দরজা খুইলা ঘুমান? খিজির আলি ঘরে ঢুকলে ওসমান শুয়ে শুয়েই হাই তোলে, ‘ন’, ঘুমোলাম কোথায়? এতে রাত করলে যে?
পিয়ারু সর্দারের খবর জানেন? খুশি হয়ে খিজির জানায় পোস্তগোলার পিয়ারু সর্দার, ৫০/৫৫টা রিকশার মালিক, আজ মৌলিক গণতন্ত্রী পদ থেকে রিজাইন দিয়েছে, পোস্তগোলার মাঠে আজ সে মিটিং করলো। আলাউদ্দিন মিয়াও মিটিঙে ছিলো, তাকে বেবি ট্যাকসি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো খিজির নিজে। এখন আইয়ুব খানের দালালীতে একনিষ্ঠভাবে লেগে রয়েছে পুলের ওপার হাবিব ফকির আর এদিকে রহমতউল্লা। তা এদের আর বেশি দিন টিকতে হবে না। রহমতউল্লার অবস্থা পাগলা কুত্তার মতো, লোকজন দেখলেই খালি ঘেউঘেউ করে, আরে মিয়া মিলিটারির তো ডাণ্ড দ্যাহো নাই। মিলিটারি ভালো কইরা নামলে এইগুলি ফাল-পাড়া কৈ যাইবো, দেইখো।’ আজ সন্ধ্যার পর তার ব্লাড প্রেশার খুব বেড়ে গিয়েছিলো, আলাউদ্দিন মিয়া খোজ নিতে গেলে তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেনি। খিজির বুঝতে পারে না, ঐ ইবলিসটার জন্যে আলাউদ্দিন মিয়ার এতো মাথাব্যথা কিসের? মহাজনের মেয়ে সিতারা তো আলাউদ্দিন মিয়ার হাতে চলেই এসেছে। এখন তার আর ভাবনা কি?-এমনকি সেদিন খিজিরকে দিয়ে আলাউদ্দিন মিয়া হীরা আওর পাথর ছবির টিকিট নিয়ে এলো। খিজির ছাড়া আর কেউ জানে না, ছবি দেখতে গিয়েছিলো আলাউদ্দিন মিয়া আর সিতারা। ওসমান কারো কাছে ফাস না করে তো খিজির একটা কথা বলে। কি? বেবি ট্যাকসি চালিয়ে ওদের মধুমিতা সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিলো খিজির নিজে। হীরা আওর পাথর দ্যাখার মতো একটা বই বটে। জেবা-ওয়াহিদ মুরাদের অভিনয়, ৪বার দেখেও খিজিরের আশ মেটেনি।—ঐ ছবির কাহিনী বলতে বলতে খিজিরের স্বর ওঠানামা করে। হঠাৎ একেকটি রিকশা কি স্কুটর চলার আওয়াজে রাত বাড়ে কয়েক ধাপ করে। জেবা ও ওয়াহিদ মুরাদের পরিণতি শোনাবার আগেই খিজির ঘুমিয়ে পড়ে। তার বিড়ির আগুন জ্বলে না, তার নিশ্বাসের বাজনা ছাপিয়ে ওঠে ঘরের নীরবতা। ওসমানের বুক কাপে: হাড্ডি ব্যাটা কি ঘুমিয়ে পড়লো? এখন ছুটে বাইরে বেরুবার জন্য ওসমানের পাজোড়া যদি ফের কাপে তো কি হবে?
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৬
আজ তাড়াতাড়ি আসবেন। দুপুরে আপা পড়তে আসবে। দরজায় তালা লাগাচ্ছিল ওসমান, সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে রঞ্জু বলে, তাড়াতাড়ি আসবেন।
রঞ্জ ফিকফিক করে হাসলে ওসমানের মাথার ভেতর রক্ত ছলকে ওঠে, অফিস ছুটি না হলে আসবো কি করে?
‘রবিবারে অফিস?
আজ সোমবার। অফিস করে খেয়েদেয়ে ফিরবো। দেরি হবে।
সার্জেন্ট জহুরের রক্ত-বৃথা যেতে দেবো না; গোলটেবিল না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ’, ‘জেলের তালা ভাঙবো –‘শেখ মুজিবকে আনবো’ –ইত্তেফাঁকের সামনে ওসমানকে রিকশা ছেড়ে দিতে হলো। এখন প্রবলেম হলো,-মিছিল সম্পূর্ণ চলে যাওয়া পর্যন্ত ওসমান কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি মিছিলের ভেতর দিয়ে রাস্তা ক্রস করে অফিসে চলে যাবে? মিছিলে কামালকে দেখে ওসমান এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়,
এই কামাল, অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন? অফিসে কি স্ট্রাইক নাকি?
‘আজ রোববার না? আজ সোমবার। ওসমান জোর দিয়ে বলে, মতিঝিলের সব অফিস থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে।’
আপনি কি পাগল হলেন নাকি? আজ রোববার। কামাল এগিয়ে যায়। ওসমান বিরক্ত হয়ে মিছিলের এক পাশে দাঁড়ায়, সোমবারকে বলার মধ্যে পাগলামির কি হলো ?
‘আরে ওসমান ভাই? আসেন, আসেন। শাহাদতের আহ্বানে ওসমান ওর পাশে চলতে শুরু করে। সোমবারের ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে উদগ্রীব, ‘আজ তো সোমবার, না? অফিসে বোধহয় স্ট্রাইক। কিন্তু রিকশা তো চলছে।
এই ব্যাপারে শাহাদতের কোনো মতামত আছে বলে মনে হয় না, আপনার কথা একটু আগেই জিগ্যেস করছিলাম। ঐ যে আপনাদের পাড়ায় ঐ রিকশাওয়ালা—কি নাম যেন?— ওকে জিগ্যেস করলাম।
খিজির? খিজির এসেছে নাকি? মিছিলে আছে? ‘হ্যাঁ সামনের দিকে। শাহাদতও জোর পা ফেলে সামনে চলে যায়, পেছনে চলে যায়, পেছনে কোনো কর্মীকে সে উপদেশ দেয়, প্রসেশনে ডেড-বডি আছে। পাবলিক যেন ওয়াইল্ড না হয়ে যায়! ওসমান তখন পাশের লোককে জিগ্যেস করে, কার ডেড-বডি ভাই ?
লোকটি জবাব না দিলে পেছন থেকে কে যেন বলে, আপনি বোধ হয় পাকিস্তানের ইনফর্মেশন মিনিস্টার। আগরতলা মামলার আসামীকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর গুলি করে মারে, আপনি খবর রাখেন না?
এইবার হঠাৎ করে মনে পড়ে, এই হত্যার খবর ওসমান পেয়েছে কাল বিকালে, রেক্সে বসে চা খেতে খেতে। সেই বন্দি কি বুলেটে নিহত ? ক্যান্টনমেন্টে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া আর কি ব্যবহার করবে? মিছিল চলছে, মিছিলের সঙ্গে হাটতে হাটতে ওপরদিকে তাকালে চোখে পড়ে উড়ন্ত ইলেকট্রিক তার থেকে ঝোলে বুকে-বুলেট-বেধা লাশ। দেখতে দেখতে মৃতদেহের ২ হাত থেকে ঝোলে আরো ২টো বুলেট-বিদ্ধ লাশ। ২ জনের ৪ হাত থেকে আরো ৪ জনের লাশ। মিছিলের ভেতর দিয়ে সেই লাশের উল্লম্ব সারি চলে, মানুষের সঙ্গে যে কোনো মুহুর্তে তাদের ঠোকাঠুকি লাগতে পারে। সবাইকে সাবধান করা দরকার। কিন্তু কামাল কোথায়? শাহাদত কোথায়? খিজির কোথায়? ওদিকে বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে মাইকে দুর্বোধ্য ধ্বনি বেজে ওঠে, ওসমানের মাথা ঘুরে ওঠে বো করে, দেখতে দেখতে মৃতদেহের সারির সঙ্গে সমস্ত মিছিল অদৃশ্য হয়ে যায়। টলোমলো পায়ে ওসমান ফিরে যায় নবাবপুরে, মোহাম্মদিয়া রেস্টুরেন্টে একটু বসে চা খায়। মনে হয় ওদিকে বোধ হয় সব শেষ হয়ে গেলো। কি শেষ হলো সে সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনো ধারণা করতে না পেরে বাইরে এসে হাঁটতে থাকে নবাবপুর রোড ধরে। নবাবপুরে অজস্র মানুষ, প্রায় সবাই যাচ্ছে বায়তুল মোকাররমের দিকে। দক্ষিণে যাচ্ছে সে একা। দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ, যানবাহন খুব কম। ওসমানের হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ বোধহয় গোটা ঢাকা শহর জুড়ে নবাবপুর প্রসারিত, এই রাস্তা আর শেষ হয় না।
ঘরে ঢুকে গ্লাস দুয়েক পানি খেলে গলার খটখটে ভাবটা কমে, কিন্তু পেটের ওপর দিকটা চিনচিন করে ওঠে। ভুল হয়ে গেলো, কোথাও খেয়ে নিলো ভালো হতো। রানু যদি অঙ্ক করতে আসে তো এই দারুণ খিদে নিয়ে অঙ্কের ভুলগুলো সনাক্ত করা কঠিন হবে। খিজির এলে ভালো হতো। খিজির ঘরে থাকলে রানুর অঙ্কে ভুল ধরার দায়িত্ব থেকে ওসমান অব্যাহতি পায়। আবার খিজিরের কাচ থেকে জেনে নেওয়া যেতো যে ঐ বন্দির ঠিক কোন জায়গাটায় বুলেট বিদ্ধ হয়েছিলো। দরজা বন্ধ করে শুতে শুতে খিজিরের ওপর ওসমানের রাগ হয়: মিছিলের সামনে থেকে সে দিব্যি চলে গেলো, একবার খোজও করলো না, ওসমান মিছিল থেকে একরকম বহিষ্কৃত হয়ে একা একা এই দীর্ঘ পথ হেঁটে কি রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর রাস্তাও বটে একখানা। আজ কি নবাবপুরের ভীমরতি ধরেছিলো যে গোটা ঢাকা মহর জুড়ে শালা শুয়েছিলো গতর ছড়িয়ে? আর্মানিটোলা, পটুয়াটুলি, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার সব কি সে দখল করে বসেছিলো আজ? নবাবপুর ধরে হাটতে হাটতে গরমে হাসফাস করে, এই হাঁটার মনে হয় আর কোনো শেষ নাই। এদিকে খিদেও পেয়েছে খুব। দূরসম্পর্কের চাচার বাড়ি থেকে পাওয়া যায় মোট ২ আনা পয়সা, তা দিয়ে বাসে করে ঘরে ফিরবে, না টিফিন পিরিওডে কিছু খাবে? কতোকাল আগেকার সেই ক্ষুধা মেশে আজকের খিদের সঙ্গে। মাথার ভেতর ভোতা ঠেকে, ভোতা মাথায় কি বর্তমান কি অতীত কাউকেই ভালো করে ধরা যায় না। মাথার ভেতরটা বড়ডো দোলে, শুধু দোলে। এই দুলুনিতে ঘোড়ার গাড়ির গড়িয়ে চলাটা বেশ বোঝা যায়। সবেধন নীলমণি ২ আনা দিয়ে স্কুলের গেট থেকে আমড়া কি চালতার আচার খেয়ে ফেলেছে, এখন বাড়ি পর্যন্ত পাড়ি দিতে হবে হেঁটে। এতোটা পথ হাটা কি সোজা কথা? ওসমান তাই উঠে বসেছে একটা ঘোড়ার গাড়ির পেছনের পাদানিতে। কোচোয়ান টের না পাওয়া পর্যন্ত যতোদূর যাওয়া যায়। ঘোড়ার গাড়ি চলেছে, ঘোড়াজোড়া ছুটছে, গাড়ি গড়িয়ে যাচ্ছে, পেছনের পাদানিতে বসে দুলছে ওসমান। ভোতা ক্লান্তি ও একঘেয়ে দুলুনিতে তার ঘুম পায়। কোনো এক পিচ্চি কেটলিতে চা নিয়ে রাস্তা ক্রস করতে করতে চ্যাচায়, গাড়িকা পিছে মানু’। গোড়ার গাড়ির ছাদ থেকে কোচোয়ানের চাবুক এসে পড়ে তার মাথায় ও বুকে। গাড়ির পাদানি থেকে লাফিয়ে নামতে নামতে চাবুক উড়ে যায় সামনের দিকে। ঘোড়ার গতি বাড়ে। কোচোয়ান পলকের জন্য মুখ ফিরিয়েছিলো। আরে এ তো খিজির! খিজির তাকে চিনতে পারলে কি তার গাড়ি থেকে এভাবে নামিয়ে দেয়? খিজির! খিজির আরে আমি। দাঁড়াও। আরে এই খিজির—।
কিন্তু খিজির আলি ফিরেও তাকায় না। ঘোড়ার গাড়ি দেখতে দেখতে চলে যায় অনেক দূরে। ওসমান রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে, এমন সময় প্যাক প্যাক করে রবারের হর্ন বাজায় মুড়ির টিন মার্ক ঝরঝরে বাস। চমকে উঠে সরে দাঁড়ালে বাসের গায়ে কণ্ডাক্টর দমাদম বাড়ি মারে। বাসের প্যাক প্যাক আওয়াজে অথবা বাসের গায়ে কণ্ডাক্টর দমাদম বাড়ি মারার ফলে ওসমান বিছানায় উঠে বসে। কিছুক্ষণ পর বোঝা যায় দরজায় কে যেন আস্তে আস্তে টোকা দিয়ে চলেছে।
আপনের শরীর খারাপ? রানু একবার আসছিলো, রঞ্জু আসলো কয়েকবার। সারাদিন দরজা বন্ধ। কি হইছে? মকবুল হোসেনের উদ্বেগ দেখে ওসমান হাসে, না এমনি।’
অসময়ে ঘুমান? ভাত খাইছেন? ওসমান ঘড়ি দ্যাখে। একটু পর নিচে যাবো।’ কারফ্যুর ভিতর কৈ যাইবেন? কারফ্যু? . বিছানায় বেশ জুত করে বসে মকবুল হোসেন, বসতে বসতে ওসমানকে ভালো করে দ্যাখে। আজ খুব গোলমাল হইছে, জানেন না?
‘হ্যাঁ ফেরার সময় রথখোলার মোড়ে লাল রায়ট কারটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। টিয়ার গ্যাস ছুড়লো। আনোয়ার আর আমি একসঙ্গে ফিরছিলাম।
বলতে বলতে ওসমানের ভুল ভাঙে, রথখোলার মোড়ে রায়ট কার দ্যাখার ঘটনাটি বেশ কয়েকদিন আগেকার। ওটা কি রথখোলার মোড়ে দেখলো? নাকি জিপিওর সামনে? নাকি আর্মানিটোলা স্কুলের মাঠে? তবে আজ সে কি দেখলো? ঘোড়ার গাড়ির পেছনের পাদানি থেকে খিজির তাকে নামিয়ে দিলো কবে?—মাথার ভেতর একটার পর একটা মরা গেরো পড়ছে, সেগুলো খোলা কি সোজা?
মকবুল হোসেন বলে, কোন মিনিস্টারের বাড়ি নাকি আগুন লাগাইয়া দিছে। দ্যাখেন তো এরকম করলে দেশে ল এ্যাঁণ্ড অর্ডার থাকে?
কখন? কোন মিনিস্টারের বাড়ি? মন্ত্রীর বাড়ির আগুনের শিখায় ওসমানের মাথার জট পুড়ে যায়, সবগুলো গেরো খুলে গেলে চেয়ারে বসে সে সিগ্রেট ধরায়।
‘দ্যাখেন তো মিনিস্টারের বাড়ি পোড়াইলে লোকসান কার? এই ঘটনায় মকবুল হোসেন বেশ অসন্তুষ্ট, গভর্মেন্ট প্রপার্টি মানে পাবলিক প্রপার্টি, তাই না?
হোস্টাইল আর এনিমি গভর্মেন্টের প্রপার্টিতে মানুষের রাইট কতোটা? এসব থাকলে মানুষের লাভ কি? নষ্ট হলেই বা কি?
কিন্তু বাড়াবাড়িটা কি ভালো? এই যে জ্বালানো পোড়ানো শুরু হইছে—। ‘গভমেন্ট এতোদিন ধরে, এতোকাল ধরে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, তার তুলনায় এটা কি? মানুষ যদি এটুকু না করে তো নেতাদের আপোষ করার স্কোপ থাকে, বুঝলেন? তার কথা মকবুল হোসেন বুঝলো কি-না পরোয়া না করে ওসমান বলে, ‘জ্বালানো পোড়ানো এমন অবস্থায় এসেছে যে বড়ো বড়ো নেতারা ইচ্ছা করলেও আর পিছিয়ে যেতে পারবে না। ধরেন, ইচ্ছা থাকলেও শেখ সায়েব কি এখন প্যারোলে বেরিয়ে এসে রাউন্ড টেবলে যেতে পারবে?
‘না, এখন আর প্যারোলে আসে ক্যামনে? আর দ্যাখেন, গভমেন্ট নিজেই আইন মানে না। কথায় কথায় গুলি করে, নিরীহ মানুষকে খুন করে তো পাবলিক সে তুলনায় কি করেছে, বলেন?
কি করছে? প্রশ্নবোধক বাক্যটি দিয়ে মকবুল হোসেন ওসমানের ওপর আস্থা জানায়। তার নিজের বা পারিবারিক বা বড়োজোর পেশাগত ব্যাপারের বাইরে কোনো বিষয়ে মতামত পোষণ করার সুযোগ তার কোনোদিন হয়নি। ওসমানের মতামত সমর্থন জানাবার জন্য তাই সে ছটফট করে। আমার তালেবটারে দ্যাখেন না, কথা নাই বার্তা নাই-। আবার আরু তালেব এবার গোটা ঘর জুড়ে ঝুলে থাকার আয়োজন করছে? ওসমান উঠে দাঁড়ায়, ছাদে যেতে যেতে আড়চোখে ঘরের ভেতরটা তদন্ত করে। না, ঘরের শূন্যতা একেবারে নিরাভরণ।
ছাদে পেচ্ছাব করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সিঁড়ির কোনো ধাপ থেকে শোনা যায় রানুর গলা, আচ্ছা। মকবুল হোসেন বলে, ভাত উপরে পাঠাইয়া দিস।
সিঁড়ির দিকের দরজা দিয়ে ওসমান দ্যাখে রানু আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। এই ঘরের আলো একটু ময়লা হয়ে পড়েছে সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পর্যন্ত। রানুর পিঠ জুড়ে ছড়ানো চুল। চুলের ওপর পড়ে আলো একটু সাফসুতরো হয়েছে, চুলের রাশি তাই চিকচিক করে। ওসমান ওর চুল দেখতে দেখতে মেয়েটা সিঁড়ির বাক ঘুরলো। সেখানে অন্ধকার। রানুর ঠিক পেছনের ধাপে আরু তালেবের বুলেট-বিদ্ধ শরীর। ওসমান ঐ দরজার কাছে গেলে রানুকে সতর্ক করার জন্য ছোট্রো করে কাশলে রানু পেছনে তাকায়। তালেবের শরীর তখন সলিড আকার ধারণ করেছে। তাই দেখেও রানুর চেহারা অপরিবর্তিত রয়ে যায়। রানুর পেছনে তালেবও অন্ধকারে নিচে নেমে গেলে ওসমান দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে, নাঃ মরে যাওয়ার পরও তালেব রানুর আস্থা এতটুকু হারায়নি।
চেয়ারে বসে ওসমান ভদ্রতা করে, আবার ওকে খাবার আনতে বললেন কেন? ঘরে পাউরুটি ছিলো।
ঘরে যা আছে তাই খাইবেন। ইলিশ মাছ খান তো? তালেবের মায় সর্ষা বাটা দিয়া ইলিশ মাছ রানছে।
‘খাই। ইলিশ আমার ভালো লাগে। ছোটবেলায় ঢাকায় এলে আব্বা রোজ ইলিশ মাছ আনতেন। গ্রামে থাকতেও পদ্মার ইলিশের নাম শুনতাম খুব।
‘ধলেশ্বরীর ইলিশ যদি খাইতেন তো বুঝতেন। ধলেশ্বরীর—। মকবুল হোসেন হঠাৎ খেয়াল করে যে চোখজোড়া যতোটা পারে খুলে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে ওসমান। তার ঠোঁট আবার সেই পরিমাণ চাপা। মনে হয় ভয়ে কিংবা বিস্ময়ে তার জ্বজোড়া কাঁপছে। মকবুল হোসেনও ভয় পায়, কি হইলো? কি?
ওসমানের মনোযোগে এদিকে ফেরাতে না পেরে মকবুল হোসেন বিছানা থেকে নেমে সিঁড়ির দরজার দিকে যায়। সিঁড়ির প্রথম কয়েকটি ধাপে ঘরের আলোর ময়লা আঁচল লোটানো। ধাপে ধাপে আলো আরো ময়লা হয়। অন্ধকার গাঢ় হতে হতে নিচের ধাপগুলোকে নিজের খাপের ভেতর গায়েব করে ফেলে। ভয় পাইছেন? মকবুল হোসেন স্নেহতেলতেলে আওয়াজে তার ভয় তাড়াবার চেষ্টা করে, ভয়ের কি আছে? ঐ্যা? আমি আছি না?
ভয় পাবো কেন? ওসমান চটচটে আদর প্রত্যাখ্যান করে, আরে ভাই ভয় পাওয়ার কি হলো? এতো সহজে ঘাবড়াই না আমি, বুঝলেন? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। এর ক্ষতিপূরণ হিসাবে মকবুল হোসেনকে ধলেশ্বরী ও ইলিশের প্রসঙ্গ ফিরিয়ে দিতে চায়, ইলিশ তো জানি পদ্মারই ভালো।
একটু আগে প্রকাশিত ওসমানের বিরক্তি মকবুল হোসেন গায়ে মাখে না। কেউ রাগ করলে বা বিরক্ত হলে তার প্রতিক্রিয়া দ্যাখানো মানে নতুন ঝামেলা তৈরি। এছাড়া ধলেশ্বরী তার বড়ো প্রিয় বিষয়। এ থেকে চট করে সরে আসা তার পক্ষে কষ্টকর। মকবুল হোসেন তাই ওসমান গনির শেষ বাক্যে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়, সেই কথা আমি কইলে আপনে মানবেন কেন? একবার চলেন। আমাগো বাড়ি ধলেশ্বরীর উপরেই। আমাগো এলাকায় যে হাঁটে যান ধলেশ্বরীর ইলিশ উঠছে তো পদ্মার ইলিশ থাইকা দাম এটু বেশি থাকবেই।’
‘সত্যি? মাথা থেকে অবাঞ্ছিত সব ছবি মুছে ফেলার জন্য ওসমান তৎপর, কিরকম বেশি?
তার ঠিক আছে? আমাগো ছোটোবেলায় এক আনা ছয় পয়সা বেশি হইলেই অনেক বেশি।
বলেন কি?’ তয়? ওসমানের বানানো-বিস্ময়ে মকবুর হোসেন অভিভূত হয়, ‘পদ্মার ইলিশ তিন আনা জোড়া তো ধলেশ্বরীরটা চাইর আনা, আঠারো পয়সা। আর মাছ পাওয়াও যাইতো! আমাগো হাঁটে বর্ষাকালে ইলিশের আমদানী হইছে এমন, কি কমু?-হাঁটের মধ্যে কুলায় নাই, জাইলারা হাই ইশকুলের ফিল্ডে বসছে চুপড়ি লইয়া – হঠাৎ বেশি কথা বলার লজ্জা বা ক্লাস্তিতে মকবুল হোসেন একটু হাসে। এরপর লজ্জা কাটাবার জন্য সে চলে আসে বর্তমানের সমস্যায়, তাইতো চিন্তা করি, বাপদাদায় কি খাইছে, আর আমরা কি খাই। সংসার চালাইতে পারি না। ছেলেমেয়ে ল্যাখাপড়ার খরচ কেমন বাড়ছে, দ্যাখেন না? এক মাইয়ারে তো আল্লা আল্লা কইরা পার করছি, আরেক মাইয়ার বিয়া দিতে হইবো। বিয়াশাদীর খরচ– ‘ –
মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন না? ওসমান বেশ সিরিয়াস। কোনোদিন কারো বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া দূরের কথা, কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজনের সঙ্গে সে জীবনে কখনো জড়িত ছিলো না। এই প্রথম একটা সুযোগ পেয়েছে, এটা সে হারাতে চায় না, রানুর বিয়ের ব্যাপারে একটা কথা ছিলো।’
রানুর বিয়ের ব্যাপারে ওসমানের উৎসাহকে বেহায়াপনা ভেবে মকবুল হোসেন বিরক্ত হওয়ার বদলে বরং লজ্জা পায় এবং ছেলেটার বেহায়াপনা আড়াল করার উদ্যোগ নেয় সে নিজেই, রানুর মায়ে আমারে কয়দিন বলছে। আপনার ফাদার তো ইন্ডিয়ায় থাকে, না? বাবাজীগো বাড়ি ওয়েস্ট বেঙ্গলের কোন জেলায়? পার্টিশনের আগে কইলকাতা গেছি কতোবার তার হিসাব নাই। গোয়ালদের জাহাজে উঠছি, সেই সময় ঐ জাহাজ–। তার ভ্রমণ কাহিনী বর্ণনা বন্ধ করে দেয় ওসমান, বাড়িওয়ালা আপনাকে কিছু বলেনি?
জী? আমাগো বাড়িওয়ালা? মকবুল হোসেন হঠাৎ ভয় পায়। ‘জী। রহমতউল্লা সায়েব রানুর জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে আসেনি? অপরাধবোধ নুয়ে-পড়া গরিবের মতো চোখমুখমাথা নিচের দিকে নুইয়ে মকবুল হোসেন কৈফিয়ৎ দেয়, মাইয়া যখন আছে তখন কতো প্রস্তাব আসবো। বাড়িঅলাও একটা লইয়া আসছে। কথা বলতে বলতে সে সাহস সঞ্চয় করে, আমার মাইয়ারে আমি কৈ বিয়া দেই না দেই, সেইটা দেখুম আমি। বাড়িআলারে পরোয়া করি? আরে কতো বাড়িআলা দেখলাম। আমারে চাপ দেওয়াইয়া কাম করাইতে পারে এমন মানুষ—।
তার সিংহপুরুষসুলভ সাহসের প্রতি ওসমান একেবারে উদাসীন, কেন? বাড়িওয়ালার প্রস্তাব খারাপ কি? ছেলেটার বাপ তো বেশ ভালো ব্যবসা করে, ছেলের নামে নবাবপুরে হার্ডওয়্যারের দোকান থাকা কি কম কথা? ঢাকায় পৈতৃক বাড়ি, আবার মার্কেট তৈরি করছে। আর কি চান?
ভয়-পাওয়া ও সুবোধ ছাত্রের মতো মকবুল মিনমিন করে, না, আমরা মানে একটু ল্যাখাপড়ার কথা ভাবছিলাম। ছেলের যদি ল্যাখাপড়া তেমন না থাকে তো—।’
রাখেন লেখাপড়া টাকাপয়সা রোজগারের জন্যেই তো লোকে লেখাপড়ার করে। একটু প্র্যাকটিক্যাল হতে চেষ্টা করেন।’
‘না, ধরেন, মেয়েটা আমার আবার একটু লাখাপড়ার ভক্ত। তারও একটা মতামত-। আপনাকে বলি, মাইল্ড করবেন না, রানু লেখাপড়ায় ভালো করতে পারবে না। অঙ্কের মাথা একেবারে ভাল। প্রোপোজালটা রিফিউজ করবেন না।
এই সময়ে ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসে রানু। গামলা ভর্তি ধোঁয়া-ওঠা ভাত, ইলিশ মাছের সৰ্যে-বাটা পাতুড়ি, আলু ভর্তা এবং কুচি কুচি করে কাটা ঢেঁড়সের চচ্চড়ি। আপাতত এর কোনোটিতেই ওসমানের রুচি নাই। রানুর কপালে লাল টিপ। তার চুল এখন দুটো বেশী হয়ে সামনে এসে ঢেউ তুলে নেমে গেছে কোমরের দিকে। তার নাকে ঘামের বিন্দু নাই, সেখানে পাউডারের আভাস। ওসমান স্বচ্ছন্দে কয়েকবার তাকে দ্যাখে। কারফ্যুর ভেতর ওর এই সাজগোজ দেখতে আসবে কে? টেবিলের ওপর ট্রে ঠিক করে রাখতে রাখতে ওসমান বলে, তুমি যাও। আমার খেতে এখনো অনেক দেরি। সকালবেলা প্লেট বাটি সব পাঠিয়ে দেবো।’
বাপের সঙ্গে রানু নিচে চলে গেলে হঠাৎ-শ্রমের ক্লান্তিতে ওসমান বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে। এইভাবে ৯/১০টা নিশ্বাস ফেললে বেশ সহজ বোধ করে। তার সমস্ত শরীরের ভার যেন পাম্প করে বার করে দেওয়া হলো। হয়তো এই কারণে তার বড়ডো খিদে পায়। হাতটাতে না ধুয়েই গপগপ করে খেতে শুরু করলো। ভাতের গামলায় আলু ভর্তা, ঢেঁড়সের চচ্চড়ি, ডাল এক সঙ্গে মেখে যতোই খায় মনে হয় পেটের সবটা বোধহয় খালিই পড়ে রয়েছে। এতো যে খাচ্ছে, শরীরের অজস্র ফাক ফোকর তবু একটুও ভরে না। ইলিশ মাছের কাটাগুলো পর্যন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করে ফেললো। ওসমানের বুক পর্যন্ত ফাকা, —যতোই ঠাসো আর যতোই গাদো আবক্ষউদরের চাহিদা মেটে না। গ্লাস গ্লাস পানি খেয়েও শরীরের খ খ করা আর থামে না। খিদে ভোলবার আশায় ওসমান তখন ঘরের শূন্যতার দিকে দ্যাখে। কিন্তু ঘর তার পেটের মতোই শূন্য। গুলিবিদ্ধদের খাড়া কোনো সচল ও আচল মিছিল দেওয়ালের মাঝখানের শূন্যতাকে এতোটুকু গয়না পরিয়ে দেয় না। ওসমান এখন তাহলে করবেটা কি? কোনো উপায় না দেখে তোশকের নিচে অনেকদিন আগে লুকিয়ে রাখা একটা পর্নোগ্রাফির বই বার করে। যা তা মাল নয়, গুলিস্তানের সামনে থেকে ২৮ টাকায় কেনা। আর্ট পেপারের পাতায় পাতায় সায়েব-মেমসায়েবদের এ্যাঁকশনের ছবি। কিন্তু সেসব বারবার দেখেও শরীরের কোথাও কিছুমাত্র স্পন্দন বোধ করা যায় না। নানা ভঙ্গিতে সঙ্গমরত নর-নারীর দেহ কেবল বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উদ্ভট সমাবেশ ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্য তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। তবে একটা ভালো লক্ষণ দ্যাখা যায়, তলপেটটা টনটন করতে থাকে। হবেই তো! যে পরিমাণ পানি খাওয়া হলো পেচ্ছাব না করে উপায় কি?
একটা কাজ পেয়ে খুশি হয়ে ওসমান দরজা খুলে ছাদে এলো। শীত যাই যাই করছে, ফাল্গুন মাস এসে পড়লো বলে! দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে ওসমাননয়ন ভরে চারদিকের কুয়াশা-ঢাকা নির্জনতা দ্যাখে। পেচ্ছাব করা হয়ে গেলে রেলিঙে ঝুঁকে নিচে খোয়া-ওঠা রাস্তা দ্যাখে, কালো রাস্তার ওপর কালো রাত্রি। এই সময় কোন এক কবিতার লাইন মাথায় আস্তে আস্তে চুলকায় কারফ্যু-দাগানো পথ, রাত্রিবেলা/ছাদের ওপরে থাকি আমি একেলা।—এটা কার লেখা? কার? কোথায় পড়েছে?—মনে পড়ার আগেই শোনা যায় কোথায় যেন গুলির শব্দ হচ্ছে। কারফ্যু ভাঙার অভিযোগে মিলিটারি কোথাও গুলি করছে। তাকেও তো গুলি করতে পারে। সে তো ঘরের বাইরে, আকাশে নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে? গুলি একবার তার বুকে লাগলে হয়, তখন এই ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে কোন শালা? আগেই প্রাকটিস করার জন্য ওসমান লাফিয়ে এই ইঞ্চি চারেক ওপরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় ধপ করে। শূন্যে থাকতে পারলে ভালো হয়। তার গুলিবিদ্ধ দেহ উড়তে উড়তে কারফ্যুচাপা শহরের বাড়িঘর, দোকানপাট, ডিআইটি, স্টেডিয়াম, কার্জন হল, গুলিস্তান, ইউনিভারসিটি, মেডিক্যাল কলেজের সামনে এলম গাছের সারি, মালিবাগের মোড়, কমলাপুর রেল স্টেশনের ফুল মার্কা ছাদ, এয়ারপোর্টের টাওয়ার, আজিমপুর গোরস্থান-এসবের ওপর দিয়ে দিব্যি উড়ে বেড়াবে। তার ওপরে কি?-ওপরে অন্যান্য গুলিবিদ্ধদের খাড়া মিছিল। এই আবু তালেব, আবু তালেবের হাতের সঙ্গে গুলি দিয়ে গাথা খিজিরের লাশ। আরে, আনোয়ার? আনোয়ারের নিচে আলতাফ, শওকত ভাই। কিন্তু ওসমানের জায়গাটা কোথায়? ঐ মিছিলে সে অনুপস্থিত কেন? মিছিলে তার এতো চেনা লোক, আকাশ জুড়ে এরা তার নিজের মুখটা সে কি-না সনাক্ত করতে পারে না। এতো মানুষের খাড়া সমাবেশে তার ঠাই হলো না। তার শূন্য ও ফাঁকা বুকে এই দুঃখ ঢুকলে একটু বল পেয়ে ওসমান নিচের দিকে দ্যাখে। পায়ের নিচে চুন সুরকি ঢাকা কালচে খয়েরি ছাদ। ফের সামনে তাকালে সব ফাকা। এই একটু-আগে-দ্যাখা জলজ্যান্ত গুলিবিদ্ধ মানুষের লম্বা ও ঋজু প্রবাহ এভাবে মুছে যাওয়াটা ভালো কথা নয়। কিন্তু তার ভয় করে না। কিংবা করলেও তা চাপা পড়ে এই হঠাৎ-হারাবার হাহাকারের নিচে। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে ফের উঠতে হয়, শেষবারের মতো পেচ্ছাবটা সেরেই নিই। কিন্তু পেচ্ছাব বেশি হয় না, কয়েক ফোটা পড়ার পর তলপেটও খালি। অন্নজলমুক্ত, মলমূত্রমুক্ত, রক্তমাংসমুক্ত, শুক্ৰধাতুমুক্ত ওসমান এখন অনায়াসে ঝুলে পড়তে পারে বুলেট বিদ্ধদের লম্বা ঝাকে। কিন্তু এবার আকাশ একেবারে ফাকা।
ঘরে এসে শুতে না শুতেই শোনা যায় গুলিবর্ষণের শব্দ। ওসমান ফের ছাদে যায়। এবার আকাশ জুড়ে লাশের মিছিল, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন মানুষের দল। কিন্তু এই সমাবেশে তার মুখ নাই। এবার আবার একটি কবিতা মনে পড়ে, এটা কি অন্য কবিতা? না ঐটারই পরের জোড়া-লাইন? বিড়বিড় করে সে আবৃত্তি করে আকাশে কারফ্যু ভাঙে সবাই মিলে। আমার শ্ৰীমুখ কৈ এই মিছিলে?-কার লেখা? কার? কিছুঁতেই মনে করতে না পারলে রাগ করে ওসমান ফের ঘরে ঢুকে বসে থাকে। ঐ কবিতার আরো সব লাইন তার একটু একটু মনে পড়ে, কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না। হয়তো স্পষ্টই মনে পড়তো, কিন্তু তার আগেই অনেক দূরে কোথায় মিলিটারির গুলিবর্ষণ শোনা যায়, সে এক লাফে এসে দাঁড়ায় ছাদে।
ওসমান এই রকম ঘর-ছাদ, ছাদ-ঘর, ঘর-ছাদ ঘর করে ওদিকে কালো ডিমের খোসা ভেঙে বেরিয়ে আসে আকাশ মহারাজ। পাতলা কুয়াশার কাফনের নিচে রাস্তার শরীরের প্রায় সবটাই একটু একটু দ্যাখা যাচ্ছে। শাহ শাহেব বাড়ির মসজিদের আজান এই রাস্তার জনশূন্য চেহারা ন্যাংটা করে ফেললে সেদিকে তাকাতে ওসমানের লজ্জা হয়। খিজির থাকলে ওসমান নির্ঘাত ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়তো। লম্বা লম্বা হাত পা নেড়ে খিজির অবিরাম কথা বলতে বলতে যেভাবে হাঁটে তাতে এই রাস্তার আব্রু দেওয়ার জন্য ও একাই একশো। খিজিরটা কোথায়? সারারাত ঘরে ফিরলো না কেন? তবে ওকে কোথায় যেন দেখলো? কোথায় দেখলো হাজার চিন্তা করেও ওসমান সেটা উদ্ধার করতে পারে না।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৭
সারাটা রাত খিজিরকে কাটাতে হয়েছে রহমতউল্লার বাড়িতে।
মওলানা ভাসানীর মিটিং থেকে বেরিয়ে মিছিলের লোকজন বর্ধমান হাউসের পাশে আগরতলা মামলার ১নম্বর জজসায়েবের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলো, আরো অনেকের সঙ্গে খিজির আলি তখন ঐ জজসায়েবকে খুঁজছিলো হন্যে হয়ে। পাওয়া গেলে এই আগুনে ফেলেই শয়তানটাকে সাফ করে ফেলা যায়, ওর জন্যে আলাদা আগুন খরচ করতে হয় না। কিন্তু ব্যাটা কোথাও নাই। তাড়া খাওয়া নেড়ি কুত্তারা ল্যাজখানা পাছার মধ্যে গুঁজে কোনদিক দিয়ে যে সটকে পড়লো কেউ খেয়াল করেনি। আগুনের আঁচে খিজিরের মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে:
ইবলিসের গুটি খতম করনের লাইগা মানষে জান বাজি রাইখা কাম করতাছে, আর আমগো মহল্লার সর্দার ইবলিসটা কেমুন খাতির জমাইয়া খায় দায়, নিন্দ পাড়ে, এ্যাঁরে মারে, অরে ধরে, আবার জুম্মনের মায়ের প্যাটের বাচ্চাটারে ভি খতম করনের ফন্দি করে!–সঙ্গে সঙ্গে খিজির রওয়ানা হয় নিজের মহল্লার দিকে।
কিন্তু দেরি হয়ে যায়। নিমতলী পার হতে না হতে সব মানুষের সঙ্গে তাকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে হয়। শোনা গেলো, কারফ্যু ফের জারি হয়েছে, ১৫মিনিট পর রাস্তায় কাউকে দ্যাখামাত্র গুলি করা হবে। লক্ষ্মীবাজার পৌছুঁতে রাস্তা সুমসাম। তবু ওসমানের ঘরের দিকে না গিয়ে খিজির ঢুকে পড়ে রহমতউল্লার গলিতে। আর্মির একটা লরি চলে গেলো ওর সামনে দিয়ে, ঐ সময়টা সে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো মহাজনের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে। লরি চরে গেলে উঠলো রহমতউল্লার বাড়ির রকে। কিন্তু একা একা সে মহাজনের কি করতে পারে? এমন সময় আস্তে করে ঘরের জানলা খুলে মুখ বাড়ায় আলাউদ্দিন মিয়া। খিজিরের উত্তেজনা খুব বাড়ে, মহাজনকে খতম করার পরিকল্পনা কার্যকর করার উৎসাহ পায়। মহল্লা এখন নিশ্চয়ই আলাউদ্দিন মিয়ার নিয়ন্ত্রণে। তার হাতে ছাত্র আছে, কর্মী আছে, তার কথা শোনার জন্যে লোকজন এখন প্রস্তুত।
আলাউদ্দিন মিয়া জিগ্যেস করে, খিজির আইছস? রাস্তায় মিলিটারি দেখলি?
না, তামাম মহল্লার মইদ্যে নাই। সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতি আলাউদ্দিন মিয়াকে মহাজন-নিধন-অভিযানে সাহস জোগাবে বলে খিজির এই মিথ্যা বলে।
তাইলে এক কাম কর। কি? মানুষজন ডাকুম? কাজ করার জন্যেই তো খিজির এসেছে, ‘ডাকুম? ‘ডাক্তার লইয়া আয়। মামুর হাল বহুত খারাপ। তা মহাজনের হাল চরমভাবে খারাপ করার উদ্দেশ্যেই তো খিজির এসেছে। ডাক্তার ডেকে কি হবে? দরজা খুলে তাকে ভেতরে ডেকে নেয় আলাউদ্দিন মিয়া, ফিসফিস করে জানায় যে পায়খানা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় রহমতউল্লা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। মামী ও সিতারার আর্তনাদ শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে জুম্মনের মা। ৩ জনে ধরাধরি করে মহাজনকে ঘরে তোলে। জুম্মনের মা নিজেই ডেকে এনেছে আলাউদ্দিন মিয়াকে। মহাজনকে বিছানায় শুইয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান চালানো হয়েছে, মাথার কাছে টেবিল ফ্যান চলছে, তবু তার কপালের ঘাম, ঘাড়ের ঘাম আর শুকায় না। ‘মামী জানে না, সিতারা ভি বুঝবার পারে নাই, মামুর স্ট্রোক হইছে, ডান সাইডটা মনে লয় প্যারালাইসিস হইয়া গেছে। অহন ডাক্তার পাই কে? মেডিক্যাল, মিটফোর্ড, আমাগো ন্যাশনাল-ব্যাকটি হাসপাতালে ফোন করছি, কয় এ্যাঁম্বুলেন্স নাই, এ্যাঁম্বুলেন্স লইয়া গেছে মিলিটারি। আহন কি করি বাবা?
আলাউদিন মিয়ার এই উদ্বেগ খিজিরের মাথায় ঢোকে না। ইবলিসের এই পতনে তার এতো হায় হায় করার কি হলো?
তুই যা বাবা। বজলুরে বিচারাইলাম তো অরে পাই না। কারফ্যুর মইদ্যে ক্যাঠা যাইবো? খিজিরের এই সরল বিবৃতিতে আলাউদ্দিন মিনতি করে, রুচিতার উপরে ডাক্তার ওদুদ বসে। যা না! বহুত বড়ো ডাক্তার।’
‘চোখের ডাক্তার।
*হউক। ব্লাড প্রেশারটা তো দেখবার পারবো। ডাইকা লইয়া আয়।
তার ঘর বন্ধ।
তাহলে বানিয়ানগর গিয়া সাইফুদিনরে লইয়া আয়। আমগো পার্টির সাপোর্টার। যা না বাবা মামুর হাল দেইখা সেতারা বেহুশের লাহান হইছে। যা বাবা’
কারফ্যুর মইদ্যে ডাক্তারে আইবো? গুলি খাইবো না?
মিলিটারি নাইক্কা। বড়ো রাস্তায় তরে একটা মিনিট ভি হাঁটতে হইবো না। গোবিন্দ দত্ত লেনের মইদ্যে দিয়ে বারাইয়া দুইটা কদম হাটলে কাঠের পুললেন। তিনটা বাড়ি পার হইলে সাইফুদিনের বাড়ি। আলাউদ্দিন মিয়া খিজিরের শতবার-দাখা বাড়ি চেনাতে চেষ্টা করে, তাতেও চিড়ে ভেজে না। ডাক্তার আইবো না।’
আইবো। ডাক্তারের হাতে রেড-ক্রস মার্ক ব্যাগ দেখলে মিলিটারি কিছু কইবো না। অরা মানুষ না? মানুষের বালা মুসিবত বোঝে না? ১০০ টাকার ১টা নোট খিজিরের হাতে তুলে দিয়ে সে বলে, যা। এই পাত্তিটা ডাক্তারের হাতে দিয়ে কইবি আলাউদ্দিন সাবের খুব বিপদ। আপনারে ডাকছে।’
মামীর বিলাপে সাড়া দিয়ে আলাউদ্দিন মামার ঘরে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই ঘরে আসে জুম্মনের মা। এইবার, এই সুযোগে খিজির একে নিয়ে সোজা কেটে পড়তে পারে। হাতে ১টা জিন্না মার্ক পাত্তি, তার এখন অভাব কি? জুম্মনের মা এসেই কাঁদতে শুরু করে, কিংবা কাদতে কাদতেই সে এসেছে, খবর পাইলা কে? আহারে। মনে হয় বাচাবো না। আল্লা! অহন আমাগো কি হইবো?
তর আবার কি হইবো? মহাজনে তরে মাগনা খাওয়ায়?’ জুম্মনের মায়ের দুঃখ উথলে ওঠে দ্বিগুণ বেগে, হায়রে আল্লা। এতো বাড়ো নামী মানুষটা বলে মইরা যায়, আর তুমি এইগুলি কি কও? তোমার দিল কি আল্লায় পাষাণ দিয়া বানাইছে?
খিজির বানিয়ানগর গিয়েছিলো। ১০০ কেন হাজার টাকা দিলেও সাইফুদিন ডাক্তার কারফ্যুর ভেতর বেরুতে পারবে না। খিজির তাকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেনি। বরং নিজে থেকে ডাক্তারকে জানিয়েছে যে বড়ো রাস্তায় মিলিটারির গাড়ি অবিরাম টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে খিজির কাজ একটা করেছে, রহমতউল্লার বাড়ির পেছনে মেস থেকে হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রকে ডেকে এনেছে। ১০০টাকার নোটটা খিজিরের কোমরে গোজা, এটা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা আপাতত তার নাই।
হবু হোমিওপ্যাথকে না ডাকলেও চলতো। এর মধ্যে টেলিফোনে আলউদ্দিন মিয়া তার দলের বড়ো বড়ো নেতাদের দিয়ে তদবির করিয়ে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালের এ্যাঁমুলেন্স ও ডাক্তার এনে হাজির করেছে। ভোরবেলার দিকে রহমতউল্লার জ্ঞান ফিরে আসে, তবে ডানদিকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার অবশ। কথা বলার জন্য খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু জড়ানো জিভের ধ্বনি গো গো করে, শব্দের আকার পায় না। এটুকু উদ্ধার করা যায় যে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার লাশটাই ফিরে আসবে। সিতারা ও সিতারার মা এ ব্যাপারে তার সঙ্গে একমত। কারফ্যুর ভেতর রোগী নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করতে আলাউদ্দিন মিয়াও ভয় পায়।
রহমতউল্লার শোবার ঘরই পরিণত হলো হাসপাতালে। খাটের স্ট্যাণ্ড থেকে ঝোলে স্যালাইন, এ্যাঁম্বুলেন্স থেকে অক্সিজেন টেন্ট নামিয়ে তৈরি রাখা হলো রোগীর মাথার কাছে, যদি দরকার পড়ে। ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে ডাক্তার চলে যায়, রাত তখন ২টার কম নয়। ঘরে মা-মেয়েতো রইলোই। মেঝেতে বসে রহমতউল্লার ডান পা ম্যাসেজ করার দায়িত্ব পেয়ে জুম্মনের মায়ের ফোপানি থামলো।
রহমতউল্লার বিছানার পাশে ইজি চেয়ারে বসে থাকে আলাউদ্দিন মিয়া। কিছুক্ষণ পর পর স্যালাইনের ফোটা গুণে দ্যাখার ভার তার ওপর অর্পিত। সায়েবের আদেশে খিজিরকে বসে থাকতে হয় ভেতরের বারান্দায়, সিঁড়ির নিচে। এখন সেখানে কোনো ঝি-চাকরানী থাকে না, হাত পা ছড়িয়ে বসে খিজির হা করে এদের মওত-খেদানো এন্তেজাম দ্যাখে। আলাউদ্দিন মিয়া মাঝে মাঝে এসে সিগ্রেট ধরায়, তার দলের বড়ো বড়ো নেতাদের টেলিফোন করে আধঘণ্টার ভেতর সে এসব কাজ সম্পন্ন করেছে—এই খবরটা নানাভাবে খিজিরকে অবহিত করে। তার গলার স্বর বাড়াবাড়িরকম উঁচু, সিতারা ও সিতারার মায়ের কানে সব কথা তার পৌঁছে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর সে কথা বলে সিতারার সঙ্গে, সিতারা না চাইতেই তাকে সান্তুনা দিচ্ছে, আরে পাগলী! এতো বড়ো ডাক্তারে কইয়া গেলো, দুইটা দিন রেস্ট লইলেই মামু এক্কেরে আগের মানুষ হইয়া যাইবো। মামু তো টেনশনের মইদ্যে থাকে, ব্লাড প্রেশারটা খুব বাড়ছিলো, প্রেশার তো এখন নর্মাল। ঠিক হইয়া যাইবো! তার স্বর ক্রমে নিচু হয়ে আসে। খিজিরের ঘুম পায়। কোথায় যেন গুলি চলছে, গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর উকি দিয়ে দ্যাখে ইঞ্জি চেয়ারে শুয়ে আলাউদ্দিন মিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে, টুলে বসে বাপের বালিশের একপাশে মাথা রেখে ঘুমায় সিতারা। আর রহমতউল্লার ডান হাঁটুর ওপর জুম্মনের মায়ের মাথা উপুড় করে রাখা। মহাজনের গা থেকে লেপ সরে গেছে। লুঙি উঠে গেছে ডান উরু পর্যন্ত। তবে তার ঐ সাইডটা এখন অচল।
সকালবেলা কারফ্যু উঠিয়ে নেওয়ার খবর পেয়ে খিজির গেলো ওসমানের ঘরে। ওসমান নাই। সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো মকবুল হোসেন, হাতে বাজারের ব্যাগ। ওসমানের খবর জানতে চাইলে বলে, না রাত্রে তো ঘরেই ছিলো। এইতো মিনিট দুয়েক আগে দেখলাম কার সঙ্গে যেন বেরিয়ে গেলো।’
খিজিরের এদিকে খিদেও পেয়েছে। ন্যাশনাল হাসপাতালের পাশে গলির মাথায় ডালপুরি ভাজা হচ্ছে, লোকের ভিড়ে সেইখানে ঢোকা অসম্ভব। নিজামি রেস্টুরেন্টটা খোলা, কিন্তু রুটি-গোশত খেতে হলে পয়সা লাগে মেলা। হঠাৎ কোমরে গোজা ১০০ টাকার নোটের কথা মনে পড়লে মহা আনন্দে খিজির নিজামিতে ঢুকে পড়ে। কোনো চেয়ার খালি নাই। খিজির এদিক ওদিক তাকিয়ে চেয়ার খালি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, এমন সময় রাস্তা থেকে আসে স্লোগানের শব্দ। মিছিল আসছে জগন্নাথ কলেজ থেকে, রেস্টুরেন্টে চেয়ারের অপেক্ষায় না থেকে খিজির প্রায় লাফ দিয়ে রাস্তায় নামে। আলুবাজার পৌঁছতে পৌঁছতে ছোটো মিছিলটার শরীর বাড়ে। স্টেশন রোড থেকে আরেকটি মিছিল তাদের সঙ্গে যোগ দিলে মিছিল স্ফীতকায় হয়ে ওঠে এবং সবাই প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলে গুলিস্তানের দিকে। কিন্তু রেলগেটের ওপারে মিলিটারি ও ইপিআরের লরির ব্যারিকেড। লরির ওপর দাঁড়িয়ে হেলমেটধারীরা মেশিনগান তাক করে রেখেছে মিছিলের দিকে। মিছিল তবু এগিয়ে যাচ্ছিলো। নেতাগোছের কেউ এসে সবাইকে ফিরে যেতে বললে মিছিল স্থির হয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে মিলিটারির লোকজন মাইকে বারবার করফু জারি করার কথা ঘোষণা করছে। হঠাৎ কয়েকটা গুলির আওয়াজ হলে মানুষ এলোমেলো ছুটতে শুরু করে।
ছুটতে ছুটতে খিজির চলে আসে নিজের মহল্লায়। বস্তিতে ঢুকতে ঢুকতে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে জুম্মনের মায়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেব। মহাজন তো অচল হয়ে পড়লো, জুম্মনের মায়ের সঙ্গে বস্তির ঘরে থাকতে তাকে এখন বাধা দেবে কোন শালা? কিন্তু বস্তিতে এসে খবর পায় যে কারফ্যু বিরতির সময় জুম্মনের মা একবার এসেছিলো। আধাঘণ্টা ভি আছিলো না, বজলুর বৌ জানায়, মহাজনের বহুত বিমার। অর লগে আমরা ভি দেখবার গেছিলাম। জুম্মনের মায়ে মহাজনের হাতপাও মালিশ করে।’
খিজির ঘরে ঢুকতে জুম্মন কি যেন লুকাবার জন্য এদিক ওদিক তাকায়। খিজিরের সঙ্গে ঘরে ঢুকছিলো বজলুও, সে চোখ রাঙায়, ‘তর হাতে কি?
কিছু না!
রঙবাজি করস? বজলুর থাবার ঘায়ে জুম্মনের লুঙির কোচড় থেকে প্লায়ার ও জু-ড্রাইভার মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। জিনিসগুলো তুলে বজলুখিজিরের হাতে দেয়, এইগুলি তর না খিজির? এইগুলি দিয়াই তো ঐ দিন আমারে খাম করলি, না? তারপর জুম্মনকে বলে, ‘তুই পাইলি কৈ?
বজলুর বৌ বলে, অর মায়ে দিছে। নইলে পাইবো কৈ?
বজলু জুম্মনের ওপর রাগ করে, তর বাপের জিনিস? কামরুদ্দিন হালায় জিন্দেগিতে এইগুলি চোখে দেখছে? জোগানদারের পোলা, তুই এইগুলি হাতাস ক্যালায়?
ভয়ে জুম্মনের ঠোঁট তিরতির করে কাপে। ভয়েও কাঁপতে পারে, রাগেও কাঁপতে পারে। খিজির জানে, রাগ হলে জুম্মনের মায়ের ঠোঁটজোড়া ঠিক এমনি করে কাপে। খিজির নরম করে বলে, ছামরা, এইগুলি দিয়া তুই করবি কি? জুম্মনের হাতে জিনিস ২টো তুলে দিতে দিতে বলে, ‘ল। রাইখা দে। হারাইবি না। হারাইলে একখান চটকানা দিয়া তর বাপের কাছে পাঠাইয়া দিমু। খিজিরের উদারতায় জুম্মন এবার ভয় পায়, প্লায়ার ও ক্রু-ড্রাইভার সে রেখে দেয় তক্তপোষের নিচে। খিজির ফের ঘোষণা করে, কইলাম না, রাইখা দে।
জোগানদারের পোলাকে এইসব যন্ত্র দেওয়া বজলু অনুমোদন করে না, দিয়া দিলি
দোস্ত ? তর কামে লাগবে না?
‘লাগবো না? আবার লইয়া আহুম।
সারাটা দিন কাটাতে হয় ওখানেই। রাস্তার মোড়ে মিলিটারির গাড়ি। এদিকে বস্তির কারো ঘরে চাল নাই। নতুন এক ভাড়াটে এসেছে, ফেরি করে তরকারি বেচে। তার ঝুড়িতে উদৃত্ত সবজি ছিলো। সেগুলো সেদ্ধ করে তরকারিওয়ালা এক চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে। খিজিরের ঘরে সবাই ধুমসে আড্ডা মারে। মহাজনের পক্ষাঘাত হওয়ায় কখনো আফসোস করে, আবার পরের মুহুর্তে তাকে গলাগলি করে। কিছুক্ষণ পর পর করফু নামক সরকারী আদেশটির সঙ্গে নানাভাবে শারীরিক সঙ্গম করার স্পৃহা জানায়। বজলুর বৌ কোথেকে ঝোলা ভর্তি কাঠালের বিচি বার করে, কবে কার বাড়ি থেকে সরিয়ে এনেছিলো কে জানে? সেই বিচি সেদ্ধ করে সবাই মিলে খাওয়া হলো। জুম্মনের গোগ্রাসে খাওয়া দেখে বজলুর বৌ আফসোস করে, ছ্যামরাটা এমুন ত্যারা অর মায়ে কতো কইলো, আমার লগে চল!’ গেলো না। মাহাজনের বাড়ি গেলে প্যাট ভইরা ভাতটা তো খাইতে পারতি।’
কিছুক্ষণ পর পর বজলু কিংবা খিজির সরু গলির মাথায় গিয়ে উকি দিয়ে আসে, কখনো জুম্মনকে পাঠায়। না, মিলিটারির গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিড়িটা পর্যন্ত আনা অসম্ভব। ওদিকের গলি থেকে কে যেন বেরিয়েছিলো। মিলিটারির হাতে তার নাস্তানাবুদ হওয়ার বিবরণ শুনে সবাই হেসেই অস্থির। বজলুর বৌ পর্যন্ত একবার উকি দিয়ে এলো। এক বুড়ো ভদ্রলোককে মিলিটারি কিভাবে ব্যাঙ লাফাতে বাধ্য করছে তার বর্ণনা দিতে দিতে সে হেসে মাটিতে গড়ায়।
সন্ধ্যার পর ট্রাক সরে যাওয়ার শব্দ আসে। খিজির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সটকে পড়ে। এই সুযোগ। যে কোনো সময় ওরা ফের চলে আসতে পারে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৮
কাল সন্ধ্যে থেকে আনোয়ারদের বাড়িতে কোঅরনটিনে থেকে এই বেরুলাম। চলেন, তাড়াতাড়ি নাশতাটাশতা করে নিই। সারাদিন প্রভিশনস নিয়ে ঘরে ফিরবেন। আমি সোজা বাসায় যাবো। কারফ্যু রিল্যাক্স করেছে মাত্র তিন ঘন্টার জন্যে। ওসমানের ঘরে ঢুকে শওকত গতরাতে আনোয়ারদের বাড়িতে ওর বড়োভাইয়ের সঙ্গে হুইস্কি খাওয়ার গল্প ছাড়ে। তা কি করে হয়? চাদে দাঁড়িয়ে ওসমান তো সারারাত শওকত ভাইকে আকাশে উড়তে দেখলো। আপনি সারারাত উড়ে বেড়াচ্ছিলেন না?
তা ওড়াই বলতে পারেন। মোর দ্যান হাফ এ বটল অফ শিভাঁজ রিগ্যাল ডিলাক্স হুইস্কি, ফিফটি ইয়ার্স ওল্ড। আনোয়ারের ভাই তিনটে পেগ মারতে না মারতেই ঘুমোতে গেলো, দেন ইট বিকেম অবলিগেটরি ফর মি টু ফিনিশ দ্য রেস্ট। শিওর, আইফেল্ট লাইক ফ্লাইং!’
আনোয়ারও তো আপনার সঙ্গে ছিলো? ‘আরে না। মওলানা ভাসানীর মিটিঙে আপনাদের কাউকে না পোয় গেলাম ওয়ারি। নো, হি ইজ স্টিল দেয়ার ইন রুরাল বেঙ্গল, ফাইটিং এ হার্ড ব্যাটল টু এলিমিনেট অল দ্য ক্লাস এনিমিজ! ওদের কোন আত্মীয় চিঠি লিখেছে, আনোয়ার নাকি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে মিসৰিহেভ করছে। হিজ মাদার ওয়াজ অন দ্য ভার্জ অফ উইপিং।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে শওকত ভাই কথা বলা অব্যাহত রাখে, ওর মার সঙ্গে কথা বলছি, তো ওর ভাই এসে বলে, কারফ্যু ইমপোজ করেছে। ওদের ওখানেই থাকতে হলো। ওর ভাই আনোয়ারের ওপর মহা খাপ্পা, বলে এসব স্রেফ হঠকারিতা। বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার সময় এটা, এখন পাঞ্জাবিদের কোণঠাসা করো। এখন এইসব শ্রেণীশত্র মারার নামে এ্যাঁনার্কি তৈরি করলে বাঙালি মিডল ক্লাস সেটেন্ড হাতে পারবে?
*আপনি কি বললেন?
আমি বললাম, তাহলে এতো মানুষ মরছে কি মিডল ক্লাসকে ফ্লারিশ করার জন্যে?তাতে ভাইয়া খেপে গিয়ে শিভাঁজ রিগ্যালের বোতল নিয়ে এলো! দুটো তিনটে পেগ মেরে বোতলটা আনোয়ারের ঘরে আমার জিম্মায় রেখে চলে গেলো নিজের ঘরে।’
ভিড়ের মধ্যে হাটা বেশ মুশকিল। বেশির ভাগ লোকের হাতে বাজারের থলে। এর মধ্যে কয়েকটা রিকশা বেরিয়েছে, কিন্তু খালি রিকশা পাওয়া অসম্ভব।
পুলিশ ক্লাবের সামনে বাস থেকে লোক নামিয়ে দিচ্ছে। গুলিস্তানের ওদিকে মিলিটারি গুলি করছে, বাস আর যাবে না। নিজামি রেস্টুরেন্টের সামনে পানের দোকান থেকে শওকত ১০টা সিগার কিনলো, নিজামিতে ভিড় ঠেলে ঢুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ২ জনে তন্দুরের রুটি ও ডাল-গোশত খেয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে, এমন শোনা যায় বাইরে মিছিল চলছে। শামসুজ্জোহার রক্ত’-বৃথা যেতে দেবে না’, ‘জেলের তালা ভাঙবো’-শেখ মুজিবকে আনবো,-স্লোগান দিতে দিতে মিছিল ছুটে যাচ্ছে নবাবপুরের দিকে।
শওকত ভাই, চলেন মিছিলে যাই।’ ওসমানের আগ্রহে সায় দেওয়ার আগেই শওকত বলে, ‘রেডিও শোনেন, রেডিওতে কারফ্যু বিরতির সময় কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করা হচ্ছে। আধঘণ্টার মধ্যেই ফের কারফ্যু জারি করা হবে শুনে লোকজন পাগলের মতো ছোটে। শওকত ৩ পাউণ্ড পাউরুটি কিনলো দেড়গুণ দামে, কলা কিনলো। ওসমান নিলো কয়েক প্যাকেট কিংস্টর্ক। দোকানপাট বন্ধ করার শব্দ পিঠে ধাক্কা দিয়ে মানুষের হাটার গতি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ওসমানদের সিঁড়ির গোড়ায় এসে শওকত বলে, ওসমান, আজ আমাকে আপনার সঙ্গে থাকতে হবে। গ্যাণ্ডারিয়ার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে রাস্তায় আর্মি নেমে যাবে।’
আসেন। এখন রিস্ক নেবেন না।’ আপনি ঘরে যান। দেখি ঐ দোকানটা থেকে টেলিফোন করে আসি। আম্মা খুব চিন্তা করবে।’
কিছুক্ষণ পর শওকত ঢুকে বলে, ‘আরে রাজশাহীতে জোহা ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর্মি নাকি বেয়নেট খুঁচিয়ে মেরেছে!’
কাকে মেরেছে বললেন? ‘জোহা ভাইকে চেনেন না, না? আমাদের গ্যাণ্ডারিয়া পাড়ার ছেলে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির টিচার। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলো! ছেলেবেলায় মিল ব্যারাকের মাঠে আমরা ক্রিকেট খেলতাম, জোহা ভাইও আমাদের সঙ্গে খেলতো। ফাস্ট ক্লাস ব্যাটসম্যান। বাসায় টেলিফোন করেছিলাম, তো আম্মা বললো যে রাজশাহী থেকে আজ ভোরবেলা খবর এসেছে। এরকম লোক হয় না রে ভাই!’
শওকত হঠাৎ চুপ করে। ওসমানের বিছানায় শুয়ে সেনাবাহিনীর অফিসারের হাতে নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্বন্ধে শওকত স্মৃতিচারণ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যায়।
ছাদে গিয়ে রেলিঙের ফাঁকে চোখ রেখে ওসমান দ্যাখে লোকজন ও যানবাহনশূন্য বিধবা রাস্তা শুয়ে রয়েছে ভোতা চেহারা করে। আকাশে রোদ চড়ে, রোদ নামতেও থাকে। দুপুরের পর ১জন বুড়ো লোককে দ্যাখা যায়, লোকটির হাতে হট-ওয়াটার ব্যাগ। আর্মির এক জওয়ান লোকটাকে কি হুকুম করলে বেচারা রাস্তায় বসে হাতজোড়া মাটিতে ঠেকায়। আর, ওসমান ভালো করে দেখে চিনতে পারে, এ তো রিয়াজউদ্দিন। সৈন্যটি হঠাৎ খুব জোরে চ্যাচায়, মাদারচোত, বাহেনচোত, বাহার নিকলে কিউ? তারপর গলা ফাটিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে কম্যাণ্ড করে, ফরওয়ার্ড ইস্টার্ট’ এই আদেশ অনুসরণ না করায় রিয়াজউদ্দিন তার লুঙি ঢাকা পাছায় বুট-শোভিত পায়ের লাথি খায় এবং হট-ওয়াটার ব্যাগ ফেলে তিড়িংবিড়িং করে ব্যাঙ লাফানো শুরু করে।
এই দেখে সেনাবাহিনীর লোকদের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্যে ওসমান রেডি হয়। কিন্তু এখানে রেলিঙ একটু উঁচু, ওসমানের মাথাও রেলিঙের সম্পূর্ণ এপারে। নিচে ডাইভ দিতে হলে তাকে প্রথমে রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়াতে হবে। তাই সই। রেলিঙের ওপরদিকের ফোকরে হাত রেখে ডান পা ওঠাতে যাচ্ছে নিচের একটি ফোকরে, এমন সময় কার হাত তার পিঠে। পা নামিয়ে নিলে পেছন থেকে কে বলে,কি করেন? দেখলে ব্যাটারা গুলি কইরা দিবো?
‘কে? রঞ্জকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওসমান তাকেও আহ্বান জানায়, ‘এসো, দুজনে শালদের ওপর লাফ দিয়ে পড়ি ওসমানের কপালে ও গলায় ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, তার চোখ লাল এবং প্রসারিত। রঞ্জু তাড়াতাড়ি পেছনের দিকে হাটতে এবং একটু টার্ননিয়ে ঢুকে পড়ে ওসমানের ঘরে। বিছানায় শওকত তখনো ঘুমাচ্ছে। ওসমানও রঞ্জকে অনুসরণ করে। ছেলেটা বেশ ভয় পেয়েছে। রঞ্জুর ভয়-পাওয়া তাকে দারুণরকম একটা ধাক্কা দেয়, মাথার ভেতরটা নতুন করে ওলটাপালটা হয় : আহা! রাত্রিবেলা বরাদায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করতে করতে মানকচুর ঝাড়ে কালচে সবুজ আঁচল জড়ানো মোবারক মল্লিকের মাকে দেখে রঞ্জু বড়ডো ভয় পেয়েছে। প্রায় ১২ বছর পাগল হয়ে থাকার পর বুড়ি মারা গেলো গত সপ্তাহে। তা সে এখানে আসবে কোথেকে? আম্মা! আম্মা’-এরপর আর মনে ছিলো না। তার মাথায় পানি ঢালছিলো কে? আসগর চাচা? নাকি আব্বা নিজেই? কি জানি’-নাঃ এরকম ভয়কে প্রশ্ৰয় দেওয়া উচিত নয়।-ওসমান জানে এসব ভয় টাইট করতে হয় কি করে! দাঁড়াও রঞ্জু বলে রঞ্জুর কাধে হাত দিয়ে তাকে সে তার বুকের কাছে টেনে আনে এবং তার শ্যামবর্ণের গালে ও বেগুনি ঠোঁটে চুমু খায়। ২/৩ টি চুমু খেলে তার উত্তেজনা শান্ত হতে থাকে, তার চোখজোড়া ঢুলে আসে। আব্বা’ রঞ্জুর এই ভয়ানক আর্তনাদে ওসমান আবার চাঙা হয়। নাঃ! ছেলেটির ভয় একটুও কাটেনি। এতো ভয় কিসের? বা হাতে রঞ্জুর চুলের খুঁটি ধরে ওসমান ডান হাতে তার গালে ঠাস করে চড় লাগাতে শুরু করে। শওকত জেগে উঠে ধাক্কায় ওসমানকে সরিয়ে দেয়। ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে রঞ্জু বলে, আব্বা ওসমানকে শওকত বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে, আপনার কি হলো? ফিলিং সিক? *আরে নাঃ ছেলেটা মিছেমিছে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এতো ভয় পাবার কি হলো? *সে জন্য হোয়াই শুড ইউ স্ক্যাপ হিম? কি ব্যাপার? আপনার শরীর খারাপ? নিচে থেকে এসেছে মকবুল হোসেন। ‘না, ভালো আছি। রঞ্জু খামাখা ভয় পাচ্ছিলো, তাই একটু শাসন করে দিলাম। চেয়ারে বসে মকবুল হোসেন পান চিবায়, রঞ্জুর খবর বোধ হয় ঠিক নয়, ওসমান তো ভালোই আছে। কোনো ঝামেলা না হলেই ভালো। লোকটা চেয়ারে পা তুলে আয়েস করে বসে। কারফ্যু হইয়া কাম নাই কাজ নাই ঘরের মদ্যে বইসা খাওদাও আর ঘুমাও। তবে কোনো বিষয়ে সে অসন্তুষ্ট, যেমন, খালি এই মিলিটারিগুলি রাস্তায় ভদরলোকদের ধইরা বেইজ্জত করে, বুঝলেন? এইটা—।’
রাখেন রাখেন। ছাদের রেলিং থেকে লাফ দিয়ে শালাদের শেষ করে ফেলতে পারি, জানেন? দেখতেই খোদার খাসি, শালাদের গায়ে জোর আছে নাকি? শালাদের সব হাম্বিতামি দেশের আনআর্মড পিপলের ওপর। দ্যাখেন না, একটা ফ্লাইং কিক দিয়ে শালাদের কোথায় পাঠিয়ে দিই। দেখবেন? চলেন, ছাদে চলেন?
শওকত তার হাত ধরে, আরে কি শুরু করলেন? বসেন না চুপচাপ। ওসমান বিছানায় বসে কিন্তু তার গলা আরো চড়ে, আরে, আপনিতো খালি বাখোয়াজি করেন। রাতভর মদ খেয়ে এসে বুলি ছাড়েন। সাহস থাকে তো চলেন– ‘
শওকত বেশ ঘাবড়ে গেছে, আপনি বরং ঘুমিয়ে নিন। রাত্রে বোদহয় ভালো ঘুমাতে পারেননি? আবার সারাদিন আপনার বিছানা অকুপই করে রাখলাম আমি। আপনি খুমান। মকবুল হোসেন রীতিমতো ভয় পেয়েছে। আমি বরং যাই। উঠে দাঁড়িয়ে শওকতকে বলে, রাত্রে তো আপনারে থাকতেই হইবো। কারফ্যুর ভেতর যাইবেন ক্যামনে? ট্রাবল হইরে আমারে খবর দিয়েন। আমি দোতালায় থাকি। কবর দিতে হেসিটেড কইরেন না।
ওসমান হঠাৎ বলে, শওকত ভায়ের থাকার দরকার কি? খিজির চলে এলে আপনি শোবেন কোথায়? ইউ বেটার গো!
ওসমান সিদ্ধান্ত নেয় যে খিজির এলেই এই কারফ্যু-চাপা শহরের ঢাকনি উল্টিয়ে সে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে।
সন্ধ্যার পর পরই খিজির আসে। শওকত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, রাস্তায় আর্মি নেই? কারফ্যুর ভেতর তুমি এলে কি করে?
ওসমানও খুব খুশি, তুমি সারাদিন ছিলো কোথায়? কাল রাত্রে তোমাকে কয়েকবার মিছিলে দেখলাম!’
কি কন? মাহাজনের গ্যাড়াকলের মইদ্যে পইড়া তামামটা রাইত আটকা থাকলাম। মাহাজনের খবর তো জানেন? মনে লয় বাচবো না। শরীলের একটা সাইড খরচা হইয়া গেছে, দোসরা সাইডটা লইয়া—।’
রহমতউল্লার শারীরিক কুশলতায় ওসমানের আগ্রহ নাই। আজ সারাদিন ছিলে কোথায়?
‘তামামটা দিন আউজকা আমার ঘরের মইদ্যে রাস্তার মোচড়টার মদ্যে মিলিটারির গাড়ি, বারাইবার পারি না। লগে বিড়ি উড়ি ভি নাই। বহুত ধান্দা কইরা ছুপায়া ছপায়৷ সালামত মিয়ার বন্ধ দোকানের বগলে গিয়া খাড়াইছিতো দেহি ঐ লাল বাড়ির নয়া ভাড়াইট সাবরে এক হামলায় মিলিটারিকান ধরাইয়া ওঠ-বস করায়। আমি আর নাই, এক্কেরে লোড় পাইড়া সিধা ঘরের মইদ্যো’ খিজির হি হি করে হাসে এবং হাসতে হাসতে ভদ্রলোকের হেনস্থা দ্যাখাবার জন্য নিজেই কান ধরে ওঠা বসা করে।—’বুঝলেন না? একটা সাব মানুষ৷ যহনই বারায়-, তহনই দেহি মাঞ্জা দিয়া বারাইতাছে, ক্যাপস্টান ফুকতাছে। হায় হায়, তারে ধইরা কানে হাত দিয়ে—।’ হসির দমকে খিজির গড়িয়ে পড়ে।
আরে রাখো’ ওসমান রাগে উঠে দাঁড়ায়, মানুষের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, আর তুমি হাসো ঐ শালা মিলিটারির কান দুটো ছিঁড়ে আনতে পারলো না?
আঃ! চ্যাতেন ক্যালায়? কারফ্যুর মইদ্যে আমি একলা একলা মিলিটারির বালটা ছিড়বার পারুম?
কারফ্যুর ভেতর কি করতে পারে তাই দ্যাখার জন্য এবং দ্যাখাবার জন্য ওসমান ছাদে যায়। শওকত এই সুযোগে নিচু গলায় খিজিরের কাছে ওসমানের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও তৎপরতার বিবরণ দেয়। রঞ্জকে চড় মেরেছে সে কথাটাও জানায় তবে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা চেপে যায়। খিজির পাত্তাই দেয় না, এইগুলি কিছু না। কয়দিন বারাইবার পারে না, তাই আন্টুপান্টু হইতাছে, বুঝলেন না?
রাস্তায় না নামলে হালায় মগজের মইদ্যে হাওয়া বাতাস খেলবার পারে না, তাই মাথাটা জাম হইয়া রইছে! খিজির তো অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে কোনো রিকশা কয়েকদিন না চালালে চেনের ভেতর জং ধরে যায়, আবার রাস্তায় চাকা ঘোরালেই সব স্বচ্ছন্দ হয়ে আসে। এতে এতো ঘাবড়াবার কি হলো?-খিজিরের এখন ঘুম পাচ্ছে। হাই তুলতে তুলতে সে মেঝেতে বিছানা পাতে, শওকতকে পরামর্শ দেয়, খাইছেন? দোনোজন ঘুমাইয়া পড়েন। বাজে কয়টা? কিন্তু সময় জানার আগেই সে উঠে বসে, কান খাড়া করে কি শোনে। শওকত উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, কি হলো?
দাঁড়ান। খিজির এবার উঠে দাঁড়িয়ে ছাদে গেলে শওকত দূর থেকে জমাটবাঁধা আওয়াজ শুনতে পায়। আওয়াজ ক্রমেই জোরদার ও স্পষ্ট হচ্ছে।
পাশের বাড়ি থেকে কোনো প্রতিবেশীকে উদ্দেশ করে কে যেন চিৎকার করে, কোথায় যেন মিছিল বেরিয়েছে। শুনছেন?
কোন বাড়ি থেকে জবাব আসে, গুলিস্তানের দিকে হতে পারে। ছাদে গিয়ে শওকত সেই অদৃশ্য ব্যক্তির ভুল সংশোধন করে, না। এটা আরো দূরের সাউণ্ড।’
ওসমান কিন্তু বুঝতে পারে যে রাস্তায় মিছিল চলছে। আকাশের মিছিলও বেরুবে। ডাঙা ও আকাশ জুড়ে এই আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
মিছিলের জায়গা সনাক্ত করার আগেই মানুষের সমবেত ধ্বনি খচিত হয় আগ্নেয়াস্ত্রের টকটকটক শব্দে। কিছুক্ষণের জন্য মানুষের কথা চাপা পড়ে অন্ত্রের দাপটে। ওসমান, শওকত ও খিজির রেলিঙে ভর দিয়ে নিচের রাস্তা দ্যাখে। অন্ধকার নির্জন রাস্তা দূরের গোলাগুলির শব্দে কাপছে। দেখতে দেখতে গোলাগুলির আওয়াজ ছাপিয়ে বেজে ওঠে মানুষের স্লোগান।
এবার কোনো প্রতিবেশী দোতলা থেকে উচ্চকণ্ঠে জানায়, নাখালপাড়ায় মিছিলে গুলি চলছে। আমার ছোটোভাই টেলিফোন করেছে, বিরাট প্রসেশন বেরিয়েছে।
মনে হচ্ছে মালীবাগের দিকে। অন্যদিক থেকে একজন চিৎকার করে, মালিবাগে নাকি বিরাট প্রসেশন বেরিয়েছে। আর্মি র্যানডম গুলি করছে।
দূরের গুলিবর্ষণ ও স্লোগানের ঠোকাঠুকি ক্রমেই স্পষ্ট হয়। এবার এই বাড়ির নিচের তলার লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ‘গওসল আজম সু ফ্যাক্টরির কর্মীরা উত্তেজিত কিংবা ভীত। ছাদ থেকে চিৎকার করে খিজির তাদের নির্দেশ ছাড়ে, ‘তরা খাড়া। মমতাজ, ফালু, কাদির, লাটমিয়া-ব্যাকটি রেডি হও। একলগে বারাইয়া পড়ম।
দোতলা থেকে মকবুল হোসেন চিৎকার করে করে ছাদের উদ্দেশে, আপনারা ঘরে ঢোকেন। ঘরে ঢোকেন। আর্মি আসলে যামনে খুশি গুলি চালাইবো।’
খিজির চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘ওসমান সাব, লন যাই! আপনেও চলেন। তার শেষ বাক্যের লক্ষ্য শওকত। চলেন যাই। রাস্তায় বহুত মানুষ নামছে। অরা কয়জনরে আটকাইবো, কন? চলেন, যাই!’
ওসমান উত্তেজনায় কাপে, শওকত ভাই, চলেন। চলো চলো। কিন্তু এইসময় দূরের গুলিবর্ষণ মনে হয় চলে এসেছে একেবারে নিচের রাস্তায়। ওসমান তাই একটু অপেক্ষা করতে চায়। কিন্তু খিজিরের ধৈর্য নাই। ঘরের ভেতর দিয়ে ধ্যাবড়া পায়ের ধপধপ আওয়াজ তুলে খিজির সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। ওসমান পিছে পিছে যাচ্ছিলো, শওকত তার হাত চেপে ধরে, দাঁড়ান। পাগল হলেন? ওসমান হাত ছাড়িয়ে নিতো, কিন্তু শওকতের হাত থেকে বেরিয়ে আসার মতো বল তার কবজিতে নাই।
ওসমানকে ফের ছাদেই যেতে হয়। শওকতের পাশে দাঁড়িয়ে রেলিঙে ভর দিয়ে দেখলো মাত্র ৭জন লোকের সঙ্গে শ্লোগান দিতে দিতে নামলো খিজির আলি, সান্ধ্য আইন সান্ধ্য আইন’–মানি না মানি না’, ‘আগুন জ্বালো আগুন জ্বলো—দিকে দিকে ‘আগুন জ্বলো’, জেলের তালা ভাঙবো’–’শেখ মুজিবকে আনবো। কয়েক মিনিটের ভেতর নানা দিক থেকে এইসব শ্লোগানের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে। মহল্লার গলি উপগলি শাখাগলি থেকে আরো সব লোক এসে ছুটছে খিজিরদের সঙ্গে। এতো লোক কোথেকে আসে? পাড়ায় কি এতো মানুষ আছে?-হ্যাঁ, এবার ওসমান ঠিক ধরতে পেরেছে। মহল্লার জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে ভিড়ে গেছে ১০০ বছর আগে সায়েবদের হাতে নিহত, সায়েবদের পোষা কুকুর নবাবদের হাতে নিহত মিরাটের সেপাই, বেরিলির সেপাই, লক্ষ্ণৌ-এর মানুষ, ঘোড়াঘাটের মানুষ, লালবাগের মানুষ। গা একটু ছমছম করলেও ওসমান সামলে নেয়। না, তার ভয় কি? এই এলাকার সবাই জানে, ভিক্টোরিয়া পার্কে পামগাছগুলোর সঙ্গে ফাঁসিতে লটকানো সেই সব মানুষ অমাবস্যায়, পূর্ণিমায়, প্রতিপদে, একাদশীতে-মধ্যরাত্রি হলেই মহল্লা জুড়ে টহল দেয়, শক্রপক্ষের গুলিগালাজের আওয়াজ শুনে তাদের কণ্ঠনালীতে, জিভে ও টাকরায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, মহল্লা মাত করে জীবিত মানুষের সঙ্গে তারা স্লোগান দেয়, মানি না! মানি না। এর মধ্যে ২ দিকের বাড়িগুলোর উদ্দেশে ১টি তীক্ষ আহ্বান শোনা যায়, বিবিজানের সিনার মইদ্যে খোমাখান ফিট কইরা নিন্দ পাইড়েন না ভাইসাবেরা, মরদের বাচ্চ মরদ হইলে রাস্তায় নামেন। লোকটি কে? এতো মানুষের মধ্যে তাকে চেনা যায় না। কিন্তু তাকে খুঁজতে খুঁজতে ওসমান দ্যাখে যে কলতাবাজারের কবন্ধটাও মিছিলে যোগ দিয়েছে। অমাবস্যার রাতে, পূর্ণিমার রাতে মুণ্ডহীন এই সেপাই ছুটে বেড়ায় নবদ্বীপ বসাক লেন, নন্দলাল দত্ত লেন, নাসিরুদিন সর্দার লেন ও পাঁচভাইঘাট লেন জুড়ে। খিজির তাকে বহুবার দেখেছে, বজলু দেখেছে, ফালু দেখেছে, মহাজনের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তাকে দেখে ফিট হয়ে গিয়েছিলো জুম্মনের মা। আজ দেখরো ওসমান। এখন কিন্তু কেউ তাকে ভয় পাচ্ছে না। মুণ্ডু নাই বলে বেচারা শুধু হাত তুলে তুলে স্লোগানে শামিল হচ্ছে। নাঃ। আর দেরি করা চলে না। ঘরে ঢুকে ওসমান জোর কদমে এগিয়ে চলে সিঁড়ির দরজার দিকে। শওকত হাত রাখে ওসমানের পিঠে, কোথায় যাচ্ছেন? কারফ্যু ভায়োলেট করলেই ফায়ার করবে।
করুক!’
না।-শওকত সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ঠিক পেছনে টকাটক টকাটক গুলিবর্ষণ শুরু হলে শওকতের সঙ্গে ওসমানকেও বসে পড়তে হয় মেঝেতে।
গুলির শব্দ থামে, কিন্তু পা দুটোকে ওসমান কোনোভাব বাগে আনতে পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। পাজোড়ার অবস্থা তখন সাইকেলের চাকার মতো, চালাতে শুরু না করলে সমস্ত শরীরটা ধপাস করে পড়ে যাবে। পা ২টো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সামলাবার জন্য ওসমান তাই ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করে। ১পা, ২পা, ৩পা, ৪পা, ৫পা, ফেলতে ফেলতে বাইরে ফের গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং ১০ম কি ১১শ পদক্ষেপে ওসমান রীতিমতো লাফাতে শুরু করে। শওকত ভয় পেয়ে নিজে পিঠ দিয়ে চেপে ধরে সিঁড়িতে নামবার দরজা। এইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে সে ঘুরতে লাগলো। তবে জায়গা বড়ডো কম বলে কখনো তক্তপোষের সঙ্গে তার পা লাগে, কখনো মাথা ঠুকে যায় দেওয়ালের সঙ্গে। লাফাতে লাফাতে ছাদে চলে গেলে সিঁড়ির দরজার ডিউটি ছেড়ে শওকতকেও ছুটতে হয় ছাদে। ওসমান। এই ওসমান’-তাকে ধরার জন্যে শওকত তার পিছে পিছে ঘোরে। কিন্তু ওসমানের গতি নির্ণয় করা কঠিন। সে এই এখন ছাদের এ মাথায় তো মুহুর্তের ভেতর ছুটে যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। ওদিকে রাস্তার গুলিবর্ষণ ও আর্তনাদের মধ্যে ঝলসে ওঠে শ্লোগানের ধ্বনি, মানি না, মানি না। একেকটি ধ্বনির ধারালো ঘায়ে ওর পা দুটো লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। পা এখন তার এতো হান্ধা যে সে যেভাবে খুশি, যতোটা খুশি লাফাতে পারে। শওকত চিৎকার করে, ওসমান প্লিজ ছাদে থাকবেন না। ফায়ারিং হচ্ছে তা ছাদে তো ওসমান সবসময় থাকছেও না। লাফাতে লাফাতে ঘর-ছাদ, ছাদ-ঘর করে বেড়াচ্ছে। কখনো লাফায় একেবারে সোজা হয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়ে ওপরদিকে। এটা ছাদেও হচ্ছে, ঘরেও হচ্ছে। ঘরেও তো ছাদ রয়েছে, তাই লাফিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়ায় সময় ঘরে থাকলে তার হাত ঠুকে যাচ্ছ সিলিঙের সঙ্গে। রক্তাক্ত হাত আবার খোলা ছাদে জুলে ওঠে মশালের মতো। শওকত তার ছুটতে ছুটতে হাপায় আর হাপাতে হাঁপাতে ডাকে, ওসমান ওসমান!
সারারাত্রি হয়তো এরকম চলতো। সিঁড়ির দিককার দরজায় করাঘাত শুনে শওকত দরজা খুলে দেয়। ভেতরে ঢোকে মকবুল হোসেন, রঙ্গু, দোতলার আরেকজন ভাড়াটে এবং ঐ ভাড়াটের ভাই বা ছেলে বা শালা। এমনকি সিঁড়ির নিচের দিকের একটি ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানু। লাফাতে লাফাতে ওসমান তখন চলে এসেছে ঘরের ভেতর। দোতলার ভাড়াটে বলে, ব্যাপার কি?
মকবুল হোসেন দাঁড়ায় লক্ষমান ওসমানের নাগালের বাইরে, ওসমান সায়েব কি হইলো, এ্যাঁ? লাফানো অব্যাহত রেখে ওসমান একটু হাসে। সে কিন্তু বুঝতে পাচ্ছে যে তার এই ব্যাপারটিতে এদের অনুমোদন নাই। কিন্তু নিজের পায়ের ওপর তার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ শেষ। রঞ্জু সাহসের সঙ্গে তার দিকে এগিয়ে আসে, নাচেন কেন? এ্যাঁ? নাচেন কেন? রঞ্জু ঠাট্টা করলেও ওসমানের এই লাফানোকে নাচ বলা যায় বৈকি। তার পা পড়ছে নিয়মিত বিরতি দিয়ে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে এর মধ্যে তাল ও লয়ও চিহ্নিত করা সম্ভব। দোতলার ভাড়াটের ছেলে কিংবা শালা কিংবা ভাই—সেই ছেলেটিও রঞ্জুর সাহসে উৎসাহিত হয়ে ওসমানের সামনে গেলে তার পায়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যায় দেওয়াল ঘেঁষে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার বাবা কিংবা ভাই কিংবা ভগ্নিপতি। এবার রঞ্জু ও শওকত একসঙ্গে ২ দিক থেকে তার পা চেপে ধরার জন্য এগিয়ে আসে। ওসমান যখন খুব জোরে লাফিয়ে তক্তপোষের কাছাকাছি এসেছে, তক্তপোষে উঠে দাঁড়িয়ে শওকত তখন ডানহাত দিয়ে ধাক্কা দিলো তার কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জু ঘুষি লাগায় ওসমানের উড়ন্ত হাঁটুতে। ওসমানের পাজোড়া শিরশির করে; কতোকাল আগে রেললাইনের কাছে বাবলাবনে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলো, সে যেন নিজেই নিজের হাঁটুতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার পাশে ছিলো কে? দুর্গাঁ? এই ঘটনা কি দুর্গার সিঁদুর-কেটা চুরির আগের না পরের? ধপাস করে পড়ে যেতে যেতে ওসমান মনে করতে পারলো না। মুণ্ডসমেত তার ধড় পড়েছে মেঝেতে, পাজোড়া তক্তপোষের ওপর। সবাই মিলে তাকে বিছানার ওপর ভালো করে শুইয়ে দেয়। এমনকি তার পায়ের তুলনায় মাথা নিরাপদ ভেবে মকবুল হোসেন পর্যন্ত ওসমানের মাথা বালিসে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দেয়। দোতলা থেকে বালতি ভরে পানি এনে তার মাথায় ঢালতে ঢালতে দোতলার ভাড়াটে মত প্রকাশ করে, ডাক্তার দ্যাখাইতে হইবো।’
সবাই চলে গেলে শওকত তার পা টিপে দেয়। ওসমানের পায়ে বড়ডো সুড়সুড়ি লাগছে। কিন্তু উঠে বসার ক্ষমতা তার নাই, শুয়ে শুয়েই আস্তে আস্তে পা নাচায়। পায়ে পায়ে প্রায় নিঃশব্দ তালি বাজে, সমস্ত ঘর তার চারদিকে বো বো করে ঘুরতে থাকে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৩৯
বাবা তোর পাওত পড়ি বাবা মুখ দিয়ে অক্ত উঠা মরবু বাপ। নাদু পরামাণিকের কাকুতি মিনতির সঙ্গে আরো কেউ কেউ চেংটুকে অনুরোধ করছিলো, হামাগোরে দ্যাখা ঘটনা বাবা, এই গাছোত যাই একোটা কোপ মারছে মুখত তাই আর ভাতের একটা নলাও তুলব্যার পারে নাই গো! অক্তবমি করতে করতে সিটক্যা মরছে!’
কিন্তু বৈরাগীর ভিটায় আজ এতো মানুষ, ঝুড়ি ও ডালের জঙ্গল সাফ না করলে লোকজনের বসবার ঠাই হয় কি করে? মানুষও এসেছে বাপু! ভিড় দেখে মনে হয় এদিককার গোটিয়া, তালপোতা, পদুমশহর, চিধুলিয়া, উত্তরের চন্দনদহ, দরগতলা, কর্ণিবাড়ি, পশ্চিমের কড়িতলা, দরগতলা, কামালপুর, গোলাবাড়ি—কোনো গ্রামে পুরুষমানুষ আজ ঘরে নাই। দূরের চর এলাকার লোকও এসেছে। যমুনার গহীন ভেতর থেকে জেগে-ওঠা ডাঙার মানুষ এদিকে খুব একটা আসে না, আজ তারা এসেছে দল বেঁধে। এদের বেশির ভাগ লোক বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দার খবর জানে না। তাই কেউ হাতের দা, এমনকি কাস্তে বা কোদাল দিয়েও ডালপালায় কোপ মারে। একেকটা কোপে বটপ্রাসাদ প্রতিধ্বনি তোলে। প্রতিধ্বনি প্রথম প্রথম ছিলো গুরুগম্ভীর, সেই আওয়াজে মানুষের গা ছমছম করে ওঠে। ডালপালা ও ঝুড়ির সংখ্যা একটু কমতেই প্রতিধ্বনি থেকে গাম্ভীর্য ও দন্ত ঝরে পড়ে, দেখতে দেখতে খটখট ও ঠকঠক ধ্বনি ছাড়া তার তেমন কিছুই থাকে না। এই শব্দসমূহ ঝরঝর করে ও পরে শিরশির করে ছড়িয়ে পড়ে পাতায় পাতায়, ডালপালায়, ফলের বোটায় এবং শালিক-হরিয়ালের পাখনায় পাখনায়। কিছু ফল টুপটাপ করে নিচে পড়ে কিছু পাতা বেঁটা থেকে খসে শূন্যে ভাসে এবং কিছু পাতার বাঁধন শিথিল হয়ে আসে। পুরুষানুক্রমে এই গাছের কোলে-কাখে বড়ো-হওয়া শালিক-হরিয়াল অতিরিক্ত উত্তেজনায় ডাল ভাঙার ও কুড়ালের কোপের ধ্বনির পাশাপাশি উড়াল দেয় উত্তরের দিকে।
বৈরাগীর ভিটা উপচে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে চাষের মাঠে, একদিকে পুকুর পাড় পর্যন্ত। অনেকে একটু ভয় পায়, তারা ইচ্ছা করেই সরে বসেছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। ইন্টু মুড়ে বসে সবাই সমাবেশের ঘনত্ব বাড়ায়। ভাঙাচোরা ও মাটির সঙ্গে প্রায় সমানহয়ে-যাওয়া পুরনো ইটের বেদীর ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের কাগজ থেকে পাঠ করতে শুরু করে আলিবক্স। তার পড়া তেমন শুদ্ধ নয়। যমুনার ভিজে বাতাসের ঝাপটায়-ভারি জিভে চ বর্গের তালব্য ধ্বনিগুলো সে দস্তমূলীয় উচ্চারণ করে। এতে আনোয়ারের অনুমোদন নাই কলেজে-পড়া ও পাটি-করা ছেলেদের আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত। তার বাক্যও মাঝে মাঝে অশুদ্ধ, প্রধানত সাধু ভাষায় লেখা হলেও চলিত রীতির হঠাৎ-ব্যবহার কানে লাগে। তবে আলিবক্সের পড়া ও মাঝে মাঝে দর্শকদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলা শুনতে শুনতে আনোয়ারের অস্বস্তি কমে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো লাগতে শুরু করে। আলিবক্সের কথা খুব স্পষ্ট। তার একই কথার পুনরাবৃত্তি বাহুল্য মনে হয় না, তার ভঙ্গি জড়তামুক্ত। খয়বার গাজীর গোরুচুরির প্রসঙ্গে এলে তার পাঠ ধীরগতি হয়, ‘ধারাবর্ষা চরের হোসেন আলী ফকিরকে প্রধান সহযোগী মোতায়েন করিয়া উহার নিযুক্ত মানুষ দ্বারা কৃষকচাষীদের ঘর হইতে গোরু-চুরির যে তৎপরতায় আপনি লিপ্ত, উহা এতদঅঞ্চলের মানুষের ত্রাস ও মৃত্যুর কারণ হইয়াছে। আপনার জ্ঞাতসারে ও আপনার হুকুমে আপনার বেতনভুক্ত শয়তান মোহাম্মদ হোসেন আলি ফকির তাহার বর্গাদার ও পত্তনি চাষীদের দ্বারা গরীব কৃষকদের গোরুচুরি করিয়া থাকে। আলিবক্স মুখ তুলে থয়বার গাজীর দিকে তাকায় আপনি কি ইহা অস্বীকার করতে পারেন?
খয়বার গাজীকে বসানো হয়েছে ১টা বেঞ্চে, তার পাশে জালালউদ্দিন। এদের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাদু পরামাণিক। লিখিত অভিযোগসমূহ পড়তে পড়তে আলিবক্স বারবার খয়বারকে ঐ প্রশ্ন করছিলো। প্রথমবার সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সমাবেশের বিশাল অংশ তার না শোনার সঙ্গে সঙ্গে শালা কথা কস না। শালা কুত্তার বাচ্চা কথা কস না বলে গর্জন করে ওঠে এবং তারপর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই আদেশটি সে মেনে চলেছে।
আলিবক্স পড়ে,আপনার চুরি-করা গোরুর বাথান হইতে আপনার নির্ধারিত জরিমানা পরিশোধ করিতে না পারায় দরিদ্র চাষী শুকরা মণ্ডল ওরফে পচার বাপ আপনার নিয়োজিত মানুষের হাতে প্রাণ দিয়েছে। নানা অজুহাতে হুকুম দিয়া আপনি মানুষ হত্যা করেন, উহাদের সংখ্যা আমাদের জ্ঞাতসারে নয়জন।
পচার বাপের ছেলে পচা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে কাঁদে তার কোলের ন্যাংটা ছেলেটা। পশ্চিমে খিয়ার অঞ্চলে ধান কাটার কাজ সেরে খাওয়া দাওয়ার পরও দেড় কুড়ি টাকা নিয়ে গতকাল সে বাড়ি ফিরেছে। হামলানো কান্নায় তার ক্রোধ বোঝা যায় না, আপাতত পিতৃশোকই তাকে সম্পূর্ণ দখল করে রেখেছে। তবে চিৎকার করে রাগ জানায় নবেজউদ্দিন, মাকুচোষ শয়তানকে বিরিঞ্চি থাকা নামাও। হামারই গোরু, পয়সা দিয়া লিয়া আসা লাগে হামাকই।’
দরগাতলার বাঁকা সাকিদার উঠে দাঁড়ায়, শালা খুনী। শয়ের উপরে মানুষ মারছে। কিসের বিচার করো তোমরা? এক কোপেত শালার কাল্লাখান আলগা করা দাও।
হাতের কাগজ থেকে মুখ তোলে আলিবক্স, আমরা এ পর্যন্ত নয়জনের খবর পাইছি। আপনে আন্দাজ শয়ের কথা তোলেন কিসক?’ খয়বার গাজীর হুকুমে বিভিন্ন সময় নিহত ৯ জন ব্যক্তির পরিচয় এবং তাদের কিভাবে হত্যা করা হয় আলিবক্স সেই বিবরণ পড়ে।
বাঁকা সাকিদার আরেকজনের কথা তোলে, ছাইহাটার আকালুর ব্যাটা শহরালির কথা বাদ দিলেন যে?
‘না’ শহরালি নিহত হয় ছাইহাটার চেয়ারম্যান খবির মণ্ডলের হুকুমে। তার বিচার করবে। ছাইহাটার মানুষ। কাল ছাইহাটাত গণ-আদালত বসবো। সবাইকে এবার চুপ করতে বলে আলিবক্স পড়ে, নয়টি নরহত্যাসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কার্যকলাপ দ্বারা মোহাম্মদ খয়বার হোসেন গাজী, ওরফে খয়বার গাজী এতদঅঞ্চলের মানুষের সমূহ বিপদ ও সর্বনাশ ঘটাইতেছে। অত্র আদালত তাহার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। পাঠ স্থগিত রেখে যে সমাবেশের অনুমোদন চায়, খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড কি আপনারা অনুমোদন করেন?
আকস্মিক নীরবতার সৃষ্টি হলো। আলিবক্সের মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে সবাই এদিক ওদিক দ্যাখে। খয়বার দিকে কিন্তু কেউ তাকায় না। সিন্দুরিয়া চরের এক লোক হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, ‘ধরো শালাকা’
‘শালাক এখনি মারো৷’ আবার সবাইকে শান্ত হতে বলে প্রস্তাবটিকে আলিবক্স রায়ে পরিণত করে এইভাবে, সর্বসম্মতিক্রমে এই গণ-আদালত মোহাম্মদ খয়বার হোসেন গাজীকে মৃত্যুদণ্ড দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল।
মানুষের বিপুল কোলাহলের মধ্যে খয়বার গাজীর মুখ আরো নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। হাতের কাগজ পড়েই চলেছে আলিবক্স। এখন আফসার গাজীর অপরাধের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে।
জমির আইনকানুন আফসার গাজী ভালো বোঝে। এসব ব্যাপারে তার কাছে কেউ এলে সে বিনা পয়সায় পরামর্শ দিয়ে থাকে। জমিজমা নিয়ে পারিবারিক সমস্যা দাখা দিলে সমাধান করার জন্যে সে সবসময় প্রস্তুত। কিছুদিনের মধ্যে সমস্যাসস্কুল পরিবারের কোনো একটি পক্ষ মামলার কাটা থেকে মুক্ত হয়ে দ্যাখে যে তাদেরই কোনো টিপসই বা ছাপের কল্যাণে জমি চলে গেছে আফসার গাজীর দখলে। আবার বন্যা কি খরা কি এমনি কোনো অভাবের সময় এলে তার তৎপরতা দারুণ বেড়ে যায়। ২৫/৩০ টাকা ধার দিয়ে আফসার তখন লেগে গেলো জমি লিখে নেওয়ার কাজে। চন্দনদহ বাজারে চায়ের দোকানের মাটির বারদায় এক বুড়ো রাত্রি কাটায়, দিনের বেলা ভিক্ষা করে বাজারের প্রান্তে বটতলায় বসে। লোকটা দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্য খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু উচ্ছসিত মানুষের সবাই একসঙ্গে কথা বলতে চায় বলে লোকটির সুযোগ মেলাই মুশকিল। শেষ পর্যন্ত পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা চাওয়ার পদ্ধতি প্রয়োগ করে কাঁদতে শুরু করলে সবাই তার দিকে মনোযোগ দেয়। কি ব্যাপার?—না, গতবার বড়ো বানের সময় যখন বাধের ওপর জীবনযাপন করছে আফসার গাজী তাকে ৩০টা টাকা দিয়ে সাদা কাগজে একটি টিপসই দিয়ে নেয়। সেই কাগজ পরে পরিণত হয় জমি বিক্রির দলিল। বন্যার পর তার সবেধন নীলমণি সেই ১ বিঘা জমিতে চাষবাস করতে শুরু করে আফসার গাজীর বর্গাদার। বুড়ো বাধা দিতে এলে আফসার গাজীর লোকজন তাকে এ্যাঁয়সা মার মারে যে বেচারাকে চন্দনদহ বাজারে বটতলায় না বসে আর বাঁচার পথ থাকে না। এখন তার জমি ফেরত পাবার কোনো রাস্তা কি এরা বাতলাতে পারে না? তার এই জিজ্ঞাসার জবাব দেয় ১টি ছেলে, জমি সব ফেরত নিয়া ভাগ করা দেওয়া হবে সোগলির মধ্যে সমান ভাগ হবো ছেলেটি আলিবক্সের দলের কর্মী, ভূমিবন্টন সম্বন্ধে দলের নীতি ব্যাখ্যা করে, একোজনের, মানে একো পরিবারের নামে দশ বিঘা জমি রাইখা বাদ বাকি বরাদ্দ করা হবো গরিব চাষাগোরে মধ্যে।’
এই ঘোষণায় একটা হৈ চৈ পড়ে যায়। ‘তা হবো ক্যামনে? জমির দলিল লাগবো না? পরচা লাগবো না? ‘জমি এখনি ভাগ করো। কিসের দলিল? শালাগোরে সব দলিল জাল!’ এবার আলিবক্সের দলের ঐ ছেলেটি ফের উঠে দাঁড়ায়, এতো মানুষ এক সাথে কথা কলে কাম হবো? আলিবক্স তখন গাজী মোহাম্মদ আফসার আলী ওরফে আফসার গাজীর দও ঘোষণা করে। আফসার গাজীর সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে গরিব, চাষীদের মধ্যে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এর ওপর তাকে যেভাবে হোক গ্রেফতার করে ৫০ ঘা বেত মারার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হলে একসঙ্গে অনেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজ নিজ হাতে অন্তত ১০ ঘা করে বেত মারার জন্যে উদগ্রীব প্রায় ২৫/৩০ জন লোক। অনেকের গায়ে আফসার বা তার হুকুমবরদারদের মারের দাগ এখনো টনটন করে। তাকে কয়েক খামারতে পারলে এই ব্যথার উপশম ঘটে। সবাই একই বাসনা প্রকাশ করতে শুরু করলে আলিবক্স তাদের বসতে বলে, ‘আরে আফসার গাজী আর রশিদ মিয়া তো এখন গরহাজির। দুই শয়তানোক যখন পাওয়া যাবো ত বিবেচনা করা দেখলেই হবো।
রশিদ মিয়ার কি করলেন? আলিবক্স জানায় যে তারও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তার অপরাধ ও শাস্তির বিবরণ পড়ার সুযোগ না দিয়ে একজন দাবী করে, অশিদ মিয়ার হোল আর বিচি ক্যাটা, ছেচ্য নুন-মরিচ দিয়ে ভর্তা করা কুত্তাক খিলাও। তার লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ সহযোগে এই খাদ্যবস্তু প্রস্তুতের প্রস্তাবে অনেকেই হাসে, তবে কেউ প্রতিবাদ করে না। কারণ নারী সহবাস হলো রশিদ মিয়ার সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাস। নারী-ভোগের ব্যাপারে লোকটি শ্রেণীচু্যত, চাষাভূষা বা কমলাপাটের বেঝিদের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব বরং বেশি। চন্দনদহ বাজারের পশ্চিমে এতো চমৎকার বেশ্যাপাড়া-কতোকাল থেকেই এই এলাকার ভদ্রলোকদের উদৃত্ত কাম মেটাবার জন্য সেটা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়ে আসছে.–অথচ রশিদ মিয়া তার ধারে কাছেও যাবে না। অন্যান্য ঋতুতে দুপুর বেলা এবং ধান কাটার সময় চাষীরা পশ্চিমে খিয়ার অঞ্চলে গেলে সন্ধ্যার পর সে চাষাদের বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর করে। একবার ১টি মেয়ের স্বামী হাতে দা নিয়ে তেড়ে এলে রশিদ মিয়া পালিয়ে এসেছিলো। কিন্তু ১সপ্তাহের মধ্যে মিয়া বাড়িতে চুরির তদন্তে এসে পুলিস ঐ লোকটিকে ধরে নিয়ে যায়। থানা পুলিস ও কোর্ট-কাছারি করতে করতে লোকটা ফতুর হলো এবং তারই আদেশে তার বৌ শেষ পর্যন্ত কাজ খুঁজতে যায় রশিদ মিয়ার বড়ি। কিন্তু রশিদ মিয়া তদিনে তার প্রতি আসক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং মেয়েটি তার স্বামীকে কোনো সাহায্য করতে পারলো না। ভিটামটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে তারা চলে গেলো যমুনার গভীরে ভেতরে কোনো চরে। তার ভিটার ওপর এখন রশিদ মিয়া ডিপ-টিউব ওয়েল বসিয়ে চমৎকার ইরি ধানের চাষ করছে।
আলিবক্স রশিদ মিয়ার জমি দখল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে প্রৌঢ় একজন চাষী উঠে দাঁড়ায়, তার আবেদন, তার ডিপকল উঠায়া হামার ভিটাত আবার বাড়িঘর তুলবার চাই।’
কিন্তু রশিদ মিয়াও অনুপস্থিত। ধরতে পারলেই তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। চেংটু জিগ্যেস করে, যাই হাজির আছে তাকে তো ফাঁসি দেওয়া হবো? ‘হু ফাসি না, মৃত্যুদণ্ড যেমন করা হোক মারা হবো। কখন? এইবার খয়বার গাজী মুখ তুলে চেষ্ট্রর দিকে সরাসরি তাকাবার চেষ্টা করে। তার ধারণা চেন্টুর সঙ্গে চোখাচোখ হলে চাষার ছেলে একটু দমে যাবে। কিন্তু খয়বারের চোখ নিম্প্রভ, সে ২টো দৃষ্টিবঞ্চিত হয়ে এদিক ওদিকে ঘুরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিচের দিকে। পান জরদার খয়েরি ঠোঁটজোড়া খুব কাপছে, কাপন থেকে মনে হয় না সেগুলো কোনো শব্দ বের করতে সক্ষম। তার পেছনে দাঁড়িয়ে নাদু বলে, ’ও মিয়া, কথা কন। চ্যাংড়াপ্যাংড়াক বুঝ দিয়া কথা কন। জালালউদ্দীন মাস্টার একবার উঠে দাঁড়িয়ে ফের বসে পড়ে। খয়বার গাজীর শরীরের সবটাই এখন কাপছে। চেন্টু এগিয়ে যায় আলিবক্সের দিকে, ভাইজান আসামীক ক্যামন কর্যা কোপ দেওয়া লাগবো কয়া দ্যান!
বিকালবেলার আলো তার কুড়ালে ঠিকরে পড়ছে। চেষ্ট্রর শরীর একটু একটু কাপে, কিন্তু তার চোখ স্থির। আনোয়ারের দেহেও চঞ্চলতা, তার চোখ দুটো এখন একেবারে ফাক হয়ে গেছে, পলক ফেলা কঠিন। খোলা চোখ দিয়ে সে বটবৃক্ষের আগাপাস্তালা দাখার চেষ্টা করে। গাছের ওপর মনে হয় পাতলা কালি জমেছে, কোনো কোনো পাতার গুচ্ছে আরো ওপরকার আলো পড়ায় সেইসব জায়গা ঝকঝক করে। নিচে কোনো জায়গা খালি নাই। মানুষ, কেবলি মানুষ। মানুষের নীরব মুখগুলো ক্রমে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
আলিবক্স বলে, চেংটু, আগায়া আসো।
হঠাৎ হু হু কান্নার ধ্বনি এই ভয়াবহ নীরবতাকে ছিঁড়ে ফেলার আয়োজন করে। আনোয়ার চট করে তাকায় বটগাছের মাথার দিকে শালার পুরনো বাসিন্দা কি নতুন কোনো উৎপাত শুরু করলো? না। কাদছে খয়বার গাজী। আর কাঁদে নাদু। কাঁদতে কাঁদতে নাদু ইটু ভেঙে বসে পড়ে, হামার ব্যাটা হয় তুই মানুষ খুন করবু?
এই মানুষটা কতোগুলো মানুষের জান কবচ করছে তার হিসাব রাখে? এই মানুষ কতোগুলা মানুষের রুজি নষ্ট করছে, কও তো? ছেলের জবাব শুনে তার কান্না আরো উথলে ওঠে।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় জালালউদ্দিন, আমার একটা আরজি আছিলো।
তাড়াতাড়ি কন। বেলা যায়। আন্দারের মধ্যে কাম সারা কঠিন। আলিবক্সের অনুমতি পেয়েও জালাল মাস্টার দাঁড়িয়ে কাপে।
আলিবক্স তাগাদা দেয়, তাড়াতাড়ি কন গো! জালাল মাস্টারের চোখ তখন আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার একটু এগিয়ে আসে, বলেন। ভয় কি? বলেন না!
আলিবক্স হঠাৎ ডাকে, চেংটু, রেডি হ।
জালাল মাস্টারের ঠোঁট কাপে, হাজেরানে মজলিসের কাছে-।
কে যেন সংশোধন করে, কন গণ-আদালত!
মহামান্য গণ-আদালতের নিকট মৌলভি মোহাম্মদ খয়বর গাজী সাহেব করুণা ভিক্ষা করেন।’
সমাবেশ জবাব দেয়, উগল্যান ধাদার কথা থোন।’
শালাক এটি কোপ দিয়া মারার পরে গোর আজাব আরম্ভ হবো। তখন বুঝবো মানুষের উপরে জুলুমের ঠেলা আল্লার বিচার যখন আরম্ভ হবো।
‘আঃ! চুপ করেন। আলিবক্সের এই নির্দেশে লোকজন থামলে জালালউদ্দিন ফের মুখ খোলে, ‘আপনেরা তাক একটা সুযোগ দেন। তওবা করার সুযোগ দেন।’
না। সুযোগ বহুত পাইছে।
জালাল মাস্টার বলে, ‘না, সেই কথা নয়। খায়বার গাজী সাহেবের একটি প্রার্থনা, কাল তিনি জুম্মার নামাজ আদায় করবার চান। তার এই অন্তিম বাসনা—।
তার ইচ্ছা তাকই কবার দেন। আলিবক্সের এই শর্ত আনোয়ার অনুমোদন করতে পারে না। বলুক না। তিনি না বলতে পারলে আর কেউ বললে ক্ষতি কি?
জালালউদ্দিন এবার সাহস পায়, ‘বাবারা, দোষক্রটি নিয়াই মানুষ। তার পাপতাপের শাস্তিও তো তাই ভোগ করবো মৃত্যুর আগেই তাই একবার জুম্মার নামাজ পড়বার চায়। এই কথার পুনরাবৃত্তি করলে সবাই হঠাৎ চুপ করে এবং শেষ বিকালের ময়লা আলোতে গোটা বটগাছ জুড়ে শালিক হরিয়াল চ্যাচাতে থাকে। করমালি বলে, উগল্যান রসের কথা থোন!
চেন্টু ঘুরে দাঁড়ায় সমাবেশের দিকে মুখ করে এই মানুষের আবার নামাজ বন্দেগি কি? তামাম জেবন তাই মানষেক জল্যা পুড়া মারছে। চুরি করছে। তার আবার নামাজের হাউস হয় কিসক?’
নাদু ডুকরে কেঁদে ওঠে, এতো বড়ো নামী মানুষটা, তার একটা হাউস রাখবেন না বাবা? আলিবক্স প্রস্তাব করে, আদালতের নিকট আমি একটা আবেদন করি। আসামীরে মগরেবের নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হোক। বাদ মগরেব তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবো।
সমাবেশ থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়। একজন বলে, হাজার হোক, আল্লার নাম নিবার চায়। দ্যাও বাপু, মগরেবের নামাজ পড়বার দাও।
বাবারা, বুদ্ধি হওয়ার পর জুম্মার জামাত কোনোদিন বাদ দেই নাই। একবার কঠিন রোগ হলো, দুই মাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে, এই আনোয়ার বাবাজীর বাপখয়বার গাজী কান্নায় ভেঙে পড়ে, আনোয়ারের বাবার সেবা শুশ্ৰুষার বিবরণ স্পষ্ট বোঝা যায় না। আনোয়ার একটু অবাক হয়, খয়বার গাজী হঠাৎ এতোগুলো কথা বলে ফেললো কি করে? জুম্মার নামাজ পড়ার বাসনা কি তার মধ্যে এতোই শক্তি সঞ্চার করলো? তার চোখ এখনো নিচের দিকে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় সে প্যানপ্যান করে, জেলহজ্জ্ব চাদের পয়লা জুম্মাটা পড়া যদি মরবার পারি তো—!
সবাই এখন চুপ। আনোয়ার ভয় পায়, লোকটার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে না দিলে সমাবেশের ভেতর আবার বিপরীত প্রতিক্রিয়া না হয়। শোনেন’, আলিবক্সের কানের কাছে
মুখ নিয়ে আনোয়ার ফিসফিস করে, ব্যাপারটা কনসিডার করতে হয়। মানুষের সেন্টিমেন্ট আবার হার্ট না হয়!
আলিবক্সের স্বরের মাত্রা কিন্তু স্বাভাবিক, ‘আরে রাখেন। শালা টাইম চায়, বুঝলেন না? পাবলিক ঠিকই বোঝে, মানুষের বুদ্ধিসুদ্ধি আপনার চায়া কারো কম না, বুঝলেন?
জালালউদ্দিন এবার হঠাৎ হাত ধরে ফেলে আলিবক্সের, বাবা, তুমি আমার ছাত্র না হলেও পুত্রতুল্য। তোমার আত্মীয়স্বজন ইষ্টিকুটুম্বের মধ্যে আমার ছাত্র নিশ্চয়ই আছে– ‘
‘মাস্টার সায়েব, আমার জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে আপনার ছাত্র থাকা সম্ভব নয়। বংশের মধ্যে ল্যাখাপড়া করছি খালি আমি একলাই।’
একটু দমে গেলেও জালালউদ্দিন হাল ছাড়ে না। একটা দিন দিব্যার পারেন না? নিজেগোরে মসজিদ, দাদাপরদাদারা বানায়া গেছে, একটা দিন খালি জুম্মার জামাত পড়বো!
আলিবক্স জবাব না দিয়ে খয়বার গাজীর অপরাধের তালিকা লেখা লম্বা কাগজটা ভালো করে পরীক্ষা করে। দলের কর্মীরা কাগজটা খয়বারের পিঠে ঠেকিয়ে দেখে নিলো, একটু পর মৃতদেহের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হবে। খয়বারের প্যানপাননি পরিণত হলো হাউমাউ আর্তনাদে। জেলহজ্জ্ব চাদের প্রথম জুম্মার নামাজ পড়ার আকুল পিপাসা তার মাথায় চড়ে, আল্লার নাম বাদ দিয়ে সে তার করাচি, ঢাকা ও বগুড়া শহরে বসবাসকারী ৩ ছেলে, মৃত কন্যা এবং বাপের বাড়িতে বেড়াতে-যাওয়া স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। এই আর্তনাদের মর্মোদ্ধার করা আনোয়ারের পক্ষে অসম্ভব। লোকটাকে নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়াটা বোধ হয় উচিত। কিন্তু আলিবক্স রাজি হতে চায় না, তার আসল মতলব কাইটা পড়া!
আলিবক্সের কানে মুখ নিয়ে আনোয়ার ফিসফিস করে, মরার আগে একটা দিন কি এসে যায়? সরকারী আদালতেও তো দেয়!
খয়বার গাজীর হাউমাউ কান্না নাদুকেও জোরে জোরে বিলাপ করতে উদ্বুদ্ধ করে, এই গাওয়ের উপরে আল্লার গজব পড়বো বাবা।
ওদিকে একটু দূরে গাবতলার দিকে কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। বাদু শেখ ও নবেজউদ্দিন তাই দেখে নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে, বটবৃক্ষের পুরনো বাসিন্দা তার বাস্ত ভিটায় মানুষের সমাগম ও কোলাহলে ক্রুদ্ধ হয়ে কি শাস্তি দিতে আসছে? করমালিও ভয় পায়, সলক কিসের গো? হাতের দায়ের ওপর তার আঙুলগুলো চেপে বসে। একটা হাজাকের আলো কাছাকাছি চলে এলে পেছনে ২০/২৫ জনে একটা মিছিল স্পষ্ট হয়। মিছিল সামনে পৌছুবার আগেই শোনা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্ৰ’-মানি না মানি না’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা:-তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জেলের তালা ভাঙবো’-শেখ মুজিবকে আনবো’।
মিছিলের সামনে প্যান্ট-শার্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা কয়েকজন কলেজের ছাত্র। সমাবেশের মানুষ ওদের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। ওদের একজন আলিবক্সকে চেনে, *আপনাদের মিটিং?
‘গণ-আদালত বসছে।’ ভালো করছেন। পশ্চিমাদের দালালগুলারে শাস্তি দেন।’ চেংটু আলিবক্সের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়, বড়ো দেরি হয়ে যাচ্ছে, খয়বার গাজীকে এক্ষুনি শেষ করে ফেলা দরকার।
কিন্তু হ্যাঁজাকওয়ালা মিছিল তখন সমাবেশে ঢুকে পড়েছে। এদের একজন বক্তৃতা শুরু করে, ভাইসব, স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহী মোনেম শাহীর শোষণে সোনার বাঙলা শ্মশানে পরিণত হয়েছে। চেংটু বক্তার দিকে এগিয়ে যায়, এখন ইগল্যান থোন। হামাগোরে কাম হবা নাগছে। কিন্তু সমবেত মানুষের কেউ কেউ বস্তৃতা শুনতে চায়, হোক না! ভাষণ হোক!’
উৎসাহিত যুবক তার বক্তৃতা অব্যাহত রাখে, বাঙালির প্রাণের দাবী, বাঁচার দাবী নিয়ে আন্দোলন করার অপরাধে বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের শিকার। বাঙালি আজ ঐক্যবদ্ধ, একমন, একচিত্ত—।
আলিবক্স তাদের একজনকে ডেকে বলে, আমাদের আদালতের কাম হয়া যাক। আপনে না হয় পরে লেকচার দিয়েন।’
বক্তা যুবক থামতে পারে না। তার দলের লোকটি বলে, আমরা তো লেকচার দিতে আসিনি। চন্দনদহ বাজারে কাল আমাদের সভা, তাই ঘোষণা করতে এসেছি।
এদের কেউ কেউ জালালউদিনের ছাত্র। তার সঙ্গে কথাবার্তায় বোঝা যায় একজন পড়ে রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে। আর একজন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ছাত্র। আর বক্তৃতা করছে যে ছেলেটি সে হলো দরগাতলার সরকারদের ছেলে, বরাবর ঢাকাতেই মানুষ, ঢাকা ইউনিভারসিটির নিমনেতা গোছের ছাত্র। জালালউদ্দিন তার ভাষণে অভিভূত, বোঝাই যায়, ভাষার উপর ছেলের দখল খুব!’
কিন্তু অধৈর্য হয়ে ওঠে চেংটু, কথা তো মেলা কলেন। আপনাগোরে মিটিঙে কাল যাওয়া হবো। এখন আমাগোরে কাম করবার দ্যান তো!
চেংটুর হাতে কুড়াল এবং চোখের স্থির মণি দেখে বক্তা ও তার সহকর্মীরা থামে। তাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত সদাসপ্রতিভ অভিব্যক্তি দিয়ে এই ভড়কে-যাওয়া সামলানো দায়। আগামীকাল বিকেল ৩টায় চন্দনদহ বাজারে তাদের জনসভায় যোগদানের আহ্বান জানিয়ে তারা পা দেয় হয় গ্রামের রাস্তায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের শ্লোগান এসে প্রতিধ্বনিত হয় বটগাছের পাতায় এবং ডালে। ওরা যাবার পর বোঝা গেলো যে সমাবেশের লোকও একটু কমে গেছে। আরো কিছুক্ষণ পর বোঝা যায় যে কয়েকজনের ছোটো একটি দল সমাবেশ থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গাজী বাড়ির দিকে। কারা? আনোয়ার পাউঁচু করে দেখবার চেষ্টা করছে, ৫/৬ জন লোকের ছায়া ছায়া গতি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। কারা?
করমালি বলে, না, হামাগোরে মানুষ! ‘কোথায় যাচ্ছে? কেউ জবাব দেয় না। হঠাৎ করে উত্তরদিকের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। কি হলো? আগুন? হ্যাঁ, আগুনের শিখা গোলাপি রজনীগন্ধার মতো দুলে উঠলো। কি হলো? চেংটু শাও গলায় জানায়, গাজীবাড়ির খানকা ঘর পোড়া।’ ‘এ্যাঁ? আনোয়ার চমকে ওঠে, খয়বার গাজীর বৈঠকখানার দালানে আগুন লাগালো কে? দেখতে দেখতে আগুনের শরীর থেকে কোমলতা লুপ্ত হয়, চওড়া ও লম্বা শিখায় আগুন আকাশভুক হবার উদ্যোগ নেয়।
‘আল্লা গো’ বলে প্রাণঘাতী একটি চিৎকার করে খয়বার গাজী মাটিতে পড়ে যায়। আনোয়ার চমকে ওঠে, চেন্টু এরকম হঠাৎ করে কুড়ালের বাড়ি মেরে লোকটাকে কি শেষ করে ফেলল?
না, তাকে কেউ স্পর্শ করেনি। গৃহদাহের দৃশ্য তার এই আকস্মিক শোকাধিক্যের কারণ। মুহুর্তের মধ্যে করমালি ও পচা তাকে ধরাধরি করে তোলে। করমালির পায়ে পোড়ার ঘা, তার পক্ষে অতো বড়ো দেহ ধরে রাখা মুশকিল। তাই তার জায়গায় নেয় চেংটু, চেংটুর কুড়াল নিচে পড়ে রইলো। পচা ও চেন্টু খয়বার গাজীকে নিয়ে ছুটতে শুরু করে উত্তরের অগ্নিকাণ্ডের দিকে। আনোয়ার হতচকিত হয়, কি হলো? চেংটু! কোথাও যাচ্ছে? আলিবক্স কিছু না বলে ওদের অনুসরণ করে। করমালি তাদের সঙ্গে খোড়াতে খোড়াতে দৌড়ায় আর চিৎকার করে, শালাক আজ হোসেন ফকিরের দশা করমু! আসোগো, সেগলি আসো শালা মাকুচোষা ডাকাত শয়তানকে আজ আগুনের মদ্যে পোড়ানো হবো!
আনোয়ার ছুটতে ছুটতে বলে, আলিবক্স, আলিবক্স’ আলিবক্স ছুটতে ছুটতে পেছনে তাকায়, তাড়াতাড়ি আসেন। -আলিবক্স, গণ-আদালতের স্পিরিট থাকছে না। এটা ঠিক হচ্ছে না। আলিবক্স খুধু ফেলে, স্পিরিট তো নষ্ট হয়াই গেছে। জুম্মার নামাজ নিয়া কাউল পয়দা করলেন। তা শয়তানটারে বাচাবার পারলেনকৈ?
আনোয়ার প্রাণপণে ছোটে, তার জমাট-বাধা মাথা টলোমলো: খয়বার গাজীকে সে বাঁচাবার চেষ্টা করবে কেন? তার অপরাধ তাতে কয়েকবার ফাঁসি দিলেও তার উপযুক্ত শান্তি প্রদান হয় না। থানা পুলিশ, কোর্ট-কাছারি সব যখন প্রহসন তখন গণ-আদালত গঠন না করে আর পথ কি? এসব কি সে কারো চেয়ে কম বোঝে? খয়বারকে সে বাঁচাতে যাবে কেন? গাজীদের সঙ্গে আত্মীয়তার তার কি এসে যায়? এখানকার পৈতৃক সম্পত্তির সঙ্গে সে তো সম্পর্কহীন, ২পুরুষ ধরে সম্পর্কহীন। তাহলে?-প্রকৃতপক্ষে দণ্ডিতের একটি বিশ্বাস, না বিশ্বাস নয়, একটি ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে সে গণ-আদালতের মর্যাদাময় চরিত্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলো। খয়বার গাজীকে জানোয়ারের পর্যায়ে নামিয়ে দিলে তাকে মেরে ফেলার জন্যে এতো মানুষের অনুমোদনের দরকার ছিলো না। তার সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে তাকে একটা পাগলা কুত্তায় পরিণত করে মারলে তার সঙ্গে সাধারণ হত্যার পার্থক্য কি? খয়বারকে শাস্তি দেওয়া দরকার। কাল আনোয়ার নিজে তাকে মারবে, দা দিয়ে হোক কুড়াল দিয়ে হোক-খয়বার গাজীর ঘাড়ে প্রথম ও চূড়ান্ত কোপট দেবে আনোয়ার নিজে।
আলিবক্স চেস্ট্রকে ধরে ফেলেছে, চেন্টু, এটা কি করলি? চেন্টু উদ্ধত চোখ নিচের দিকে নামে। খয়বার গাজী মাটিতে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকে। আলিবক্স চেংটুর ডান হাত ধরে ঝাকায়, আদালতের সোগলির মতামত অসম্মান করা আসামীকে নিয়া তুমি দৌড় মারছে কিসক?
তাক আগুনে দিয়া মারা দরকার। আপনেরা কি তাক মারবার দিবেন?
কোন শাল তাক রক্ষা করবার পারে? আদালত তার মৃত্যুদণ্ড সাব্যস্ত করছে। তার অপরাধ সোগলি একটা একটা করা লেখা তার পিঠোত লাগায় দেওয়া হবো। তাইলে আর সব শয়তান শয়তানি বন্দ করবো। তুমি শালাক খালি খুন করবার চাও? খয়বারেক পুড়ায়৷ মারা তুমি আরেক খয়বার হবার চাও? এদিকে গাজীদের বৈঠকখানা জ্বলে যাওয়ার দপদপ আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যায় জালাল মাস্টারের চিৎকার, আরে, তামাম গাঁও পুড়া যাবো গো! পানি ঢালো, পানি ঢালো।’
পুডুক। করমালি প্রতিবাদ করে, শয়তানে গুনাগরি দিবো না?
আরো কেউ কেউ হৈ হৈ করে ওঠে, শালার সব শ্যাষ হয়া যাক!’
জালাল মাস্টার সর্তক করে, আরে গাও দগ্ধ হয় যাবো!
হামাগোরে আছে কি? শালারাই তো ব্যামাক নিয়া নিজেগোরে ঘরোত তুলছে!
‘আরে পরিবার আছে না? তোমাদের স্ত্রীপুত্রকন্যা আছে না? জালাল মাস্টারের আহবানে সাড়া দিয়ে এবার অনেকে তার কাছে আসে। খয়বারের আত্মীয়স্বজন কারো টিকি দাখা যায় না, ভয়ে সবাই এদিক ওদিক গা ঢাকা দিয়েছে। জালালউদ্দিন তাই সমাবেশের লোকদের কিসব নির্দেশ দেয়। দেখতে দেখতে প্রচুর পরিমাণে মাটির কলসি বদনা বাটি চলে আসে। বাড়ির সামনে পুকুর থেকে পানি তুলে লোকজন খয়বার গাজীর বৈঠকখানা আগুন নেভাবার কাজে তৎপর হয়ে ওঠে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪০
আনোয়ারদের বাড়িতে লোকজন নাই বললেই চলে। গতকাল দুপুরে বড়োচাচা সপরিবাবে চলে গেছে পদুমশহর। সেখানে তার শালীর শ্বশুর-বাড়িতে রাত্রিকাটিয়ে চলে যাবে বগুড়া। বাড়ির পেছনদিক দিয়ে গেছে, মেয়েদের জন্য গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। মন্টুটা পর্যন্ত পালিয়েছে। এতোগুলো ঘর ফাকা। মাঝখানের মস্ত শোবার ঘরে খয়বার গাজী, ঘরের ২টো দরজায় আলিবক্সের দলের লোকজন। বারান্দায় বান্দু শেখ ও পচা। আনোয়ারের ঘরের ভেতর দিককার দরজা খোলা, দরজার পাশে বারান্দায় লোহার থামে সুতা বেঁধে জাল বোনে নবেজউদ্দিন। দেওয়ালে হেলান দিয়ে পোড়া পা মেঝেতে কোনোরকম রেখে কোকায় করমালি। করমালির গায়ে জ্বর। এই পোড়া পায়ের যে কি হবে! আনোয়ার তো ওষুধপত্রের কোনো ব্যবস্থাই করতে পারলো না।
দলের ১টি ছেলের সঙ্গে নিচুস্বরে কথা বলতে আলিবক্স বেরিয়ে আসছিলো, আনোয়ারের ঘরে ঢুকে বলে, ‘আনোয়ার ভাই, আপনে গাজীর ঘরে যান। রাত্রে ঐ ঘরেতে থাকবেন।
‘আপনে?
‘আমার যাওয়া লাগবো।’
‘কোথায়? এতো রাত্রে?’
আলিবক্স তাকে টেনে বারান্দার এক প্রান্তে নিয়ে যায়, ছাইহাটার খবর ভালো না।
কি?
‘এই চ্যাংড়া খবর নিয়া আসছে। আমাগোরে চ্যাংড়ো।’
আলিবক্সের দলের ছেলেটি খবর নিয়ে এসেছে যে সন্ধ্যা থেকে ছাইহাটায় খুব গোলমাল। কাল দুপুরে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে গণ-আদালত বসবে, ছাইহাটার চেয়ারম্যানের বিচারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু আজ বিকাল থেকে দলের ১টি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের লোকজন খেপে গিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ি চড়াও হয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ওদিকে যে ছেলেরা আজ বৈরাগীর ভিটার সামনে দিয়ে মিছিল নিয়ে গেলো তারা প্রাইমারি স্কুলের মাঠ দখল করে স্কুলের দেওয়ালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙিয়ে দিয়েছে। তাদের দাবী এই যে আগামীকাল গণ-আদালত বসানো চলবে না, বসলে ওদের চন্দনদহের ঐতিহাসিক আলিবক্সদের পরবর্তী প্রোগ্রাম নষ্ট হতে পারে। আলিবক্স আজ ওখানে সব ঠিক করে ভোর হওয়ার আগেই ফিরে আসবে।
বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ নিচে উঠান, পাতলা কুয়াশা জড়ানো শীত সেখানে শিরশির করে। আগুনের ১টি বিন্দুকে উঠানে জ্বলতে দেখে আনোয়ার চমকে ওঠে, কে?
মুখ থেকে বিড়ি নামিয়ে এগিয়ে আসে চেংটু। হঠাৎ চমকে ওঠায় আনোয়ার বিব্রত হয়, আলিবক্স, ভোরে আসতে পারবেন তো?
পারবো। না পারলেও অসুবিধা হবে না। দুইটার মধ্যেই বৈরাগী ভিটাত কাম শ্যাষ করা আবার ছাইহাটা মুখে মেলা করা লাগবো।
চেংটু বলে, ‘ভাইজান না আসবার পারলে হামরা আছি না?
খয়বার গাজী শুয়ে রয়েছে বড়োচাচাদের বিশাল সেকেলে পালঙে। গদিমোড়া ইঞ্জি চেয়ার বসতে বসতে আনোয়ার আড়চোখে তার দিকে তাকায়। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আয়ুব অধিকারী লোকটা কম্পমান চোখে তার চারপাশের জগৎ শেষবারের মতো অনুভব করে নিচ্ছে। জীবনে কতোগুলো খুনজখম করেছে, কতো মানুষের সর্বনাশ করেছে—তাই ভেবে কি সে অস্বস্তি বোধ করে? তার মাথায় কি কেয়ামতের ভয়? আখেরাতের ভাবনায় কি সে কাতর নিজের বিশ্বাস কি সংস্কার অনুসারে নামাজ পড়ে মৃত্যুর আগে তওবা করতে পারলে লোকটা একটু শান্তি পায়। এই অনুতাপ মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তাকে হয়তো ১টি মানুষে পরিণত করবে।
বাবা! বাবা আনোয়ার খয়বারের ডাকে আনোয়ার ইজি চেয়ার থেকে উঠে তার কাছকাছি দাঁড়ায়’, কিছু বলবেন?
খয়বারের চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। আনোয়ার বলে, ‘জয়নামাজ এনে দেবো? নামাজ পড়বেন?
খয়বার ভাঙাচোরা গলায় বিড়বিড় করে বৈঠকখানার সবটাই পুড়ছে, না? আনোয়ার জবাব দেওয়ার আগেই সে স্বগতোক্তি করে এতো দিনের বাড়ি চাষাভূষার হাতে লুটপাঠ হলো। কতো জিনিসপাতি, বাসনকোসন, সোনা-দানা, কাপড়চোপড় কাশ্মিরী শালই আছে বারো চোদখান! বাপজানের আমলের চিনামাটির বাসন, দাদীর আমলের গয়নাপাতি।’
আনোয়ার অবাক হয়ে লোকটার বিলাপ শোনে।
বৈঠকখানার পেছনে ধানের গোলা, ওটাতেও আগুন দিছে বাবা?
ধানের গোলা? আপনি যাদের গোরু চুরি করেছিলেন ধানের গোলা এখন তাদের দখলে।
আনোয়ারের ঘৃণা হয়, সম্পত্তির লোভ লোকটার এতোটুকু কমেনি।
তোমরা আমাক ধর্যা আগুনের মধ্যে ফালায়া দিবার পারলা না? আমার দলিলপত্র হিসাব নিকাস সব থাকলো পুব দুয়ারি দালানের মধ্যে। আমার ছেলেরা সব চাকরি বাকরি করে, সয়সম্পত্তির হিসাব কিছু বোঝে না। বলতে বলতে খয়বার কাঁদে, কাঁদতে, কাঁদতে ফের বলে, রোকেয়ার ব্যাটার নামে কিছু লেখা দিবার পারলাম না। সৎ মায়ের সাথে থাকে, বাপ যতো ভালো মানুষ হোক, কদিন তার ভালোমানুষ থাকবে? মৃত কন্যার একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যতের ভাবনায় খয়বার গাজী উদ্বিগ্ন। তবে এর চেয়েও বড়ো উদ্বেগ তাকে অস্থির করে, সাথে পরামর্শ করা হলো না। ঐ জমির দশা যে কি হয়?’
আনোয়ার ভাবে চেংটুর কুড়াল চেয়ে নিয়ে এক কোপে শালাকে শেষ করে দিই। মৃত্যুর আগের মুহুর্তে সম্পত্তির জন্য ব্যাটার এরকম খাইখাই ভাব;–এর চিকিৎসা আর কি হতে পারে?
বাবা, আনোয়ার, এক বদনা পানি দিবার কও তো। অজু করা জায়নামাজে বসি। আল্লা! ও আল্লা!
বারান্দায় বসে খয়বার গাজী অজু করে। জাল বোনা বন্ধ রেখে নবেজউদ্দিন এবার টুল, একবার গামছা এগিয়ে দেয়। ঘরের ভেতর খয়বার নামাজ পড়তে বসলে নবেজউদ্দিন দাঁড়িয়ে থাকে তার পেছনে। বারান্দায় পায়ের যন্ত্রণায় গোঙায় করমালি। উঠান থেকে আলিবক্সের দলের ১টি ছেলে এগিয়ে আসে। ছাইহাটা থেকে খবর এসেছে, তাদের দলের নিখোজ ছেলেটির লাশ পাওয়া গেছে ইউনিয়ন কাউন্সিলের অফিসের পেছনে। গ্রামের লোক ঐ অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চেয়ারম্যান বোধহয় পালিয়ে গেছে, তার ভাইকে ধরা হয়েছে।
ঘরে রাকাতের পর রাকাত নামাজ পড়ে চলেছে খয়বার গাজী। এই করতে করতে সকাল হয়। আনোয়ারের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। চেংটু এসে খবর দেয, আলিবক্সের ফিরতে দুপুর হতে পারে।
আনোয়ারের ঘুম মাথায় ওঠে, তাহলে এখানকার কাজ?
হামরা আছি কিসক? জুম্মার নামাজ বাদে কাম করা হবো?
৮টা সাড়ে ৮টার দিকে ১টি ছেলে এসে জানায় যে আলিবক্স রওয়ানা হয়েছে। আনোয়ার এক গ্লাস পানি খাবার জন্যে পাশের ঘরে ঢুকেছে, এমন সময একটু দূর থেকে সমবেত কণ্ঠের ধ্বনি কানে আসে। তাহলে আলিবক্স কি মিছিল নিয়ে আসছে?
না। এ মিছিল আলিবক্সের নয়। তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা’; তোমার নেতা আমার নেতা’-শেখ মুজিব শেখ মুজিব—এইসব শ্লোগান থেকে বোঝা যায় চন্দনদহের জনসভায় উদ্যোক্তারা গ্রাম প্রদক্ষিণে বেরিয়েছে। দেখতে দেখতে মিছিল বাড়ির সামনে এসে পড়ে এবং মিছিলের কয়েকজন ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর। কেউ কেউ বলে,
আসেন ভাই, আপনারা সবাই আসেন।
বাঙালির জাতীয় নেতা আজ কারাগারের অন্তরালে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের হাত থেকে তাকে ছিনিয়ে আনার জন্যে ঢাকার হাজার হাজার মানুষ আজ বুক পেতে দিচ্ছে বুলেটের সামনে। সামান্য গ্রাম্য কোন্দল নিয়ে আপনারা বাঙালির ঐক্য নষ্ট করবেন না।’ ১ তরুণ নবেজউদিনের হাত ধরে, আসেন ভাই। হাত ছাড়িয়ে নিলে ছেলেটি ধরে বান্দু শেখের হাত এবং তার হাতে গুঁজে দেয় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি আঁকা পোস্টার। বান্দু শেখ ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেলে চেংটু চটে যায়, আপনেরা কি আরম্ভ করছেন? হামাগোরে মানুষ নিয়া টানেন কিসক?
তোমাদের মানুষ আমাদের মানুষ কি ভাই? আমরা সবাই বাঙালি চেংটু তার ডান হাতে কুড়াল নেয়, সোহাগের কথা থোন হামরা বলে জানে মরি, শালা মাকুচোষা শয়তানগুলা হামাগোরে ছেচ্যাপিষ্যা শাষ করলো-
মিছিলের আরো কয়েকটা ছেলে এবার হৈ হৈ করতে করতে ঘরে ঢুকলে আনোয়ার বাধা দেয়, ঘরের ভেতর ঢুকছেন কেন? বাইরে যান।’
আপনার কথায়? ১টি ছেলে ঘুরে দাঁড়ায়, এটা আমার খালার বাড়ি, জানেন? আপনারা বেআইনী দখলদার।’
আমাদের সঙ্গে গোলমাল করবেন না। ভালোভাবে বলছি সবাই মিছিলে আসেন। চশমাওয়ালা ছিপছিপে ছেলেটির জবাবে আনোয়ার জোরে ধমক দেয়, গোলমাল তো করছেন আপনারা। বেরিয়ে যান। আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের থ্রেট করার সাহস পান কোথায়?’
তার কথা শেষ হতে না হতে চেংটু এসে দাঁড়ায় তাকে আড়াল করে, আপনেরা যান। দুপুরবেলা হামাগোরে কাম সমাধা হলে আপনাগোরে সভাত যাওয়া হবো।
চশমাওয়ালা রুখে দাঁড়ায়, আমাদের ভয় দ্যাখাও, না? তার সঙ্গীরা চিৎকার করে, ‘এতো বড়ো কথা! ভয় দ্যাখায়?’
সংঘর্ষের সম্ভাবনায় আনোয়ার চঞ্চল হয়ে ওঠে। আলিবক্স কি তাকে বিপদে ফেলে কেটে পড়লো? হঠাৎ দ্যাখে হাতের কুড়াল ওপরে তুলে চেংটু সবাইকে তাড়া করছে। চেংটুর সঙ্গে নবেজউদ্দিন হাতের দা ঘোরানো শুরু করে। মিছিলের ছেলেরা দৌড়ে বাইরে চলে যায়। চেংটু ও নবেজউদিনের সঙ্গে আনোয়ারও বাইরে ছোটে। মিছিলের ছেলেরা রাস্তা ধরে চন্দনদেহের দিকে উধাও হলো। বাড়ির বাইরে কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে নবেজউদ্দিন কাপে, বড়োমানষের ব্যাটাগোরে কওয়াই হলো, তোমাগোরে সভাত যাওয়া হবো তা শালাগোরে প্যাগনা কতো!—’
এইভাবে কথাবার্তা চলছে, চেংটু হঠাৎ প্রায় দৌড়ে ভেতরের দিকে চলে যায়। আনোয়ার তার পেছনে।
ঘরে চেংটু একা। আনোয়ার বারান্দায় পা দিতেই চেন্টু হাঁপায়, গাজী কোটে?
নাই।’ কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নেমে চেন্টু দৌড়াতে শুরু করে কলাপাড়ের দিকে। পায়খানা গেছে বোধহয়! কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ায় আনোয়ার।
কলতলা থেকে হলুদ বনের ভেতর দিয়ে গেলে বাড়ির শেষ সীমায় পায়খানা। পায়খানা খোলা দরজায় উকি দিয়ে চেন্টু চিৎকার করে, বদনা আছে।
শুধু বদনাই আছে? ‘হু! মানুষ নাই!’ পায়খানার পেছনে শটিবন। এরপর নিচু জায়গা, বর্ষার পানি নামলে এখানে মাগুর শিঙির ছড়াছড়ি, এখন বাশপাতার পাজা। এরপর উঁচু জায়গায় ঘন ও বড়ো বাঁশঝাড়। খুঁজতে খুঁজতে সবাই বাশঝাড় পেরিয়ে দাঁড়ায় ফসলের মাঠে। আদিগন্ত মাঠ। মাঠের ওপার পদুমশহর গ্রাম লী লী করে। এতো তাড়াতাড়ি খয়বার গাজী এই মাঠ পার হবে কি করে? আনোয়ার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপায়! সবাই মিলে বাড়ির ভেতর ও আশেপাশে খোঁজাখুঁজি চালায়। রান্নাঘরে সিলিঙে ঝোলানো পাটখড়ির বেঁচেকা। সেখানে হাতড়াতে গেলে ডান হাতে বিছার কামড় খায় নবেজউদ্দিন। আলিবক্সের দলের ১টা ছেলে চুলার ভেতর পর্যন্ত খোঁচায়। আলিবক্স ফিরে এলে আরেক দফা অনুসন্ধান চললো। দলের কর্মীদের আলিবক্স চাপা ও কঠিন গলায় একটু বকে, নিজের ঘরের মধ্যে থাকবার পারলা না? মানষেক এতো বিশ্বাস করো কিসক?
এই অবিশ্বাসী মানুষটি কি আনোয়ার? কাঁটা কাঁটা ঢোঁক গিলতে গিলতে আনোয়ার প্রস্তাব করে, পদুমশহর গেলে হয় না?
আলিবক্স হাসে, পদুমশহর ইস্কুলের মাঠে ঐ মিছিলআলাগো সভা চলতিছে। বড়োলোকের গাঁও, সোগলি গাজীগোরে ইষ্টিকুটুম। ঐ গাঁয়ের মেলা মানুষ ঢাকাত থাকে, বগুড়াতে থাকে। ছেলেপেলে সব কলেজ ইউনিভারসিটিত পড়ে। চন্দনদহের মিটিং করে সব তারাই। ঐ গাঁওত আজ ঢোকাই যাবো না।
বারান্দায় এক কোণে বসে লাল রঙের চোখ মেলে চেংটু দেখছিলো উঠানের কালো মাটি। করমালির বিরতিহীন গোঙানিতে বিরক্ত হয়, মাগীমানষের লাকান নালাস কিসক? তারপর মাটির দিকে মুখ রেখেই সে বিড়বিড় করে, শালা তামাম আত ধর্যা নামাজ পড়ে, কতো বড়ো মুসল্লি পুরু ও ফাটা ঠোঁটে ছোট্রো ১টি হাসির টুকরাকে চেন্টু চটকায়, ভাইজান, কওয়া যায় না, জুম্মার নামাজের ওকতো হলে আজান শুন্যা বৈরাগীর ভিটাত অ্যাসা খাড়া হবার পারে। মুসল্লি মানুষের জবানা-বরখেলাপ করবার পারে?
আনোয়ার চুপচাপ শোনে। চটকানো তেতো হাসি গিলে ফেললে চেংটুর কথা আরো তেতো হয়ে ওঠে, বড়োনোকের মাথাত কতো ফন্দিই বারায়! আলিবক্স ছাইহাটা যাবার প্রস্তুতি নেয়, আমরা যাই ভাইজান, যদি কোনো সোস্বাদ পান তো নবেজউদ্দিনকে পাঠায়া দিবেন।
কিন্তু নবেজউদ্দিন থাকবে না। ছাইহাটার নামকরা সিধেল চোর জুলু ধরা পড়েছে, গণআদালতে তার বিচার হবে। জুলু চোর একবার নবেজউদিনের ঘরে সিধ কেটে একটা কাঁথা আর সের ২চাল নিয়ে গিয়েছিলো, লোকটাকে সে নিজ হাতে ২টো চড় মারতে চায়। নবেজউদ্দিন আবার আনোয়ারকেও যেতে বলে। কিন্তু চেংটুর নির্বিকার নীরবতায় আনোয়ার ইতস্তত করে, এখানে করমালি একেবারে একা থাকবে। পায়ের যা অবস্থা।’
তা আপনে কি করবেন?
চেন্টুর কথায় আনোয়ার বিরক্ত হবার সুযোগ পেয়ে একটু চাঙা হয়ে ওঠে, থাকা দরকার। ফোস্কা গলে গেলে বিপদ হবে!’
সবাই চলে গেলে হঠাৎ ঝপ করে সন্ধ্যা হয়ে যায়। করমালির পাশে দাঁড়িয়ে উঠানের ওপারে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা নোন-ধরা দেওয়াল তার লোমভরা গতর নিয়ে যেন নড়াচড়া করে। সন্ধ্যার পর লণ্ঠন হাতে আনোয়ার বড়োচাচার ঘরে যায়, লন্ঠনের শিখা বাড়িয়ে খাটের নিচে উকি দেয়। খুনী, গোরু-চোর, আইয়ুব-মোনামের গুপ্তপাণ্ডাদের সেবাদাস খয়বার গাজী এখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে নাই তো? নির্জনতার সুযোগে ব্যাটা আবার অতর্কিতে লাফিয়ে পড়বে না তো আনোয়ারের ওপর? রাত বাড়ে। ভেতরের বারান্দা থেকে করমালিকে সাবধানে ঘরে এনে মেঝেতে তার শোবার বন্দোবস্ত করে আনোয়ার। করমালির একটানা গোঙানি একজন সঙ্গীর উপস্থিতিকে নিশ্চিত করলে আনোয়ার শুয়ে পড়ে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪১
রাস্তায় যখন নামে খিজিরের সঙ্গে ছিলো মোটে কয়েকজন, গওসল আজম সু ফ্যাক্টরি’র কর্মীরা। এই কয়েকজনের শ্লোগানের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তোলে মহল্লার সবগুলো গলি উপগলি জুড়ে। এখন এ-গলি ও-গলি থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছে। নবদ্বীপ বসাক লেনের পেছনদিকের বস্তি দিয়ে টুটাফাটা কাঁথা, বেঢপ কোট ও রঙ-জুলাজামা গায়ে বেরিয়ে আসে ১০/১২ জন মানুষের ১টি দল। পাঁচভাইঘাট লেনের শামসুদ্দীনের রুটির কারখানার লোকজন বেরিয়ে এসেছে তন্দুরের ওম ছেড়ে। হৃষিকেশ দাস রোডের গ্যারেজ থেকে আসছে রিকশাওয়ালার দল। ঠাকুরদাস লেনের ৫/৬ জনের ১টি নীরব মিছিল সরব হয়ে ওঠে কলুটোলার মানুষের মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। মানুষের সংখ্যা অনুমান করা মুশকিল। দরকারই বা কি? আকাশে চাঁদ নাই, নির্মেঘ আকাশে তারা আছে বটে, তবে তার আলো নামে কুয়াশা ছুঁয়ে। এর সঙ্গে মেশে ল্যাম্পোস্টগুলোর হলুদ আলো। কালচে হলুদ আলোর নিচে মানুষের সারি ক্রমে দীর্ঘ হয়, খিজিরের গা একেকবার ছমছম করে ওঠে, সে নিশ্চিত যে মহল্লার বহুকালের পুরনো বাসিন্দারা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তার ভয় করে না, জীন বলে মাহাক্কাল বলো-আজ সবাই মানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। দ্যাখো, রহমতউল্লার চায়ের দোকানের মেসিয়াররা পর্যন্ত এসেছে, ঐ যে তার গ্যারেজের তোতামিয়া। তাদের সামনে উসকুখুসকু চুলওয়ালা ঐ লোকটা কে? আরে এ যে বজলু। শালার পেটে কি ১/২টো পাইট পড়েছে যে মাথাটা ঘুরে গেছে? নাঃ কারফ্যুর মধ্যে কাম নাই, রুজি রোজাগার সব বন্ধ, শালার মাল টানার পথ কৈ? আর একটু এগিয়ে গেলে দ্যাখা যায় শ্যামাচরণ চৌধুরী লেনের মানুষ। ঈশ্বরদাস লেনের মানুষ আসে বাণী ভবনের কলেজছাত্রদের সঙ্গে। মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের পাশের মুচিপাড়ার এতো ছেলে এসেছে। গলিউপগলি শাখা-গলি থেকে এই যে ছলকে ছলকে মানুষ আসছে, এর ফলে সামনে পেছনে মিছিল কেবল বেড়েই চলে। এতে খিজির পড়ে মিছিলের মাঝামাঝি। সামনে যাওয়া দরকার। উত্তর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। ঐদিকে যাওয়া চাই। কারফ্যু ভেঙে শালার টুকরা টুকরা করে ফেলো কালো আকাশ। হঠাৎ ১মুহুর্তের জন্য চোখে পড়ে জুম্মনকে। হাত উঁচু করে জুম্মন শ্লোগান দিচ্ছে, তার পাশে আরো কয়েকটা পিচ্চি। সবগুলোই বস্তি এলাকার ছ্যামরা। এর মধ্যেও জুম্মনের হাতে কু-ড্রাইভার দেখে খিজিরের হাসি পায়। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলার সময় নাই। হাওয়ায় শোনা যায় মালীবাগ, কমলাপুর, শাজাহানপুর থেকে, নাখালপাড়া মনিপুরীপাড়া থেকে হাজার হাজার মানুষ কারফ্যু ভেঙে ছুটে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ক্যান্টনমেন্টের চারদিকের দেওয়াল ভেঙে ফেলা হবে আজ রাতে, বিশাল সমাবেশের সমবেত আঘাতে চূৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে মিলিটারির গুদাম গুদাম হাতিয়ার। কিংবা হাতিয়ার সব চলে আসবে মানুষের হাতে। খিজিরের হাত তো আজ খালি, তার ক্ষুড্রাইভার ও প্লায়ার সে দিয়ে এসেছে জুম্মনের হাতে, ২/৪টা হাতিয়ার নিতে খিজিরের আজ কোনো ঝামেলা হবে না। চুতমারানি মিলিটারিকে আজ ভাসিয়ে দেবে পেচ্ছাবের ফেনার মতো।
খিজিরদের মিছিল এখন ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। পার্কের গাছপালা তাদের শ্লোগানের জবাবে জোরে জোরে মাথা নাড়ে। পামগাছের মাথা থেকে গলার ফাস খুলে খুলে নেমে আসছে কবেকার কোন সেপাইয়ের দল। মিছিলের সঙ্গে তারাও এখন মোড় নেবে ডানদিকে। এমন সময় নর্থব্রুক হল রোড থেকে বেরিয়ে আসে সশব্দ মিছিল। মিছিলের সামনে পাতলা খান লেনের স্কুটার গ্যারেজের ড্রাইভাররা। তাদের প্রত্যেকের হাতে একেকটি টিন, গ্যারেজের ছাদ খুলে নিয়ে এসেছে। টিনের ঢালওয়ালাদের সামনে রাখার জন্য খিজিরদের মিছিল ঘুরে যায় বাঁদিকে।
খিজির থাকতে চায় টিনের ঢালওয়ালাদের পাশে, যতোটা পারে তাড়াতাড়ি হাঁটছে। তার পায়ে যেন নতুন প্যাডেল ফিট করা, মনে হচ্ছে নতুন টায়ার-টিউব লাগানো বডি নিয়ে সে চলছে। মিছিলের লোকদের ওভারটেক করার জন্য ওকে হাটতে হয় এর পাশ দিয়ে, ওর পাশ দিয়ে। ওকে সাইড না দিয়ে কারো উপায় আছে? কিন্তু একেবারে সামনে এসে পৌঁছবার আগেই শাখারি বাজারের দিক থেকে চিত্তরঞ্জন এ্যাঁভেনু দিয়ে ১টা ট্রাক এসে দাঁড়ালো পুরনো স্টেট ব্যাঙ্ক বিল্ডিঙের গেটে। পেছনে আর ১টি ট্রাক। ২টোই মিলিটারি লরি। কালচে হলদে আলোয় মিলিটারিদের মুখ দ্যাখা যায় না, ঘন জলপাই রঙের হেলমেট তাদের মাথার ওপরকার অন্ধকারকে গাঢ় করে তুলেছে। মিছিল তখন শতগুণ জোরে ভরা গলায় প্রতিবাদ জানায়, মানি না। মানি না। এই আওয়াজ অন্ধকারকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করতে না করতে ট্রাক থেকে ছুটে আসে টরটরটরটর গুলিবর্ষণের শব্দ। টিনের ঢালে ঢালে শিলাবৃষ্টি বাজে, আগুনের শিলাবৃষ্টি: টং টং টংটঙটংটংটং সঙ্গে সঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাবা গো মা গো আল্লাগো বাঁচাও পানি প্রভৃতি আর্তনাদ। গুলিবর্ষণ, মিছিলের প্রান্তের ‘মানি না! মানি না!’ স্লোগান ও এইসব আরতনাদের সমবেত কোরাসে পিচের রাস্তা, কংক্রিটের ফুটপাথ এবং এই দুইয়ের মাঝখানে নালা একসঙ্গে কাঁপতে শুরু করে। পায়ের নিচে সব কাপে। খিজির জানে, এই সময় স্পিড কমাতে নাই। স্পিড কমালেই অনিবার্য পতন। ট্র্যাফিক সিগন্যালের পরোয়া করলেই এখন বিপদ! সিগন্যালের লাল তর্জনী এখন অবয়ব বদলে গুলির শব্দে পরিণত হয়ে তাকে রীতিমতো শাসায়। টকটকটকটকটক এখন কে শোনে কার কথা? খিজিরের সামনে ২জন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে গেছে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে। খিজির এগিয়েই যাচ্ছে, ডানদিকের রাস্তা ধরে, ফুটপাথ ঘেঁষে। ভিড় এখানে এখন পাতলা, তাড়াতাড়ি চলতে কোনো বাধা নাই। কিন্তু আরো এক ঝাক টকটকটিকটক ধ্বনির সঙ্গে চোখের সামনেকার কালচে হলুদ আলোর ভাগ মিলিয়ে যায়, অন্ধকার গাঢ়তর হয়। ব্যাপারটা কি হলো? কোন শালা খানকির বাচ্চ ট্রাক এসে ধাক্কা দিলো তার বুকে, বুকের ব্যদিকে ও পেটের ঠিক ওপরভাগে। শরীরের এই ২জায়গায় সলিড আগুন এসে বিধে গেলো, সামনে এখন কিছু দ্যাখা যাচ্ছে না। শালা ট্রাক-ড্রাইভারকেও দ্যাখা যায় না, খিজির গালাগালি করার জন্য মুখ হা করে, এই হালার চুতমারানি ডেরাইভার, তার মায়রে বাপ, তরে লাইসেন দিলো ক্যাঠায়? চোখ দুইখান খুইলা গাড়ি চালাইবার পারস না?-কিন্তু মুখ দিয়ে ধ্বনি বেরোয় না, সটান সে পড়ে গেছে ফুটপাথ ঘেঁষে। অন্ধকার গাঢ়তর হয়, সারা মহল্লায় কি কারেন্ট চলে গেছে? কিন্তু যতোই কারেন্ট যাক, এখন কি তার এমনি শুয়ে থাকবার সময়ঃ হায়রে, সবাই বুঝি পৌঁছে গেছে ক্যান্টনমেন্টের গেটে, আর সে হালায় খোমাখান ভ্যাটকাইয়া পইড়া থাকে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। কি হলো? তার বডির চেসিস কি ভেঙে গেলো? তার টায়ারে কি হাওয়া নাই? নতুন টায়ার কি ফেসে গেলো নাকি? আবার দাখো, ঘাড়ে, বুকে ও পেট পানি গড়িয়ে পড়ছে! পানি ভি আরম্ভ হইলো। ম্যাঘ নাই, বাদলা নাই, পানি হয় ক্যামনে? মাথাটা তার পড়ে রয়েছে ড্রেনের মধ্যে, তাই কি উঠতে পাচ্ছে না? মাথাটা যদি কেউ একটু উঁচু করে দিতো? খিজির তো আর টের পাচ্ছে না যে কেবল আরেকটি বুলেট দিয়েই তার মাথাটা উঁচু করে রাখা সম্ভব।— থাক, তার আর দরকার হয় না। একটু কাত করতেই মাথা তার পাতা হয় ফুটপাথের ওপর, কিন্তু এই কাত হওয়ার ধকলটুকুতেই খিজির বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে উল্টোদিকের সাদা দেওয়ালে লেখা লাল শ্লোগান ল্যাম্পোস্টের হলুদ আলোতে একটু একটু দোলে। ঐ দেওয়াল ঘেঁষে ফুটপাথে টিয়াপাখি দিয়ে মানুষের ভাগ্য গণনা করে ১ঝুড়ো, সেই লোকটি ১টি ছায়া হয়ে ১বার ওপরে ওঠে, ১বারে নামে। দেওয়ালের ভেতর কৃঞ্চচূড়া ডালের কাঁকড়া মাথায় শুয়েছিলো ল্যাম্পোস্টের আলো। দেখতে দেখতে তাও নিভে গেলো। এবার ঝাপশা আলো জ্বলে চোখের ভেতরকার কালো মণিতে। সেই আলোতে দোলে রোকনপুর, লক্ষ্মীবাজার, শ্যামবাজার, বাঙলাবাজার, সদরঘাট, সূত্রপুর, ফরাশগঞ্জ, এমনকি গ্যাণ্ডারিয়া ফরিদাবাদ পর্যন্ত। দোলানো ঘোরানো সেইসব মহল্লার রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে, উপগলিশাখাগলিতে খিজির প্যাডেল ঘোরায়। তার সামনে হেঁটে যাচ্ছে জুম্মনের মা। কিছুতেই তার নাগাল পাওয়া যায় না, ওভারটেক করা তো দূরের কথা খাড়া না মাগী!—দ্যাখে তো পুরুষ্ট্র পেটটা নিয়ে এভাবে ছোটার কোন মানে আছে?-অমুন লোড় পাড়স, একখান উষ্টা খাইলে দুইটা জান খতম হইয়া যাইবো-হেই খবর রাখস? –কে শোনে কার কথা? একেকটা গলির ভেতর ঢোকে,-ডাস্টবিনে স্তুপের ওপর শুয়ে থাকে বিড়ালের মড়া-পোয়াতি মানুষের এইসব দেখতে হয়না। ঐদিকে যাইস না। ঐ গলিতে গভীর রাতে বড়ো গ্যারেজে বসে বোতল টানতে টানতে জুয়া খেলে মহাজনদের পেয়ারের ড্রাইভারেরা। ঐদিকে যাইস না।-ঐ দিকে রহমতউল্লার গ্যারেজ, নয়া কিসিমের রিকশা ঠাহর কইরা মাহাজনে তরে হান্দাইয়া দিবো গ্যারেজের মইদ্যে!-কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এভাবে এতো ঘোরার পর খিজির ফের গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। এবার নিজের গতরটাকে বোধ করতে পারে সাঙ্ঘাতিক ব্যথায়। বুঝতে পারে তার গোটা শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে,-এতো রক্ত কোথেকে এলো? বন্ধ ও ক্লান্ত চোখের কম্পমান মণিতে গাঁথা হয় একটি সিঁড়ি, সিঁড়ির নিচে রক্তের ঢেউয়ে দোল খায় উলঙ্গ নারীদেহ। কার গতরখান বে? কোন খানকি আইয়া তার বগলে ঘুমায়? কাঠায়?-রক্তের মধ্যে দোলে তার মায়ের কালোকিষ্টি গতরখান। মাগো ও মা। সিনাটার মইদ্যে বহুত বিষ! কি কইলি? বেলা বহুত হইয়া গেছে, গাড়ি জমা দেওনের টাইম পার হইয়া গেছে? মাহাজনে চেতবো? আউজকা গাড়ি জমা দিমু ক্যালায়?-আউজকা ক্যান্টনমেন্ট যাইতে হইবো, জমা উমা নাইক্কা!—কিন্তু চাকা তো আর চলে না। গাড়ির চেসিস ভেঙে ফেলেছে, এই গাড়িতে সে প্যাডেল ঘোরায় কিভাবে?-মহাজনের ওপর রাগ করে সে শ্যামবাজারে মাল তুলেছিলো অনেক বেশি করে!-মায়ে যে কি কয়—নিজেই ইচ্ছা করে নারিন্দার পুলে ঠেলে তোলার সময় ভরা গাড়ির চেসিস ভেঙে ফেলেছে?—না মা! তাই কি হয়?–নাঃ মা মাগীও কোথায় সরে যায়। চেসিস ভাঙা বডি আর ঠেলা যায় না-হঠাৎ খুব বমির বেগ আসে খিজিরের। মুখ দিয়ে ছলকে ছলকে রক্ত পড়ছে। রাস্তায় গলানো পিচ ঢালার মতো রক্ত পড়ে নাকের ওপর, রক্ত পড়ে ঠোঁটের কেশ বেয়ে, চিবুক বেয়ে। চোখজোড়া নিজে নিজেই খুলে যায়। ওপরে সবই কালো রঙে আঁকা। ল্যাম্পোস্ট থেকে বিদ্যুৎ বহন করে ছুটে চলে তারের বাক, সেগুলো সব এখন অদৃশ্য। অথচ চোখজোড়া তার হাট করে খোলা, পোড়োবাড়ির ভাঙা দরজার মতো সেগুলো বন্ধ করা যায় না। রক্ত ও বারুদের গন্ধে সে আপ্লুত হয়, তবে পলকের জন্যে মাত্র। রক্তের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে সব রঙ, সব গন্ধ এমনকি বাতাস পর্যন্ত তার আয়ত্তের বাইরে। খিজিরের মুখে অন্ধকার হয়ে পড়েছে পার্কের ভেতরকার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ানো গোলাচি গাছের প্রসারিত রোগা ডালের ছায়া। খিজিরের বা হাত ছড়ানো ফুটপাথের ওপর। সেই হাতের নিচে ও ওপরে পাম গাছের ছায়া। কাছ থেকে ও দূরে থেকে আসা গুলিবর্ষণ, শ্লোগান ও আর্তনাদ তার কানের পর্দায় মিছেমিছি ধাক্কা দেয়। তার খুব ঘুম পায়, ভাঙা চেসিসওয়ালা বডিটার প্যাডেল ঘুরিয়ে কোনোমতে যদি গ্যারেজ পর্যন্ত পৌছা যেতো! কিন্তু ড্রেনের ময়লা পানিতে পড়ে থাকা পায়ে কোনো বল পাওয়া যায় না। পায়ের বুড়ো আঙুল একটুখানি কেঁপে স্থির হয়ে থাকে।
ভোর হতে না হতে ৩টে বড়ো মাছি খিজিরের হা করা মুখের ওপর ভো ভো করে ওড়ে। কিছুক্ষণ পর তাদের নীল পাখায় গোলাপী আভা পড়ে তেরছা হয়ে।-এই দৃশ্য দেখেছিলো জুম্মন। ভিক্টোরিয়া পার্কের ভেতরে রেলিঙ ও মস্ত স্মৃতি-স্তম্ভের মাঝামাঝি জায়গায় পাতাবাহারের ১টি ঝোপের আড়ালে সে লুকিয়েছিলো। আশেপাশে কেউ ছিল না, খিজিরকে পাহারা দেওয়া দরকার। কিন্তু ভালো করে রোদ ওঠার আগেই মিলিটারির গাড়ি এসে দেখতে দেখতে সব লাশ তুলে নেয়। শেষ লাশটি ছিলো খিজিরের। জুম্মন কি করবে? তার হাতের স্কু-ড্রাইভার ও প্লায়ার পড়ে গিয়েছিলো স্মৃতিস্তম্ভের সিঁড়ির নিচে। সেগুলো খুঁজে পেতে পেতে মিলিটারির লাশওয়ালা গাড়ি আজাদ সিনেমা পার হয়ে গেছে।
চিলেকোঠার সেপাই – ৪২
৩ দিন রহমতউল্লা অনেকটা সামলে উঠেছে। তার বেইশ অবস্থা কেটে গেছে, ব্লাড-প্রেশার স্বাভাবিক, গতরাতে ঘুমও ভালো হয়েছে। তবে শরীরের ডান দিকটা তার একেবারে অবশ, যতদিন বাঁচে এটাকে এমনি করে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। আজ সকাল থেকে তার কথাবার্তা অর্থাৎ বিলাপ ও গালাগালি ফের শুরু হয়েছে। কিন্তু জিভ, ঠোঁট ও টাকরার ১টা সাইড অকেজো বলে বেশির ভাগ শব্দ পরিণত হয় ধ্বনিসর্বস্বতায়। মেয়েকে পাশে বসিয়ে সে কাঁদে, বৌয়ের কান্না দেখে কাঁদে, আলাউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে কাঁদে। তাঁর মৃত পুত্র আওলাদের নাম ধরেও কাঁদে। আবার জুম্মনের মাকে দেখেও মহাজন হাউমাউ করে কাঁদে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে তার বিলাপ মোটামুটি আন্দাজ করা যায়: এই বাড়ির খাইয়া পোলাটা মানুষ হয়েছে। ছ্যামরাটার কুনোদিন গোলামের লাহান দেহি নাই। আউজকা উই মরে গুলি খাইয়া, এ্যাঁ? আল্লার কাছে কি গুনা করছিলো, আল্লা মালিক, আল্লাই জানে!
না, না, খিজির গুনা করবে কেন? ওসমান সান্তুনা দেয়, মিলিটারি তো চারদিকে মানুষ মারছে, এর প্রোটেস্টে খিজির মিছিলে বেরিয়েছিলো!
‘আব্বার লগে এইগুলি কইয়া লাভ কি? আব্বা কি জানে? সিতারার এই কথা শুনে ওসমান তখন তাকেই দ্যাখে। ওসমান অবশ্য দেখতে এসেছে রহতমউল্লাকে। সিতারা এখন দিনরাত কেবল রুগ্ন বাবার শুশ্রুষা করে, নইলো তার সঙ্গে এতাক্ষণ একই ঘরে বসে থাকার কথা ওসমান কি ভাবতেও পারে?
তা ঠিক! সিতারার কথায় ওসমান সায় দেয়, উনি তো কারেক্ট সিচুয়েশনটা জানেন না।
আলাউদ্দিন মিয়া একটু বাইরে গিয়েছিলো। আধঘণ্টা পর ফিরে এসে কি ১টা ইঞ্জেকশন ঠিকমতো দেওয়া হলো কি-না জিগ্যেস করে। লোকটা বড়ো ব্যস্ত, ১বার বসে তো ২বার দাঁড়ায়। চারদিকে তার ঝামেলা! মহল্লার রিকশাওয়ালারা নতুন আবদার ধরেছে, খিজিরের লাশ ফেরত চাই খিজিরের লাশ তো নিয়ে গেছে আর্মির গাড়ি, সে তো ওকে মেরে ফেলার পর পরই। এখন মানুষের নতুন সখ হয়েছে, তার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অতো সোজা? ক্যান্টমেন্টে গিয়ে বললাম আর লাশ ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলো? এখন পাবলিককে বোঝায় কে? আলাউদ্দিন মিয়া অকারণে সিতারার ওপর দাপট হাকে, দ্যাখো না শেখ সায়েবে বারাইয়া আহুকা শেখ সায়েবে আইলে এইগুলির হাউকাউ থামো
‘মনে হয়। বলেই ওসমানের ভুল ভাঙে। কারণ কাল রাত্রে খিজিরের ডাকে রাস্তার বেরিয়ে ওসমান দ্যাখে যে পথচারীদের হাতে হাতে মশাল জ্বলছে। খিজিরকে অবশ্য পাওয়া যায়নি। মরে গেছে বলেই সে হয়তো অদৃশ্য হতে শিখেছে। অন্যান্য লোকের সঙ্গে ওসমান সারাটা রাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলো। সব জায়গায় আগুন জ্বলছিলো। নবাবপুরে আগুন, নিমতলীতেও আগুন। ফায়ার ব্রিগেডের বড়ো গাড়ি থেকে মোটা মোটা পাইপ দিয়ে জলধারা পড়ে রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু আগুনের শিখা নিচে নামে না। দেখতে দেখতে এইসব জলধারা পরিণত হয় নদীতে। সদরঘাট থেকে জনসন রোড, নবাবপুর হয়ে নিমতলী পেরিয়ে মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে স্যাভেজ রোড হয়ে বুড়িগঙ্গা ছুটে চলেছে শাহবাগ এ্যাভেনু্যতে। সেখান থেকে নদী ছোটে এয়ারপোর্টের দিকে। তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে যায়, নীলক্ষেতে, নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে মীরপুর রোডে। নদীর ঢেউ এসে লাগে ধানমণ্ডির এ-রাস্তা সে-রাস্তায়। কিন্তু আগুনকে তা এতোটুকু দমাতে পারে না। ওসমান কি আর বলবে, বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, পানি বাড়ার সঙ্গে আগুনের শিখা আরো ওপরে ওঠে। ওসমান ঠিক টের পায় নদী এসেছে আগুনকে উস্কে দেবার জন্যে। আগুনকে কদমবুসি করতে করতে নদী এগিয়ে যায়। লোকজনের পা ডুবে যায় পানিতে, কিন্তু পানির একেকটি ঝাপটায় মশালের আগুন আরো পুরুষ্ট্র হয়ে ওঠে। ওসমানের কোমর পর্যন্ত ভিজে গিয়েছিলো, ওখান থেকে কখন এসে বিছানায় শুয়েছিলো তার মনে নাই কিন্তু সকাল বেলা তার কোমর পর্যন্ত লুঙি পানিতে ভিজে চপচপ করছিলো—এইসব ব্যাপার মনে হলে আলাউদিনের বিবৃতির প্রতি সমর্থনটি ওসমান প্রত্যাহার করে নেয়, না। সারাটা শহর জুড়ে যেভাবে আগুন জ্বলছে, কারো সাধি নেই যে এটা নেভাতে পারে।’
‘খালি আগুন জ্বালাইলে হয় না ওসমান সাব, লিডারের মতো লিডার হইলে আগুন নিভাইবার ভি পারে, বুঝলেন?
কিন্তু কাল যে দেখলাম এতো বড়ো বুড়িগঙ্গা নদী, আগুনের পায় সে-ও তো কদমবুসি করে।’
সিআরা জিগ্যেস করে, বুড়িগঙ্গা কি করে বললেন?
ওসমান উৎসাহ পায়, কাল, বুঝলেন আগুন নেভাবার কাজে মিলিটারি শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীকে ফিট করে দিলো রাস্তার সঙ্গে। বুড়িগঙ্গার ঢেউ লেগে আগুন তো আরো লকলক করে বাড়ে!
সিতারা একটু একটু হাসে। আলাউদ্দিন উঠে পড়ে চেয়ার থেকে, আপনি কি কন এইগুলি?
হ্যাঁ। আমি দেখলাম তো, মিলিটারি সব ফায়ার ব্রিগেড দিয়েও আগুন নেভাতে পারলে৷ না। শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার কোর্স চেঞ্জ করে নিয়ে এলো, তো নদীর ঢেউ লেগে আগুন খালি বেড়েই চলে।
আপনার ব্রেনের ইস্কুপ ব্যাকগুলি চিলা হইয়া গেছে। আপনে বাইরে আসেন ক্যান? যান, ঘরে গিয়া ঘুমাইতে চেষ্টা করেন। রাইতে ঘুম হয়? বলে কার ডাকে আলাউদ্দিন বাইরে যায়।
ওসমান বেশ জুত করে চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে। সিতারার সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে। কিন্তু সিতারাও ভেতরে চলে গেলে তার একমাত্র শ্রোতা থাকে রহমতউল্লা।
আলাউদ্দিন সায়েব বিশ্বাস করলেন না, কিন্তু আমি নিজে দেখলাম। মিলিটারির তো যন্ত্রপাতির অভাব নেই, কি সব মেশিন দিয়ে নদীর একটা সাইড ধরে প্রেশার দিয়ে পানি টেনে এনেছে। কিন্তু দেখলাম নদীর পানিতে আগুনের তেজ আরো বাড়ে।
রহমতউল্লার জবাব এখন একেবারেই অস্পষ্ট। ওসমান আরো উৎসাহিত হয়ে তার বিবরণ দেওয়া অব্যাহত রাখে। এমন সময় ঘরে ঢোকে জুম্মনের মা, হাতে বালতি ও বদনা। তার পেছনে অয়েল-ক্লথ হাতে সিতারা। জুম্মনের মা বলে, অহন মাথা ধোঁয়াইতে হইবো। আপনে এটু বরাদায় গিয়া বহেনা’
না, না, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তোমারা কাজ করো। হঠাৎ করে ওসমানের মনে পড়ে, জুম্মনের মায়ের পেটের ভেতরকার প্রাণীটির খবর কি? হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে জিগ্যেস করে জুম্মনের মা, তোমার বাচ্চার খবর কি?
বদনার নল দিয়ে রহমতউল্লার মাথার পানি ঢালতে ঢালতে জুম্মনের মা বলে, ‘জানেন না? পরশুদিন থাইকা অরে পাই না।’
তবে কি পেটের ভেতর থেকে তার সন্তানকে চুরি করা হলো? ওসমান টোক গিলে বলে, মানে?
কি জানি কৈ গেছে। জুম্মনের বাপে ভি বহুত বিচরাইতাছে না, জুম্মনেরে পাওয়া যায় না।
জুম্মনের জন্যে ওসমানের উদ্বেগ কম নয়, হঠাৎ কোথায় গেলো?
আল্লা মালুম। উদিনকা আপনাগো খিজির মিয়ার কি যন্ত্রপাতি লইয়াকৈ গেলো, আর দেহি না।
খিজিরের আবার যন্ত্রপাতি কি? চট করে মনে পড়ে, ঐ স্ত্রু-ড্রাইভার প্লাস?
হ। কাউলকা দেহি ঐগুলি নাই। তামান দিন জুম্মনে ঘরে আহে নাই। ওসমানের সন্দেহ হয়, খিজিরই বোধহয় জুম্মনকে নিয়ে কোথায় গেছে। তা এটা অবশ্য খিজিরের অন্যায়, মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে এভাবে না বলে নেওয়াটা ঠিক নয়। খিজিরকে আজ কোথায় যেন দেখলো? না, মনে পড়ে না!—মনে করতে গিয়ে ওসমানের মাথা খুব ঘোরে এবং জুম্মনের মা, সিতারা ও রহমতউল্লার চেহারা ঝাপশা হয়ে আসে।