমুতের ওপর পা টানতে টানতে ওসমানের চেহারায় নতুন ধরনের দাগ পড়ছে। এখন খাকি বলে কালো বলো, সবুজ বলো সাদা বলো-কারো সাধ্যি নাই যে তাকে সেই ওসমান গনি বলে সনাক্ত করে।