পেটে খিদের খোঁচায় চোখজোড়া ফাঁক হয়ে পড়লে কুলসুমের নজরে পড়ে দরজার কপাট একটা হাট করে খোলা। তমিজের বাপের বাঁ পায়ের কাদামাখা পাতা চৌকাঠের ওপর। দরজা কি খুলে পড়েছে এই পায়ের ধাক্কাতেই? কী করে হয়? ঐ পায়ে কি সেই জোর আছে? মাটিতে শুয়ে রয়েছে; এর মানে মানুষটা রাত্রে উঠে বাইরে গিয়েছিলো; তার মানে কালাহারের কাদাপানি তার পায়ের না হলেও দুই আনা রক্ত টেনে নিয়েছে। আজ দুপুরবেলা পর্যন্ত হাঁটার ক্ষমতা তার হবে কি-না সন্দেহ। তার ডান পা অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে দরজার ভেজানো কপাটের শেষ প্রান্তে। তার রঙ-জ্বলা ভবনের অনেকটাই ওপরে ওঠানো, কাপড় তার জায়গামতো নাই। অনেকদিন আগে, এই ঘরে তখন তমিজের মায়ের সংসার, একদিন অমাবস্যার রাতে তমিজের বাপ কালাহার বিলে নামলে মুনসির পোষা গজারের একটি এক কামড়ে তার উরু থেকে খুবলে নিয়েছিলো এক ছটাক মাংস। তমিজের বাপের বন ওপরে ওঠায় সেই কামড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। তার নিচে হাঁটুতে দগদগ করে বছরখানেকের একটি ঘা। এই ঘা শুরু হলো বড়শির খোঁচা খেয়ে। বড়শি পেতে তমিজের বাপ বসেছিলো ফকিরের ঘাটের শ্যাওড়াগাছের নিচে। মস্ত একটা মাগুর বড়শিতে গেঁথে গেলে তমিজের বাপ হঠাৎ করে টান দেয়। মাগুরশুদ্ধ বড়শি এসে লাগলো তার হাঁটুর ওপর, বড়শি থেকে মাছ ছিটকে পড়ে শ্যাওড়াগাছের নিচু একটা ডালে আর বড়শি গেঁথে যায় তার হাঁটুর ভেতর। মাছটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি, পানিতে যে ওটা ফিরে গেছে তারও কোনো আলামত তমিজের বাপ দেখে নি। মাছটা তবে ডাঙায় এসেছিলো কার ইশারায় যে তার কারসাজিতে বড়শির ঘা তার আজো সারলো না? তমিজের মায়ের আমলের গজার মাছের কামড়ের দাগ আর হাল আমলের বড়শিবেঁধার ঘা কিন্তু কাছাকাছিই থাকে। ঘা তার দিনে দিনে বাড়ে, ভাব দেখে মনে হয়, গজারের কামড়ের দাগকে বুঝি এই ছুঁয়ে ফেললো। কিন্তু ঐ দাগের সীমায় পৌঁছে শালা আর এগোয় না, আর ওপরে ওঠার লক্ষণ তার নাই। তবে ঘা তার শুকায়ও না, যেটুকুই আছে পুঁজে রসে তাই আরো পুরুষ্ট হয়ে ওঠে।
কাদা লেগে রয়েছে হাঁটুর নিচেই। আর একটুখানি ওপরে লাগলে ঘায়ের আঁশটে গন্ধে কালাহার বিলের সোঁদা গন্ধ মিশে অন্য একটি গন্ধ পাওয়া যেতো। ঐ গন্ধটাও কুলসুমের খুব চেনা। এখন পর্যন্ত আগলে-রাখা নাকছাবিপরা নাকটিকে কুঁচকে নিশ্বাস নিলে বিলের পানির একটু সোঁদা, একটু পানসে ও একটু আঁশটে গন্ধের সঙ্গে তার নাকে ঝাপটা মারে অন্য আরেকটি হালকা বাস্না। কিসের বাস্না গো? মাচার ওপর উঠে কুলসুম এদিক দেখে, ওদিক দেখে। গন্ধে গন্ধে দিশা পেলে জিনিসটা তার চোখে পড়ে। কী গো?–না, তমিজের বাপের রোগপটকা কালোকিষ্টি গতরের পিঠের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে শাপলা ফুলের হেঁড়াখোড়া পাপড়ি। এবার কুলসুমের নাকের সঙ্গে সারা পেট ও বুক নিয়োজিত হয় গন্ধ শোকার কাজে। সারাটা শরীর দিয়ে বাতাস টেনে টেনে ছোটো ও মাঝারি নিশ্বাসগুলিকেও সে প্রসারিত করে লম্বা একটি নিশ্বাসে। তা সেটাকে দীর্ঘশ্বাসই বলা যায়। এই দীর্ঘশ্বাসটিকে শব্দে হেঁকে নিলে তার কথাগুলি হবে এরকম : বুড়া যদি শাপলার উঁটা কয়টা তুলে আনতো! তাহলে কী হতো? তাহলে বেশি করে মরিচ দিয়ে, রসুনের কয়টা কোয়া কুচিয়ে ফেলে কুলসুম কী সুন্দর চচ্চড়ি বেঁধে ফেলে। একটু চচ্চড়ি হলে পোড়া মরিচ কয়টা ডলে নিয়ে তমিজের বাপ তিন সানকি ভাত সেঁটে ফেলতে পারে একাই। রাতভর হাঁটাহাঁটি করে আর কাদাপানি ঘেঁটে ঘরে ফিরলে পরদিন অনেক বেলা করে উঠে তমিজের বাপ কী ভাতটাই না গেলে! এই হাড়গিলা গতরটার ভেতর বুড়া এতো এতো ভাত রাখে কোথায়?
বুড়ার জন্যেও বটে, তার নিজেরও বেশ খিদে পেয়েছে, আজ সকাল সকাল ভাত চড়ানো দরকার। কাল দুপুর থেকে ঝমঝম বৃষ্টি, উঠানের চুলা পানিতে টইটম্বুর। পরশুদিনের ভাতে পানি দেওয়া ছিলো, কাল বিকালে তমিজের বাপ একলাই তার সবটা গিললো। পান্তা খেয়ে হুকায় কয়েকটা টান দিয়ে মাচায় উঠে বুড়া সেই যে নিন্দ পাড়তে শুরু করলো, আল্লা রে আল্লা, সন্ধ্যাবেলার ঝড়, ঝড়ের পর বৃষ্টি, তারপর আসমানের একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর ফের টিপটিপ বৃষ্টি, মানুষটা এসবের কোনো খবরই যদি রাখে! পেট ঠাণ্ডা থাকলে বুড়া কী ঘুমটাই যে পাড়ে!
কাল সকালে কয়েকটা শাক আলু পেটে জামিন দিয়েছিলো কুলসুম। ব্যস ওই পর্যন্ত। এ ছাড়া এ পর্যন্ত তার মুখে একটা দানা পড়ে নি। তার আর ঘুম হয় কোখেকে? ঘরে ভোলা-উনান একটা আছে, কিন্তু পরের দিন বাদলা হলে চাল জুটবে কী করে—এই বিবেচনায় হাঁড়ির চালটুকুতে গন্ধ নিয়ে কুলসুম গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েছিলো স্বামীর পাশে। ঘরে এবার নতুন চাল ছাওয়া হয়েছে, কোনোখান দিয়ে পানি পড়ছে না—এই সুখে বিভোর কুলসুমের চোখেও যে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিলো সে কিছুই টের পায় নি। তারপর তমিজের বাপ কখন উঠলো, বাইরে গেলো কখন, আবার ফিরে এসে শুয়ে পড়লো মেঝেতে,-কুলসুম এসব কিছুই টের পায় নি। তমিজের বাপ এখন যতোই ঘুমাক, বেলা করে ঘুম থেকে উঠে পিঁচুটি-জড়ানো চোখে ঘরের কোণে হাঁড়িবাসনের দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকবে, তারপর ভাত না পেলে তার সারা শরীরে সাড়া পড়ে যাবে, তখন গলা থেকে কাশি জড়ানা যে স্বর বেরোবে তাতে আর কারো ঘরে টেকা দায়।
তবে সেই স্বর বেরুতে এখনো দেরি আছে, বুড়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে ঘরের দুটো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার মাটির সরা তুলে কুলসুম প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়। এই কম্ম করতে তাকে মেঝেতে নামতে হয় নি, মাচায় বসেই মাচার শেষ প্রান্তের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা যায়। তো তার তিনটে কি চারটে নিশ্বাসে হাঁড়ির সের দেড়েক চালে বলকানো ভাতের সুবাস পাওয়া যায়। এতে তার পেট, তারপর তলপেট এবং তলপেট থেকে ফের পেট হয়ে ওপরদিকে বুক ও একেবারে জিভ পর্যন্ত চনচন করে ওঠে। চালের ভাতের গন্ধ পেয়ে পেটের এই তোলপাড়ে কুলসুমের গতর কিন্তু এলিয়ে পড়ে না, বরং আরো চাঙা হয়ে ওঠে। গতরের সাড়ায় সে তখন এটা করে, ওটা করে। যেমন, কয়েক মাস আগে টাউন থেকে তমিজের নিয়ে-আসা বড়ো এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার মাটির সরা সরিয়ে তমিজের মায়ের আমলের একটা ওষুধের শিশি আলগোছে তুলে তার খরখরে আঙুলে কাচের মসৃণ ছোঁয়া নেয়। ছোটো গোল আয়নাটা ডান হাতে নিয়ে একবার নিজের মুখের ডানদিকে, একবার বাঁদিকে এবং একবার চিবুক দেখে। দুই গাল ও চিবুক দেখার পুনরাবৃত্তি চলে বেশ কয়েকবার। দুই গালের মধ্যে তার তেমন ফারাক নাই, শরীরের শ্যামলা রঙ গালে ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে বলে নিজের মুখটাকে তার প্রায় ফর্সাই ঠেকে। টিকলো না হলেও নাকটা তার উঁচুই, সামনের দিকটা একটু বড়ো। ঠোঁটজোড়া তার দাদার মতো অতোটা পাতলা নয়, কিন্তু পান খেলে দাদার মতোই দুটো ঠোটই টুকটুকে লাল দেখায়। দাদার মুখে পানশুপারি থাকতে দিনরাত, কুলসুম পান পায় কোথায়? আয়না ভালো করে দেখে সেটা পাশে রেখে হাঁড়ির ভেতর থেকে একটা একটা করে তমিজের পুরনো পিরান, লুঙি ও তিলে-ধরা কিস্তি টুপি হাতে নিয়ে নাকের সঙ্গে ঠেকিয়ে কুলসুম জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে গন্ধ নেয়। তমিজের পিরানের পিঠটা হেঁড়া, তমিজ ফেলে যাবার পর আর ধোয়া হয় নি। জামার বুকে ঘামের গন্ধ দিনদিন ফিকে হয়ে আসছে, কুলসুমের নিশ্বাসের তোড়ে শিগগরিই মুছে না যায়! না-কি নিশ্বাসে নিশ্বাসেই এর গন্ধ এখন পর্যন্ত টিকে আছে কি-না তাই বা কে জানে?