স্বপ্নে গ্রামের রাস্তায় পা হড়কে যাওয়ায় ঘুমের ভেতর চমকে উঠে ডান পায়ের অবস্থান পাল্টায় আনোয়ার। ঐ পায়ের ধাক্কায় জেগে ওঠে ওসমান। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ও ঠোঁটের ব্যথা কনকন করে ওঠে। বলতে গেলে এই ব্যথাই তাকে অনেকক্ষণ ধরে একটু একটু করে ঠেলছিলো। ভালোভাবে জেগে ওঠবার পর ব্যথা কিন্তু ভেঁাতা হয়ে আসে। মনে হয় তাকে জাগিয়ে তোলা ছাড়া তার কপাল ও ঠোঁটের ব্যথার আর কোনো ভূমিকা নাই। শরীর জুড়ে অবসাদ! অনেকক্ষণ ঘুমাবার পর এই অবসাদ থাকে। তবে এটা কাটানো এমন কিছু কঠিন নয়। গায়ে হাতে পায়ে বলসঞ্চারের জন্য চোখ বন্ধ করে ওসমান একাগ্রচিত্ত হলো। ফলে অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। ছাদের রেলিং টপকে ওসমান পড়ে যাচ্ছে নিচে। ঠোঁটে ও কপালে চোট লাগলো কি তখনি? তার পরনে হাওয়াই শার্ট, শার্টের পকেটে এস্ত্রয়ডারি-করা প্যাগোড়া। আর কিছু স্পষ্ট নয়। ছাদ থেকে ঐ অতর্কিত পতনের পর সে চলে যায় অনেক নিচে, সেখানে কালো পানির অগাধ গভীর বিল। বিলের ওপরকার চেহারা ঝাপশা। গভীর পানির তলায় বিলের হিমকাদাময় আদুরে পেটের ভেতর সে সাতরাচ্ছিলো, তখন কে তাকে খুব জোরে ধাক্কা দেয়। কে সে? কবেকার নৌকাডুবির পর নৌকার ভাঙা গলুই গাথা ছিলো বিলের তলায়, তার সঙ্গে হয়তো তার মাথা ঠেকে গিয়েছিলো। অথবা বিলের প্রধান ব্যক্তিত্ব জনাব রাঘব বোয়াল, সিতার-ই-ইমতিয়াজ, হেলাল-ই-জুরাত কিংবা তার পরিষদ জনাব বাঘা শোল তমঘা-ই খিদমত ঘাই মেরেছিলো, সেই ঘায়ে তার কপাল টনটন করছে। এই ব্যথা একটু ভেঁাতা হয়ে গেলেও এর সাহায্যেই বিলের ছলছল স্পন্দন চেনা যাচ্ছে। বিলের গভীর ঘন বুক থেকে কখন যেন সে উঠে এসেছে ডাঙার ওপর। বিলের কলি খুলে ওসমান ফুটে বেরিয়েছে, সমস্ত শরীর তার একেবারে টাটকা ও নতুন। চোখ মেললে দ্যাখে, সে গুয়ে রয়েছে এই ঘরে, এই বিছানার ওপর। মেঝেতে বসে চাষাভূষা চেহারার ১টি লোক তার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো। এখন বুঝতে পাচ্ছে, ঐ লোকটাকেও ওরা বন্দি করে রেখেছিলো। বোকাসোকা গ্রাম্য মানুষটি দিব্যি ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে গেলো আরে ওসমানের কি-না এই বন্দিত্ব ঘোচার কোনো লক্ষণই নাই।
আহেন, বারাইয়া আহেন। অ ওসমান সাব, আহের না! জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকে খিজির। খিজিরকে দ্যাখামাত্র ওসমানের সবকিছু মনে পড়ে গেলো। এইতো তার পাশে শুয়ে রয়েছে ১সেন্ট্রি। এই পাহারাদার কে? একে চেনা চেনা মনে হয়। হ্যাঁ, এইবার চিনতে পারে, ব্যাটা মিলিটারির লোক। মেজর না কর্নেল? আরে দূর! অতো সোজা? ব্যাটম্যান কি জওয়ান টওয়ান কিছু হবে। পুলিস-কনস্টেবলও হতে পারে। তবে ভাবসাব দেখে মনে হয় ব্রিগেডিয়ার কি মেজর জেনারেল। হতেও পারে। এতো ক্ষমতাবান অফিসার না হলে ওসমানকে এভাবে আটকে রাখে? এর হাত থেকে রেহাই পাবার উপায় কি? মিলিটারির লোক-মানুষকে যতোভাবে পারো বন্দি করে রাখার যাবতীয় ফন্দি রপ্ত করাই এদের জীবনের পরম সাফল্য। লেখাপড়া জানে না, এমনকি যুদ্ধটাও ঠিকমতো করতে পারে না; অথচ দ্যাখো শালারা কি মৌজে থাকে! তো নিজের দেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বন্দি করার ফন্দির্টুকু না জানলে কি এতো মৌজ মারতে পারে?
ওসমান সাব বারাইয়া আহেন দেরি হইয়া যায়, আহেন!
খিজির বড্ডো তাগাদা দিচ্ছে। বুঝতে পাচ্ছে না, এই জানোয়ারটির হাত থেকে বেরিয়ে আসা কতো কঠিন কাজ! এদের হলো ওয়ান-ট্যাক ব্রেন। খুলির ভেতর যা ঢোকানো হলো তাই সেট হয়ে গেলো চিরকালের জন্য। তাই নিয়ে দিনরাত ঘোৎ ঘোৎ করবে। খাটি ও নির্ভেজাল শুওরের বাচ্চা। এদের মধ্যে আবার বড়ো বড়ো পজিশন নিয়ে যারা তারা হলো শুওরের বড়োভাই গণ্ডারের মতো। ১দিকে দৌড়াতে শুরু করলে আশেপাশে তাকায় না। গন্তব্যে বলে আদৌ কিছু আছে? —ওসমান মাথা তুলে পাশের লোকটির হাত ও পা দ্যাখে, সেখানে নখ ও থাবা লুকিয়ে রেখে ব্যাটা গভীর ঘুমে অচেতন।
ডরান ক্যালায়? খিজির ফের তাগাদা দেয়, দুপুরবেলা দেখলেন না ঐ গেরাইম্যা চাষাটা কেমুন ফাল পাইড়া গেলো গিয়া! এই মিলিটারি হালায় কতো ডাক পাড়লো, কিছু করবার পারলো? আপনে খালি ঘরের মইদ্যে বইয়া মুঠঠি মারেন।
খিজির কথা বলছে একা, কিন্ত এইসব বাক্যে কোরাসের আভাস। অনেক লোক থাকলে এই মেজর না কর্নেল না দারোগা না কনস্টেবল না মেজর জেনারেলকে ভয় পাবার কি আছে? তবু সাবধানের মার নাই, ওসমান ভালো করে ঘুমন্ত লোকটির মুখ পরীক্ষা করতে থাকে।
আরে আহেন না কতো মানু বারাইয়া আহে! আপনে দেহি দিন নাই, রাইত নাই, হোগাখান একবার উপ্তা কইরা একবার চৌকির লগে ঠেকাইয়া খালি খোয়াব দ্যাহেন! ওঠেন! গতরটা ঝাড়া দেন!
কিন্তু বেরিয়ে যাবো বললেই বেরুনো যায়? এই ঘরের ২টো দরজাতেই তালা। তার ওপর পাশে ডিউটি দিচ্ছে শাসলো সেন্ট্রি। ওসমান খুব সাবধানে উঠে বসে। এই সামান্য নড়াচড়ায় সেন্ট্রি শালা ঘুমের মধ্যে সাড়া পায় এবং অস্ফুট স্বরে বলে, এই আবদুল, আমার ঘড়িটা- ওসমান এবার নিশ্চিত হলো: না ব্যাটা ঘুমিয়েছে ঘুমাও, গভীরভাবে ঘুমাও। ঘুমের মধ্যেও তোমার ঘড়ির ভাবনা!
কি হইলো? মরলেন নাকি? আহেন না?
নাঃ খিজিরের বিবেচনাবোধ কম। আরো খিজিরের কি? খিজিরের ঘর নাই, বাড়ি নাই, দরজা নাই, ছিটকিনি নাই, তালা নাই, টেবিল নাই, ঘড়ি নাই, ঘণ্টা নাই, মিনিট নাই। ইচ্ছা হলো আর সোজা বেরিয়ে পড়লো। আমি কি তাই পারি?
আমরা যাই। আপনে মিলিটারি হালার তলায় উপ্ত হইয়া নিন্দ পাড়েন!
তক্তপোষের সস্তা কাঠ ক্যাঁচক্যাঁচ করে। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা পড়লে ওসমানের মাথা শিরশির করে ওঠে। না, ভয় কিসের? কর্নেল না মেজর না দারোগা না মেজর জেনারেল ব্যাটা কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে ঘোৎ ঘোৎ করে ঘুমায়। ঘরে আলো জ্বলছে, ওসমান আস্তে করে সুইচ টিপে অন্ধকার করে দিলো। বাইরের আলোয় মশারির আড়ালে লোকটির ঘুমন্ত মুখ ভারি দুঃখী দুঃখী মনে হয়। লোকটি কে? কেএম ওসমানের করোটিতে ১টির পর ১টি ঢেউ খেলে -লোকটি কে? কে? —ঢেউয়ের গতি ক্রমে দ্রুত হয়, তীব্র ও দ্রুতগতিতে ঢেউয়ের মাথার ফেনায় টুটাফাটা কয়েকটি ছবি চিকচিক করে ওঠে কার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ওসমান রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। রথখোলার মোড় মস্ত বড়ো-মার্কা ১টা গাড়ি লাল রঙের আভাস দিয়ে কোথায় হারালো। ঢেউ চলে যায় দূরের কোনো অদৃশ্য তটভূমিতে, কিছু দ্যাখা যায় না।-না, দ্যাখার জো নাই। দাখার দরকার নাই। ওসমান সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
আসছি খিজির! আলো না থাকলেও এই ঘরের সব কিছু তার জানা। টেবিলের ওপর এলোমেলো বইয়ের স্তৃপ, প্লেট, বাটি, পানির গ্লাস, সিগ্রেটের প্যাকেট, দেশলাই। আলনায় ময়লা কাপড়, মেঝেতে লুঙি ও গেঞ্জি। ওসমানের বুক টনটন করে। এরকম হচ্ছে কেন?–আরে নাঃ আসলে টনটন করছে তার তলপেট। ওদিকে ছাদের দরজায় তালা। ওসমা বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতরেই লুঙি তুলে পেচ্ছাব করতে শুরু করলো। পাইপ দিয়ে পানি ঢালার মতো নুনু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচ্ছাব করে। টেবিলের বইপত্র ভিজে যায়, প্লেটে কুসুম-গরম হলুদাভ পানি জমে, আলনার কাপড় ভেজে এবং সব দিয়ে গুয়ে যা থাকে তাই দিয়ে ভিজিয়ে দেয় উপুড়-হয়ে-শোয়া সেন্ট্রির নাদুসনুদুস পাছাখানি। এতেও তার ঘুম না ভাঙায় ওসমান বীরপুরুষের মতো বালিশের নিচে হাত দিয়ে বার করে নেয় চাবির গোছা।
সিঁড়ির দিকে দরজায় লাগানো তালা খুলতে তার ১ মিনিটও লাগে না। চাবির গোছাটি সে ছুড়ে ফেলে জানলা দিয়ে, খুব জোরে ছেড়ে, ছাদ পেরিয়ে, ছাদের রেলিং ডিঙিয়ে চাবির গুচ্ছ পড়ে যায় নিচে। সেন্ট্রি ব্যাটা চাবিটা না পেয়ে বেশ ধাদায় পড়বে, এটা ছাড়া আর আর মানুষকে সে বন্দি করবে কিভাবে?
দরজা তো খোলা হলো। কিন্তু নিচে নেমে কি হবে? রাস্তায় হাজার হাজার রিকশা, রিকশার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মিলিটারি। হাড্ডি খিজির বলে, কি হইলো?
রাস্তায় মিলিটারি।
মিলিটারির মায়েরে বাপ রাস্তা অগো জমিদারি? চুতমারানির দালান ইমারত ব্যাকটি কবজ করছে। রাস্তাভি দখল করবো?
ওসমানের সামনে অন্ধকার খাদ। এই খাদের ভেতর নিচে নামবার সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে ওর কোনো অসুবিধা হয় না। আগডুম বাগডুম খোলা মাঠ ঘাট, ম্যান অফ দি কপাট, ম্যান ইনদি কপাট,-গুনগুন করে গাইতে গাইতে ওসমান নিচে নামে, কোনো ধাপে পা হড়কায় না। তবে সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে ধাক্কা খায় দরজার সঙ্গে। তাকে আটকাবার জন্যে দরজা নিজেই এগিয়ে এসেছে। ওপরের ছিটকিনি খুলে দরজায় ঠেলা দিলে কপাট দুটো একটু ফাক হলো। বাইরের আলো চিকন রেখার ওপর চড়ে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির প্রথম কয়েকটি ধাপ পর্যন্ত ময়লা হলুদ করে তোলে। দরজায় আরেকবার ধাক্কা দিয়ে ওসমান বুঝতে পারে আলোর রেখা আর চওড়া হবে না। দরজায় তালা লাগানো, কপাটজোড়ার ফাক ঐ কয়েক ইঞ্চির বেশি বাড়ানো যাবে না। তাহলে?—এখন কি তবে ফিরে যেতে হবে ঐ কামরায়? তক্তপোষে শুয়ে ঘুমাবার সম্ভাবনায় ওসমান হাই তোলে, শরীর এলিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু শোবে কোথায়? যেখানে শোবে একটু আগেই তো সেখানটায় পেচ্ছাব করে এলো। তাহলে?
কি হইলো? নিচে আইয়া খাড়াইয়া থাহেন?
দরজা বন্ধ। তালা লাগানো। চাবি কার কাছে তুমি জানো?
চাবির গুলি মারেন। বাইর হন।
কোনদিক দিয়ে বেরুবো?
মুসিবত! আরে মিয়া আপনে আছেন ঘরের মইদ্যে, তালা ভি ঘরের মইদ্যে দরজার লগে! ক্যামনে বারাইবেন ঠিক পান না? হায়রে মরদ।
কপাট কপট ইয়েস বন্ধ কপাট, আগডুম বাগডুম ঘোড়াভূম মাঠ দোয় পড়ার মতো বিড়বিড় করতে করতে ওসমান সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলো। তারপর ‘দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট, কর্নেলে জেনারেল করলো লোপাট’ বলে গুণে গুণে ৮ বার ধাক্কা দিলে দরজায় বিকট আওয়াজ হয়। কিন্তু দরজায় ফাক যেমন ছিলো তেমনি থাকে।
আইলেন?
তালা ভাঙা যাচ্ছে না।
ভিতরে খাড়াইয়া ভি তালা ভাঙবার পারেন না। মরদ হইয়া পয়দা হইছিলেন তো? হিজড়াগো লগে লইয়া আমাগো কাম নাই। আমরা যাই গিয়া। খিজির সত্যি সত্যি রওয়ানা হলে ওসমান একটু বিচলিত হয়। না, তাড়াতাড়ি করা দরকার। সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠে ফেরদৌড়ে নেমে দরজার গায়ে সে প্রবল বেগে লাথি লাগায়। এরকম ১বার ২বার ও ৩বার তার জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে তালার কড়া খুলে গেলো। কপাটজোড়া হা হয়ে ভয়-পাওয়া কোনো ভিখারি এবং তার ছায়ার মতো একটু একটু কাঁপে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৫২
ওসমানের এইসব তৎপরতা আনোয়ারের কানে নিশ্চয়ই ধাক্কা দিচ্ছিলো। কিন্তু সে তখন আমূল ঘুমে বিদ্ধ।
ওসমান উঠে গেলে তার ঘুম ভাঙেনি। বরং হাঁটুজোড়ার ভেতর ভাঁজ করে রাখা হাত ২টো ছড়িয়ে সে শুয়েছে আরাম করে। রোগা ও পুরনো তক্তপোষে চারকোনা মশারির ভেতর পাতলা কাঁথার নিচে মাঝারি সাইজের ফর্সা তনুখানি পরিপাটি করে বিছিয়ে ঘুমে ঘুমে আনোয়ার তলিয়ে গেছে অনেক ভেতরে। নিরিবিলি এই ঘর তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে নিভৃত হয়। ওসমান সুইচ অফ করে যাওয়ার পর পাতলা অন্ধকার ১টি কাথা হয়ে তার চোখমুখ ঢেকে দিয়েছে। ওপরে এই অন্ধকার একটু পাতলা, কিন্তু তার চোখের ভেতরকার অন্ধকারকে এটা বেশ ঘন করে তোলে। অন্ধকার ক্রমে পুরুষ্ট্রও হয়। অন্ধকারে পড়ে অন্ধকারের ছায়া এবং ছায়া-অন্ধকার ঘনিয়ে আসে বৈরাগী ভিটায়। চেংটুকে খুঁজতে গিয়ে সেখানে দ্যাখা মেলে জালাল মাস্টারের। বটগাছের পুরু শিকড়ে বসে জালালউদ্দিন বৈরাগীর ভিটার নতুন মহিমা কীর্তন করে, এতদঅঞ্চলের ব্যামাক মানুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা এই বটবৃক্ষের তলা দিয়া যাতায়াত করে। হাটবাজার যাবার পথ এখন কতো সংক্ষিপ্ত হছে আন্দাজ করবার পারে? আগে দুপুরবেলাতেও এদিক আসতে মানুষ আতঙ্কিত হছে, আর এখন? জালালউদ্দিন উৎসাহ ও উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসে, এখন বিকাল হলে স্থানীয় চ্যাংড়া প্যাংড়া, যুবক ও তরুণদের বেড়াবার জায়গা হছে এটা। আবার ধরে ধর্মসভা কও, ওয়াজ মহফিল কও আর সভাসমিতি কও-এই কয়ট ইউনিয়নের মধ্যে এরকম জুতের জায়গা আর কোথায় পাবা? বগুড়া থাকা, নেতৃবৃন্দ আসেন, এই বটবৃক্ষের তলায় গ্রামবাসী তেনাদের ভাষণ শোনে, বুঝলা না?-আনোয়ার বোঝে বৈ কি কতো মানুষের সঙ্গে বসে সে নিজেও বক্তৃতা শুনছে, জাতীয় পর্যায়ের কোনো এক নেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে শুনতে ঝিমায়। বাতাস বইলে বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গত করে বাজতে-থাকা বটপাতার মর্মরধ্বনিতে তার বড়ো ঘুম পায়।
স্বপ্লের এই ঘুম আনোয়ারের সত্যিকারের ঘুমকে মস্ত বড়ো কড়াইতে ধিক ধিক তাপে জ্বাল হতে থাকা দুধের মতো আওটায়। তার গালের ভেতর টাকরায় জিভ লেগে আওয়াজ হয়। আনোয়ার তারিয়ে তারিয়ে সুস্বাদু ঘুম পাড়ে। আওটানো ঘুমে সর পড়ে, ঘুমে ঘুমে সর পুরু হয়। বাইরের যাবতীয় শব্দ, গন্ধ ও রঙ সেই ঘরের ওপর আটকে থাকে, আনোয়ারকে ছুঁতেও পারে না।
চিলেকোঠার সেপাই – ৫৩
তার জোড়পায়ের লাথিতে তালা ভেঙে দরজা খুলে গেলে ওসমান রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলো চিৎপটাং হয়ে। ডান পায়ের পাতা তার ঢুকে যায় রাস্তার পাশে রাখা রিকশার স্পোকের ফাঁকে, তার পায়ের জায়গা সংকুলানের জন্য বেশ কয়েকটা স্পোককে ভেঙে যেতে হয়। বা পায়ের হাঁটুর নিচের দিকটা পড়ে টুকরা কাচের ওপর, ভাঙাচোরা খোয়াও ছিলো সেখানে, হাঁটুর নিচে তার থেতলে গেছে। ওসমানের মাথা পড়েছিলো নালার ঠিক কিনারে, লম্বা লম্বা চুলে নালার ময়লা থিকথিক করে। মাথার চাদি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিলো। তবে ওসমান বেশিক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকতে পারেনি, খিজিরের ধমকে লাফ দিয়ে উঠে দ্যাখে তার সামনে ও ওপরে, পাশে ও পেছনে ল্যাম্পোস্টের বাম্বের আলো ডিমের কুসুমের মতো ঘন। এর সঙ্গে মিশেছে হলুদ জ্যোৎস্না। এই মিশ্রিত আলো মলমের মতো ওসমানের গা জুড়িয়ে দেয়। তার সামনে খিজির। খিজির দাঁড়াও বলে ওসমান পা বাড়ায়। সে চলছিলো রাস্তার ডান দিক দিয়ে কিন্তু এদিকে লাইসেন্স-প্রার্থী রিকশার সারি। তাকে তাই চলতে হয় রাস্তার মাঝখান দিয়ে। কিন্তু খিজিরের গতি বড়ো দ্রুত, ওসমান তাই পা চালায় একটু জোরে। কুয়াশার নিচে ল্যাম্পোস্টে ল্যাম্পোস্টে ঢুলঢুল বাল্বগুলো মানুষের পদার্পণে চমকে জ্বলে ওঠে। এইসব বাঘের কম্পন ও হাল্কা কুয়াশার ধীরগতিতে রাত্রি গড়ায়। হাওয়ায় হাওয়ায় রাত্রির জমাট বাধা কালো শরীর রঙ বদলায়। আকাশ তাই এই কালো, এই কালচে নীল, এই গোলাপী কালো, এই গোলাপী নীল, আবার দেখতে দেখতে নীলচে-নীল। রাত্রিকালের শরীর একটু ভিজে, ওসমানের শীতশীত করছিলো। পায়ের গতি বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে শীতশীত ভাবটা কেটে যায়। ডানদিকে ও বাদিকে গলি-উপগলি সব ফাকা। কিন্তু রাস্তায় মানুষ না থাকলে কি হবে, আশেপাশের বাড়িঘরের মানুষের নিশ্বাসে প্রশ্বাসে গলি-উপগলি ফেপে উঠে গোটা সুভাষ বোস এ্যাঁভেনুকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে জনসন রোডের মোহনায়। না, হাঁটার জন্যে ওসমানকে তেমন কোনো উদ্যম নিতে হয় না, রাস্তার স্রোতে তার পাজোড়া ঢেউয়ের মতো এগিয়ে চলেছে। মুশকিল এই খিজির আলিকে নিয়ে। লোকটা বারবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ওসমান একেকবারে হাক দেয়, খিজির দূর থেকে জবাব আসে, আহেনা’ একবার মনে হলো সে খুব কাছে চলে এসেছে, এটু জলদি করেন ওসমান সাব পাও দুইখান মনে লয় ইসকু মাইরা রাস্তার লগে ফিট কইরা দিচ্ছেন!’ তা ওসমান তো প্রায় দৌড়েই চলেছে, খিজিরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি সোজা কথা? খিজির চলে পানির মধ্যে মাছের মতো। দ্যাখো তো, এই লোকটির সঙ্গ নেওয়ার জন্য ছুটতে হয় ওসমানকে।
মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের সামনে গোলাচি গাছের রোগা ১টি ডালের মোটা ছায়া পড়েছে ডাস্টবিনের ওপর। তার পাশে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শোয়া কুকুরটা তাকে দেখে ঘেউঘেউ করে। তার ঘেউঘেউতে সাড়া দেয় কলতাবাজারের মাথায় যে পানির ট্যাঙ্ক সেখানকার ৩/৪টে কুকুর। মধ্যরাত্রে প্যাট্রোলপুলিসের সতর্ক বশির জবাবে যেমন বাঁশি বাজায় দূরের পুলিস, এই এলাকার কুকুরগুলাও তেমনি ১টার পর ১টা ঘেউঘেউ করে চলেছে। ইটার গতি কমিয়ে ওসমান ধমক দেয়, চুপ কর। কুত্তার বাচ্চা! খিজির কোথেকে হেসে ওঠে, আহেন ঐগুলি কিছু করবো না। ডাফরিন হোস্টেলের বাস্তুছুচোটি ঘরে ফিরছিলো ফুটপাথের ধার ঘেঁষে, ওসমানকে দেখে কিংবা তার পায়ের আওয়াজে সে চিটি করে ওঠে। সারি সারি রিকশার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো কালো-সাদা বিড়াল। সে একটু থমকে দাঁড়ালো, তারপর রাস্তা ক্রস করে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের গেটের সামনে। টাইন আহেন। ফের খিজিরের গলা। এইবার ওসমান তাকে একেবারে সামনা-সামনি পায়। খিজির ঝুলছে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে, তারে ঝুলতে বুলতে লোকটা আবার কোথায় চলে গেলো?
মাথার ওপর ইলেকট্রিক তারের ঝাঁক ছুটে চলে ল্যাম্পোস্ট ছুয়ে ছুঁয়ে। তারের ভেতরকার বিদ্যুতের চলাচল খিজির নিশ্চয়ই স্পর্শ করতে পাচ্ছে। স্পর্শ করা কি বলছো? লোহার রডের মতো আঙুলগুলো দিয়ে ইলেকট্রিক তার মুচড়ে বিদ্যুৎ সে নিংড়ে নিচ্ছে নিজের হাড্ডিসার শরীরে। না হলে ব্যাটা এরকম স্পিড পায় কোথেকে? ওসমান এবার খুব জোরে দৌড়াতে শুরু করে। তার আশা ইলেকট্রিক তারের কাক ১বার না ১বার ছোঁ মেরে তাকে তুলে নেবে ঐ উঁচুতে, খিজিরের পাশে চলতে তখন আর তাকে কোনো বেগ পেতে হবে না।