বিলের শিওরের আরো উত্তরেও কিন্তু সবই মুনসির কবজায়, সেখানেও তারই। রাজত্ব। তা তমিজের বাপ সেখানে গিয়েছে বৈ কি! সেখানে অনেক দিনের ঘন কাশবন সাফ করে পাটের জমি তৈরির আয়োজন করেছিলো শরাফত মণ্ডল। তখন পৌষ মাস। খুব ভোরবেলা কুয়াশার নিচে দুটো নৌকা করে নিজগিরিরডাঙার চাষাদের সঙ্গে এপারের মাঝিপাড়ার কয়েকজন গেলো, তমিজের বাপও চললো কামলা খাটতে। কাশবনে ওই সময়ে পানি থাকে না বলে তখনি এই উদ্যোগটা নেয়। কিন্তু না, কাশবনে খটখটে শুকনা জায়গা কোথাও নাই। তখনো পায়ের নিচে প্রতিটি কদমে পানি ছপছপ করছিলো। পৌষ মাসের হিম কাটাতে হাজার হাজার জোঁক গা শুকাচ্ছিলো কাশগাছের রোগা কাণ্ডে, তদের ভারে গাছগুলো একটু একটু নুয়ে পড়েছিলো। এতোগুলো মানুষ কাস্তেকোদাল নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লে দারুণ বুভুক্ষু জোঁকগুলো নিজেদের পছন্দমতো দলে দলে একেকজন কামলার হাতে পায়ে পেটে তলপেটে উরুতে নুনুতে পাছায় হাঁটুতে, এমন কি গোয়ায়-যে যেখানে সুবিধা করতে পারে—খামচে ধরে ঝুলে পড়লো। তাদের বহুকালের খিদে মেটাতে গিয়ে গিরিরডাঙার মাঝি ও নিজগিরিরডাঙার চাষারা ঠিক ভয় না পেলেও যন্ত্রণায় সেগুলো ছাড়াতে তৎপর হয়ে ওঠে এবং শরীরের কোনো না কোনো জায়গায় আস্ত জোঁক বা জোঁকের কামড়ের দাগ নিয়ে ঘরে ফেরে সন্ধ্যার পর। তা ওই জমি ব্যবহারের জন্যে শরাফত মণ্ডলকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো আরো কয়েকটা বছর। তাও সে নিজে নয়, তার বড়োবেটা। ওটার পত্তনি নেবে তখন ওখানে কাশগাছ একটাও নাই। চাষা ও মাঝিদের গতরে জোঁকের গাঢ় চুম্বনের রেশ মুছে যাবার আগেই কাশবনের বন্দোবস্ত নিয়েছিলো টাউনের উকিল রমেশ বাগচি। টাউনের বাবু,-জোতজমি করা কি এদের কাজ? তার বেকার ভাগ্নে টুনুবাবুকে জমির তদারকির ভার দিয়ে রমেশবাবু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। টুনুবাবুকে সাহায্য করার জন্যে এবং তার ওপর একটু নজর রাখার জন্যেও বটে, রমেশবাবু এদিককার একজন বেশ কর্মঠ, বিশ্বাসী ও বোকাসোকা মানুষ খুঁজছিলো। তমিজের বাপ ইচ্ছা করলেই সুযোগটা নিতে পারতো। খবরটা যখন পায় তার তখন একরকম উপাস চলছে, তমিজের মায়েরও আটমাস, কাজকাম করতে পারে না।
কিন্তু শরাফত মণ্ডল বললো, বিলের উত্তর সিথান জায়গা ভালো লয়। হুঁশিয়ার হয়া কাম করা লাগবি। তা মণ্ডল তো মিছা কয় নি, মুনসির রাগ একটু বেশিই বটে। কারো ওপর মুনসির আসর একবার হয় তো সারা জীবনের মতো তার সব কাজ কাম বন্ধ। তখন তার কিসের বৌ আর কিসের বেটাবেটি! তমিজের বাপ জাহেল মাঝির বেটা, পাক নাপাকের সে জানে কী? সেখানে গিয়ে কখন কী করে বসে সেই ভয়ে সে একেবারে গুটিয়ে পড়লো। তারপর আট মাস শেষ না করেই একটি মরা মেয়ে বিয়ে তমিজের মা মণ্ডলবাড়ির বৌঝিদের মতো বিছানায় শুয়ে পড়লে মণ্ডলের দুই নম্বর বিবি গলা নিচু করে সাবধান করে দেয়, তমিজের বাপ, বিলের সিথানে যাওয়া আসা করার চিন্তা করিস না। আবার কী মুসিবত হয় কে জানে?
এসব সেই কোন কালের কথা, কত বছর আগে, সে হিসাব করা তমিজের বাপের সাধ্যের বাইরে। আর দেখো, আজকাল মুনসিকে একটু দেখার লালচে সেই তমিজের বাপ রাতবিরেতে ঘুমের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিলের ধারে এসে হাজির হয় একই রাস্তা ধরে। তা মুনসির কোনো আলামত দেখতে হলে রাত্রিবেলাই হলো ঠিক সময়। তমিজের বাপের হাতের ঢেউয়ে ঢেউয়ে মেঘের গাঢ় ছাই রঙ হালকা ছাই হয়ে আসছে। এইবার বিলের পানিতে ভেড়ার পাল হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটবে। ছাইরঙ ঝেড়ে ফেলে মেঘ সম্পূর্ণ হাওয়া হয়ে যাবে। তখন ভেড়াগুলোর ময়লা সাদা পশমে ঢাকা শরীর দেখে ভেড়া বলে সনাক্ত করা সোজা। তা শালার মেঘ আর কাটে কৈ? মেঘ কাটলেই না ভেড়াগুলোর পিছে পিছে এসে হাজির হবে মুনসি। তার হাতে মাছের নকশা কাটা লোহার পান্টি। এই পান্টি তার হাতের সঙ্গে জোড়া লাগানো, বড়ো একটা আঙুলের মতো বেরিয়ে এসেছে তার হাতের তালু থেকে। মুনসির গলার ফাঁক দিয়ে তার হাঁকডাক দিনদিন একটু একটু করে কমলেও তার দাপটে শরীর এখনো কাঁপে। ওই ফাঁকের জন্যে সে কথা বলতে পারে না, তবে ওখান থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাসের যে ধমক বেরিয়ে আসে ভেড়ার পালের কাছে তার হুকুম বোঝার জন্যে তাই মেলা। চার পা ছুড়ে তারা সাতার কাটে, হাবুড়ুবু খায়। উত্তরে পাকুড়গাছ থেকে দক্ষিণে শিমুলগাছ, এমন কি উত্তর পূর্বে পোড়াদহ মাঠ ছুঁয়ে পানিতে সারারাত তাদের ডোবা ও ভাস, যাওয়া ও আসা সব চলে এই বাতাসের গর্জন মোতাবেক। তাদের তোলপাড়-করা চলাচলে বিলের সব মাছ সরে সরে যায়। প্রবীণ বোয়াল কি বুড়ো বাঘাড় তার পরিবার। পরিজন নিয়ে অনেক নিচে ড়ুব দিয়ে বিলের তলায় শ্যাওলায় কিংবা সোয়াশো বছর আগে ভূমিকম্পে তৈরি বন্যার তোড়ে মাঝির হাত থেকে খসে-পড়া বৈঠায় বুক পেতে অপেক্ষা করে, কখন ভেড়ার পাল গুটিয়ে নিয়ে ভেড়াগুলোকে গজার মাছের চেহারা ফিরিয়ে দিয়ে মুনসি এদের পাঠিয়ে দেবে বিলের নির্ধারিত জায়গায়। আর নিজে উঠে পড়বে পাকুড়গাছের মগডালে। তারপর? পরদিন সারাটা দিন ধরে শকুনের চোখের ধারালো মণি হয়ে আকাশ ফালা ফালা করে ফৈলবে। আর যদি ফুর্তি ওঠে তো রোদের মধ্যে রোদ হয়ে মিশে বিলের পানিতে তাপ দেবে। আর হাপসে গেলে পাকুড়গাছের ঘন পাতার আড়ালে হরিয়াল পাখির ডানার তলে লোমের মধ্যে লোমশিশু হয়ে হরিয়ালের নরম মাংসের ওমে টানা ঘুম দেবে একেবারে সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত।