সেও তো অনেকদিন হয়ে গেলো। তার বিয়ের তখন বোধহয় বছর দুয়েক কেটেছে, তমিজের বাপ সন্ধ্যারাতে বসে ভাত খাচ্ছে, ল্যাম্ফোর কালচে আলোয় ঘর একটু থমকে ছিলো, বাইরে চাঁদের আলোয় উঠানে বসে হুঁকা টানছিলো তমিজ। তামাকের ধোঁয়ার নেশায়-মাতাল জ্যোৎস্নার অনেকটাই খোলা দরজা পেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে কালচে লাল আলোতে হলুদ রঙ মিশিয়ে দেওয়ায় কুলসুমের মাথাটা হয়তো এতটু ঘুরেই গিয়েছিলো। এমন সময় ট্যাংরা মাছ দিয়ে গোগ্রাসে ভাত খেতে খেতে তমিজের বাপ একটা পেঁয়াজ চাইলো। কুলসুম উঠে দাঁড়িয়ে মাচার ওপর মাটির হাঁড়ি থেকে পেঁয়াজ পেড়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে স্বামীর পাতে দেবে বলে উপুড় হয়েছে, কিংবা উপুড় হয়ে বসতে গেছে স্বামীর সামনে, এমন সময় তার বাম পা লেগে গেলো তমিজের বাপের ডান হাতের কনুইতে। ফলে ভাতের সানকিখান একটু কাৎ হয়ে পড়লো। ঘরের মেঝে লেপামোছায় কুলসুম একটু অকর্মা, সারা মেঝে জুড়ে সম্পূর্ণ সমান জায়গা, একটাও যদি পাওয়া যায়! তা তমিজের বাপের সানকির ডালের একটুখানি ছলকে পড়লো মেঝেতে। না, আর কিছু পড়ে নি। ছলকে-পড়া ডালের সঙ্গে ভাতের কয়েকটা দানা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ির মাছের কণা কি বেগুনের কুচি কি পোড়া মরিচের কামড়ানো টুকরা সব যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গিয়েছিলো সানকির ভেতরেই। তাতেও মানুষটার রাগ কী! তড়াং করে লাফিয়ে উঠলো ভাত ছেড়ে, তারপর শুরু হলো তার সাটাসাটি, তুই আমার ভাতেত পাও দিস? এই নাপাক ভাত হামি এখন মুখোত তুলি ক্যাংকা করা? সঙ্গে সঙ্গে ওই এঁটো হাতের কিল পড়তে লাগলো কুলসুমের পিঠে। বাপরে, ভাতের সঙ্গে বহুদিন পর মুখে দুটো মাছ পড়তে না পড়তে বুড়ার তেজ কী! হাতের কিল আর তার থামে না। ওদিকে চাঁদের আলোয় হুকা টানা খান্ত দিয়ে দরজায় এসে দাড়ালো তমিজ। বাপের রাগে জোগান দেয়। সেও, বাজানের ভাতের থালিত তুমি পাও দেও? ইটা কেমন কথা গো? মুখের রন্ন তুমি পাও দিয়া ঠেললা? নক্ষ্মীর কপালেত তুমি নাথি মারো? কেমন মেয়ামানুষ গো তুমি?
ছেলের সমর্থনে শক্তি পেয়ে বাপ বৌয়ের চুল ধরে টেনে আনে উঠানে, বলে, অতো খলবল খলবল কিসক রে? হুঁশিয়ার হয়া কাম করা যায় না? বেহায়া মাগী, মনে হয় চুলকানি উঠিছে, খালি নাফ পাড়ে, খালি নাফ পাড়ে। আর এই তমিজ জোয়ান মরদটা, কিছুই জানলো না, বুঝলো না, শুরু করলো প্যাচাল পাড়তে, ওজগার তো করো না, ফকিরের ঘরের বেটি, ওজগারের কষ্ট তো বোঝো না! মানুষের ভাতের থালিত তুমি নাথি মারবা না তো মারবি কেটা? তমিজের আক্ষেপে তার বাপের তেজ কিন্তু বাড়ে না। সানকি থেকে ভাতের কয়েকটা দানা গড়িয়ে পড়ার বেদনায় ক্লিষ্ট মুখে সে আরো কয়েক গ্রাস ভাত তোলে এবং তবুও অর্ধভুক্ত থাকার কষ্ট বুকে নিয়ে উঠানের দিকে মুখ করে বসে পড়ে চৌকাঠের ওপর। উঠানের ছোটো ফাঁকা জায়গাটা হালকা ফ্যাকাশে জোৎস্নায় একটুখানি ওপরে উঠেছিলো, ঊর্ধ্বগামী সেই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে সে হুঙ্কার ছাড়ে, তামুক দে! বৌকে বকার হঠাৎ উত্তেজনায় সে হাঁপায়, ফলে তার হুঙ্কারে রুগ্ন ঘর্ঘরতা, সেই শব্দে জোৎস্নায় এতোটুকু চিড় ধরে না এবং কুলসুম পর্যন্ত ওই হুকুম কিংবা তমিজের হালকা ক্ষোভ এবং জ্যোৎস্নাপীড়িত ছটফটে শূন্যতাকে কিছুমাত্র পরোয়া না করে পায়ের দুমদাম আওয়াজে ঘরে ঢোকে। ঐ যে ঘরে ঢুকে মাচার ওপর শুয়ে পড়লো, সারারাত সে আর উঠবে না। মেঝেতে তার ভাতের খোলা হাঁড়ি যেমন ছিলো তেমনি খোলাই পড়ে থাকবে, এলোমেলোভাবে ছিটানো থাকবে এটা ভাতের সানকি, পানি খাবার খোরা, পানির বদনা। এসব এমনি পড়েই থাকবে। এই যে না খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো, এখন মারো আর বকো, কারো সাধ্যি নাই তাকে মাচা থেকে ওঠায়। ওদিকে মণ্ডলবাড়িতে রাতভর সের দুয়েক চাল নিয়ে ঘরে ফেরা, তাই বা কম কী? এখন এই মাগীকে মাচা থেকে ওঠায় কে? বৌকে মাচা থেকে ওঠাবার ক্ষমতা হয় না বলে এবং গলার জোরও মিইয়ে আসায় তমিজের বাপকে অব্যাহত রাখতে হয় আগের প্যাচাল। তবে প্যাচালে এখন আফসোসই বেশি, মেয়ামানুষ, তার এতো কোদ্দ ভালো লয়, ভালো লয়। আজ পাছাবেলা থ্যাকা খলবল, খালি খলবল। নাফপাড়া মেয়ামানুষের কপলেতে দুষ্ক থাকে, সংসার ছারেখারে যায়।
মাচায় শুয়ে এসব শুনতে শুনতে কুলসুমের সত্যি সত্যি লাফ পাড়তে ইচ্ছা করে। বুড়া তার লাফ পাড়ার দেখলোটা কী? খিয়ার এলাকায় ধান কাটা সেরে আগের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলো তমিজ। গাঁয়ের বাইরে রোজগার করতে যাওয়া জীবনে তার সেই প্রথম। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো কম করে হলেও তিন আনা কম দুইটা টাকা। আকালের দুই বছর আগে সেটা কি কম টাকা গো? খিয়ারের ধান নিয়ে এসেছিলো তাও সের আষ্টেক তো হবেই। কাল সন্ধ্যায় তমিজ যখন বাড়ি পৌঁছয় কুলসুম তখন মণ্ডলবাড়িতে। পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে সে দেখে, তমিজ গিয়েছে নিজগিরিরডাঙায়, মণ্ডলের জমির ফলন আর ধান কাটা দেখতে। তারপর কাৎলাহার বিল ঘুরে এসেছে তৌড়া জালটা নিয়ে, কয়েকটা ট্যাংরা নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর পেরিয়ে বিকাল। মাঝির ঘরের ছেলে হলে কী হয়, মাছ ধরায় তার হাউস কম, কেরামতিও একটু কমই। তবে মাছ ছাড়া খিয়ারের চিকন চালের ভাত খেতে মন চায় না। সেই জন্যেই তার জাল নিয়ে বিলে যাওয়া। খিয়ারের চিকন চালের ভাত, চিরল চিরল করে কাটা এলোকেশী বেগুনের সঙ্গে খুব ঝাল দিয়ে বাঁধা মাছ। চচ্চড়ি, মাসকলায়ের ডাল আর নতুন আলুর ভর্তা,এতোসব রান্নাবান্নার উত্তেজনায় কুলসুম সেদিন তমিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলো একটু বেশি। হাসাহাসিটাও বোধহয় বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। তা কুলসুমের দোষ কী? বুড়া খালি তার পেছনে লেগে থাকে, নিজের বেটার ইয়ার্কি মারা তার চোখেই পড়ে না। রঙ করে তো তার বেটা, আজ দেখা হওয়ার পর থেকে তো সে কেবল মজা করে খিয়ারের গল্পই করলো সেখানে একোজন জোতদারের দেড়শো দুইশো পাঁচশ্যে হাজার বিঘা জমি। তাদের জমিতে দাঁড়ালে যতোদূর চোখ যায় খালি ধানের ভিউ। মাঠের পর মাঠ সেখানে ধানের জমি। কোন কোন মুলুক থেকে সেখানে ধান কিনতে যায় পাইকাররা। মণকে মণ ধান কিনে ধানের বস্তা নিয়ে রেলগাড়ি করে তারা চলে যায় কোথায় কোথায়! তালোড়া না কাহালু-কীসব জায়গায় রেলের স্টেশন আছে, স্টেশনের পাকা বারান্দায় ধানের বস্তার পাহাড় জমে ওঠে! এতো ধান হলে কী হবে, খিয়ারের মানুষ নাকি কিপটের একশেষ, ফকির মিসকিনকে তারা খয়রাত দেয় না, রাত্রে মুসাফির এলে তারা ঘরের দরজা আটকে রাখে। দেশে পানি না থাকলে মানুষের জানে দয়ামায়া একটু কমই হয়। সেখানে নদী নাই, খাল নাই, খালি বড়ো বড়ো পুকুর। সেগুলো তো আর আল্লার দান নয়, মানুষের কাটা। নদীই নাই, সেখানে বান হবে কোত্থেকে? বানের পানির কামড়ে পায়ে ঘা হয় শুনে কোন বর্গাদারের বেটার বৌ ও মা! কী কচ্ছে? পানি বলে কামড়ায়? পানির দাঁত জালায় নাকি? বলে কীরকম আঁতকে উঠেছিলো তমিজ অদ্ভুত ভঙ্গি করে তার নকল করলে কুলসুম হেসে বাঁচে না। তবে খিয়ারের মানুষের সুখ বুঝি আর টেকে না।–উত্তর থেকে পশ্চিম থেকে নতুন নতুন ঢেউ আসছে, বর্গাদাররা সব ধান নিজেদের ঘরে তোলার জন্যে একজোট হচ্ছে। ইগলান কী কথা?-কুলসুমের বিস্ময়ে উৎসাহিত হয়ে তমিজ গম্ভীর হয়ে যায়। তবে কুলসুমকে আবার আশ্বাসও দেয়, কোথায় এখন যুদ্ধ চলছে, সবাই সেই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, বর্গাদারদের নেতারা কী করবে বুঝে উঠতে পাচ্ছে না। তা যুদ্ধের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী?—কুলসুমের এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া তমিজের পক্ষে একটু মুশকিল। তবে সে জানায়, যুদ্ধের জন্যে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। টাউনে তমিজ নিজে নিজে দেখে এসেছে গোরুর গোশতের সের উঠেছে। চার আনায়। দর না উঠলে সেরখানেক গোশত সে নিয়ে আসতো। এই যে বাজারে সাদা কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না, মণ্ডলরা হ্যারিকেন জ্বালাতে টাউন থেকে চড়া দামে সাদা কেরোসিন আনে,—এসবই যুদ্ধের জন্যে। যুদ্ধের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম চড়বে কেন?—কুলসুমের কৌতূহলে সাড়া না দিয়ে তমিজ তখন টাউনের গপ্পো ধরে। তাকে খিয়ারে যাওয়া আসা করতে হয়েছে তো টাউন হয়ে। টাউনের মানুষ সব দোকানে বসে চা খায়, গরম চা দেয় ছোটো একটা খোরার মধ্যে করে। যুদ্ধের জন্যে নাকি সাদা। চিনিও পাওয়া যায় না, তারা লাল চিনির চা খায়, একেক খোরা দুই পয়সা। একবার খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে তমিজের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে বাবা, আর নয়! টাউনের মানুষ সব মানুষ সুবিধার লয় গো, কথার প্যাচে তারা মানুষকে ঠকায়, চার আনার জিনিস তারা দর হাঁকে আট আনা দশ আনা। সেখানকার হোটেলে কতো কিসিমের খাবারই যে পাওয়া যায়, কুত্তা জবাই করে তারা খাসি বলে চালায়। তমিজ তাই টাউনে আর যাই করুক, গোশত কখনোই খায় না। তাকে ঠকাবার জো নাই, পুবের পাড়াগাঁর মানুষ হলে কী হয়, টাউনের ফন্দি ফিকির ধরতে আর দেরি হয় নি। তারপর ধরো টাউনের মেয়েমানুষেরা! তারা কীভাবে কথা বলে, মাজা দুলিয়ে তাদের হাঁটা, বিয়ের বয়েসি ল মেয়েরা, বিয়ে দিলে দুই তিন ছেলের মা হতো, বুকের সঙ্গে বই জড়িয়ে ধরে ইস্কুলে যায়, রিকশায় শাড়ি জড়িয়ে পর্দা করে বসেও শাড়ির ওপর দিয়ে মুখ তুলে তারা টাউন দেখতে দেখতে, কথা বলতে বলতে চলে,-শরীর দুলিয়ে তমিজ এসব বিত্তান্ত এমনভাবে বলে যে হেসে কুটিকুটি না হয়ে কুলসুমের আর জো থাকে না। তা এসব কথাবার্তা আর হাসাহাসিতে তমিজের বাপের মন থাকবে কোত্থেকে? ঘরে থাকলে বেশিরভাগ সময়ই তো সে ঘুমায়, না হয় হুঁকাটা হাতে গুড়ক গুড়ুক টানে, না হলে চৌকাঠে বসে ঝিমায়। তা এতোদিন পরে তমিজ সেদিন ঘরে ফিরেছিলো, সেবার সেই তো তার প্রথম গাঁয়ের বাইরে যাওয়া। ছেলে রোজগার করে ঘরে এলো তো কুলসুম। একটু খুশি হবে না? হোক না তার সৎ বেটা, হোক না সতীনের বেটা, পেটে নাই বা ধরলো তাকে, তবু বেটা তো!