কম-কথা-বলা বেটির তার নালিশ করার খাসলত তো একেবারেই নাই। তা হলে?
দেখো, মা মারে। শুনে বেটির নজর অনুসারে ফুলজান তাকায় সামনের দিকে। দিঘির ঠিক ওপারেই হুরমতুল্লার বর্গা করা ধানের জমি। তারপর বেশ কয়েক বিঘা ফাঁকা জমির পর বাঙালি নদীর রোগা স্রোত, দুই বছরে প্রায় কুঁজেই এসেছে। না, সেখানে তো কেউ নাই। তার একটু পশ্চিমে কালাহার বিলের উত্তর সিথান। সেখানে আসমান থেকে ঝোলে গোল চাঁদ। কালাহারের উত্তর সিথানে কোনো বড়ো গাছের বাধা না পেয়ে চাঁদ নেমে এসেছে একটু নিচে।
চাঁদের আজ এ কী হাল হয়েছে গো? পরশু না পূর্ণিমা ছিলো? যঁা, পরশুই তো। কি তার আগের দিন? এই কয়েকদিনে চাঁদের গতর একটু রোগা হয়েছে। তা পরশুও তো চাঁদের ঘন করে আওটানো দুধে সয়লাব হয়ে গিয়েছিলো মুলুকের আমন ধানের জমি। ওই দুধ চুমুক দিয়েই তো আমনের শীষে দুধ জমলো ঘন হয়ে। আর এই দুইদিনে চাঁদের এ কী ব্যারাম হলো গো? তার গায়ের রূপার বন্ন হয়ে গেছে কালচে লাল, গতর থেকে হলদেটে আভা মুছেই গেছে। চাঁদের সবটা গতরে কেমন কালচে লাল কালচে লাল দাগ। হায় আল্লা! চাঁদের এই হাল হলো কী করে গো? হরেন ডাক্তার, না হরেন। ডাক্তার নয়, প্রশান্ত কম্পাউনডার হলে মনে হয় ধরতে পারতো। না কি ওই কম্পাউনডারই শয়তানি করে ফুলজানের বেটার গায়ের ছোঁয়া বাঁচাতে তার বিমারি মুখটাকে ছুঁড়ে দিলো এই কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের দিকে না, তাই বা কী করে হয়? তার বেটার গালে কি এরকম শুকনা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ ছিলো?
তা হলে কি মণ্ডলের ছোটোবিবির ভয়টাই ঠিক? গা ছমছম করলেও ওই ভয়টাই ভর করে ফুলজানের মাথায়। তমিজ যদি সত্যি সত্যি পুলিসের গুলি খায়, তবে সে নিজে বৌকে ছেড়ে অতো ওপরে চড়ে বসে কোন আক্কেলে? তবে মাঝির বেটার দেমাকটা তো বেশি-শ্বশুরবাড়িতে দিনমান কাম করবে, শ্বশুরের জমির লোভ তার মোনলা আনার জায়গায় আঠারো আনা; কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে তার গোয়া কামড়াবে। তাহলে তার থাকার জায়গা আর কোথায়? মাঝিপাড়ায় গিয়ে সে উঠতে পারবে? ওই অপয়া ঘর ভেঙে কালাম মাঝি ওখানে পাকা মসজিদের ভিত দিয়েছে। মাঝিপাড়াতেই আরেকটা মসজিদ করার একটু কথা নাকি উঠেছিলো। তা কুলসুমকে বাঁচাতে গিয়ে কালাম মাঝির ওই যে জখমটা হলো, এরপর সে প্রায় নুলো হয়ে পড়েছে। হাতে ব্যথা নিয়ে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যেতে তার ভারী কষ্ট। তার কষ্ট দেখে মাঝিপাড়ার মানুষ মন খারাপ করে। আর ওই কুফা ঘরটা ভেঙে মসজিদ করলে বরং মাঝিদেরই ভালো হবে। কালাম মাঝি বাড়িটিও পাকা করার আয়োজন করছে। কিন্তু আল্লার ঘর পাকা না করে তার নিজের বাড়িতে সে ইট বসায় কী করে?
কিন্তু তমিজ ওখানে গিয়ে উঠতে তো আর পারে না। তাই কি সে গুলি-খাওয়া মুখে এসে ঢুকে পড়েছে গোলগাল চাঁদের গতরে? তাই কি চাঁদটাকে এমন ভূতুড়ে দেখায়?
তমিজের ভাবনায় ফুলজানের ভয় একটু কাটে। ওই ডাকাবুকো মানুষটা, জেতা হোক মরা হোক, থাকলে বুকে একটু বল পাওয়া যায়।
চাঁদের নিচে বড়ো গাছ একটাও নাই। পাকুড়গাছ তো গেছে অনেকদিন আগেই, আর যেগুলো ছিলো সব পড়ে গেছে, বৈকুণ্ঠ মরলো, ওই ঝড়ের রাতে। এখন সেখানে খালি ঝোপ আর ছোটো ছোটো গাছড়া। উত্তর সিথান জুড়ে আর দেখা যায় আলো। মানুষ কয়, সন্ধ্যার পর পাকুড়তলায় এখন খালি আগুন জ্বলে। তবে এখন তো ফুলজানের ভয় খানিকটা কেটেছে, আলোর দিকে কিছুক্ষণ দেখেই বুঝতে পারে আসলে ওই ঝোপে আর গাছড়াগুলোতে জ্বলছে ঝক ঝক জোনাই পোকা। ঝোপের ওপরে, ছেড়ে-যাওয়া ইটখোলার পড়ে-থাকা নষ্ট ইটের সারিতে জোনাকি একবার জ্বলে, ফের নেভে। তারা নিভলে ফের জ্বলে ওঠে একটু নিচেকার জোনাকির ঝাঁক। ওপরের জোনাকি ফের আরো ওপরে উড়ে জুলে ওঠে দ্বিগুণ তেজে। মনে হয় এতো বড়ো জায়গা জুড়ে সমস্ত ঝোপঝাড় তারা নিজেদের আগুনের ডানায় ডানায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে অনেক ওপরে।
এখন ফুলজানের মনে হয় এখানে না থাকাই ভালো। কৃষ্ণপক্ষের এই রাত্রে মেয়েকে সামনে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোষের দিঘির অনেক উঁচু পাড়ে, আরো অনেক অনেক উঁচু একঠেঙে তালগাছের নিচে উইঢিবির সামনে। এখান থেকে উত্তরে, একটু উত্তর পশ্চিমে এসব কী দেখা যায়! একবার মনে হয় এসব তার চেনা, আবার গা শিরশির করে : আসলে কি সে কিছু ধরতে পারে-ও বাপজান বলে বুক ফাটিয়ে ডাকতে গেলে ফুলজান টের পায় তার সব আওয়াজ আটকে গেছে তার ঘ্যাগের মধ্যে, গলা পর্যন্ত স্বর আর আসে না। এখন তার বেটির কান্নাও থেমে গেছে, এখন ফেঁপানোটা শুধু সামলাতে পাচ্ছে না। নিয়মিত বিরতি দিয়ে তার ফোঁপানির আওয়াজেই ফুলজান এখনো দাঁড়িয়ে থাকার বল পাচ্ছে। বেটির ফোঁপানির শেষদিকের টানে ফুলজানের মনে পড়ে, তার বাপই একদিন বলেছিলো, বড়ো বড়ো গাছ সব না থাকায় ডালহারা, পাতাহারা, গাছহারা এবং বড় গাছের আন্ধার কোণাঘুপচিহারা সব জোনাকি এখন ছড়িয়ে পড়েছে ঘাসের ওপর, ঝোপেঝাড়ে আর ছোটো গাছড়ার নরম সরম ডালে।।
কিন্তু ফুঁপিয়ে সব কান্না বার করে দিয়ে বেটি তার চুপ হয়ে গেলে সব একেবারে। সুমসাম হয়ে যায়। ফুলজানের মনে হয়, বেটিও তার চুপ, এই সুযোগে জোনাকির ঝকের আলো অতোদূর থেকে তার নাড়ি টিপেটিপে তার ভয়ডর সন্দেহ সব ঠিক সনাক্ত করে ফেলছে। তার ডান হাতের কবজিতে সুড়সড়ি লাগে। . ফুলজানের বেটি হঠাৎ করে বলে, হেঁসেল জুলে। শুকনা অশ্রুর নুনের খারে তার। গলা রুখা শোনায়, মা, হেঁসেল জ্বলিচ্ছে।