ঘরে শুয়ে হ্যারিকেনের আলোয় আনোয়ার ময়লা সাদা সিলিঙের কালচে সবুজ কড়িকাঠ দ্যাখে। বৈরাগীর ভিটায় মেজোমামা এখনো গলাবাজি করেই চলেছে। মেজোমামার সঙ্গে একবার দাখা হলে ভালো হয়। বৈরাগীর ভিটায় একবার গেলে হতো। কিন্তু গণ-আদালত নিয়ে ওখানে যে ধরনের কথাবার্তা চলছে তাতে যাওয়াটা ঠিক নিরাপদ নয়। মেজোমামার ওপর রাগও হয়, লোকটা কি বোকা, না সুবিধাবাদী? গতবার জাতীয় পরিষদের ইলেকশনে যারা তার সঙ্গে বিট্রে করলো, তাদেরই ১জন মৌলিক গণতন্ত্রী পদ থেকে রিজাইন করে তার মিটিঙে প্রিজাইড করে, আর মেজোমামা কি-না তাদের মতো লোকদের নিয়ে এ গ্রাম সে -গ্রাম করে বেড়াচ্ছে? মেজোমামাকে একবার এসব কথা বললে হতো। মেজোমামাই রাজনীতিতে তার প্রথম আগ্রহ তৈরি করে। ছেলেবেলায় তার কাছ থেকে কতো কতো বই পেয়েছে। রাজনীতির সোজা সোজা বইগুলো সব মেজোমামার দেওয়া। ক্লাস নাইনে উঠে উপহার পেলো, জানবার কথা’র দশ খণ্ড। কলেজে পড়ার সময়ও বইগুলো তার যা কাজে এসেছে। তারপর লোকায়ত দর্শন’, ‘মার্কসবাদের অ আ ক খ’। সব মেজোমামার দেওয়া। ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময়েই মেজোমামা নেতাগোছের লোক। ভাষা আন্দোলনের সময় কোন হলের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক কিংবা কি যেন ছিলো। ক্লাস-ফাইভে-পড়া আনোয়ারের কাছে মেজোমামা তখন হিরো। রাজনীতির জন্যেই সি এস এস পরীক্ষা দিলো না। পরীক্ষা দিলে এতোদিন নির্থাৎ জয়েন্ট সেক্রেটারি। আব্বা কতোবার চাপ দিয়েছে বুলু, পরীক্ষাটা দে। নতুন দেশ, চাকরিতে ঢুকলেই লিফট তা দেশোদ্ধার করবে বলে মোজোমামা চাকরির মোহ ছাড়লো, এতো সাধের ঢাকা শহর,-তাও ছাড়লো। নিজের জেলা-শহর ওকালতি করে, বিরোধীদলের রাজনীতি করে মেজোমামা অবশ্য এখন চমৎকার পজিশন করে নিয়েছে। পার্টি পাওয়ারে এলে মন্ত্রিত্ব সুনিশ্চিত। অন্তত উপমন্ত্রী তো হবেই। কিন্তু মেজোমামার মন্ত্রিত্ব বা উপমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনায় একটু বিরক্ত হলেও তার সঙ্গে দ্যাখা কররা ইচ্ছাটা আনোয়ারের কমে না। মনে হয় মিটিং শেষ করে মেজোমামা একবার এখানে আসবেই। এতোদূর এসে বড়োবুবুর শ্বশুরবাড়িটা ঘুরে যাবে না?–তাহলে বড়ো ভালো হয়। আনোয়ারকে বৈরাগীর ভিটায় যেতে হলো না, আবার মামার সঙ্গে দ্যাখাও হয়েও গেলো! এই সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে তার বুকের বদলে পা নাচতে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘণ্টা দুয়েক পর পাশের ঘরে কথাবার্তার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে। প্রথমে কেবল ধ্বনি, তারপর অন্ধকার। বড়োচাচার কথা শোনা যাচ্ছে, অন্ধাকারের কারণটা বোঝা যায়, বড়োচাচা বোধহয় হ্যারিকেনটা নিয়ে গেছে।
নিশ্চিত হয়ে আনোয়ার পাশ ফিরে শোয়। হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে ঢোকে মন্টু, ভাইজান, ঘুমাচ্ছেন?
তোমরা কখন এলে?
ঘণ্টাখানেক হবে। আব্বা আপনাকে ডাকতে নিষেধ করলো।
বড়োচাচা এসেছেন? বড়োচাচী?
আম্মা আরো কয়েকটা দিন দেখে আসবে। আমরাই আসতে সাহস করি না। ইয়াসিন মামা আজমিটিং করতে আসলো, আমরা তার জিপে আসলাম। গ্রামের কনডিশন তো এখন অনেক ভালো দেখতেছি। আম্মাকে পরশুদিন নিয়া আসবো।
বড়োচচা শুয়ে পড়েছে?
না, এখনো খাওয়াই হয়নি।—আপনের খুব দুর্ভোগ গেলো, না? আপনেও কাম পান নাই ঐ হুজ্জতের মধ্যে ঢুকছেন!
বড়োচাচা কি করছেন?
আব্বা গল্প করে জালাল ফুপার সঙ্গে। জালাল ফুপ চন্দনদহ বাজার থাকা ইয়াসিন মামার সঙ্গেই আছে। জালাল ফুপা আপনের কথা খুব কয় তা আপনে ওদের সঙ্গে থাইকা ভালোই করছেন। ফুপ কয়, আপনের হেলপ না পাইলে খয়বার চাচা নাকি বাঁচতোই না!
আমার হেলপ? আনোয়ার রেগে ওঠে, আমি ঐ প্রফেশনাল মার্ডারারকে হেলপ করতে যাবো কোন দুঃখে? শুওরের বাচ্চা কতো মানুষকে খুন করেছে, কতো লোকের সর্বনাশ করেছে, জানো? আমি ওকে হেলপ করবো?
কি যে কন আনোয়ার ভাই! হাজার হলেও মুরুব্বি তো!
আরে রাখো তোমার মুরুব্বি একই গ্রামে থাকো, আর জানো না? মানুষের গোরুচুরির গ্যাঙের সঙ্গে ব্যাটা জড়িত, জানো না?
আনোয়ার তুমি ঘুমাও নাই বাবা? লণ্ঠনের আলোতে জালালউদ্দিন মাস্টারের দীর্ঘ শরীর ছায়ার মতো দোলে। আনোয়ার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়, চলেন, ঐ ঘরে চলেন। মন্টু বরং একটু ঘুমাক!
পাশের ঘরে খেয়ে উঠে ইজিচেয়ারে বসে বড়োচাচা খিলাল করছে। আনোয়ারকে দেখে বলে, কয়েকদিন তোমার খুব কষ্ট হলো, না? জমিরের মাকে ভালো করা বলা গেছিলাম। বড়োচাচার সাময়িক নীবরতার সুযোগে জালাল মাস্টার তার আগেকার প্রসঙ্গ টেনে আনে, এই চ্যাংড়াক জিজ্ঞাসা করা দ্যাখেন।
কি? আনোয়ার জানতে চাইলে জালালউদ্দিন বলে, চেংটুর উপরে আমরা যতো দোষারোপ করি, ছোড়া সেদিন বৈরাগীর ভিটা সাফ না করলে গায়ের মধ্যে এরকম বৃহৎ সভা হবার পারে?
জালালউদ্দিন বিস্তারিতভাবে জানায় যে চন্দনদহের মিটিং সেরে ইয়াসিন সায়েব চলেই যেতো, তার জিপ তো রেডিই ছিলো। বেঁকে বসলো এই জালালউদ্দিন। কেন?-না, তা হয় না। এই এলাকা, এই সমগ্র থানা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের গ্রামের লোক। সেই গ্রামে ১টা মিটিং হতেই হবে। ইয়াসিন সায়েব হাসে, গোটিয়ায় মিটিং করার জায়গা কোথায়? আমি বৈরাগীর ভিটার কথা কই তা ইয়াসিন ভাই কয়, আরে মাস্টার সায়েব, বটগাছের ডালে ঝুলতে ঝুলতে মানুষ ভাষণ শোনে? আর আমি ভাষণ দেবো মগডালে চড়ে?—আবার আফসার গাজীও লম্ফ ঝম্প করে, আরে না ঐ গ্রামে সভা করার জায়গা নেই। তা আমি কই, একবার চলেন, গেলেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়। ছেলেপেলে বটগাছের অর্ধেক সাফ করছে না? চেংটু একলাই পরিষ্কার করছে বারো আনি ভাগ।
বড়োচাচা হাই তোলে, চেংটুর কথা বাদ দেন। শালা খুনী, মানুষ খুন করার জন্য শালা লাফ পাড়ে। প্রসঙ্গটি এখানেই শেষ করার জন্য বড়োচাচা আনোয়ারকে বলে, তোমার মামার সাথে দ্যাখা করলা না কেন? দরগাতলার সরকার বাড়িতে তার জেয়াফত, আসগর সরকার একরকম জোর করাই নিয়া গেলো, কাল কৰ্ণিবাড়ি ইস্কুলের ফিল্ডে মিটিং আসরের বাদ। যদি যাও তো দ্যাখা হবে। একটু থেমে ফের বলে, অবশ্য তুমি যদি সময় করতে পারো, তোমরা সব ব্যস্ত মানুষ!’ বড়োচাচার এই শ্লেষটি আনোয়ার হজম করে। বড়োচাচা কিন্তু থামতে পারে না, তোমরা ময়মুরুব্বি মানো না। তোমার মামা খুব আঘাত পাইছে।’
‘কেন?’
কেন তা তুমি নিজেই জানো। খয়বার গাজী নিজেই বগুড়া গিয়া তাকে সব বলছে।
‘খয়রার গাজী এখান থেকে পালিয়ে মেজোমামার সঙ্গে দ্যাখা করেছে? খয়রার গাজী আইয়ুব খানের পাড় দালাল, আর মেজোমামা জেল খেটে বের হলো সেদিন!—
তোমরা খালি পলিটিক্স দ্যাখো। আত্মীয়তা কুটুম্বিতা সব বাদ দিবা?
খয়রার গাজীর প্রাপ্য শাস্তি তাকে দেওয়া হয়েছিলো। লোকটা পালিয়ে না গেলে-
আনোয়ারের কথা শেষ না হতেই জালালউদ্দিন বলে, না ভাইজান, শোনেন, আনোয়ারের জন্যেই খয়রার গাজীর প্রাণহানি হলো না। নামাজের বুদ্ধিটা না করলে।
নামাজের বুদ্ধি আমি করিনি। খয়রার গাজী যতো ক্রাইম করেছে, যতো লোক হত্যা করেছে, যতো মানুষের গোরু চুরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে-।
সেই হিসাব করবে গভমেন্ট। বড়োচাচা ধমক দেয়, তুমি পলিটিক্স করো আর এই সোজা কথাটা তোমার মাথায় ঢোকে না? ইলেকশনে উইন করো, গভমেন্ট ফর্ম করো, তারপর অপরাধীদের ধরে শাস্তি দাও। পশ্চিমাদের খেদাবার আগেই যদি নিজেদের আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি ধ্বংস করা শুরু করো তো ফায়দা লুটবে কারা?—বোঝাই যায় এসব কথা মেজোমামার বক্তৃতার উদ্ধৃতি। উদ্ধৃতি প্রয়োগের পর বড়োচাচা নিজের মন্তব্য ঝাড়ে, তোমার বাপের ছেলেবেলার বন্ধু, খেলার সাথী, তার সাথে কি আচরণটা তুমি করলা, এ্যাঁ?
না না ভাইজান, ভুল বুঝবেন না। আনোয়ারকে রক্ষা করার জন্য জালালউদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয় আনোয়ার নিজেই, আব্বার বন্ধু, কিন্তু গ্রামের লোকদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কিরকম?
আমরাও তো গ্রামেরই লোক।
আপনি খালি খালি লোকটাকে সাপোর্ট করছেন বড়োচাচা। আপনার কোনো উপকারে আসে খয়রার গাজী ? কয়েক বছর ধরে তো আপনার সঙ্গে গোলমাল করেই চলেছে।
লাভ লোকসান, উপকার অপকার দিয়া সব বিচার করি না বাবা! জলচৌকিতে জায়নামাজ বিছায় বড়োচাচা, আত্মীয় তো! জ্ঞাতি না হলেও কুটুম্ব। আমাদের মধ্যে বিয়াশাদি চলে আজ কয়েক পুরুষ ধর্যা। আমার দাদা ভিন্ন মজহাবে গেছেন, বাবাও কড়া আহলে হাদিস ছিলেন, সম্পর্ক তো তাও নষ্ট হয়নি। আত্মীয়তা বন্ধ হয়নি। এখন উটকা মানুষের সাথে একজোট হয় আত্মীয়স্বজনের বেইজ্জত করা-এসব কি ভালো কাজ?
জায়নামাজ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বড়োচাচা বলে, তোমার একটা চিঠি আছে। আমার জামার পকেটে দ্যাখো।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৪
বিছানায় দেওয়াল ঘেষে ঘুমাচ্ছে মন্টু। ওর পাশে বসে আনোয়ার খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করে। ওসমানের হাতের লেখা বরাবরই খুব জড়ানো, কিন্তু এরকম দুর্বোধ্য তো কখনো ছিলো না। মনে হয় একটানে গোটা চিঠি লেখার চেষ্টা করেছে। হ্যারিকেনের সলতে উসকে দিয়ে ১টা ১টা করে অক্ষর ধরে ধরে অনেক কষ্টে আনোয়ার চিঠির পাঠোদ্ধার করে।