ফুলজান তাই মাথা থেকে ঝামটা দিয়ে সরিয়ে দেয় মেয়ের ছোটো ছোটো হাত দুটো। তাতে ঝামেলা বরং বাড়ে। বেটি তার সোজা হাঁটা দেয় দিঘির ঢালের দিকে। মোষের দিঘির উঁচুপাড়ে লম্বা তালগাছের নিচে পুরনো উইঢিবিতে ওঠার ঝোঁকটা তার একটু বেশি। উইটিবির সামনে হাত তিনেক জায়গা, হুরমতুল্লা মাঝে মাঝে মগরেবের নামাজ পড়ে ওখানে। নিচেই খাড়া পাড়, সেখান থেকে পা হড়কে গেলে গড়িয়ে পড়বে পুকুরের পানিতে। তখন? ফুলজান তাই নিড়ানি বন্ধ রেখে বেটিকে ধরতে ছোটে দিঘির ঢালের ওপর দিয়ে।
৫৯. জখম চাঁদের নিচে
হুরমতুল্লার মতিগতি ফুলজানের ভালো ঠেকে না। ভাগের ধান অনেকটা সে আছে বেচার তালে। মনে হয় মণ্ডলের গোলাতে সব ধান তুলে দিয়ে নগদানগদি টাকা নিয়ে বুড়া সোজা হাঁটা ধরবে সোনামুখির দিকে। নবিতনের শ্বশুরের হাতে দোকান সাজাবার টাকা মিটিয়ে দিয়ে পোড়াদহ মেলার সময় পেয়ারের বেটিকে নাইওর নিয়ে আসার অনুমতিটা আদায় করবে। ছোটো বোন ফালানিটা সেই কবে গেছে নবিতনের শ্বশুরবাড়ি, তাকে বাড়ি আনার ব্যাপারে বুড়া কিন্তু চুপচাপ। সেখানে নাকি সে মহা সুখে থাকে। তা তাদের এতো পয়সা, বৌয়ের বোনকেও রাখে দুধেভাতে, আর বৌয়ের বাপের কাছ থেকে বেটার দোকান সাজাবার খরচ রেয়াদ করে না। ইজ্জতের দামাদের দোকান সাজাবার ব্যবস্থা করলে কয়েকটা মাস যে গুষ্টিশুদ্ধ তাদের কাউনের চালের ভাত খেতে হবে, এমন কি মাসখানেক আধপেটা কাটাতে হবে সেদিকে হুরমতুল্লার কি কোনো খেয়াল আছে?
তা বাপ চাইলো আর ফুলজান তাই হতে দিলো? আজ তো তার জমিতে আসার কথাই ছিলো না। কিন্তু সারাটা দিন বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে হুরমতুল্লা মেলা আসিচ্ছে, বেটিটাক ঘরত আনবার পারমু না বলে বিলাপ করতে থাকলে ফুলজানের আর সহ্য হয় না। তাই এখন সে জমিতে এসেছে খন্দের পরিমাণ আন্দাজ করতে। তারপর দেখা যাবে বুড়া চুপচাপ ধান বেচে কী করে?
সন্ধ্যার ঠিক আগে ফুলজান এসে দেখে, মোষের দিঘির উঁচুপাড়ে তালগাছতলায়। উইটিবিটা পেছনে রেখে নামাজ পড়ছে হুরমতুল্লা। সেজদা দিয়ে অনেকক্ষণ সে মাথা না তুললে ফুলজানের বুক ঢিপঢিপ করে : বাপজান তার বেহুঁশ হয়ে গেলো না তো? আজ দুপুর থেকে তো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েই ছিলো, পেয়ারের বেটির জন্যে বিলাপ করার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার পেচ্ছাব করতে ওঠা ছাড়া আসরের ওকত পর্যন্ত তো সে শুয়েই কাটিয়েছে। বাপজানের আবার এদিক ওদিক কিছু হলো না তো?-কিন্তু সেজদা থেকে। উঠে হুরমতুল্লা ফের সেজদা দিলে বাপের শারীরিক সুস্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলে ফুলজানের গা জ্বলে : বুড়ার আবার নামাজ বন্দেগি কিসের? সেজদায় উপুড় হয়ে কি দোয়া পড়ে, না নবিতনের শ্বশুরের জন্যে টাকা জোগাড়ের ফন্দি আঁটে?
মোষের দিঘির উঁচুপাড়ে তালতলায় নামাজ পড়ে হুরমতুল্লা, আর জমির ধারে ধারে ঘোরে ফুলজান। পিছে পিছে হাঁটে তার বেটি। চারদিকে ধানজমি, পাকা আধপাকা আমনের খেত। প্রায় সব জমির ধানে পুরুষ্ট শীষ। দেখে দেখে চোখ ভরে যায়। তবে তাদের জমিতে খন্দের পরিমাণ আন্দাজ করতে হবে হুরমতুল্লার সঙ্গে, তার মুখ দিয়ে ধানের পরিমাণ কতো হতে পারে তা স্পষ্ট শুনে নিতে হবে। তবেই না বুড়া এদিক ওদিক করতে ভয় পাবে।
মেয়েকে কোলে তুলে আলের ওপর দিয়ে হেঁটে মোষের দিঘির ধারে গিয়ে দেখে, দিঘির পাড়ের ওপর হুরমতুল্লা নাই। নামাজ পড়ে সে এর মধ্যেই কোথায় গেলো? তার পাঁচুন পড়ে আছে দিঘির ঢালে পুবের জমির পাশে। তা হলে? বাপজান বোধহয় জিরাতে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে।
জমির পাশে বসে জিরাতে ইচ্ছা করে ফুলজানেরও। শরীরটা বড়ো অস্থির লাগে। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। গায়ে এন্ডির চাদরটা জড়ালে গরম লাগে, আবার খুলে ফেললে ২ শীত শীত করে।
এর ওপর তার বেটির উৎপাত। মায়ের মাথায় ছোটো হাতের চাপ দিয়ে ভাত খাওয়ার লালচ জানাতে শুরু করেছে বেলা ড়ুতেই। চোখ গরম করে ফুলজান তার দিকে তাকালে সে বলে, ভাত খামো।
দুপুরে আজ ফুলজান কচুর শাক তুলেছে মেলা, কচুর শাকের ভেতর কাউন দিয়ে ঘাটি করেছে একটা। দুপুরে খেয়েছে, রাতের জন্যেও আছে। তা দুপুরে অনেকদিন পর কচুর শাকের নরম ঘাঁটি পেয়ে সবাই অনেক খেয়েছে, এত তাড়াতাড়ি তো খিদে পাওয়ার কথা নয়। বেটির ওপর ফুলজানের রাগ হয়। সে আর একবার ভাত খামো বলতেই ফুলজান তার পাছায় দুটো ও দুই গালে গোটা তিনেক চড় মারে। আরো চড় মারতে তার হাত উঠেছিলো, কিন্তু মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছোটে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ের দিকে। এই বুঝি তালতলায় উইঢিবির দিকে চললো। ওখান থেকে হুঁড়িটা বুঝি পড়েই গেলো পুকুরের পানিতে। ফুলজানও ছুটলো চড়াই ভেঙে। বেটির তার কয়দিন হলো ঝোঁক হয়েছে ওই উইটিবির ওপর চড়ার। তাই কি কেউ পারে? ওর ওপর উঠতে গেলেই পা পিছলে পড়ে যাবে সামনের ছোটো জায়গাটায়, সেখান থেকে গড়িয়ে একেবারে দিঘির পানিতে। ফুলজান তাকে ধরে ফেললো ঊইটিবির নিচেই। এই একটুখানি সময় তাকে উৎকণ্ঠায় রাখার জন্যে তার রাগ উস্কে ওঠে এবং রাগটা ঝাড়ে বেটির পিঠে কষে কয়েকটা কিল মেরে। আরো মারার জন্যে হাত ওঠাচ্ছিলো, কিন্তু এবার তার হাত নেমে যায় বেটির নালিশ শুনে। কাঁদতে কাঁদতে নোনতা পানি জড়ানো গলায়, মারে! মারে! বলে সোজা উত্তরপশ্চিমে তাকিয়ে মেয়ে তার নালিশ করে কার কাছে?