সেই কতোদিন আগের কথা, কতো দিন আগের উচ্ছ্বাস, আকালের আগের খুশি, আকালের কাঁটাবেঁধা বছর উজিয়ে এসে কুলসুমের বুকে ছলছল করে ওঠে। গর্ভে তো সে কাউকে ধরলো না, ছেলে বলো আর মেয়ে বলো তমিজই তার সব। এই আবেগ বুকে উপচে পড়লে সারাটা শরীর তার শিরশির করে এবং শরীরের এই উৎপাত থেকে রেহাই পাবার তাগিদে তমিজের দোষ ধরার জন্যে সে হঠাৎ করে হন্যে হয়ে ওঠে। কিন্তু সে হলো মুখ মেয়েমানুষ, ফকিরের ঘরের বেটি, অতো বড়ো জোয়ান মরদ তমিজের আয়াব তার চোখে পড়ে কী করে? বরং তমিজের বাপের অঘোরে ঘুমের সুযোগে ছেলের ওপর বাপটার এই রাগের খানিকটা চুরি করে সে চাখে : ক্যা বাপু, কামের খোজে খিয়ার এলাকাত না গেলে হয় না?-কিন্তু আবার কাজের সুযোগ এদিকে দিনে দিনে কমে আসছে। এ কথাও তো ঠিক। বেশি দিন নয়, ময়মুরুব্বির কাছে শোনা গেছে, ১০/১২ বছর আগে এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙায়, বিলের এপার ওপার জুড়ে ধান রোপা, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা—সব কামই পাওয়া গেছে। এখানেই। তখন নাকি কামলা দেওয়ার মানুষই ছিলো কম। আর যখন তখন কোনো কাজ বাধলে যেতে হতো বিলের ওপারের পচার বেটা কসিমুদ্দির কাছে। লোকটা বাপের মতোই বোকা ছিলো। জমি ছিলো না তার এক ফোঁটা। থাকতো চাষাদের খুলিতে, এর বারান্দায়, ওর গোয়ালে। গাছ কাটা কি ঘর মেরামতের দরকার হলে মানুষ তার হাতে পায়ে ধরতো। আর দেখো, এই কয় বছরে যেদিকে তাকাও হাজার কসিমুদ্দি। সব শালা খালি কাম খুঁজে বেড়ায়। আকালের বছর এতো মানুষ মরলো, এতো মানুষ ভিটাজমি বেচে দেশান্তরি হলো, তবু শালার মানুষ তো কমে না। জমি-বেচা মানুষ যারা গাও ছাড়ে নি, সব কামলা খাটার জন্যে পাগল। কামের জুত কৈ? আগে বর্গাদাররা জমিতে মানুষ খাটাতো, এখন বর্গাদার তার কোলের ছেলেকে পর্যন্ত জমিতে লাগায়।-ঠিক আছে, সবই ঠিক? এরকম হলে তমিজ খিয়ারে না গিয়ে। করবে কী?—কিন্তু তার বাপের কথাটাও বোঝো, ভালো করে বুঝে দেখো। খিয়ারে কাম করতে গিয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গে তোমার অতো ঢলাঢলি কিসের গো? তমিজের বাপ তো সবই জানে, কুলসুমও অনুমান করতে পারে, খিয়ারের মানুষ মানুষ ভালো লয়। জোয়ান মরদ, কামের মরদ দেখলে তারা নিজেদের মেয়েদের লেলিয়ে দেয় তার পেছনে। মেয়ের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে ঐ ছেলেকে তারা ধরে রাখে নিজেদের ঘরে। ওদের দিয়ে নিজেদের বর্গা-নেওয়া জমিতে কাম করায়, গোরুবাছুরের দেখাশোনা করায়, ঘর। তোলে; মাটি ছেনে দেওয়াল গেঁথে তার ঘর তোলে, মেহনত কম নয়। ছেলে। চিরকালের জন্যে তাদেরই হয়ে যায়। ঐসব ডাইনি মেয়েরা ধুলা ঝাড়ে আর পুরুষগুলি তাদের গোলাম হয়ে জীবন কাটায়। নিজেদের বাপমায়ের কথা তাদের আর মনেও পড়ে না। বিয়ে করে পুরুষমানুষ শ্বশুরবাড়িতে কায়েম হবে, ব্যাপারটা কুলসুমের কাছে হঠাৎ করেই অসহ্য ঠেকে। তমিজের বাপ কি ব্যাজার হয় এমনি? তমিজের বাপ। তো যি সি মানুষ লয় বাপু!—ঘুমের মধ্যে সে কার ডাকে বাইরে চলে যায়, কতোদূর যায়, কোথায় যায়, কেউ জানে না। তমিজের বাপকে নিয়ে মানুষ কতো কথাই না বলে! এমনিতে টোপ পাড়লে কী হবে, কামে গেলে তার জুড়ি নাই। শরাফত মণ্ডলের দখলে যাবার আগে কাৎলাহার বিলের মাছ তো ভোগ করেছে মাঝিপাড়ার মানুষই। তখন তমিজের বাপের তৌড়া জালেও পাঁচ সের সাত সের রুই কাৎলা উঠেছে কয়েকটা করে। মাছের ভারে এইসব ছোটো জাল বিলের তলায় এমনি করে আটকে গেছে যে তমিজের বাপকে গলা পানিতে নেমে জালের দড়ি গোটাতে হয়েছে। মুরুব্বি মাঝিরা বলেছে, তুমি বাপু বিলে নামার সময় হুঁশিয়ার হয়া নামো। তুমি জাল ফালালেই ব্যামাক মাছ মনে হয় দৌড়াদৌড়ি করা খালি তোমার জালতই আসে। কথা ভালো লয় বাপু। কেউ কেউ আরো ভয় দেখিয়েছে, একটা গজার যদি একদিন জালেত পড়ে তো বড়ো মুসবিত হবি। কেউ কেউ তার রক্তে তার দাদা বাঘাড় মাঝির অসাধারণ কেরামতি প্রবাহিত হয় বলে মন্তব্য করেছে। এসব অনেক আগের কথা। এখানে। তখন তমিজের মায়ের সংসার, কিংবা আরো আগে তমিজের বাপ তখনো বিয়েই করে। নি। তবে কুলসুমের দাদা চেরাগ আলি জানতো আসল খবর।ওসব দাদা পরদাদা কোনো ব্যাপার নয়। তমিজের বাপের শক্তি আসে পাকুড়গাছ থেকে। কালাহার বিল এখন মণ্ডলের দখল, মাঝির বেটা তমিজের বাপ এখন আর মাছ ধরার কেরামতি দেখায় কোত্থেকে?-দাদার কথা কুলসুম বিশ্বাস করে কীভাবে? এখানে আসার পর থেকে, তার বিয়ের অনেক আগে থেকেই তমিজের বাপকে সে তো এরকম ঝিমাতে আর ঘুমাতেই দেখে আসছে। কাৎলাহার বিল তো মণ্ডল ইজারা নিয়ে দখল করলো সেদিন, আকালের পরের বছর। তার আগে থেকেই তমিজের বাপ একইরকম মানুষ। তবে হ্যাঁ, কামে কোনোমতে একবার লাগলে সে নাকি অন্য মানুষ। জমিতে কাম। করতে গেলেও এখনো সে নাকি তিন কামলার খাটনি খাটে একলাই। আবার ঐ মানুষই ঘরে এলে শুরু হলো তার ঘুম আর টোপ-পাড়া। তবে একটা কথা আছে।-তমিজের বাপের ঘুম মানে তো খালি চোখ বন্ধ করে নাক ডাকা নয়; ঘুমের মধ্যেই তার নড়াচড়া, তার হাটা, ঘুমের মধ্যেই তার সব চলাচল। কতো মানুষ তাকে নিয়ে কতো কথা কয়। এতে মানুষের ভয় আর ভক্তি দেখেও বেটা তার কথা শোনে না কেন? বাপ যখন পছন্দ করে না তো তমিজ বছর বছর খিয়ারের দিকে না দৌড়ালেই পারে। এই যে আজ ২০/২১ দিন তমিজ বাড়ি নাই, এই বাদলায় খিয়ারে সে কী করছে কে জানে? এখন এখানে বিলের ওপারে মণ্ডলের জমিতে আউশ কাটা চলছে, হুরমতুল্লা একলাই তার জমি বর্গা করছে। আউশ কাটার পর বীজতলা থেকে চারা নিয়ে আমন। রোপা হচ্ছে। কাজের অভাব আছে? তমিজের ফুটানিটাও একটু বেশি। এখানে শরাফত মণ্ডলের জমি বর্গা করতে চাইলো, মণ্ডল রাজি হলো না দেখে সোজা হাঁটা দিলো খিয়ারের দিকে। তা বাপু ওখানেও তো কামলাই খাটবি, ওখানে তোকে জমি বর্গা দেওয়ার জন্যে মানুষ কি বসে আছে নাকি? এই বাদলায় সারা দিন পানিতে ভিজতে ভিজতে ধান কাটতে হবে তো ওখানেও। সন্ধ্যাবেলা কোনো বর্গাদারের ঘরের বারান্দায় সে হয়তো বর্গাদারের গোলগাল বৌ কি ছিনাল মেয়ের হাত থেকে চালভাজা কি কঁঠালের বিচি ভাজা খাচ্ছে। তা মাগীরা কি তাকে এমনি এমনি খেতে দেয়? বাঁশের খুঁটির সঙ্গে সুতা বেঁধে জাল বুনে নিচ্ছে না? তাদের আরো কতো ফন্দি আছে তাও কুলসুম ঠিক বোঝে!