ফুলজান তখন দেখতে পায় জোনাকির ঝাঁক পাখায় পাখায় আগুন নিয়ে গোটা পকুড়তলাটাকে একটু একটু করে তুলতে তুলতে নিয়ে যাচ্ছে ওই ভূতুড়ে চাঁদের দিকে। না-কি চাঁদটাই জোনাকির টানে নেমে এসেছে একটু নিচে? জোনাকির ঝাঁকের কাছাকাছি? জোনাকির তাপে তাপে, আঁচে আঁচে, এমন কি ধোঁয়ার ধোঁয়ায় চাঁদের গতর থেকে লালচে কালো ছোপ উঠে যাচ্ছে, সেখানে এখন খালি ঘন কালচে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। জোনাকির হেঁসেলের তাপে কি ওটা অঙ্গার হয়ে যাবে না তো?
মা, হেঁসেলেত ভাত চড়াছে। আধো বোল মুছে পরিষ্কার জবানে ফুলজানের বেটি বলে, ভাত রান্দে।
তাই তো, বেটি তার মিছে কথা কয় নি, চাঁদের নিচেই জোনাই পোকার জ্বালে জ্বালে চাঁদের ওপর সেদ্ধ হচ্ছে আউশের রাঙা চাল। পানসে লাল মাড় উপচে পড়তে না পড়তে আগুনের আলো হয়ে তাই গড়িয়ে পড়ছে কালাহারের উত্তর সিথানে। দেখে আর ফুলজানের বেটি নিশ্বাস নেয় জোরে জোরে। বেটি কি ভাতের বাসনা পায় নাকি গো? আল্লা, তাই যেন পায়! জোনাকির শিখায় চাঁদের ওপর সেদ্ধ আউশের চালের ভাতের গন্ধে সে পেট ভরাক। ভালো করে পেটটা ভরলে ঘরে ফিরে তাকে আর ভাত খেতে দিতে হয় না, আবার রাত না পোয়াতেই জেগে উঠে কিংবা ঘুমের মধ্যেই ভাতের জন্যে মাচার নিচে সে ঘুরঘুর করবে না। কচুপাতা দিয়ে ঘাঁটা কাউনের চালের ভাতটা থাকলে বরং কাল এক সন্ধ্যা চলে যাবে।
ও মা! কিছুক্ষণের মধ্যে ফুলজানের নাকমুখমাথাগলাঘ্যাগ সব ভরে ওঠে ভাতের গন্ধে। কেটা কয় মিছা কথা? আউশের চালের সেদ্ধ হবার ঘেরান চারদিক ম ম করে। আবার মনটা খুঁতখুঁতও করে, এই আউশের চালের ভাতের গন্ধ বুক ভরে নেওয়ায় কি পেট ভরে? খিদা কি তার দূর হবে? আর এই সুবাস একবার পাবার পর কচুর পাতার সঙ্গে কাউনের ঘাঁটি কি আর মুখে রুচবে? কিন্তু সেই গন্ধ শোঁকার আশ তো ফুলজানের মেটে না।
ভাত খামো। ভাত রান্দিচ্ছে, মা ভাত খামো।-এর মানে বেটির পেট তার খালিই রয়ে গেছে। কোনো ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়াই মেয়ের এই আবদার তার রুখা গলায় শোনায় দাবির মতো। খালি পেটে গলায় এতো তেজ ছুঁড়িটা পায় কোথায় গো? ফুলজানের জানটা কাঁপে। মানষে কয়, পাকুড়তলার চোরাবালির ভেতর তমিজের বাপ নাকি মাঝে মাঝে গা মোচড়ায়। ওই মানুষটাই এসব কারসাজি করছে না তো? বেটার ঘেগি বৌটাকে তার পছন্দ হোক চাই নাই হোক, নিজের বংশের একমাত্র নাতনিকে দেখার আশায়, ভাতের সুবাসে তার জিউটা ঠাণ্ডা করার জন্যে তমিজের বাপই হয়তো ঝক ঝক জোনাই পোকার বুকে ফুঁ দিয়ে হেঁসেল জ্বালিয়ে দিয়েছে। চোরাবালি থেকে নাতনিকে দেখতে দেখতে বেটার বৌকে নিশ্চয়ই সে দেখতে পায়। ফুলজান শরম পায় এবং তাড়াতাড়ি করে শাড়ির আঁচল তুলে দেয় মাথার ওপর, একটু বেশি করেই টানে। কী জানি, তাকে বেপর্দা দেখে শ্বশুর যদি ঘুমঘুম গলায় একটা শোলোক বলে তাকে শাসন করে! মুনসির শোলোক ফুলজান আগে অনেক শুনেছে। পোড়াদহ মেলায় মজনুর শোলোক, ভবানী সন্ন্যাসীর নামে কতো শোলোক শুনেছে। তা এসব তার মনে থাকে না, কোনোদিন নিজে নিজে আওড়ায় নি পর্যন্ত। তমিজ তাকে এতোসব কথা বলতো, কিন্তু শোলোক শোনায় নি কখনো। তার দুই চারটা শোনোক জানা থাকলে না হয় ফুলজান। তাই জপতো মনে মনে, তমিজের বাপ হয়তো তাতে একটু ঠাণ্ডা হতো।
কিন্তু বেটি তার এরকম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? এই ছটফটে মেয়েটা এতোক্ষণ ধরে এরকম স্থির চোখে তাকায় কী করে? নিজের মেয়ে তার দেখতে দেখতে সেয়ানা হয়ে যাচ্ছে নাকি? সত্যি তার বেটি তো? বেটিকে ভয় পেয়ে, তার অচেনা হয়ে যাওয়া ঠেকাতে এবং তাকে খানিকটা বশ করতেও বটে, নিজের হাঁটুজোড়া মাটিতে রেখে ফুলজান দুই হাতে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। মেয়ের ছোটো ঘাড়ে সে ঠেকায় নিজের ঘ্যাগ এবং তার ছোটো মাথায় রাখে নিজের চিবুক। চিবুকে শিরশির করে ওঠে বিজবিজ আওয়াজ। তমিজের বাপ নিশ্চয়ই তার ওপর আসর করে নাতনির মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার জানা অজানা মুনসির পাওনা-শোলোক।
ফুলজান আস্তে করে বলে, বাড়িত চল মা। ভাত খাবু না?
ভাত খাবার কথাতেও মেয়ে সাড়া দেয় না। তার ছোটো ছোটো কালো কুচকুচে পা দুটো সে শক্ত করে চেপে রাখে মাটির ওপর। বেজায় গোয়ার হুঁড়ি গো! হুরমতুল্লা যে বলে, মিছা কথা নয়, এই মাঝির বংশের মানুষ বড়ো একরোখা। মাছ ধরা হলো এদের কুলপেশা, মাছের মতোই ঝাক ধরে থাকে। নদীর স্রোতের সঙ্গে এদের খাতির, স্রোত যেদিকে চললো তো সবাই ছুটলো সেদিকেই। আবার স্রোতের সঙ্গে বিবাদ করতেও শালাদের বাধে না। কেমন?–না, স্রোতের উল্টাদিকে চলতেও এরা মাতে সমান তালে। উজানে তো উজানে, ভাটায় তো ভাটায়। বিলের ওপারে গিরিরডাঙার মাঝিরা একজোট হয়েছে কি আজ থেকে? এরা ছিলো সব মুনসির সাগরেদ। তারই পেয়ারের মানুষ। কোন সেপায়ের গুলিতে সেই মুনসি মরে ভূত হয়েছে, সে কি আজকের কথা? তখন এই তমিজ তো তমিজ, তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরও জন্ম হয় নি, বাঘাড় মাঝির দাদা না-কি তারও দাদার জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও সে তখন গিরিরডাঙায় নতুন মাটি-ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন গোরা সেপায়ের বন্দুকের গুলিতে খুন হয়ে মুনসি তার গলার শেকল আর হাতের মাছের নকশা-আঁকা পান্টি নিয়ে উঠে পড়ে পাকুড়গাছের মাথায়। সে কি আজকের কথা? মাঝির গুষ্টির কুষ্টি জানতে বয়ে গেছে ফুলজানের! তবে লোকে বলে, সেই পাকুড়গাছ থেকে মুনসি নাকি বিল শাসন করছে সেই থেকে। রাতে তার পোষা গজারের ঝক তারই হুকুমে ভেড়ার পাল হয়ে হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কেটে বেড়ায় তামাম বিলের ওপর। তা পাকুড়গাছ হারিয়ে গেলে মুনসির আরস এখন কোথায় উধাও হয়েছে কে জানে? মুনসির জায়গা কি এখন দখল করেছে তমিজের বাপ। তবে কি-না, মানুষটা নাকি একটু হাভাতে কিসিমের। তার যেমন খাওয়ার লালচ, গজার মাছগুলোকে কেটেকুটে জোনাকির হেঁসেলে চড়িয়ে দিয়েছে হয়তো ওই মানুষটাই। আর গুলি-খাওয়া গতরটা মেলে দিয়ে গোল চাঁদটা কি রান্নার সুবিধা করে দিলো? ফুলজান নিশ্চিত হয়, তার বেটি এখন গজার মাছের মাখা-মাখা-করে-রাধা ঝাল সালুনের সুবাস পাচ্ছে। নইলে শুধু ভাতের গন্ধে এতোক্ষণ হাঁ করে নিশ্বাস নেওয়ার হুঁড়ি তো সে নয়।