বন্ধ কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট, আগডুম বাগডুম ইন খোলা মাঠ, ম্যান অফ দি কপাট ম্যান ইনদি কপাট, দুই তিনচার পাঁচ ছয় সাত আট, কর্নেলে জেনারেলে করলো লোপাট, কপাট বন্ধ হলে কপাটি জমাট, স্টেমিটিল সিডেটিভ ঝপট ঝপাট, ম্যান ইন দি কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট।–দিনে দিনে ওসমানের ছড়া লম্বা হয়, ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ে। মাঝে মাঝে কয়েকটা লাইন তার ঝরে পড়ে, পরদিন সদ্যোজাত লাইনের সঙ্গে কোনোটা ফিরে আসে, কয়েকটি লুপ্ত হয় চিরকালের জন্যে। ওসমান প্রায় সবসময় এসব গুনগুন করে, কখনো কথা বাদ দিয়ে এমনি সব ভাজে, কখনো বেশ দরাজ গলায় আবৃত্তি করে, মাঝে মাঝে বিকট স্বরে চাচায়। তবে চ্যাচানোটা কম, বিড়বিড় করে বলতেই সে ভালোবাসে। শুনতে শুনতে আনোয়ারের একরকম মুখস্থ হয়ে গেলো, এমনকি নিজেও সে ছড়াটির কোনো লাইন গুনগুন করছে। শওকত ভাই ১দিন এসব শুনে কাগজে লিখে রাখতে বললে, সাইকিয়াট্রিস্টকে দাখালে ওসমানের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।
আজ বিকালবেলা ১টা ১ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর থেকে ওসমান একটু শান্ত। এমনকি রাত্রে মাছে ঝোল দিয়ে ভাত খেতে বসে খিজিরকে খাওয়াবার জন্য ভাতের লোকমা শূন্যে ছুড়লো না, বরং নিজেই চেটেপুটে খেয়ে হাত না ধুয়েই চুপচাপ বসে রইলো। আনোয়ার হাত ধুতে বললে সে স্বরচিত ছড়া খুব মিহিদুরে আবৃত্তি করতে লাগলো।
ওসমানের নিস্তেজ চেহারা দেখে আনোয়ার তার পাশে বসে, আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, ওসমান বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে? তোমার আব্বাকে টেলিগ্রাম করে দিই? টেলিগ্রাম করেনি, তবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল। ওসমানের পাসপোর্টও নাই, পাসপোর্ট পাওয়া খুব কঠিন। এর ওপর ওসমানকে পাসপোর্ট অফিসে হাজির করলে ওকে পাসপোর্ট তো দেবেই না বরং বাপ কোথায়, মা কোথায়—এসব ধরে একটা যা তা কাণ্ড করে বসবে। আনোয়ার তবু ফের জিগ্যেস করে, ওসমান বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে?
ওসমানের লালচে চোখে গাঢ় লাল প্রলেপ পড়ে, গাঢ় খয়েরি মণিজোড়া ২ ফোটা মধুর মতো তরল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মাত্র কয়েক পলকের জন্য। দেখতে দেখতে তরল মধুবিন্দু ফের জমাট বাধে এবং চোখের গাঢ় লাল রঙ হয় লালচে। জমাটবাঁধা মণিজোড়ায় এলোমেলো দৃষ্টি পুরু সর ফেলে। ওর চোখের এই রঙবদল দেখে আনোয়ারের মায়া হয়। ওসমান উঠে এবার শুয়ে পড়ো, কেমন?
কেন? বাড়ি যেতে বললেন যে? ওসমান উঠে দাঁড়ায়, জানলা দিয়ে উকি দেয় ছাদে, ছাদের শূন্যতার উদ্দেশে বলে, খিজির, একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।
কোথায় যাবে ওসমান? আনোয়ারকেও উঠে দাঁড়াতে হয়, এখন ঘুমাও।
খিজির আমি রেডি। বলে ওসমান মিষ্টি হেসে মাথা নোয়ায় আনোয়ারের দিকে, আচ্ছা আসি। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে সে অনুরোধ করে, ছিটকিনিটা খুলে দিন।
ওসমানের অবধারিত বিস্ফোরণ ঠেকাবার জন্য আনোয়ার চট করে ঐ দরজার কাছে চলে যায় এবং ওসমানের প্রতি তার ব্যবহার বদলাতে বাধ্য হয়, ওসমান, গোলমাল করো না, বিছানায় শুয়ে পড়ো।
এই ধমকেই ওসমান এই লোকটার ওপর তার স্বল্পস্থায়ী আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে এবং খিজির, একটু দাঁড়াও বলতে বলতে তার এটো হাতে ছিটকিনি খোলার উদ্যোগ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের ডান হাত চলে যায় দরজার ছিটকিনিতে। বা হাত দিয়ে ওসমান আনোয়ারের ডান হাতের ওপর খুব জোরে ঘুষি মারে, এতোটাই জোরে যে তার বেগে আনোয়ারের হাতটা নিচে নেমে আসে। এই সুযোগে ওসমান ছিটকিনি খুলে ফেলে। কিন্তু আনোয়ার তার সমস্ত শরীর দিয়ে আটকে রেখেছে গোটা দরজা, তাই দরজা খুলতে পারে না। ওসমান তখন চিৎকার করে খিজিরের সাহায্য চায়, খিজির আরে এসো না, আমাকে দরজা খুলতে দিচ্ছে না তো!’ ওসমান তার ২হাত দিয়ে আনোয়ারের ডান হাত চেপে ধরেছে, তার বা হাতটা পড়েছে একটু বেকায়দায়, সেটা কোনো কাজে লাগনো যাচ্ছে না। আনোয়ার ভয় পায়, ওসমানের হাতে যে প্রবল বল টের পাওয়া যাচ্ছে তা কিন্তু অস্বাভাবিক। রাত্রি বাজে ১০টা, বাইরে কারফ্যু, এই অন্ধকারে অপঘাতে মৃত খিজির কি ওসমানের ওপর সাঙ্ঘাতিক ভাবে ভর করলো? ১ জন মৃত ও ১ জন জীবিত মানুষের সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে সে পারবে কেন? ভয়ে আনোয়ারের গলা শুকিয়ে আসে, আজ রাত্রে এদের সঙ্গে আবার কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। জীবিত মানুষের গলা শোনাবার জন্যে নিজেই চিৎকার করে ওঠে, ওসমান, তুমি এ কি শুরু করলে? সরে যাও, এখান থেকে সরো!
জানলা দিয়ে ঢুকতে পারবে না? দাঁড়াও, ছাদের দরজা খুলে দিচ্ছি। খিজিরকে এই নির্দেশ দিয়ে ওসমান তাকে ঘরে ঢোকবার জন্য ছাদের দিককার দরজা খোলার উদ্দেশ্যে এদিকের দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার ওর ২টো হাতই ধরে ফেলে। তার হাতগুলো আনোয়ারের জোড়হাতের ভেতর নড়াচড়া করে। টানতে টানতে আনোয়ার তাকে বিছানার দিকে নেওয়ার চেষ্টা করে। টানা হ্যাঁচড়ার এই ব্যায়াম করার ফলে ব্যায়ামের নিয়ম অনুসারে আনোয়ারের শরীরে বল ফিরে আসে। তবে ওসমানের সঙ্গে পারা অতো সোজা নয়। ১ ধাক্কায় আনোয়ারকে সে প্রায় ঠেলে ফেলেই দিয়েছিলো। তবে এই ধাক্কাটা সামলাতে গিয়ে আনোয়ারের বেশ সুবিধাও হলো। তাকেও ১টা ধাক্কা দিতে হয়, অতর্কিত ও অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কায় ওসমান ছিটকে পড়ে বিছানার ঠিক মাঝখানে। ওসমানের ওপর লাফিয়ে পড়ে ওর ২ বাহুর ওপর শক্তি প্রয়োগ করে আনোয়ার ওকে চিৎকরে শুইয়ে দিলো। ২বাহুমূলে নিজের ২হাত চেপে ধরে আনোয়ার ওয়ার্নিং দেয় ওসমান, বাড়াবাড়ি করো না। সোজা হাসপাতাল পাঠিয়ে দেবো। কতো ধানে কতো চাল এখানে বুঝতে পারে নি, না?
আপনি না বললেন আমি বাড়ি যেতে পারবো। আমাকে রিলিজ করে দেন না, বাড়ি যাই। আমি বাড়ি যাবো।
বাড়ি যাবে বললেই বাড়ি যাওয়া যায়? ওসমানকে সম্পূর্ণ কবজ করতে আনোয়ার ওর মুখ ভাংচায়, বাড়ি যাবো! বাইরে বেরুলেই বাড়ি?
‘রাস্তায় নামলেই বাড়ি যাওয়া যাবে। খিজির সব চেনে, বেরুলেই ও বাড়ি নিয়ে যাবে।’ ওসমান ফের ওঠার চেষ্টা করছে। আনোয়ারের হাতে তালুতে ওসমানের বাহুমূলের পেশীর কাপনি বেশ ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। ওসমান এবার ওর পা দিয়ে আনোয়ারকে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। বুদ্ধি করে আনোয়ার তখন লাফ দিয়ে উঠে বসে ওসমানের পেটের ওপর, আবার তার ২বাহুর ওপর থেকেও আনোয়ার হাত কিন্তু সরায়নি। তাকে একটু উপুড় হয়ে থাকতে হচ্ছে। এমনি উপুড় হয়ে রাত্রি কাটাতে হলে বিপদ। তার মুখে লাগছে ওসমানের ফোস ফোস নিশ্বাসের বাতাস, এতো গরম, যে আনোয়ারের কপাল, চিবুক ও নাকের ডগায় ঘাম জমে গেলো। আনোয়ার এখন কি করতে পারে? তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো না। কারণ ওসমান হঠাৎ করে খুব জোরে খুধু ছুড়ে দিলো আনোয়ারের মুখে। সদ্য ভাত খাওয়া মুখের লালা তার কপালে, চোখে, নাকে, ঠোঁটে, গালে ও চিবুকে। সারা গা নিখিন করে। আঠালো থুথু তার চোখের সামনে লম্বা পর্দার মতো ঝোলে। পর্দা জুড়ে বসে রাত জেগে পাড়াশোনা করে আনোয়ার। আই এ পরীক্ষার পড়া করতে হচ্ছে, আবুলের মা ঢোকে চায়ের ফ্লাস্ক হাতে। টেবিলে ফ্লাস্ক রেখে আবুলের মা বলে, ‘আম্মায় কইছে, বেশি রাইত কইরেন না, শরীল খারাপ করবো। আবুলের মায়ের ঘষা ঘষা কণ্ঠস্বরে তার ১৭ বছর বয়সের কান খসখস করে, শরীর হঠাৎ বলকাতে থাকে এবং চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়েটিকে সে জড়িযে ধরে। আবুলের মা খুব চমকে গিয়েছিলো, আরে ছাড়েন, ছাড়েন। আঃ! কি করতাছেন? ছাড়েন। তার এই আবেদন অগ্রাহ্য করে তাকে ঠেলে ঠেলে খাটের কাছে এনে এমনি করে শুইয়ে দিয়েছিলো। মেয়েমানুষ হলে কি হয়, তার বাহু ওসমানের বাহুর চেয়ে নরম নয়, বরং আরো রোগ, আরো কঠিন। কোনো ভাবে হ্যাঁচকা টানে তাকে শুইয়ে আনোয়ার তার ওপর শোবার চেষ্টা করছে, এক সময় মেয়েটি তার মুখে খুধু ছুড়ে ফেললো। তারও ছিলো এমনি সদ্য-ভাত খাওয়া মুখের আঠালো খুখু, আনোয়ার লাফিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছিলো মেঝেতে। ১০বছর আগেকার এই ঘটনায় সে এখন দারুণভাবে অপমানিত বোধ করছে। ওসমান কিন্তু থুথু ছোড়া অব্যাহত রেখেছে, মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে, শালা কর্নেলের বাচ্চা, কথা দিয়ে কথা রাখলি না। এবার কিন্তু আনোয়ার ওসমানের পেট থেকে লাফিয়ে নামলো না। বরং আরেকটু চেপে বসে ওসমানের ডান গালে প্রথমে এবং পরে বা গালে ঠাস ঠাস করে অন্তত ৭/৮টা চড় মারলো। নাকের ওপর লাগালো বেশ সলিড ওজনের ১টা ঘুষি। ওসমান এতেই নেতিয়ে পড়েছিলো, আনোয়ার তার ওপর টেবিল থেকে কড়া ডোজের ৩টে সিডেটিভ ট্যাবলেট জোর করে ঢুকিয়ে দিলো তার মুখের ভেতর ওসমান অবশ্য ট্যাবলেটগুলো খুখুর মতো ছুড়ে দিতে চাইলেও পারলো না, সেগুলো আটকে রইলো তার ঠোঁট ও দাঁতের ফাঁকে।
ওসমান নিস্তেজ হয়ে পড়লে আনোয়ার বসে থাকে তক্তপোষের ধার ঘেঁষে। ধ্বস্তাধস্তির পর তার শরীর ভেঙে পড়ছে। একটু শোবার জন্য শরীর কাঙাল হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন শোওয়া মানে ঘুম। ঘুমিয়ে পড়াটা নিরাপদ নয়। ওসমান যদি উঠে পড়ে? উঠে যদি ছাদে চলে যায়? ছাদের দিকের দরজা ভেতর থেকে তালা লাগানো। সিঁড়ির দিকের দরজায় বাইরের ১টি কড়ায় তালা ঝুলছে। আনোয়ার উঠে সেই তালা খুলে লাগালো ভেতরদিকে শিকলের সঙ্গে। সিঁড়ির নিচে রাস্তার সঙ্গে যে দরজা সেখানে তালা আছে কি-না আনোয়ারের জানা নাই। দরকারটা কি? এই ঘরের তালা ওসমান যদি খুলতে যায় তাকে সামলানো হবে তখনি।
তবে আনোয়ারের বড়ডো ঘুম পাচ্ছে। চা খেলে হতো। টেবিলে আবুলের মায়ের রেখে-যাওয়া ফ্লাস্ক খুঁজতে গিয়ে সে চমকে ওঠে, আরে সে কি আজকের ঘটনা? সে কি এখানে? –নিচে থেকে চা খেয়ে এলে হয়। কিন্তু কারফ্যুর রাতে তার জন্যে দোকান খুলে রেখেছে কে? -ওসমানের ঘুমিয়ে পড়ার নিশ্বাসে আনোয়ারের চোখ আরো চুলে চুলে আসে। ওসমানের পাশে সরু জায়গাটায় শুতে শুতে ভাবে একটু গড়িয়ে নিলে ফ্রেশ লাগবে, রাত জাগতে তখন কষ্ট হবে না। কিন্তু এখন ক্লান্তি তো একটুও কাটে না, মনে হয় লম্বা রাস্তা ধরে সে হাঁটছে। এটা কোন রাস্তা?–তাই বলো! চন্দনদহ বাজার থেকে সে হেটে চলেছে নিজেদের গ্রামে। গাবতলায় গোরুর গাড়ির চাকায় ক্ষয়-হওয়া জায়গায় আনোয়ার হোচট খায়। এর ফলে সে চমকে ওঠে। কিন্তু ঘুম ভাঙে না, তন্দ্রার পাতলা একটি পরতে ভেসে উঠেই ডুবে যায় ঘুমের অনেক ভেতরে।