এই সময়ে একটি টিকটিকির ঠিকঠিক আওয়াজ কুলসুমের অনুমানের যাথার্থ নিশ্চিন্ত করে। আসলে টিকটিকি নয়, মেঝেতে পাশ ফিরতে ফিরতে তমিজের বাপই বোধহয় তার সন্দেহে সায় দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো। মানুষটা কী কয়? কাল রাতে বেরিয়ে কার সাথে কী নিয়ে কথাবার্তা বলে এসেছে? কুলসুমের দাদাই কি তমিজের বাপের স্বপ্নে এসে কিছু ইশারা দিয়ে যাচ্ছে?—ইশ! কথাগুলো যদি একটু বোঝা যায়! তমিজের বাপের ঘুমের ভেতর বলা কথা শুনতে কুলসুম মাটিতে উপুড় হয়ে কান পাতলো তমিজের বাপের মুখের কাছে। ঘুমের মধ্যেই তমিজের বাপ লুঙি আরেকটু ওপরে ওঠায়, তার হাত দুটো রাখে নিজের উরুসন্ধিতে এবং কথা বলার বদলে সে জোরে নাক ডাকতে থাকে। কুলসুম তার। লুঙিটা একটু নামাতে গেলে তমিজের বাপের নাক ডাকা থামে এবং সুস্বাদু কিছু খাবার ভঙ্গিতে জিভে ও টাকরায় চপচপ আওয়াজ করে?—তা হলে চেরাগ আলি কি তার স্বপ্ন থেকে সরে পড়লো নাকি? না-কি তমিজের বাপ নিজেই তার সব কথা গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের গলার ভেতরে? চপচপ করে কথাগুলো গিলে ফেললে সেগুলো ঝাপসা হতে হতে ঠাঁই নেয় তমিজের বাপের কোন খোয়াবের শাঁসের মাঝখানে কুলসুম তার নাগাল পায় না।
কানে কথা ঢোকার বদলে তার নাকে ঢোকে তমিজের বাপের মুখের পচা আঁশটে গন্ধ। কুলসুমের টিকালো-না-হলেও উচু নাক বেয়ে তমিজের বাপের মুখের এই পরিচিত গন্ধ ঢুকে পড়ে তার পেটে। গলায় তো লাগেই, এমন কি একটুখানি ধাক্কা দেয় তার মগজেও। কুলসুমের জিভ জুড়ে এখন পচা মাছের বাস্না। মাচার নিচে বারবার থুথু ফেলে গন্ধটা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতেই কুলসুম স্বামীর নাকের কাছে নিজের নাক এগিয়ে দেয়। এতে তো পেটটা তার ভরে যাবার কথা, কিন্তু ফল হয় উল্টো। নিস্তেজ খিদেটা তার পেট থেকে তলপেটে এবং ফের পেট হয়ে বুক, এমন কি গলা পর্যন্ত হাঁচড়েপাঁচড়ে ঘোরে। শরীরের এইসব অঙ্গে তোলপাড় ওঠে যে একই সঙ্গে তা নয়। তার চোখের একেকটি পলকে একেকটি অঙ্গে খিদে খুব জোরেসোরে জানান দিয়ে যায়। তবে বারোভাতারি খানকি খিদেকে কাবু করার কায়দাও কুলসুমের জানা। আছে। জানে তো জন্ম থেকেই, তবে নতুন ফন্দিটা শিখেছে বছর দুই আগে আকালের সময়। সেটা কী রকম?—জোরালো কোনো গন্ধ পেট ভরে নিতে পারলেই পেটটা তার বেশ ফুলে ওঠে। তবে থুথু ফেললে চলবে না। থুথু যতোবার আসে একটু জমতে দিয়ে গিলে ফেলতে হবে, তাতে পাতলা ডাল খাওয়ার কাজ হয়। বমি বমি লাগবে; কিন্তু বমি করা চলবে না, বমি হলেই পেট খালি।
গন্ধের ভাবনাই কুলসুমের নাকে খেলিয়ে দেয় পানজৰ্দার হালকা সুবাস। গোলাবাড়ি হাটের বৈকুণ্ঠের মুখের এই গন্ধ বৈকুণ্ঠকে ছাড়াই এসে হাজির হলো,এরকম মাঝে মাঝে তো হয়ই, তবে এতে পেট ভরে না। গন্ধটা নাক দিয়ে ঢুকে গলা পর্যন্ত নেমে ফের উঠে যায় মাথায় এবং মগজে অনেকক্ষণ ধরে ম ম করে কখন মিলিয়ে যায় সে ঠিক ধরতে পারে না।
উঠানে ভাঙা মাটির মালসা চাপা-দেওয়া চুলার ভেতর ছাই গত রাতের বৃষ্টিতে ভিজে কাদা। এর ভেতর থেকে কয়লার দুটো টুকরা নিয়ে ফের ঘরের ভেতর দিয়ে বাইরের উঠান পেরিয়ে ডোবায় পৌঁছে খিদে মেটাবার তাড়া কিন্তু তার আর রইলো না। ডোবার ওপারে একটু উঁচু সরু পথ, খানিকটা গিয়ে গাঁয়ের শেষে এই পথ মিশেছে। গোলাবাড়ি যাবার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড়ো রাস্তার সঙ্গে। বর্ষার ভিজে হাওয়ায় গোলাবাড়ি থেকে পানজর্দার সুবাস কি একেবারেই আসে না? পুবদুয়ারি ঘর তাদের, দাদা বলতো, দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের রাজা, পুবদুয়ারি তাহার প্রজা। যমুনার তীরে তাদের মাদারিপাড়া, দরগাতলার মতো এদিককার সব বাড়িও পুবদুয়ারি। এখানে এসে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে পুবদুয়ারি ছাপরা ঘর পেয়ে চেরাগ আলি মহা খুশি, দেখ, একইরকম ঠেকিচ্ছে না রে? আবার বিয়ের পর ডোবার এদিকে তমিজের বাপের ঘরে ঢুকলো কুলসুম, এটাও পুবদুয়ারি। একটু বাতাস বইলেই তাদের ঘরে হাওয়া ঢোকে। ডোবার ঘাসপাতাশ্যাওলা, অল্প পানির খলসে পুঁটি কি ডোবার ধার ঘেঁষে কাদার ঘরসংসার-করা শোল বেলের তাজা আঁশটে গন্ধ, মানুষের গুয়ের গন্ধ, গোরুবাছুরের গোবরের গন্ধ-সব মিলেমিশে ঝাঁ ঝাঁ রোদে শুকিয়ে কিংবা বৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ে ঘরে ঢুকে মাচার ওপরটা, মাটির মেঝেটা বা ঘরের ছোটো শূন্যতাটিকে কখনো ভারি করে তোলে, কখনো হালকা করে ফেলে।
এসব গন্ধ কি কুলসুমের আজকের চেনা? তমিজের বাপের সঙ্গে বিয়ের কতো আগে থেকে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ের ভেতর ছাপরা ঘরে থাকতেই তো তার থাল-বাসন ধোয়াপাকলা, কাপড় কাচা, মুখ ধোয়া, হেগে ছোচা, গোসল করা সবই তো হয়েছে এই ভোবাতেই। কালাম মাঝির বাড়িতে পাতকুয়া কাটার আগে খাবার পানিও নেওয়া হতো এখান থেকেই। তখন এটা অবশ্য পুকুরই ছিলো। বড়ো বানের পলি জমে উত্তর দিকটা ভরে গেলে ওখানে আরো মাটি ভরে মরিচবেগুনের খেত করে কালাম মাঝি জায়গাটা নিজের দখলে নিয়ে আসে। এসব তো কুলসুমের চোখের সামনের ঘটনা। আল্লারে আল্লা, বিয়ের পরও কুলসুমের সেই আগের নিয়মের কোনো বদল হলো না।
ডোবার ধারে বসে চোখ বন্ধ করেও সে ঠাহর করতে পারে ডোবার ওপারে সরু রাস্তায় সাইকেল চেপে চলেছে সাকিদারদের ইস্কুলে-পড়া ছেলে। ধানের ভার নিয়ে মণ্ডলবাড়িতে যাচ্ছে অহিদ পরামাণিক।
খেজুরগাছের পিড়িতে বসে ডোবার পানিতে ঝুঁকে কুলকুচো করছে কুলসুম, তার মুখের ছাইকয়লামাখা পানিতে ডোবার ঘোলা পানির রঙ পাল্টায় না। সেই অপরিবর্তনীয় পানির দিকে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনীর সাদা দাঁতগুলি চকচক শব্দ করে মাজতে মাজতে এবং বারবার কুলকুচো করতে করতে কুলসুম ঠিক বোঝে, দক্ষিণের কলুপাড়ার গফুর কলু গোলাবাড়ি যাচ্ছে দলবল নিয়ে। লোকটা গফুর কলু না। হলে তার কিছুই এসে যায় না, শ্যামলা মুখটা যতোটা পারে ফর্সা করে তুলতে অবিরাম পানির ঝাপটা মারতো। কিন্তু গফুর কলু মানুষটা বেহায়া ধরনের আলাপি মানুষ, আবার তার মুখে কথা শুনতেও কুলসুমের কান দুটো উসখুস করে। তা কথা বেশি বললে কী হয়, গফুর ভাইটা কামের মানুষ। অসুখে পড়ে বাপটা তার তেলের ঘানি ঘোরাতে পারে না, তার একরকম ভিক্ষা করে খওয়ার দশা হয়েছিলো। গফুর কিন্তু তেলের ঘানি টানি বাদ দিয়ে ঘুরতে লাগলো মণ্ডলের ছোটোবেটা কাদেরের পিছে পিছে। বছরখানেক তার লীগের পাট্টির হুজুগে মেতে থাকায় তার মেলা ফায়দা হয়েছে। সে এখন কাজ পেয়েছে কাদেরের তেলের দোকানে। এই এলাকায় শুধু কোরোসিন তেল বেচার দোকান প্রথম করলো শরাফত মণ্ডল, সেই দোকান চালায় কাদের। এক বছরেই দোকানের সাইজ বড়ো করে ফেলেছে, আগে টাউন থেকে সপ্তাহে দুইবার ৬/৭টা করে তেলের টিন আসত টমটমে করে, এখন জোড়া জোড়া গোরুর গাড়ি ভর্তি টিন এনেও আশেপাশের চাহিদা মেটাতে পারে না। এর সব দেখাশোনার ভার গফুরের ওপর। কিন্তু এ নিয়ে গফুরের দেমাক নাই, মাঝিপাড়ার আর আর মানুষের সঙ্গে তমিজের বাপও যে তাকে কলুর বেটা কলুর বেটা বলে হেলা করেছে এসব কথা সে মনেও রাখে না। কুলসুমের সঙ্গে দেখা হলেই সে একটু দাঁড়াবে, গোলাবাড়ি হাটের খবর দেবে, তমিজের বাপের কথা জানতে চাইবে, তমিজ কবে ফিরবে জিগ্যেস করবে এবং কুলসুমের দাদার খোয়বের মানে বলার একটা দুটো নজির দেবে। আজকাল কলুপাড়ার কয়েকটা চ্যাংড়াপ্যাংড়া তার সঙ্গে থাকবেই। লীগের পাট্টির হুজুগ বেশ ভালোই শুরু হয়েছে, হুজুগে সে এদের শরিক করায়, দোকানের কাম কম থাকলে সে নিজেও কাদেরের পিছে পিছে ঘোরে। তা করো, মনিবের মর্জি মতো তোমাকে তো চলতেই হবে। কিন্তু আজ আবার ওই ছিনাল মাগীটাকে নিয়েছো কেন? বুলু মাঝির ভাতারের ভাত-না-খাওয়া বৌ আবিতন এই সাত সকালে কলুর বেটার পাছার সঙ্গে সেঁটে যায় কোথায়? বেশরম বেলহাজ মাগী, দুদিন পর ভাতার তালাক দেবে, আজ তুই রাস্তা দিয়ে হাঁটিস অন্য জায় তর মানুষের বগল ধরে। শরম করে না?