তা না হয় হলো, কিন্তু এখন?—ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এতোদূর এসে তমিজের বাপ এখন মুনসিকে কৈ কোথাও দেখতে পায় না। জাগরণে তাকে দেখতে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার, স্বপ্নের আড়ালেই কি সে রয়ে যাবে চিরটা কাল? মুনসি মানুষ ভালো লয় গো। মানুষটা মুনসি ভালো লয়! ব্যামাক মানুষের আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে থাকতে সে বড়ই ওস্তাদ।হায়! হায়! মুনসি কি মানুষ নাকি? তওবা! তওবা! মুনসিকে মানুষের সারিতে নিয়ে এলে তোরকম বালামুসিবতই না সে দিয়েই চলবে! মরার আগে পর্যন্ত মুনসি হয়তো মানুষই ছিলো। তা সে কি আজকের কথা? সেই কোন আমলে এক বিকালবেলা বেলা ডোবার আগে আগে মজনু শাহের হাজার হাজার বেশুমার ফকিরদের সঙ্গে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় গোরাদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে সে পড়ে গিয়েছিলো সাদা ঘোড়া থেকে। সব্ব অঙ্গে তীর-বেঁধা সেই ঘোড়া উড়ে গেলো কোথায় কে জানে, আর এখানে এই কাদায় পড়ে থাকতে থাকতে মুনসির লাশ জ্বলে উঠলো লাল আগুন, নীল আগুন, কালো আগুনের শিখায়। তিন দিন তার জ্বলন্ত শরীর ছোঁয়ার সাহস কারো হলো না, কাফন দাফন সবই বাকি রইলো দেখে মুনসি কী আর করে, গুলিতে ফাঁক-করা গলা নিয়ে সোজা চড়ে বসলো পাকুড়গাছের মাথায়। মুনুসি সেই থেকে আগুনের জীব। তার গোটা শরীর, তার ল দাড়ি, তার কালো পাগড়ি, তার বুকের শেকল, তার হাতের পান্টি সবই এখন আগুনে জ্বলে। এরকম একটা মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে ফেলার ভয় ও আফসোসে তমিজের বাপ চমকে চমকে ওঠে। হয়তো এই চমকেই ধাক্কা খায় তার ঘুমের ঘনঘোর আন্ধার। হঠাৎ ঘুম-ভাঙা মানুষের মতো চোখ মেলে সে পা ফেলে সামনে। পায়ের গিরে-সমান পানিতে নিজের পায়ের ছপছপ আওয়াজে সে শোনে মুনসির গলা থেকে বেরুনো চাপা গর্জনের বন্ধু কাত্রানি। আশায় আশায় তার বুক ছটফট করে : এই বুঝি মুনসির দেখা পাওয়া গেলো! ভয়ে ভয়ে তার বুক ছমছম করে : এই বুঝি রে মুনসি এসে পড়লো! বিলের শাপলার মূল তার পায়ে ঠেকলে একটু উপুড় হয়ে সে আঁকড়ে ধরে শাপলার ডাঁটা। কিন্তু শাপলার লতা কি তার শরীরের ভার বইতে পারে? বিলের তলার কাদাই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট। তার হাতের মুঠোয় ছিড়ে চলে আসে শাপলার পাপড়ির দোমড়ানো টুকরা। হেঁড়া পাপড়ির নরম ছোঁয়ায় তার ঘুমের পাতলা কয়েকটা খোসা উঠে গেলেও ঘুম কিন্তু সবটা কাটে না। তার মধ্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সে চলতে থাকে বাড়ির দিকে। তার হাতে শাপলার হেঁড়াখোঁড়া পাপড়ি। কাধে জাল। তন্দ্রা কেটে যাবার আগেই পথ চলার একেকটি কদমে তন্দ্রা ফের ঘন হতে থাকে ঘুমে।
কিন্তু সবসময় কি এমনি হয়?-না কোনো কোনো দিন টানা কোনো আওয়াজে তমিজের বাপের ঘুম একদম ভেঙে গিয়েছে। অনেক দূর থেকে, পাকুড়গাছ ছাড়া আর কোখেকে হবে?-ভাঙা ভাঙা গলায় টেনে টেনে কে যেন কয়,
সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি।
তলায় গজার মাছ অতি হিংস্ৰমতি।।
গভীর নিশিতকালে মুনসির আদেশে।
বিলের গজার মাছ রূপ লয় মেষে।।
এর পরেও অনেক কথা শোনা যায়, কিন্তু তমিজের বাপ দারুণভাবে চমকে ওঠায় সেগুলো চলে যায় তার কানের এখতিয়ারের বাইরে, ফলে মাথায় চুলকানি তুলেই সেসব হারিয়ে যায়। এমন হতে পারে যে, কথাগুলো তার শরীর জুড়ে শিরশির করছিলো। সেগুলো শব্দের আকার পেতে না পেতে তমিজের বাপের ঘুম ভাঙে এবং ততক্ষণে আওয়াজটি ফিরে গেছে পাকুড়গাছে। যে বাতাসে ভর করে আওয়াজ আসে তারই প্রবল। ঝাপটায় এর পরের কথাগুলো উড়ে যায় দক্ষিণে মণ্ডলবাড়ির খুলি পর্যন্ত, তাইতে জেগে ওঠে শরাফত মণ্ডলের শিমুলগাছের সাদা বকের ঝক। এইসব বক হলো শরফতের পেয়ারের জীব, মণ্ডলের প্রতাপেই এরা বাঁচে এদের সবটা হায়াৎ নিয়ে। তার কড়া নিষেধ আছে বলেই গ্রামের মানুষ দূরের কথা, মাঘ মাসের শেষ বুধবারে দুর-দুরান্ত থেকে পোড়াদহের মেলায় আসা হাজার হাজার মানুষের কারো সাধ্যি নাই যে ঐ গাছের দিকে একটা ঢিল ছোঁড়ে। শরাফত মণ্ডলের মতো এই বকেদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিলো নিজগিরিরডাঙা গ্রামে। সেখানে চাষাপাড়ার খালের পর কামারপাড়া, কামারপাড়ার সীমানা শুরু হয় দশরথ কর্মকারের অর্জুনগাছ দিয়ে। দশরথের পূর্বপুরুষের নাম যদি মান্ধাতা না-ও হয়ে থাকে, তবু মান্ধাতার আমলেই যখন দশরথ তো দশরথ, তার ঠাকুরদারও জন্ম হয় নি, এমন কি ঠাকুরদার বাপেরও জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন কেটে নতুন বসতকরা নতুন ভিটায় সদ্য-বসানো হাঁপরের আঁচে হামাগুড়ি দিচ্ছে, অর্জুনগাছে বকেদের ঘর সংসারের শুরু সেই তখন থেকেই। বক ও কামারের বংশ বেড়েছে পাশাপাশি। গত আকালের সময় কামাররা পটাপট মরতে আরম্ভ করলে বেশ কয়েকটা বকও মরে পড়ে রইলো অর্জুনগাছের নিচে। আকালের সময় কামারদের জমিজমার অর্ধেক চলে যাচ্ছিলো জগদীশ সাহার দখলে, কামারদের ডেকে শরাফত টাকা দিলে সেই টাকা তারা জগদীশকে দিয়ে জমিগুলোকে ক্রোক হওয়া থেকে বাঁচায়। তবে সেগুলোর মালিক হয় শরাফত নিজেই। ওইসব কামার টাউনের দিকে চলে গেলে তাদের ভিটায় হাল দিতে যায় মণ্ডলের কামলারা এবং তখন অর্জুনগাছের বকের ঝাক বিল পাড়ি দিয়ে উড়ে এসে বসলো শরাফত মণ্ডলের শিমুলগাছের ডালে ডালে। এই অবলা পক্ষীর জাতকে শরাফত মণ্ডল ঠাঁই দিয়েছে পরম যত্নে। আল্লা মেহেরবান, তার নজরে এড়ায় না কিছুই, এই কাজে শরাফতের সওয়াব মিলেছে মেলা। তার পয়মন্ত সংসারে ছেলেমেয়ে, বৌঝি, গোরুবাছুর, হাঁস-মুরগি, জমিজমা, কামলাপাট দিনদিন বেড়েই চলেছে। তবে একটা কথা—হিন্দু গাঁয়ের পাখি কি কারো কপাল এতো ফেরাতে পারে? আসলে কথাটা মুখে বলতে একটু বাধো বাধো ঠেকলেও গ্রামের মানুষ জানে এই গাছভরা বক হলো মুনসির হুকুমের গোলাম। বকের মন্থর উড়ালে তমিজের বাপ তাই থরথর করে কাপে। এই কাঁপুনি আবার ঘুমের মধ্যে শোনা কিংবা ঘুম ভাঙানিয়া শোলোকেরও রেশ হতে পারে। এই শোলোক কি বের হয় মুনসির ফুটো গলার ভেতর দিয়ে বাতাসের ওপর ভর করে? নাকি তমিজের বাপের পরিচিত কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর তার লোমভরা কানে আটকে গিয়ে ভোঁ ভোঁ করে? ভোঁ ভোঁ আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত বিলের ওপর উড়াল দিয়ে দিয়ে তাই জরিপ করার দায়িত্ব পালন করতে করতে ৭/৮টা বক আবার তমিজের বাপের মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে সে পাক কি নাপাক তাই হিসাব করে চলেছে। গজার মাছের চেহারা নেওয়ার জন্যে মুনসি ভেড়ার পালকে হুকুম করে কীভাবে তাই দেখতে তমিজের বাপের ঘুমে-নেতানো দুটো হাত একটু আগে নড়ছিলো আকাশের মেঘ তাড়াতে, তাই এখন চট করে চেপে বসে তার নিজেরই মাথার ওপর। পাটের আঁশের মতো চুলে ঢাকা এই মাথায় বকের নজর পড়লেই মুনসির হাত থেকে তার আর রেহাই নাই গো, রেহাই নাই! মুখ ঘুরিয়ে তমিজের বাপ কাদা ঠেলে উঠে পড়ে ডাঙার ওপর। এবং সোজা পথ ধরে বাড়ির দিকে। এবার তার কদম পড়ে এদিক ওদিক। কয়েকবার গাইখুরা গাছের কাঁটা লাগে পায়ের নিচে, হাজা-পড়া পায়ের অজস্র ফুটোর কয়েকটিতে কাটা বিধেও যায়। হাঁটতে হাঁটতে কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে আরো কাঁটা বেঁধার ঝুঁকি নিয়ে আরো জোর কদম ফেলে সে ছোটে বাড়ির দিকে। এরকম কতোবার আকাশের মেঘ তাড়িয়ে মুনসিকে দেখতে গিয়ে পাতলা ছাই রঙের উড়ন্ত মেঘ চোখে পড়লে তারই ভয়ে পিছু হটতে গিয়ে তমিজের বাপ তার ঘাড়ের তৌড় জাল ফেলে গেছে বিলের ধারে, কখনো কাদার ওপর, কখনো বৃষ্টিভেজা ডাঙায়।