ক্যারে কুলসুম, আত্রে ঘরের দুয়ার দিস নাই? রাত্রে কুলসুমের দরজা খুলে রাখার কারণ জানার আগেই গফুর কলু বলে, কাল তালতলাত হাঁটু পানি জমিছিলো রে, তাই। ঘুরা তোর ঘরের খুলির উপর দিয়া গেনু। তোর দুয়ার দেখি খোলা। ভুলকি দিয়া দেখি তুই নিন্দ পাড়িচ্ছ। তমিজের বাবোক ক্যামা দেখনু না।
বলতে বলতে তার ডান হাতের পুঁটলিটা পাচার হয়ে যায় বা হাতে। বলে, মনে হলো বাঁশের আড়াত গেছে। আড়ার ধার দিয়াই তো হ্যাটা গেনু, দেখনু না তো। একলা একলা তোক ঘরত থুয়া তাই কোটে গেছিলো রে?
তমিজের বাপের অনুপস্থিতিতে গভীর রাত্রে তার ঘরে উঁকি দিয়ে লোকটা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে গেছে—এই খবরে কুলসুমের অস্বস্তি হতে না হতে ভাতারের ভাত-না-খাওয়া আবিতন মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, ঘর দুয়ার খুল্যা নিন্দ পাড়িস কিসক? তোর বাপের বাড়ির কথা ভিন্ন। ওটি আছিলো কী, আর চোরে লিবিই বা কী? এটি না। হলেও বাসনকোসনগুলা তো আছে। মামুর জাল যে কয়খান আছে তাই চুরি হলে তোক বেচলেও দাম উঠবি না, বুঝলু?
আবিতন মাঝিদের মেয়ে। তমিজের বাপ কোনো না কোনোভাবে এর চাচা মামু দাদা খালু নানা ভাই ভাতার লাঙ একটা কিছু হয়ই। সেই সুবাদে কুলসুমের বাপের বাড়ি নিয়ে খোটা মেরে গেলো।-মাঝির ঘরের বেটি, তুই দুই দিন বাদে লিকা বসবু কলুর বেটার সাথে। তমিজের বাপের সাথে তোর আত্মীয়তা কুটুম্বিতা তখন কোটে যায় দেখা যাবি।তা দেখে নেওয়ার কাজটা কুলসুম এখনি করতে পারে। কিন্তু গফুর কলু তাগাদা দেয়, চলো চলো। কাদের ভাই কছে লওটার মদ্যে গোলাবাড়ি পৌঁছা লাগবি। জোড়াগাছত সভা দশটার সময়। গোলাবাড়িত থ্যাকা মেলা করলে এক ঘন্টার কম। লাগবি? চলো বাপু, এ্যানা পাও চালাও।
আরে বাপ! কুলসুম আর কতো দেখবে? মণ্ডলের দোকানে কাম নিয়ে গফুর কলু আজকাল সময় ঠিক করে ঘড়ির সময় দিয়ে। আবার সভা করে বেড়ায়। কলুর বেটা কলু, তার আবার ফুটানি কতো দেখবো? আবিতনের কথার ঝাঁঝে কুলসুমের রাগ হয় গফুর কলুর ওপর। দাদা এই কলুটাকে বেশি খাতির করতে, এক আধ পোয়া সর্ষের তেলের লোভে কী মনোযোগ দিয়েই না তার খোয়াবের বিত্তান্ত শুনতো। সেই কলুর বেটা এখন। ঘোরে মাঝির ঘরের বৌয়ের সাথে। মরার গাঁয়ে এদের গাঁয়ে আঁটার বাড়িও কেউ মারে না।
০৩. গফুর কলুর ওপর রাগ
কিন্তু গফুর কলুর ওপর রাগ করে কি আবিতনের কথার ঝাঁঝ মোছা যায়? ডোবার ধার থেকে উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে মাটিতে কুলসুমের পা পড়ে দরকারের তুলনায় অনেক বেশি জোরে। এতোগুলো ভারি কদমে আবিতনের পাছায় লাথি ছুঁড়ে মারা হয়। না। বরং পায়ের ভেতর দিয়ে মাগীর চোপা কুলসুমের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢুকে তার সারা শরীরে কোলাহল তুলতে থাকে। ভাতারের ভাত-না-খাওয়া মাগীর ওপর যতোই রাগ হোক, গ্রামের আর দশটা বৌঝিদের মতো সেই রাগ ঝাড়ার ক্ষমতা কুলসুমের নাই। তার বাপ নাই এবং কোনোদিনই ছিলো না বলে বাপের বাড়ির অভাব অনটনের খোটা। দিলে সে মুখ ঝামটা দিয়ে জবাব দেয় কোন মুখে? সে যখন এতোটুকু, হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে কি করে নি, তখনি এক চৈত্র কি বৈশাখের পূর্ণিমা রাতে ভেদবমি করতে করতে মারা যায় ওই অপরিচিত বাপটা। তারপর, কততদিন পর মনে নাই, যমুনার পুবপাড়ের এক চাষার হাত ধরে ও তাকে কোলে করে মা তার চলে যায় যমুনার পুবেরই কোনো চরে, সেই চরের নাম কুলসুম এখন পর্যন্ত জানে না। তারপর মায়ের। কোল থেকে নামবার অল্প দিনের মধ্যেই কুলসুম ঘুরতে থাকে দাদার আঙুল ধরে ধরে। চেরাগ আলি ফকির তো গান করতে করতে নানান দেশে ঘোরে, হয়তো যমুনার ওই চরে মরা ছেলের বৌয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গিয়েছিলো, কুলসুমের মা-ই হয়তো সবুজ শাড়ির ময়লা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কুলসুমকে তুলে দিয়েছিলো তার প্রথম পক্ষের শ্বশুরের হাতে। দাদার সঙ্গে এ-গাঁও ও-গাঁও নিয়ে কিন্তু মানুষ এভাবে কথা বলে নি। কয়েকটা ঘরে তো খয়রাত তার একরকম বাধাই ছিলো, শুক্রবার জুম্মার আগে। যে-কোনো সময় একবার গেলেই বেতের ছোটো টালার আধখানা ভরে চাল ঢেলে দিতো তার ঝোলায়। ঈদে বকরিলে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে নতুন হোক পুরনো হোক লুঙি একটা ঠিকই পাওয়া গেছে। মিলাদে ফকিরকে যেতে হতো একলাই, কিন্তু কারো জেয়াফতে নাতনিকে সঙ্গে নেওয়ার এজিন না পেলে চেরাগ আলি দাওয়াত কবুলই করতো না। একবার মনে আছে, মাদারিপাড়ার পশ্চিমে খাল পেরিয়ে চন্দনদহের আকন্দবাড়ির হাফিজ দারোগার মা মহরমের চাঁদের এক ভোররাতে স্বপ্নে হাফিজের বাপকে গোরুর গোশত দিয়ে ভাত খেতে দেখে তিনজন ফকিরকে গোরুর। গোশত দিয়ে ভাত খাওয়াবার নিয়ত করে। তিন ফকিরের এক ফকির চেরাগ আলি। চেরাগের সাথে কুলসুমকে দেখে আকন্দের পুরনো বাদি হোচ্চার মা গজরগজর করে, দেখো, সাথ সাথ লাতনিক লিয়া আসিছে। ও ফকিরের বেটা, তোমার লাতনিক জেয়াফত দেওয়া হছে? চাকরানি মাগীর ভাঙা মোেটা গলার আওয়াজে উঠানের পাশে মস্ত রান্নাঘর থেকে ছোলার ডাল দিয়ে গোরুর গোশত রান্নার গন্ধ শুকনা কাটা হয়ে কুলসুমের পেটে গলায় বুকে চিরে চিরে যায় : না খেয়েই যদি ফিরে যেতে হয়! তা। হলে? কিন্তু তার দাদা চেরাগ আলি ফকির কি কাউকে পরোয়া করার মানুষ? তাঁর কথা সরাসরি বাড়ির গিন্নির সাথে, হাফিজ দারোগার মাকে লক্ষ করে সে বলে, মা, হামার। সাথে হামার লাতনি আছে গো। হামরা মাদারি ফকির, মানষের বাড়িত একলা। জেয়াফত কবুল করা হামাগোরে মানা আছে মা। একলা খাই তো হামাগোরে দোয়া। কবুল হয় না। আর একটা কথা কি, মাদারিপাড়ায় যতোদিন ছিলো, শুকুরবার দিন দুপুরবেলা খেতে বসে কথা বলা ছিলো ফকিরের জন্যে মকর, তাকে থাকতে হতো চুপচাপ। পাতে তার কখন ভাত লাগবে, গোশতের টুকরা চেয়ে নেওয়া কি এক হাতা ডাল ঢেলে দিতে বলা, দৈ দিলে আরেকটু গুড় চেয়ে নেওয়া,দাদার হয়ে এসব দায়িত্ব পালন করেছে কুলসুম। মানুষের নিয়ত বলো, মানত বলল, ফকির খাওয়ানো বলল, এমন কি খতনা, কুলখানি, জেয়াফত সাধারণত জুম্মার দিনেই আসে বেশি। নাতনিকে সঙ্গে না রাখলে চেরাগ আলির খাওয়া ভালো হবে কী করে? মাদারিপাড়ার খালটা পেরিয়ে চন্দনদহ, শিমুলতলা, শাকদা, গোসাইবাড়ি, ভবানীহাট, দরগতিলা-এসব গ্রামে বড়ো বড়ো গেরস্থের বাস। এক চন্দনদহেই তো খালি টিনের ঘর আর টিনের ঘর। শিমুলতলায় তালুকদারদের মস্ত দরদালান, ভবানীহাটে সরকারবাড়িও পাকা দালান। এসব জায়গায় আকিকা, খতনা, কুলখানি, চেহলাম, বিয়েশাদি, মানত একটা না একটা লেগেই থাকতো। দরগাতলায় শাহসাহেবের দরগাশরিফ, সেটা তো চেরাগ। আলির একরকম বাড়িঘরই বলা চলে। সেখানে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পা দিলে আর কিছু হোক, আটার খোরমা কিংবা চালগুড়ের পাতলা শিরনি জুটতোই।