প্রিয় আনোয়ার,
তুমি মিছেমিছি গ্রামে গেলে। এখানে রাস্তায় রাস্তায় আগুন জ্বললো তুমি দেখতে পেলে না। বড়ো বড়ো দালান কোঠাও রেহাই পায়নি। আগুন নেভাতে মিলিটারি বুড়িগঙ্গা নদীর প্রবাহ ঘোরাতে গিয়েছিলো, তাতে ফল হয়েছে বিপরীত। রাস্তায় রাস্তায় নদী, নদীর পানির ওপর ভর করে জুলতে থাকে আগুন। খবরের কাগজ পাও? কাগজে এর নাম দিয়েছে নদী ও আগুনের যুগলপ্রবাহ। সেদিন রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমানের মস্ত বড়ো মিটিং হলে এই যুগলস্রোতোধারা চাপা পড়েছে। আমি এত ঘাবড়াই না! আমি তো খিজিরকে চিনি। খিজিরদের horizontal মিছিল দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। কপালে থাকলে তুমি দেখতে পাবে। না পারো তো আমি কি করবো? একটা পদ্য আছে জানো? ‘কেঁদে কেন মরো? আপনি ভাবিয়া দ্যাখো কার ঘর করে! এই পদ্যেই জবাব আছে। ইতি।
ওসমান।
চিঠির বাক্য স্পষ্ট। কিন্তু ওসমান এসব কি লিখেছে? ও কি ঠাট্টা করার লোক? ওসমানকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে, ওর শরীর বোধ হয় খারাপ, কিন্তু আনোয়ার এখন গ্রাম ছেড়ে যায় কি করে? এতো কিছুর পরেও শয়তানদের ফণা নিচে নামে না। চেংটুর পরিষ্কারকরা বৈরাগীর ভিটায় এরা চুটিয়ে মিটিং করে অথচ চেংটুর ওপর রাগ এদের প্রতিদিন কেবল বেড়েই চলে। চেংটুকে নিয়ে ঢাকায় গেলে হতো। কিন্তু ও ঢাকায় যাবে কেন? ওসমানকে এর কথা লিখেছিলো, ওসমানের চিঠিতে কৈ তার কোনো উল্লেখ নাই তো! ওসমানের হলোটা কি? শরীর বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে। নোভালজিন ছাড়া ছেলেটা একটা দিনও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। কতোবার বলা হয়েছে, এ্যাঁসিডিটির রোগীর এভাবে এ্যানালজেসিক খাওয়ার পরিণতি সাঙ্ঘাতিক হতে পারে। পেটে হয়তো আলসার বাধিয়ে বসেছে; এই রোগের জন্যেও চিঠি এলোমেলো হতে পারে। রোগে কষ্টে ওসমানের পাশে থাকার মতো কেউ নাই। ওসমানের প্রতি কর্তব্যবোধ আনোয়ারের মাথায় ১টি কাটা বেধায়: ওর কাছে থাকার জন্যেই একবার ঢাকায় যাওয়া উচিত। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই খোঁচাটা চুলকানোর আরাম দেয়, ঢাকায় যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুম ভালো করে চেপে আসতেই জিন্না এ্যাঁভিনু্যর ফুটপাথ ধরে আনোয়ার হাটতে শুরু করে। হ্যাঁ, আউটার স্টেডিয়ামের দেওয়াল ঘেঁষে ফুটপাথ ধরে তাড়াতাড়ি হাঁটছে। সঙ্গে চেংটু। আনোয়ার খুব খুশি, চেংটুকে নিয়ে সে নানান জায়গায় যাবে। সবাইকে বলবে, এরকম কর্মী কেউ চোখে দেখেছে? ঢাকায় বসে তোমরা বিপ্লবের অবজেকটিভ কন্ডিশন দেখতে পাও, কিন্তু বিপ্লবের হাতিয়ার দেখতে চাও তো চেংটুকে দ্যাখো! কিন্তু চেংটুর হাতে ১টা হাতিয়ার থাকায় আনোয়ার উসখুস করে। ছোকরা তার পাশে ছিলো, এখন চলে গেলো ঠিক পেছনে। সামনে ট্রাফিকের লাল সংকেত জ্বলে উঠেছে, আনোয়ার সামনে এগোতে পারে না। দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে আড়চোখে চেংটুর দিকে তাকায়। চেংটুর দা হাত বদল করে। আনোয়ার দেওয়ালের দিকে আরেকটু সরে। দেওয়ালের ঘষাটায় তার ডান হাতে ব্যথা করছে। হাতের ব্যথায় আনোয়ারের ঘুম ভাঙে।
কোথেকে মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ আসে হঠাৎ করে মনে হয়, মন্টু কোথায়? মন্টু না থাকায় ঘুমের মধ্যে আনোয়ার চলে এসেছে দেওয়ালের দিকে। ডান হাত তার চাপা পড়েছে নিজের শরীর ও দেওয়ালের মাঝখানে। তখন স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে। চেংটুকে সে ভয় পেলো কেন? চেংটুকে ভয় পাওয়ার গ্লানিতে আনোয়ার প্রায় মিনিটখানেক চুপচাপ শুয়ে থাকে। কিন্তু বাড়ির ভেতরের কান্নার আওয়াজ উথলে উথলে উঠছে। হঠাৎ ভয় হয় ঢাকা থেকে কোনো খারাপ খবর এলো না তো? আম্মার ব্লাড প্রেশার আজকাল খুব উঠানামা করে, যে কোনো সময় একটা স্ট্রোক হতে পারে। আনোয়ার প্রায় লাফিয়ে উঠে ভেজানো দরজা খুলে ভেতরের বারান্দায় দাঁড়ায়। উঠানের মাঝামাঝি গোল হয়ে বসে কাঁদছে কয়েকজন চাষী বৌ। না, তার মায়ের দুঃসংবাদে এদের ভেঙে পড়ার কথা নয়। আনোয়ার একটু আশ্বস্ত হলে জমিরের মা এসে তাড়া দেয়, ভাইজান, মুখ ধুয়্যা নেন। নাশতা ঠাণ্ডা হয়্যা গেলো। উঠানে কারা? জমিরের মার কাছে জানা যায় এদের ১জন হলো চেংটুর মা, ১জন তার চাচী, ১জন তার ভাবী এবং আরেকজন চেংটুর স্বামী-পরিত্যক্তা বোন।
চন্দনদহ বাজার থেকে এদিকে আসার রাস্তায় গ্রামের শুরুতেই বুড়ো গাব গাছ। গাব গাছের পাশে ধান-কাটা জমিতে নামবার ঢালে আজ ভোরবেলা চেংটুর লাশ পাওয়া গেছে। আনোয়ারদের বাড়ির বাইরে কাঁঠালতলায় ভিড়। পরিচিত ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে রয়েছে নাদু। তার সামনে হাতলওয়ালা চেয়ারে বড়োচাচা। নাদু মাঝে মাঝে মাটিতে হাতের চাপড় মারে এবং আল্লা ও নিহত চেংটুকে নানাভাবে আহবান করে। পোড়া পা টেনে টেনে ঘুরে বেড়ায় করমালি। উঁচু দাত দিতে তার নিচেকার পুরু ঠোঁট চেপে-ধরা। আনোয়ারকে দেখে তার দাঁতের চাপ শিথিল হয়, ‘ভাইজান, এটা কেমন হলো?
ধরা গলায় বান্দু শেখ বলে, কপাল।
ও চেংটু চেংটু। হারামজাদা তোর নাফ-পাড়া কেটে গেলো? বেন্ন্যামানষের ব্যাটা, চাষাভূষার ব্যাটা, তুই যাস বড়োনোকের সাথে তাল দিব্যার? বিলাপ করতে করতে নাদ
পরামাণিক মাথা রাখে বড়োচাচার পায়ে। বড়োচাচা তারা বিরলকেশ মাথায় আঙুল ছুয়ে ছলছল চোখে তাকায় সামনে।
আনোয়ারকে একটু আড়ালে ডাকে করমালি, ‘ভাইজান বোঝেন তো! আফসার গাজী কালও নাফ পাড়ছে, কয়, কোনো শালাক কিছুঁতেই ছাড়া হবো না। এখন বোঝেন।’
‘আলিবক্স কোথায়? আনোয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আলিবক্স ঠিক বুঝতে পারবে এ সময় কি করা দরকার।
তাই গেছে পুবে, চরের মধ্যে। নদীর ঐ পারে গোরুচোরেরা আবার দল পাকায়! এদিকে পাও দিলে তো এ্যাঁরা আলিবক্স ভাইজানোক সাফ কর্যা দিবো।
‘লাশ কোথায়?
লাশ আছে গাবতলাত। পুলিস না আসলে বলে লাশ ধরা যাবো না।
আনোয়ার বলে, পুলিসে কেস দেওয়া দরকার।
পুলিস করমালির উঁচু দাঁতের চাপে কথাটি এমনভাবে বেরোয় যে মাথা নিচু করে আনোয়ারকে একটু সরে দাঁড়াতে হয়।
গাবগাছতলায় ভিড় আরো বেশি। শহরের ছাত্রকর্মীরা এসেছে মেলা, আজ কর্ণিবাড়ি স্কুলের মাঠে জনসভা, তারই প্রচার করে বেড়াচ্ছে। কাঁদের হাতে চেংটু মারা পড়লো, এ নিয়ে কারো স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারণা নাই, কিন্তু তার মৃতদেহ নিয়ে তারাই মিছিল করতে চায়। এই মৃতদেহ তারা পুলিসকে ছুঁতে দেবে না। খোড়াতে খোঁড়াতে করমালি এখানে এসে পড়েছে। আনোয়ারকে ডেকে বলে, ‘ভাইজান, আপনে কন না কিসক? এতোগুলা শিক্ষিত মানুষ আসছে, চেংটুকে কারা মারবার পারে, কি সমাচার কয়া দেন না!
কিন্তু প্রমাণ ছাড়া আনোয়ার আন্দাজে কথা বলে কিভাবে? এর ওপর চেংটুর বড়োভাই সোটকা পরামাণিক তেড়ে আসে করমালির দিকে, ‘হামার ভায়েক খায়াও তোরগোরে খিদা মেটে নাই? তোর কি? তোর পাওখানই পুড়ছে, পাও পুড়া তোর শালা এখন ভিক্ষা করার জুত হবো! তোরা বাপব্যাটা এখন একসাথে বাজারেত বস্যা থালি ধরলেই পয়সা।
ছাত্রদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় তারাও এই মৃতদেহ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চায় না। এসব করা মানে আজকের মিটিঙের বারোটা বাজানো। তাদের কাছে চেংটুর বাবার করুণ বাসনাটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য জালালউদ্দিন তৎপর। চেংটুর মৃতদেহ বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দাকে আরো উত্যক্ত করে তুলতে পারে। তাড়াতাড়ি ছেলের দাফন হলে তার রুহের আরাম হয়, জীন এবং পুলিসের ঝামেলা থেকে জীবিত লোকজনও রেহাই পায়। আনোয়ারের বড়োচাচারও ইচ্ছা তাই। ২পুরুষের চাকর নাদু পরামাণিকের ইচ্ছাটা পূরণ করার জন্য বড়োচাচা বড়ো উদগ্রীব।
আনোয়ার তাকিয়ে থাকে চেংটুর মুখের দিকে। ঠোঁটজোড়া তার দারুণভাবে চেড়ে-ধরা। কানের নিচে ছুরির গভীর দাগ। খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি সজারুর কাটার মতো খাড়া হয়ে চেংটুর মুখটাকে সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে দিয়েছে।
৪দিন পর আনোয়ার আরেকটা চিঠি পায়। শওকত ভাই ঠিকানা পেলো কোথায়? আনোয়ার ঠিক এতোটা ভাবেনি, ওসমানের অবস্থা যে রকম হয়েছে সে কল্পনাও করেনি। ওসমানকে প্রায়ই নাকি দ্যাখা যায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। স্টেডিয়ামের বারান্দায় ১দিন চিৎকার করে দৌড়াতে দ্যাখা গেছে। কাপড়চোপড় পরে খুব নোংরা। কথাবার্তার ব্যালান্স নাই। আনোয়ারের কথা খুব বলে, আনোয়ারের বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে দ্যাখা করে ওর খবর নিয়েছে কয়েকবার। আনোয়ার কি কয়েকদিনের জন্যে ঢাকায় আসতে পারে? ওসমানকে দ্যাখাশোনা করা দরকার। কয়েকদিনের জন্যে বিপ্লব স্থগিত রেখেও আনোয়ার যেন একবার ঢাকায় আসে।-চিঠি পড়তে পড়তে আনোয়ার উদ্বিগ্ন হয়। আবার চিঠি পড়া শেষ হলে বুঝতে পারে যে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত আরো বেশি। ঢাকায় যাওয়া খুব দরকার। মাথার ভেতর তার নতুন হাওয়া খেলে এবং হাতপাগুলোর আড়ষ্টতা কাটে। শওকত ভাইয়ের ওপর এতোটা কৃতজ্ঞতা বোধ করে যে তার ছোটো শ্লেষটুকুওমিষ্টি লাগে।