গাবগাছতলায় পৌঁছবার আগে ঢেকুর উঠলে মুরগির কোর্মার স্বাদ বোঝা যায়। ভোরবেলা উঠে বড়োচাচী এর মধ্যে এতো আয়োজন করেছে। বড়োচাচী বাড়ি ফিরেছে পরশু সকালে, ২টো দিন গেছে বাড়ি ঝাড়পোছ করতে। আর আজ সকাল ৯টার বাসে আনোয়ার চলে যাবে শুনে সূর্য ওঠার আগে থেকেই রান্নাবান্নার প্রস্ততি নিতে শুরু করেছে। অতো সকালে আনোয়ার ভাত খেতে পারে না বলে এক গাদা পরোটা ভাজে, রাত্রে জ্বাল-দেওয়া মুরগির কোর্মা রাধে, এর ওপর ডিম ভাজা। চাচী নিজে বসে থেকে পাতে ১টা ১টা পদ তুলে দেয় আর বলে, ‘আবার কোনদিন আসো ঠিক আছে? খাও বাবা।
আমি তো বিশ পঁচিশ দিনের মধ্যে আবার আসছি চাটী!
আনোয়ারের এই কথায় আমল না দিয়ে বড়োচাচী তার প্লেটে তরকারি ঢালে, বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার বাপ বছরে দুই বছরে তাও এক আধবার আসছে। ঐ বারান্দার উপরে বস্যা রোদ পোয়াছে আর কছে, ভাবী, পাটিসাপটা করল্যা না? আবার চরের মধ্যে থাকা পাখি ম্যারা নিয়ো আসছে, ভাবী ভালো করা রোস্ট করে তো! —দেখতে দেখতে কতোদিন হয়া গেলো!’ ঐ বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বড়োচাচা চুপচাপ উঠান দ্যাখে।
এর মধ্যে এসে পড়ে জালালউদ্দিন, তাড়াতাড়ি করো। বাসের টাইম হলো।
সেই থেকে জালালউদ্দিন বকবক করেই চলেছে। আনোয়ার বগুড়া নেমেই যেন তার মামার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে। ইয়াসিন সাহেবের এখন ঘন ঘন এলাকায় আসা উচিত। ফিল্ড এখন ভালো, এইসময় এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার।
গাবগাছতলায় পৌঁছবার পর জালালউদ্দিন চুপ করে। কি হলো? কোর্মার ঢেকুরের গন্ধ চাপা পড়ে মৃতদেহের আবছা গন্ধে। গাবতলায় জবুথবু হয়ে বসে রয়েছে নাদু পরামাণিক। জালাল মাস্টার আস্তে আস্তে বলে, আহা! প্রত্যেক দিন এই জায়গায় অ্যাসা বস্যা থাকে। বার্ধক্যে পুত্রবিয়োগ!
‘ঢাকাত যাও?’ নাদু পরামাণিক উঠে দাঁড়ায়।
হ্যাঁ। এখন বাসে যাবো বগুরা। কাল সকালে ঢাকার ট্রেন ধরবো। আনোয়ার কৈফিয়ৎ দেয়, আমার এক বন্ধুর খুব অসুখ। একটু সেরে উঠলেই আমি ফিরবো।
নাদু ওদের সঙ্গে হাঁটে। ১টা ময়লা চাদরে তার গা জড়ানো। একটু একটু বাতাসে রোগা শরীর কাপে। তার দাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় মুখের অভিব্যক্তি সংগঠিত হতে পারে না। আনোয়ার তাই বারবার দেখেও নাদুর চোখেমুখে শোক কি হতাশা সনাক্ত করতে পারে না।
চন্দনদহ বাজারের শুরুতে খয়বার গাজীর ধানকলের টিনের ছাদ সকালবেলার রোদে ঝকঝক করে। আজ হটবার নয়, তবু এদিক ওদিক লোকজন দেখে জালালউদ্দিন অবাক হয়, এতো মানুষ?
ধানকলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আফসার গাজী। তার সঙ্গে শহর থেকে আসা কয়েকজন ছাত্রকর্মী। আফসার এগিয়ে আসে আনোয়ারের দিকে, নাদুকে জানায়, কি গো, পরশুদিন বড়ো মিটিং হলো বাজারের মধ্যে, তোমার ব্যাটার নাম করা প্রস্তাব পাস করলাম। তুমি আসলা না? তারপর সে তাকায় জালালউদিনের দিকে, আপনেও তো ভাষণ দিলেন। নাদুক কন নাই?
জালালউদ্দিন অপরাধীর মতো হাসে।
মাস্টার মানুষ বারো বছর মাস্টারি করলে কি জানি হয়?’ জালালউদ্দিনকে ঠাট্টা করার পর আফসার গাজী আফসোস করে চেংটুকে নিয়ে, চ্যাংড়া মানুষ। মাথা গরম করা কোপ মারলো বৈরাগীর ভিটাত। আগুনের জীব বাপু কোরান হাদিসে কি মিছা কথা কইছে? জিনের গাওত হাত পড়ছে। নাদুকে সে সান্তনা দেয়, মন খারাপ করা কি করব্যা? জুম্মার ঘরত ভালো করা শিরনি দিও। ট্যাকাপয়সা না হয় কিছু নিও।’
চেন্টুর মৃত্যুর পেছনে জিনের সক্রিয় ভূমিকা সম্বন্ধে জালালউদ্দিনও নিশ্চিত, মসজিদে শিরনি দেওয়ার জন্যে সে নিজেও কিছু চাঁদা দেওয়ার প্রস্তাব করে।
আফসার গাজীর প্রভাবে আনোয়ারের জায়গা হলো বাসে ড্রাইভারের সিটের পাশেই, বাসের ভেতরটা প্রায় ভরে গেছে, তবে বাস ছাড়তে এখনো অনেক দেরি, ছাদের ওপর লোক এখনো ওঠেনি। আনোয়ারের কাছে বিদায় নিয়ে আফসার গাজী একটু দূরে দাঁড়িয়ে জালালউদিনের সঙ্গে গল্প করে।
বাবা নাদু এগিয়ে আসে আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার বাসে উঠতে গিয়েও ওঠে না, সেও একটু এগিয়ে যায় নাদুর কাছে।
বাবা’ নাদু দুই সিলেবলের শব্দের পুনরাবৃত্তি করে। তার ডান হাত হঠাৎ খুব কাপে। সেই হাত তার নোংরা চাদরের ভেতর ঢুকে পড়লে আনোয়ার ভয় পায় এবং সতর্ক হয়ে একটু সরে দাঁড়ায়। নাদুর হাত দিয়ে বের হয়ে আসে কালচে ন্যাকড়া জড়ানো পুটলি। নাদুর মুঠি এমন কাপছিলো যে আনোয়ার হাত বাড়িয়ে জিনিসটা না ধরলে ওটা পড়েই যেতো। পুটলি হাতে নিয়ে আনোয়ার জিগ্যেস করে, কি?
নাদু কাচুমাচু মুখ করে তার দিকে তাকায়, চেংটুর মা বেনবেলা করছে। খায়ো বাবা!
কি?
নাদুর চোখ এবার নিচের দিকে। অপরাধী স্ত্রীর পক্ষ থেকে সে কৈফিয়ৎ দিচ্ছে, চেংটুর মাও কয়টা পিঠা করছিলো। তোমাক খাবার দিচ্ছে!’
আনোয়ারের নাকমুখ হঠাৎ নোনা পানিতে বন্ধ হবার উপক্রম হয়। কালচে নোংরা ন্যাকড়া কিংবা তার ভেতরকার পিঠার গন্ধ কিছুই পাওয়া যায় না। তার নীরবতায় ঘাবড়ে গিয়ে নাদু উসখুস করে, আপন মনে প্রলাপ বকে, চেংটু এই পিঠা খুব পছন্দ করছে। হারামজাদা মাথাগরম আছিলো তো দাখো নাই কোটে কোটে ঘুরছে একদিন বাড়িতে যায়া কয়, ও মা, আলো-চাল কোটো তো! ভাপা পিঠা করো, আনোয়ার ভায়েক পিঠা খাওয়ামু-চেংটুর মা, বুঝলা না?–মেয়ামানুষ, মনমেজাজ ভালো থাকে না। অভাবের সংসার বাপু, ঘরত ভাতের চাউলেরই অনটন, পিঠা আর বানাবার পারে না। হারামজাদা অর মায়ের কাছে খালি তোমার গপ্পো করছে বাবা! তুমি আজ ঢাকাত যাবা শুন্যা ফজরের আগে আত থাকতে উঠছে, পিঠা বানায় আর কাব্দে মেয়ামানুষ তো খালি কাব্দে। মেয়েমানুষের স্বভাবের বিবরণ দিতে গিয়ে নাদু পরামাণিকের গলা ধরে আসে খায়ো বাবা মটোরের মদ্যে অনেকক্ষণ থাকবা, খিদা নাগবো। খায়ে।’ নাদুর কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে, মনে হয় বোবা যেন কথা বলার চেষ্টা করছে।
স্টার্ট দেওয়ার পরও বাস নড়ে না। নাদু এবার হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে বিশাল ডুমুর গাছের নিচে। তার পেছনে মতিলাল আগরওয়ালার পাটের গুড়ামের সামনে থেকে জালালউদ্দিন ও আফসার গাজী এগিয়ে এসে আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। নাদুর বসে-পড়া শরীর দেখে আনোয়ার ভয় পায়, লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাটতে পারবে তো? বাস চলতে থাকে ছেচড়াতে ছেচড়াতে। কাচা রাস্তায় স্পিড দেওয়া সম্ভব নয়। তবু দেখতে দেখতে নাদু পরামাণিক ও জালালউদ্দিন ও আফসার গাজী ও চন্দনদহ বাজার আড়ালে পড়ে যায়।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৫
তক্তপোষে খিজিরের প্লায়ার ও স্ক্রু-ড্রাইভার। ২টোর ছোঁয়া বাঁচিয়ে শুয়ে পড়লে জুম্মনের মায়ের গা শিরশির করে। বড়ো শীত করে, স্যাঁতসেঁতে শীত; ঠাণ্ডা লোহার টুকরা যেন এগিয়ে আসছে তার তলপেটের দিকে। সারা শরীর কাপে, কিন্তু যন্ত্রগুলো ঠেলে ফেলে দেওয়ার মতো বল সে হারিয়ে ফেলেছে।–নাঃ! মহাজনের বাড়ি কাজে যাওয়াটা আজ ঠিক হয়নি। কিন্তু সিতারার পান-চিনি, আজ না গিয়ে পারে? আর শনিবারের ঘটনা, আজ ৫/৬ দিন হতে চললো, শরীর তবু সেরে ওঠে না কেন?
শনিবার কি? হ্যাঁ, শনিবারেই তো!-ঠাণ্ডায়, দুর্বলতায় এবং প্লাস ও ক্ষু-ড্রাইভারের ধাতব হাজিরায় জুম্মনের মায়ের মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে পড়ে, দিন তারিখ সব গুলিয়ে যায়। তাহলে কামরুদিন এসেছিলো কবে? এসে খুব শাসিয়ে গেলো, তুই তাইলে থাক! তুই প্যাট খসাইবি না, তে আমার কি গরজ পড়ছে ঐ জাউরাটারে লইয়া তরে ঘরে তুলুম? কিন্তু জুম্মনের মা কি করতে পারে? ঐ রাতে, হ্যাঁ শুক্রবার রাতে এসেছিলো খিজির। ঠিক এই তক্তপোষে বসে তার তলপেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। সেই সাড়াশি-মার্ক আঙুলগুলোর চাপে জুম্মনের মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। চিটচিটে অন্ধকারে মরা মানুষটাকে স্বপ্নে দাখার ফলে ভয়ে পেটের ব্যথা ঠিক ততোটা ঠাহর করতে পারেনি। টের পেলে দুপুরবেলা, মহাজনের বাড়িতে বাসন মাজতে মাজতে, উরুসন্ধিতে ভিজে ভিজে ঠেকেছিলো। বিবিসায়েবকে বলে তাড়াতাড়ি চলে আসে বস্তিতে। তক্তপোষে শুতে না শুতে মনে হয় পেটের বাসিন্দা আগুন হয়ে জ্বলে উঠছে। তাহলে রাত্রিবেলা হাড্ডি খিজির কি হাতের ঘষায় ঘষায় আগুন জ্বলিয়ে দিয়ে গেলো? জুম্মনের মা কি নাপাক হয়ে ঘোরাঘুরি করেছে? রাত্রে একা ঘরে ফেরার সময় নন্দলাল দত্ত লেনের গলা-কাটা মাহাক্কাল কি তার দিকে নজর দিলো?-এতোসব ভাবনার সুযোগ পাওয়া যায় না। প্রবল যন্ত্রণার মধ্যে জুম্মনের মা টের পায় যে ওসব কিছু না, হাড্ডি চোদাই মইরা অহন তার গুড়াটারে চেতাইয়া দিছে! —যে মানুষ এখন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেনি, তার মস্তানিটা দ্যাখো আগুনের পা দিয়ে জুম্মনের মায়ের পেটে সে অবিরাম লাথি মারতে শুরু করলে আর সহ্য হয় না। বজলুর বৌ ভাগ্যিস সেই সময় বস্তিতেই ছিলো, জুম্মনের মায়ের গোঙানি শুনে সে-ই সব ব্যবস্থা করে। সব কথা জুম্মনের মা খেয়াল করতে পারে না। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসার মুহুর্তে সে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছিলো, মনে হলো খিজিরের লম্বা শরীর গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। খিজিরকে ধরার জন্যে সে কি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো? ১বার মনে হলো রক্তাক্ত শরীর নিয়ে খিজির বোধহয় উঠে চেপে বসেছে তার তলপেটের ওপর। খিজিরের রক্তে তার কোমরের নিচে থেকে উরু, হাঁটু, পা—সব ভিজে যাচ্ছে। গাঢ় লাল রক্ত ফোয়ারার মতো উঠছে জুম্মনের মায়ের শরীর থেকে, সমস্ত ঘর কালচে লাল রঙে অন্ধকার হলো। তারপর আর কিছু দ্যাখা যায়নি। বজলুর বৌ এবং আরো কয়েকটি মেয়েলি গলার স্বর ভেসে আসে অনেক দূর থেকে। সেইসব কথা দেখতে দেখতে ঝাপশা ধ্বনি হয়ে উড়াল দেয় গলির ভেতর, গলি দিয়ে হারিয়ে যায় বড়ো রাস্তায়। এদিকে তার নিঃশব্দ ও অন্ধকার শরীর থেকে তরল আগুন বেরিয়ে যাচ্ছে, এতো আগুন বেরোবার জন্যে উরুসন্ধির পথ তার বড়ডো সরু, গতর পুড়ে যায়, গতর ছিঁড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর গনগনে জ্বলন্ত কয়লার তাল বেরিয়ে যাওয়ার স্পর্শ টের পায় এবং আগুনের শিখা তখন মাথা নোয়ায়। তারপর সব অন্ধকার। ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরলে মনে হয়েছিলো সারা জীবনে সে আর উঠতে পারবে না।
কিন্তু তারিয়ে তারিয়ে কতোদিন কষ্ট পাবে জুম্মনের মা মহাজনের বাড়িতে উৎসব, বস্তির ঘরে শুয়ে বসে থাকা কি তার পোষায়? আবার ঐ বাড়িতে গেলে কাজকাম না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাও যন্ত্রণা। আজ বিকাল হতে বিবিসায়েব নিজেই তাকে ছুটি দিলো। জুম্মনের মা কি এসব বোঝে না? কাজে কামে যতোই সচল হোক, শুভ-অনুষ্ঠানে অপয়া মেয়েমানুষ ঘরে থাকলেই কুফা। তা সে না হয় একটু দূরে বসে বসে দেখতো, তাতে সিতারার জীবনটা কি নষ্ট হয়ে যেতো? কতো লোক আজ মহাজনের বাড়িতে বজলুর বৌ পর্যন্ত নিজের মহাজনের বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে ঐ বাড়িতে ১বার এটা বাটে, ১বার ওটা এগিয়ে দেয়। আবার জুম্মনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বিবিসায়েবের সঙ্গে কিসব ফুসুরফাসুর করে আল্লাই জানে। মাগী সেদিন এতো যত্ন-আত্তি করলো, ৫/৬ দিন যেতে না যেতে তার বিবিসায়েবের কাছে গিয়ে তার নামে কিসব গিবত করে!-জুম্মনের মায়ের মনে হয়, এই বজলুর বৌ-ই শয়তানি করে তার বাচ্চা নষ্ট করলো না তো? মাসখানেক হলো শাহ সায়েবের বাড়িতে মাগী ঠিক কাজ করে, কামরুদিনের টাকা খেয়ে শাহ সায়েবের দোয়া-পড়া তাৰিজ হয়তো পুঁতে রেখেছে জুম্মনের মায়ের ঘরের সামনে। একবার উঠে দেখবে?-নাঃ দাঁড়াবার মতো বল নাই বলে মাটি খুঁড়ে তাবিজ খোজার কাজ স্থগিত রাখে -এখন তাকে বিয়ে করতে কামরুদিনের তো কোনো অসুবিধা হবে না। বিয়ের দিনই সে জিগ্যেস করবে, জুম্মনের বাপ, ঈমানে কওতো, আমার প্যাট খসাইবার লাইগা বজলুর বৌরে দিয়া তুমি আমার ঘরের বগলে তাবিজ পোতাইয়া রাখছিলা না?
কিন্তু রাগ বা সংকল্প-তার মাথায় কিছুই দানা বাধে না। সব ছাপিয়ে ওঠে খিজিরের প্লায়ার ও ক্ষু-ড্রাইভার। শেষ বিকালবেলা দেখতে দেখতে গর্তে গড়ায়, বস্তির পাশের নর্দমা থেকে উঠে আসে সন্ধ্যাবেলা,-ভাপসা ঘিনঘিনে অন্ধকার। জুম্মনের মায়ের শরীরের রুগ্ন হিম তাকে এতোটুকু ঝকঝকে করতে পারে না। সেই অন্ধকার বরং তক্তপোষের ওপরকার প্লায়ার ও ভূ-ভ্ৰাইভারের দীর্ঘদিন ব্যবহারজনিত মসৃণতা মুছে ফেলে এবং আদিম কালের কোনো লোহার আস্ত্রের মতো সেগুলো হয়ে ওঠে খসখসে। খিজির কি ২ হাতে ২টে ধরে তার দিকে এগিয়ে আসবে? এগুলো নেওয়ার জন্যেই কি মৃত্যুর পরও আসাযাওয়া অব্যাহত রেখেছে? এসব দিয়ে তার তলপেটে সরাসরি খোঁচা দিয়ে জিগ্যেস করতে পারে, ফালাইয়া দিছস? ওস্তগররে দিয়া মারাইবার লালচে পোলাটারে দুনিয়াটা দ্যাখবার দিলি না?–তার কথা স্পষ্ট নয়, গুলিবিদ্ধ শরীর থেকে আসা ঘড়ঘড় নিশ্বাসে ঘরের অন্ধকার আরো পাকে। হঠাৎ শোনা গেলো, বত্তি জ্বালাও নাই?-হোক মরা মানুষের গলা, স্পষ্ট বাক্য শুনে জন্মনের মা বুকে বল পায়। এই ছোট্রো শক্তির সাহায্যে সে আরো শোনে, তোমার বলে কঠিন বিমারী ? কি হইছে মা?
জুম্মনের উপস্থিতি টের পেয়ে জুম্মনের মা জোরে জোরে নিশ্বাসে ফেলে। এই নিশ্বাস একটু নোনা বলে তার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। মনে পড়ে বেশ কয়েকদিন আগে এইসব যন্ত্রপাতি নিয়ে জুম্মন কোথায় চলে গিয়েছিলো। ৭/৮ দিন তার পাত্তা নাই। এখন বিকালবেলা ঘরে এসে তক্তপোষের ওপর যন্ত্রগুলো দেখেই তো তার বোঝা উচিত ছিলো যে জুম্মন ফিরে এসেছে। বুঝতে পারলো না কেন?
জুম্মন কুপি জ্বালালে কালচে লাল আলোয় ছেলের মুখ দেখে জুম্মনের মা জড়সড় হয়ে বসে। হয়তো এই ভাবটা সামলাবার জন্য ছেলেকে সে ধমকায়, ঐগুলি লইয়াকৈ গেছিলি হারামজাদা? চুরি কইরা ভাগছিলি কৈ?
চুরি করুম ক্যালায়? আমারে দিয়া গেছে।
তর বাপের সামান? ক্যাঠায় দিছে?
খিজিরে। একটা চেন ভি দিয়া গেছে। দেখবা? কি সোন্দর!
পিচ্চি পোলাটার মুখে বয়স্ক মানুষের নাম উচ্চারণ জুম্মনের মায়ের কানে খরখর করে। কি কম? বলতে বলতে জুম্মনের মা তার উদ্যত হাত গুটিয়ে নেয়। নাঃ পোলার দোষ কি? খিজিরকে কিছু বলে ডাকতে সে তো ছেলেকে কখনো শেখায়নি। একবার ইচ্ছা হয় যে বলে, তারে তুই চাচামিয়া কইবাব পারস না? এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে খিজিরের স্থায়ী অনুপস্থিতি বড়ো প্রকট হয়ে ওঠে। লোকটার জন্যে একটু কাদার লোভে জুম্মনের মায়ের গলা, জিভ ও ঠোঁট আকুপাকু করে। মায়ের এইসব লোভলালসা সম্পর্কে উদাসীন জুম্মন ঘোষণা করে, আঞ্চায় না আবার বিয়া করতাছে। মাকে তরু অন্যমনস্ক দেখে জুম্মন গলা চড়ায়, আব্বায় বিয়া করতাছে। ফুফু আমারে কইছে। কয় মাইয়া খুব সোন্দর। তোমার লাহান কালা পাতিলার তলা না। মাইয়ার বাপে মতিঝিলের কোন বিলাতি অফিসের পিয়ন। আব্বারে চাকরি দিবো। আব্বায় ওস্তাগরি ছাইড়া দিবো। ঐ অফিসের সায়েবে আব্বারে থাকনের জায়গা ভি দিবো। ধানমণ্ডির মইদ্যে থাকে।
আমি ধানমণ্ডি উনমণ্ডি যাইবার পারুম না! জুম্মনের মায়ের মুখ থেকে এই কথা বেরিয়ে পড়লে খিজির খিলখিল করে হাসে, তোমারে লইলে তো? আব্বায় থাকবো নয়া বৌ লইয়া। আমি আব্বার লগে থাকুম না!
জুম্মনের মা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। জুম্মন বুঝতে পারে না, কামরুদিনের জন্যে ওর মায়ের এতোটা টান কেন? যে লোকের ঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে এসেছে কতোদিন আগে, যে এখন তার কেউ নয়, তার ৩ নম্বর বিয়ের খবরে মা এতোটা ভেঙে পড়বে জানলে খবরটা না হয় সে চেপেই যেতো।
রাত বাড়ে। মায়ের কান্না আর থামে না। এদিকে জুম্মনের খিদে পেয়েছে। মহাজনের বাড়ি থেকে মায়ের নিয়ে আসা মিষ্টি ও ফিরনির সবটাই মেরে দিয়ে শুয়ে শুয়ে সে হাই তোলে। মায়ের কান্নার বিরতি নাই। কাঁদতে কাঁদতে জুম্মনের মা বলে, তুই থাকবি আমার লগে।
না। আমারে লগে থাকতে কইছে ওসমান সাবে। ওসমানের সঙ্গে থাকবার সংকল্প জানাতে জানাতে জুম্মনের চোখ থেকে ঘুম চলে যায়। এই মহাজন বলো আর আলাউদ্দিন মিয়া বলো,-এদের দেখলেই ভয় লাগে। খিজিরকে এরা ঘর থেকে বার করে দেয়নি? ওসমান সায়েবের ঘরেই খিজির এখনো রোজ আসে, ওসমান সায়েব তার সঙ্গে কতো কথাবার্তা বলে। খিজিরের ক্রু-ড্রাইভার আর প্লায়ার আর সাইকেলের চেনটা নিয়ে জুম্মন রেখে দেবে ওসমান সায়েবের ঘরে। খিজির তাহলে ঐসব রোজ দেখতে পাৰে।
আরে, ঐ সাবের না মাথা খারাপ হইছে! উই কি কয় না কয়- জুম্মনের মা ছেলেকে ধমক দেয় বটে, কিন্তু তার গা ছমছম করে। জুম্মন ঘুমিয়ে পড়লে তার ভয় আরো বাড়ে। জুম্মনের মুখ বড়ো শান্ত ও নিশ্চিন্ত। এই মুখে কার ছায়া? জুম্মনের জন্মের আগে খিজিরের সঙ্গে জুম্মনের মায়ের তো দাখাই হয়নি। তবে?-ঘুমের মধ্যে এরকম একটানা নিশ্বাস নিতে শুনেছে সে কোথায়? জুম্মনের নিশ্বাসে ভর করে খিজির আলি কি তাকে শাসন করতে এসেছে? অপঘাতে মরলে মানুষের কতো কষ্ট হয়—কাল পরশু বিবি সায়েবের কাছে কিছু টাকা চেয়ে নিয়ে শাহ সায়েবের মসজিদে শিরনি পাঠিয়ে দেবে। জুম্মনের একটানা নিশ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে শুনতে জুম্মমের মায়ের চোখে নতুন পানির ঢল নামে। একটু ফোপাবার পর গলা খুলে কাঁদতে শুরু করে। কামরুদিনের নতুন বিয়ে করার খবর খিজিরের জন্যে এভাবে হামলে কাদবার পথ খুলে দিয়েছে। কান্নায় এতোটুকু বিরতি না দিয়ে জুম্মনের মা ছেলেকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৬
দেওয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় শুয়ে ছিলো ওসমান সায়েব। ঘরে আরো ৩জন। এদের সবাইকে জুম্মন চেনে। আনোয়ার সায়েবকে আগে দাখেনি, কয়েকদিন থেকে দেখছে, রোজই আসে, রাত্রে মাঝে মাঝে এখানেই থাকে। আলতাফ সায়েব প্রায়ই দ্যাখা যায় আলাউদ্দিন মিয়ার ওখানে। চুরুটওয়ালা সায়েবের নাম না জানলেও জুম্মন একে চেনে, এই সায়েব ইংরেজি কথা বেশি বলে, তার অর্ধেক কথা বোঝা যায় না। তা কোন ভদরলোকটা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে? ওসমান সায়েবের কথা বার্তা নিয়ে সবাই যে হাসাহসি করে কেন জুম্মন বুঝতে পারে না। পাগল বলো আর মাথা-খারাপ বলো,–এই সায়েবের কথাবার্তা বরং জুম্মনের মাথায় ঢোকে, স্পষ্ট বোঝা যায় যে খিজিরের সঙ্গে বাইরে বেরোবার জন্য লোকটা উদগ্রীব। তা এই ১ ঘরের ভেতর কাহাতক বন্দি থাকা যায়?
তাকে দেখে ওসমান উঠে বসে, রাত্রে কোথায় ছিলি?
চুরুট-সায়েব বলে, আমাদের একটু চা খাওয়াতে পারবি?
চায়ের কেতলি নিয়ে জুম্মন তার হাতের ক্রু-ড্রাইভার ও প্লায়ার তক্তপোষের নিচে রেখে দেওয়ার জন্য উপুড় হতেই ওসমানের চোখজোড়া সেদিকে হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো। চোখের লাল-খয়েরি রেখাগুলো কাপে, সে তাকায় ওপরের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট জোরে চিৎকার করে, সরো! টেবিলের ওপর ওভাবে ঝুলছে কেন? সরে যাও!
গ্লাসে গরম পানিতে চামচ দিয়ে ওভালটিন ঢালছিলো আনোয়ার, চমকে উঠে গ্লাস সরিয়ে ফেললো। ঠোঁট থেকে চুরুট নামিয়ে শওকত হাসে, কি ব্যাপার? আপনিও এফেক্টেড হলেন?
লজ্জা পেয়ে আনোয়ার মনোযোগ দিয়ে গ্লাসের ভেতর চামচ নাড়ে। ওসমান তখন বন্ধুদের কাছে প্রকৃত ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, বুঝলে না? জুম্মনের হাতে ওর ফেভারিট টুলস দেখে খিজির এসে পড়েছে। এতো লোক দেখে বোধহয় আড়ালে চলে গেলো।
চুপ করে ঘুমান শওকতের ধমকে ওসমান সুবোধ বালকের মতো দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে। জুম্মনের চোখজোড়া এখন ঐদিকে। খিজিরের ঝুলন্ত আবির্ভাবটি দ্যাখার জন্যে এ কয়েকদিন ধরে সে অনেক চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছা, -খিজিরকে দ্যাখামাত্র তার হাতে প্লাস ও কু-ড্রাইভার গুঁজে দেয়। আহা, এই ২টো পেলে মরার পর বেচারার রুহু শান্তি পায়। কিন্তু এই সায়েবদের হাউকাউ শুনে খিজির নিশ্চয়ই অনেকক্ষণের জন্য গায়েব হয়ে গেলো। জুম্মনের মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। এর ওপর চুরুট-সায়েব বলে, তোকে দেখলেই তোর বাবা এসে পড়ে।’
বাবা না, সৎ বাবা। আলতাফের এই সংশোধনী অগ্রাহ্য করে শওকত জানতে চায়, ‘এনিওয়ে, ডাক্তার কি বলছে?
চায়ের কেতলি হাতে জুম্মন বেরিয়ে যাচ্ছিলো, শওকত ডাকলো, তোর এই সব যন্ত্রপাতি নিয়ে যা। এইসব দেখলে ওসমানের তোর বাপের কথা মনে পড়ে, বুঝলি না?
কেতলি ও ঐসব নিয়ে জুম্মন বেরিয়ে গেলে আলতাফ বলে, ‘হ্যাঁ আনোয়ার, তারপর?
ওসমান যাতে শুনতে না পায় আনোয়ার তাই গলাটা নিচে নামায়, ডাক্তার বলে এক ধরনের শিজোফ্রেনিয়া। প্যারানয়েড শিজোফ্রেনিয়া।
শওকত বাধা দেয়, আজকাল মাথার গোলমাল হলেই সাইকিয়াট্রিস্টদের ডায়াগনসিস হলো শিজোফ্রেনিয়া। সামথিং লাইক এ্যাঁলার্জি ইন ফিজিক্যাল ডিজঅর্ডার। সবাই হেসে ফেললে ওসমান উঠে বসে এবং খুশি খুশি চোখ করে ওদের হাসি সম্পূর্ণ অনুমোদন করে। আনোয়ারের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে ওভালটিন খেয়ে ফের শুয়ে পড়ে। শওকত তখন মনোযোগী হয় আনোয়ারের দিকে, ডাক্তার কি এ্যাডভাইস দিলো?
তিনটে ওষুধ দিয়েছে। সিডেটিভ তো চলবেই, স্টেমিটিল টুয়েন্টি ফাইভও কন্টিনিউ করতে হবে। আর একটা ওষুধ কয়েকদিন খাওয়ার পরে ফের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তবে প্রধান চিকিৎসা হলো সঙ্গ দেওয়া।
সঙ্গ দেবে কারা? খুব নিজেদের লোক? হা, ঘনিষ্ট। মানে যাদের সঙ্গ, আই মিন-যারা— এগিয়েবল টু হিম। শওকত বলে, একা হলেই আনডিজায়রেবল এলিমেন্টস স্টার্ট হস্টিং হিম।
আলতাফ বলে, এখানে নিজেদের লোক মানে তে আমরাই। ইন্ডিয়া থেকে ওর বাবাকে কি নিয়ে আসা সম্ভব? আমাদেরই এ্যাঁটেন্ড করতে হবে।’
আনোয়ার তো এটা ভালো করেই জানে। গতকাল ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পর আনোয়ার ওকে নিয়ে গিয়েছিলো ওয়ারিতে, ওদের বাড়িতে। বাড়ির প্রতিক্রিয়ার জন্য ও তৈরি হয়েই ছিলো। আম্মা একটু বিড়বিড় করতেই সে তার রিহার্সেল-দেওয়া বাক্য ঝাড়লো, আমার বন্ধু বিপদে পড়লে আমার বাড়িতে তাকে শেলটার দিতে পারবো না? জবাৰে আনোয়ারের মা বিপদগ্ৰস্ত মানুষের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ও তার মৃত স্বামীরউদ্যোগী ভূমিকার বিবরণ দেয়, বিপদ আপদে মানুষকে সাহায্য করবো না কেন? পঞ্চাশ সালের রায়টে এই বাড়িতে আটটা হিন্দু ফ্যামিলি পুরো একমাস ছিলো, জনিস? তোরা তখন ছোটো, কতো ঝুঁকি নিয়ে আমরা তাদের থাকতে দিয়েছিলাম।
তো এখন একটিমাত্র লোকের ব্যাপারে আপনাদের এতো আপত্তি কেন?
সুস্থ লোক হলে কথা ছিলো। একটা পাগলকে—।
একটা লোক একটু অন্যরকম হয়ে গেলেই তাকে পাগল বলে ফেলে দিতে হবে? আমাদের ছোটোচাচার মাথায় ডিফেক্ট দ্যাখা গেলে আপনারা তাকে দারুণ নেগলেক্ট করেছেন। কাজটা ভালো করেননি আম্মা।
এবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসে তুই কি যা তা বলতে শুরু করেছিস। আনোয়ারের মা কেঁদে ফেলে, জাহাঙ্গীরের জন্যে কি কম করা হয়েছে? তোর আব্বা ওর লেখাপড়ার সম্পূর্ণ ভার নেয়নি? তারপর মাথায় অসুখ হলো, একেবারে উন্মাদ মতো হয়ে গেলো তো তোর আব্বাই কতো কষ্ট করে বাড়ি নিয়ে গেলো।
চিকিৎসা করাননি কেন?
পাগলের চিকিৎসা কি তখন তেমন ছিলো?
কে বললো ছিলো না? কলকাতয় লুম্বিনী পার্ক ছিলো না? রাঁচিতে পাঠাতে পারতেন না?
আনোয়ার কাউকে পরোয়া করে না। তার ঘরে তার বন্ধু থাকনে, সে পাগল কি স্বাভাবিক সেটা দাখার অধিকার আছে একমাত্র তারই। ওসমানকে নিজের ঘরে রেখে সবাইকে একচেটি নেওয়া যাবে ভেবে আনোয়ার বরং খুশি হয়েছিলো। হুইস্কি, শিল্প-সাহিত্য ও সমাজতন্ত্রের কনিস্যার ভাইয়ার প্রতিক্রিয়াটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে দ্যাখার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো।
তোমার বাসায় রাখা তো মুশকিল। আলতাফ বলে, তোমার মা আছেন, ভাৰী আছেন-।
আরে না! কোনো প্রবলেমই হতো না। আমাদের বাড়িতে এ্যাঁবনর্মাল লোকদের সহ্য করার ট্রাডিশন আছে। ঠাট্টা করে বললেও আনোয়ারের গলায় প্রচ্ছন্ন গর্ব শিরশির করে ওঠে, আমার চাচা ফুল ফ্লেজেড পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।’
এই জেনারেশনে এসে হয়েছে তুমি। আলতাফ বললে সবাই হাসে।
শোনো, প্রবলেম তৈরি করলো ওসমান নিজেই।
ওয়াইল্ড হয়ে গেলো?
না। খুব স্বাভাবিক মানুষের ভঙ্গিতে জেদ শুরু করলো। রাত সাড়ে বারোটার দিকে হঠাৎ তার খেয়াল হলো এই ঘরে বোধহয় খিজির এসে অপেক্ষা করছে। বলে, চলো, আনোয়ার চলো। খিজির অপেক্ষা করছে। খিজির মাটিতে পা রাখতে পারে না, স্পেসে ঝোলে, বেচারা কতোক্ষণ ঝুলবে? চলো। এমন জেদ করলো, শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়লো একাই। আমি কি করি? ওর পিছে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে রাত একটায় এখানে এলাম।
এরপর ওকে একা একা এখানে রাখে কি করে? জুম্মনটাকে এই ঘরে রাখা যায়। কিন্তু এইটুকু ছেলের ওপর ভরসা করা যায়? ছোকরা ভয় পায় না, কিন্তু ওসমানের সব কথা, সব দ্যাখা সে বিশ্বাস করে এবং নিজে সেগুলো দ্যাখার জন্যে উদগ্রীব।
না, না, ওর ওপর ডিপেন্ড করবে, পাগল নাকি? শওকত পরামর্শ দেয়, বরং হাসপাতালে যাও।
পাবনা? পাবনায় সিট পাওয়া কঠিন। নেক্সট টু ইমপসিবল!’ আনোয়ার রাজি হয় না।
তাহলে পিজিতে চেষ্টা করা যাক। পিজিতে সাইকট্রির ওয়ার্ড খুলেছে। মেডিক্যাল কলেজেও থাকতে পারে।’
শওকতের দ্বিতীয় প্রস্তাবও আনোয়ারের অনুমোদন পায় না। না, হাসপাতালে দিয়ে লাভ নাই। কেন?–অন্য সব রোগীদের সঙ্গে থেকে তার রোগ আরো জটিল হতে পারে। পাগলরা অবশ্য নিজেদের জগতেই মগ্ন থাকে, কিন্তু ওসমান যে ধরনের মানুষ, পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে তার যেরকম আগ্রহ, তাতে ভয় হয় যে অন্য সহরোগীদের দ্যাখা হ্যাঁলুসিনেশন নিজে দ্যাখার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠবে। যদি দেখতে পারে তো তার নিজের উদ্ভট জগৎ আরো জটিল হবে এবং দেখতে ব্যর্থ হলে হতাশ হয়ে পড়বে।
যুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে আনোয়ারের বাড়াবাড়িরকম আগ্রহে শওকত অবাক হয়। আলতাফ জানতে চায় বুঝলাম তো। কিন্তু ওর সঙ্গে থাকবে কে?
কেন? আমি যতোদিন পারি থাকি না! আমার তো আপাতত-।
তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে দোস্ত!’ আলতাফ সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন হয়, এ্যাঁবনর্মাল লোকের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকাটা ঠিক নয়।’
আনোয়ার তাহলে কি করবে? ওসমানকে হাসপাতালে পাঠালে আনোয়ারের করার থাকে কি? সে যে গ্রামের সমস্ত কাজ রেখে এখানে এসেছে সে তো ওসমানকে দ্যাখাশোনা করবে বলেই। ওসমানের শুশ্রুষা করা থেকে খারিজ হলে ঢাকায় থাকার পক্ষে তার আর যুক্তি থাকে?
শওকত ও আলতাফ চলে গেলে নিচে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আনোয়ার ভাত ও মুরগির ঝোল নিয়ে আসে ওসমানের জন্য। সিঁড়ির গোড়ায় পা দিয়েই ওসমানের চিৎকার শোনা গেলো, প্রত্যেকটি ধাপ পেরোবার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার আরো স্পষ্ট হয়। নিজের ঘরে দরজার মুখে ধাক্কা খেয়ে আনোয়ার পড়েই যাচ্ছিলো। কোনোরকমে টাল সামলে উঠলে তার সামনে দাঁড়ায় রঞ্জ। রঞ্জু ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আনোয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তবে তার ভয়ও কাটে, দ্যাখেন তো! কি করতাছে, দ্যাখেন।’
ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওসমান। তার গায়ে গেঞ্জি, পরনে কিছু নাই। তার লিঙ্গ নেতিয়ে রয়েছে কালো ও স্যাঁতসেতে অণ্ডকোষের ওপর। আনোয়ার বিছানা থেকে চাদর টেনে তার কোমরে জড়িয়ে দিলে ওসমান নিজেই সেটা লুঙির মতো পরে নেয়। তারপর অভিযোগ করে, দ্যাখো তো, ব্যাটা রঞ্জকে এ্যাঁটাক করতে আসে। আমি না ধরলে রঞ্জুর মাথায় লাথি মারতো!’ ওসমানকে একরকম ঠেলে বিছানায় বসিয়ে দিলে আনোয়ারের চোখে পড়ে মেঝের এক কোণে। সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে ভাত, পুইশাক, আলু ও ইলিশ মাছের টুকরা। সেসবের দিকে আঙুল দেখিয়ে ওসমান বলে, দ্যাখে তো আনোয়ার। আমাদের বিলের জমির রাজভোগ ধানের চালের ভাত, কি সুন্দর জুইফুলের মতো সাদা আম্মা নিজে রেধে দিলো, আমি নিয়ে এলাম, খিজিরকে বললাম, খাও, তুমিও খাও, আমিও খাই। ব্যাট নিজেও খাবে না, আমাকেও খেতে দেবে না। আবার রঞ্জুর পিঠে লাথি মেরে ঘর থেকে বার করে দিতে চায়!
রঞ্জুর ভয় একেবারে কেটে গেছে, সে বেশ মজা পাচ্ছে, তার চোখের কোণে চাপা হাসি চিকচিক করে।
আনোয়ার বলে, ‘ভাত তুমি এনেছো?
জী। আমাকে ধরতে আসলে গামলাটা হাত থাইকা পইড়া গেলো।
তুমি এসব আনতে গেলে কেন? ওর অবস্থা তো জানো। কখন কি করে।
আমার কি দোষ? ছোটোআপার ঢঙ!
তোমার ছোটো আপাও এসেছিলো?
মাথা খারাপ? পাগল আর কুত্তা আর তেলাপেকা—এই তিনটা জিনিসরে ছোটোআপ যমের মতো ডরায়। আমার পিছে পিছে দরজা পর্যন্ত আসছিলো। উনারে দেইখা আমার হাতে ট্ৰে দিয়া আপা এ্যাঁবাউট টার্ন। খুব রসিয়ে রসিয়ে রঞ্জ ওসমানের আচরণের বিবরণ দেয়। তাকে দেখে ওসমান প্রথমে একটু হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো। এরপরই রঞ্জ, সাবধান খিজির তোমাকে মারতে আসছে!’ বলে চিৎকার করে লাফিয়ে মেঝেতে নামে এবং রঞ্জকে জড়িয়ে ধরে। বিছানা থেকে ডাইভ দেওয়ার সময় তার লুঙি খুলে গিয়েছিলো, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে রঞ্জু হাসে। ওর এইসব হাসি ও বর্ণনাকে পাত্তা না দিয়ে ওসমান দেওয়ালের দিকে মিনতি করে, খিজির, প্লীজ, রঞ্জকে ধরে না। প্লীজ খিজির!
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৭
ওসমানের ঘুমের আয়োজন করতে গিয়ে রাত্রে আনোয়ারের ঘুম হয় না। ওসমান যতোক্ষণ জেগে থাকে ততোক্ষণ তার কথাবার্তা কি চ্যাচামেচি চলে; ইঞ্জেকশন দিয়ে, ট্যাবলেট খাইয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে হয়। তক্তপোষে ২ জনে কোনোভাবে থাকতে পারে বটে, কিন্তু ওসমান বড়ো ছড়িয়ে শোয়, আনোয়ার সারাটা রাত্রি প্রায় বসেই কাটায়। জুম্মনের আসার কোনো ঠিক নাই। পরশু একবার এসেছিলো, সারাটা দিন ওসমানের চ্যাচামেচি শুনলো খুব মনোযোগ দিয়ে, তারপর থেকে উধাও। সকালবেলা আনোয়ারের বড়ডো ঘুম পায়। ঘুমন্ত ওসমানের ঘরে তালা লাগিয়ে সে চলে যায় ওয়ারি। তখন সাড়ে ৭টা ৮টা হবে। ওদের বাড়ির বাইরে গেটের কাছে নালার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে করমালি।
করমালি? তুমি? আনোয়ার খুব অবাক হয়। সারারাতের ভোতা ধকলের পর এই বিস্ময় তাকে চাঙা করে তোলে।
আসসালামালেকুম। কেমন আছেন ভাইজান?
করমালির পায়ের ফোস্কাগুলো সব গলে গেছে, সেখানে এখন দগদগ করছে গোলাপি ঘা। করমালি নিশ্চয়ই পায়ের চিকিৎসা করতে এসেছে। আনোয়ারের ভালো লাগে। ওসমানকে সামলাতে সামলাতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন হলো শালার মার্শাল ল জারি হয়েছে। রাস্তায় বেরোলেই সেনাবাহিনীর অশিক্ষিত ও উদ্ধত জানোয়ারদের মুখ, ঘরে বসে এদের উদ্দেশে গালাগালি করা—আর ভালো লাগে না। অন্তত করমালিকে দেখে মনে হচ্ছে, এসব আর কাহাতক চলতে পারে? আনোয়ার গদগদ গলায় বলে, ‘তুমি কখন এসেছে?
করমালি ঢাকা পৌঁছেছে গতরাত্রে। রাত্রি কাটিয়েছে স্টেশনে। সকালবেলা বেরিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে আনোয়ারদের বাড়ি খুঁজে পেয়েছে। ঠিকানা পেলো কোথায়?
করমালি, সারারাত স্টেশনে ছিলে? খুব কষ্ট হয়েছে, না?
কষ্ট হবে কেন? পাকা ঘর, মস্ত উঁচু ছাদ। শ’য়ে শ’য়ে লোক শুয়ে থাকে, ওরকম আরামের জায়গা করমালি চোখে দ্যাখেনি। এই বাড়িতে পৌঁছলে একটা কাজের লোক তাকে ধমক দিলে সে আনোয়ারের কথা বলে এবং গ্রামের পরিচয় দেয়। এরপর আনোয়ারের মা তার জন্যে নাশতা পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে।
গ্রামের খবর কি? নাদু পরামাণিক কেমন আছে? নবেজউদ্দিন? বান্দু শেখ? করমালির বাপের শরীর কেমন? একটা প্রশ্নের পিঠে আরেকটা প্রশ্ন করে আনোয়ার, করমালি জবাব দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না।
জালাল মাস্টার সাহেবের খবর কি?
মাস্টার সায়েব ভাষণ দিয়া বেড়ায়। বৈরাগীর ভিটাত সপ্তায় সপ্তায় সভা হয়, জালাল মাস্টার আরম্ভ করলে আর কেউ ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পায় না। শুনে আনোয়ার হাসে। লোকটা কথা বলার চান্স পেলে থামতে চায় না। আজকাল সব বক্তৃতা আবার মাইকে হয়, জালাল মাস্টারকে আটকায় কে?
বৈরাগীর ভিটায় আজকাল খুব মিটিং হয়, না?
প্রায়ই। আফসার গাজী এদিক ওদিক বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছে। মার্শাল ল হওয়ার পর প্রথম দিকে চুপচাপ ছিলো, এখন ফের নতুন করে দ্বিগুণ বেগে শুরু হয়েছে।
আফসার গাজী বৈরাগীর ভিটায় আসে? মিটিং করে?
হ্যাঁ, বৈরাগীর ভিটা তো ধরতে গেলে তারই দখলে। তারই সভাত মাস্টার সায়েব লেকচার দেয়। আপনে পেপার পড়েন না? ঢাকার পেপারেও হামাগোরে ওটিকার সভার কথা ল্যাখে!
থাক, এসব অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এখন বরং থাক। এখন করমালির পায়ের চিকিৎসাই প্রধান মনোযোগ লাভের যোগ্য।
করমালি, তোমাকে বোধহয় কিছুদিন থাকতে হবে। পায়ের যা অবস্থা মনে হয় সেরে উঠতে তোমার টাইম লাগবে।’
পাও হামার এমনি ভালো হয়া যাবো ভাইজান আগের চায়া কতো ভালো!
তবে করমালি ঢাকায় এসেছে কেন? কিন্তু জিগ্যেস করএত আনোয়ারের বাধোবাধো ঠেকে।
আপনার সাথে কথা আছে। আপনাক যাওয়া নাগবো।’
কোথায়?
হামাগোরে ওটি। সোগলি আপনাক যাবার কছে?
কেন?
করমালি এবার গ্রামের খবর জানায়। আফসার গাজী থানা পর্যায়ে বড়ো নেতা হতে চলেছে। মিটিঙে মিটিঙে তার চাচা খয়রার গাজীর নামে যা-তা বলে বেড়ায়, ওর চাচা হলো আইয়ুব খানের দালাল, বাঙালির শক্র। দালাল চাচার আধপোড়া বাড়ি ঘর দখল করার জন্যে আফসার হন্যে হয়ে উঠেছে। এদিকে এইসব কথা বলে, আবার বৈরাগীর ভিটায় গণআদালত বসিয়ে যারা এদের বিচার দাবী করেছিলো নানাভাবে তাদের সর্বনাশ করার চেষ্টা করছে। তার সঙ্গে সদাসর্বদা এক দঙ্গল কলেজের ছাত্র, তাদের খাওয়া দাওয়া সব তার বাড়িতে। গ্রামের লোক ভয়ে কাতর, এখন আনোয়ার গিয়ে যদি কিছু করতে পারে। ‘আপনে যদি গায়ের মানষের সাথে এ্যাঁনো কথাবার্তা কন, সাথে সাথে থাকেন তো আফসার গাজী এতো সাহস পায় না। গরিব গরবা চাষাভূষা মানুষ, মুরুখু মানুষ, বুঝলেন না? আপনে থাকলে হামরা হিরদয়ে বল পাই ভাইজান!
আলিবক্স কোথায়?
তাই তো হাজত খাটে। জেলই বুঝি হলো!
জেলে? কেন?
বগুড়া থাকা মিলিটারি অ্যাসা তাস ধর্যা নিয়া গেছে। মানুষ খুন করার মামলা দিছে। হোসেন আলি ফকিরকে মারা হলো না? হামার নামেও মামলা দিছে। হামি পলায়া বেড়াই। এখন আর ভয় করি না ভাইজান!
খুনের মামলার পলাতক আসামী তার ঘরে। আনোয়ারের সমস্ত শরীর দুলে ওঠে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বাইরের যাবতীয় দৃশ্য, ধ্বনি ও গন্ধ উত্তপ্ত হয়ে ভাপ ছাড়ে না, গ্রামে যাওয়াটা এখন অবশ্য কর্তব্য। এখানে থেকে তার লাভ কি? এইসব একঘেয়ে কালো পিচঢালা এবং এবড়োখেবড়ো খোয়া-ওঠা রাস্তা ও গলি, এইসব কালো থিকথিক-করা ড্রেন, ময়লা উপচে-পড়া ডাস্টবিন, রাস্তার ২পাশে উঁচু উঁচু দালান, এইসব ট্র্যাফিকজাম, রিকশা যেতে যেতে ট্রাকের গুতো খাওয়ার অবিরাম ভয়, তাদের বাড়ির মোটা মোটা দেওয়ালের ভেতর আম্মার অসুখী অসন্তষ্ট ও লোভী চেহারা, এইসব পথে ঘাটে রেস্টুরেন্টে বাখোয়াজি, ওসমানের উৎপাত,–নাঃ, আর কতো? গ্রামে আফসার গাজী কি করতে পারে যদি আনোয়ার একবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়? আলিবক্সকে ধরে নিয়ে গেছে।–তার কর্মীরা আছে, তাদের নিয়ে আনোয়ার কি রুখে দাঁড়াতে পারে না? পারবে না কেন?
যাবো! তোমার সঙ্গেই যাবো।
যাবেন? করমালির চাষাড়ে গলা আবেগে আটকে আসে, যাবেন ভাইজান? হামি গাওত খুব বড়ো গলা করা কয় আসছি, আনোয়ার ভাইজান আসবো। কালই না হয় মেলা করি!
যাত্রার দিন ধার্য করতে আনোয়ার ইতস্তত করে, না কাল নয়। তোমার চিকিৎসা চলুক। পা একটু সেরে না উঠলে কাজ করবে কি করে? আমারও একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
আলতাফের বড়োভাই মেডিক্যাল কলেজের এ্যাঁসোসিয়েট প্রফেসব। আলতাফকে দিয়ে ধরা হলো তাকে। মেডিক্যাল কলেজের আউটডোর কয়েকদিন চিকিৎসার পর করমালির পায়ের ঘা গোলাপি থেকে খয়েরি হয়, তাকে খুঁড়িয়ে হাটতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আগের চেয়ে তাড়াতাড়ি হাটতে পারে। এর মধ্যে আনোয়ারকে গ্রামে ফেরার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করেছে। এতো তাড়াহুড়া করার আছেটা কি? গ্রামের চাষাভূষাদের এই ঘরমুখে স্বভাব আনোয়ার সহ্য করতে পারে না। এতো তাড়াতাড়ি গ্রামে গিয়ে তারা করবেটা কি? বৈশাখ পড়লো, করমালির বাড়িতে এখন খাবার কোথায়? অথচ দাখো, রাতদিন বাড়ি বাড়ি করে অস্থির। এদিকে দিনকে দিন ওসমানের অসুখ বেড়েই যাচ্ছে। ডাক্তার ভরসা দিয়েছিলো, গরম পড়তে শুরু করলে একটু কমবে। কোথায়? ওসমান একটু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আনোয়ারকে অপেক্ষা করতেই হয়। করমালিকে একটা চাকরির সংস্থান করে দিতে পারলে সবদিক থেকে ভালো হতো। আনোয়ার অনেককে বলেও রেখেছে, বড়োভাইয়ের কোন বন্ধুর অফিসে একটা কাজ জুটে যেতে পারে। এই চাকরি পেলে ওর যাই—যাই ভাবটা কাটে। চাকরি না করে ওর উপায় কি? এই খোড়া পা দেখে ওকে জমি বর্গ দেবে কে? আবার ওসমানের ঘরে রাত্রে আজকাল করমালিই থাকে, ও থাকলে আনোয়ার বেশ নিশ্চিত। চাকরি পেলেও ও ওসমানের ঘরেই শোবে। আবার চাকরি পেলে খাওয়া দাওয়ার জন্য আনোয়ারের ওপরে নির্ভর করতে হবে না, এই গোয়ার গোবিন্দ মার্ক চাষা ছেলের অস্বস্তিটা তাহলে কাটে। আনোয়ার এসব বোঝে। সবচেয়ে বড় কথা, কয়েকদিন এখানে রেখে ওকে বেশ তৈরি করে নেওয়া যায়। শুধু সাহস থাকলে হয় না, সংগঠিত হতে হয়, রাজনীতি ভালো করে রপ্ত করা দরকার। একে দিয়ে তো ভোটের রাজনীতি করানো হচ্ছে না যে খালি হৈ হৈ করে বেড়ালেই চলবে। একে গড়ে তুলতে হবে, চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আলিবক্সের সঙ্গে ছিল বটে, কিন্তু আলিবক্স এদের সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চরিত্র অর্পণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিংবা আলিবক্স হয়তো চেষ্টাও করেনি। আনোয়ার করবে। করমালিকে ঢাকায় রেখে যদি সে যথার্থ রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে তাকে মানুষ করতে পারে তো একটা কাজের মতো কাজ হয়।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৮
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মকবুল হোসেনের ঘরের সামনে আনোয়ার ১টি জটলা দেখতে পায়। ভেতরে মকবুল হোসেনের স্ত্রীর একটানা কান্না। আবু তালেবের মৃত্যুর পর থেকে মহিলার কান্না অবশ্য প্রায়ই শোনা যায়, কিন্তু এরকম হাউমাউ কান্না অনেকদিনের জন্য স্থগিত ছিলো। রোগা ১টি লোক দরজায় দাঁড়িয়ে অনুপস্থিত কাউকে লক্ষ করে গালগালি করছে। এই লোকটা হলো মকবুল হোসেনের বোবা মেয়ের স্বামী, আনোয়ার একে চেনে না। আলাউদ্দিন মিয়াও আছে, আনোয়ারকে দেখে তার মেহেদি-রাঙানো আঙুলগুলো নাচাতে নাচাতে এগিয়ে আসে, আপনে আসছেন? দোস্তোরে রাইখা কই কই বিপ্লব কইরা বেড়ান? আপনের দোস্তো আমার বাড়ির ছাদে মানুষ খুন করে।’
কি? কি হয়েছে?
আপনার দোস্তো মকবুল সাবের পোলার খুন করার এ্যাটেম্পট লইছিলো।
এ্যাঁ? কাকে? কে খুন করলো?
রঙ্গুরে খুন করতে গেছিলো আপনাগো পাগলাটা! আপনারে কইয়া দিলাম, আপনে তো উনার গার্জিয়ান, আপনে ঘর দ্যাখেন। পাগল ছাগলরে বাড়িতে রাখতে পারুম না। আমার আর ভাড়াইটাগো সিকিউরিটির রেসপনসিবিলিটি তো আমার ঘাড়েই। আপনে ঘর দ্যাখেন।
আরে, হলোট কি বলবেন তো!
নিজেই গিয়া দ্যাখেন। আপনের দোস্তের ঘরে আরো মানুষ আছে। খালি আমার বাড়ি, নাইলে এতোক্ষণ দারোগ পুলিস মিলিটারি আইয়া পাগলা খুনীটারে আর আমান রাখতো না!
শোনেন, পাগলা হোক আর যাইহোক, আমার দোস্তো ভাড়া দিয়ে থাকে। বললেন আর ভাড়াটে উঠে গেলো, অতো সহজ নয়!
আলাউদ্দিন মিয়া রাগে ও অপমানে এবং এর চেয়ে ও বেশি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সামলে নিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আরে যান যান ইচ্ছা করলে অক্ষণ, এই মুহূর্তে উঠাইয়া দিবার পারি। ছাদের উপরে থাকবার দিছি, মানুষ খুন করবার চায়, তার হইয়া লেকচার দিবার লাগছে। ঐগুলি লেকচার আপনাগো পার্টির মইদ্যে কইরেন। আমার বাড়িতে খাড়াইয়া আমারে বেইজ্জত করে আলাউদ্দিন মিয়া উত্তেজনা ও রাগে রীতিমতো কাপে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাপে, এর মধ্যে আনোয়ার উঠে যায় ওসমানের ঘরে।
ঘরে করমালি, পারভেজ, দোতলার ১ভাড়াটে এবং জুম্মন। চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে ওসমান। জুম্মন ছাড়া বাকি ৩ জন একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে আনোয়ার শাসনের ভঙ্গিতে বলে একজন। একজন কথা বলেন। পারভেজ তখন জানায় যে সকালে মকবুল হোসেন এসেছিলো ওসমানের কাছে বিদায় নিতে, সঙ্গে ছিলো পারভেজ।-বিদায়? বিদায় নেবে কেন? —মকবুল হোসেন তো এই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে, ভোরবেলা বেড়িয়েছিলো, চেনাজানা সবাইকে বলতে গিয়েছিলো, তা পারভেজের ওখানে গেলে সে আবার অন্য সব প্রতিবেশীদের বাড়ি যাবার সময় মকবুল হোসেনকে সঙ্গ দেয়। মকবুল সাহেব এখানে কতোদিন থাকলো, বেচারার বড়ো ছেলেটা মারা গেলো এখানে থাকতেই। আহা! তালেব কি ভালো ছেলেই ছিলো!
হ্যাঁ, তা হলোটা কি? আনোয়ারের অধৈর্য দেখে দোতলার ভাড়াটে কথকের ভূমিকা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়, মকবুল সায়েবের ছোটো ছেলেটারে ওসমান সায়েব গলা টিপ্যা ধরছিলো। এক্কেরে তুইলা না ধইরা– ‘
কিন্তু দোতলার এই ভাড়াটের ওপর ওসমান বিরক্ত, তাই পারভেজকেই জিগ্যেস করে, রঞ্জকে ওসমান মারবে কেন?
পারভেজ এবার তার কাহিনী বর্ণনার নিজস্ব ভঙ্গি অনুসরণ করে। মকবুল হোসেনের সঙ্গে তার ছেলেও ওসমানের ঘরে এসেছিলো। ওসমান ছিলো একা, করমালি গিয়েছিলো নিচে ওসমানের জন্য নাশতা কিনতে। ওসমানের তখন কথাবার্তা প্রায় স্বাভাবিক। মকবুল হোসেনকে বসবার জন্য সে চেয়ার এগিয়ে দেয়। তবে মকবুল হোসেনের এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে সে অবাক। মকবুল হোসেন তখন বাড়ি ছাড়ার কারণ জানায়। বিয়ে করে এই বাড়ির মালিক হয়েছে আলাউদ্দিন মিয়া। শ্বশুর তার পক্ষাঘাতে পড়ে আছে বলে যাবতীয় কাজকর্ম ও সম্পত্তি দাখাশোনার দায়িত্ব পড়েছে তার ওপরেই। লোকটা সংস্কারপন্থী, পুরনো ব্যবস্থা সে কিছুকিছু পাল্টাতে চায়। বাড়িভাড়ার ব্যাপারেও তাই। ভাড়া বাড়িয়েছে দেড়গুণ। এমন কি মকবুল হোসেন নিজেও এই ভাড়াবৃদ্ধি অনুমোদন করে। মার্শাল ল হওয়ায় খাজনা-ট্যাক্সের ব্যাপারে খুব খুব কড়াকড়ি চলছে, কোথাও ফাকি দেওয়ার জো নাই।
আরে ভাই, ভাড়া বাড়াচ্ছে এ তো আমিও জানি। কয়েকদিন আগে ওসমানের ভাড়া দিলাম, এর ভাড়া তো ডবল করে দিয়েছে। আপনি আসল ব্যাপারটা বলেন না!
আনোয়ারের ধৈর্যচ্যুতিতে পারভেজ বিব্রত হয়ে একটু সংক্ষেপ করার চেষ্টা করে। তবে সংক্ষিপ্ত হওয়া তার স্বভাবের বাইরে। সুতরাং তাকে জানাতে হয় যে কিছুক্ষণের মধ্যে ওসমান অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, মকবুল হোসেনের কথায় সে আদৌ কান দিচ্ছিলো কি-না সন্দেহ। সে তাকিয়েছিলো ছাদের দিকে। ছাদের রেলিঙে ভর দিয়ে রন্থ তখন পাড়াটাকে ভালো করে দেখে নিচ্ছে। রভুকে দেখতে দেখতে ওসমান বিড়বিড় করে, আরে খিজির, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি আসছি। আমি নিজেই পারবো, তুমি যাও না। দাখো না আমি একই পারবো। তো পারভেজ ওর স্বগতোক্তিকে আমল দেয় না, জীন পরিভর করলে মানুষ কতো কি বলে, ওসমান তো বেশ কিছুদিন থেকে শূন্যের ভেতর কাকে যেন দেখতে পায়, এ আর নতুন কি হলো? আরে খিজির রাখে রাখো, মেরো না। ওটাকে আমার ওপর ছেড়ে দাও। বলতে বলতে ওসমান ছাদে চলে যায়। করমালি ততোক্ষণে কাঁঠালপাতার ঠোঙা হাতে ফিরে এসেছে। ওর পেছনে পেছনে ঘরে ঢোকে জুম্মন। ওসমানের নাশতা দেবে বলে করমালি টেবিলে প্লেট রাখছে, পারভেজ জুম্মনকে বলছে, কি রে ব্যাটা, তোর খবর কি? পারভেজের অনুরোধে মকবুল হোসেন ১টা কাগজে তার নতুন ঠিকানা লিখছে, এমন সময় ছাদ থেকে ধ্বস্তাঞ্চস্তির আওয়াজ আসে। কি হলো? না, রঞ্জকে জাপটে ধরে ওসমান তার মুখে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছে। ওসমান চিৎকার করে বলছিলো, রঞ্জ, এই শেষবার ফাইনাল। বিদায়? পারভেজ ও করমালি ছুটে যেতে সে রঞ্জুর ঠোঁট কামড়ে একটুখানি মাংস ছিঁড়ে নেয় এবং খু করে তাই ছুড়ে ফেলে রঞ্জুর মাথায়। তারপর রঞ্জকে পাঞ্জাকোলা করে তুলে তাকে রেলিং ডিঙিয়ে নিচে ফেলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রেলিং সেখানটায় উঁচু, বদিকে নিতে পারলে ছুড়ে ফেলাটা সহজ হয় বলে রঞ্জকে সে হিচড়ে টেনে নিচ্ছিলো বঁদিকেই। পারভেজ ও করমালি দৌড়ে গিয়ে তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। দোতলার ভাড়াটেও তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে, মোটা লোকটা ওসমানরে বা পায়ের লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ে চিলেকোঠার দরজায়।
এদিকে ওসমান ততোক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে ঐ উঁচু রেলিং পার করে রঞ্জকে নিচে ফেলা অসম্ভব এবং করমালি ও পারভেজ রঞ্জকে কিছুঁতেই বাঁদিকে টেনে নিতে দেবে না। তখন ওসমান করলো কি রঞ্জুর মাথাটা ঠুকতেই লাগলো রেলিঙের সঙ্গে। ২হাত দিয়ে রঞ্জুর মাথা জড়িয়ে ধরে ওসমান ঠকাস ঠকাস করে ঠোকে আর বলে, আর তোমার রক্ষা নেই। খিজিরের কাছে আমি প্রমিজবাউণ্ড, আমি ওকে কথা দিয়েছি আজ সব চুকিয়ে দেবো। রঞ্জুর মাথার পেছনদিক থেকে রক্ত পড়তে থাকে, পারভেজ ও করমালি সীমাহীন শক্তি প্রয়োগ করে ওসমানকে সরিয়ে দেয়। রঞ্জুর অজ্ঞান শরীর ধপাস করে পড়ে গেল ছাদের ওপর এবং তাই দেখে মকবুল হোসেনের অবস্থা হয় অধিক-শোকে-পাথর গোছের। ওসমান সেই সময় আকাশের দিকে চিৎকার করে ওঠে, ফিনিশ করে দিলাম। খিজির, দেখলে তো? এবার চলো! পারভেজ কিংবা করমালি কেউই এইসব কথার মানে বুঝতে পারেনি। আনোয়ার কি বলতে পারে?
কিন্তু আনোয়ারের উদ্বেগ এখন অন্য ব্যাপারে, রঞ্জুর অবস্থা এখন কেমন?
বেটার। খবর পেয়ে আলাউদ্দিন সায়েব এলেন। উনি আবার লোক পাঠিয়ে ডক্টর নিয়ে এলেন। ডক্টর শুনে পাঠিয়ে দিলো মিটফোর্ড। মাথায় চোট লেগেছে তো, হসপিটালে দু’চারদিন থাকতে হতে পারে।’
আনোয়ার এবার দ্যাখে ওসমানকে, এরও তো কপালে রক্ত, ঠোঁটেও রক্ত। আলাউদ্দিন মিয়া এসে রাগের মাথায় মুখে একটা ঘুষি দিয়েছিলো, আবার রঞ্জুর বড়ো বোনের হাজব্যান্ড এসেছিলো, ওসমানের কপালে সে-ও একটা রো লাগায়। তবে মনে হয় খুব চোট পায়নি।
আনোয়ার একটু রাগ করে, এ বেচারা অসুস্থ লোক, একে এভারে মারে? আপনারী কিছু বললেন না?
না, না, আলাউদ্দিন সাহেবের ওপর আপনে খালি খালি রাগ করছেন। রঞ্জু খুন হয়েছে বলে রিউমার রটে যাওয়ায় রাস্তায় মেলা লোকের ভিড় জমে গিয়েছিলো। উনি খবর পেলেন তো এসে সবাইকে হটিয়ে দিলেন। রঞ্জুর দুলাভাই খুব হৈচৈ করছিলো কে পুলিসে খবর দেবে, মিলিটারি নিয়ে আসবে। উনি তো সব সামলাবেন। উনার কথা হলো কে, আমার ভাড়াটে, যা করার আমি করবো!
উনি কি ভাড়াটেদের প্রজা ভাবেন না কি?
আনোয়ারের রাগ দেখে পারভেজ অবাক হয়, উনারে বেবি ট্যাকসি নিয়ে আমি আর মকবুল হোসেন সাহেব আর রঞ্জুর দুলাভাই মিটফোর্ড গেলাম। আবার ঐ ট্যাকসিতে রিটার্ন করলাম। আলাউদ্দিন সাহেব— ।
আলাউদ্দিন মিয়ার কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে আনোয়ার প্রসঙ্গ পাল্টায়, ‘তো ওসমান ঘুমিয়ে পড়লো কখন? ইঞ্জেকশন দিয়েছিলো কে, করমালি।
ঐ চ্যাংড়াক এই ঘর থাকা সরাবার সাথে সাথে ওসমান ভাইজান বিছনাত শুইয়া পড়লো। করমালি বলে, আজব কথা ভাইজান। এতো হৈচৈ, তাক নিয়ে এতো টানা হ্যাঁচড়া, তার কপালেত রক্ত, ঠোঁটেতে রক্ত, শুইয়া তাই হাসে।
হাসলো?
হ্যাঁ। হা হা করা খুব হাসলো, হামি কি করমু দিশা পাই না, দেখি, হাসতে হাসতে ঘুমাইয়া পড়লো। এক ঘড়ির মধ্যে তার নাক ডাকা আরম্ভ হলো
কোনোরকম গোলমাল করেনি? তোমাকে মারধোর করার চেষ্টা করেছিলো?
না ভাইজান হাসতে হাসতে কিবা কথা কলো–।
কি বললো?
কথা কিছু বোঝা যায় না।
ওসমানের পাশে বসে আনোয়ার শিউরে উঠলো। রঞ্জকে ওসমান যদি সত্যি সত্যি মেরে ফেলতো। রঙুর ওপর ওর এতো রাগ কেন? ডাক্তারের সঙ্গে পরবর্তী এ্যাঁপয়েন্টমেন্ট বোধহয় পরশু। আনোয়ার ডাক্তারকে এই ঘটনাটা কিভাবে বলবে?
করমালি বলে, নিন্দ পাড়ক। আহারে, মানুষটা কতোদিন দুই চোখের পাতা এক করবার পারে নাই!
বিকাল ৫টায় মকবুল হোসেন এই বাড়ি ছেড়ে, এই পাড়া ছেড়ে সপরিবারে রওয়ানা হলো জিন্দাবাহার সেকেন্ড লেনের দিকে। আলাউদ্দিন মিয়াকে এখানে অনেকেই খুব ধরেছিলো, বেচারাদের আর কটা দিন সময় দেওয়া হোক। কিন্তু ৪টের আগেই নতুন ভাড়াটের মালপত্র এসে গেছে। সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাহ করে তাদের আসবাবপত্র দ্যাখে। এতো সব চেয়ার টেবিল খাট আলমারির মালিক এখানে বাস করতে এলো কোন দুঃখে? একটু ভালো এলাকায় বাড়িভাড়া নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে, নবাগত লোকটিকে তাই হয়তো একটু নিচে নামতে হলো। ১বছরের মধ্যে আলাউদ্দিন মিয়া যদি আরেক প্রস্থ বাড়ায়?-এই ভয়কে এড়াবার জন্য সবাই নতুন ভাড়াটের ছেলেমেয়েদের চেহারা ও তাদের কথাবার্তার খুঁত ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে মকবুল হোসেনকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করলেও আলাউদ্দিন মিয়া তাদের নানাভাবে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন, মিটফোর্ড হাসপাতালে তার দাপট খাটিয়ে রঞ্জুর দ্রুত নিরাময়ের ব্যবস্থা করবে। দরকার হলে তার দলের কযেকজস কর্মী পাঠিয়ে ডাক্তার নার্সদের তটস্থ করে রাখবে।
লটবহর নিয়ে ঠেলাগাড়ির সঙ্গে গেলো মকবুল হোসেন। ১টি রিকশায় রানু ও রানুর মা। আনোয়ার ছাদের রেলিঙে ঝুঁকে তাদের দেখলো। চোখ মুছতে মুছতে রানুর মা বারবার ওপর দিকে তাকাচ্ছিলো। রানুও তাকিয়েছিলো ১বার। দিন বড়ো হচ্ছে, বিকাল ৫টাতেও রানুর চুলে রোদ পড়েছে, কিন্তু তার মুখের ওপর বিকালবেলার ছায়া। রানুর মুখ কাপশা। আনোয়ার স্পষ্ট করে মেয়েটিকে দেখতে পারলো না।
ঘরের ভেতর এসে দ্যাখে করমালি কেতলি করে চা নিয়ে এসেছে। বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে ওসমান, তার মুখ বালিশে গোজা। তার গেঞ্জিতে পিঠের বাদিক ঘেঁষে একটা ফুটো। আনোয়ারের মাথা দুলে ওঠে রঞ্জুর দুলাভাই বা আলাউদ্দিন মিয়া যদি ওসমানের পিঠের এই জায়গাটায় একটা ৬্যাগার বসিয়ে দিতো রাগের মাথায় লোকে কি না করতে পারে? হঠাৎ মনে হয় শালা ঘুম যেন ডাগার হয়ে গাথা রয়েছে ওসমানের পিঠে, এই ঘুম থেকে তার আর পরিত্রাণ নাই।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৯
করমালি অবশ্য ঘাবড়ায় না, খিদা পালে নিজেই চেতন পাবো। ভাত তো টেবিলের উপর থাকলেই, তাই চেতন পালে ভাত খাওয়াইয়া ওষুদপতি দিয়া হামি শুতমু। আপনে যান ভাইজান কতোক্ষণ বস্যা থাকবেন? কয়েকদিন থেকে রাত্রে অবশ্য করমালিই থাকে। কিন্তু আজ ওসমানের কপাল ব্যান্ডেজ, ঠোঁট ফুলে ঢোল। যে কাণ্ডটা করলো আজ, এরপর শুধু করমালির ভরসায় কি আনোয়ার বাড়ি যেতে পারে?
আপনে যান! করমালি ফের ভরসা দেয়, আত হলো। মনে হয় তামান আত তাই নিন্দ পাড়বো।
সারা রাত ঘুমাবে? তুমি বুঝলে কি করে?
আনোয়ারের ছেলেমানুষি প্রশ্নে করমালি পরিণত চোখ করে হাসে। এই হাসিতে ভরসা আছে, প্রশ্ৰয়ও আছে।-আনোয়ার তার ওপর ওসমানের দায়িত্ব দিয়ে দিব্যি বাড়ি যেতে পারে। আনোয়ারের খুব ঘুম পাচ্ছে, শরীর দারুণ ক্লান্ত। করমলিটা ভাগ্যিস এসেছিলো ও না থাকলে ওসমান তাকে লাশ নিয়ে বসে থাকার দশা করে ছাড়তো। করমালির ওপর কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে আনোয়ার তার চাকরির খবর দেয়। ভাইয়া গতকাল তাকে জানিয়েছে-ভাইয়ার বন্ধুর অফিসে চাকরি, আনোয়ার চাইছিলো একেবারে চূড়ান্ত নিয়োগ-পত্র নিয়ে করমালিকে জানাবে। কিন্তু উপচে-ওঠা কৃতজ্ঞতাবোধ সামলাতে না পেরে এখনি বলে ফেললো। করমালি পরশু কাজে যোগ দিতে পারবে। পরশু তো বরিবার, তাহলে তার পরদিন। কাজ এমন কিছু নয়। কেরানীদের ঘর থেকে সায়েবের ঘরে কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে আসাযাওয়া করা। মতিঝিলের সেই অফিসে ঘর মোটে আড়াইটে, সুতরাং আসা-যাওয়ার পরিধিও কম। মাঝে মাঝে চা তৈরি করতে হবে। চা তৈরি করা শিখতে করমালির কতোক্ষণ আর লাগবে? একটু লেখাপড়া জানা থাকলে ভালো হতো। করমালি নাম দস্তখত করতে পারে না?–তাতে আপাতত কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, পরে আনোয়ার তাকে খানিকটা লেখাপড়া শিখিয়ে দেবে। একবার কাজ শিখতে পারলে এ অফিস থেকে ও অফিস যাও, বেতন বাড়িয়ে নাও মতিঝিলে সায়েব সুবো থেকে শুরু করে পিওন চাপরাশি পর্যন্ত এই নিয়মে চলে। ওখানে লোকে চাকরি নেয় মালপানি কামাবার উদ্দেশ্যে। যতো পারো, যেভাবে পারো, টাকা বানাও! করমালিও কিছুদিন পর বেশি বেতনে অন্য অফিসে যেতে পারবে। চাকরিই ওর জন্য ভালো। এই পা নিয়ে চাষবাসের কাজ করবে সে কি করে? আর ওকে জমি বর্গাই বা দেবে কে? আর এখন গ্রামে দেখলেই আফসার গাজীর লোক ওকে নির্ঘাত পুলিসে ধরিয়ে দেবে।
করমালি চুপচাপ শোনে আর উসখুস করে। অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বলে, কিন্তু ভাইজান, হামার তো বাড়িত যাওয়া নাগে!
বাড়ি? গ্রামে যাবে? কবে?
দুই চারদিনের মদ্যে গেলে ভালো হয়। অনেকদিন হয় বাড়িছাড়া-।
যাও। কাজে জয়েন করে সপ্তাহখানেক পর তিনচারদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে এসো। অফিসে বলো যে বাড়িতে সবাইকে বলে আসা হয়নি, বিছানাপত্র আনতে হবে।’
বিছানা?
আচ্ছা, বিছানা না হয় আমি ব্যবস্থা করবো। এই ঘরেই থাকবে। মেঝেতে অসুবিধা হবে?
না ভাইজান, দালানের মদ্যে মেঝেও যা, চৌকিও তাই। কথা সেটা নয়। বাড়িতে গেলে হামি তো আর আসবার পারমু না!
মানে? তোমার চাকরি ঠিক করলাম যে!
ঢাকাত বস্যা চাকরি করলে হামাগোরে পোষাবো, কন?
বাড়ির জন্য মন খারাপ করে? আনোয়ারের রাগ হয়, বাড়ির জন্যে এরকম স্যাঁতসেঁতে টান হলো এদের প্রধান রোগ, এই পিছুটান থাকলে এদের দিয়ে কি হবে?
ফাপরের কথা কন? ফাপর তো এ্যাঁনা নাগেই। তাই বলা ফাপরে অস্থির হলে হামাগোরে চলে? ধান কাটার সময় খিয়ার অঞ্চলে গেলে কয়টা মাস কোটে কোটে থাকি, তখন কি বাড়িঘরের উদিশ থাকে?
তাহলে? তাহলে বাড়ি যাবে কেন?
গাওত যাওয়া নাগবো না ভাইজান? গাওত বলে ওদিক কেয়ামত হবা নাগছে গো! গাজীগোরে শরীলেত এ্যাঁনা বাড়ি পড়ছে, বুঝলেন না? আবার শুনি ভোট নাকি হবো? সরকার পাটিও তারা, আবার অন্য পাটিও তারাই। ভোট হলে তামাম গাও খালি খচ্যা বেড়াবো। বৈরাগীর ভিটার বটগাছের ডাল ভাঙা হছে, পুরানা বাসিন্দা এখন তামাম গাওদের মদ্যে খালি নাফ পড়বা নাগছে!
‘তো তুমি এখন গিয়ে কি করবে? তোমাকে তো পুলিস ধরবে। বুঝতে পাচ্ছে না কেন?
আরো মেলা মানষের নামে তো মামলা করছে। সোগলির সাথে থাকলে বল পাওয়া যায়। ধরেন, হামরা চাষাভুষা মানুষ, একলা এই দালানের মদ্যে বস্যা থাকলে ক্যামকা ঠেকে। গায়ের মদ্যে অরা কেয়ামত করে, বুড়া বাপটকে ম্যারাই ফালালো নাকি?
আনোয়ার চুপচাপ ওসমানের উপুড়-হওয়া ঘুমন্ত শরীরের ওঠানামা দ্যাখে। করমালি আস্তে আস্তে বলে,ভাইজান, কোদ করলেন?
ক্রুদ্ধ না হলেও বিরক্ত তো হয়েছেই। ভাইয়াকে এতো করে বলে এর চাকরির ব্যবস্থা করে দিলো, লোকটা পাত্তাই দিলো না। ছোটো অপমানবোধটা সে চেপে রাখতে পারলো না, না, রাগ করবো কেন? কয়েকটা মাস পরে আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম। গ্রামে তো আমারও কাজ আছে করমালি!
করমালি ওসমানের মশারি টাঙায়। ঘরে মশা গুনগুন করছে, রাস্তায় রিকশার টুংটং আওয়াজের স্পষ্টতায় রাত বাড়ে। করমালি বলে, এই ভাইজান ভালো না হলে আপনে যান কেমন কর্যা?
আনোয়ার উঠে দাঁড়ায়, ১২টা থেকে কারফ্যু। এখন রওয়ানা হলে কারফ্যুর আগে আগে ওয়ারি পৌঁছতে পারবে।
ঠিক আছে। তুমি যাও। কালকেই যেতে পারো। ওসমান সেরে উঠলে কিংবা হাসপাতালে ওর একটা ব্যবস্থা করে কয়েক মাস পার আমিও যাবো।
দরজা টরজা ঠিতমতো বন্ধ করা এবং ওসমান জেগে উঠলে তাকে পথ্য ও ওষুধ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আনোয়ার বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি দিকের দরজায় দাঁড়িয়ে ফের করমালির দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, ইচ্ছা হলো আর এই অসুস্থ লোকটাকে ফেলে রেখে চলে গেলাম, তা তো হয় না করমালি। হুট করে চলে গেলে কোনো কাজ হয়?
না ভাইজান। করমালি আনোয়ারের সঙ্গে একমত, হুট করা নিজের মানুষ ত্যাগ করা আপনে যাবেন ক্যামন করা দ্যাখেন না, গা ছাড়া এটি থাকতে হামার কেমন উটকা উটকা ঠেকে!
পরদিন ওসমানের ঘুম ভাঙে সকাল ৮টা দিকে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে করমালি মেঝেতে গড়িয়ে খুমিয়ে পড়েছিলো। রাত্রে মাঝে মাঝে তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো, চমকে চমকে উঠে দেখছিলো ওসমানের দিকে। না, মিহি সুরে নাক ডাকছিলো ওসমানের। খুব ভোরে উঠে ছাদে মুখ ধুয়ে করমালি ফের বসেছিলো মেঝেতে। ওসমানের জাগরণের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে থাকতে তার ভয় হচ্ছিলো, মানুষটার সঙ্গে দাখা না করেই তাকে বাড়ির দিকে রওয়ান হতে না হয়! করমালি অবশ্য ইচ্ছা করলে আরো কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারে। কিন্তু তাহলে এখানে চাকরি নেওয়ার জন্য আনোয়ার নতুন করে চাপ দেওয়ার সুযোগ পায়। এখন করমালি কি তাই পারে? বৈরাগীর ভিটার বাস্তচু্যত জীন গ্রামে কঁপিয়ে পড়েছে, সব তছনছ করে দিচ্ছে, এই সময় দালানের ভেতর সে বসে থাকে কোন আঞ্চেলে? আনোয়ারের কথা সে রাখে কিভাবে? আনোয়ার ভাইজান মানুষ খুব ভালো। মিয়ারা বলো, গাজীর বলো,-ভদরলোকদের মধ্যে এরকম মানুষ মেলে নাগো দাখো না, কাল রাত্রে করমালি চলে যাবে শুনে কতো রাগ করলো, আবার বেরিয়ে রাস্তা থেকে ফের মশা তাড়াবার কয়েল এন জ্বলিয়ে দিয়ে গেলো, ওসমানের মশারি টাঙিয়ে দিলে, মশা তো তোমাকে একলা পেয়ে সব রক্ত খেয়ে ফেলবে।’-না বাপু, এরকম ভালোমানুষ পাওয়া যায় না। বন্ধুর রোগ নিয়ে তার মাথা এখন গরম, করমালির ছটফটানি সে বুঝবে কিভাবে?-সকালবেলা মেঝেতে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে করমালির চোখ জড়িয়ে আসছিলো। কি, চেংটুর সঙ্গে সে হেঁটে চলেছে কোন নতুন চরের ভেতর দিয়ে। শীতকালের সর-পড়া যমুনায় বুদবুদ উঠেছে। চেন্টু বলছে, একটা খাপি জাল হলে পাঙাস ধরা গেলোনি রে! যমুনার ভেতর বড় পাঙাস ঘাই মারে। খাই মারার শব্দে তন্দ্রা ছিঁড়ে গেলে করমালি দ্যাখে, ওসমান খুব শব্দ করে হাই তুলছে।
চেতন পালেন, ভাইজন? খুব নিন্দ পাড়ছেন গো! ওঠেন, মুখ ধুয়া নাশতা করেন।
জড়ানো গলায় ও খুষি-খাওয়া-ফোলা ঠোঁটে ওসমান কি বলে করমালি বুঝতে পারে না। কি কন, ভাইজান? খিদা নাগছে?
আনোয়ার ঢুকে বলে, হ্যাঁলো ওসমান ঘুম ভাঙলো? এখন ফ্রেশ তো? ওসমান বড়োঁ বড়ো চোখে তাকালে তার চোখের গাঢ় লাল ও খয়েরি রেখাগুলোর রঙ পানসে মনে হয়। এতোহ্মণ ঘুমিয়ে কি তার চোখের অস্থির রক্তচিহ্ন মুছে গেছে?-চমৎকার আনোয়ারের বুক কাপে, ওসমান বোধহয় ভালো হয়ে গেলো! প্রচণ্ড আঘাত বা দুর্ঘটনার লুপ্তশ্ৰুতি ফিরে পাওয়ার কতো গল্প শোনা যায়। ওমসানের কি তাই হলো? কাঁপতে কাঁপতে আনোয়ার বলে, ওসমান ওঠে। মুখ ধুয়ে নাও। চলো আজ একটু বাইরে যাবো। রেক্সে যাবে?
অদ্ভুত ভঙ্গি করে ওসমানে হাসে, চলেন। আপনার গায়ে বুলেট লেগেছে কোথায়? আনোয়ার ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে। ওসমান কি তাকে চিনতেও পাচ্ছে না? তাহলে? সে কি ওসমানের অপরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হলো? করমালি চলে যাচ্ছে। আনোয়ার তো এখন থেকে এখানেই থাকবে। যার কাছে একবার অপরিচিত তার সঙ্গে কাটলে কিভাবে?
মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় আসন পেতে বসে ওসমান বলে, চা খেয়ে চলেন। করমালি নিচে হোটেল থেকে নানরুটি, কলেজির ভুনা তরকারি ও চা এনে দিলে আস্তে আস্তে সব খায়। তার ঠোঁটের ফেলাটা একটু কমেছে, তবে খেতে এখনো কষ্ট হচ্ছে।
এদিকে করমালির ট্রেন বেলা ১২টায়। আনোয়ার তাকে তাগাদা দেয়, করমালি তুমি যাও। গাড়িতে জায়গা না পেলে মুশকিল হবে।’
তাহলে চলেন ভাই।’ বলতে বলতে তক্তপোষ থেকে নেমে ওসমান স্যাণ্ডেল পায়ে দেয়। ছাদে পেচ্ছাব করে এসে জামা গায়ে দেয়, চলেন, আমি রেডি। খিজির তো আরো সকালে বেরুতে বলে গেছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলেন।’
বসো কোথায় যাবে? আনোয়ার ধমক দিলে ওসমান মিনমিন করে, রাগ করেন কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তো আমাকে ডাকলেন না কেন? চলেন। এখনো টাইম আছে।
করমালি ফ্যালফ্যাল করে সব দ্যাখে। আনোয়ার পকেট থেকে টাকা বার করে তার হাতে দেয়, রাখো।’
ট্যাকা দিলেন? করমালি ইতস্তত করলে আনোয়ার বলে, ‘ট্রেনের টিকেট করতে হবে। রাস্তায় খাওয়া দাওয়া—।’
আর পাঁচটা টাকা দিলে ভালো হলোনি ভাইজান। ঢাকা থাকা যামু, বাড়িত ধরেন ছোল পোলগুল্যান আছে, বুড়া বাপ আছে। কিছু খরচ করার হাউস করছিলাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আনোয়ার ছোট্রো করে হাসে, ‘এই অবস্থাতেও তোমার হাউস? তোমার গ্রামে নাকি কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে, এর মধ্যে তোমার হাউস আসে কোথেকে? আনোয়ারের এই বিরক্তির কোনো মানে করমালি বুঝতে পারে না। আফসার গাজী গ্রামে কেয়ামত শুরু করেছে বলে গ্রামবাসীরা কি সখ আহলাদ সব বিসর্জন দেবে? এর চেয়ে ভালো অবস্থা আবার ছিলো কবে?
‘নাও।’ আনোয়ার এবার ১০ টাকার ১টা নোট তার হাতে দিলে করমালি ৫টা টাকা ফেরত দেয়, পাঁচ টাকা হলেই হবো। বাপজানের একখান তবন আর ভাইসতাগোরে গোঞ্জি নিমু। কয়টা কলা নিমু ভাইজান। চেংট্রর বাপের হাতে কলা কয়টা দিলে বুড়ার ব্যাটা এ্যাঁনা খুশি হবো। গাড়ির টিকেট তো করমু না, আর পাঁচ টাকা হলেই হবো।
আরে নিয়ে যাও। ট্রেনের টিকেট করবে না কেন?
গাড়িত উঠি কতো, হামাগোরে টিকেট করা লাগে না ভাইজান। করমালি এবার তোলে ওসমানের প্রসঙ্গ, ভাইজানের অসুখ মনে হয় বাড়তিছে। আজ দ্যাখেন আপনাকে চিনবার পারতিছে না?
অসুখ বাড়বে কেন? আঠারো ঘণ্টা ঘুমিয়েছে, এখন একটু অন্যরকম তো লাগবেই। তুমি যাও। তোমার আবার কেনাকাটা আছে, ট্রেন ফেল করবে। যাও।’
তো যাই ভাইজান! যায়া না হয় খবর দিমু। করমালি দরজায় পৌঁছলে ওসমান দাঁড়ায় তার পেছনে, চলেন। তাড়াতাড়ি চলেন।
সিঁড়ির ধাপে পা রেখে করমালি ফিরে তাকায় ওসমানের দিকে, আপনে শুয়্যা থাকেন ভাইজান। আল্লা বাচালে আনোয়ার ভায়ের সাথে হামাগোরে গাওত একবার আসেন।
‘আঃ! করমালি, ফের দাঁড়াচ্ছে কেন? ওসমানের অবস্থা বুঝতে পাচ্ছে না? বলতে বলতে আনোয়ার দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ওসমানের ঘাড়ে হাত রেখে তাকে একরকম ঠেলে বসিয়ে দেয় তক্তপোষের ওপর। তারপর বন্ধ দরজায় ভেতরের দিকে কড়ায় তালা লাগাতে লাগাতে ওসমানের মিনতি শোনে, আমাকে বাইরে যেতে দিন না ভাই। খিজির ওয়েট করছে, জানেন তো মাটিতে ও পা ঠেকাতে পারে না। বেচারা কতক্ষণ ঝুলবে?
ওসমানের পাশে বসলে আনোয়ারের চোখে পড়ে বিছানার প্রান্তে ৫ টাকার নেট, টাকাটা উড়ে যাচ্ছিলো, আনোয়ার ধরে ফেলে। হ্যাঁ, করমালির ঐ নোটটাই। করমালি কখন যে টাকাটা রেখে দিলো আনোয়ার বুঝতেই পারলো না। করমালির বিদায়ের মুহুর্তে তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ এতোক্ষণ পর কর্কশ হয়ে বাজছে। আনোয়ার ছাদে গিয়ে রেলিঙে ঝুঁকে নিচের রাস্ত দ্যাখে। করমালিকে ডেকে এই টাকাটা দিতে পারলে ভালো হয়। সে না হয় সে নাদু পরামাণিকের হাতে টাকাটা তুলে দিতো।
রাস্তায় রিকশার সারি। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নতুন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের রিকশা এসে অপেক্ষা করছে লাইন ধরে। রিকশার লাইনের ওপার ল্যাম্পোস্টের নিচে পান বিড়ি সিলেটের দোকান। এর একটু দূরে টিনের ডাস্টবিনের পাশে ঝগড়া করছে নেড়ি কুও ও ধুমসি কুওা। আরেকটু দূরে রিকশায় উঠে হুড ঢেকে দিচ্ছে ১ তরুণী। এইসবেরও সামনে ইলেকট্রিক তারের ঝাঁকের নিচে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে করমালি। আনোয়ার ডাকে, করমালি! ও করমালি!
কিন্তু রাস্তায় স্কুটার, রিকশা, নারায়ণগঞ্জগামী বাস, পথচারী মানুষ এবং ঝগড়ায় মত্ত কুকুরদের সমবেত ধ্বনিতে তার স্বর চাপা পড়ে। করমালি ফিরেও তাকায় না, খোড়াতে খোড়াতে চলে যাচ্ছে জনসন রোডের দিকে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৫০
বিকালবেলা আলতাফ ঘরে ঢোকে, তার মাথায় অন্য সমস্যা। কি দোস্ত? এখানে ঢোকাটাই তো মুশকিল। দরজার সামনেও রিকশার লাইন।
‘চুকতে তো তবু পারলে। বেরুনো প্রায় অসম্ভব। সকালে শুনলাম নতুন লাইসেন্স নেওয়ার জন্য রিকশার কিউ নাকি গ্যাণ্ডারিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
সকালে ছিলো গ্যাণ্ডারিয়া পর্যন্ত? এতোক্ষণ তাহলে নারায়ণগঞ্জ। আলতাফ ঠাট্টা করে, কিন্তু ঢাকায় রিকশা বৃদ্ধির সরকারী পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে তার হাসি মুছে যায়, এসব আসলে শয়তানি বড়ো শহরে কখনো রিকশা থাকে? সিটিতে থাকবে অটোমোবাইলস পাঞ্জাবির ঢাকাকে কিছুঁতেই সিটি ডিক্লেয়ার করবে না, বুঝলে? সিটি ঘোষণা করলেই এখনে চাকরিরত যাবতীয় লোককে সিটি এ্যাঁলাউন্স দিতে হবে। শালদের বুক টাটায়। ওদিকে বাঙলার কৃষকের রক্তে গড়ে তোলে করাচি। করাচি কমপ্লিট হলো তো ইসলামাবাদ!
ঢাকাকে সিটি বানালে বাঙলার কৃষকের লাভ কি?
তোমার তো লাভ হয়। তুমি সিটির অধিবাসী হতে পারো। তোমাদের কলেজের গভর্নিং বডিকে প্ৰেশার দিয়ে বাড়িভাড়া বাড়িয়ে নিতে পারো। এক্সট্রা পাওনটা না হয় তোমাদের বিপ্লবের জন্যে চাঁদা দিলে। কথাটা বলতে পেরে আলতাফ খুশি হয় এবং একটু চা খেতে চায়।
দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি। আমার ভাতও খেতে হবে। দুপুরে কিছু খাইনি।
রেস্টুরেন্টে খেয়ে এবং ওসমানের জন্যে প্লেটে খাবার ও সবার জন্যে কেতলিতে চা এনে আনোয়ার দ্যাখে যে ওসমান দাঁড়িয়ে রয়েছে ছাদে, পাশে জুম্মন।
আলতাফকে একটু বিচলিত মনে হচ্ছে, একটু আগে এই ছোকরা এসেছে। ওসমান তো চিনতেই পাচ্ছিলো না। অথচ দাখো এই ছোকরা এসে কি ইশারা করলো আর সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো ছাদে। ওসমানের কথাবার্তা শুনে আমার কিন্তু ভয় করছে।
ওসমানের দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ফুটে উঠছে। আজ সারাদিন তো ভালোই কাটলো। বিড়বিড় করে নানান লোকের সঙ্গে কথা বলা ও ২ সিলেবলের অস্পষ্ট ছড়া আবৃত্তির মধ্যেই তার তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু এখন জুম্মনের পাশে তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে বিপদের সংকেত সেকেন্ডে সেকেন্ডে স্পষ্ট হচ্ছে।-খিজির, আমি রেডি। জুম্মনও এসে পড়েছে। তুমি তোমার জিনিসপত্র নাও। অদৃশ্য খিজিরকে ওসমান তার জিনিসপত্র দেওয়ার প্রস্তাব করতেই জুম্মন নিজের হাফ প্যান্টের পকেট থেকে স্কু-ড্রাইভার ও প্লায়ার বার করে ওপরদিকে তুলে ধরে। ওসমান ধমক দেয়, আরে ওখানে ধরিস কেন? এদিকে।
কিন্তু জুম্মন ওদিকে গেলেও খিজির সেসব স্পর্শ করে না। ওসমান বলে, আরে ও তো অনেক ওপরে, তুই ছুঁতে পারবি না। আমাকে দে। জুম্মন বিনা দ্বিধায় যন্ত্রগুলো ওসমানের হাতে সমর্পণ করে। অদৃশ্য ও ঝুলন্ত খিজিরের হাতে ওগুলো অর্পণ করার উদ্দেশ্যে ওসমান ওপরদিকে লাফ দিলো। খিজির নিশ্চয়ই আরো ওপরে আছে কিংবা এও হতে পারে যে দুষ্টুমি করে ওসমানের ছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্য বারবার স্প্রিঙের মতো ওপরে উঠে যাচ্ছে।
আরে খিজির কি শুরু করলে? তোমার স্কু-ড্রাইভার, তোমার প্লাস না প্লায়ার কি বলে, –এই নাও। একি? কিন্তু খিজির তার আয়ত্তের বাইরেই থেকে যায়, ওসমানের লাফ দেওয়ার গতি ও তীব্রতা ক্রমে বাড়ে। হাইজাম্পে ওর অসাধারণ দক্ষতা দেখে আনোয়ার ও আলতাফ মুগ্ধ। তবে এই দক্ষতা আরেকটু বাড়লেই ছাদের রেলিংটপকে ওসমান নির্থাৎ নিচে পড়ে যাব। ওকে ধরার জন্য তাই ২ জনেই দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু ওসমান প্রতি পলকে জায়গা বদলাচ্ছে। তাছাড়া আরো মুশকিল আছে। পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের অনুকরণে নিজের শরীরকে অক্ষ হিসাবে ব্যবহার করে ওসমান ঘোরে আহ্নিক গতিতে এবং এভাবে ঘুরতে ঘুরতে, বরং বলা যায় ঘুরপাক খেতে খেতে চক্রাকারে আবর্তিত হয় ছাদের অনেকটা জায়গা জুড়ে। এই শেষ তৎপরতাটিকে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের বার্ষিক গতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। তবে পৃথিবী ও অন্যন্য গ্রহ ওসমানের মতো ওপরদিকে লাফায় কি-না তা আনোয়ার বা আলতাফের জানা নাই। এরা ২ জনেই তার পিছে ঘুরছে, তার ২টো উপগ্রহের মতো তার মাধ্যাকর্ষণ এলাকার মধ্যেই থাকছে, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পাচ্ছে না। খিজিরের প্রতি মিনতি জানাতে ওসমান কিসব বলছে, তার কথা মাঝে মাঝে ছন্দোবদ্ধ। তবে এর বেশির ভাগ উচ্চারণ ২ সিলেবলের, এগুলো আদৌ কোনো শব্দ কি-না বোঝা যায় না।
ওসমানের দিকে ছুটছিলো জুম্মনও। আলতাফ হঠাৎ করে তার ঘাড়ে হাত দিয়ে তাকে থামায়, নিজেও থেমে হাঁপায়, তোকে আসতে বললো কে?
তোর ঐসব ইয়ে, মানে খিজিরের ঐ প্লায়ার আর স্ক্রু-ড্রাইভার দেখেই ওসমানের মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। তুই চলে যা না। আনোয়ারও অভিযুক্ত করলো জুম্মনকেই, কিন্তু সে দৌড়ানো থামায়নি।
আলতাফ ফের নতুন উদ্যমে দৌড়াতে শুরু করে, ঐ অবস্থাতেই সে জুম্মনকে নির্দেশ দেয়, ‘তুই যা না বাবা!
মগর আমার পেলাস? আমার ইসকু ডেরাইভার? জুম্মনের এই দাবীর জবাব দেয় আনোয়ার, তুই তো দিয়েই দিলি খিজিরকে দেওয়ার জন্য ওসমানকে দিলি না?
কৈ, ঐ সাবে তো খিজিরের নাগাল পাইতাছে না। ওসমান এইবার অনেক ওপরে লাফ দিয়ে শূন্যের দিকে ছুড়ে দেয় ক্ষু-ড্রাইভার ও প্লায়ার, নাও, খিজির। ধরো! তোমার জিনিস ধরে ফেলো’
জু-ড্রাইভার পড়ে যায় ছাদের এক কোণে। কিন্তু প্লায়ারটা ছাদের রেলিং ডিঙিয়ে পড়লো নিচে। অবশ্য খিজির মাঝপথে ওটা ধরে ফেলে তো আলাদা কথা। ভু-ড্রাইভারটা চট করে কুড়িয়ে নিয়ে চিলেকোঠার ভেতর দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো জুম্মন। রেলিঙে ভর দিয়ে ঝুঁকে আলতাফ দেখলো রাস্তার ধারে ড্রেনে হাত ঢুকিয়ে জুম্মন প্লায়ারটি খুঁজছে। আলতাফ আরো কিছুক্ষণ দেখতো, কিন্তু ওসমান ধপাস করে বসে পড়েছে ছাদে, আনোয়ার তার কাধে হাত দিতে সুবোধ বালকের মতো সে উঠে দাঁড়ায়, চলেন। কোথায় যেতে হবে চলেন।
বিছানায় বসে ওসমান একটু হাঁপাতে হাপাতে বিড়বিড় করে তার দুই-সিলেবল-প্রধান শব্দের পদ্য আবৃত্তি করে চললো। তার চোখ নিচের দিকে, মনে হয় সে যেন নামাজে বসে সুরা পড়ছে। আলতাফ আস্তে আস্তে আনোয়ারকে সাবধান করে দেয়, ‘আনোয়ার, এর কভিশন কিন্তু খুব খারাপ। হাসপাতালে দিয়ে দাও। একটা এ্যাঁকসিডেন্ট হলে—।
দূর! আজ সারাদিন তো ভালো ছিলো। এ্যাঁসোলিউটলি নর্মাল। জুম্মনকে দেখে এই কাণ্ডটা করলো। সীজন চেঞ্জ হলে ইমপ্রভ করবে।’ আনোয়ার বললো বটে, কিন্তু মনে হয়, পাবনাতেই যদি শেষ পর্যও পাঠাতে হয়। রোগীর সঙ্গে ওরা কি কাউকে থাকতে দেয়? না, তা দেবে কেন? তখন? আনোয়ার তখন কি করবে? এই যে এতোদিন পর কলেজ খুললো, মার্শাল ল হবার পরদিনই খুললো, এখন থেকেই আবার বন্ধের পায়তারা চলছে। আবার শোনা যাচ্ছে কলেজ নাকি উঠে যাবে, কলেজের ফান্ড খুব খারাপ। তা উঠলেই কি আর থাকলেই কি, ঐ কলেজে সপ্তাহে ৬টা ক্লাস করা কি কোনো কাজ হলো? ওসমান হাসপাতালে গেলে আনোয়ার ঢাকা থাকবে আর কি করতে করমালিকে কথা দেওয়া হয়েছে, গ্রামে যেতে হবে। আত্মীয়স্বজনের পুরুষানুক্রমিক শয়তানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, তাদের কাছে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া, আবার যাদের সঙ্গে কাজ করবে তাদের নিরঙ্কুশ আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েও অব্যাহত রাখা;-এসব ভাবলেই অবসাদে গা এলিয়ে পড়ে। এই অবসাদ কাটাবার জন্যে ঝাঁঝালো মেজাজে আলতাফকে জিগ্যেস করে, তোমার খবর কি? পলিটিক্যাল এ্যাকটিভিটিস?
ভালো। খুব ভালো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে।
তা তো পাবেই। আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে, মাঠ তো তৈরি করা হয়েছে। এই মাঠকে তোমরা পকেটে পোরার ব্যবস্থা করছে। মুভমেন্টের সময় যেসব লোক পিপলের টার্গেট ছিলো এখন তোমাদের ডানার নিচে এসে গ্রামকে তছনছ করে বেড়াচ্ছে।
ডানা থাকলেই ডানার নিচে মানুষ আসে আনোয়ার। ন্যাশনালিজমের ডাকে নানা ধরনের লোক তো আসবেই। আমাদের নেতা এখন সকলের নেতা। সবাই তাকিয়ে আছে বত্রিশ নম্বরের বাড়িটার দিকে।
কোন কাগজে পড়লাম, বত্রিশ নম্বর নাকি মার্শাল ল-র খবর পেয়ে বাক্স পেটরা সাজিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। আমি এলেই ওদের গাড়িতে উঠে পড়বেন।
ভয়ডর জিনিসটা তার একটু কম। জীবনের অনেকগুলো বছর যার জেলে কাটলো তার আবার ভয় কিসের?
ভয়টা তো জেলের বাইরেই বেশি। বাইরের ঝড়-ঝাপ্টা তার গায়ে লাগে না। মাঝে মাঝে বাইরে এসে ঝড়ে-পড়া আম কুড়াবেন।
ঝড়-ঝাপটা কি সব সময় ভালো? ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার হয়ে লাভ কি?
ঢাল তলোয়ার ছাড়াই যা হলো তাতেই নেতা বেরিয়ে আসতে পারলেন। এখন তার কাজ হলো নিধিরামদের হাতে ঢাল তলোয়ার যাতে উঠতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এই এ্যাঁসাইনমেন্ট তাকে দিলো কে?
র্যাকে মুক্ত করে আনার জন্যে মানুষ বুলেটের সামনে এগিয়ে যায় তাকে কেউ কোনো এ্যাঁসাইনমেন্ট দিয়ে মাঠে নামাতে পারে না, বুঝলে? আলতাফের গলা বেশ চড়ে গেছে, তোমাদের বাড়াবাড়ির জন্য মাশার্ল ল হলো। কয়েকটা দিন দ্যাথো, আমাদের নেতা-।
ওসমানের বিড়বিড় আবৃত্তি হঠাৎ বিকট উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠলো, এবার তার ধ্বনিসমূহ শব্দ বলে চেনা যায়, মার্শাল ল, ইয়েস মার্শাল ল, লিটল লিটল ক খ গ বারবার বললে এর অস্ত্যমিল স্পষ্ট হয়।
সারাদিন এই কথাগুলো আনোয়ার বুঝতে পারেনি, এখন সবগুলো ধ্বনি শব্দ হয়ে ওঠার পর সে ক্লান্ত বোধ করে, আঃ ওসমান, থামো।
ওসমান ধরণা দেয় আলতাফের কাছে, আপনি একটু বলেন না। আপনারা আমাকে রিলিজ করে দিন। আমার কাজ আছে।
ওসমান, আমাকে চিনতে পাচ্ছে না? ওসমানের মাথায় তার নিজের পরিচয় একেবারে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে আলতাফ হন্যে হয়ে ওঠে, আমি আলতাফ মনে নেই? তোমার বন্ধু আলতাফ
ওসমান বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে, কি যে বলেন। আপনাকে চিনবো না কেন? আপনারা দুজনে তো একই র্যাঙ্কের অফিসার, না? কর্নেল? না ব্রিগেডিয়ার? না মেজর?
আনোয়ার বলে, ‘নাও আলতাফ, আর্মিতে এতো বড়ো দুজন বাঙালি অফিসার পেলে। এখন তোমরা খুশি তো?
আপনারা দরজাটা খুলে দিন না! ওসমান এই অনুরোধ করে ফের বিড়বিড় করে আবৃত্তি করে, আগডুম বাগডুম ইন খোলা মাঠ, বন্ধ কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট।
‘আঃ! থামো না ওসমান। আনোয়ারের নির্দেশ ওসমান মানে না, সে আবৃত্তি করেই চলে, দুইজন কর্নেল একখানা খাট, বন্ধ কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট।