রোজ সকালবেলার এইসব কাজকাম সেরে কুলসুম মেঝের দিকে আড়চোখে তাকায়। না, তমিজের বাপ আঘোরে ঘুমায়। কুলসুম এবার মাচার সব হাঁড়িপাতিল বস্তার আড়ালে লুকিয়ে-রাখা ঘরের সবচেয়ে পুরোনো জিনিস তার দাদার জরাজীর্ণ বইটা বার করে জান ভরে গন্ধ নেয়। বইটা তার দাদার, দাদা হলো তার বাপের বাপ, অথচ তমিজের বাপ এটাকে আগলে রাখে যক্ষের ধনের মতো। জাহেল মানুষ, মাঝির বেটা, বইয়ের সে বোঝেটা কী? অথচ কুলসুম এটায় হাত দিয়েছে টের পেলেই কটমট করে তাকায়। পাতায় পাতায় চৌকো চৌকো দাগ দেওয়া আর হাবিজাবি কী লেখায় ভরা এই বই তার দাদা যে কী বুঝতো আল্লাই জানে, এ নিয়ে কুলসুমের মাথাব্যথা নাই। তবে হাজার হলেও দাদার জিনিস, অনেকক্ষণ ধরে গুঁকলে দরজায় দাদার চেহারাটা ভেসে ওঠে। কিন্তু তারিয়ে তারিয়ে দাদাকে দেখার সময় কোথায় তার? মাটিতে কুলসুমের ভারি পায়ের চাপে তমিজের বাপের রোগা কালো গতরে অল্প একটু হলেও সাড়া পড়ে, কীসব বিড়বিড় করতে করতে লুঙিটা সে তোলে আরেকটু ওপরে। এতোক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো তার হাঁটুর ঘা, এবার তমিজের মায়ের আমলের কাটা দাগটাও বেরিয়ে পড়লো। লুঙি আরেকটু ওপরে উঠলেই বুড়ার কালো কালো কুচকুচে বিচি দুটোর ওপর ন্যাতানো নুনুখানও বেরিয়ে পড়বে। ওটা দেখে লাভ কী কুলসুমের? কিন্তু স্বামীর লুঙি ঠিক করার চেষ্টা না করে কুলসুম চুপচাপ দাড়িয়েই থাকে। কান দুটো তার খাড়া করে রাখা, সমস্ত মনোযোগ দিয়ে সে তমিজের বাপের বিড়বিড় ধ্বনির আস্ত আস্ত শব্দগুলো শুনতে চায়। তমিজের বাপের থুথুতে জড়ানো তলাত তাজল তাছ ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ছপছপ করে গড়িয়ে পড়লে কুলসুম আরো ভালো করে কান পাতে। তমিজের বাপ এখন কী স্বপ্ন দেখছে? কাজল বলতে গিয়েই কি তার মুখ দিয়ে তাজল বেরুলো? দাদা বলতো, কাজলের স্বপ্ন দেখলে ছেলেমেয়ে বাপমায়ের কলজে ঠাণ্ডা করে দেয়। এর মানে হলো, ছেলেমেয়ের হাতে বাপমায়ের জান জুড়ায়। তা তমিজের বাপের ফরজন্দ বেটা আছে, এরকম খোয়াব তো সে দেখতেই পারে। নিজের খালি কোলে হাত রেখে স্বামীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত কুলসুম চোখ বুলায় এই আবোর মানুষটা কি তার বিয়ে-করা বিবির শূন্য কোলের কথা কখনো ভাবে? তার কি হুঁশজ্ঞান কিছু আছে?–বেহুঁশ হয়ে ঘুম পাড়তে পাড়তে তমিজের বাপ নতুন করে বিড়বিড় করে উঠলে কুলসুম ফের সেদিকে কান পাতে। কিন্তু অন্য সময়ের মতো এখনো তার কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে গলার ভেতর ভাত খাবার সুড়ঙ্গ দিয়ে সেঁধিয়ে পড়ে তমিজের বাপের পেটের ভেতর। কুলসুম কখনো তার নাগাল পায় না। দিনের বেলা কিংবা রাতেও জাগনা থাকলে শোলোক বলার ক্ষমতা তমিজের বাপের লোপ পায়। তখন যতোই পুস করো, ক্যা গো, নিন্দের মদ্যে কার সাথে কি শোলেক কচ্ছিলা, কও তো? শুনে তমিজের বাপ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, তার ঘুমের ভেতরকার কথা জানবার জন্যে কুলসুম বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে ভুরু কোঁচকায়, মেজাজ ভালো থাকলে হয়তো স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নে বলা শোলোক মনে করার চেষ্টা করে, চেষ্টা করতে করতে ঝিমায়, চেষ্টা করার ক্লান্তিতে তার স্বর নিচু হয়ে আসে এবং ঘুমের ভেতরে যেভাবে বলে প্রায় সেভাবেই বিড়বিড় করে, নিন্দের মদ্যে মানুষ কী কয় না কয়, কিছু মনে থাকে? কী জানি বাপু, কী যে কলাম। কী বা দেখলাম। তার স্বপ্ন মনে করার জন্যে কুলসুম আরো মিনতি করলে তার দাম বাড়ে, ধমক দিয়ে ওঠে তখন, অঙের কথা এখন থো। ভাত দে। ভাদ্দে। কামোত যাই। কুলসুমের গো তবু যায় না, স্বামীর ধমক খেয়েও তার হুশ হয় না, এমন কি তমিজের বাপের হাতের মারও সে থোরাই পরোয়া ক্লরে। ঘুমন্ত মানুষ কথা বলে মুনসির সাথে, না হলে জিন পরির সাথে, মাসুম বাচ্চাদের আলাপ হয় ফেরেশতাদের সাথে। আগুনের জীবদের সাথে তমিজের বাপের কি যোগাযোগ হয় না? দাদা বলতো, মানুষটাক আবোর ঠেকলে কী হয়, জাহেল মাঝির বেটা হলে কী হয়, অর মদ্যে বাতেনি এলেম থাকবার পারে রে! মানুষটার মদ্যে আগুন জ্বলে!
এমন কালোকিষ্টি ছাইয়ের গাদার ভেতর আগুন উস্কে তোলার জন্যেই কি দাদা তাকে এর হাতে সোপর্দ করে কেটে পড়লো? তা সেই দাদার তত্ত্বতালাশ কি তমিজের বাপ কিছুই করতে পারে না? দাদার সঙ্গে কতো বছর ধরে এতো মেলামেশা করলো, এতো গুজুরগাজুর এতো ফুসুরাসুর করেও তমিজের বাপ কি দাদার কি কিছুই রপ্ত করতে পারলো না? দাদার যে হেঁড়াখোড়া পুরোনো বই, বইয়ের ভেতরে নানা কিসিমের চিহ্ন, চৌকো রেখা, হাবিজাবি কীসব লেখা,-এইসব দেখে দেখে, মাটিতে ওইসব রেখা এঁকে এঁকে দাদা কতো মানুষের খোয়াবের মানে বলে দিয়েছে, হারানো জিনিসের হদিস করে দিয়েছে; কত মানুষের হাউসের মেয়েমানুষের সঙ্গে আশেকের পথ বাতলে দিয়েছে; বলতে নাই, কুলসুম শুনেছে জোয়ান বয়সে এই বই দেখে দেখেই মানুষের কাছে পয়সা নিয়ে দাদা অনেকের সংসার ভেঙেও নাকি দিয়েছে।তো সেই বইটাই রয়ে গেলো তমিজের বাপের কাছে। বইয়ের মালিক হয়েও মানুষটা কুলসুমের দাদার কোনো খবরই বার করতে পারে না। ঘুমের মধ্যে এই যে উঠে কোন মুলুক ঘুরে আসে, ঘরে যতোক্ষণ ঘুমায় ঘুমের মধ্যে কী কী বলে, দাদার শোলোকগুলোই তোতলায়, তা সে কি কোনো ইশারাই পায় না? নাঃ! তার কথা বোঝবার কোনো উপায়ই কুলসুমের নাই। এইযে কথা কয়টা মুখ থেকে ছাড়তে ছাড়তেই তমিজের বাপ ফের মিহি সুরে নাক ডাকতে শুরু করলো, কখন খান্ত দেয় কে জানে? মেঝে জুড়ে বুড়া যেভাবে শুয়ে থাকে তাতে মাচা থেকে কুলসুমের নামাটাও মুশকিল। ওই হাড়গিলা শরীরে তিল পরিমাণ জায়গাতেও তার পা ঠেকে তো সর্বনাশ, বুড়া একটা হুলুস্থুল কাণ্ড করে বসবে। এই পা লাগানো নিয়ে একদিন তার কম ভোগান্তি হয় নি।