সারাটা দিন ঘরেই কাটলো, সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও খিজিরের পাত্তা না পেয়ে ওসমান বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালাবার জন্য সুইচ টিপলো।
কারেন্ট নাই। খিজিরই কি বিদ্যুৎ নিয়ে গায়েব হয়ে গেলো!
নিচে নামতে নামতে ওসমান দ্যাখে রঞ্জুদের ঘরের দরজা খোলা। হ্যারিকেন জ্বলছে, মানে এখানেও বিদ্যুৎ নাই। খিজির আবার এখানে ঘাপটি মেরে বসে নাই তো?-না। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে মকবুল হোসেন আমন্ত্রণ জানায়, আসেন আসেন। খবর জানেন তো?
খিজিরের খবর জানতেই তো ওসমান এসেছে, কি? খিজির-।
মকবুল হোসেন তাকে শেষ করতে দেয় না আরে আজকের খবর জানেন না? শেখ সায়েব তো রিলিজড!
বলেন কি? ওসমান এবার রাস্তায় মানুষের উল্লাস শুনতে পায়।
হ্যাঁ। আমি প্রথমে ভাবলাম রিউমার। পরে রঞ্জু আইস্যা বলে—
রঞ্জু নিজেই কথা বলে। শেখ মুজিবুর রহমানকে দ্যাখার জন্য রঞ্জু আজ একা একা অনেক ঘুরেছে। ধানমণ্ডিতে ৩২ নম্বরে গিয়েছিলো, শোনে যে মিছিল করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শহীদ মিনার। রানু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে না, তুই দেখবি ক্যামনে? এতো মানুষের মধ্যে দেখতে পারলি?
পারবো না ক্যান? উনি শহীদ মিনারে উঠছেন, আমি উইঠা দাঁড়ালাম উল্টাদিকের একটা দেওয়ালের উপরে। কতো মানুষ গাছে উইঠা দেখছে!’
রানু আফসোস করে, আমি দেখতে পারলাম না।
রঞ্জু আশ্বাস দেয়, কাল দেখতে পারো। কাল রেসকোর্সে শেখ সায়েবের মিটিং।
রেসকোর্স মকবুল হোসেন অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে, রেসকোর্স, না পল্টন?
রেসকোর্সই হবে। ওসমান সমর্থন করে রঞ্জকে, পল্টনে আগুন জ্বলছে। শাহবাগ এলাকায় আগুন নেভাবার জন্য আর্মির লোকজন রেসকোর্সের কাঠের রেলিং ডিঙিয়ে রাস্তায় নামছে। মিলিটারি নদীকে টেনে এনেছে। নদী আর আগুন নেভাবে কি? বরং নদীর পানির ঝাপটায় আগুন আরো বাড়ে।
রঞ্জু বলে, কি বললেন? নদী?
‘হ্যাঁ। নদীর ওপর আগুন জ্বলছে। নদীর স্রোতে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ছে।’
মকবুল হোসেন উঠে দাঁড়ায়। তার বোবা মেয়েটা তেলনুন মাখানে মুড়ির গামলা নিয়ে আসে, সে-ও বাপের পাশে দাঁড়ায়।
রঞ্জু বেশ মজা করে বলে, আপনি বোধহয় নৌকায় বইসা দেখলেন?
মকবুল হোসেন ছেলেকে থামায়, আঃ রঞ্জু তার ভয় ওসমান আবার লাফালাফি শুরু না করে। তার সমস্ত তৎপরতা কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই ভালো হয়।
রানুর পাতলা ঠোঁট যেন আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটু রেখা নাই, ঠোঁটজোড়া কি পাথরে পরিণত হলো? কিন্তু রানু কি রঞ্জু কি মকবুল হোসেন-কারো দিকে ওসমানের খেয়াল নাই। তার নিজের চোখে দ্যাখা আগুন ও নদীর ঘটনা সে বর্ণনা করে চলে।
বলতে গেলে আগুন ও পানির পটভূমিতে বিশাল জনসমাবেশ দাখার আশায় ওসমান পরদিন গেলো রেসকোর্স। রেসকোর্সে দারুণ ভিড়। কয়েক লক্ষ মানুষ মিটিং শেষ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশাল মাঠ পেরিয়ে লোকজন কাঠের রেলিঙ ডিঙিয়ে রাস্তায় নামছে। সবাই কথা বলেছে, সবাই শ্লোগান দিচ্ছে, জেলের তালা ভেঙেছি’-‘শেখ মুজিবকে এনেছি। ঐ চলন্ত সমাবেশে ১টি ছোটো ঢেউয়ের মতো দুলতে দুলতে ওসমান সামনে এগোয়। কিন্তু নাঃ আগুন কোথায়? এই রেসকোর্স পার হয়ে শাহবাগ এ্যাঁভেনু্যতে সেদিন ছিলো বুড়িগঙ্গার স্ফীত প্রবাহ, তার ওপর জুলছিলো আগুনের স্রোত। আজ কি আবার শুকনা ও নেভানো রাস্তা জেগে উঠলো? আগুন কোথায়? নদী কি শেষ পর্যন্ত আগুন নিভিয়ে ফের ফিরে গেছে নিজের খাতে? আগুনের খোজে গোটা মাঠ ঘুরে ওসমান এপাশে এসে রাস্ত Tয় নামে। মাঝে মাঝে ছাত্রদের একেকটি দল, নাচতে নাচতে ইউনিভারসিটির দিকে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু আগুন কোথায়? এই কয়েকদিনে কারফ্যু দিয়েও আগুন নেভানো যায়নি, আজ এতো মানুষ বেরিয়ে এলে কি শালার আগুন একেবারে নিভে গেলো?
এদিকে রোদ পড়ে আসছে। উৎসবমুখর মানুষ ঘরে ফেরে। বুকটা ওসমানের ফাকা ফাকা ঠেকে। হতাশ হয়ে সে নুয়ে নুয়ে হাটছিলো। এমন সময় ঢাকা ক্লাবের দিক থেকে গোলমাল শোনা যায়। আহা! এবার আগুন লাগবে। আহারে। এবার যদি আগুন লাগে। কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজের প্রায় সঙ্গে ছুটে যায় ১টা জিপ। ঢাকা ক্লাবের ভেতর থেকেই জিপটা বেরিয়েছে। কয়েকটা মানুষ পায়ে ও উরুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেছে। লাগাঁও! রাগে ও উৎসাহে ওসমান ঢাকা ক্লাবের দিকে দৌড়ায়। আহ! ভালো করে আগুন ধরাতে পারলে দালানটা চমৎকার জ্বলে উঠবে, তার আভায় লাল হয়ে উঠবে চলন্ত সমাবেশটি। ঢাকা ক্লাবের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে মানুষ। মূল দালানের বাইরে এক জায়গায় শূন্য মদের বোতল ও বিয়ারের কেন স্তূপ করে রাখা। লোকজন সেইসব তুলে নিয়ে ছুড়তে শুরু করে ভেতরের দিকে। ওসমানও ২টো বোতল ছুড়ে কি হবে? কিন্তু তার ইচ্ছা এখানে আগুন লাগানো হোক। তাই চৎকার করে ওঠে, আরে ভাই বোতল ছুড়ে কি হবে? আগুন লাগান, আগুন লাগান। —উত্তেজনায় সে লাফায়, ‘আগুন জ্বলো আগুন জ্বলো।
ক্লাবের ভেতর থেকে কয়েকজন সাহসী পুরুষ বেরিয়ে এলে বেশ কয়েকজন বোতল নিক্ষেপকারী শ্লোগান দেয়, আগুন জ্বলো, ‘আগুন জ্বালো!
এর মধ্যে বাইরের কয়েকজন তরুণ ঢুকে পড়লে ঐসব সাহসী পুরুষদের কেউ কেউ তাদের দিকে এগিয়ে যায়, এসবের মানে কি? আমরা কি বাঙালি নই?
ওসমানও ছেলেদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, আগুন জ্বালান, আগুন জ্বালান। এরা সব কলেজ ইউনিভারসিটির ছাত্র, আগুন জ্বালাবার পরিচালনা তো এদেরই হাতে। একজন পকেটে হাত দিয়ে ফের খালি হাত বের করে আনলে ওসমান তাকে দেশলাই দেয়, ‘আগুন জ্বালান। তরুণ নিম-ছাত্রনেতা দেশলাই নিয়ে সিগ্রেট ধরায়, ধন্যবাদ। তার সঙ্গী যুবকটি জুতমতো জায়গা বেছে নিয়ে উত্তেজিত বোতল নিক্ষেপকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা ঝাড়ে, ভাইসব, আপনারা এই জায়গা ছেড়ে দয়া করে চলে যান। আমাদের আন্দোলন এখন চূড়ান্ত সাফল্যের পথে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্ত করে এনেছি। এই ক্লাব, এইসব দালান-কোঠা,-সব এখন আমাদের সম্পত্তি। বাঙালার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এসবের মালিক। এসবের ক্ষতিসাধন করা মানে নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগানো। গোলটেবিল বৈঠকের প্রাক্কালে এরকম উচ্ছঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের সাফল্যের পথে বিয়ের সৃষ্টি করবে। ভাইসব-‘
তার কথায় এবং অন্যান্য তরুণ নেতাদের অনুরোধে লোকজন হতে একেকটি হুইস্কি বা জিন বা ব্রাণ্ডির শূন্য বোতল কি বিয়ারের খালি টিন নিয়ে ঢাকা ক্লাব ছেড়ে চলে যান। ওসমান অবশ্য কোনো খালি বোতল নেয়নি।
ওদের বাড়ির সামনে রাস্তায় ছোটোখাটো জটলার সামনে কথা বলছে আলাউদ্দিন মিয়া। দেখে ওসমান বেশ খুশি, আলাউদ্দিন মিয়াকে বলে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু লোকটা কথা বলছে অন্য ১টি বিষয়ে। কি ব্যাপার? না, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের ওপর সে খুব চটা -এদের আক্কেলটা দ্যাখো! কিসব দাবী নিয়ে স্ট্রাইক করেছে, ১০ ঘণ্টা হয়ে গেলো কোথাও কারেন্ট নাই। আরে বাবা, এইভাবে ধর্মঘট করলে কষ্ট পায় কারা? তারা কি বাঙালি নয়? হাসপাতালে বাঙালি রোগীদের কতো কষ্ট বাঙালির হাতেই তো পাওয়ার আসছে, নেতা বেরিয়ে এসেছে, তার কথা শোনো! এই যে ঢাকা ক্লাবের সামনে গোলমাল করতে গিয়েছিলো, এর কোন মানে হয়? ঢাকা ক্লাব কি পাঞ্জাবির পকেটে করে নিয়ে যেতে পারবে? বাঙালির সম্পদ নষ্ট হবে বাঙালির হাতে?-বক্তৃতা দিতে দিতে আলাউদ্দিন মিয়ার গলা শেষের দিকে ধরে আসে।
তার সাময়িক বিরতির সুযোগে ওসমান বলে, ঢাকা ক্লাবর ভেতর থেকে একটা জিপ বেরিয়ে পাবলিকের দিকে গুলি করে। মানুষ তাই একসাইটেড হয়ে গিয়েছিলো। আজ ওখানে আগুন ধরালে ঠিক হতো!
আরে, আপনে আবার রাস্তায় বারাইছেন? আলাউদ্দিন মিয়ার ভারাক্রান্ত গলা এখন খরখরে হয়ে উঠে, ঘরে যান। মাথার নাই ঠিক-ঠিকানা, উনি অহন লেকচার দিবার আইছেন? যান!
কার হাতে ১টা ট্রানজিস্টার বাজছে। মাঝে মাঝে বিশেষ ঘোষণা বলা হচ্ছে। আলাউদ্দিন মিয়া বলে, ‘শোনেন, ভালো কইরা শোনেন। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ১টি বাণী বারবার প্রচার করা হচ্ছে। রেসকোর্সের লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে আজ এই শপথ নেওয়া হয়েছে যে শহীদদের রক্তে রঞ্চিত আন্দোলন যেন উত্তেজনা সৃষ্টির দ্বারা লক্ষভ্রষ্ট না হয়। সব রকম প্ররোচনা ও উত্তেজনার মুখে তার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী যেন আইন, শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষা করেন।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪৩
কাঁঠালতলায় অন্ধকার। রাস্তার ওপার মরিচ ও বেগুনের ছোটোখাটো খেত পেরিয়ে জোড়পুকুরের ওপরকার পাতলা কুয়াশা ওপারের ন্যাড়া মাঠকে ঝাপশ করে তুলেছে। একটু দূরে বৈরাগীর ভিটায় হ্যাঁজাক লণ্ঠনের সাদা আলো, কিন্তু সেই আলোর একটু ছটাও এখানে আসেন। ঐ আলো এখান থেকে দ্যাখা যাচ্ছে বলে বরং এখানকার অন্ধকার আরো জমাটবাধা। একই নিয়মে বৈরাগীর ভিটার হৈচৈ এবং বক্তৃতায় এখানকার নীবরতা আরো ঘন হয়। বৈরাগীর ভিটায় মাইকে বস্তৃতা চলছে, আনোয়ার সব শুনতে পাচ্ছে, দীর্ঘ বক্তৃতা, গলাটা খুব চেনাচেনা ভাইসব, অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে আমাদের আন্দোলন আজ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। বাঙলার জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙলার মানুষ আজ পশ্চিমাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে। এই বিজয় সম্ভব হলো কেন?-এই বিজয়ের একমাত্র কারণ হলো বাঙালির জাতীয় ঐক্য। কিন্তু ভাইসব, ঐক্যের প্রয়োন কি শেষ?-না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র আজো চলছে। এই মুহুর্তে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে হানাহানি করি, বাঙালি হয়ে বাঙালির বাড়ি জ্বালাই, এক হত্যা করে, ওর ফসল কেটে নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করি তার সুযোগ নেবে কারা? বলুন কারা? যারা বারোশো মাইল দূর থেকে আমাদের সম্পদ শোষণের কর্মে লিপ্ত, যারা আমাদের সোনার বাঙলাকে আজ শশানে পরিণত করেছে, যারা বাইশ বৎসর ধরে বাঙলাকে তাদের বাজার ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা- ৷ শিক্ষিত লোকের ভরাট গলা। বোধহয় ঢাকা থেকে এসেছে, জেলার কোন নেতাও হতে পারে। মনোযোগী হলে লোকটাকে বোধহয় চেনা যায়, কিন্তু আনোয়ার বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। চোখের সামনে অন্ধকার হঠাৎ অন্ধকারতর একটি ছায়া তৈরি হলে আনোয়ার ভয়ে চিৎকার করে, কে?
ভাইজান একলা বস্যা আছেন? নবেজউদ্দিন হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়ে।
‘নবেজউদ্দিন? কোথেকে?
বৈরাগীর ভিটাত সভা হবা নাগছে। সভাত গেছিলাম।
সভা শেষ হয়ে গেলো?
এখনি? নবেজউদ্দিন ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে থুথু ফেলে, সভা তামান আতই ব্যান চলে! আপনের মামুর ভাষণ চলতিছে, এইতো শোনাই যায়।
আমার মামু?
‘ছ, বগুড়া টাউন থাকা আপনের মামু আসছে তো। সাক্ষাৎ হয় নাই? মেজোমামার বস্তৃতা আনোয়ার আগে কখনো শোনেনি। তবে মেজোমামার এমনিতে কথা বলে চমৎকার। তা মেজোমামা এসেছে, আনোয়ার কোন খবরই পেলো না। নবেজউদ্দিন আরো তথ্য দেয়, ‘চন্দনদহ বাজারের সভা শ্যাষ করা এটি আসছে। আপনার চাচাও তো সাথে আসছে। তারা সোগলি যায়া গাজীগোরে পোড়া ঘরগুল্যান দেখ্যা আসলো। টাউনেত থাকা, ঢাকাত থ্যাকা কতো ছাত্র আসছে। চন্দনদহের বাজারে মস্ত বড়ো সভা হলো। তা হামি কই ভাইজান, ঐ সভা হামাগোর বৈরাগীর ভিটার এই সভার লাকান জমে নাই। আত না হলে কি সভা জমে?
‘চন্দনদহের মিটিঙে আর কে কে ছিলো?
আফসার গাজী আছিলো, তাই সব বন্দোবস্ত করা দিলো!
আফসার গাজী? আনোয়ার প্রায় বিষম খায়, আফসার গাজী না পালিয়ে গেছে ও ব্যাটা এসে জুটলো কোথেকে?
আনোয়ার ১বার উঠে দাঁড়ায়, ফের বসে, বিড়বিড় করে বলে, লোকটার সাহস একটু বেড়ে গেছে না?
কি যে কন ভাইজান।’ পিছনে মানুষ থাকলে সাহস হবো না? আপনের মামু ধরেন জেলার এতোবড়ো নেতা, আফসার গাজী তার কোলে কোলে ঘোরে, তার সাথে ঢাকার ছাত্ররা আছে, বগুড়ার কলেজের ছাত্ররা আছে। ছাত্রগোরে খিলান দিলান করায় আফসার গাজী, বাজারের মধ্যে তার গুদামঘর খালি কর্যা দিছে, চাকর দিয়া পাকশাক করায়, খরচ করতিছে দুই হাতে, এখন তার গায়েত হাত তুলবো ক্যাডা?
‘আর ওর চাচা? খয়বার গাজী ?
নবেজউদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর পাল্টা জিগ্যেস করে, কিসক? খয়বার গাজীর খবর আপনে জানেন না?
‘ঐ শালা শুওরের বাচ্চার খবর আমি জানবো কোথেকে? এ্যাঁ? এই কথাটি আনোয়ার বলে চিৎকার করে, আমি জানবো কেন? ঐ্যা’ আনোয়ারের হঠাৎ-উত্তেজনার তাপে নবেজউদ্দিন উঠে দাঁড়ায়, হাত ২টো তার স্বতঃস্ফূর্তভাবে জোড়া হয়ে যায়। নবেজ কথা বলে না। তার কালো শরীরের চাপে চারপাশের অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে এলে নবেজের চেহারা সম্পূর্ণ আকার পায়। হঠাৎ উচ্চকণ্ঠ হয়ে পড়ায় আনোয়ারও বিব্রত হয়, তার মেজাজ এরকম হঠাৎ চড়া হলো কেন? গলা নামিয়ে এবার আনোয়ার বলে, ‘খয়বার গাজীর খবর আমি জানবো কোথেকে? ব্যাটাকে কি কম খোজা হলো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নবেজউদ্দিন হাত কচলায়, কোনোরকমে সে মুখ খোলে, না ভাইজান, এমনি কল্যাম। হামরা মুখ্য মানুষ, হামাগোরে কথা কি ধরা লাগে? চেংটু উদিনক্যা কলো—।’
‘চেংটুটা কোথায়? সেই যে আলিবক্সের সঙ্গে গেলো তার আর পাত্তা নেই। এরকম করলে কাজ হয়? তোমার সঙ্গে দ্যাখা হলো কোথায়?
কামেই গেছে, এক জায়গাত দ্যাখা হলো। নবেজউদ্দিন সেই জায়গার নাম গোপন রাখে। বলে, আপনার কথা চেংটু কয়, ভাইজান নরম দিলের মানুষ, সোজা মানুষ, খয়বারের শয়তানী আপনে বুঝব্যার পারেন নাই। নামাজের অছিলা করা তাই পার পায়া গেলো। না হলে ঐ শালা বাঁচবার পারে? না তার ভাইসতা আজ সভার মধ্যে দেওয়ানগিরি করে?
আনোয়ার জবাব দেয় না। নবেজউদ্দিন একটু পর উসখুস করে, বলে, ‘ভাইজান, ঘরেত যান। নিওড় পড়তিছে, একটা অসুখ বাধাবেন!’
শিশিরে ভিজলে আমার অসুখ হয় না।’
কি যে কন আপনেরা ঢাকার মানুষ, গায়ের শীত, নিওড় সহ্য করার পারবেন?
ঢাকাতেও শিশির, শীত, রোদ বৃষ্টি আছে নবেজ। ঢাকার হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় ফুটপাতে রাত কাটায়।
আপনারা বড়োলোক। দালানের মধ্যে থাকেন। নবেজউদ্দিন একটু সস্নেহ তাড়াও দেয়, ’ওঠেন ভাইজান, ঘরত যান।’